দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর
শ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্বধর্ম-সমন্বয়
[Why all scriptures — all Religions — are true]
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখছো কত রকম মত! মত, পথ। অনন্ত মত অনন্ত পথ!
ভবনাথ — এখন উপায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ — একটা জোর করে ধরতে হয়। ছাদে গেলে পাকা সিঁড়িতে উঠা যায়, একখানা মইয়ে উঠা যায়, দড়ির সিঁড়িতে উঠা যায়; একগাছা দড়ি দিয়ে, একগাছা বাঁশ দিয়ে উঠা যায়। কিন্তু এতে খানিকটা পা, ওতে খানিকটা পা দিলে হয় না। একটা দৃঢ় করে ধরতে হয়। ঈশ্বরলাভ করতে হলে, একটা পথ জোর করে ধরে যেতে হয়।
“আর সব মতকে এক-একটি পথ বলে জানবে। আমার ঠিক পথ, আর সকলের মিথ্যা — এরূপ বোধ না হয়। বিদ্বেষভাব না হয়।”
[“আমি কোন্ পথের?” কেশব, শশধর ও বিজয়ের মত ]
“আচ্ছা, আমি কোন্ পথের? কেশব সেন বলত, আপনি আমাদেরই মতের, — নিরাকারে আসছেন। শশধর বলে, ইনি আমাদের। বিজয়ও (গোস্বামী) বলে, ইনি আমাদের মতের লোক।”
ঠাকুর কি বলিতেছেন যে, আমি সব পথ দিয়াই ভগবানের নিকট পৌঁছিয়াছি — তাই সব পথের খবর জানি? আর সকল ধর্মের লোক আমার কাছে এসে শান্তি পাবে?
ঠাকুর পঞ্চবটীর দিকে মাস্টার প্রভৃতি দু-একটি ভক্তের সঙ্গে যাইতেছেন — মুখ ধুইবেন। বেলা বারটা, এইবার বান আসিবে। তাই শুনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীর পথে একটু অপেক্ষা করিতেছেন।
[ভাব মহাভাবের গূঢ় তত্ত্ব — গঙ্গার জোয়ার-ভাটা দর্শন ]
ভক্তদের বলিতেছেন — “জোয়ার-ভাটা কি আশ্চর্য!
“কিন্তু একটি দেখো, — সমুদ্রের কাছে নদীর ভিতর জোয়ার-ভাটা খেলে। সমুদ্র থেকে অনেক দূর হলে একটানা হয়ে যায়। এর মানে কি? — ওই ভাবটা আরোপ কর। যারা ঈশ্বরের খুব কাছে, তাদের ভিতরই ভক্তি, ভাব — এই সব হয়; আবার দু-একজনের (ঈশ্বরকোটির) মহাভাব, প্রেম — এ-সব হয়।
(মাস্টারের প্রতি) — “আচ্ছা, জোয়ার-ভাটা কেন হয়?”
মাস্টার — ইংরেজী জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলে যে, সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে ওইরূপ হয়।
এই বলিয়া মাস্টার মাটিতে অঙ্ক পাতিয়া পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের গতি দেখাইতেছেন। ঠাকুর একটু দেখিয়াই বলিতেছেন, “থাক, ওতে আমার মাথা ঝনঝন করে!”
কথা কহিতে কহিতে বান ডাকিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে জলোচ্ছ্বাস — শব্দ হইতে লাগিল। ঠাকুরবাড়ির তীরভূমি আঘাত করিতে করিতে উত্তর দিকে বান চলিয়া গেল।
ঠাকুর একদৃষ্টে দেখিতেছেন। দূরের নৌকা দেখিয়া বালকের ন্যায় বলিয়া উঠিলেন — দেখো, দেখো, ওই নৌকাখানি বা কি হয়!
ঠাকুর পঞ্চবটীমূলে মাস্টারের সহিত কথা কহিতে কহিতে আসিয়া পড়িয়াছেন। একটি ছাতা সঙ্গে, সেইটি পঞ্চবটীর চাতালে রাখিয়া দিলেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণের মতো দেখেন, তাই বড় ভালবাসেন। নারাণ ইস্কুলে পড়ে, এবার তাহারই কথা কহিতেছেন।
[মাস্টারের শিক্ষা, টাকার সদ্ব্যবহার — নারাণের জন্য চিন্তা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — নারাণের কেমন স্বভাব দেখেছ? সকলের সঙ্গে মিশতে পারে — ছেলে-বুড়ো সকলের সঙ্গে! এটি বিশেষ শক্তি না হলে হয় না। আর সব্বাই তাকে ভালবাসে। আচ্ছা, সে ঠিক সরল কি?
মাস্টার — আজ্ঞা, খুব সরল বলে বোধ হয়
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ওখানে নাকি যায়?
মাস্টার — আজ্ঞা, দু-একবার গিছল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — একটি টাকা তুমি তাকে দেবে? না কালীকে বলব?
মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ তো, আমি দিব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বেশ তো — ঈশ্বরে যাদের অনুরাগ আছে, তাদের দেওয়া ভাল। টাকার সদ্ব্যবহার হয়। সব সংসারে দিলে কি হবে?
কিশোরীর ছেলেপুলে হয়েছে। কম মাহিনা — চলে না। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “নারাণ বলেছিল, কিশোরীর একটা কর্ম করে দেব। নারাণকে একবার মনে করে দিও না।”
মাস্টার পঞ্চবটীতে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ পরে ঝাউতলা হইতে ফিরিলেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “বাহিরে একটা মাদুর পাত্তে বল তো। আমি একটু পরে যাচ্ছি — একটু শোব।”
ঠাকুর ঘরে পৌঁছিয়া বলিতেছেন, “তোমাদের কারুরই ছাতাটা আনতে মনে নাই। (সকলের হাস্য) ব্যস্তবাগীশ লোক নিজের কাছের জিনিসও দেখতে পায় না! একজন আর-একটি লোকের বাড়িতে টিকে ধরাতে গিছল, কিন্তু হাতে লণ্ঠন জ্বলছে!
“একজন গামছা খুঁজে খুঁজে তারপর দেখে, কাঁধেতেই রয়েছে!”
[ঠাকুরের মধ্যাহ্ন-সেবা ও বাবুরামাদি সাঙ্গোপাঙ্গ ]
ঠাকুরের জন্য মা-কালীর অন্নপ্রসাদ আনা হইল। ঠাকুর সেবা করিবেন। বেলা প্রায় একটা। আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিবেন। ভক্তরা তবুও ঘরে সব বসিয়া আছেন। বুঝাইয়া বলার পর বাহিরে গিয়া বসিলেন। হরিশ, নিরঞ্জন, হরিপদ রান্না-বাড়ি গিয়া প্রসাদ পাইবেন। ঠাকুর হরিশকে বলিতেছেন, তোদের জন্য আমসত্ত্ব নিয়ে যাস।
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন, বাবুরাম, কাছে একটু আয় না? বাবুরাম বলিলেন, আমি পান সাজছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন — রেখে দে পান সাজা।
ঠাকুর বিশ্রাম করিতেছেন। এদিকে বকুলতলায় ও পঞ্চবটীতলায় কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন, — মুখুজ্জেরা, চুনিলাল, হরিপদ, ভবনাথ, তারক। তারক শ্রীবৃন্দাবন হইতে সবে ফিরিয়াছেন। ভক্তরা তাঁর কাছে বৃন্দাবনের গল্প শুনিতেছেন। তারক নিত্যগোপালের সহিত বৃন্দাবনে এতদিন ছিলেন।