সারা বিকাল আকাশ মেঘলা ছিল। সন্ধ্যা বেলা চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। রানু অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। ঘরের ভেতর প্রচুর হাওয়া। রানু চোখ না মেলেই হাত বাড়ল, টগর নেই। তার সঙ্গেই শুয়েছিল। এক ফাকে উঠে চলে গেছে।
টগর! টগর!
কী মা?
কি করছ, তুমি?
কিছু করছি না।
টগর কথা বলছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজছে নিশ্চয়ই। রানু এসে দেখে সত্যি তাই। রেলিং ধরে টগর বসে আছে। গা মাথা ভিজে সাপ সাপ করছে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। দৃশ্যটি কেমন যেন অন্য রকম। যেন এই ছেলেটির কেউ নেই। বারান্দায় বসে বসে কাঁদছে।
বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক না টগর। ভেতরে আস।
আসছি।
টগর এল না। ঠিক আগের মতই বসে রইল। রানুর ইচ্ছা হল কড়া গলায় একটা ধমক দিতে। সে ধমক দিল না। নিজেকে চট করে সামলাল। ছোট বাচ্চাদের খানিকটা নিজের মত থাকতে দিতে হয়। কিছুক্ষণ ভিজলে এমন কি আর ক্ষতি হবে?
টগর!
কি মা?
অপলা কোথায়? আসেনি এখনো?
না।
তুমি কি আপলার জন্যেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছ?
টগর জবাব দিল না। সম্ভবত সে অপলার জন্যেই অপেক্ষা করছে। অপলা খাতাপত্র কি সব কেনবার জন্যে নিউমার্কেটে গিয়েছে। এতক্ষণে চলে আসার কথা। আসছে না কেন, কে জানে।
রানুর মনে হল অপলার অনেক সাহস হয়েছে। আগে একা একা কোথাও যেত না। এখন যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কলেজ থেকে ফিরল সন্ধ্যা পার করে। তাদের কি নাকি ফাংশান ছিল। রানু দেখল ফর্সা মত রোগা একটি ছেলে এসেছে তার সঙ্গে। অনেক দিনের পরিচিত এমন ভঙ্গিতে ছেলেটি কথা বলছিল। অপলা বলল, চা খেয়ে যাও সিরাজ। ছেলেটি তার উত্তর দেয়নি। মাথা বাকিয়েছে। যার মানে হ্যাঁ কিংবা না দুই হতে পারে।
রানু একবার ভেবেছিল বলবে, রিকশায় একজন ছেলের সঙ্গে আসা ঠিক না। এ রকম আর কোনো দিন আসিস না। রিকশায় দু’জন পাশাপাশি বসা মানেই গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসা। এভাবে বসলেই শরীর কথা বলতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসব কথা বলা হয়নি। কারণ কথাগুলি তার নিজের নয়। ওসমানের কথা। অন্যের কথা নিজের ভেবে বলার কোনো অর্থ হয় না।
রানু বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখল ইলেকট্রসিটি নেই। শহরের ইলেকট্রসির এমন অবস্থা। একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই কারেন্ট নেই। আর একবার নেই হলে সারা রাতের জন্যে নেই। রানু হারিকেন জ্বালাল। হারিকেনে তেল নেই। কতক্ষণ জুলিবে কে জানে। ড্রয়ারে মোমবাতি ছিল। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সে চায়ের পানি চাপিয়ে আবার বারান্দায় এল। টগরের ঠাণ্ডা লাগছে। কিছুক্ষণ পর পরই কেঁপে উঠছে। নীল হয়ে আছে ঠোঁট। কতক্ষণ ধরে সে বৃষ্টিতে ভিজছে?
টগর!
কী মা?
এসো মাথা মুছিয়ে দেই।
টগর উলে এল। কোনো আপত্তি করল না।
চা খাবে বাবা? তোমাকে একটু আদা চা করে দেই?
টগর অবাক হয়ে বলল, আমি বড় হয়ে গেছি, না?
হ্যাঁ তুমি বড় হয়েছ। অনেক বড়।
এখন আমি রোজ চা খাব?
হ্যাঁ খাবে।
রানু মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে হালকা গলায় বলল, শুধু চা না, চাইলে সিগারেটও এনে দেব।
দূর।
রানু হেসে ফেলল। টগর উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। শীতে সে অল্প অল্প কাঁপছে। রানুর বড় মায়া লাগল। নির্বিরোধ শান্ত ছেলে হয়েছে টগর। কারো প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই।
রানু পিরিচে চা ঢেলে দিল। টগর কেমন বিড়ালের বাচ্চার মত চুক চুক করে চা খাচ্ছে। একবার মুখ তুলে মাকে দেখল এবং হেসে ফেলল।
আমাদের টগর সোনামণি আজ এত খুশি কেন?
এমনি।
না। এমনি নয়। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
টগর লজ্জিত ভঙ্গিতে পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করল। নীল রঙের চিঠির কাগজ। সে কাগজটা মার দিকে বাড়াল না। টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে হাসতে লাগল।
কি এটা? চিঠি?
হুঁ।
কার চিঠি? কে লিখেছে?
আব্বা।
রানু কাগজ তুলে নিল। ওসমানের চিঠি নয়। চিঠিটা অপলার লেখা। বাবার চিঠি এসেছে এই বলে সে নিশ্চয়ই টগরকে বুঝিয়েছে। মেয়েলি ধরনের একটা ট্রিক। রানু অপ্রসন্ন মুখে চিঠিতে চোখ বোলাতে লাগল।
প্রিয় টগর সোনা,
তুমি কেমন আছগো? তোমার কথা খুব ভাবি। লেখালেখি নিয়ে খুব ব্যস্ত তাই আসতে দেরি হচ্ছে। তুমি এক কাজ কর না কেন–চলে এসো এখানে। তুমি এলে খুব মজা হবে। আমরা খুব বেড়াব।
পুকুরে সাঁতার কাটিব। আসবে না তুমি? না এলে আমি রাগ করব। আসবে, আসবে, আসবে।
রানু ভ্রূ কুঁচকে দীর্ঘ সময় চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই নকল চিঠিটা কি উদ্দেশ্যমূলক নয়? অপলা কি এখানে সূক্ষ্ম একটা চাল দেয়ার চেষ্টা করছে না? সে নিশ্চয়ই ভেবেছে টগর চিঠি পেয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠবে বাবার কাছে যাবার জন্যে। টগর অবশ্যি সে রকম কিছু করছে না। রানু একবার ভাবল বলে, টগার, এটা একটা নকল চিঠি। এ চিঠি তোমার বাবার লেখা নয়। কিন্তু সে তা বলল না।
বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। অপলার দেখা নেই। কত দেরি করবে। সে? রানুর মনে হল অপলাকে কিছু বলা দরকার। স্বাধীনতা মানে রাত করে বাড়ি ফেরা নয়। সে নিজে একজন স্বাধীন মহিলা কিন্তু সে কি রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে না।
অপলা ফিরল কাক ভিজা হয়ে। কাগজ কিনতে গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে কোনো কাগজপত্র দেখা গেল না। সে গুন গুন করতে করতে বাথরুমে কাপড় বদলাতে গেল। বাথরুম থেকেই বলল, ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি নেমে গেছে তাই না। আপা? আমি আজ অবশ্যি ইচ্ছা করেই ভিজলাম। যখন খুব তেজে বৃষ্টি নামল তখন রিকশার হুঁড ফেলে দিলাম। রাস্তায় যারা ছিল সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আমাকে পাগল ভেবেছে বোধ হয়।
রানু তার কথার কোনো জবাব দিল না। মেয়েটি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এটা ঠিক সহজভাবে গ্রহণ করা মুশকিল। তাকে বললে কেমন হয়–অপলা তুই এরকম হয়ে যাচ্ছিস কেন?
অপলা মোমবাতি খুঁজে বের করল। যেন কিছুই হয়নি। এমন ভঙ্গিতে পড়তে বসল। পড়া আগালো না। এক জায়গায় বসে সে পড়তে পারে না। ঘুরে ঘুরে পড়তে হয়। বই বন্ধ করে সে টগরের সঙ্গে গল্প করতে বসল। পাশেই রানু আছে। সে দিকে সে কিছুমাত্র লক্ষ্য করছে না। যেন এ ঘরে মানুষ নামের কেউ নেই।
ভূতের গল্প শুনবি টগর?
হুঁ।
হুঁ কি? ভাল করে বল। বল, হ্যাঁ, শুনব।
হ্যাঁ শুনব।
ভয় পেয়ে কাঁদবি না তো?
না। কাঁদব না।
সত্যি ভূতের গল্প শুনবি না মিথ্যা ভূতের গল্প?
সত্যি ভূতের গল্প।
অপলা হারিকেনের আলো আরো খানিকটা কমিয়ে দিল। রানু লক্ষ্য করল টগর অপলার কোমর জড়িয়ে কোলে মাথা গুজে শুয়ে আছে। অপলা টগরের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গল্প করছে। রানু কি ঈর্ষা বোধ করছে? করছে বোধ হয়। তার ইচ্ছা করছে টগরকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে। এই সন্ধ্যাবেল কিসের ভূতের গল্প।
বৃষ্টি কমে এসেছিল। রাত দশটার দিকে আবার প্রবল বেগে বর্ষণ শুরু হল। বাতাস বইতে লাগল। প্রচণ্ড শব্দে। ঝড় শুরু হল নাকি? দূর থেকেই হৈচৈ চিৎকারের শব্দ আসছে। বস্তীর কাঁচা ঘরবাড়ি কিছু উড়ে গেছে নিশ্চয়ই। অপলা বলল, কেমন ভয় ভয় লাগছে আপা। পুরুষ কেউ নেই।
পুরুষ মানুষ থাকলে কি করত? ঝড় থামিয়ে দিত?
তা দিত না, তবে সাহস পাওয়া যেত। ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ না থাকলে কেমন একা একা লাগে।
এরকম মেয়েলি ধরনের কথা বলিস না তো, গা-জ্বালা করে।
মেয়ে মানুষ মেয়েলি ধরনের কথাই তো বলব? তোমার নিজেরও কিন্তু আপা ভয় ভয় করছে, শুধু মুখে স্বীকার করছ না।
রানু ঘুমুতে গিয়ে দেখল টগর বিছানায় নেই। আবার অপলার কাছে চলে গিয়েছে। মশারি ফেলতে গিয়ে এমন এক পলকের জন্যে মনে হল ঝড়-বৃষ্টির রাতে একজন কেউ পাশে থাকলে ভালই হয়।
আপা।
কি?
তোমার তো একা এক ভয় লাগবে। সবাই মিলে আজ একসঙ্গে ঘুমুলে কেমন হয়?
আমার এত ভয়-টয় নেই, তুই ঘুমুতে যা। আর শোন একটা কথা, বানিয়ে বানিয়ে টগরকে চিঠি খেলার দরকার নেই।
বেচারা তার বাবার জন্য মন খারাপ করে থাকে।
থাকতে থাকতে এক সময় অভ্যাস হবে। তখন আর খারাপ লাগবে না।
অভ্যাস হবার দরকার কি? বাবার জন্যে মন খারাপ হওয়াটা কি খারাপ?
গত তিন মাসে যে বাবার ছেলের কথা একবারের জন্যেও মনে হয়নি, তার জন্যে মন খারাপ হওয়া ঠিক না।
একবারও ছেলের কথা মনে হয়নি সেটা তুমি কিভাবে বলছি? চিঠি লিখেননি তার মানে এই নয় যে…
তোর কাছে মানে শুনতে চাই না।
শোন আপা, আমি যদি টগরকে নিয়ে দুলাভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই তোমার আপত্তি আছে? মেডিকেল কলেজ দু’দিন বন্ধ থাকবে। সোমবার এবং বুধবার। মঙ্গলবার মিস করলে তিন দিন ছুটি পাওয়া যায়। যাব?
রানু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। বলে কি এই মেয়ে!
কি আপা যাব? যাওয়া কোনো সমস্যা হবে না। ট্রেনে যাব তার পর.
ছুটি হয়েছে, নিজের বাড়িতে যা।
নিজের বাড়িতে আমার আছে কে বল? তা ছাড়া এক দুদিনের জন্যে গিয়ে হবেটা কি! গরমের ছুটিতে তো এমনিতেই যাব। যাব না?
অপলা রানুর পাশে বসল। সে কী আগের চেয়ে রূপবতী হয়েছে, না হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় তাকে সুন্দর লাগছে? এত লম্বা চুল ছিল অপলার তা আগে লক্ষ্য করা যায়নি। অপলা। হালকা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার অনেক মিল আছে আপা। তোমার কোথাও কেউ নেই, আমারো নেই। এটা এমন কোনো হাসির কথা নয়, কিন্তু অপলা হাসল। রানু বলল, অনেক অমিলও আছে।
তা আছে। স্বভাব-চরিত্র দুজনের দুরকম।
তোর স্বভাব-চরিত্র অবশ্যি দ্রুত বদলাচ্ছে।
তোমারও বদলাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তুমি ততই কঠিন হচ্ছি। এটা ঠিক না। আপা। নিজের কষ্ট পাঁচছ। অন্যকেও কষ্ট দিচ্ছি।
অপলা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। উঠে দাঁড়াল। রানু কিছুই বলল না। আপলা দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল এবং শান্ত স্বরে বলল, আমি ঠিক করেছি। আমি যাব। টগরকে তুমি আমার সঙ্গে না দিতে চাও দিও না। আমি একাই যাব।
হঠাৎ তোর এত আগ্রহের কারণ কি?
আমি দুলাভাইয়ের একটি চিঠি পেয়েছি। তিনি আমাকে যাবার জন্যে লিখেছেন।
চিঠি কবে পেয়েছিস?
গতকাল।
সেখানে কী লেখা আছে টগরকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে?
না নেই।
তুই একাই যা। ওকে নেবার দরকার নেই।
আপা, তুমি কী চিঠিটি পড়তে চাও?
না। আমি পড়তে চাই না। অন্যের চিঠি পড়ার অভ্যেস আমার নেই। ব্যক্তিগত চিঠি আমি পড়ি না।
পড়তে চাইলে পড়তে পার। তোমার টেবিলের উপর রেখে এসেছি। টগরকে আমার সঙ্গে যেতে দাও। আপা। প্লিজ!
অপলা ঘুমুতে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম এল না। সে খানিক্ষণ কাদল। কত অদ্ভুত ঃখ কষ্ট আছে মানুষের। এরকম সুন্দর একটি রাতে কেউ কাঁদে? রানু হঠাৎ ঠিক করল টগরকে সে অপলার সঙ্গে যেতে দেবে।
রানু ভাবতেও পারেনি। অপলা সত্যি সত্যি টগরকে নিয়ে রওনা হবে। এ জীবনে আমরা অনেক কিছুই করতে চাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা হয়ে ওঠে না। কল্পনাকে কাজে লাগানো কঠিন। রানু কলেজে উঠে একবার ঠিক করেছিল একা একা শোনাবো। কিন্তু রানু চুপচাপ। সে কোনো রকম আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অপলা যখন বলল, টগরের জন্যে কী গরম কাপড় নেব। আপা? রানু হেসে বলল, এই গরমে গরম কাপড় কেন?
তাহলে থাক। নেবার দরকার নেই। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে কিনা কে জানে? হয়ত রাতে উঠে কাঁদতে শুরু করবে।
কাঁদবে না।
আমারও মনে হয় কাঁদবে না। আমার কী মনে হয় জান আপা? আমার মনে হয়। বাবাকে ছেড়ে आअgङछ्रे bाङ्ग्रेहद न्ा।
আসতে না চাইলে রেখে আসিস।–
অপলা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, তাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি রেখে আসব। রানু গম্ভীর হয়ে বলল, বললাম তো রেখে আসিস।
কিন্তু তুমি মুখ কালো করে বলছি। এটা রাগের বলা। এই কথাটি তুমি কী হাসি মুখে বলতে পারবে? দেখি হাসতে হাসতে বল তো?
রানু কিছু বলেনি। বিরক্ত হয়েছে। ইদানীং অপলা তাকে বেশ বিরক্ত করছে। যা সে পছন্দ করে না তা করতে চেষ্টা করছে। ইচ্ছা করেই করছে বোধ হয় কেন সবাই এমন বৈরী হয়ে উঠছে?
অপলা যাবে সকাল সাড়ে এগারোটায়। রানু অফিসে গেল না। খুব ঘন ঘন অফিস কামাই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ তাকে কিছু বলছে না। কিন্তু এক সময় হয়ত বলবে। সিদ্দিক সাহেব মিষ্টি মিষ্টি গলায় খুব কড়া কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দেবেন। এই লোকটিও এখন তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হবার কোনো কারণ নেই। সিদ্দিক সাহেব মানুষটি ভদ্র, কাজ বোঝেন এবং প্রচুর কাজ করেন। সমস্যাটি কোথায় তাহলে? এ রকম হচ্ছে কেন রানুর?
টগর সকাল থেকেই বেশ গম্ভীর। বারবার তার নিজের ছোট্ট সুটকেস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। রানু ভেবেছিল শেষ মুহূর্তে টগর মত বদলাবে। মাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না। কিন্তু টগরের ভাবভঙ্গি সেরকম নয়। সে মাকে কিছুটা এড়িয়ে চলছে। সম্ভবত তার ধারণা হয়েছে মা হঠাৎ বলবে, তোমার যাবার দরকার নেই, টগার। তুমি চলে গেলে আমি একলা হয়ে যাব। রাতে ভয় লাগবে। তুমি থেকে যাও।
টগর অপলার পাশে পাশে ঘুরছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছে মাকে। চোখে চোখ পড়ামাত্র মাথা ঘুরিয়ে নিচ্ছে। যেন সে মাকে চিনতে পারছে না। ওরা রওনা হবার আগে আগে রানু টগরকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।
টগর খুব সাবধানে থাকবে কেমন? একা একা পুকুরে যাবে না। আচ্ছা?
টগর মাথা নাড়ল। সে যাবে না।
ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে।
করব।
বাবার জন্যে কি নিয়ে যাচ্ছি টগর?
টগর অবাক হয়ে তাকাল মার দিকে? ঠিক এই প্রশ্ন সে আশা করেনি।
বাবার জন্যে কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিত না? সে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে কি আনলে আমার জন্যে? তখন কি বলবে তুমি?
কি নেব?
তুমি ভেবে-টেবে বের কর কি নিতে চাও।
তুমি বলে দাও।
এমন কিছু নিতে হবে যাতে সে খুশি হয়। ভেবে-টেবে বের করতে হবে কি নিলে খুশি হবে। এসো আরো ভাবি। বোকা ছেলে এমন করে কেউ বুঝি ভাবে? ভাবতে হয় গালে হাত দিয়ে।
টগর সত্যি সত্যি গালে হাত দিল। রানু হেসে ফেলল। চমৎকার একটি ছবি। ছেলে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। বাবার জন্যে কি নেয়া যায়? এর মধ্যে কোথায় যেন মন খারাপ করার মত একটা ব্যাপার আছে।
রানু বলল,
আমার জন্যে খারাপ লাগবে না?
লাগবে।
তুমি কাঁদবে না। আমার জন্যে?
হুঁ। কাঁদবি।
তাহলে একটু কাঁদ আমি দেখি।
টগর ফিক করে হেসে ফেলল। ছোট্ট ছোট্ট হাতে জড়িয়ে ধরল মাকে। রানু একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন সে এই শিশুটিকে দেখবে না। আর সে ফিরে আসবে না মার কাছে।
রানু ভেবেছিল ঘর থেকেই সে তাদের বিদেয় দেবে। কি মনে করে সে ওদের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গেল। ট্রেন ছাড়বার আগে অপলা বলল, তুমি একা একা ও বাড়িতে থাকতে পারবে না। আপা। তুমি খালার কাছে চলে যাও। খালার সঙ্গে থাক। রানু গভীর স্বরে বলল, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই টগরকে চোখে চোখে রাখবি। পানিতে যেন না নামে।
কোনো ভয় নেই। আপা।
পৌঁছেই টেলিগ্রাম করবি।
টেলিগ্রাম পৌঁছবার আগে তো আমরাই চলে আসব।
তবু করবি।
ঠিক আছে করব।
রানু হঠাৎ লক্ষ্য করল টগর কাঁদছে। অপলা বিরক্ত হয়ে বলল, এই কাঁদছিস কেন? টগর জবাব দিল না। শাড়ির আঁচলে সে মুখ ঢেকে রেখেছে। বারবার তার ছোট্ট শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অপলা বলল, মার জন্যে খারাপ লাগছে?
হুঁ।
তাহলে যাবার দরকার নেই। তুই থেকে যা।
টগরের কান্না আরো বেড়ে গেল। গার্ড হুঁইসেল দিয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করবে অপলা। বিব্রত মুখে বলল, আপা, তুমিও উঠে এসো না। প্লিজ।
রানু জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে রইল। এবং এক সময় ট্রেন ছেড়ে দিল। তার নিজের চোখেও কী পানি আসছে? আসছে বোধ হয়। সব কেমন ঝাপসা লাগছে। রানুসান গ্লাস চোখে দিল; জল-ভরা চোখ কাউকে দেখাতে ইচ্ছা করে না। ট্রেন চলে যাবার পরও সে কিছুটা সময় ঘুরে বেড়াল স্টেশনে। সিলেট মেল এসে থেমেছে। ব্যস্ত হয়ে যাত্রীরা নামছে। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। একজন মানুষের সঙ্গে অন্য জনের কোন মিল নেই। ছোট একটি বাচ্চা গর্বিত ভঙ্গিতে গট গট করে হাঁটছে। তার মা হাত ধরতে চাচ্ছে। সে কিছুতেই হাত ধরতে দেবে না। কি গম্ভীর শিশুটির চলার ভঙ্গি। টেগরের মত হয়েছে বোধ হয়। রানুর চোখ আবার ভিজে উঠছে। মন দুর্বল হয়ে গেছে। ভাল কথা নয়।
রানুর মামা ইসমাইল সাহেব, রানুকে দেখে খুবই অবাক হলেন। দীর্ঘ দিন পর সে বাড়িতে এল। ইসমাইল সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। এখন প্রায় অথর্ব অবস্থায এসে পৌঁছেছেন। নিজে নিজেই কিছুই প্ৰায্য করতে পারেন না।
কেমন আছ মামা?
ভাল আছি। বেশ ভাল। তুই কী মনে করে?
দেখতে এলাম। বাসায় কেউ নেই নাকি? ফাকা ফাঁকা লাগছে।
বিয়ে বাড়িতে গেছে। চলে আসবে। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবে। তুই বোস।
রানু বসল। ইসমাইল সাহেব হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানলেন। হালকা গলায় বললেন, এখনো রাগ পুষে রেখেছিস?
না মামা কারো ওপর আমার রাগ-ট্যাগ নেই।
এদিকে তো আসিস না।
ইচ্ছে করেই আসি না।
কেন?
তোমার কথা না শুনে বিয়ে করেছিলাম। খুবই রাগ করেছিলে তুমি। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে, মনে আছে?
ইসমাইল সাহেব কিছু বললেন না। রানু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেই বিয়ের আজ এই অবস্থা। লজ্জাতেই আসি না।
আজি কী মনে করে এলি?
কিছু করার ছিল না। কোথাও যাবার ছিল না। তাই এসেছি।
টগরকে কার কাছে রেখে এসেছিস?
ও তার বাবার কাছে গেছে। গ্রামের বাড়িতে। ওর বাবা কিছুদিন ধরে গ্রামের বাড়িতে আছেন।
জানি।
কিভাবে জানলে?
কোন পত্রিকা যেন দেখলাম কথাসাহিত্যিকের নির্বাসন।
রানু চুপ করে গেল। ইসমাইল সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, গ্রাম নিয়ে কিছু লিখবেন বোধ হয়?
জানি না। লিখলে লিখবে। লেখালেখির ওপর আমার কোনো ভক্তি নেই। উৎসাহ-ও নেই। ঐ প্রসঙ্গ থাক মামা। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ কর। তোমার শরীর এখন কেমন?
ভাল না। সময় বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে।
আফসোস হয়?
না, দায়িত্ত্ব পালন করেছি। মেয়েগুলির বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা চাকরি করে। আফসোস থাকবে কেন? কোন আফসোস নাই।
মামা, চা খাব।
নিজে বানিয়ে খেতে হবে। কাজের ছেলেটা কোথায় যেন গেছে।
তুমি খাবে?
চা-সিগারেট আমার জন্যে নিষিদ্ধ। তবে তোর খাতিরে খাব এক কাপ।
রানু চা বানাতে গেল। সে প্রায় বার বছর এ বাড়িতে কাটিয়েছে কিন্তু তবু সব কেমন অচেনা লাগছে। পুরনো আসবাব প্রায় কিছুই নেই। ঝক ঝক করছে চারদিক। তার সময় এরকম ছিল না। এলোমেলো থাকত সব কিছু। এখন ঘর সাজায় কে? এ বাড়িতে কোনো মেয়ে নেই। মামা তার ছেলের বিয়ে দেননি। নাকি দিয়েছেন। কিন্তু তাকে জানাননি? বোধ হয় তাই। মামার সঙ্গে তার এখন আর সম্পর্ক নেই। রানু সবার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে।
মামা তোমার চা। চিনি দেইনি। চিনি নিশ্চয় খাও না?
না, খাই না।
ইসমাইল সাহেব নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। তার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। চায়ে চুমুক দেবার ভঙ্গি, বসে থাকার ভঙ্গি সব কিছুতেই গম্ভীর ক্লান্তির ছোঁয়া। সত্যি সত্যি কি তার সময় শেষ হয়ে এসেছে? যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রানুর বড় মায়া লাগল। ইসমাইল সাহেব বললেন, আজ রাতটা আমার এখানে থেকে যা। বুলুর বিয়ে দিয়েছি, ওর বৌকে দেখবি।
বুলুর বিয়ের কথা আমাকে তো কিছু বলনি।
বলার মত বিয়ে নয়। বলার মত হলে বলতাম।
ইসমাইল সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে মাথা রাখলেন।
তোমার শরীর এত খারাপ তবু সবাই তোমাকে এক ফেলে চলে গেল?
ওরা যেতে চায়নি। আমি জোর করে পাঠিয়েছি। সব সময সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত, এটা সহ্য হয় না।
রানু খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, মামা আমি টগরকে নিয়ে যখন আলাদা হয়ে গেলাম তুমি কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করলে না কেন এরকম করলাম?
ইসমাইল সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন কিছু বললেন না।
আমি আশা করেছিলাম তুমি অন্তত জানতে চাইবে। আমার সব কথা শুনবে এবং শেষ পর্যন্ত বলবে, যা করেছিস ভালই করেছিস।
ইসমাইল সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, যা করেছিস ভালই করেছিস।
তুমি কিছু না জেনেই বলেছ। মামা মন দিয়ে শোন, মনিকা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে টগরের বাবার খুব ভাব ছিল। মেয়েটি দারুণ রূপবতী এবং চমৎকার মেয়ে। মামা তুমি কী আমার কথা শুনিছ?
ইসমাইল সাহেব জবাব দিলেন না। রানু, দেখল তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। গাছে গাছে পাখ-পাখালি ডাকছে। আকাশে মেঘ। আজও বোধ হয় ঝড়বৃষ্টি হবে। রানু ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।