২৮. স্নেইপস ওয়ারস্ট মেমরি

২৮. স্নেইপস ওয়ারস্ট মেমরি

মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকের আদেশ

ডলোরেস জেইন আমব্রিজকে (উচ্চ তদন্তকারী) অ্যালবাস ডাম্বলডোর-এর বদলে
হোগওয়ার্টস স্কুল অব উইচ ক্রাফট অ্যান্ড উইজার্ডরির প্রধান নিযুক্ত হলেন।

উপরোক্ত আদেশ এডুকেশনাল ডিক্রি নম্বর আঠাশ অনুসারে প্রদত্ত হইল।
স্বাক্ষর
কর্নেলিয়াস অসওয়াল্ড ফাজ, মিনিস্টার ফর ম্যাজিক

রাতারাতি নোটিশটা স্কুলের বিভিন্ন জায়গায় আটকে দেওয়া হলেও, ক্যাসেলের একজনও জানতে পারলো না যে ডাম্বলডোর কেমন করে একা দুজন অরর, উচ্চ তদন্তকারী, মিনিস্ট্র অব ম্যাজিকের মন্ত্রী এবং তার অধীনস্থ সহকারীকে পরাস্ত করেছেন। হ্যারি ক্যাসেলের কোথায় গেলো না গেলে তাতে কিছু আসে যায় না, প্রধান বিষয় হচ্ছে ডাম্বলডোর এবং যদিও মূল ঘটনার কিছু অংশ কানাঘুষোতে লোকেরা শুনলো (হ্যারির কানে এলো এক দ্বিতীয় বার্ষিকের ছাত্রী আরেকজন ছাত্রীকে বলছে ফাজ এখন সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে আছেন, মাথায় একটা বড় কুমড়ো গজিয়েছে) বাকি অংশটা কতোটা যে সঠিক সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। সকলেই জানে, যেমন হ্যারি আর মেরিয়েটা জানে। ওরা সেই সময় ডাম্বলডোরের অফিসে যা কিছু ঘটেছিলো তার সবই দেখেছিলো। মেরিয়েটা এখন হাসপাতালে। হ্যারিকে সকলে অনুরোধ করতে শুরু করেছে আসলে কি হয়েছিলো তার সঠিক বিবরণ দেবার জন্য।

হ্যারি সম্বন্ধে খবরাখবর শোনার পর, হারবোলজি ক্লাস থেকে ফিরে এরনি ম্যাকমিলান পুরোদস্তুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, সব শুনেছি, সব জেনেছি। ভেবোনা ডাম্বলডোরের ফিরে আসতে আর দেরি নেই। কতদিন আর আটকে রাখতে পারবে, কখনও পারেনি এবারেও পারবে না। আমরা সেকেন্ড ইয়ারে এখন তাকে দরকার। হ্যারি, রন, হারমিওন যাতে শুনতে পায় তেমনিভাবে তাদের কাছে এসে আস্তে আস্তে বললো, ফ্যাট ফ্রিয়ার বলেছে, গত রাতে আমব্রিজ ক্যাসেল মার্চ করার পর ডাম্বলডোরের অফিস ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করেছিলেন। তাকে ধরার জন্য ঘরে ঢোকা তো দূরের কথা গারগোইল পেরোতে পারেনি।

—হেড মাস্টারের ঘরে তার ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এরনি বোকা বোকা হাসলো, দেখে মনে হয় মহিলা একটু বদমেজাজী।

হারমিওন আর ওরা এনট্রেন্স হলে যেতে যেতে মুখ ভেংচে বললো, শুনেছি তিনি হেডমাস্টার হতে চান। সব ছাত্র-ছাত্রী, স্টাফেদের মাথার ওপোর দিনরাত লাঠি ঘোরানো। মূর্খ, ক্ষমতালোভী, ব্যাঙ মুখী মহিলা।

ঠিক সেই সময়ে ড্রাকো ম্যালফয়, ক্র্যাবে আর গোয়েলে পেছনের দরজা খুলে আসরে দাঁড়ালো। ওর মুখটা পরের অনিষ্ঠ করার জন্য জ্বল জ্বল করছে।

–বাকি কথাটা খতম করো গ্রেঞ্জার! আসলে আমি গ্রিফিন্ডর আর হাফ লপাফদের কিছু পয়েন্ট ছাঁটাই করতে ইচ্ছুক। ম্যালফয় আড়মোড়া ভেঙে টেনে টেনে বললো।

এরনি তৎক্ষণাৎ বললো, পয়েন্ট ছাঁটাই করার তুমি কে হে? মাস্টার মশাইরা ছাড়া কেউ পয়েন্ট দিতে বা ছাঁটাই করতে পারেন না।

রন স্বাভাবিকভাবে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললো, ওহে মনে রেখে আমরা প্রিফেক্ট? উইসলি কিং মুখ ভঙ্গি করে বললো–সেটা আমি ভালো করেই জানি। ওর কথা শুনে ম্যালফয়, ক্র্যাবে, গোয়েলে ওরই মতো হাসলো। কিন্তু তদন্তকারী দলের সদস্যরা।

হারমিওন ভুরু কুঁচকে বললো–মানে?

বুকে আঁটা একটা রূপোর চাকতি দেখিয়ে ম্যালফয় বললো, দ্য ইনকুইঞ্জিটোরিয়ল স্কোয়াড।

হারমিওন দেখলো ওর রোবসের বুকে রূপোর আই চাকতি, ঠিক প্রিফেক্ট ব্যাজের নিচে আটকানো রয়েছে।

কিছু ছাত্রদের নিয়ে একটা স্কোয়াড। ওরা মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিককে আমব্রিজের হয়ে সাহায্য করবে। তো মিস গ্রেঞ্জার, নতুন হেডমিস্ট্রেসের প্রতি অবাধ্য ও রূঢ় হওয়ার জন্য তোমার পাঁচ পয়েন্ট কেটে নিলাম। ম্যাকমিলান তোমারও পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেলো কারণ আমার বিরুদ্ধাচারণ করছে। পটার আমি তোমাকে পছন্দ করি না তাই পাঁচ পয়েন্ট কাটলাম। উইসলি তোমার শার্টের বোতাম নেই, পাঁচ পয়েন্ট গেলো তার জন্য। ও হ্যাঁ ভুলে গেছি, তুমি অসম্ভব বদমেজাজী এবং মাড-ব্লাড তাই তোমার আরও দশ পয়েন্ট গেলো গ্রেঞ্জার।

রন ওর জাদুদণ্ডটা বার করতে যাচ্ছিলো বাধা দিলো হারমিওন, না, চুপ করে থাকো।

ম্যালফয় বললো, চালাকের মতো কাজ করো গ্রেঞ্জার। জেনে রেখো এখন থেকে নতুন হেড, নতুন দিনকাল। দুষ্টুমি করবে না পট্টি উইসলি কিং।

বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে ম্যালফয়, গোয়েলে আর ক্র্যাবের সঙ্গে চলে গেলো।

এরিনে বললো, ধ্যাৎ আমাদের গুল মারছে। ও কেমন করে আমাদের পয়েন্ট ছাঁটাই করবে শুনি? অসম্ভব হাসির ব্যাপার। এরকম হলে তো প্রিফেক্ট সিস্টেমকে নিচু করে দেখা হবে।

ততক্ষণে হ্যারি, রন, হারমিওন ওদের পেছনের দিকে দেয়ালের কুনুজির নিচে বিরাট আওয়ার গ্লাসে যন্ত্রচালিতের মতো ফিরে তাকালো।

হ্যারি রাগে ফেটে পড়ে বললো, ম্যালফয় আমাদের সব মিলিয়ে পঞ্চাশ পয়েন্ট কেটেছে। ওরা তখন গ্রিফিন্ডরের আওয়ার গ্লাস দেখছিলো। সেখান থেকে আরও অনেক পাথরের স্ল্যাব ওপরে উঠে গেছে।

জর্জ ব্রেকের সময় বললো, মন্টেগু আমাদের জন্য চেষ্টা করেছিলো।

–চেষ্টা করেছিলে, মানে? রন কথাটা শোনা মাত্র বললো।

ফ্রেড বললো, বোকাটা সব কথা গুছিয়ে ঠিক করে বলতে পারেনি, কেন বলতো? আমরা ওকে ফার্স্ট ফ্লোরের ভ্যানিশিং কেবিনেটে পুরে দিয়েছি।

হারমিওনের মুখ দেখে মনে হয় ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।

–তোমরা কিন্তু অসম্ভব বিপদে পড়বে!

–তাই? তবে ওই মন্টেগু ক্যাবিনেটের ভেতর থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত, ফ্রেড নির্বিকার চিত্তে বললো। তা ফিরতে দুএক সপ্তাহ লাগতে পারে। ঠিক জানি না ওকে কোথায় পাঠিয়েছি। যাকগে ভবিষ্যতে আমরা যাতে কোনও অসুবিধায় না পড়ি তার ব্যবস্থা করছি।

হারমিওন জিজ্ঞেস করলো–এর আগে ওটা করেছিলে?

–অবশ্যই আমরা করেছি, জর্জ বললো, তার জন্যে কি আমরা বহিষ্কারের শাস্তি পেয়েছি? আমরা খুব ভাল করেই জানি কততটা এগোতে পারি।

জর্জ মাথা চুলকোতে লাগলো, হ্যাঁ, এখন…।

ফ্রেড বললো, ডাম্বলডোর কোথায় গেছেন বলতে পারো?

 জর্জ বললো, শান্তি ভঙ্গের গোলমালের আশংকা করছি।

 –ঠিক বলেছো, এটাই আমাদের নতুন হেডমাস্টারের প্রাপ্য, ফ্রেড বললো। হারমিওন চেপে চেপে বললো, এসব ঝামেলার মধ্যে যাবে না, বে-আইনী কিছু করবে না। ওইসব করলে তোমাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন।

–তুমি ঠিক আমাদের কথাটা বুঝতে পারলে না হারমিওন, পেরেছো? ফ্রেড হারমিওনের মুখের দিকে তাকয়ে হাসতে হাসতে বললো, আমাদের এই স্কুলে বেশিদিন থাকতে বয়ে গেছে। ডাম্বলডোরের জন্য কিছু না করতে পারলে আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। কথাটা বলে হাতঘড়িতে সময় দেখে বললো, তো একনম্বর আইটেম আরম্ভ হতে বাকি নেই, আমাকে এখন গ্রেট হলে লাঞ্চ খেতে যেতে হবে। তোমরা যদি দুর্বল হও, টিচারও তোমাদের অনুসরণ করেন তো কিছুই করা যাবে না।

–কিছুই করা যাবে না মানে? হারমিওন জানতে ইচ্ছুক হয়ে বললো।

—দেখতে চাও তো আমার সঙ্গে দৌড়াও, জর্জ বললো।

ফ্রেড আর জর্জ পিছন ফিরে লাঞ্চ খেতে যাওয়া সিঁড়ি ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো। ওদের দেখে একটুও উদবিগ্ন মনে হলো না। এরনির ট্রান্সফিগারেশনের হোমওয়ার্ক বাকি এমন কিছু একটা বললো, তারপরই ফ্রেড জর্জর মতো ভিড়ে মিশে গেলো।

হারমিওন বললো–আমাদের ভালোর জন্য এখানে আর আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। যদি সন্দেহ করে?

–ঠিক বলেছো, রন বললো।

হ্যারি সবেমাত্র সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থোকা থোকা সাদা মেঘ দেখছে তখন কে যেন ওর পিঠে হাত রাখলো। পিছন ফিরে দেখলো কেয়ারটেকার ফিলচ! ফিলচ থেকে দূরে সরে যাবার জন্য ও কয়েকটা স্টেপ পিছিয়ে গেলো। ফিলচকে দূর থেকে দেখলে ভালো করে চেনা যায়।

–হেডমিস্ট্রেস তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন, পটার। ও ধূর্তের মতো চোখ করে বললো।

ফ্রেন্ড আর জর্জের পরিকল্পনার কথা ভেবে হ্যারি বোকার মতো সরাসরি বললো, আমি তো কিছু করিনি।

কথাটা শুনে ফিলচের মুখ চাপা হাসিতে ভরে গেলো।

–হাঃ হাঃ অপরাধ প্রীড়িত মন? ফিলচ বললো, চলো আমার সঙ্গে।

হ্যারি, রন আর হারমিওনের দিকে তাকালো। দুজনকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। ও কাঁধে ঝাঁকানি দিয়ে ফিলচের পেছনে পেছনে চললো।

হ্যারি ক্ষুধার্থ ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় ঠেলে ফিলচের সঙ্গে যেতে যেতে ওদের দিকে তাকালো।

ফিলচকে দেখে মনে হলো, খুব খুশি মনে আছে। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে প্রথম ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে ফিলচ বললো, এখানে এখন সবকিছু বদলে যাচ্ছে, পটার।

হ্যারি বিষণ্ণ মুখে ঠাণ্ডা গলায় বললো–হ্যাঁ আমিও লক্ষ্য করেছি।

ফিলচ বললো–তুমি জানো না হ্যারি, ডাম্বলডোরকে বছরের পর বছর বলে চলেছি, একটু শক্ত হোন, এতো নরম আর দয়ালু হবেন না। বুঝলে, নোংরা লোকেরা তোমার দিকে নোংরা ছুঁড়তে সাহস করবে না যদি তোমার হাতে চাবুক থাকে। যখন ঊনত্রিশ নম্বর ডিক্রি জারি হলো পটার, তখন তিনি মন্ত্রীকে একটা কাগজ দিয়ে সই করতে বললেন। অর্ডার পিভসের এই টাওয়ার থেকে বিতাড়ণ। সত্যি জানি না ওর এই পরিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে।

হ্যারি খুব ভালো করে জানে আমব্রিজ ফিলচকে হাতে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাবেন। ওকে যেমন করেই হোক হাতে রাখলে অনেক কিছু করতে পারবেন। ফিলচ, হোগওয়ার্টসে বহু বছর ধরে আছে, সব কিছু আনাচে কানাচের খবর রাখে। সব গোপন ঘর, পথ, লুকিয়ে রাখার জায়গা ফিলচের পর যদি কেউ ওইসব জানে তো ফ্রেড আর জর্জ।

প্রফেসর আমব্রিজের ঘরের সামনে এসে দরজায় তিনটে টোকা মেরে দরজা খুলতে খুলতে ফিলচ বললো–এসে গেছি পটার।

–ম্যাডাম পটার এসেছে, ফিলচ বললো।

আমব্রিজের ঘর হ্যারির খুবই পরিচিত। এই ঘরে হ্যারি বহুবার ডিটেনসন থেকেছে। সবই ঠিক আছে শুধু পরিবর্তন একটাই। তার ডেস্কের ওপের একটা কাঠের ফলকে লেখা রয়েছে হেড মিস্ট্রেস তাছাড়া তার ফায়ার বোল্ট, ফ্রেড আর জর্জের ক্লিনসুইপস সেগুলো ডেস্কের পেছনের দেয়ালে চেন ও গজাল দিয়ে আটকে রেখেছেন শুধু নয়, চেন যাতে কেউ খুলতে না পারে তার জন্য তালা দিয়ে রেখেছেন।

আমব্রিজ ডেস্কের পেছনে বসেছিলেন, গোলাপি একটা পার্চমেন্টে কিছু লিখছিলেন। ওদের দেখে খুব বড় করে হাসলেন।

খুব মিষ্টি করে বললেন–ধন্যবাদ আরগম।

ফিলচ বললো, না না ম্যাডাম ধন্যবাদ জানানোর কি আছে? বাতের ব্যথায় বেশি ও অবনত হতে পারলো না।

আমব্রিজ কাটা কাটা স্বরে বললেন–বসো। একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। হ্যারি চেয়ারটায় বসে দেখলো আমব্রিজ ওর দিকে না তাকিয়ে লিখে যেতে লাগলেন। হ্যারি আন্দাজ করতে পারলো না ওর জন্যে নতুন মারাত্মক কিছু মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন কিনা।

ব্যাঙেরা যেমন বেশ মোটা মোটা পোকা-মাকড় গিলে খাবার জন্য হাঁ করে থাকে তেমনিভাবে ওর দিকে তাকিয়ে লেখা বন্ধ করে বললেন, ও… এখন তুমি কি কিছু খাবে পটার?

–কি? হ্যারি এমনভাবে তাকালো যেন ভুল কিছু শুনেছে।

–মিস্টার পটার কিছু পানীয়? আগের মতোই হাসতে লাগলেন, এই পামকিন জুস, চা, কফি?

প্রতিটি ড্রিঙ্কের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে জাদুদণ্ড মোরালেন। চা-কফি-পামকিন জুস টেবিলের ওপোর ভাসতে ভাসতে চলে এলো।

হ্যারি বললো, ধন্যবাদ, আমি কিছু খাবো না।

দারুণ নরম সুরে আমব্রিজ বললেন–না, আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে খাবে। এর মধ্যে থেকে যেকোন একটা বেছে নাও।

–ঠিক আছে, তাহলে চা, হ্যারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো।

আমব্রিজ চেয়ার থেকে উঠে হ্যারির দিকে পিছন ফিরে নিজে দুধ মিশিয়ে চা বানিয়ে বললেন–ঠাণ্ডা হবার আগে শেষ করে ফেলল। খাবে তো? এখন, ওয়েল পটার। ভাবছি তোমার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা করা যাক। গত রাতের সেই বীভৎস ব্যাপারের পর তো আর কথা হয়নি।

হ্যারি চুপ করে রইলো। আমব্রিজ নিজের চেয়ারে গুছিয়ে বসে হ্যারির উত্তরের অপেক্ষায় ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যারি যেমন বসেছিলো তেমনভাবে বসে রইলো। বেশ খানিকটা সময় চুপ করে বসে থাকার পর আমব্রিজ বললেন, তুমি চা খাচ্ছে না?

হ্যারি কাপটা মুখে ঠেকিয়ে না খেয়ে রেখেদিলো। যেসব বেড়াল ছানার ছবিগুলো আমব্রিজের পেছনে টাঙ্গানো ছিলো, তার নীল চোখ দেখে ম্যাড আই মুডির ম্যাজিক্যাল চোখের কথা মনে পড়ে গেলো। কথাটা মনে হতেই ও কাপটা নামিয়ে রেখে ভাবলো, আমব্রিজের মত শক্রর সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খেতে দেখলে ম্যাড আই মুডি কি ভাববেন! শক্রর সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খাওয়া?

–কী ব্যাপার? আমব্রিজ ওকে তীক্ষ্মভাবে দেখে বললেন, চা খাবে না? চিনি লাগবে?

হ্যারি বললো, না।

ও কাপটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে ভান করলো চা খাচ্ছে। আমব্রিজ বুঝতে পেরে হাসলেন।

–খুব ভালো, খুব ভালো। হ্যাঁ তারপর বলতে পারো এলবাস ডাম্বলডোর এখন কোথায় আছেন?

হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, আমার কোনো ধারণা নেই।

ঠিক তেমনি অমায়িকভাবে হাসতে হাসতে আমব্রিজ বললেন, দেরি করছে কেন? চা শেষ করো। শোন, ভালো করে শোনো পটার। বাচ্চাদের মত খেলে সময় কাটানোর সময় আমার নেই। আমি জানি ডাম্বলডোর কোথায় আছেন, তুমি ও ভালো করেই জানো। গোড়া থেকেই দেখে চলেছি তুমি আর ডাম্বলডোর একসঙ্গে চলেছে, তোমার অবস্থানটা তুমি ভাল করে এখন চিনে নাও।

হ্যারি আবার দৃঢ় স্বরে বললো, আমি জানি না।

ও আবার কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে চা খাবার ভান করলো। আমব্রিজ সেই একই দৃষ্টিতে হ্যারিকে দেখে চললেন।

–ঠিক আছে, জানো না যখন, আমব্রিজ বললেন। মুখ দেখলেই বোঝা যায় খুবই হতাশ শুধু ক্ষুন্ন হয়েছেন। বেশ তাহলে বল সিরিয় ব্ল্যাক কোথায় আছেন, ঠিকানা জানো?

হ্যারির পেটের ভেতরটা গুড় গুড় করে উঠলো, চায়ের কাপটা হাতে কাঁপতে লাগলো। কাপ থেকে খানিকটা চা চলকে সসারে পড়ে গেলো। খানিকটা চা ওর আলখেল্লার ওপোরও পড়ে গেলো।

–আমি জানি না, জবাবটা যেনো তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো।

–আমব্রিজ বললেন–মিস্টার পটার, তোমার বোধহয় মনে আছে গত অক্টোবর মাসে গ্রিফিন্ডরে আগুন লাগার সময় আমি প্রায় ধরে ফেলেছিলাম জঘন্য অপরাধী সিরিয়সকে। শোনো, আমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে, তুমি প্রায়শই সিরিয়সের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করো। জেনে রেখো তোমাদের দুজনের মধ্যে একজনও আমার কবল থেকে পালাতে পারবে না। সে যাই হোক আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি, সিরিয়সের সন্ধান দিলে। আবার তোমাকে বলছি, বলো কোথায় লুকিয়ে আছে সিরিয়স ব্ল্যাক?

–আমার কোনও ধারণা নেই, জানি না, হ্যারি একইভাবে জবাব দিলো, কোনও ক্লু দিতে পারছি না।

হ্যারি শুধু নয়, দুজনেই দুজনের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হ্যারির চোখে জল এসে গেলো। তখন আমব্রিজ চেয়ার ছেড়ে আবার উঠে দাঁড়ালেন।

–খুব ভালো। তবে একটা কথা পরিষ্কারভাবে জেনো মিনিস্ট্রি আমার সঙ্গে আছে। এই স্কুলের দৈনন্দিন ঘটনা, ভেতর আর বাইরের লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। আমার ছাড়া ফুঁ নেটওয়ার্ক রেগুলেটর, প্রত্যেকের ওপোর কড়া নজর রেখে চলেছে। আমার অধীনের স্কোয়াড, প্যাচা মারফত প্রতটি চিঠি যাওয়া ও আসার পর খুলছে আর পড়ছে। ফিলচ ক্যাসেলের প্রত্যেকটি গোপন রাস্তার ওপর নজর রাখছে। আমি যদি কোনো খবর হাতে পাই…।

বু-উম!

শব্দে অফিস ঘরটা কেঁপে উঠলো ভূমিকম্পের মতো। আমব্রিজ ডেস্কটা চেপে ধরে পতনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচালেন। একটু ভয় পেয়ে গেলেন। আচমকা শব্দ ও কম্পনে।

–কিসের শব্দ?

আমব্রিজ ঘরের দরজার দিকে তাকালেন। সেই ফাঁকে হ্যারি বাকি চাটা পাশে রাখা শুকনো ফুলের টবে ফেলে দিলো। নিচের তলায় অনেক লোকের হৈ হট্টোগল, ছুটোছুটির শব্দ পেলো।

আমব্রিজ বেশ জোরে জোরে বললেন–লাঞ্চ খেতে যেতে পারো পটার। অফিস ঘর থেকে হাতে জাদুদণ্ডটা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন। হ্যারি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে কেন, কোথা থেকে শব্দটা হলো দেখার জন্য নিচের তলায় চলে গেলো।

সেখানে অসম্ভব ভিড়, সকলেই ছোটাছুটি করছে। অন্য কেউ জানুক বা না জানুক হ্যারি খুব ভাল করেই জানে কে ওই জাদুমুগ্ধ শব্দবাজি আর আগুন ছড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে শুধু বাজির বুম বুম কামানের গোলার মত শব্দ, আগুন আর ধোঁয়া। শুধু তাই নয়, পাঁচ ফিট পরিধির উড়ন্ত সসার হুজ হুজ শব্দ করে উড়ছে। ছোট ছোট রূপালী তারা সৃষ্টি করছে রকেট। হ্যারি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইবোটেকনিক্যাল মিরাকল দেখতে লাগলো। সেই শব্দ আর বিস্ময়কর ব্যাপার যেন শেষ হবে না, বেড়েই চলেছে।

মুখে চোখে দারুণ আতঙ্ক নিয়ে ফিলচ আর আমব্রিজ সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। বেশ বড় একটা ক্যাথরিন হুইলস কোথায় যাবে ঠিক করতে না পেরে বিকট হু-ই-ই-ই শব্দ করে ঘুরতে ঘুরতে আমব্রিজ আর ফিলচের দিকে গেলো। ওরা দুজনেই রক্ষা পাবার জন্য মাথা হেঁট করে এক পাশে সরে গেলেন। ভাগ্য ভালো জ্বলন্ত চাকাটা ওদের গায়ে না লেগে ঘুরতে ঘুরতে খোলা জানালা দিয়ে। বাইরের মাঠে গিয়ে পড়লো। ইতোমধ্যে কিছু ড্রাগন আর বড় বড় বাদুড় বাজি ভীষণ শব্দ করতে করতে আর ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে খোলা দরজা দিয়ে দ্বিতীয় ফ্লোরের দিকে চলে গেলো।

আমব্রিজ আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি ফিলচ ওগুলো আমাদের কুপোকাৎ না করলে সবগুলো স্কুলের ভেতরে পড়বে, স্টুপিফাই!

আমব্রিজের জাদুদণ্ড থেকে জ্বলন্ত লাল অগ্নিশিখা বেরিয়ে এসে একটা রকেটে আঘাত করতেই রকেটটা জোরে শব্দ করে ফেটে গেলো, দেয়ালে টাঙানো একটা জাদুকরির আঁকা ছবিতে আঘাত করে শক্ত দেয়াল ভেদ করে মাঠের মাঝখানে আছড়ে পড়লো। তারপরই আবার করিডোরে ফিরে এসে পরের ছবিটায় আগাত করলো। তার পাশেই দুজন জাদুকরি তাশ খেলছিলো, যার ছবিতে আঘাত করলো তাকে বাঁচানোর জন্য কাছে টেনে নিলো।  

আমব্রিজ খুব জোরে জোরে বললেন, না ফিল্চ স্টান করো না, মনে হচ্ছে। সারা পৃথিবী জাদুমন্ত্রে জর্জরিত।

ফিলচ বললো, হেড মাস্টার আপনি ঠিক বলেছেন। ও জানে সেই ফায়ার ওয়ার্ক বন্ধ করার ওর ক্ষমতা নেই। আমব্রিজ মানা করার পর ফিলুচ কাবার্ড থেকে একটা ঝাড়ু বার করে আগুন নেভাবার চেষ্টা করলো। আগুন ভোল বদলে ঝাড়ুটায় লেগে দাউ দাউ করে পুড়ে গেলো।

হ্যারি হাসতে হাসতে গোপন দরজা দিয়ে বাইরে এসে দেখলো এক কোণে ফ্রেড আত্মগোপন করে রয়েছে। শুনতে পেলো তখনও আমব্রিজ আর ফিলচ সমানে চিষ্কার করে যাচ্ছেন।

হ্যারি হাসি বন্ধ না করে বললো–খেল দেখিয়েছে বটে, তোমরা ডাক্তার ফিলিস্টারকেও হার মানিয়েছে দেখছি! নো প্রবলেম।

–আমব্রিজ রুখতে যাবার চেষ্টা করলে যতোবার চেষ্টা ততোবার দশগুণ বেড়ে যাবে।

পটকা, নানা রকমে ছোটো বড়ো বাজি, বলতে গেলে বিকেল পর্যন্ত সমস্ত স্কুলে ছড়িয়ে পড়লো। দারুণ ব্যাঘাত করলো স্কুলের কাজের বিশেষ করে বোমা পটকা (ফায়ার ক্র্যাকারস)। শিক্ষকরা সেইসব তেমন কেউ আমল দিলেন না।

প্রফেসর ম্যাগকগোনাগল যখন একটা ড্রাগন ক্র্যাকার দারুণ শব্দ করে তার ঘরে ফাটলো তখন তিনি কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন–মিস ব্রাউন… হেডমিস্ট্রেসকে দয়া করে গিয়ে বলবেন, আমাদের ক্লাশরুমে দারুণ শব্দ করে বোমা ফেটেছে, কোনো রকমে প্রাণে বেঁচেছি।

প্রফেসর আমব্রিজের সারাদিন কেটে গেলো–শব্দ বাজি, বাজি ইত্যাদি বন্ধ করার ব্যাপারে। ছুটির ঘণ্টা বাজলে অনেকেই গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে হাতে স্কুলব্যাগ নিয়ে ছুটলো। হ্যারির সব দেখে মন খুশিতে ভরে গেলো। দেখলো আমব্রিজ দরদর করে ঘামছেন, সারাদেহে, আলখেল্লায় কালো কালো দাগ! বেরিয়ে আসছিলেন ফ্লিটউইকের ক্লাশরুম থেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে।

ফ্লিটউইক মুখে চোরা ব্যঙ্গ হাসিতে বললেন, ধন্যবাদ প্রফেসর আমব্রিজ। আমি চেষ্টা করলে, আতশ বাজি, ক্র্যাকার, পটকা বন্ধ করতে পারতাম। দুঃখের বিষয় আমার তো কোনো অথরিটি নেই।

সেই রাতে গ্রিফিন্ডর কমনরুমে ফ্রেড জর্জের জয় জয়কার–ওরা হিরো বনে গেছে। সচরাচর হারমিওন যা করে না তাই করলো। ভিড় ঠেলে দুই ভাইয়ের কাছে গিয়ে অভিনন্দন জানালো।

–দারুণ বানিয়েছে তোমরা, চমৎকার, ও উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো।

ওরা হারমিওনের অপ্রত্যাশিত প্রশংসায় একটু খুশি হলো। বুক ফুলিয়ে বললো, ওগুলো হচ্ছে ওয়াইল্ড ফায়ার হুইজ ব্যাংগস। একটাই দুঃখের ব্যাপার আমাদের স্টক আজ সব খতম! আবার বানাতে হবে। গ্রিফির ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ওর চমক দেবার আতশবাজির অর্ডার নিতে বললো। হারমিওন ওয়েটিং লিস্টে তোমার নাম রাখতে পারি পাঁচ গেলিয়ন বেসিক ব্লেজ ব্লকসের, আর দশ গেলিয়ন ডিফ্রেগ্রেসন ডিলাকসের জন্যে লাগবে।

হারমিওন, হ্যারি আর রন টেবিলের কাছে ফিরে এলো। ওদের মাথায় তখন হোমওয়ার্ক। নানারকম গোলমালে ওরা পিছিয়ে পড়েছে।

–শুক্রবার থেকে ইস্টার হলিডে শুরু হবে, আমাদের হাতে এখন বেশ সময় আছে। তাড়াহুড়ো করে হোমওয়ার্ক করো না।

ওরা দুজনে যখন শুতে গেলো তখনও পটকার দুমদাম আওয়াজ থামেনি। দুএকটা পটকা ওদের ঘরেও ঢুকে পড়েছে।

হ্যারি বরাবরই খোলা জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ, প্রকৃতি দেখতে ভালোবাসে। তখনও আতশবাজি খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে, বাইরের সবকিছু ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখছে। কালো আকাশের নিচে উজ্জ্বল মেঘ দেখতে দেখতে ওর বড়ো রহস্যপূর্ণ, অস্পষ্ট মনে হলো। অনেকটা সময় দেখার পর ও পাশ ফিরে শুলো। ভাবতে লাগলো, কে জানে আমব্রিজ প্রথম দিন ডাম্বলডোরের জায়গায় হেডমিস্ট্রেস হয়ে কি ভাবলেন। তারপর মনে হলো কাজের কথা। এততক্ষণে নিশ্চয়ই স্কুলে সারাদিন গোলমালের কথা ফাজের কানে গেছে। কি ভাবছেন ফাজ? ফাজের মুখটা মনে করে হ্যারি নিজের মনে হাসলো। তারপর ঘুমোবার জন্য দুচোখ বন্ধ করলো।

ঘুম আসেনি, কানে তখনও আসছে বাজির হইজ শব্দ আর পটকা, ক্র্যাকারের দম ফাটানো শব্দ। তবে একটু কমেছে। স্কুল বিল্ডিংয়ের অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। অথবা মনে হয় ও নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। স্বপ্ন দেখছে

ডিপার্টমেন্ট অব মিস্ট্রিজের করিডোর দিয়ে ও চলেছে। আস্তে নয় খুব জোরে। অদূরে সেই বন্ধ কালো দরজা। ও চাইছে দরজাটা বন্ধ না থেকে খুলে যাক। অথবা কেউ যেনো খুলে দেয়।

দরজা খুলে গেলো। ও সেই আগের দেখা গোল ঘরের মধ্যে ঢুকলো। ঘরে ঢোকার জন্য একটা নয়, সারি সারি দরজা। যে দরজাটা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে ও ঠিক সেইরকম আর একটা দরজায় হাত রাখলো। দরজাটা খুলেছে, আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই দরজা দিয়ে ও একটা রেক্ট্যাঙ্গুলার ঘরে ঢুকলো। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত এক যান্ত্রিক টিক টিক শব্দ শুনতে পেলো। দেয়ালে আলোর রশ্মি নেচে বেড়াচ্ছে। কেন হচ্ছে ওর তদন্ত করার সময় নেই। ওকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।

ঘরের শেষ প্রান্তে একটা দরজা রয়েছে, ও স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ দরজাটা খুলে গেলো।

ও এখন একটা আবছা আলোকে পূর্ণ চার্চের মত লম্বা ও বড় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরে অন্য কিছু নেই, শুধু রয়েছে সারি সারি বড় বড় সেলফস। প্রত্যেকটা সেলফের ওপোর রয়েছে ধূলো ময়লা ভর্তি ছোটো ছোটো কাঁচের বর্শা। হঠাৎ হ্যারির বুক উত্তেজনায় টিপ টিপ করতে লাগলো। ও জানে ওকে কোথায় যেতে হবে। ও জোরে জোরে হেঁটে এগিয়ে গেলো, কিন্তু সেই বিরাট শূন্য ঘরে জোরে জোরে হাঁটার সময় ও নিজের পদ শব্দ শুনতে পেলো না।

ঘরের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা ও দেখতে চাইছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। অথবা অন্য কেউ সেটা দেখতে চাইছে।

ওর কাটা দাগে জ্বালা শুরু হলো।

তারপরই কান ফাটানো শব্দ

ব্যাংগ!

সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। বিভ্রান্তি আর রাগে ও ফেটে পড়লো। অন্ধকার ডরমেটরি থেকে ভেসে ওর কানে এলো হাসির শব্দ!

সিমাস ওকে জাগতে দেখে বললো–ঠাণ্ডা থাকো। তারি দেখলো সিমাস জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার মনে হয় ক্যাথরাইন হুইলসের একটা রকেটের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। আরে ওইতো ওখানে পড়ে রয়েছে দেখে যাও।

হ্যারি দেখলো রন আর ডিনের ঘুম ভেঙেছে। কি হয়েছে ভাল করে দেখার জন্য বিছানার ওপোর জবুথবু হয়ে বসেছে। ও বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইলো। কপালে জ্বালা–ব্যথা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। ওর মনে আনন্দ নেই, খুশি নেই, নিরাশায় পূর্ণ। মনে হলো ও যখন খুব সুন্দর একটা জিনিস স্পর্শ করতে যাবে ঠিক সেই সময় অদৃশ্য থেকে কে যেন সেটা ছিনিয়ে নিলো। তারই রাগ মনের মধ্যে ফুঁসছে।

গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের জানালার ধারে দেখলো গোলাপী ও রূপোলি রংয়ের ছোটো ছোটো ডানাওয়ালা পিগ লেটস ভেসে যাচ্ছে। ও শুয়ে শুয়ে গ্রিফিরদের আনন্দ উচ্চ চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো। ঠিক ওর ডরমেটরির তলা থেকে শব্দগুলো আসছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কাল সন্ধ্যাবেলা ওর অকলামেন্সির ক্লাস আছে।

***

পরেরদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও ভাবতে লাগলো স্নেইপ কি শেখাবেন সেই সম্বন্ধে। স্নেইপ জানতে চাইবেন স্বপ্নে ও কি দেখেছে। ডিপার্টমেন্ট অফ মিষ্ট্রিজের কতোটা গভীরভাবে ও স্বপ্নেতে প্রবেশ করেছিলো। ওর মনে পড়ে গেলো গত অকলামেন্সির ক্লাসে স্নেইপ যা শিখিয়েছিলেন তার কিছুই ও প্র্যাকটিস করেনি। ডাম্বলডোর চলে যাবার পর অনেক গোলমাল চলছে ও জানে অনেক চেষ্টা করেও মনকে ও ফাঁকা করতে পারবে না। কে জানে স্নেইপ গোলমাল ইত্যাদি বাহানা মেনে নেবেন কি না।

তাই ক্লাসে যাবার আগে সামান্য সময় প্র্যাকটিস করে নিলো, কিন্তু তাতে মন ভরলো না। হারমিওন অনেক প্রশ্ন করেও ওর মনের ভাব জানতে পারলো না।

যা হবার তাই হবে ভেবে ও স্নেইপের ঘরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। অর্ধেকটা পথ যাবার পর ওর দিকে চো-কে বেশ জোরে জোরে হেঁটে আসতে দেখলো।

যাকগে, ক্লাশে না যাবার একটা বাহানা পেয়ে গেলো। চো বললো, এদিকে এসো। এনট্রেন্স হলে যাবার রাস্তায় যেখানে বিরাট হাওয়ার গ্লাসটা আছে তার কাছে দাঁড়ালো।

গ্রিফিন্ডর তখন ফাঁকা হয়ে গেছে।

হ্যারি চোকে বললো–তুমি ভালো আছো তো? আমব্রিজ কি তোমাকে ডিএ ক্লাশ সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করেছেন?

চো বললো, নাতো। যাকগে সে কথা। আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসছি হ্যারি। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি মেরিয়েটা সব ফাঁস করে দেবে।

–হা হা, ঠিক আছে। ঠিক আছে, হ্যারি যেনো ভাবজগতে বিচরণ করছে। এমনইভাবে বললো। ও শুনেছে মেরিয়েটা এখন হসপিট্যাল উইংগ-এ ম্যাডাম পমফ্রের চিকিৎসাধীনে রয়েছে। এখনও ওর মুখের ব্রণের একটাও সারেনি।

–চো বললো–মেয়েটা সত্যি ভালো, ও একটা ভুল করে ফেলেছে।

 –হ্যারি চোর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।

–হ্যাঁ সত্যই তো অতি ভালো মেয়ে ও তোমার বন্ধু। একটা ভুল করে ফেলেছে এই তো? ও শুধু ডিএর ব্যাপার ফাস করেনি, তোমাকেও ফাঁসিয়েছে

–ঠিক আছে আমরা সকলে ছাড়া পেয়ে গেছি, তাই না? চো কাকুতি মাখা সুরে বললো–তুমি তো জানো ওর মা মিনিস্ট্রিতে কাজ করেন, তাই!

–তুমি বোধহয় জানো রনের বাবাও মিনিস্ট্রিতে কাজ করেন! হ্যারি দারুণ রেগে বললো, তুমি যদি লক্ষ্য করে থাকো তাহলে দেখবে ওর পোশাকে ও মুখে গুপ্তচরের ছাপ আছে।

 চো জোর দিয়ে বললো, সবকিছু হারমিওন গ্রেঞ্জারের কারসাজি। ওর বলা উচিত ছিলো আমাদের নামের তালিকায় ও জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করেছিলো।

হ্যারি তিক্ত স্বরে বললো, ভালই করেছিলো। কথাটা শুনে মুখ চোখ লাল হয়ে গেলো।

–ও হ্যাঁ আমি ভুলে গিয়েছিলাম, অবশ্যই ওটা তোমার প্রিয় বান্ধবী হারমিওনের আইডিয়া।

হ্যারি সতর্ক করে দিয়ে বললো, আজেবাজে কথা বলবে না।

–বুঝলে আমি বাজে কথার ধার দিয়ে যাই না।

–ভালো, খুব ভালো, হ্যারি বললো, আমার এখন অনেক কাজ আছে, সময় নেই।

–বেশ তো কাজ করো, কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে, চো অসম্ভব রেগে গিয়ে বললো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।

দারুণ রেগেমেগে হ্যারি স্নেইপের অন্ধকার ঘরের দিকে চললো। ও অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছে স্নেইপের ওর মনের মধ্যে ঢুকতে অনেক সহজ হবে যদিও ঠাণ্ডা মাথায় যায়। কিন্তু ভেবেও কিছু হলো না। মেরিয়েটা সম্বন্ধে চোর মন্তব্য মাথায় নিয়ে ও স্নেইপের ঘরে ঢুকলো।

স্নেইপ হ্যারিকে ঠাণ্ডা অনুভূতিহীন গলায় বললেন, দেরি করে এসেছে পটার।

স্নেইপ, হ্যারির দিক থেকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। মনের যাবতীয় চিন্ত -ভাবনা স্বাভাবিকভাবে সাবধানে ডাম্বলডোরের পেনসিভে রাখছিলেন। তারপর অনেক উপাদান সমন্বিত বস্তুর উপাদানটা শেষে পাথরের বেসিনে ফেলে হ্যারির দিকে ফিরলেন।

–তারপর, যা যা শিখিয়েছি তার অভ্যাস করছে তো? স্নেইপ বললেন। হ্যারি মিথ্যে বললো, হ্যাঁ করছি। কথাটা স্নেইপের দিকে না তাকিয়ে স্নেইপের ডেস্কের একটা পায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।

–কতোটা শিখেছো তা এখনই জানা যাবে, তাই না? হ্যাঁ, পটার তোমার জাদুদণ্ড এবার বের করো, স্নেইপ সরাসরি বললেন।

–তাহলে এক-দুই-তিন, স্নেইপ হালকাভাবে বললেন। হ্যাঁ, এক-দুই…। ঠিক সেই সময় স্নেইপের ঘরের দরজা ঠেলে ড্রেকো ম্যালফয় ঘরে ঢুকলো। এমন ভাব করলো যেন ও স্নেইপের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে, হ্যারিকে যেনো দেখেনি। প্রফেসর স্নেইপ, স্যার… ও আমি দুঃখিত।

ম্যালফয় তারপর হ্যারি আর স্নেইপের দিকে একটু আশ্চর্য হবার ভান করে দেখলো।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে ড্রেকো, আমি এখন পটারকে সামান্য পোসান ব্যবহার করে অসুখ সারানোর কথা বলছিলাম।

হ্যাগ্রিডের ঘরে তদন্ত করতে এসে আমব্রিজের মুখ যতটা খুশি, আনন্দে উদভাসিত ছিলো মনে হলো তার চেয়েও বেশি ড্রেকোর মুখের হাসি।

হ্যারির দিকে সামান্য হেঁট হয়ে বললেন–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কেন ওর মুখটা জ্বালা জ্বালা করছে। স্নেইপ কড়া মেজাজে ম্যালফয়কে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে অথবা উপযুক্ত একটা কার্স প্রয়োগ করতে পারতেন।

–হ্যাঁ এবারে বলো, কেন আমার কাছে এসেছো? স্নেইপ বললেন।

–দরকার। প্রফেসর আমব্রিজ আপনার সাহায্য চাইছেন। ম্যালফয় বললো, মন্টেগু ফোর্থ ফ্লোরের (পাঁচতলার) বাথরুমে আটকা পড়ে গেছে স্যার।

স্নেইপ বললেন, বাথরুমে? তা সেখানে কেমন করে আটকা পড়লো?

ম্যালফয় সামান্য ঘাবড়ে গিয়ে বললো, তাতো জানি না স্যার।

–খুব ভালো, খুব ভালো, এখন তুমি যাও, বাকিতটা কাল সন্ধ্যা বেলায় শেষ করবো, হ্যারিকে বললেন স্নেইপ। স্নেইপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ম্যালফয়, হ্যারিকে ব্যাঙ্গ করে বললো, কি বললেন রেমিডিওল পোসান? ম্যালফয় স্নেইপের সঙ্গে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

উত্তেজিত হয়ে হ্যারি পকেটে জাদুদণ্ডটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে গেলো। হাতে ওর এখনও কম করে চব্বিশ ঘণ্টা সময় রয়েছে, প্র্যাকটিস করার অনেক সময়। আমব্রিজের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ম্যালফয় এখন সমস্ত স্কুলের ছেলে–মেয়েদের রসিয়ে রসিয়ে পোসানের খবরটা দেবে বলবে, হ্যারির পোসানের দরকার রয়েছে। এক সেকেন্ড দাঁড়াবার পর ও লক্ষ্য করলো দরজার ফ্রেমে কাঁপা কাঁপা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ও দাঁড়ালো, আলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো আগে যেনো কোথাও ওইরকম কাঁপা কাঁপা আলোর রশ্মি দেখেছে। হ্যাঁ, গতকাল রাতে এইরকম এক আলোর স্বপ্ন। দেখেছে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজের করিডোর দিয়ে গোলাকার ঘর সংলগ্ন অন্য একটা ঘরে ঢুকলো।

ও পেছনে তাকালো, আলোটা ডেস্কের ওপোর রাখা পেনসিভ থেকে আসছে। স্নেইপের কিছু চিন্তা ওর মধ্য থেকে ঘুরছে। এমনও হতে পারে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজ কিছু খবর পাঠিয়েছে যা তিনি হ্যারিকে জানাতে চান না। অধীর আগ্রহে স্নেইপের জন্য ঘরে দাঁড়িয়ে রইলো। আশ্চর্য মন্টেগুকে টয়লেট থেকে মুক্ত করতে এতো সময় নিচ্ছেন কেন? স্নেইপ কি মন্টেগুকে মুক্ত করে সোজা অফিসে ফিরে আসবেন, না ওকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাডাম পমফ্রের হাসপাতালে যাবেন? নিশ্চয়ই হসপিটালে যাবেন। মন্টেগু স্নিদারিনের কিডিচ টিমের ক্যাস্টন। স্নেইপ চান ও তাড়াতাড়ি যেনো সেরে যায়।

হ্যারি আরও একটু পেনসিভের কাছে এসে দাঁড়ালো। খুব তীক্ষ্ণভাবে তাকালো। পেনসিভ থেকে তখনও অদ্ভুত রং-এর আলো বেরোচ্ছে। হ্যারি একটু ইতস্ত করে ওর জাদুদণ্ডটা বার করলো। ঘরে বাইরে তখন দারুণ নিস্তব্ধতা। ও পেনসিভের মধ্যে রাখা উপাদানে জাদুদণ্ডের মুখ দিয়ে হালকা নাড়া দিলো।

পেনসিভের মধ্যে জমা উপাদান খুব দ্রুত ঘূর্ণির মতো ঘুরতে লাগলো। হ্যারি পেনসিভের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখলো ভেতরের উপাদানটা স্বচ্ছ হয়ে গেছে। ও আবার মাথা নিচু করে তাকালো… একটা ঘর দেখতে পেলো। মনে হলো ছাদের সিলিং-এ একটা গোলাকার জানালা দিয়ে ঘরটা দেখছে। আসলে ও সব গুলিয়ে ফেলেছে না গ্রেট হল দেখছে।

ওর সিঃশ্বাস স্নেইপের চিন্তার সাগরের ওপোর গভীর এক কালো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ভেসে বেড়াতে লাগলো। ওর মস্তিষ্ক মনে হলো যেন নরকের সীমান্তে চলে গেছে। যা করতে চাইছে তা করতে গেলে ও পাগল হয়ে যাবে। ও কাঁপতে লাগলো, যেকোনো মুহূর্তে স্নেইপ ঘরে এসে যেতে পারেন।

ম্যালয়ের ড্রিপ ব্যঙ্গ ভরা মুখ ভাবতে ভাবতে একটা লাগামছাড়া সাহস ওকে গ্রাস করলো।

ও বড়ো দেখে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পেনসিভে জমা করে রাখা স্নেইপের চিন্ত রি ওপোরের স্তরে মুখটা ছোঁয়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মেঝেটা সামনের দিকে গড়িয় পড়তেই হ্যারির মাথাটা সোজা ডুবে গেলো পেনসিভের মধ্যে। প্রচণ্ডভাবে লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে ঠাণ্ডা অন্ধকার সাগরে ডুবে যেতে লাগলো। তারপর ও দেখলো গ্রেটহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারটে হাউজের চারটে টেবিল সেখানে নেই। তার বদলে সেখানে পর পর সাজানো রয়েছে শত শত টেবিল। প্রত্যেকটা টেবিলের সামনে চেয়ারে ছেলেমেয়েরা ঝুঁকে পড়ে পার্চমেন্টে কিছু লিখে চলেছে। শব্দ শুধু পার্চমেন্টের পাতা ওল্টাবার আর কুইলের (কলম) লেখার খস খস শব্দ। পরিষ্কার বোঝা যায় ওরা পরীক্ষা দিচ্ছে।

খোলা জানালা দিয়ে রৌদ্র এসে ওদের মাথার উপর পড়েছে। সূর্যের আলোর নানা রং বাদামি, তামা, সোনালী। হ্যারি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মনে হলো, স্নেইপ হলের মধ্যে কোথায় আছেন, এটাই ওর স্মৃতি।

হ্যারি দেখলো ডানধারের পিছনে একটা টেবিল। হ্যারি সেইদিকে তাকালো। দেখলো, স্নেইপ কিশোর অবস্থায় ওর দিকে উত্তষ্ঠিত ফ্যাকাশে স্নান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। অনেকটা অন্ধকারে কিছু লুকিয়ে রাখার মতো। মাথার লম্বা আর তৈলাক্ত চুলগুলো টেবিলের ওপোর ঝুলে পড়েছে। ওর বাঁকা নাকটা প্রায় আধইঞ্চি ব্যবধানে টেবিলের ওপোর রাখা পার্চমেন্টে রয়েছে। কুইল দিয়ে পার্চমেন্টে কিছু লিখছেন। হ্যারি ধীরে, ধীরে কিশোর স্নেইপের পেছনে দাঁড়ালো। পরীক্ষার খাতার হেডিং লেখা দেথলো ডার্ক আর্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সাধারণ জাদুবিদ্যার কৌশল।

তাহলে তখন স্নেইপের বয়স কত হবে? পনেরো–মোল, হ্যারিরই বয়সী। দেখলো অনেকটা লিখেছেন… পাশের ছাত্রের চেয়েও অন্তত: এক ফুট বেশি। তাহলেও ওর লেখা আঁকাবাঁকা জড়ানো জড়ানো।

আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে কথাটা শুনে হ্যারি লাফিয়ে উঠলো। পাশ ফিরে দেখলো প্রফেসর ফ্লিটউইক টেবিলের পাশে ঘুরছেন। তার কিছু দূরে একটি ছেলে বসে রয়েছে তার মাথার চুল অবিন্যাস্ত, ভীষণ অবিন্যস্ত। হ্যারি যেন হাওয়াতে ভাসছে। দুটো লাইন দেওয়া টেবিলের মাঝখান (আইল) দিয়ে চললো। তৃতীয় সারিতে দাঁড়ালো। ঝকড়া ঝাকড়া অবিন্যস্ত চুলের ছেলেটা পার্চমেন্টে যা লিখেছে। তা দেখার জন্য মুখের কাছে ধরলো এবং সোজা হয়ে বসলো।

 হ্যারি স্তব্ধ হয়ে ওর পনের বছরের বাবার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

দারুণ এক উত্তেজনায় কাঁপছে হ্যারি। ও নিজেকে নিজে দেখছে। কিন্তু তাতো নয়, ইচ্ছাকৃত ভূলের বোঝা দিয়ে দেখে চলেছে জেমসকে। জেমসের চোখ দুটো হালকা বাদামি রঙের। নাকটা হ্যারির চেয়ে সামান্য বড় কপালে কোনো কাটা দাগ নেই। কিন্তু মুখ চোখের চেহারা, ভাব বলতে গেলে একই রকম বাবাও ছেলের একইরকম। জেমসের মাথার চুলও হ্যারির মতো। হাত দুটো হ্যারির মতো হতে পারতো, হ্যারি তাহলে পার্থক্যটা বলে দিতে পারতো। জেমস উঠে দাঁড়ালে হাতের দৈর্ঘ্য মাপতে পারতো।

জেমস দাঁড়িয়ে বড় দেখে একটা হাই তুলে মাথার অবিন্যস্ত চুল হাত দিয়ে আঁচড়ে ঠিক করতে গিয়ে আরও এলোমেলো করে ফেললো। তারপর জেমস। প্রফেসর ফ্লিটউইকের দিকে তাকিয়ে পিছন ফিরে একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

আরও চমকে দেখলো সেই ছেলেটি আর কেউ নয় সিরিয়স। সিরিয়স জেমসকে দেখে হেসে বুড়ো আঙ্গুল তুললেন। সিরিয়স তার চেয়ারে আরাম করে বসে রয়েছে, সামনের দিকে দুটো পা প্রসারিত দেখতে খুবই সুশ্রী, ওর বড় বড় কালো রঙের চুল চোখের ওপোর ঝুলে পড়েছে। ইচ্ছে করেই চোখের ওপোর থেকে চুলগুলো সরাচ্ছেন না। ঠিক তার পেছনে একটি পেয়ে বসে জেমসের দিকে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হয়, জেমস মেয়েটিকে লক্ষ্য করেনি। ঠিক তার দুটো। সিট আগে বসে রয়েছে লুপিন। লুপিনকে দেখে হ্যারির পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলে সবাই পরীক্ষার খাতায় লিখতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে যা লিখেছে তাই পড়ছে আর পড়ার সময় কুইলের আগা দিয়ে থুতনি চুলকাচ্ছে, ভুরু কোঁচকাচ্ছে।

তো ওয়ার্মটেল কোথায়? ওয়ার্মটেল নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে ওয়ার্মটেলকে দেখতে পেলো হ্যারি। উসকো খুসখো চুলের একটি ছেলে, সুচালো নাক। ওয়ার্মটেল বিচলিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে আঙ্গুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটছে। পার্চমেন্টের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঝেতে জুতো ঘষছে। হ্যারি, ওয়ার্মটেলকে ক্ষণিক দেখে নিয়ে জেমসের দিকে তাকালো। দেখলো এক টুকরো পার্চমেন্টে হিজিবিজি কিছু লিখছে। দেখলো একটা ছবি, স্নিচের ছবি। তার ওপোর বড় বড় করে লিখলো এল.ই। তার মানে কী?

প্রফেসর ফ্লিট উইক গুরুগম্ভির গলায় বললেন–তোমরা সবাই অনুগ্রহ করে লেখা বন্ধ করো, তুমিও করো। আমি তোমাদের পার্চমেন্ট এক এক করে নিচ্ছি! অ্যাকিও।

প্রায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীদের পার্চমেন্ট বাতাসে ভাসতে ভাসতে প্রফেসর ফ্লিন্টউইকের প্রসারিত হাতের কাছে পড়লো, ধাক্কা দিলো। ফ্লিটউইক সেই ধাক্কায় পড়ে গেলেন। হাত থেকে ছিটকে গেলো কিছু পার্চমেন্ট। ছেলে–মেয়েরা হেসে উঠে ফ্লিটউইককে দাঁড় করিয়ে ইতস্ত পড়ে থাকা পার্চমেন্টগুলো গুছিয়ে টেবিলে রাখলো।

ফ্লিট উইক হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ধন্যবাদ, অশেষ ধন্যবাদ তোমাদের। এখন তোমরা হল ছেড়ে যেতে পারো।

হ্যারি ওর বাবার (জেমসের) দিকে তাকালো, দেখলো সেই এল.ই লেখাটা কাটাকুটি করে লাফিয়ে উঠে, কুইল, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দুটো ব্যাগের মধ্যে পুরে সিরিয়সের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো।

হ্যারি এধার ওধার তাকিয়ে দেখলো স্নেইপ অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখনও তার চোখ প্রশ্নপত্রের ওপোর। তারপর মাকড়সার মতো ঝাঁকি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এনট্রেন্স হলের দিকে চললো।

বেশ কয়েকটি মেয়ে বকবক করতে করতে স্নেইপ সিরিয়স, লুপিন আর জেমসকে আলাদা করে নিয়ে ওদের মাঝখানে দাঁড় করালো। হ্যারি, স্নেইপকে চোখে চোখে রাখলো। কিন্তু জেমস আর তার বন্ধুদের কোনও কথা শুনতে পেলো না।

এনট্রেন্স হলে এসে সিরিয়স জিজ্ঞেস করলো, মুনি দশ নম্বর প্রশ্ন তোমার কেমন মনে হয়েছে?

–মন্দ নয়, লুপিন বললো, দশটা চিহ্ন আঁকো যাতে ওয়্যার উলফ বোঝা যায়, দারুণ প্রশ্ন তাই না?

জেমস ঠাট্টার সুরে বললো, তুমি সব চিহ্নগুলো ঠিক ঠিক আঁকতে পেরেছো?

–মনে হয় পেরেছি, রোদে ভরা মাঠের দিকে সকলের সঙ্গে যেতে যেতে লুপিন বললো, প্রথমঃ যে আমার চেয়ারে বসে আছে, দুই: যে আমার জামা-কাপড় পরে আছে। তিন হচ্ছে রেমাস লুপিন!

একমাত্র ওয়ার্মটেল হাসলো না।

ও আগ্রহের সঙ্গে বললো–আমি শূয়োরের আকার আঁকতে পেরেছি, ওঁর কুত কুতে চোখ আর ছোট ল্যাজ, আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না।

জেমস অধৈর্য হয়ে বললো, তুমি একটি বুদ্ধিহীন, স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন ছেলে, ওয়ার্মটেল। তুমি মাসে একবার ওয়্যার উলফদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করো।

লুপিন বললো, আস্তে কথা বলো।

হ্যারি জানে যা দেখছে সবই স্নেইপের কৈশার জীবনের স্মৃতি। সকলকেই কৈশোর অবস্থায় দেখছে, তাদের কথাবার্তা শুনছে। স্নেইপ দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলে হ্যারি আর জেমসকে দেখতে পাবে না। তারপরই দেখতে পেলো জেমস ওর তিন বন্ধুর সঙ্গে মাঠ পেরিয়ে লেকের দিকে গেলে স্নেইপ ওদের পিছু পিছু চললো। তখনও তার চোখ পরীক্ষার কাগজের ওপোর। কোথায় চলেছে ঠিক নেই, এমনই এক উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

হ্যারি জেমস আর অন্যদের ওপোর চোখ রেখে চললো।

শুনতে পেলো সিরিয়স বলছে–ওই কাগজটা ভেবেছিলাম একটা কেক টেক গোছের কিছু হবে। বুঝলে, আমি যদি আউটস্ট্যান্ডিং না পাই তো খুব আশ্চর্য হবো।

–আমিও, জেমস বললো। পকেটে হাত পুড়ে একটা সোনালী রঙের স্নিচ টেনে বার করলো।

–তুমি কোথা থেকে ওটা পেয়েছে?

জেমস বললো আন্দাজ করো। ও স্নিচটা নিয়ে খেলা করতে লাগলো। মাঝে মাঝে সেটাকে উড়তে দিয়েই আবার ধরে নিয়ে এলো। ওর অপূর্ব অভিব্যক্তি। ওয়ার্মটেল বড়ো বড়ো চোখ করে জেমসের দিকে তাকিয়ে রইলো।

লেকের ধারে বড় একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়ালো। ওই গাছতলায় একদিন রোববার রন-হারমিওন আর হ্যারি হোমওয়ার্ক শেষ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করেছিলো। গল্প করতে করতে ঘাসের ওপোর শুয়ে পড়েছিল। হ্যারি দেখলো ঘন ঝোঁপঝাড়ের ছায়াতলে স্নেইপ শুয়ে পড়েছে। হ্যারিও বীচ গাছ ঝোঁপঝাড়ের মাঝের খালি জায়গাটায় বসে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। লেকের জলে বাতাসে সৃষ্টি ছোটো ছোটো ঢেউয়ের ওপোর সূর্যালোক পড়ে ঝিকমিক করছে। লেকের তীরে কিছু মেয়ের দল হাসছে, গল্প করছে, খুব সম্ভব ওরা সবেমাত্র গ্রেট হল ছেড়ে এসেছে। ওরা পা ঠাণ্ডা করার জন্য জুতো মোজা খুলে ফেলে জলে পা ডুবিয়ে। বসেছে।

লুপিন একটা বই বার করে পড়তে লাগলো। সিরিয়স খুব রুক্ষ মেজাজে ময়দানের ঘাসের ওপোর ছেলে মেয়েদের হৈ হৈ, ঘাসের ওপর দিয়ে চলাফেরা  দেখতে লাগলো। জেমস তখনও স্নিচ নিয়ে খেলা করে চলেছে। মাঝে মাঝে ওদের ছেড়ে দিচ্ছে আবার ধরে নিয়ে আসছে। ওয়ার্মটেল জেমসের খেলা দেখছে আর মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে। হ্যারি দেখলো, ওর বাবার বিশ্রী একটা অভ্যেস, মাথার চুল কখনই ঠিক করে রাখছে না। ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে আঙ্গুল দিয়ে উসকোখুসকো করে দেয়।

সিরিয়স, জেমসকে অবিরত স্নিচ নিয়ে খেলা করতে দেখে রেগে গেলো। বললো–এই তোমার খেলা থামাবে? ওয়ার্মটেল তুমিও অযথা বাহবা দেবে না।

ওয়ার্মটেলের কথাটা শুনে মুখ লাল হয়ে গেলো। জেমস হি হি করে হাসতে লাগলো।

পকেটে স্নিচগুলো পুরে রেখে বললো–তোমার যদি বিরক্ত লাগে…।

হ্যারির মনে হলো জেমস একমাত্র সিরিয়সের কথা শোনে।

সিরিয়স বললো, সত্যি আমার এক ঘেয়ে লাগছে। আজ যদি পূর্ণিমা হতে তো বেশ হতো।

–তোমার ভালো লাগতো, লুপিন ওর হাতের বই থেকে মুখ না তুলে বললো, আমাদের এখনও ট্রান্সফিগারেশন বাকি আছে। তোমার যদি এক ঘেয়ে লাগে তো আমাকে টেস্ট করতে পারো। বইটা দ্যাখো কি লিখেছে।

কিন্তু সিরিযস ঘেৎ ঘোৎ করে উঠলো–তোমার ওই জঞ্জাল সাফ করার আমার সময় নেই। রাবিশ আজেবাজে বই আমি পড়তে চাই না। কি করে করতে হয় আমি জানি।

জেমস বললো, প্যাডফুট পড়লে তুমি অনেক কিছু জানতে পারবে, জ্ঞান বৃদ্ধি হবে।

সিরিয়স মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কুকুরেরা খরগোস দেখলে মারার জন্য যেন চুপ করে যায় তেমনি চুপ করে তাকিয়ে রইলো।

–বাঃ চমৎকার! খুব আস্তে আস্তে বললো স্নিভেলাস।

হ্যারি ঘুরে দেখতে গেলো সিরিয়স কি দেখছে।

স্নেইপ আবার দাঁড়ালো। আউল-এর কাগজপত্র ব্যাগের মধ্যে গাদাগাদি করে রাখলো। তারপর ঝোঁপ-ঝাড়ের ছায়া থেকে সরে গিয়ে ঘাসের ওপোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। একই সঙ্গে সিরিয়স, জেমস উঠে দাঁড়ালো।

লুপিন আর ওয়ার্মটেল বসে রইলো। লুপিনের মুখের সামনে সেই বইটি খোলা। দেখে মনে হয় না পড়ছে। তবে মাঝে মাঝে ভুরু কোঁচকাচ্ছে।

–ঠিক আছে স্নিভেলাস? জেমস বেশ জোরে জোরে বললো।

স্নেইপ খুব দ্রুত কিছু করতে চাইছে। ব্যাগটা ফেলে রেখে হাতটা আলখেল্লার পকেটে পুরলো। জাদুদণ্ডটা সম্পূর্ণ বার করার আগে জেমস চিৎকার করে বলেন, একসপেলিয়ারমাস!

স্নেইপের জাদুদণ্ড হাত থেকে ছিটকে প্রায় বার ফিট দূরে মাটিতে শব্দ করে আছড়ে পড়লো। সিরিয়স হো হো করে হেসে উঠলো।

ইমপেডিমেন্টাল! বলে স্নেইপের দিকে জাদুদণ্ডটা বাড়িয়ে বললো–স্নেইপ হাতের জাদুদণ্ডটা মাটি থেকে তোলার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো।

ছাত্রছাত্রীরা দুর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো, কেউ কেউ ওদের খুব কাছে এগিয়ে এলো। কারও কারও মুখে মজা দেখার, আবার কারও মুখে ভীতির ছাপ।

স্নেইপ মাটিতে পড়ে গিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। জেমস আর সিরিয়স ওর দিকে এগিয়ে গেলো জাদুদণ্ড হাতে তুলে, জেমস লেকের পারে ছাত্রীদের দেখতে লাগলো। ওয়ার্মটেল, আর লুপিনের পাশে দাঁড়িয়ে ওদের ভালো করে দেখতে লাগলো।

জেমস জিজ্ঞেস করলো, পরীক্ষা কেমন হলো! স্নিভেলি?

–আমি ওকে দেখছিলাম, ওর নাকতে পার্চমেন্টে ঠেকে গিয়েছিলো, সিরিয়স আক্রোশের সুরে বললো, পার্চমেন্ট তেলের দাগে চ্যাপচ্যাপে হয়ে যাবে, পরীক্ষক একটা অক্ষরও পড়তে পারবেন না।

বেশ কয়েকজন হেসে উঠলো ওদের কথাবার্তা শুনে। স্নেইপ কি যে ছেলে মেয়েরা পছন্দ করে না ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ওয়ার্মটেল ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলো। জাদু প্রয়োগের জন্য স্নেইপ উঠবার চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারলো না। ওকে যেনো দড়ি দিয়ে কেউ আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে। স্নেইপ ছটফট করতে লাগলো।

জেমসের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, দাঁড়াও, তোমাকে মজা দেখাচ্ছি!

যেনো কিছুই হয়নি সিরিয়স এমনই এক মুখ করে বললো, কিসের জন্য? আরে তুমি কি করতে পারো সিভেলি, এবার তুমি নাক মুছে আমাদের দিকে তাকাও।

স্নেইপের জাদুদণ্ড অনেক দূরে পড়ে রয়েছে তাই শুয়ে শুয়েই বিড় বিড় করে নানা জাদুমন্ত্র বললো কিন্তু কাজের কিছু হলো না। জাদুদণ্ড তো ওর আয়ত্বে নেই।

স্নেইপের মুখ থেকে গোলাপি রঙের সাবানের বাবলস বেরিয়ে এলো।

বাবলস সারা মুখ ঢেকে দিলো, কথা বলার শক্তি নেই। যেনো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে স্নেইপের।

জেমস বললো, উঠো, এবারে স্কাউর জিফাই। মুখ ধুয়ে এসো।

লেকের ধারে বসে থাকা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হ্যারির চোখ পড়লো একটি মেয়ের দিকে। মাথাভর্তি লাল চুল তার পিঠের ওপোর ছড়িয়ে পড়েছে। চকচক করছে বাদামি রঙের দুটি চোখ, অনেকটা হ্যারির মতো।

সে হ্যারির মা!

জেমস তাকে দেখে অনেক শান্ত ও নরম হয়ে গেলো।

–কেমন আছো ইভান্স? গলার স্বর ওর অনেক শান্ত।

–তুমি স্নেইপের পেছনে কেন লাগছ জেমস, ওতো তোমাকে কিছু করেনি।

জেমস বললো, ও রয়েছে কেন বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?

–তুমি মনে করেছো তুমি খুব মজার লোক! তা নয়, তুমি একটি একগুঁয়ে ঝগড়াটে, পটার কেন তুমি বিরক্ত করছো? ওকে একলা থাকতে দাও জেমস।

জেমস বললো–পেছনে লাগা বন্ধ করতে পারি একটি শর্তে যদি তুমি আমার সঙ্গে চলো ইভান্স। তাহলে ওই বুড়ো স্নিভেলিকে ছেড়ে দেবো।

লিলি বললো, তুমি যদি কারো পেছনে লাগো তাহলে তোমার সঙ্গে যাবো না বলে দিলাম।

সিরিয়স বললো, ভাগ্য খারাপ। কথাটা বলে স্নেইপের দিকে তাকিয়ে বললো, ওহো…।

দেরি করে ফেলেছে জেমস। স্নেইপ ততক্ষণে ওর জাদুদণ্ড তুলে নিয়ে জেমসের দিকে তুলে ধরেছে। জেমসের মুখের ধারে বেশ বড় মতন এক ঝলক আলো দেখা গেলো, আলখেল্লাটা রক্তের ছিটেতে ভরে গেলো। জেমস তরাক করে লাফিয়ে সরে গেলো। দ্বিতীয়বার আলোর ঝলক দেখা দিলে দেখা গেলো স্নেইপের পা ওপোরে, মাথা নিচে ও হাওয়াতে ভাসছে। গায়ের আলখেল্লাটা মাথা থেকে নিচে ঝুলে পড়েছে, ল্যাক প্যাকে দুটো পা আর ময়লা ময়লা আন্ডার প্যান্টস দেখা। যাচ্ছে।

ওখানে যারা ছিলো তারা ছাড়াও জেমস, সিরিয়স আর ওয়ার্মটেল স্নেইপের ওই অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে ফেটে পড়লো।

লিলি ভীষণ রেগে গিয়ে জেমসকে বললো, ওকে নামিয়ে দাও বলছি জেমস।

–নিশ্চয়ই দেবো, নিশ্চয়ই দেবো। জেমস ওর জাদুদণ্ড ওপোরে তুলতেই স্নেইপ ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। মাটিতে পড়েই স্নেইপ বেশভুষা ঠিক করে ওর জাদুদণ্ডটা বার করবার আগেই সিরিয়াস বললো–পেট্ৰিফিকাস টোটালাস! বলার সঙ্গে সঙ্গে স্নেইপ বসে পড়লো একটা বোর্ডের মতো।

আবার লিলি জোরে জোরে বললো–ও যেমন ছিলো তেমনভাবে ওকে থাকতে দাও! লিলি কথাটা বলেই নিজের জাদুদণ্ড বার করলো। জেমস আর সিরিয়স সতর্ক হয়ে গেলো।

জেমস অনুনয়ের সুরে বললো–ওহো ইভান্স তোমাকে সম্মোহন করতে আমাকে বাধ্য করো না।

–বেশ তাহলে ওর ওপোর থেকে তোমার সম্মোহন তুলে নাও।

জেমস গভীর শ্বাস ফেলে স্নেইপের দিকে তাকিয়ে বিপরীত সম্মোহন প্রয়োগ করলো।

স্নেইপকে কোনরকমে দাঁড়াতে দেখে জেমস বললো, ইভান্স আছে বলেই তুমি আজ ছাড়া পেয়ে গেলে।

–আরে যাও যাও কে ওই নোংরা ক্ষুদে মাডব্লাডের সাহায্য চায়।

লিলি চোখ ছোট ছোট করে হাসলো। বাঃ বেশ ভালই, ও শান্ত স্বরে বললো।

জেমস স্লেইপের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে বললো, এই তুমি ইভান্সের কাছে ক্ষমা চাও বলছি। আবার ওর জাদুদণ্ড স্নেইপের দিকে এগিয়ে দিলো জেমস।

লিলি বললো–আমার জন্য স্নেইপ অবশ্যই ক্ষমা চাইবে না। তোমরা দুজনেই ঠিক নয়।

–কি বললে? জেমস রেগে গিয়ে বললো, আমি তোমাকে কখনোই ওইরকম বলবো না, তুমি জানো!

ইভান্স বললো–জেমস তুমি খুব বদরাগি। যা করছো সবই ঠিক করছো ভাবো। করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যাকে সামনে পাও তাকেই সম্মোহন করো, কারণ তুমি যা পারো, অনেকেই তা পারে না বলে। সত্যি তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

কথাটা বলে ইভান্স সেখান থেকে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।

–ইভান্স শোনো শোনো রাগ করো না, জেমস নরম সুরে বললো।

কিন্তু ইভান্স ফিরে তাকালো না।

জেমস বললো, কে জানে ও এতো রেগে আছে কেন! আমি কোনো কথা ওকে আঘাত দেবার জন্য বলি না, মাঝে মাঝে রাগিয়ে দিই।

আবার একটা আলোর ঝলক, স্নেইপকে দেখা গেলো মাথা নিচু পা ওপোরে, হাওয়াতে ভাসছে।

–সিভেলির প্যান্ট খুলে নিচ্ছি কে দেখতে চায়?

–কিন্তু সত্যই জেমস স্নেইপের প্যান্ট খুলে নিয়েছে কিনা কেউ দেখতে পেলো না। কে যেনো একটা হাত দিয়ে ওর কাঁধ চেপে ধরলো। হ্যারি সেই হাত ছাড়িয়ে কে চেপে ধরেছে দেখবার চেষ্টা করলো। আঁতকে উঠলো সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে। স্নেইপ আর অতীতের কিশোর বালক নেই। ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর স্নেইপ, রাগে গড় গড় করতে করতে বললেন–খুব মজা লেগেছে তাই না?

হ্যারির মনে হলো ও আকাশে উড়ছে। গরমের দিন উধাও হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা বরফশীতল অন্ধকারে ভাসতে ভাসতে ওপোরে উঠছে। স্নেইপ একটা হাত দিয়ে ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছেন। তারপরই তীর বেগে নিচে নামতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর পা স্নেইপের ঘরের পায়ের স্পর্শ পেলো। দেখলো ডেস্কের সামনে স্নেইপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ডেস্কের ওপোর পেনসিভ।

হ্যারির হাতটা অসম্ভব শক্ত করে ধরে। এতো শক্ত করে ধরে রয়েছেন যে, হাতটা অসার হয়ে গেছে। তো, পটার খুব মজা পেয়েছো তাই না?

 হ্যারি স্নেইপের হাত থেকে মুক্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো–না, নাতো স্যার।

–তোমার বাবা দারুণ মজারু ছিলো তাই না? স্নেইপের ঠোঁট দুটো কাঁপছে, মুখটা সাদা, দাঁত নেই বললেই চলে। হ্যারিকে এতো জোরে নাড়া দিতে লাগলেন যে, ওর চশমা নাকের ডগায় নেমে এলো।

–সত্যি বলছি না।

স্নেইপ তার শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হ্যারিকে ছুঁড়ে ফেললেন। হ্যারি দরাম করে অন্ধকার ঘরে পড়ে গেলো।

–তুমি যা যা দেখলে কাউকে বলবে না, স্নেইপ ধমকে বললেন।

–না, বলবো না, হ্যারি মেঝে থেকে দাঁড়াবার চেষ্টা করে বললো–কাউকে বলবো না।

–বেরিয়ে যাও, আমার অফিসে আর যেনো তোমাকে দেখতে না পাই।

হ্যারি দরজার দিকে যাবার সময় একগাদা মরা আড়শোলা ওর মাথার ওপোর পড়লো। ও দরজাটা খুলে করিডোর দিয়ে পো-পা করে দৌড়ালো। স্নেইপ আর ওর ব্যবধানে তিনটে তলা পর্যন্ত পৌঁছে ও থামলো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁফাতে লাগলো। চটে যাওয়া হাতে হাত বুলোতে লাগলো।

ওর গ্রিফিল্ডর টাওয়ারে যেতে এতটুকু ইচ্ছে করলো না। রন আর হারমিওনকে। যা যা দেখেছে তা বলারও একটু ইচ্ছে নেই। ওর বাবা সকলের সামনে স্নেইপকে যথেষ্ট হেয় করেছিলেন সন্দেহ নেই। স্নেইপের তখনকার মনের অবস্থা হ্যারি বুঝতে পেরেছে। সব কিছু দেখে ওর বাবা যে খুব একগুয়ে বদ মেজাজী, তবে মজা করতে ভালো বাসতেন, স্নেইপ এই কথাটি ওকে অনেকবার বলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *