এক বস্ত্রে, কপর্দকশূন্য অবস্থায় প্রায় কারুকে না জানিয়ে যিনি বাংলা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তিনি চার বৎসর পর ফিরে এলেন রাজকীয় মহিমায়। স্বদেশ ছেড়ে তিনি যখন আমেরিকায় যাত্রা করেন, তখন অল্প সংখ্যক মানুষই সে সংবাদ জানত, তার প্রত্যাবর্তনের সময় বিপুল সংবর্ধনার আযোজন করা হয়েছিল সর্বত্র।
ভারত সাম্রাজ্যের ভূমিতে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম পা রাখলেন কলম্বো শহরে। তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য সেখানকাব হিন্দু সমাজ আগেই একটি কমিটি গঠন করেছিল, বহু গণ্যমান্য ব্যাক্তি জাহাজঘাটায় উপস্থিত। জাহাজ থেকে নেমে একটা স্টিম লঞ্চে যাত্রীদের আনা হচ্ছিল, ডেকে গরুয়া পোশাক ও পাগড়ি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ, হাজার হাজার মানুষ তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে! স্বামীজির সঙ্গে এসেছেন সেভিয়ার দম্পতি, তাঁরা এরকম দৃশ্য কখনও দেখেননি।
কলম্বো ছাড়াও সিংহলের অনুরাধাপুর, কাণ্ডি, জাফনা প্রভৃতি নগরে তাঁর বিপুল সংবর্ধনা চলল দিনের পর দিন, তাঁকে বক্তৃতা দিতে হল অনেকগুলি। বন্যার সময় যাঁর বীরবিক্রম দেখে সবাই অভিভূত, যাঁকে মনে হয় সিংহপুরুষ, তিনি কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেশ ক্লান্ত, শরীরও সুস্থ নয়। সকাল থেকে বাত্রি পর্যন্ত জনসমাগম লেগেই আছে, মানুষের শ্রদ্ধাভক্তিও এক সময় অত্যাচারের পর্যায়ে চলে যায়। দিনের পর দিন এরকম চলতে থাকলে স্বামী বিবেকানন্দকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হত, তাই তাঁর অন্তুরঙ্গ সঙ্গীবা একটি ছোট জাহাজ ভাড়া করে সিংহল ছেড়ে রওনা হলেন মূল ভারত ভূখণ্ডেব দিকে।
জাফনা থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল সমুদ্র পথ পেরুলেই ভারতের উপকূল রেখা। সদলবলে স্বামীড়ি এসে পৌঁছলেন পাষান নামে একটি ছোট শহরে।
ইংল্যান্ড বক্তৃতা সভাগুলি দিন দিন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, বেশ কয়েকজন সক্রিয় শিষ্য ও কর্মী পাওয়া গিয়েছিল, তারই মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ এক সময় ঠিক করলেন দেশে ফিরে আসবেন। বিদেশে যতই সাফল্য আসুক, দেশে তাঁব গুরুভাইরা অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় রয়েছেন। শ্ৰীরামকৃষ্ণের নামে তার সংসাব ছেড়েছেন, একটা ভাড়াবাড়িতে একসঙ্গে থেকে জপ-তপ, রান্না রান্না ও আড্ডা গুলতানি চলে, এই কি মুক্তি লাভের উপায়!
বিবেকানন্দ ঠিক করলেন, সবাইকে এক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে এনে একটি সঙ্ঘ বা মিশন স্থাপন কতে হবে। ঝাপিয়ে পড়তে হবে সেবামূলক কাজে। এতকাল হিন্দু ধর্ম শিখিয়েছে শুধু ব্যক্তিমানুষের মুক্তির কথা, জ্ঞান মার্গ, ভক্তি মার্গ দিয়ে তুমি মোক্ষ লাভ করো। কিন্তু যুগের পরিবর্তন হয়েছে। এখন চিন্তা কবতে হবে মানুষের মুক্তির কথা। চতুর্দিকে এত অভাব, এত দাবিদ্র্য, এত বঞ্চনা, এসব থেকে চোখ ফিরিয়ে তুমি যদি নির্জনে একা একা তপস্যা করো, তা তো স্বার্থপরতারই নামাওল। অন্য সব ধর্মে সঙঘবদ্ধভাবে মানবসেবার উদ্যোগ থাকে, হিন্দু ধর্মে সঙ্ঘবদ্ধ হবাব কোনও ধারণাই নেই, তাই তো এ ধর্মের এত অবনতি।
একবার দেশে ফেরার কথা মনে হতেই বিবেকানন্দ ছটফট করছিলেন, আর দেরি করতে চাননি। একজন ইংরেজ শুভার্থী বলেছিলেন, আপনি চার বছর পাশ্চাত্য দেশে রইলেন, এখানকার বাতাস নির্মল, জল জীবাণুশুন্য, খাদ্যদ্রব্য অনেক ভাল, আপনি এইসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এখন হঠাৎ ভাবতে গিয়ে কি টিকতে পারবেন? সেখানে সব কিছুই অস্বাস্থ্যকর, নোংরা, ধুলো, কাদা পাচপেচে। বিবেকানন্দ তাঁকে সহাসো উত্তর দিয়েছিলেন, দ্যাখো ভাই, দেশ ছেড়ে আসার আগে আমি ভাবতকে শুধু ভালবাসতাম। এখন ভারতের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত আমার পবিত্র মনে হয়, সেখানকার বাতাস পবিত্র, ভারত আমার পূণ্যভূমি, সারা ভারতই আমার তীর্থক্ষেত্র!
পাম্বানে নেমে বিবেকানন্দ সেখানকার খানিকটা ধুলো নিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন।
এখানেও নিরিবিলিতে থাকা গেল না, রামনাদের রাজা স্বয়ং সেখানে পাত্রমিত্রদের নিয়ে বিবেকানন্দকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য উপস্থিত। রাজশকটে তাঁকে বসিয়ে অন্যরা পদব্রজে অনুসরণ করতে লাগলেন, কিছুদূর যাবার পর রাজার মনে হল এতেও যেন এই সন্ন্যাসীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না, ঘোড়াগুলো খুলে দিয়ে তিনি স্বয়ং গাড়িটা টানতে গেলেন, আরও বহু লোক এসে তাতে হাত লাগাল। সহস্র কণ্ঠের জয়ধ্বনিতে বিমথিত হল বাতাস। এত বাড়াবাড়ি বিবেকানন্দর ঠিক সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিবাদ জানাবারও উপায় নেই।
রামেশ্বর শিবের মন্দিরে প্রবেশ করে তাঁর মনে পড়ল পুরনো দিনের কথা। আমেরিকা যাবার আগে যখন তিনি পরিব্রাজক ছিলেন, তখনও একবার এই মন্দিরে এসেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন দণ্ডকমণ্ডলুধারী এক পথশ্রান্ত সন্ন্যাসী, কেউ এখানে তাঁকে চিনত না। আর আজ শুধু তাঁকে একটু চোখে দেখার জন্য বহু লোক ঠেলাঠেলি করছে।
মন্দির প্রাঙ্গণে তাঁকে একটি বক্তৃতা দিতে হল। কোনও হিন্দু সন্ন্যাসী সচরাচর যে কথা বলেন না, বিবেকানন্দ উচ্চারণ করলেন সেই সার সত্য। মূর্তিপূজা প্রকৃত পূজা নয়। দরিদ্র, দুর্বল, রোগী-এই সকলের মধ্যেই যিনি শিব দর্শন করেন, তিনিই যথার্থ শিবের উপাসনা করেন। শিবের সন্তানদের সেবাই শিবের সেবা। যে ব্যক্তি শুধু প্রতিমার মধ্যে শিবোপাসনা করে, সে প্রবর্তক মাত্র।
এর পর মাদুরা, ত্রিচিনাপলী, কুম্ভকোণম, মাদ্রাঞ্জ প্রভৃতি শহরেও সংবর্ধনার উত্তরে বিবেকানন্দ প্রায় এই রকম কথাই বলতে লাগলেন। আমাদের এই মাতৃভূমি বহুকাল পরে গভীর নিদ্রা পরিত্যাগ করে জেগে উঠছে। অন্ধ যে, সে দেখতে পাচ্ছে না। বিকৃত মস্তিষ্ক যে, সে বুঝতে পারছে না।…সব ধর্মই সত্য। পৃথিবীর লোককে আমাদের কাছ থেকে এই পরধর্মসহিষ্ণুতা শিখতে হবে।
মাদ্রাজে বিবেকানন্দের আগমন উপলক্ষে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। সভার পর সৃভা, বক্তৃতার পর বক্তৃতা, অসংখ্য দর্শনপ্রার্থী। ভারতের জল ও বায়ু যতই তাঁর কাছে পবিত্র মনে হোক, অনেক দিন অনভ্যাসের পর এখানকার বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তাঁর সর্দিকাশি হল, জল পান করে পেটের গণ্ডগোল। শরীর বেশ কাবু হয়ে পড়েছে, তবু সে কথা তিনি কারুকে জানাতে চান না। বক্তৃতাতেও তিনি ক্রমশই ধর্মের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বলছেন। মাদ্রাজের শেষ বক্তৃতায় বললেন, এখন পুজো-টুজো সব বন্ধ থাক। আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের গরীয়সী ভারত মাতাই আমাদের আরাধ্য হোন, অন্যান্য অকেজো দেবতাদের এই কটা বছর ভুলে থাকলে ক্ষতি নেই। সেইসব দেবতারা এখন ঘুমোচ্ছ, দেশের মানুষই জাগ্রত দেবতা। সবাই যোগী হতে চায়, সবাই ধ্যান করতে চায়, এ কি তামাসা নাকি?
মাদ্রাজ থেকে আবার জাহাজে চাপলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। জাহাজের ডেক ভর্তি ডাব, ডাবে ডাবে একেবারে ছয়লাপ। শ্রীমতী সেভিয়ার ডেকে এসে সমুদ্র দর্শনের জন্য দাঁড়াবারই জায়গা পেলেন না। তিনি ভাবলেন, এটা কি মালের জাহাজ নাকি? আসলে তা নয়, ডাক্তার বিবেকানন্দকে জলের বদলে ডাব খেতে বলেছেন, সে কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ভক্তরা সবাই ডাব দিয়ে গেছে। বিবেকানন্দর অবস্থা বেশ কাহিল, তিনি শুয়ে শুয়ে কাটালেন কয়েকটা দিন।
চারদিন পর জাহাজ এসে ভিড়ল খিদিরপুরে। কলকাতাতেও দ্বারভাঙ্গার মহারাজের নেতৃত্বে অভ্যর্থনা কমিটি তৈরি হয়ে গেছে, পরদিন খিদিরপুর থেকে একটি স্পেশাল ট্রেনে স্বামীজিকে নিয়ে আসা হল শিয়ালদা স্টেশনে।
কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দ নামে কেউ ছিলেন না। বরানগরের মঠ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবিদিষানন্দ, তিনিই স্বামী বিবেকানন্দ রূপে ফিরে এলেন। শিয়ালদা স্টেশনে তাঁর পায়ের ধুলো নেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। বিপুল জনতার মধ্যে সকলেই যে তাঁর ভক্ত তা নয়, বেশ কিছু রয়েছে নিছক কৌতূহলী দর্শক। কেউ কেউ অনাদের আবেগ ও ভক্তির প্রাবল্য দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, এই তো দেশের অবস্থা। যেহেতু সাহেবরা এই সন্ন্যাসীটিকে কল্কে দিয়েছে, দুচারটে সাহেব মেম ওকে নিয়ে নাচানাচি করেছে, তাই দেশের লোক ওকে এখন মাথায় নিয়ে নাচছে। আগে তো বাবা ওর কথা কিছু শুনিনি। সাহেবরা প্রশংসা করলেই বুঝি গুণপনা বোঝা যায়! কেউ, কেউ বলল, শুনেছি তো এ লোকটা সিমলে পাড়ার এক কায়স্থ বাড়ির ছেলে। অব্রাহ্মণরাও গায়ে গেরুয়া চড়াচ্ছে, হায় রে, কালে কালে দেখব কত। কেউ বলল, সস্নোসী হয়ে কালাপানি পাড়ি দিয়েছে, কেরেস্তানদের সঙ্গে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়েছে, যা, তাকে সন্ন্যাসী বলে মানতে হবে।
এই সব অবিশ্বাসীদের তুলনায় ভক্ত ও উদাসপ্রবণদের সংখ্যা অবশ্যই বহুগুণ বেশি। এখানেও বিবেকানন্দ গাড়িতে ওঠার পর ছাত্ররা ঘোড় খুলে দিয়ে নিজেরাই টানতে লাগল, গাড়ির সামনে ব্যাণ্ড পার্টি, পেছনে সংকীর্তনের দল। পথের মাঝে মাঝে তোরণ ফুলের মালায় সাজানো। শোভাযাত্রাটি এসে থামল অদূরেই রিপন কলেজের সামনে। স্বামী বিবেকানন্দ খুবই ক্লান্ত, পরে তাঁর প্রকাশ্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা হয়েছে, এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর সদলবলে তিনি চলে এলেন বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়িতে। সেখানে মধ্যাহ্নভোজ। সঙ্গের সাহেব মেম ভক্তদের উত্তম থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা দরকার তাই বরানগরে গোপাললাল শীলের সুরমা বাগানবাড়িটি ঠিক করে রাখা আছে। বিবেকানন্দ নিজে অবশ্য সেখানে রাত্রিবাস করবেন না, তিনি চলে গেলেন আলমবাজারের মঠে শুরুভাইদের সান্নিধ্যে।
চার বছর বাদে আবার বন্ধু সম্মিলন। অভাব কৃচ্ছ্রতার মধ্যেও আমোদ আহ্লাদে এই বন্ধুদের সঙ্গে অনেক দিন কাটিয়েছেন বিবেকানন্দ। প্রায় সকলের সঙ্গে তুই-তুকারির সম্পর্ক। কিন্তু মাঝখানের এই কয়েক বৎসরে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, বিবেকানন্দর বিশ্বখ্যাতি যেন অনেকখানি দূরত্ব এনে দিয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধে বিবেকানন্দর সাফল্যে অনেকে যেমন গর্বিত, তেমনি কেউ কেউ ক্ষুব্ধও বটে। ক্ষোভের কারণ এই যে বিদেশে শত শত বক্তৃতায় এবং শ্বেতাঙ্গ শিষ্য-শিষ্যা সংগ্রহ করে বিবেকানন্দ যেন ব্যক্তিগত কৃতিত্ব অর্জন করেছেন বেশি, গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের নাম তো তেমনভাবে প্রচার করেননি। হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধার কিংবা বেদান্তের টানে এরা ঘর ছাড়েননি, এরা সংসার ত্যাগ করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য, তাঁর ভালবাসার প্রবল টানে। শিকাগোর বিশ্বধর্মসম্মেলনের অত লোকের সামনে শ্রীরামকৃষ্ণের মাহারে কথা নরেনের বলা উচিত ছিল না? সেখানে সে একবারও উচ্চারণ করেনি গুরুর নাম!
সকলকে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিবেকানন্দ বললেন, কী রে, তোরা সব চুপ করে আছিস কেন? ভাবছিস কি, আমি বদলে গেছি? বিলেত-ফেরতা হাফ-সাহেব হয়ে গাট-ম্যাট করে কথা বলি? ওরে, আমি তো সেই তোদরই একজন।
লাটু মহারাজের কাঁধে হাত দিয়ে তিনি আবার বললেন, কী রে, লেটো, বেগুনভাজার মতন মুখ করে আছিস কেন? এর মধ্যে আরও মুটিয়েছিস!
লাটু মহারাজ বিবেকানন্দর গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, লরেন, তুই ঠিক-ঠাক এক রকমই আছিস? আমি শুনেছি কি, তুই বিলায়েত আম্রিকা ঘুমকে ঘুমকে বহোৎ লেকচার ফাটিয়েছিস, বহোৎ লেকচার। আমি সবাইকে বলেছি, ও ছাড়া কে এমুন পারবে? ঠাকুরই তো বলকে গিয়েছেন, লরেন শিক্ষে দিবে!
বিবেকানন্দ বললেন, লেটো, তুই আমার বুকটা ঠুলি, আমার বুকটা যেন জুড়িয়ে গেল। হ্যাঁ রে, তামাক খাওয়াবি না? কতদিন হুঁকো খাইনি। সিগারেট-চুরুটে কি নেশা শানায়!
একজন কল্কে ধরিয়ে নিয়ে এল, বিবেকানন্দ মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে, দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে হুঁকো টানতে টানতে বললেন, আঃ, কী আবাম হল! রাজা-মহারাজারা যতই খাতিরযত্ন করুক, আপনজনের মধ্যে বসে থাকার মতন সুখ আর হয় না।
তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসলেন গুরুভাইরা। শিবানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে নরেন, আমেরিকায় নাকি অনেকগুলি বেদান্ত সেন্টার স্থাপিত হয়েছে?
বিবেকানন্দ হাত তুলে বললেন, ওসব কথা পরে হবে। আজ আয় নিজেদের গল্প করি শুধু। তারক তই যে এক সময় শেয়াল-ককরকে রোজ রুটি খাওয়াতিস, সেই অভ্যেসটা এখনও আছে? সেই যে বরানগরের মঠে তুই জানলায় দাঁড়িয়ে ভোঁদা ভোঁদা বলে ডাকতি, আর একটা শেয়ালছানা এসে ঘোঁ ঘোঁ করে আওয়াজ করত। বিবেকানন্দ শিয়ালের ডাক এমন নকল করে দেখালেন যে সবাই হেসে উঠলেন। বাবুরাম বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমার এসব মনে আছে?
বিবেকানন্দ বললেন, মনে থাকবে না কেন রে শালা। আমি কি মরে ভূত হয়েছি? তোর সেই কথাটাও মনে আছে। সেই যে একবার, ওরে রাখাল, তোর মনে আছে, একবার মঠে কালীপুজোর সময় পাঠাবলি হল? আমরা ক’জনা পাঁঠাবলি চেয়েছিলাম, তোর আর বাবুরামের আপত্তি ছিল খুব।
শেষ অবধি আমাদের মতটাই টিকল। বলি যখন হচ্ছে, পাঁঠার ব্যাঁ ব্যাঁ ডাক যাতে শোনা না যায়, সেইজন্য এই বাবুরামটা চট করে ঠাকুরঘর থেকে একটা খোল এনে সেটা বাজিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেছিল। ওদেশে গিয়েও দৃশ্যটা যতবার আমার মনে পড়েছে, অমনি একা একা হেসেছি। শালার বৈরিগির মতন বিটকেলমি, খোল বাজিয়ে বলি করা!
বাবুরাম হাসতে হাসতে বললেন, সুরেশবাবুর ভয়ে আর আমি খোল বাজাই না। বিবেকানন্দ কৌতূহলী হয়ে বললেন, কেন, কেন, সুরেশবাবুকে ভয় পাবার কী আছে?
বাবুরাম বললেন, সুরেশবাবু বোষ্টমদের ওপর বড় খাপ্পা! একদিন বলরামবাবুকে কী ভয়টাই না দেখালেন! আমারও পিলে চমকে গিয়েছিল। বিবেকানন্দ ধমক দিয়ে বললেন, আমোলো সবটা খুলে বল না!
বাবুরাম বললেন, বলরামবাবু নিরীহ মানুষ, পরম বৈষ্ণব। ঠাকুরের ভক্ত হয়েও বৈষ্ণব ভাব ছাড়েননি। আর সুরেশ মিত্তির ঘোর শাক্ত। একদিন বলে কী, বলরাম শালা বোষ্টম! তোর রাধাকেষ্ট একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে পী পী আওয়াজ কচ্ছে; সাত জন্মের শুকনো উপোসী, চি ঠি কচ্ছে আর একটা বাঁশিতে ফু পাড়ছে! আর আমার মা কেমন জানিস? লাক চড়াচড় আওয়াজ কচ্ছে, শালা তোর একটা বোষ্টমকে ধরছে আর আমার মার খাড়া দিয়ে বলি হয়ে যাচ্ছে!
বিবেকানন্দ প্রাণ খুলে হাসলেন। বারবার বলতে লাগলেন, কী বললেন, মা লাক চড়াচড় আওয়াজ কচ্ছে, সেটা কী রে? ঢাকের বাজনা?
স্মৃতি রোমন্থনে আর গল্পে গল্পে রাত ভোর হয়ে গেল। কয়েকদিন পর শোভাবাজারে রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রাসাদের সামনের প্রাঙ্গণে এক জনসভায় স্বামী বিবেকানন্দকে সংবর্ধনা জানানো হল। প্রায় পাঁচ হাজার লোক সেখানে সমবেত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে শহরের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। কলকাতা ত্যাগের আগে তাঁকে কেউ বক্তৃতা দিতে দেখেনি। তিনি নম্র, বিনীত স্বরে বললেন, আমি এখানে আপনাদের সামনে সন্ন্যাসী হিসেবে আসিনি, ধর্মপ্রচারক হিসেবেও আসিনি, আগের মতন আপনারা আমাকে এই কলকাতারই একটি ছেলে বলে গণ্য করবেন। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বগাদপি গরীয়সী কোনও মানুষ কি কখনও এ কথা ভুলতে পার?
সভাসমিতি ইত্যাদি থিতিয়ে যাবার পর বিবেকানন্দ কাজে মন দিলেন। দিনের বেলা শীলদের বাগানবাড়িতে কিংবা বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে চিঠিপত্র লেখা ও ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় কাটান, রাত্তিরবেলা ফিরে যান আলমবাজারের মঠে। মিশন স্থাপনের প্রস্তুতিও চলছে।
দেশে ফিরে এসে তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, যে-ভারত তিনি দেখে গিয়েছিলেন সে ভারত এখন আরও বেশি দুর্দশাগ্রস্তু। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ, প্রতিদিন বহু সহস্র লোকের প্রাণ যাচ্ছে। চতুর্দিকে হাহাকার। এত বড় দুর্ভিক্ষ আগে কখনও আসেনি। এর ওপর আবার পশ্চিম ভারতে ছড়িয়েছে সর্বনাশা প্লেগ, যে-কোনও সময় সেই কালরোগ সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দেশের যখন এই অবস্থা, তখন ধর্মের কথা কে শুনবে? কোটি কোটি অভুক্ত মানুষের কাছে বেদান্তের ব্যাখ্যা শোনাতে গেলে তা পরিহাস বলে মনে হবে না? শ্রীরামকৃষ্ণও বলে গেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। কাজ শুরু করতে হবে, তার আগে ভান্স করে সংগঠিত হওয়া দরকার।
একদিন গিরিশ ঘোষ এলেন দেখা করতে। বয়েসের অনেক তফাত হলেও দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বলরাম বোসের বাড়িতে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিরিশবাবু কৌতুক করে গান ধরলেন :
আমারে
ভুলে রে প্রাণ, ভাল তো ছিলে?
কী জন্য আর দেখি নে হে,
পথ ভুলে কি এলে?
শুনছি লোকে, প্রাণ, করে ভান
ঢুকলে গো কার অন্দরে…
বিবেকানন্দ দ্রুত উঠে গিয়ে বন্ধুকে আলিঙ্গনে জড়ালেন।
একটুক্ষণ কুশল বিনিময় হল। বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, জি সি, তুমি এখন কোন থিয়েটারে আছ? তুমি তো ঘন ঘন ঠাঁই বদলাও।
গিরিশচন্দ্র বললেন, যে আমায় ধরে রাখতে পারে তার কাছেই থাকি। এখন আবার ফিরে এসেছি স্টার থিয়েটারে। সে থাক। সাহেবদের দেশে তোমার খুব সুনাম রটেছে, কিন্তু আমি বাপু তোমাকে বিবেকানন্দ-টিবেকানন্দ বলতে পারব না, নরেন বলেই ডাকব।
বিবেকানন্দ বললেন, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ, তোমার যেমন মর্জি। নতুন কী পালা লিখলে বলল। ‘বিশ্বমঙ্গল’ পালাটা এখন কোথাও হয়? আহা, অনবদ্য, বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।
গিরিশচন্দ্র বললেন, সে সব হবে অখন। কিন্তু নরেন, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার? মাত্র চৌতিরিশ বছর বয়েস, এক মধ্যেই চুলে পাক ধরেছে? চোখের নীচে কালি! কী দিব্যকান্তি দেখেছি তোমাকে!
বিবেকানন্দ বললেন, ভাই, সবাই বলে, বিদেশে আমার খুব নাম-যশ রটেছে। কিন্তু সেখানে খাটতে খাটতে যে আমার মুখে রক্ত উঠে গেছে, তা কেউ জানে না।
গিরিশচন্দ্র বললেন, তাই তো দেখছি।
বিবেকানন্দ বললেন, তুমি তো দিব্যি নাদুস-নুদুস আছ। তুমি শালা স্টেজে মাগি নাচাও আর দু’খানা গান জুড়ে দিয়ে পয়সা লোটো! সন্ধের সময় এখনও ক’ পাত্তর চলে?
তারপর ভৃত্যের উদ্দেশে হাঁক দিয়ে বললেন, ওরে, তামাক দিয়ে যা?
গিরিশবাবু বললেন, এখনও তামাক চালাচ্ছ? ভাষাও বদলায়নি দেখছি। ও দেশেও এমন করতে নাকি?
বিবেকানন্দ সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, মানুষের স্বভাব কি বদলায়? আমার কী জান ব্রাদার, বেশিক্ষণ গুরুগম্ভীব মুখ করে থাকতে পারি না, মাঝে মাঝে ফষ্টিনষ্টি না করলে ভাল লাগে না ওদেশের লোকেরা ভাবে, যে-যত ধর্মপরায়ণ হবে, তার চালচলন তত গম্ভীর হবে। পাদ্রিরা সব উৎকট মুখ করে থাকে। আমি বক্তৃতা দিতাম এক রকম, তারপরে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যখন হাসি-ঠাট্টা করতাম, তা দেখে অনেকে অবাক হয়ে যেত। কেউ কেউ মুখের ওপর বলেও ফেলত, আপনার এমন চপলতা শোভা পায় না। তার উত্তরে আমি বলতাম, ‘আমরা আনন্দের সন্তান, বিরস মুখে থাকব কেন?’
গিরিশচন্দ্র বললেন, নরেন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? এ প্রশ্নটা অনেকের মনেই এসেছে, তোমার সামনে কেউ সই করে বলছে না। সেদিন তুমি রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়ির সভায় গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শতকণ্ঠে বললে। এমন কথাও বললে যে যদি কায়মনোবাক্যে আমি কোনও সৎ কাজ করে থাকি, যদি আমার মুখ দিয়ে এমন কোনও কথা বেরিয়ে থাকে যাতে জগতের কোনও ব্যক্তি কিছুমাত্র উপকৃত হয়েছে, তাতে আমার কোনও গৌরব নেই, তা তাঁরই। এ কথা শুনে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। কিন্তু তুমি আমেরিকা-ইংল্যান্ডে এমন কথা বলোনি কেন? এইসব দেশে যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের কথা কেন প্রচার করে এলে না?
বিবেকানন্দ একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এই প্রশ্ন অনেকের মনে তোলপাড় করেছে। তারা ওদেশের পরিবেশটা জানে না, এদেশের মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা কোন স্তরের সে সম্পর্কে ধারণা নেই। গুরুদেবের কথা যে কোথাও বলিনি তা নয়। বলেছি, ঘনিষ্ঠদের কাছে বলেছি। যারা দীক্ষা নিয়েছে, তারা ঠাকুরের নামেই দীক্ষিত হয়েছে। প্রথম থেকেই প্রকাশ্যে কেন বলিনি জানো? শুধু ধর্মের কথা বলে ওদের মনোযোগ টানা যায় না। প্রথম থেকেই নতুন অবতারবাদের কথা তুললে ওরা বলবে, ওঃ, আবার অবতার? আমাদের যিশুই তো এক অবতার, আরও নতুন অবতারের দরকার কী? ওরা দর্শন ও বিজ্ঞানের বড়াই করে। ভক্তির বদলে এখন যুক্তিবাদের যুগ এসেছে। সুতরাং যুক্তি দিয়ে দর্শন-বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ এনেই ওদের মন জয় করতেহবে। শুধু গুরু গুরু করে নাচলে ওরা মানবে কেন? আমাদের অধ্যাত্ম দর্শনের যে বিশাল ভাণ্ডার আছে, সে কথা তো ওদের দেশের প্রায় কেউই জানে না।
গিরিশচন্দ্র বললেন, তোমার কাছ থেকে এসব জ্ঞানের কথা শোনার জন্য ওদের কী দায় পড়েছিল? ওরা বড়লোক, বিলাস ব্যসনে মেতে আছে, আমাদের মতন গরিব-বোরা কী ভাবে না ভাবে, তাতে ওদের কী আসে যায়?
বিবেকানন্দ বললেন, ভাই জি সি, ওদেশে গিয়ে বুঝেছি, যারা খুব ধনী, তাদেরও খুব অভাব থাকে। যাদের আহার-বিহারের কোনও অভাব নেই, তারাও মানসিক দিক থেকে বুভুক্ষু। জাগতিকভাবে প্রচুর উন্নতি করেও অনেকের মধ্যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আর কে বলেছে, আমরা শুধুই গরিব? আমি ভিখিরির মতন ওদের কাছ থেকে কিছু চাইতে যাইনি। বারবার বলেছি, আমাদের মধ্যে হবে আদান-প্রদানের সম্পর্ক। ওদের কাছ থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষা আমাদের নিতেই হবে, তার বদলে আমরাও দেব এক উদার ধর্ম ও দর্শন, যাতে শাস্তির সন্ধান পাওয়া যাবে।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, শুনেছ নিশ্চয়ই আমরা একটা মিশন গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। সেই মিশন হবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নামে, সেই মিশনের মাধ্যমেই বিশ্ববাসী তাঁর নাম জানবে।
গিরিশচন্দ্র বললেন, মিশন? খ্রিস্টানদের মতন? সাহেব মিশনারিরা জঙ্গলে পাহাড়ে গিয়ে কোনও কোনও ন্যাংটা আদিবাসীদের মধ্যে পাঁঊরুটি আর বিস্কুট বিলোয় সেইরকম কিছু নাকি?
বিবেকানন্দ বললেন, ঠাট্টা নয়, জি সি, সত্যিকারের সেবার কাজ শুরু করতে হবে, এ দেশটাকে জাগাতে হবে। আমি ঠিক করেছি, বেশ কিছু ব্রহ্মচারী আর ব্রহ্মচারিণী তৈরি করব, তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে শেখাবে, শুধু লেখাপড়া নয়, শেখাবে যে আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করতে পারলে মানুষ সব কিছু পারে।
এই সময় একজন শিষ্য একখানি বেদগ্রন্থ নিয়ে উপস্থিত হল। কয়েক দিন ধরে বিবেকানন্দ ওই শিষ্যটিকে বেদ ও সায়নভাষ্য পড়াচ্ছেন। তিনি গিরিশচন্দ্রকে বলেন, তুমি একটু বসো, একে কিছুক্ষণ পড়িয়ে নিই, তারপর তোমার সঙ্গে আবার কথা বলব।
গিরিশচন্দ্র বললেন, ওরে বাবা, অত সব শক্ত শক্ত জ্ঞানের কথা এখন বসে থেকে শুনতে হবে? বিবেকানন্দ সহাস্যে বললেন, শুনলে ক্ষতি কী? সারা জীবনে এসব তো কিছু পড়লে না, খালি কেষ্ট-বিদের নিয়েই দিন কাটালে।
গিরিশচন্দ্র বললেন, কী আর পড়ব ভাই! অত সময়ও নেই, বুদ্ধিও নেই যে ওতে সেঁধুবো। তবে ঠাকুরের কৃপায় ওসব বেদ-বেদান্ত মাথায় রেখে এবার পাড়ি মারব। আমার কাছে সবই তিনি। ওই বেও তিনি।
মাথার ওপর হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, জয় বেহুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণের জয়।
বিবেকানন্দ শিষ্যটির দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখে রাখ, এ হচ্ছে কাল-ভৈরব। এর মতন যার ভক্তি বিশ্বাস তার বেশি পড়াশুনো করার দরকার হয় না। তোরা কিন্তু একে অনুকরণ করতে যাসনি। বেশির ভাগ মানুষেরই পড়াশুনো করে বুদ্ধিটা মার্জিত করা দরকার। শাস্ত্রগ্রন্থ। আলোচনা-পঠন-পাঠনে সত্য বস্তু প্রত্যক্ষ হয়।
গিরিশচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হে নরেন, একটা কথা বলি। বেদ-বেদান্ত তো ঢের পড়লে, এই যে দেশ জুড়ে ঘোর হাহাকার পড়ে গেছে, অন্নাভাব, ব্যভিচার, ভূণহত্যা ইত্যাদি মহাপাপ চোখের সামনে মোজ ঘটছে, এই সব নিবারণ করার কোনও উপায় সম্পর্কে তোমার বেদে কিছু বলেছে?
বিবেকানন্দ চুপ করে রইলেন।
গিরিশচন্দ্র বললেন, তুমি এতকাল সাহেবদের কে ছিলে, দেশের প্রকৃত অবস্থা বোধ করি জানো না। ওরে ভাই রে, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে প্যাখো, মানুষ আর মানুষ নেই। খিদের জ্বালায় মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকে না। ভিক্ষাক্সের ভাগ দিতে হবে বলে স্বামী তার স্ত্রীকে জলে ঠেলে ফেলে দিলে ছেলে তার বাপের গলায় পা দিয়ে পিষছে। বাঁকুড়ার হাটে এক মা তার তিনটি হট হট সন্তানকে বিক্রি করতে এনেছিল। লোকে যেমন বাড়ির পোষা গরু-ছাগল অভাবের জ্বালায় বিক্রি করে দেয়, সেইভাবে এখন জননীরা সন্তানদের বেচছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে যে গ্রামের ঘরে ঘরে মানুষ মরে পড়ে থাকছে, কি হিন্দু কি মোছলমান কেউ সেই সব শবদেহ দাহ করে না, কবর দেয় না, শ্যালকুকুরে দিনদুপুরে ছিঁড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। তোমার বোই বলো আর কোরানই বলো, কোন শাস্ত্রগ্রন্থে এর সুরাহা আছে বলো দেখি?
বিবেকানন্দ কিছু বলতে গেলেন, কিন্তু তাঁর ওষ্ঠ কেঁপে উঠল, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, চক্ষু দিয়ে নেমে এল জলের ধারা। নিজেকে সামলাবার জন্য তিনি উঠে চলে গেলেন বাইরে।
গিরিশচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিষ্যটিকে বললেন, দেখলি বাঙাল, কত বড় প্রাণ। তোদের স্বামীজিকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না। ওই যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি। চোখের সামনে দেখলি তো, মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো শুনে স্বামীজির বেদ-বেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল!
বিবেকানন্দ সভা-সমিতিতে যাওয়া বন্ধ করে সংগঠনের কাজে মন দিলেন। অবিলম্বে সেবামূলক কাজ শুরু করতে হবে। একটা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি চাই, বাড়ি চাই, কে দেবে টাকা? জো ম্যাকলাউড, ওলি বুল, স্টার্ডি প্রমুখ বিদেশি ভক্তদের সঙ্গে পত্রবিনিময় চলছে নিয়মিত। তাঁর যে-কোনও কাজে ওঁরা সাহাযোর হাত এগিয়ে দিতে প্রস্তুত। ক’দিন ধরে বিবেকানন্দর মাথায় স্ত্রীশিক্ষার কথাটা ঘুরছে। মেয়েদের আগে তুলতে হবে। ভারতে এখন শতকরা দশ-বারোজন মাত্র শিক্ষিত তার মধ্যে আবার মেয়েদের শিক্ষার হার শতকরা একজনও হবে কি না সন্দেহ। মাকে শিক্ষার আলো দিতে পারলে, কুসংস্কারমুক্ত করে তুলতে পারলে তবেই তো সন্তানরাও ঠিক ঠিক মানুষ হবে।
স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য উপযুক্ত নারী চাই। এদেশে সেরকম নারী কোথায়? ইংল্যান্ডে মার্গারেট নামে মেয়েটি এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু এত দূর দেশে এসে সে কি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? এ দেশের ভাষা জানে না, এখানকার নোংরা পরিবেশের কথা সে বোধ হয় কল্পনাও করতে পারে না। আরও একটা কথা, তার মতন একজন মেম সাহেবকে কি মেনে নিতে পারবে এ দেশের ছাত্রীরা?
ঘুমের মধ্যে বিবেকা, পর ভ্রম হল। তিনি যেন আবার আমেরিকায় ফিরে গেছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন ডেট্রয়েট শহরে কিংবা পায়চারি করছেন সহস্র দ্বীপপুঞ্জের অরণ্যে। আবার জেগে উঠে মনে হয়, সত্যিই কি তিনি কখনও গিয়েছিলেন পশ্চিম গোলার্ধে? নাকি সেটাই স্বপ্ন? কী বিশাল দুরত্ব, মাত্র কয়েকটা শতাব্দী আগে, আমেরিকা নামে মহাদেশটির অস্তিত্বই জানা ছিল না। জো মাকলাউড চিঠি লিখেছে, আর কি কোনওদিন দেখা হবে না?
দিনের বেলা দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তিনি কোথায় কখন যান, কী করে যেন লোকে সন্ধান পেয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকেই কৌতূহলী মানুষ। নিজে নিজে সন্ন্যাসী সাজা উটকো গেরুয়াধারী কারুর কারুর ধারণা হয়েছে, বিলেত আমেরিকায় গিয়ে সাধু সেঙ্গে বসলেই বাহবা পাওয়া যাবে, তারা যাওয়ার উপায় জানতে চায়। কারুর কারুর ধারণা হয়েছে, স্বামী বিবেকানন্দ সাহেবদের দেশে বক্তৃতা দিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করেছেন, সাহেব-মেমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, সেই সব লোকেরা আসে আর্থিক সাহায্য চাইতে। বিবেকানন্দ সকলকেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বিদায় করতে চান, অনর্থক সময় নষ্ট হয়। এক একদিন মেজাজ ঠিক রাখা শক্ত হয়ে পড়ে।
সেদিন তিনি বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ায় প্রিয়নাথ মুখুজ্যের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে, তারই মধ্যে একজন এসে খবর দিল বাইরে একজন বিবেকানন্দর লক্ষাপ্রার্থী, সে কিছুতেই যাবে না, ঝুলোঝুলি করছে।
বিবেকানন্দ বাইরে বেরিয়ে এলেন। লোকটির চেহারা আধা-সন্ন্যাসী ধাঁচের, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি। কাঁধের ঝোলা থেকে একটি ছবি বার করে তাঁর হাতে দিয়ে সে বলল, সে গোরা সভার একজন প্রচারক, স্বামী বিবেকানন্দর নাম শুনে সে এসেছে, তাঁর কাছ থেকে এই পুণ্য কাজের জন্য কিছু অর্থসাহায্য চায়।
বিবেকানন্দ ছবিটি দেখতে লাগলেন। একটি বেশ স্বাস্থ্যবতী গাভীর ফটোগ্রাফ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের সভার কাজটা ঠিক কী বলুন তো?
প্রচারকটি উদ্দীপ্তভাবে বলল, আমরা গোমাতার হত্যা নিবারণ করতে চাই। কশাইদের হাত থেকে গোমাতাকে রক্ষা করি।
বিবেকানন্দ বললেন, কিন্তু যে-সব গরু খুব বুড়ো ধুড়ো হয়ে পড়ে, সেগুলির কী হবে? গোয়ালা বা চাষীরাও তো সেরকম গরু বলদ রাখতে চায় না।
সে বলল,আমরা সারা দেশে পিজরাপোল স্থাপনের ব্যবস্থা করছি। সেখানে গোমাতার সেবা করা হবে। সেই জন্যই আরও অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন।
বিবেকানন্দ বললেন, তা বেশ, কিন্তু দেশে এখন মহা দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে। ভারত গভর্নমেন্ট ন’ লক্ষ লোকের অনশনে মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করেছেন, সরকারি রিপোর্টেই ন লাখ! আপনাদের সভা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের সাহায্যের কোনও উদ্যোগ নিয়েছে কী!
লোকটি বলল, সেটা আমাদের কাজ নয়। গোমাতাকে রক্ষা না করলে সনাতন হিন্দুধর্ম রসাতলে যাবে।
বিবেকানন্দ বললেন, তা তো বুঝলাম। কিন্তু এত মানুষ যখন বিপন্ন, তখন কিছুদিনের জন্যে গোমাতার কাক্স মুলতুবি রেখে মানুষের সেবা করাই কি উচিত নয়?
লোকটি বলল, গোমাতার কথা ভুলে যাব? মশাই, মানুষ মরছে তো আমরা কী করব? মানুষের পাপেই তো এই দুর্ভিক্ষ। যেমন কর্ম তেমনি ফল। পাপের কর্মফলেই তো মানুষ মারে।
হঠাৎ বিবেকানন্দর মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। তিনি সক্রোধে বললেন, যে সভা মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না, নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণ বাঁচাবার জন্য এক মুষ্টি অয় দেয় না, পশু-পক্ষী রক্ষার জন্য মাতামাতি করে, সে সভার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। কর্মফল!!
লোকটি বলল, আপনি কমফলে বিশ্বাস করেন না?
বিবেকানন্দ বললেন, কর্মফলে মানুষ মরছে এরকম দোহাই দিলে জগতে কোনও বিষয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্র করাটাই জে বিফল সাব্যস্ত হয়। আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না। গো-মাতারাও নিজ নিজ কলেই কশাইয়ের হাতে যাচ্ছেন ও মরছেন, তাতে আমাদের কী করার
লোকটি বলল, শাস্ত্রে বলে গরু আমাদের মাত্রা।
ওকে বাধা দিয়ে বিবেকানন্দ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, ত্যাঁ, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তা না হলে আপনাদের মতন এমন কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন!
এ কথার মর্ম না বুঝে লোকটি আবার বলল, অনেক আশা করে আপনার কাছে কিছু অর্থসাহায্যের জন্য এসেছি!
বিবেকানন্দ এবার নিজেই হেসে ফেললেন। এমন ব্যক্তির ওপর রাগ করেও লাভ নেই।
তিনি নরম গলায় বললেন, আমি সন্ন্যাসী, ফকির, আমি অর্থ পাব কোথায়? আমি নিজের কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছি। আমার কাজ আপনাদের সঙ্গে মিলবে না। আগে মানুষকে অন্নদান, তারপর বিদ্যাদান, তারপর ধর্ম।