চর্তুদশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর
ছোকরা ভক্তদের সঙ্গে আনন্দ — মা-কালীর আরতিদর্শন ও চামর ব্যজন —
মায়ে-পোয়ে কথা — “কেন বিচার করাও”
বেলা পাঁচটা। ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। বাবুরাম, লাটু। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি) — কেন একঘেয়ে হব? ওরা বৈষ্ণব আর গোঁড়া, মনে করে আমাদের মতই ঠিক, আর সব ভুল। যে কথা বলেছি, খুব লেগেছে। (সহাস্যে) হাতির মাথায় অঙ্কুশ মারতে হয়। মাথায় নাকি ওদের কোষ থাকে। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর এইবার ছোকরাদের সঙ্গে ফষ্টিনাষ্টি করতে লাগলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আমি এদের (ছোকরাদের) কেবল নিরামিষ দিই না। মাঝে মাঝে আঁশ ধোয়া জল একটু একটু দিই। তা না হলে আসবে কেন।
মুখুজ্জেরা বারান্দা হইতে চলিয়া গেলেন। বাগানে একটু বেড়াইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আমি জপ … করতাম। সমাধি হয়ে যেত, কেমন এর ভাব?
মাস্টার (গম্ভীরবাবে) — আজ্ঞা, বেশ!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) সাধু! সাধু! — কিন্তু ওরা (মুখুজ্জেরা) কি মনে করবে?
মাস্টার — কেন কাপ্তেন তো বলেছিলেন, আপনার বালকের অবস্থা। ঈশ্বর-দর্শন করলে বালকের অবস্থা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা। পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি করে, হয়তো খেউর মুখ দে বেরোয়। আর যুবা অবস্থায় সিংহের ন্যায় লোকশিক্ষা দেয়।
“তুমি না হয় ওদের (মুখুজ্জেদের) বুঝিয়ে দিও।”
মাস্টার — আজ্ঞা, আমার বোঝাতে হবে না। ওরা কি আর জানে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ ছোকরাদের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করিয়া একজন ভক্তকে বলিতেছেন, “আজ অমাবস্যা, মার ঘরে যেও!”
সন্ধ্যার পর আরতির শব্দ শুনা যাইতেছে। ঠাকুর বাবুরামকে বলিতেছেন, “চল রে চল। কালীঘরে!” ঠাকুর বাবুরামের সঙ্গে যাইতেছেন — মাস্টারও সঙ্গে আছেন। হরিশ বারান্দায় বসিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “এর আবার বুঝি ভাব লাগলো।ম”
উঠান দিয়া চলিতে চলিতে শ্রীশ্রীরাধাকান্তের আরতি একটু দেখিলেন। তৎপরেই মা-কালীর মন্দিরের অভিমুখে যাইতেছেন। যাইতে যাইতে হাত তুলিয়া জগন্মাতাকে ডাকিতেছেন — “ও মা! ও মা! ব্রহ্মময়ী!” মন্দিরের সম্মুখের চাতালে উপস্থিত হইয়া মাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। মার আরতি হইতেছে। ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করিলেন ও চামর লইয়া ব্যজন করিতে লাগিলেন।
আরতি সমাপ্ত হইল। যাহারা আরতি দেখিতেছিলেন এককালে সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও মন্দিরের বাহিরে আসিয়া প্রণাম করিলেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তেরাও প্রণাম করিলেন।
আজ অমাবস্যা। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। গরগর মাতোয়ারা! বাবুরামের হাত ধরিয়া মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে নিজের ঘরে ফিরিলেন।
ঘরের পশ্চিমের গোল বারান্দায় ফরাশ একটি আলো জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। ঠাকুর সেই বারান্দায় আসিয়া একটু বসিলেন, মুখে ‘হরি ওঁ! হরি ওঁ! হরি ওঁ’! ও তন্ত্রোক্ত নানাবিধ বীজমন্ত্র।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর ঘরের মধ্যে নিজের আসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়াছেন।
[Origin of Language — The Philosophy of Prayer]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া মার সহিত কথা কহিতেছেন — বলিতেছেন, “মা, আমি বলব তবে তুমি করবে — এ কথাই নয়।
“কথা কওয়া কি? — কেবল ঈশারা বই তো নয়! কেউ বলছে, ‘আমি খাব’, — আবার কেউ বলছে, ‘যা! আমি শুনব না।’
“আচ্ছা, মা! যদি না বলতাম ‘আমি খাব’ তাহলে কি যেমন খিদে তেমনি খিদে থাকত না? তোমাকে বললেই তুমি শুনবে, আর ভিতরটা শুধু ব্যাকুল হলে তুমি শুনবে না, — তা কখন হতে পারে।
“তুমি যা আছ তাই আছ — তবে বলি কেন — প্রার্থনা করি কেন?
“ও! যেমন করাও তেমনি করি।
“যা! সব গোল হয়ে গেল! — কেন বিচার করাও!”
ঠাকুর ঈশ্বরের সহিত কথা কহিতেছেন। — ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
[সংস্কার ও তপস্যার প্রয়োজন — ভক্তদিগকে শিক্ষা — সাধুসেবা ]
এইবার ভক্তদের উপর ঠাকুরের দৃষ্টি পড়িয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — তাঁকে লাভ করতে হলে সংস্কার দরকার। একটু কিছু করে থাকা চাই। তপস্যা। তা এ জন্মেই হোক আর পূর্বজন্মেই হোক।
“দ্রৌপদীর যখন বস্ত্রহরণ করছিল, তাঁর ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন শুনে ঠাকুর দেখা দিলেন। আর বললেন — ‘তুমি যদি কারুকে কখনও বস্ত্র দান করে থাক, তো মনে করে দেখ — তবে লজ্জা নিবারণ হবে।’ দ্রৌপদী বললেন, ‘হাঁ, মনে পড়েছে। একজন ঋষি স্নান কচ্ছিলেন, — তাঁর কপ্নি ভেসে গিছলো। আমি নিজের কাপড়ের আধখানা ছিঁড়ে তাকে দিছলাম। ঠাকুর বললেন — তবে আর তোমার ভয় নাই’।”
মাস্টার ঠাকুরের আসনের পূর্বদিকে পাপোশে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — “তুমি ওটা বুঝেছ।”
মাস্টার — আজ্ঞা, সংস্কারের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — একবার বল দেখি, কি বললাম।
মাস্টার — দ্রৌপদী নাইতে গিছলেন ইত্যাদি। (হাজরার প্রবেশ)