6 of 11

২৮.১৫ হাজরা মহাশয়

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

হাজরা মহাশয়

হাজরা মহাশয় এখানে দুই বৎসর আছেন। তিনি ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুরের নিকটবর্তী সিওড় গ্রামে প্রথম তাঁহাকে দর্শন করেন, ১৮৮০ খ্রী:। এই গ্রামে ঠাকুরের ভাগিনেয়, পিসতুতো ভগিনী হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র, শ্রীযুক্ত হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের বাস। ঠাকুর তখন হৃদয়ের বাটীতে অবস্থিতি করিতেছিলেন।

সিওড়ের নিকটবর্তী মরাগোড় গ্রামে হাজরা মহাশয়ের নিবাস। তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি, জমি প্রভৃতি একরকম আছে। পরিবার, সন্তান-সন্ততি আছে। একরকম চলিয়া যায়। কিছু দেনাও আছে, আন্দাজ হাজার টাকা।

যৌবনকাল হইতে তাঁহার বৈরাগ্যের ভাব — কোথায় সাধু, কোথায় ভক্ত, খুঁজিয়া বেড়ান। যখন দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে প্রথম আসেন ও সেখানে থাকিতে চান ঠাকুর তাঁহার ভক্তিভাব দেখিয়া ও দেশের পরিচিত বলিয়া, ওখানে যত্ন করিয়া নিজের কাছে রাখেন।

হাজরার জ্ঞানীর ভাব। ঠাকুরের ভক্তিভাব ও ছোকরাদের জন্য ব্যাকুলতা পছন্দ করেন না। মাঝে মাঝে তাঁহাকে মহাপুরুষ বলিয়া মনে করেন। আবার কখনও সামান্য বলিয়া জ্ঞান করেন।

তিনি ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় আসন করিয়াছেন। সেইখানেই মালা লইয়া অনেক জপ করেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরা বেশি জপ করেন না বলিয়া লোকের কাছে নিন্দা করেন।

তিনি আচারের বড় পক্ষপাতী। আচার আচার করিয়া তাঁহার একপ্রকার শুচিবাই হইয়াছে। তাঁহার বয়স প্রায় ৩৮ হইবে।

হাজরা মহাশয় ঘরে প্রবেশ করিলেন। ঠাকুর আবার ঈষৎ ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন ও কথা কহিতেছেন।

[ঈশ্বর প্রার্থনা কি শুনেন? ঈশ্বরের জন্য ক্রন্দন কর, শুনবেন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — তুমি যা করছ তা ঠিক, — কিন্তু ঠিক ঠিক বসছে না।

“কারু নিন্দা করো না — পোকাটিরও না। তুমি নিজেই তো বল, লোমস মুনির কথা। যেমন ভক্তি প্রার্থনা করবে তেমনি ওটাও বলবে — ‘যেন কারু নিন্দা না করি’।”

হাজরা — (ভক্তি) প্রার্থনা করলে তিনি শুনবেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — এক — শো — বার! যদি ঠিক হয় — যদি আন্তরিক হয়। বিষয়ী লোক যেমন ছেলে কি স্ত্রীর জন্য কাঁদে সেরূপ ঈশ্বরের জন্য কই কাঁদে?

[পূর্বকথা — স্ত্রীর অসুখে কামারপুকুরবাসীর থর থর কম্প ]

“ও-দেশে একজনের পরিবারে অসুখ হয়েছিল। সারবে না মনে করে লোকটা থর থর করে কাঁপতে লাগলো — অজ্ঞান হয় আর কি!

“এরূপ ঈশ্বরের জন্য কে হচ্ছে!”

হাজরা ঠাকুরের পায়ের ধুলা লইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সঙ্কুচিত হইয়া) — “উগুনো কি?”

হাজরা — যাঁর কাছে আমি রয়েছি তাঁর পায়ের ধুলা লব না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরকে তুষ্ট কর, সকলেই তুষ্ট হবে। তস্মিন্‌ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্‌। ঠাকুর যখন দ্রৌপদীর হাঁড়ির শাক খেয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত হয়েছি, তখন জগৎসুদ্ধ জীব তৃপ্ত — হেউ-ঢেউ হয়েছিল! কই মুনিরা খেলে কি জগৎ তুষ্ট হয়েছিল — হেউ-ঢেউ হয়েছিল?

ঠাকুর লোকশিক্ষার্থ কিছু কর্ম করতে হয়, এই কথা বলিতেছেন।

[পূর্বকথা — বটতলার সাধুর গুরুপাদুকা ও শালগ্রামপূজা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — জ্ঞানলাভের পরও লোকশিক্ষার জন্যে পূজাদি কর্ম রাখে।

“আমি কালীঘরে যাই, আবার ঘরের এই সব পট নমস্কার করি; তাই সকলে করে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে যদি না করে তাহলে মন হুস্‌ফুস্‌ করবে।

“বটতলায় সন্ন্যাসীকে দেখলাম। যে আসনে গুরুপাদুকা রেখেছে তারই উপরে শালগ্রামও রেখেছে! ও পূজা করছে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি এতদূর জ্ঞান হয়ে থাকে তবে পূজা করা কেন? সন্ন্যাসী বললে, — সবই করা যাচ্ছে — এ ও একটা করলাম। কখনও ফুলটা এ-পায়ে দিলাম; আবার কখনও একটা ফুল ও-পায়ে দিলাম।’

“দেহ থাকতে কর্মত্যাগ করবার জো নাই — পাঁক থাকতে ভুড়ভুড়ি হবেই।”

[The three stages — শাস্ত্র, গুরুমুখ, সাধনা; Goal প্রত্যক্ষ ]

(হাজরাকে) — “এক জ্ঞান থাকলেই আনেক জ্ঞানও আছে। শুধু শাস্ত্র পড়ে কি হবে?

“শাস্ত্রে বালিতে চিনিতে মিশেল আছে — চিনিটুকু লওয়া বড় কঠিন। তাই শাস্ত্রের মর্ম সাধুমুখে গুরুমুখে শুনে নিতে হয়। তখন আর গ্রন্থের কি দরকার?

“চিঠিতে খবর এসেছে, — ‘পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবা — আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ এখন চিঠিখানি হারিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চারদিকে খোঁজে। অনেক খোঁজবার পর চিঠিখানি পেলে, পড়ে দেখে, — লিখেছে — ‘পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ তখন চিঠিখানি আবার ফেলে দেয়। আর কি দরকার? এখন সন্দেশ আর কাপড়ের যোগাড় করলেই হল।

(মুখুজ্জে, বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — “সব সন্ধান জেনে তারপর ডুব দাও। পুকুরের অমুক জায়গায় ঘটিটা পড়ে গেছে, জায়গাটি ঠিক করে দেখে নিয়ে সেইখানে ডুব দিতে হয়।

“শাস্ত্রের মর্ম গুরুমুখে শুনে নিয়ে, তারপর সাধন করতে হয়। এই সাধন ঠিক হলে তবে প্রত্যক্ষ দর্শন হয়।

“ডুব দিলে তবে তো ঠিক ঠিক সাধন হয়! বসে বসে শাস্ত্রের কথা নিয়ে কেবল বিচার করলে কি হবে? শ্যালারা পথে যাবারই কথা — ওই নিয়ে মরছে — মর শ্যালারা, ডুব দেয় না!

“যদি বল ডুব দিলেও হাঙ্গর-কুমিরের ভয় আছে — কাম-ক্রোধাদির ভয় আছে। — হলুদ মেখে ডুব দাও — তারা কাছে আসতে পারবে না। বিবেক-বৈরাগ্য হলুদ।”


ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ। গীতা, ১৮।১১
যস্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ৷৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *