কণার মুখ হাসিহাসি।
তাকে দেখে মনে হতে পারে আনন্দময় কোন অভিজ্ঞতার জন্যে সে অপেক্ষা করছে। তার গায়ে ইস্ত্রি করা সুতীর ছাপা শাড়ি। শাদা জমিনে নীল রঙের ফুলের ছাপ। কণাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শরীরে নীল ফুল ফুটে আছে। সত্যি সত্যি ফুটে আছে। কণা মাথায় গন্ধ তেল দিয়ে চুল বেঁধেছে। মাথার গন্ধটাকেই মনে হচ্ছে ফুলের গন্ধ।
নার্স ঘরে ঢুকে কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ঘণ্টা খানিক।
কণা ঠিক আছে বলে আগের মত হাসি হাসি মুখ করে বসে রইল। নার্স বলল, আপনার স্বামী আসেন নি?
জ্বি না।
উনি এলে ভাল হত।
কণা হাসল। সেই হাসি যা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। কণা তার তেইশ বছরের জীবনে এই হাসি অনেকবার ব্যবহার করেছে। হয়ত আরো অসংখ্যবার ব্যবহার করতে হবে। তার এখন আর ভাল লাগে না। হাসিটা সে শুধুমাত্র একজনের জন্যেই ব্যবহার করতে চায়। হাসি হল শরীরেরই একটা অংশ। ঠোঁটের ফাকে ফুলের মত ফুটে ওঠে। শরীর যেমন সবার জন্যে নয়–হাসিও তেমনি সবার জন্য না।
কণা বসে আছে ধানমণ্ডি পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে তার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা হবে। নতুন। একজন মানুষের দায়িত্ব নেয়ার সামৰ্থ তার স্বামীর নেই। অনেক আলাপ আলোচনা করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবার পর কণা হোসেছে খিলখিল করে। কণার স্বামী বিরক্ত মুখে বলেছে, হাস কেন?
কণা বলেছে, হাসতে ভাল লাগে এইজন্যে হাসি। ছোটবেলায় খুব কাঁদিতাম এইজন্যে নাম হয়ে গিয়েছিল কাদুনি। কী দুনি থেকে কানি। কানি থেকে কণা। বুঝলেন সাহেব?
এত কথা বল কেন?
আচ্ছা যাও, কথাও বলব না।
কণা শান্ত মুখে কেরোসিনের চুলা ধরিয়েছে। কৌটায় সামান্য কিছু কফি আছে। স্বামীকে কফি বানিয়ে দিয়ে সে অবাক করে দেবে। চা ভেবে চুমুক দিয়ে দেখবে কফি। সে আঁৎকে উঠবে। মজার একটা ব্যাপার হবে। কণা সারাজীবন চেয়েছে তাকে ঘিরে সারাক্ষণ মজার মজার সব ঘটনা ঘটুক। কিন্তু তার জীবনটা এ রকম যে তাকে ঘিরে মজার কোন ঘটনা কখনো ঘটে না। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে।
তাকে কাপড় খুলে আধাবুড়ো একজন মানুষের সামনে নানান অঙ্গ ভঙ্গি করে বসে থাকতে হয়। আধাবুড়ো মানুষটা তার ছবি আঁকে। তবে মানুষটা ভাল। ঋষির মত মানুষ। মানুষটার চোখে লোভ ঝিলমিল করে না। কখনোই সে কোন অজুহাতে হাত দিয়ে তার নগ্ন শরীর জুয়ে দেয় না। মানুষ এ রকম হয় কিভাবে?
একটা স্বাভাবিক জীবন কণার কেন হল না? আল্লাহ কি জন্মের সময় তার কপালে লিখে দিয়েছেন–এই মেয়েটার কোন স্বাভাবিক জীবন হবে না? সে সরক্ষণ ভয়ংকরের ভেতর থাকবে। তার গর্ভে আসবে সুন্দর সুন্দর শিশু। তাদের একের পর এক ফেলে দিতে হবে। কোনদিন তাদের সে কোলে নিতে পারবে না। তাদের ঠোঁটে চুমু দিতে পারবে না। রাতের বেলা কাধে শুইয়ে সুর করে বলতে পারবে না–
আমার কথাটি ফুরাল
নটে গাছটি মুড়াল।
কেনরে নটে মুড়ালি?
গরুতে কেন খায়?
কেনারে গরু খাস?
রাখাল কেন চরায় না?
কেনরে রাখাল চরাস না?
বৌ কেন ভাত দেয় না?
কোনলো বৌ ভাত দিস না?
কলাগাছ কেন পাতা ফেলে না?
কেনরে কলাগাছ পাতা ফেলিস না?
জল কেন হয় না?
কেনরে জল হস না?
ব্যাঙ কেন ডাকে না?
কেনারে ব্যাঙ ডাকিস না?
সাপ কেন খায়?
কেন রে সাপ খাস?
খাবার ধন খাবুনি,–গুড় গুড়ুতে যাব নি?
কোনকিছু নিয়েই কণা বেশীক্ষণ ভাবতে পারে না। তার ভাল লাগে না, মাথা ধরে যায়। কিন্তু পেটের শিশুগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার ভাবতে ভাল লাগে। শুধু যে তার ভাবতে ভাল লাগে তা না–এদের নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তার কথা বলতেও ভাল লাগে। তার কথা বলার লোক কোথায়? কাজেই সে নিজেই আশে পাশে থেকে লোক খুঁজে নেয়। হয়ত সে রিকশা করে যাচ্ছে–সে ফস করে বলে বসিল, রিকশাওয়ালা ভাই আপনের ছেলেমেয়ে কি? রিকশাওয়ালা চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তার চোখে চাপা সন্দেহ বিকবিক করে। কণার ধারণা তাকে হয়ত খারাপ মেয়ে ভাবে। খারাপ মেয়েরাই রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে দ্রুত ভােব জমাবার জন্যে ব্যক্তিগত গল্প শুরু করে। তখন কণা তার বিশেষ হাসিটা হাসে। এই হাসি বলে দেয়–সে খারাপ মেয়ে না। ভাল মেয়ে। এরকম ভাল মেয়ে সচরাচর পৃথিবীতে আসে না। তবে ভাল মেয়ে হলেও সে খুব দুঃখী মেয়ে। এ রকম দুঃখী মেয়েও সচরাচর পৃথিবীতে আসে না।
কণা উঠে দাঁড়াল। এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে তার পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। একটু হাঁটাহাঁটি করলে বোধহয় ভাল লাগবে। কণা বারান্দায় চলে এল। বারান্দাটা ফাঁকা। টুলের উপর একজন খাকি পোষাক পরা পিয়ন বসে আছে। বেচারা বোধ হয়। কয়েক রাত ঘুমায়নি। আয়েশ করে ঝিমাচ্ছে। তাকে কি কণা জিজ্ঞেস করবে–পিয়ন ভাই, আপনার ছেলেমেয়ে কি? কণা নিশ্চিত এই প্রশ্ন করা মাত্রই পিয়নের চোখ থেকে ঘুম কেটে যাবে। সে লাফ দিয়ে উঠবে।
আচ্ছা, কণা কি পারেনা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পেটের শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে? সে নিজে যদি বেঁচে থাকতে পারে তার শিশুটি থাকবে না কেন? আচ্ছা, সেতো সাজ্জাদ নামের দারুণ বড়লোক ঐ ছেলেটার কাছে চলে যেতে পারে। পারে না? তাকে গিয়ে বলতে পারে–
সাজ্জাদ ভাই আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি কণা।
উনি হাসি মুখে বলবেন, হ্যাঁ চিনতে পারছি। কেমন আছ কণা?
ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভাল আছি।
কণা, তোমাকে কেমন জানি রোগা রোগ লাগছে। তোমার কি কোন অসুখ
উহুঁ। আমি খুব ভাল আছি। আমি আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি।
বল কি কাজ?
আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান। এটা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
এখনো কি চান?
হ্যাঁ, এখনো চাই।
আমি রাজি আছি সাজ্জাদ ভাই।
সত্যি রাজি আছ?
হ্যাঁ সত্যি–তিন সত্যি।
তিন সত্যিটা কি?
মাটির সত্যি, আকশের সত্যি আর পাতালের সত্যি।
তাহলে তুমি চলে এসো।
একটা কিন্তু আছে যে সাজ্জাদ ভাই।
কিন্তুটা কি?
আমার পেটে একটা শিশু আছে। শিশুটিকে আমি বড় করতে চাই।
অবশ্যই বড় করবে।
আমার স্বামীকেও তো ছেড়ে চলে আসতে হবে।
তাতো হবেই, আমাদের বর্তমান সমাজ এক স্বামীর দুটি স্ত্রী সহ্য করে নিলেও, এক স্ত্রীর দুই স্বামী সহ্য করবে না।
কিন্তু ওকে তো আমি প্রচণ্ড রকম ভালবাসি।
তোমার ভালবাসার ক্ষমতা আছে বলেই তুমি ভালবাস। আজ তুমি তোমার স্বামীকে প্রচণ্ড ভালবাসছ–একদিন আমাকেও প্রচণ্ড ভালবাসবে। ভালবাসা নির্ভর করে ভালবাসার ক্ষমতার উপর।
তাও ঠিক।
একটা কথা কি জান কণা, ভালবাসতে হলে ভালবাসার উপকরণ লাগে। ক্ষুধার্ত পেটে ভালবাসা যায় না। আমার কাছে ভালবাসার উপকরণ আছে। আমি তোমাকে নিয়ে কি করব জান?
কি করবেন?
জোছনা রাত্রিতে তোমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাবো শহর থেকে দূরে। আশি, নব্বুই, একশ কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি চলবে। হাওয়ায় উড়বে তোমার চুল।
আমরা কোথায় যাব?
তুমি যেখানে যেতে চাও আমি তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাব।
আমি কখনো সমুদ্র দেখিনি–আপনি আমাকে সমুদ্র দেখাবেন?
অবশ্যই দেখোব। তুমি চাইলে সমুদ্রের কোন এক প্রবাল দ্বীপে তোমার জন্যে ঘর বানিয়ে দেব। তুমি কি চাও?
হ্যাঁ চাই।
শোন কণা, তোমার স্বামীর এত ভালবাসার দরকার নেই। আমার দরকার। আমার প্রচুর ভালবাসা দরকার।
কণা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নার্স এসে বিরক্ত মুখে বলল, আপনি এখানে? আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আসুন ভেতরে আসুন। ডাক্তার এসে গেছেন। ফরম ফিলাপ করেছেন?
কণা শুকনো গলায় বলল, জ্বি।
আসুন তাহলে।
কণা ক্লান্ত গলায় বলল, চলুন।
নার্স বলল, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই।
কণা বলল, আমি ভয় পাই না।