২৮. সালমা বানু চোখ মেললেন

সালমা বানু চোখ মেললেন। ঘর আলো হয়ে আছে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তবু কিছুই যেন ঠিক স্পষ্ট না। নতুন চশমা পরলে চারপাশ যেমন এলোমেলো লাগে–তেমন লাগছে। সব কেমন যেন আঁকা বাঁকা। মাথার উপরের ছাদ মাঝখানে খানিকটা যেন নেমে এসেছে। তিনি কোথায়? হাসপাতালে? হাসপাতালে যদি হন। তাহলে ঘরটা চিনতে পারছেন না কেন? তার তৃষ্ণা বোধ হল। প্রবল তৃষ্ণা না–হালকা ধরনের তৃষ্ণা। ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি কেউ তার হাতে দিলে তিনি ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে গ্লাসটা শেষ করতেন। ঢাক ঢক করে না। ঢাক ঢক করে পানি খাওয়ার মত তৃষ্ণা তার হয়নি। আরামদায়ক তৃষ্ণা। যে তৃষ্ণা নিয়ে রাতে ঘুমুতে যাওয়া যায়। ঘুমের অসুবিধা হয় না।

তিনি সাবধানে মাথা কাত করলেন। তার কাছে মনে হচ্ছিল কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না। পুরো ঘরটা ফাঁকা। তাঁর একটু ভয় ভয় লাগল। তিনি ডাকলেন, রুনু, ও রুনু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে রুনু নামের কাউকে তিনি চেনেন না। হঠাৎ এই নামটা কেন তাঁর মাথায় এল তিনি জানেন না। তার শীত শীত করছিল। কেউ যদি একটা পাতলা সুতির চাদর তাঁর কোমর পর্যন্ত টেনে দিত। এটা কোন কাল? শীত কাল? আশ্বিনের শেষ ভাগ? আশ্বিনের শেষ ভাগে গায়ে হালকা সুতির চাদর দিতে হয়।

একটা চালতা গাছের কথা তার মনে পড়ল। তাদের মামার বাড়ির উঠোনে চালতা গাছটা ছিল। ঘন সারিবদ্ধ পাতার কি বিশাল গাছ। পাতাগুলি করাতের মত খাজকাটা। মে-জুন মাসে বড় বড় ফুল ফুটতো। শাদা ফুল। মোটা পুরুষ্ট পাপড়ি। কি অদ্ভুত সুগন্ধি ফুল! মেজো মামী একবার চালতার আঠা এনে তাঁর মাথায় মাখিয়ে দিলেন, এতে না-কি চুল উজ্জ্বল হবে। চুল উজ্জ্বল হয়েছিল কি-না তাঁর মনে নেই। কারণ তার দুদিন পরই তার মাথা কামিয়ে দেয়া হয় যাতে ঘন হয়ে চুল উঠে।

তিনি হাসপাতালের এই ঘরে চালতা ফুলে গন্ধ পেতে লাগলেন। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও চালতা গাছ আছে। চালতা গাছ ছেয়ে ফুল ফুটেছে। তিনি আবারো ডাকলেন–রুনু, ও রুনু। তাঁর মন বলছে–রুনু নামের একজন কেউ পাশেই ঘুর ঘুর করছে। সে একটা পাতলা সুতির চাদর তাঁর কোমর পর্যন্ত টেনে দেবে। কঁচের ঝকঝকে পরিষ্কার গ্রাসে করে এক গ্রাস পানি এনে দেবে। তখন তিনি রুনুকে বলবেন, ও রুনু, তুই আমাকে কয়েকটা চালতা ফুল এনে দিতে পারবি? রাতের বেলা গাছ থেকে ফুল পাড়া নিষেধ। তবু তার খুব ইচ্ছা করছে বালিশের কাছে কয়েকটা ফুল রেখে দিতে।

কিশোরী বয়সে বালিশের কাছে ফুল রেখে ঘুমানোর অভ্যাস হয়েছিল। ফুলের গন্ধ নিয়ে ঘুমুতে গেলে সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায়। সুন্দর স্বপ্ন দেখার লোভে রাতের পর রাত তিনি বালিশের পাশে ফুল নিয়ে ঘুমিয়েছেন।

একবার অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেওছিলেন। কিশোরী বয়সের সেই স্বপ্নে একটা কিশোর ছিল। যার চোখ দুটি মেয়েদের মত জলেভরা। স্বপ্নে তিনি ছেলেটির সঙ্গে নানান ধরনের দুষ্টুমি করেছিলেন। সে কোন প্রতিবাদ করে নি। সারাক্ষণ মাথা নিচু করেছিল। এক একবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে কেঁদে ফেলবে। তবু তিনি দুষ্টুমি বন্ধ করলেন না। দুষ্টুমি করতে তাঁর এত মজা লাগছিল। স্বপ্ন ভাঙ্গার পর তিনি অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তাঁর মনে হল–এই রকম সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এরকম একটা ছেলের সাথেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিশোরী বয়সের স্বপ্নের ব্যাপারটা তিনি অবশ্যি কোনদিনই তাঁর স্বামীকে বলেন নি। ছেলেমেয়েদেরও বলেন নি। আজ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে— অথচ আজ কেউ পাশে নেই। রুনু মেয়েটা বোধ হয় আছে। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন, ও রুনু। রুনু।

রুনু জবাব দিল। অস্পষ্টভাবে বলল, হুঁ।

ও রুনু, ঘরের জানালা বন্ধ কেন? জানালা খুলে দিলে চালতা ফুলের গন্ধ আরো ভাল পাওয়া যেত।

কথাগুলি তিনি বললেন খুব স্পষ্টভাবে। তারপরই তাঁর তৃষ্ণা হঠাৎ বেড়ে গেল, শ্ৰবাসকষ্ট শুরু হল। সমস্ত শরীরে বিচিত্ৰ এক ধরনের ছটফটানি শুরু হল। তিনি আবারো ডাকলেন, ও রুনু। রুনু…..

একবারের জন্যেও তাঁর নিজের পুত্র-কন্যা, স্বামীর কথা মনে পড়ল না। পরিচিত পৃথিবীর কারোর কথাই মনে এল না। রুনু নামের একটি কাল্পনিক মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে, চালতা ফুলের গন্ধ শুকতে শুকতে তিনি যাত্রা করলেন–রহস্যময় এক জগতের দিকে। তিনি মারা গেলেন রাত তিনটায়।

 

আতাহার ভোরবেলা কখনো হাসপাতালে আসে না। সেদিন কি মনে করে যেন এল। মার ঘরে উকি দিল। বেডের উপর লম্বালম্বিভাবে হলুদ রঙের একটা চাদর বিছানো। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রবল শোক তাকে আচ্ছন্ন করল না। বরং হঠাৎ নিজেকে খানিকটা মুক্ত বলে মনে হল। মনে হল, এই এতদিন পর বিবলিক্যাল কর্ড কাটা পড়ল। শিশুর জন্মের পর নাড়ি কেটে মার কাছ থেকে তাকে আলাদা করা হয়। তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় তুমি এখন আর তোমার মায়ের শরীরের কোন অংশ না। তুমি আলাদা একজন মানুষ। সত্যিকার অর্থে কিন্তু সেই নাড়ি কাটা পড়ে না। যতদিন মা বেঁচে থাকেন। ততদিন অদৃশ্য নাড়ির বন্ধন থাকে। বন্ধন কাটে মার মৃত্যুতে।

দীর্ঘদিনের অভ্যেসের কারণে আতাহার মনে মনে মাকে বলল, কি ব্যাপার মা, এরকম হুট করে চলে গেলে যে?

বলেই লজ্জা পেল। এমন গভীর বিষাদের সময় এ জাতীয় হালকা কথাবার্তা কি বলা চলে?

আতাহার ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে পুরোপুরি মুক্ত করার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ মা। তোমাকে ধন্যবাদ। একজন মানুষের সৃষ্টির প্রথম শর্ত হচ্ছে পূর্ণ মুক্তি। পুরোপুরি মুক্ত একজন মানুষই সৃষ্টি করতে পারে। সৃষ্টিকতাঁর সৃষ্টির মূল রহস্যই এইখানে–তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত।

হলুদ চাদর সরিয়ে মার মুখ দেখার কোন ইচ্ছা আতাহারের হল না। সে চাচ্ছে তার মনে জীবিত মানুষের মুখের স্মৃতিটিই থাকুক। মৃত মানুষের শীতল ছবি না।

আতাহার হাসপাতালের বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাল। এটা অন্যায় একটা কর্ম। জায়গায় জায়গায় নোটিশ ঝুলছে ধুমপান মুক্ত এলাকা। আজকের দিনে সামান্য অন্যায় বোধ হয় করা যায়। তাকে ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করতে হবে। সারাদিনের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। মিলিকে খবর দিতে হবে। মিলি একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল–কোথায় আছে। সেই নাম্বার কে জানে। নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। মনিকাকে টেলিফোন করতে হবে। খবর শুনে এরা দুজনই আকাশ ফাটিয়ে কাঁদবে। এদের কান্না শুনতে হবে।

মৃত্যু ব্যাপারটা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকার কোন উপায় কি আছে? মৃত্যু শোকে কাতর মানুষদের মৃত্যুশোক ভুলানোর জন্যে কোন ব্যবস্থা থাকলে ভাল হত–বিশেষ একটা টেলিফোন নাম্বার। যে নাম্ববারে ডায়াল করলেই সমবেদনায় আর্দ্র একটি কণ্ঠ বলবে,

আমি জানি তোমার মন ভয়ংকর খারাপ। ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তারপরেও এসো আমরা খানিকক্ষণ গল্প করি। জানোলা দিয়ে তাকিয়ে দেখ বাইরের আকাশ কি ঘন নীল। কত না মধুর বাতাস। তোমার চারদিকে জীবন ঝলমল করছে— এর মাঝখানে মৃত্যু নিয়ে ভেবোনাতো।

আতাহার করিডোর ধরে এগুচ্ছে। তার একটা টেলিফোন করা দরকার। তার মন বলছে পরিচিত কারো সঙ্গে খানিকক্ষণ সাধারণ কোন বিষয় নিয়ে কথা বললেই তার মন ঠিক হয়ে যাবে। যে কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে–আওয়ামী লীগ, বিএনপি রাজনীতি। খালেদা হাসিনার ঠাণ্ডা স্নায়ু যুদ্ধ। গ্ৰীন হাউস এফেক্ট পরিবেশ গত বিপর্যয়। বিষ্ণুদের কবিতায় ভুল ছন্দ …

হাসপাতাল এবং রেলওয়ে ইনকোয়ারির টেলিফোন কখনো ডায়াল টোন থাকে না। রিসিভার উঠালে হয়। ভয়াবহ নীরবতা কাকে বলে তা বোঝা যায় কিংবা কট কট শব্দ হয়। মনে হয় কেউ যেন জাতি দিয়ে টেলিফোনের তার কাটছে।

আতাহার বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল হাসপাতালের ইনকোয়ারির টেলিফোন ঠিক আছে। ডায়াল টোন আসছে। সে সাজ্জাদের নাম্বার ডায়াল করল। দুবার রিং হতেই সাজ্জাদ বলল, আতাহার তোর খবর কিরে?

আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, বুঝলি কি করে আমি?

মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে। রিং বাজা মাত্রই মনে হল তুই। খবর কি রে?

তেমন কোন খবর নেই।

তুই বাসায় চলে আয়। এক্ষুণি চলে আয়।

এখন আসতে পারব না। একটা সমস্যা আছে।

মানুষ হয়ে জন্মেছিস সমস্যাতে থাকবেই। চলে আয়।

এখন আসতে পারব না। সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকব।

রাতে আসবি?

হ্যাঁ, তা আসতে পারি। কোথায়?

এখন বলব না। আগে এরেঞ্জ করে নেই।

আসে-পাশে কি নীতু আছে নাকি?

না। কথা বলবি? ডেকে দেই?

দে।

আতাহার টেলিফোন ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ইস, কেউ যদি এক মগ গরম এসপ্রেসো কফি তার হাতে ধরিয়ে দিত। আর একটা ডানহিল সিগারেট। ফেনা ভর্তি কফির মাগে চুমুক দিতে দিতে সে টেলিফোনে কথা বলতে পারত।

আতাহার ভাই!

কে, নীতু?

হুঁ।

তুই আছিস কেমন?

ভাল।

জ্বর কমেছে?

হুঁ।

শুনলাম কামাল সাহেবের সঙ্গে বিয়েটা হচ্ছে না। এ রকম হুটহাট ডিসিশান নিস কেন? খুব খারাপ।

আপনার কি হয়েছে আতাহার ভাই?

কিছু হয় নিতো।

আমার ধারণা হয়েছে। আপনার গলার স্বর পালেট গেছে।

মনে হয়। ঠাণ্ডা লেগেছে।

না ঠাণ্ডা না— অন্য কিছু। আতাহার ভাই আপনার মা কেমন আছেন?

আতাহার জবাব দিল না। তার ইচ্ছা করছে টেলিফোনটা রেখে দিতে।

আতাহার ভাই?

হুঁ।

আপনার মা কেমন আছেন?

কেমন আছেন বলতে পারছিনারে। তাকে একটা হলুদ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। শাদা চাদরে ঢেকে রাখা নিয়ম–মনে হয় এদের শাদা চাদর শেষ হয়ে গেছে।

আতাহার ভাই, আপনি কি হাসপাতালে?

হুঁ।

আমি আসছি।

তুই কি আমার জন্যে একমগ এসপ্রেসো কফি বানিয়ে আনবি? আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছা করছে।

আমি কফি নিয়ে আসব।

তুই কি একটু সেজোগুজে আসবি নীতু? আমার খুব সুন্দর একটা মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে।

 

বাদ আছর আতাহার তার মাকে কবরে নামিয়ে দিল। রাত নটা পর্যন্ত এক একা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হাঁটাল। দশটার দিকে সাজ্জাদের সঙ্গে গেল চানখার পুলের এক বাড়িতে। মজার কিছু দেখতে।

মজার ব্যাপারটা ঘটতে যাচ্ছে। আতাহার তাকিয়ে আছে। তার পেটের সবকিছু দিলা পাকিয়ে উঠেছে। সে অনেক কষ্টে ঘেন্না চেপে রাখছে। কতক্ষণ চেপে রাখতে পারবে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে শরীরের সমস্ত ঘেন্না বমি হয়ে বের হয়ে আসবে। দুৰ্গন্ধ বমিতে সে সমস্ত পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে। কারণ তার চোখের সামনে নোংরা কদৰ্য একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে।

সে এবং সাজ্জাদ বসে আছে একটা টিনের বাড়ির মেঝেতে। এই গরমেও বাড়ির সব কটা জানালা বন্ধ। তাদের সঙ্গে আরো তিনজন আছে, যারা ডাল-খোর। নেশার জগতে ফেসিডিলের আদরের নাম হল ডাল। যারা দৈনিক তিন-চার বোতল খায় তারাই ডাল-খোর। ডাল খাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর আনন্দময় আবহাওয়া বিরাজ করছে। তিন ডাল-খোরের একজন এখন আরেকটি বিচিত্র নেশা করবে। আতাহার এবং সাজ্জাদ তার জন্যেই অপেক্ষা করছে। সে জ্যান্ত টিকটিকি খাবে। ডালের নেশা দু-তিন ঘণ্টার বেশি থাকে না। ডালের পর একটা জ্যান্ত টিকটিকি খেতে পারলে নেশাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। পৃথিবী নানা বর্ণে, নানা গন্ধে ধরা দেয়।

টিকটিকে যে খাবে তার নাম কুদ্দুস। সে এক কৃষি ব্যাংকের নাইট গার্ড। আজ তার অফ ডিউটি। সে মুখ-বন্ধ টিনের কোটায় টিকটিকি নিয়ে এসেছে। টিনের কোটার মুখ ফুটো করা আছে যাতে টিকটিকি মরে না যায়।

সাজ্জাদ। বলল, কৌটায় কয়টা টিকটিকি আছে?

কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, তিন-চারটা আছে, গনতি নাই। বেশীও থাকতে পারে।

আপনি খাবেন কটা?

ভাইজান একটা খাব। বিষাক্ত জিনিস তো–বেশি খাইলে বাঁচনের উপায় নাই।

জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন?

জ্যান্ত খাওনের নিয়ম। খাওনের পর ডাইল দিয়ে কুলি করলেই সব হজম। তবে ভাইজান–টিকটিকির লেজের বিষয়ে সাবধান। টিকটিকির সব বিষ তার লেজে।

লেজ খাওয়া যায় না? তাও খাওয়া যায়। অনেক ঝামেলা আছে। লেজটারে প্রথম পুইড়া ছাই বানাইতে হয়। সেই ছাই সিগারেটের শুকার সাথে মিশাইয়া টানতে হয়।

আপনি টেনেছেন?

জ্বে-না, অত ঝামেলা পুষায় না।

আতাহার বলল, জ্যান্ত টিকটিকি খান, ঘেন্না লাগে না?

ঘিন্নার কি আছে? মাছ মাংস মানুষে খায় না? অত ঘিন্না করলে দুনিয়াতে বাঁচন যায় না। তাছাড়া ভাইজান, ডাইল-খোরের অত ঘিন্না থাকে না। এইটাই ডাইলের মজা। ডাইল খাইলে কোন কিছুতে ঘিন্না লাগে না। সবেরে বড় আপন লাগে। দুনিয়াটা যে রঙ্গিলা এইটা ডাইল না খাইলে বুঝা যায় না।

আতাহার ঘৃণা ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদের চোখে কোন ঘৃণা নেই, বিস্ময়ও নেই। তার চোখে শুধুই কৌতূহল। নির্ভেজাল কৌতূহল।

কুদ্দুস টিনের কোটা থেকে একটা টিকটিকি বের করে আনল। বা হাতের আঙুলে একটা টোকা দিতেই টিকটিকির লেজ খসে পড়ল। কুদ্দুস হাসিমুখে বলল, বড়ই আজিব পোকা। লেজ খুইল্যা পড়ে, আবার লেজ হয়।

ছাদের দিকে মুখ করে কুদ্দুস প্রকাণ্ড হা করে টিকটিকিটা মুখের ভেতর ছেড়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করল। কচ কচ শব্দ হচ্ছে।

আতাহার ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দুহাতে পেট চেপে রাস্তায় বসে পড়ল। মনে হচ্ছে বমি করতে করতে সে রাস্তাতেই নেতিয়ে পড়বে। রাস্তা ফাকা, দূরে ডাস্টবিনের কাছে একটা কুকুর ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। কুকুরটা ভীত পায়ে আতাহারের দিকে আসছে। আতাহারের মনে হল কুকুরটার চোখ মমতা ও সহানুভূতিতে আর্দ্র। আতাহার ডাকল, আয় আয়, তুই আমার কাছে আয়।

কালো রঙের কুকুর এগিয়ে আসছে। আতাহার আবারো ডাকল, আয় আয়–। কি আশ্চর্য! এই অদ্ভূত অবস্থাতেই তার মাথায় কবিতার লাইন আছে। কোন মানে হয়? একজন কবি সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করেন–একগাদা বমি সামনে নিয়ে সে বসে আছে। এর ভেতর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্যের জন্ম অন্ধকারে। আলোর জন্মদাত্রী মা অবশ্যই অন্ধকার।

একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা
হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেলো।
ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।
বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার।
আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি–
অন্ধকারকে দেখব বলে।
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার।

একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল।
বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।
কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার!
কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার
সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।
তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে।
তবু সে হাঁটছে–
তাকে যেতে হবে আরো গভীর অন্ধকারে।
যে অন্ধকার–আলোর জন্মদাত্রী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *