২৮. শাহানার বিয়ে হয়ে গেল

তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই শাহানার বিয়ে হয়ে গেল। বড়ো সমস্যা ছিল বিয়ের খরচের সমস্যা। তার সমাধান হল অদ্ভুত ভাবে। হোসেন সাহেব কবির মাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন রফিকের শ্বশুর রহমান সাহেবকে দাওয়াত দিতে। দুজনই ভেবে রেখেছিলেন পরিচয়পর্ব খুব সুখকর হবে না। হোসেন সাহেব আসতে চান নি। তিনি বারবার বলছিলেন, ছোট বৌমা আগে যাক, বাবার সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে আসুক, তারপর আমি যাব। মনোয়ারা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকেছেন, ছোট বৌমা যেতে চাচ্ছে না, তাকে জোর করে পাঠাব?

তাকে জোর করে পাঠাবে না, তাহলে আমাকে জোর করে পাঠােচ্ছ কেন?

বাজে কথা বলবে না। তৈরি হও, কবির ভাই যাবে তোমার সাথে। কথাবার্তা যা বলবার সেই-ই বলবে, তুমি চুপ করে থাকবে।

তাহলে আমার যাবার আর দরকারই—বা কী?

আবার বাজে কথা?

হোসেন সাহেব চুপ করে গেলেন। দাওয়াতের চিঠি হাতে এমনভাবে বের হলেন যেন ফাঁসিকাঠে ঝোলবার জন্যে যাচ্ছেন। ইয়া মুকাদেমু পড়ে ডান পা ফেললেন। আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন। দোয়ার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক রফিকের শ্বশুর হোসেন সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন। আন্তরিক স্বরে বললেন, আমার এত সৌভাগ্য, এত বড় মেহমান আমার ঘরে! আদরযত্বের চূড়ান্ত করলেন ভদ্রলোক। নিজের মেয়ের কথা এক বারও জিজ্ঞেস করলেন না। কবির মাস্টার সে-প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মেয়ের সঙ্গে যা বোঝাপড়া তা আমাকেই করতে দিন। ঐটা বাদ থাক। আপনি আপনার নীলগঞ্জের ব্যাপারটা বলুন। এই বয়সে একটা শক্ত কাজ হাতে নিলেন।

যখন বয়স কম ছিল, তখন এইসব চিন্তা মাথায় আসে নি। এখন এসেছে। এখন কি বয়সের কারণে ঐ চিন্তা বাদ দেওয়া ঠিক হবে?

মোটেই ঠিক হবে না। বয়স কোনো ব্যাপার নয়।

আপনি আমার মনের কথাটা বলেছেন বেয়াই সাহেব।

এক দিন যোব আপনার নীলগঞ্জ দেখতে।

ইনশাআল্লাহ। বড়ো খুশি হলাম বেয়াই সাহেব, বড়ো খুশি হলাম।

শাহানার বিয়েতে তিনি থাকতে পারবেন না বলে খুব দুঃখ করলেন, কারণ আজ সন্ধ্যায়। তাঁকে ব্যাংকক যেতে হচ্ছে। কিছুতেই থাকা সম্ভব নয়।

বুঝলেন বেয়াই সাহেব, এক দিন আগে জানতে পারলেও ব্যাংককের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করতাম। এখন তো সম্ভব না। আপনি কিছু মনে করবেন। না।

তাঁরা উঠে আসবার সময় রহমান সাহেব বেশ বিব্রত মুখেই একটি খাম এগিয়ে দিলেন। নরম স্বরে বললেন, এটা দিতে খুবই লজ্জা পাচ্ছি। নিজের হাতে কোনো একটা গিফটু দেওয়া দরকার ছিল। এত অল্প সময়ে কিছু কেনা সম্ভব নয়। আপনার মেয়েকে বলবেন, সে যেন নিজের পছন্দ মতো ভালো একটা কিছু কেনে।

বাড়ি ফেরার পথেই খাম খোলা হল। দশ হাজার টাকার একটা ক্রসূড় চেক। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! হোসেন সাহেব ভেবেছিলেন চেক দেখে মনোয়ারা রেগে যাবেন। ক্যাটিক্যাট করে বলবেন, এত বড় সাহস, আমাকে টাকা দেখাচ্ছে। টাকার গরম আমার কাছে?

আশ্চর্যের ব্যাপার–সে রকম কিছু হল না। মনোয়ারা একটি কথাও বললেন না। ঐ টাকায় শাহানাকে কিছু কিনে দেওয়া হল না। পুরোটাই খরচ হল বিয়েতে। আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হল। খাবারের মেনুতে আগে টিকিয়া ছিল না, এখন টিকিয়া এবং দৈ মিষ্টি যোগ হল। গরিব আত্মীয়স্বজন যারা বিয়েতে এসেছে, তাদের অনেকের জন্যে শাড়ির ব্যবস্থা হল। ছেলেকে যে আংটি আগে দেবার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক ভালো একটা আংটি কেনা হল। মনোয়ারার ইচ্ছা ছিল সু্যুটের কাপড় আরেকটু ভালো দেওয়া। কিন্তু আগেই কাপড় কিনে দরজির দোকানে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সেটা সম্ভব হল না।

শাহানা বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠানটি খুব সহজভাবেই পার করল। মনোয়ারা ভেবেছিলেন মেয়ে কেঁদেকেটে বিশ্ৰী একটা কাণ্ড করবে। সে রকম কিছু হল না! শাহানার আচরণ সহজ এবং স্বাভাবিক। এক বার শুধু নীলুকে বলল, ভাবী, আনিস ভাইকে একটু ডেকে আনবে? কথা বলব।

নীলু বিরক্ত স্বরে বলল, এখন ওর সঙ্গে কথা বলবে মানে? কী কথা?

তেমন কিছু না। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছে কিনা।

ঐসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

আচ্ছা যাও, ভাবব না।

শাহানা মিষ্টি করে হাসল। বিয়ের সাজে আজ তাকে তেমন সুন্দর লাগছে। না। কেমন যেন জবড়াজং দেখাচ্ছে। গা ভর্তি গয়না। ফুলেফেপে আছে জমকালো শাড়ি। ঠোঁটে কালচে রঙের লিপস্টিক। একেবারেই মানাচ্ছে না। এক দল মেয়ে তাকে ঘিরে আছে। এরা অকারণে হাসছে। এদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসছে শাহানা। একেক বার হাসতে— হাসতে ভেঙে পড়ছে। দৃশ্যটি কেমন যেন ভালো লাগে না। নীলু এক সময় শাহানাকে এক পাশে নিয়ে নিচু গলায় বলল, এত হাসছ কেন?

হাসির গল্পগুজব হচ্ছে, তাই হাসছি। কেন ভাবী, আমার হাসায় কোনো বাধা আছে?

শাহানার গলার স্বরও যেন অন্য রকম। কঠিন এবং কিছু পরিমাণে কৰ্কশ। নীলু আর কিছু বলল না। শাহানা ফিরে গিয়ে আরো শব্দ করে হাসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *