বৈদ্যবাটীর বাটী ক্রমে অন্ধকারময় হইল –রক্ষণাবেক্ষণ করে এমন অভিভাবক নাই –পরিজনেরা দুরবস্থায় পড়িল –দিন চলা ভার হইল, গ্রামের লোকে বলিতে লাগিল বালির বাঁধ কতক্ষণ থাকিতে পারে? ধর্মের সংসার হইলে প্রস্তরের গাঁথনি হইত। এদিকে মতিলাল নিরুদ্দেশ –দলবলও অন্তর্ধান –ধুম-ধাম কিছুই শুনা যায় না –প্রেমনারায়ণ মজুমদারের বড়ো আহ্লাদ –বেণীবাবুর বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া তুড়ি দিয়া “বাবলার ফুল লো কানে লো দুলালি, মুড়িমুড়কির নাম রেখেছো রুপালী সোনালী” এই গান গাইতেছেন। ঘরের ভিতরে বেণীবাবু তানপুরায় মেও মেও করিয়া হামির রাগ ভাঁজিয়া “চামেলি ফুলি চম্পা” এই খেয়াল সুরৎ মূর্ছনা ও গমক প্রকাশপূর্বক গান করিতেছেন। ওদিকে বেচারামবাবু “ভবে এসে প্রথমেতে পাইলাম আমি পঞ্জুড়ি” এই নরচন্দ্রী পদ ধরিয়া রাস্তায় যাবতীয় ছোঁড়াগুলাকে ঘাঁটাইয়া আসিতেছেন। ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাততালি দিতেছে। বেচারামবাবু এক একবার বিরক্তি হইয়া “দূঁর দূঁর” করিতেছেন। যৎকালে নাদের শা দিল্লী আক্রমণ করেন তৎকালীন মহম্মদ শা সংগীত শ্রবণে মগ্ন ছিলেন –নাদের শা অস্ত্রধারী হইয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে মহম্মদ শা কিছুমাত্র না বলিয়া সংগীতসুধা পানে ক্ষণকালের জন্যেও ক্ষান্ত হয়েন নাই –পরে একটি কথাও না কহিয়া স্বয়ং আপন সিংহাসন ছাড়িয়া দেন। বেচারামবাবুর আগমনে বেণীবাবু তদ্রূপ করিলেন না –তিনি অমনি তানপুরা রাখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে বসাইলেন। কিয়ৎক্ষণ শিষ্ট মিষ্ট আলাপ হইলে পর বেচারামবাবু বলিলেন –বেণী ভায়া। এতদিনের পর মুষলপর্ব হইল –ঠকচাচা আপন কর্মদোষে অধঃপাতে গেলেন। তোমার মতিলালও আপন বুদ্ধিদোষে রূপস্ হইলেন। ভায়া ! তুমি আমাকে সবর্দা বলিতে ছেলের বাল্যকালাবধি মাজা বুদ্ধি ও ধর্মজ্ঞান জন্য শিক্ষা না হইলে ঘোর বিপদ ঘটে, এ কথাটির উদাহরণ মতিলালেতেই পাওয়া গেল। দুঃখের কথা কি বলিব? এ সকল দোষ বাবুরামের –তাঁহার কেবল মোক্তারি বুদ্ধি ছিল –বুড়িতে চতুর কিন্তু কাহনে কানা, দূঁর দূঁর !!
বেণী। আর এ সকল কথা বলিয়া আক্ষেপ করিলে কি হইবে? এ সিদ্ধান্ত অনেকদিন পূর্বেই করা হয়েছিল –যখন মতির শিক্ষা বিষয়ে এত অমনোযোগ ও অসৎ সঙ্গ নিবারণের কোনো উপায় হয় নাই তখনই রাম না হতে রামায়ণ হইয়াছিল। যাহা হউক, বাঞ্ছারামেরই পহবারো –বক্রেশ্বরের কেবল আঁকুপাঁকু সার। মাস্টারি কর্ম করিয়া বড়োমানুষের ছেলেদের খোশামোদ করিতে এমন আর কাহাকেও দেখা গেল না –ছেলেপুলেদের শিক্ষা দেওয়া তথৈবচ, কেবল রাত-দিন লব লব, অথচ বাহিরে দেখানো আছে আমি বড়ো কর্ম করিতেছি –যা হউক মতিলালের নিকট বাওয়াজির আশাবায়ু নিবৃত্তি হয় নাই –তিনি “জল দে, জল দে” বলিয়া গগিয়া আকাশ ফাটাইয়াছেন কিন্তু লাভের মেঘও কখন দেখিতে পান নাই –বর্ষণ কি প্রকারে দেখিবেন ?
প্রেমনারায়ণ মজুমদার বলিল –মহাশয়দিগের আর কি কথা নাই? কবিকঙ্কণ গেল –বাল্মীক গেল –ব্যাস গেল –বিষয়কর্মের কথা গেল –একা বাবুরামি হাঙ্গামে পড়ে যে প্রাণ ওষ্ঠগত হইল –মতে ছোড়া যেমন অসৎ তেমনি তার দুর্গতি হইয়াছে, সে চুলায় যাউক, তাহার জন্য কিছু খেদ নাই।
হরি তামাক সাজিয়া হুঁকাটি বেণীবাবুর হাতে দিয়া বলিল –সেই বাঙালবাবু আসিতেছেন। বেণী বাবু উঠিয়া দেখিলেন বরদাপ্রসাদবাবু ছড়ি হাতে করিয়া ব্যস্ত হইয়া আসিতেছেন –অমনি বেণীবাবু ও বেচারামবাবু উঠিয়া অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন –পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা হইলে পর বরদাবাবু বলিলেন –এদিকে তো যা হবার তা হয়ে গেল সম্প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে –বৈদ্যবাটীতে আমি বহুকালাবধি আছি –একারণ সাধ্যানুসারে সেখানকার লোকদিগের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য –আমার অধিক ধন নাই বটে কিন্তু আমি যেমন মানুষ বিবেচনা করলে পরমেশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছে, আমি অধিক আশা করিলে কেবল তাঁহার সুবিচারের উপর দোষারোপ করা হয় –এ কর্ম মানবগণের উচিত নহে। যদিও প্রতিবেশীদের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য কিন্তু আমার আলস্য ও দুরদৃষ্টবশত ঐ কর্ম আমা হইতে সম্যক্ রূপে নির্বাহ হয় নাই। এক্ষণে –
বেচারাম। এ কেমন কথা। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় দুঃখী প্রাণী লোককে তুমি নানা প্রকারে সাহায্য করিয়াছ –কি খাদ্য দ্রব্যে –কি বস্ত্রে –কি অর্থে –কি ঔষধে –কি পুস্তকে –কি পরামর্শে –কি পরিশ্রমে, কোনো অংশ ক্রটি করো নাই। ভায়া ! তোমার গুণকীর্তনে তাহাদিগের অশ্রুপাত হয় –আমি এ সব ভালো জানি –আমার নিকট ভাঁড়াও কেন ?
বরদা। আজ্ঞে না ভাঁড়াই নাই –মহাশয়কে স্বরূপ বলিতেছি, আমা হইতে কাহারো যদি সাহায্য হইয়া থাকে তাহা এত অল্প যে স্মরণ করিলে মনের মধ্যে ধিক্কার জন্মে। সে যা হউক, এখন আমার নিবেদন এই মতিলালের ও ঠকচাচার পরিবারেরা অন্নাভাবে মারা যায় –শুনিতে পাই তাহাদের উপবাসে দিন যাইতেছে, এ কথা শুনিয়া বড়ো দুঃখ হইল, এজন্য আমার নিকট যে দুই শত টাকা ছিল তাহা আনিয়াছি। আপনারা আমার নাম না প্রকাশ করিয়া কোনো কৌশলে এই টাকা পাঠাইয়া দিলে আমি বড়ো আপ্যায়িত হইব।
এই কথা শুনিয়া বেণীবাবু নিস্তব্ধ হইয়া থাকিলেন। বেচারামবাবু ক্ষণেক কাল পরে বরদাবাবুর দিকে দৃষ্টি করিয়া ভক্তিভাবে নয়নবারিতে পরিপূর্ণ হওত তাঁহার গলায় হাত দিয়া বলিলেন –ভাই হে ! ধর্ম যে কি পদার্থ, তুমিই তাহা চিনেছ –আমাদের বৃথা কাল গেল –বেদে ও পুরাণে লেখে যাহার চিত্ত শুদ্ধ সে-ই পরমেশ্বরকে দেখিতে পায় –তোমার যেমন মন পরেমশ্বর তোমাকে তেমনি সুখে রাখুন। তবে রামলালের সংবাদ কিছু পাইয়াছ ?
বরদা। কয়েক মাস হইল হরিদ্বার হইতে এক পত্র পাইয়াছি –তিনি ভালো আছেন –প্রত্যাগমনের কথা কিছুই লেখেন নাই।
বেচারাম। রামলাল ছেলেটি বড়ো ভালো –তাকে দেখলে চক্ষু জুড়ায় –অবশ্য তার ভাল হবে –তোমার সংসর্গের গুণে সে তরে গিয়েছে।
এখানে ঠকচাচা ও বাহুল্য জাহাজে চড়িয়া সাগর পার হইয়া চলিয়াছে। দুটিতে মানিকজোড়ের মতো, এক জায়গায় বসে –এক জায়গায় খায় –এক জায়গায় শোয়, সর্বদা পরস্পরের দুঃখের কথা বলাবলি করে। ঠকচাচা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলে –মোদের নসিব বড়ো বুরা –মোরা একেবারে মেটি হলুম –ফিকির কিছু বেরোয় না, মোর শির থেকে মতলব পেলিয়া গেছে –মোকান বি গেল –বিবি সাথে বি মোলাকাত হল না –মোর বড়ো ডর তেনা বি পেল্টে শাদি করে।
বাহুল্য বলিল –দোস্ত ! ওসব বাত দেল থেকে তফাত করো –দুনিয়াদারি মুসাফিরি –সেরেফ আনা যানা –কোই কিসিকা নেহি –তোমার এক কবিলা, মোর চেট্টে –সব জাহানম্মে ডাল দাও, আবি মোদের কি ফিকিরে বেহতর হয় তার তদ্বির দেখো।
বাতাস হু হু বহিতেছে, জাহাজ একপেশে হইয়া চলিয়াছে, তুফান ভয়নক হইয়া উঠিল। ঠকচাচা ত্রাসে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিতেছেন –দোস্ত ! মোর বড়ো ডর মালুম হচ্ছে, আন্দাজ হয় মোর মৌত নজদিগ।
বাহুল্য বলিল –মোদের মৌতের বাকি কি ? মোরা মেম্দো হয়ে আছি চলো মোরা নীচু গিয়া আল্লামির দেবাচা পড়ি –মোর বেলকুল নেকজাবান আছে যদি ডুবি তো পীরের নাম নিয়ে চেল্লাব।