দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর
শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত — ঠাকুরের নানা সাধ
[পূর্বকথা — প্রথম কলিকাতায় নাথের বাগানে — গঙ্গাস্নান ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগ লালসা থাকা ভাল নয়। আমি তাই জন্য যা যা মনে উঠতো আমনি করে নিতাম।
“বড়বাজারের রঙকরা সন্দেশ দেখে খেতে ইচ্ছা হল। এরা আনিয়া দিলে। খুব খেলুম, — তারপর অসুখ।
“ছেলেবেলা গঙ্গা নাইবার সময়, তখন নাথের বাগানে, একটি ছেলের কোমরে সোনার গোট দেখেছিলাম। এই অবস্থার পর সেই গোট পরতে সাধ হল। তা বেশিক্ষণ রাখবার জো নাই, — গোট পরে ভিতর দিয়ে সিড়সিড় করে উপরে বায়ু উঠতে লাগল — সোনা গায়ে ঠেকেছে কি না? একটু রেখেই খুলে ফেলতে হল। তা না হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
“ধনেখালির খইচুর, খানাকুল কৃষ্ণনগরের সরভাজা, তাও খেতে সাধ হয়েছিল।” (সকলের হাস্য)
[পূর্বকথা — শম্ভুর ও রাজনারায়ণের চন্ডী শ্রবণ — ঠাকুরের সাধুসেবা ]
“শম্ভুর চন্ডীর গান শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল! সে গান শোনার পর আবার রাজনারায়ণের চন্ডী শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল। তাও শোনা হল।
“অনেক সাধুরা সে সময়ে আসত। তা সাধ হল, তাদের সেবার জন্য আলাদা একটি ভাঁড়ার হয়। সেজোবাবু তাই করে দিলে। সেই ভাঁড়ার থেকে সাধুদের সিদে কাঠ, এ-সব দেওয়া হত।
“একবার মনে উঠল যে খুব ভাল জরির সাজ পরব। আর রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সেজোবাবু নূতন সাজ, গুড়গুড়ি, সব পাঠিয়ে দিলে। সাজ পরা হল। গুড়গুড়ি নানারকম করে টানতে লাগলুম। একবার এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে, — উঁচু থেকে নিচু থেকে। তখন বললাম, মন এর নাম রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাওয়া! এই বলে গুড়গুড়ি ত্যাগ হয়ে গেল। সাজগুলো খানিক পরে খুলে ফেললাম, — পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম — আর তার উপর থু থু করতে লাগলাম — বললাম, এর নাম সাজ! এই সাজে রজোগুণ হয়!”
[বৃন্দাবনে রাখাল ও বলরাম — পূর্বকথা — রাখালের প্রথম ভাব ১৮৮১ ]
বলরামের সহিত রাখাল বৃন্দাবনে আছেন। প্রথম প্রথম বৃন্দাবনের খুব সুখ্যাত করিয়া আর বর্ণনা করিয়া পত্রাদি লিখিতেন। মাস্টারকে পত্র লিখিয়াছিলেন, ‘এ বড় উত্তম স্থান, আপনি আসবেন, — ময়ূর-ময়ূরী সব নৃত্য করছে — আর নৃত্যগীত, সর্বদাই আনন্দ!’ তারপর রাখালের অসুখ হইয়াছে — বৃন্দাবনের জ্বর। ঠাকুর শুনিয়া বড়ই চিন্তিত আছেন। তাঁর জন্য চন্ডীর কাছে মানসিক করেছেন। ঠাকুর রাখালের কথা কহিতেছেন — “এইখানে বসে পা টিপতে টিপতে রাখালের প্রথম ভাব হয়েছিল। একজন ভাগবতের পণ্ডিত এই ঘরে বসে ভাগবতের কথা বলছিল। সেই সকল কথা শুনতে শুনতে রাখাল মাঝে মাঝে শিউরে উঠতে লাগল; তারপর একেবারে স্থির!
“দ্বিতীয় বার ভাব বলরামের বাটীতে — ভাবেতে শুয়ে পড়েছিল।
“রাখালের সাকারের ঘর — নিরাকারের কথা শুনলে উঠে যাবে।
“তার জন্য চন্ডীকে মানলুম। সে যে আমার উপর সব নির্ভর করেছিল — বাড়িঘর সব ছেড়ে! তার পরিবারের কাছে তাকে আমিই পাঠিয়ে দিতাম — একটু ভোগের বাকী ছিল।
বৃন্দাবন থেকে এঁকে লিখেছে, এ বেশ জায়গা — ময়ূর-ময়ূরী নৃত্য করছে — এখন ময়ূর-ময়ূরী বড়ই মুশকিলে ফেলেছে!
“সেখানে বলরামের সঙ্গে আছে! বলরামের কি স্বভাব! আমার জন্য ওদেশে (উড়িষ্যায় কোঠারে) যায় না। ভাই মাসহারা বন্ধ করেছিল আর বলে পাঠিয়েছিল, ‘তুমি এখানে এসে থাকো, মিছামিছি কেন অত টাকা খরচ কর।’ — তা সে শুনে নাই — আমাকে দেখবে বলে।
“কি স্বভাব! — রাতদিন কেবল ঠাকুর লয়ে; — মালীরা ফুলের মালাই গাঁথছে! টাকা বাঁচবে বলে বৃন্দাবনে চার মাস থাকবে। দুশ টাকা মাসহারা পায়।“
[পূর্বকথা — নরেন্দ্রের জন্য ক্রন্দন — নরেন্দ্রের প্রথম দর্শন ১৮৮১ ]
“ছোকরাদের ভালবাসি কেন? — ওদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন এখনও ঢুকে নাই। আমি ওদের নিত্যসিদ্ধ দেখি!
“নরেন্দ্র যখন প্রথম এলো — ময়লা একখানা চাদর গায়ে, — কিন্তু চোখ মুখ দেখে বোধ হল ভিতরে কিছু আছে। তখন বেশি গান জানতো না। দুই-একটা গাইলে,:
‘মন চল নিজ নিকেতনে’ আর ‘যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।’
“যখন আসত, — একঘর লোক — তবু ওর দিক পানে চেয়েই কথা কইতাম। ও বলত, ‘এঁদের সঙ্গে কথা কন’, — তবে কইতাম।
“যদু মল্লিকের বাগানে কাঁদতুম, — ওকে দেখবার জন্য পাগল হয়েছিলাম। এখানে ভোলানাথের হাত ধরে কান্না! — ভোলানাথ বললে, ‘একটা কায়েতের ছেলের জন্য মশায় আপনার এরূপ করা উচিত নয়।’ মোটা বামুন একদিন হাতজোড় করে বললে, ‘মশায়, ওর সামান্য পড়াশুনো, ওর জন্য আপনি এত অধীর কেন হন?’
“ভবনাথ নরেন্দ্রের জুড়ি — দুজনে যেন স্ত্রী-পুরুষ! তাই ভবনাথকে নরেন্দ্রের কাছে বাসা করতে বললুম। ওরা দুজনেই অরূপের ঘর।”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম, লোকশিক্ষার্থ ত্যাগ — ঘোষপাড়ার সাধনের কথা ]
“আমি ছোকরাদের মেয়েদের কাছে বেশি থাকতে বা আনাগোনা করতে বারণ করে দিই।
“হরিপদ এক ঘোষপাড়ার মাগীর পাল্লায় পড়েছে। সে বাৎসল্যভাব করে। হরিপদ ছেলেমানুষ, কিছু বোঝে না। ওরা ছোকরা দেখলে ওইরকম করে। শুমলাম হরিপদ নাকি ওর কোলে শোয়। আর সে হাতে করে তাকে খাবার খাইয়ে দেয়। আমি ওকে বলে দিব — ও-সব ভাল নয়। ওই বাৎসল্যভাব থেকেই আবার তাচ্ছল্যভাব হয়।
“ওদের বর্তমানের সাধন — মানুষ নিয়ে সাধন। মানুষকে মনে করে শ্রীকৃষ্ণ। ওরা বলে ‘রাগকৃষ্ণ’। গুরু জিজ্ঞাসা করে, ‘রাগকৃষ্ণ পেয়েছিস?’ সে বলে ‘হাঁ, পেয়েছি।’
“সেদিন সে মাগী এসেছিল। তার চাহুনির রকম দেখলাম, বড় ভাল নয়। তারি ভাবে বললাম, ‘হরিপদকে নিয়ে যেমন কচ্চো কর — কিন্তু অন্যায় ভাব এনো না।’
“ছোকরাদের সাধনার অবস্থা। এখন কেবল ত্যাগ। সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। আমি ওদের বলি, মেয়েমানুষ ভক্ত হলেও তাদের সঙ্গে বসে কথা কবে না; দাঁড়িয়ে একটু কথা কবে। সিদ্ধ হলেও এইরূপ করতে হয় — নিজের সাবধানের জন্য, — আর লোকশিক্ষার জন্য। আমিও মেয়েরা এলে একটু পরে বলি, তোমরা ঠাকুর দেখগে। তাতে যদি না উঠে, নিজে উঠে পড়ি। আমার দেখে আবার সবাই শিখবে।”
[পূর্বকথা — ফুলুই শ্যামবাজার দর্শন ১৮৮০ — অবতারের আকর্ষণ ]
“আচ্ছা, এই যে সব ছেলেরা আসছে, আর তোমরা সব আসছো, এর মানে কি? এর (অর্থাৎ আমার) ভিতরে অবশ্য কিছু আছে, তা না হলে টান হয় কেমন করে — কেন আকর্ষণ হয়?
“ও-দেশে যখন হৃদের বাড়িতে (কামারপুকুরের নিকট, সিওড়ে) ছিলাম। তখন শ্যামবাজারে নিয়ে গেল। বুঝলাম গৌরাঙ্গভক্ত। গাঁয়ে ঢোকবার আগে দেখিয়ে দিলে। দেখলাম গৌরাঙ্গ! এমনি আকর্ষণ — সাতদিন সাতরাত লোকের ভিড়! কেবল কীর্তন আর নৃত্য। পাঁচিলে লোক! গাছে লোক!
“নটবর গোস্বামির বাড়িতে ছিলাম। সেখানে রাতদিন ভিড়। আমি আবার পালিয়ে গিয়ে এক তাঁতীর ঘরে সকালে গিয়ে বসতাম। সেখানে আবার দেখি, খানিক পরে সব গিয়েছে। সব খোল-করতাল নিয়ে গেছে! — আবার ‘তাকুটী! তাকুটী!’ করছে। খাওয়া দাওয়া বেলা তিনটার সময় হতো!
“রব উঠে গেল — সাতবার মরে, সাতবার বাঁচে, এমন এক লোক এসেছে! পাছে আমার সর্দিগর্মি হয়, হৃদে মাঠে টেনে নিয়ে যেতো; — সেখানে আবার পিঁপড়ের সার! আবার খোল-করতাল। — তাকুটী! তাকুটী! হৃদে বকলে, আর বললে, ‘আমরা কি কখনও কীর্তন শুনি নাই?’
“সেখানকার গোঁসাইরা ঝগড়া করতে এসেছিল। মনে করেছিল, আমরা বুঝি তাদের পাওনাগণ্ডা নিতে এসেছি। দেখলে, আমি একখানা কাপড় কি একগাছা সুতাও লই নাই। কে বলেছিল ‘ব্রহ্মজ্ঞানী’। তাই গোঁসাইরা বিড়তে এসেছিল। একজন জিজ্ঞাসা করলে, ‘এঁর মালা তিলক, নাই কেন?’ তারাই একজন বললে, ‘নারকেলের বেল্লো আপনা-আপনি খসে গেছে’। ‘নারকেলের বেল্লো’ ও কথাটি ওইখানেই শিখেছি। জ্ঞান হলে উপাধি আপনি খসে পড়ে যায়।
“দূর গাঁ থেকে লোক এসে জমা হতো। তারা রাত্রে থাকত। যে বাড়িতে ছিলাম, তার উঠানে রাত্রে মাগীরা অনেক সব শুয়ে আছে। হৃদে প্রস্রাব করতে রাতে বাহিরে যাচ্ছিল, তা বলে, ‘এইখানেই (উঠানে) করো।’
“আকর্ষণ কাকে বলে, ওইখানেই (শ্যামবাজারে) বুঝলাম। হরিলীলায় যোগমায়ার সাহায্যে আকর্ষণ হয়, যেন ভেলকি লেগে যায়!”