২৯. এই জীবনটাও তো সুন্দর

রাত একটা পঁচিশ মিনিট পর্যন্ত কমল কম্পিউটারে একটা গেম খেলল। একটা পঁচিশ থেকে দুটা দশ মিনিট পর্যন্ত ইন্টারনেটে The Chariot of Time বইটার অনুবাদক রবার্ট কিং সম্পর্কে খোজ বের করার চেষ্টা করল। বইটার মূল রাশিয়ান লেখক Yori Medvedev নিশ্চয়ই এই ভুল করেন নি। যেমন এক জায়গায় আছে–

I was with the contemplator of Heaven.

এটা ভুল। Heaven-এর আগে ‘the’ article বসবে। শুদ্ধটা হবে–

I was with the contemplator of the Heaven.

ইন্টারনেটে রবার্ট কিং নামের কোনো অনুবাদকের খোঁজ পাওয়া গেল না। তার কোনো ওয়েবসাইট থাকলে কমল সবগুলি ভুল পাঠিয়ে দিত। ভুল থাকা ঠিক না।

দুটা দশ থেকে দুটা পনেরো মিনিট পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মিনিট সে খাওয়া দাওয়া করল। খাওয়ার মধ্যে ছিল–

একটা চকলেট–কিটকেট।

একটা বিসকিট। বিসকিটের নাম–Danisa Tradional Butter Cookies.

একগ্লাস অরেঞ্জ জুস।

দুটা পনেরো মিনিটে সে রুবিক কিউব নিয়ে বসল। পাজলটা সে তিনবার সলভ করল। তার সময় লাগল–

প্রথমবার ৬ মিনিট ২ সেকেন্ড

দ্বিতীয়বার ৫ মিনিট ০ সেকেন্ড

তৃতীয়বার ৫ মিনিট ১০ সেকেন্ড

এরপর সে দরজা খুলে বের হলো। তখন সময় ২টা ৩১ মিনিট ১২ সেকেন্ড। সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িঘরের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতে সময় নিল বার মিনিট। ছাদে বসেই সে ঘড়ি দেখল। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ি অন্ধকারে দেখা যায়। ঘড়িতে বাজে দুটা তেতাল্লিশ মিনিট তের সেকেন্ড।

কমল সিঁড়িঘরের ছাদের শেষপ্রান্তে বসেছে। এখান থেকে পড়লে সাড়ে চারতলা থেকে পড়া হবে। তার মোটেই ভয় করছে না। কারণ তার Batophobia নেই। তার আছে–

Acousticophobia : Fear of noise.

Broutophobia : Fear of thunder storms.

Demophobia : Fear of crowds.

Ophthalmophobia : Fear of being stared at.

Osmophobia : Fear of smells.

ছাদের উপর জায়গাটা ঠাণ্ডা। সামনের দিক থেকে বাতাস দিচ্ছে। এটা ভালো। পেছন দিক থেকে বাতাস দিলে সে ঝুপ করে নিচে পড়ে যেত। উপর থেকে নিচের রাস্তা দেখতে ভালো লাগছে। যখন রাস্তায় মানুষ থাকে তখন দেখতে অন্যরকম লাগে। যখন মানুষ থাকে না, তখন আবার আরেকরকম লাগে। এখন রাস্তাটাকে নদীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, একটা নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। নদীর দুপাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং।

কমল পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করল। এই টেলিফোন তার মা তাকে দিয়েছেন। সে এই টেলিফোন কখনো ব্যবহার করে না। আজ মাকে টেলিফোন করল। অনেকেই ঘুমুবার সময় টেলিফোন বন্ধ করে ঘুমায়। কমলের মা বলেছেন, তিনি কখনো তা করবেন না। টেলিফোন সবসময় হাতের কাছে রাখবেন। কমলের যখন দরকার হয়, তখনই যেন সে মার সঙ্গে যোগাযোগ। করতে পারে।

চারবার রিং বাজার পর মুনা ঘুম ঘুম গলায় বললেন, কে? কমল?

হ্যাঁ, মা।

এত রাতে তোমার টেলিফোন! কী সমস্যা? এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?

কমল বলল, আমি চিন্তা করছি। চিন্তা করার সময় জেগে থাকতে হয়। ঘুমিয়ে চিন্তা করা যায় না।

দিনেরবেলা চিন্তা করবে। এখন ঘুমুতে যাও। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে তুমি বাতি নিভিয়ে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে। এক… দুই…

মা শোন, তিন পর্যন্ত গোনার মধ্যে আমি বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারব। এক থেকে তিন গুনতে সময় লাগবে তিন সেকেন্ড। আমি যেখানে আছি সেখান থেকে ঘরে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুতে সময় লাগবে বার মিনিট।

তুমি কোথায় আছ?

সিঁড়িঘরের ছাদে।

Oh my God! তুমি সেখানে কী করছ?

তোমাকে তো বলেছি, চিন্তা করছি।

তুমি এক্ষুনি নেমে এসো। এক্ষুনি।

না। চিন্তা শেষ না করে নামব না। এমন হতে পারে চিন্তা শেষ করার পরেও নামব না। আমার এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে।

প্লিজ কমল, তুমি এসব কী বলছ? আমার হাত-পা কাঁপছে। তুমি কী নিয়ে চিন্তা করছ?

কমল বলল, আমি বেঁচে থাকলে আমার জন্যে ভালো হবে, না মরে গেলে আমার জন্যে ভালো হবে–এইটা নিয়ে চিন্তা করছি।

মুনা হতভম্ব গলায় বললেন, তুমি যে এখানে বসে আছ তোমার বাবা জানেন?

এই সময় কমল শুনল, পাশ থেকে কে যেন বলল, সমস্যা কী? কমল গলা চিনতে পারল, আহমেদ ফারুকের গলা। তিনি এত রাতে মার সঙ্গে আছেন? কমল বলল, মা, টেলিফোনটা আহমেদ ফারুককে দাও।

মুনা টেলিফোন রেখে দিলেন। কিংবা তার হাত থেকে টেলিফোন পড়ে গেল।

কমল ঘড়ি দেখল।

 

রাত তিনটা চল্লিশ মিনিট।

কমল আগের জায়গাতেই আছে। রাস্তায় পুলিশের একটা গাড়ি। দমকল বাহিনীর দুটা গাড়ি। কিছু লোকজনও দেখা যাচ্ছে। ছাদে সালেহ ইমরান দাঁড়িয়ে আছেন। সালেহ ইমরানের পাশে মুনা। মুনার চোখ লাল। তিনি একটু পরপর চোখ মুছছেন। একটু দূরে আহমেদ ফারুক। ফারুকের সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসার দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। তারা কেউ সিঁড়িঘরের ছাদের দিকে যাচ্ছেন না। কারণ কমল জানিয়ে দিয়েছে, কাউকে সে যদি ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে তাহলে সে উপর থেকে আঁপ দেবে। সালেহ ইমরান পুলিশ অফিসারকে জানিয়েছেন, কমল যা বলছে তা করবে। সে কখনো কাউকে ভয় দেখানোর জন্যে কিছু করে না।

তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মতিন এসে পৌঁছল। সে কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলল না। সরাসরি সিঁড়িঘরের লোহার সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিক গলায় বলল, লমক মিআ কি বসআ? (কমল আমি কি আসব?)

কমল বলল, নকে বেসআ? (কেন আসবে?) ছিরক ন্তাচি মিআ। (আমি চিন্তা করছি।)

মতিন বলল, প্লিজ আমাকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে দাও।

না।

মতিন বলল, মানুষ কেন আনন্দ পায়, কেন ভয় পায়, এটা আমি বের করেছি।

কমল বলল, সোআ লেহতা। (তাহলে আসো।)

মতিন সিঁড়ির দিকে না গিয়ে সালেহ ইমরানের দিকে এগিয়ে গেল। সালেহ ইমরান ধরা গলায় বললেন, প্লিজ লুক আফটার মাই সান।

মতিন এগিয়ে যাচ্ছে। তার পা টলছে। কমল বলল, তোমার কি Batophobia আছে?

Batophobia কী?

উচ্চতা ভীতি।

হ্যাঁ, আমার উচ্চতা ভীতি আছে। আমি দোতলা থেকে নিচে তাকাতে পারি না।

তুমি নিচের দিকে তাকিও না, তুমি আই লেভেলে তাকাও। আমার পাশে এসে বসো। কিন্তু খুব কাছে না। এমনভাবে বসবে যেন হাত দিয়ে আমাকে ছুঁতে না পার।

আমার মাথা ঘুরছে, আমি ছাদের এত কিনারায় যেতে পারব না। তুমি বরং আমার কাছে আসো।

কমল বলল, না। আমি যেখানে আছি সেখানে থাকব। এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিতে সহজ হবে।

নিচে ঝাঁপ দেবে?

হ্যাঁ। কারণ আমি চিন্তা করে বের করেছি, আমি মরে গেলে আমার জন্যে ভালো হবে।

কীভাবে?

তুমি কাছে এসো তারপর বলব। হাঁমাগুড়ি দিয়ে আসো। নিচে না তাকিয়ে আসো।

মতিন হাঁমাগুড়ি দিয়ে এগুলো! কমলের পাশে বসল। এক পলকের জন্যে চোখ গেল নিচে। মতিনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তার মনে হলো, এক্ষুনি সে পড়ে যাবে। কমল বলল, তোমাকে বললাম না নিচে তাকাবে না। সবচে ভালো হয় যদি চোখ বন্ধ করে থাক।

মতিন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ছাদের শেষপ্রান্তে এসে কামালের মতো পা ঝুলিয়ে বসল।

কমল বলল, এখন চোখ খোল।

মতিন বলল, আমি চোখ খুলব না। এখন তুমি বলো, কেন তুমি মরে গেলে তোমার জন্যে ভালো হবে? তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ না?

বুঝতে পারছি না। মানুষ শরীরে ব্যথা না পেয়েও কেন কষ্ট পায় আমি বুঝি না।

এই কষ্টকে বলে মানসিক কষ্ট। মনের কষ্ট।

কমল বলল, মন বলে কিছু নেই। কাজেই মনের কষ্টও নেই। এই কষ্ট আমরা নিজেরা বানিয়েছি। এই নিয়ে আমি আর কথা বলব না।

তুমি কি ঠিক করে ফেলেছ যে, নিচে ঝাঁপ দেবে?

হ্যাঁ।

কখন ঝাঁপ দেবে?

পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে।

পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে কেন? এখন না কেন?

কমল বলল, আজ সানরাইজ হবে পাঁচটা চল্লিশে। আমি সানরাইজ দেখব। Sun-কে বলব, হ্যালো! তারপর ঝাঁপ দেব। আমি সূর্য পছন্দ করি।

মতিন বলল, তুমি তোমার প্রিয়জনদের আর দেখবে না, এটা ভেবে খারাপ লাগছে না?

শুধু সালেহ ইমরানের জন্যে খারাপ লাগছে।

বাবাকে নাম ধরে ডাকছ কেন কমল?

উনি আমার বাবা না। আহমেদ ফারুক আমার বাবা।

তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ।

আহমেদ ফারুক যদি তোমার বাবা হন, তাতে সমস্যা কী? তুমি তোমার জীবন যাপন করছ। তোমার বাবার বা মার জীবন না।

কিন্তু আমার মন খারাপ।

একটু আগে তুমি বলেছ, মন বলে কিছু নেই। কাজেই মন খারাপও নেই।

আমি ভুল বলেছি। সরি।

কমল শোন, তুমি মানুষকে যন্ত্র ভাবো। মানুষ যন্ত্র না। মানুষ এমন যে, কোনো কারণ ছাড়াই সে কষ্ট পায়। আমি তোমার কেউ না, কিন্তু তুমি ঝাঁপ দিলে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাব।

কেন?

কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার মা যেমন তোমাকে ভালোবাসেন, তোমার বাবা যেমন তোমাকে ভালোবাসেন, আমিও বাসি। আমরা যে-কেউ তোমাকে বাঁচাবার জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।

তুমি কি সত্যি কথা বলছ? কেউ সত্যি কথা বলে না।

আমি সত্যি কথাই বলছি। আমি নিচে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত আছি, যদি তুমি প্রমিজ করো আমি ঝাঁপ দেবার পর তুমি তোমার মার কাছে ফেরত যাবে। আমি কিন্তু ঝাঁপ দেব।

কমল ঠাণ্ডা গলায় বলল, তাহলে ঝাঁপ দাও। আমি দেখতে চাই তুমি সত্যি কথা বলছ।

মতিন বলল, পাঁচটা চল্লিশ মিনিট হোক। সূর্যটা দেখে যাই।

তুমি সূর্য ভালোবাস?

মতিন বলল, উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম খুব ভালোবাসেন। আমি ততটা বাসি না। কমল, তুমি ঘড়ি ধরে থাক। পাঁচটা চল্লিশ বাজবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলবে।

কমল চোখের সামনে ঘড়ি ধরল।

মতিন উঠে দাঁড়াল। বসে থেকে ঝাঁপ দেয়া সমস্যা। দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দেয়াই ভালো। মতিন তাকাল সালেহ ইমরানের দিকে। উঁচু গলায় বলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। পাঁচটা চল্লিশ বাজতেই কমল আপনাদের কাছে ফিরে যাবে।

গভীর আনন্দ নিয়ে মতিন অপেক্ষা করছে। এই আনন্দের উৎস কী সে জানে না। কে যেন তার মাথার ভেতর বলল, ভালো দেখিয়েছ। কে বলল কথাটা কে জানে?

পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। পাঁচটা চল্লিশ বাজতে বেশি বাকি নেই।

 

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট হাসপাতালের হিমশীতল একটি ঘর। মতিন শুয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, সে যেন অনন্তকাল এভাবেই শুয়ে ছিল। তার চেতনার একটি অংশ কাজ করে। সে শব্দ পায়। একবার তার কাছে মনে হলো, কমল এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কমল বলল, আমি সরি বলতে এসেছি। একবার মনে হলো, কে যেন তার গায়ে হাত রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি মৃন্ময়ী। কেন এরকম করলেন? কেন? সালেহ ইমরান সাহেব একবার বললেন, কমল আমার সঙ্গে থাকবে। সে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড। কমল বলেছে সে সাধারণ মানুষ হবার চেষ্টা করবে। আবার মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ধোঁয়াটে জগৎ থেকে এক ছায়ামুর্তি বলে, আপনি হাসপাতালে শুয়ে থাকলে কে আমাকে খুঁজে বের করবে? আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? মতিন ফিসফিস করে বলে, তুমি তৌ।

মতিনের সবচে ভালো লাগে যখন উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম তার পাশে এসে বসেন। তাঁর গা থাকে আতরের গন্ধ ভেলে আসে। তিনি একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। মতিনের মনে হয়, বাহ! এই জীবনটাও তো সুন্দর।

2 Comments
Collapse Comments

Eta kichu holo? Dhur

হুমায়ুন আহমেদ পাঠকদের নিয়ে এক প্রকার মশকরা করে গেছেন।

মানুষকে বিভ্রান্ত করা সোজা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *