তুম -সে বেজা হৈ মুঝে অপনী তবাহী-কা গিলা,
ইস-মেঁ কুছ শাইবা -এ খুবী -এ তকদির-ভী থা।
(কেমন করে তোমাকে বলি তুমিই করেছ আমার সর্বনাশ,
এতে ভাগ্যের দশ হাতের খেলাও ছিল কিছু।।)
বম্বে শহরটা আমার সঙ্গে কথা বলত, মির্জাসাব। বলবে না -ই বা কেন বলুন? বম্বে আর আমার জীবনের এত মিল, মাঝে মাঝে মনে হত, আমি একদিন আসব বলে শহরটা অপেক্ষা করে ছিল। দেশভাগের পর লাহোরে গিয়েও মনে হত, আমি যেন বম্বেতেই আছি, ভাইজানেরা। বারো বছর ধরে বম্বের সঙ্গে আমার ভাব-ভালবাসা; শহরটা ছেড়ে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল, দুটো ডানা হারিয়ে একটা পঙ্গু সিন্ধুসারস পাকিস্থানে চলেছি। আমার মতো একটা লাথখোরকে তো আশ্রয় দিয়েছিল বম্বেই। আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিল, দিনে দুপয়সা বা দশ হাজার টাকা যাই রোজগার করো না কেন, ইচ্ছে করলেই তুমি এখানে মস্তিতে থাকতে পারো, মান্টো। পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষ হিসেবেও এখানে জীবনটা কাটিয়ে দিত পারো তুমি। যা খুশি তা-ই করতে পারো। কেউ তোমার খুঁত ধরতে আসবে না। কেউ তোমার কানের কাছে এসে ভাল হওয়ার কথা বলবে না। একা তোমাকেই সবচেয়ে কঠিন কাজ করতে হবে, হ্যাঁ, একা তোমাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি ফুটপাথে থাকতে পারো, প্রাসাদেও থাকতে পারো; তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও কিছু যাবে আসবে না। আমি যেখানে আছি, সেখানেই থেকে যাব। সে আমার হাত ধরে তার সব গলিঘুজি, রইস এলাকা, সমুদ্র, তার দিন-রাত্রি, তার উল্লাস-শিহরন-পাপ-পতন চিনিয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমি কাউকে কখনও ভালবেসে থাকি, তবে এই শহরটাকে, আর কাউকে নয়।
মির্জাসাবের তুলনায় আমার জীবন খুব ছোট, ভাইজানেরা। তাই আমার জীবনের কিস্সা বলতে হলে, কত যে মানুষের কথা বলতে হবে। বম্বেই আমাকে এইসব মানুষকে চিনিয়েছিল। আমি যেসব গল্প লিখেছি, তার চরিত্ররা সবাই আমার চেনা, চেনা বলছি কেন, তাদের সঙ্গেই তো আমি জীবন কাটিয়েছি, তারা আমার আত্মার আত্মীয়। আমি যা লিখেছি, সব-সব ব্যাক্তিগত, আমার নিজের দেখা-শোনা-জানা-অনুভবের কথা। কোনও বিশেষ রাজনীতি আমার অনুপ্রেরণা ছিল না। তাই কখনও আমাকে প্রগতিশীল, কখনও প্রতিক্রিয়াশীল বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। প্রগতিশীল সাহিত্যের নামে টন-টন কাগজ খরচ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ছাপা হয়েছে। তার মতো কদর্য, অসৎ সাহিত্য আর কখনো দেখা যায় নি। তাকে সাহিত্য বলা যায় না। কোনও রাজনীতি বা তত্ত্বের চশমা চোখে লাগিয়ে আমি দুনিয়াটাকে দেখিনি, ভাইজানেরা। নিজের মতো করে বুঝতে চেয়েছি একটাই কথা-জীবন আমাদের জন্য কী নিয়ে এসেছে? তা হলে পেরিন-এর কিস্সাটাই শোনাই আপনাদের। পেরিনকে আমি কখনও দেখিনি। শুধু তার কথা শুনেছি ব্রিজমোহনের কাছে, তবু এই গল্পের প্রধান চরিত্র পেরিন। পেরিন যেন বম্বের আত্মা।
আমি তখন সেই খোলিতেই থাকি, যার কথা আগেই আপনাদের বলেছি। বম্বের খোলি মানে দোজখের চেয়েও নোংরা। ছারপোকা, উকুন, ইঁদুর, মানুষ-একসঙ্গে থাকে। সে বাড়িটায়। একটাই গোসলখানা, তার দরজা বন্ধ করা যায় না। ভোর থেকে মেয়েরা সেখানে ভিড় করে খাবার জল নেবার জন্য। তারপর চান করার জন্য লাইন পড়ে যেত। ব্রিজমোহন থাকত আমার পাশেরই একটা খোলিতে। প্রতি রবিবার ব্রিজমোহন তার বান্ধবি পেরিনের সাথে দেখা করতে যেত বান্দ্রায়। পেরিন পারসি মেয়ে। ওর সঙ্গে ব্রিজমোহনের সম্পর্কটা যে আসলে কী, তা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। ব্রিজমোহন কেন প্রতি রবিবার বান্দ্রায় যায়? পেরিন যেন তার জীবনের তীব্র এক নেশা। যাওয়ার জন্য প্রত্যেকবার আমাকে আট আনা ধার দিতে হত তাকে। বান্দ্রায় গিয়ে পেরিনের সঙ্গে কয়েকটা ঘন্টা কাটিয়ে সে ফিরে আসত। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী করো তোমরা? বেড়াতে যাও, না ঘরে বসে আদর-টাদর করো?
-না, না। ব্রিজমোহন হেসে বলে, পেরিনের জন্য শব্দজব্দ সমাধান করে দিই।
-শব্দজব্দ?
ইলাসট্রেটেড উইকলিতে বেরোয় তো। পেরিন ওগুলো পাঠায়। অনেকগুলো প্রাইজও পেয়েছে।
ব্রিজমোহনের কোন কাজ ছিল না। খোলিতে বসে ও পেরিনের শব্দজব্দের সমাধান করত।
আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, পেরিন তো প্রাইজ পায়। তুমি কী পাও?
-কিছু না।
-প্রাইজের এক পয়সাও তোমাকে দেয়নি?
-না।
-কেন? তুমিই তো ওর শব্দজব্দ করে দাও।
-তাতে কী? পেরিন তো ওর নামেই পাঠায়। ও প্রাইজ জেতে। আমাকে পয়সা দেবে কেন?
-আচ্ছা বুরবাক তুমি।
ব্রিজমোহন ওর হলদেটে দাঁত বার করে হাসত।
ছবি তুলত ব্রিজমোহন। পেরিনের অনেক ছবি আমাকে দেখিয়েছিল। কত ভঙ্গিমা, কত পোশাক। শালওয়ার-কামিজে, শাড়িতে, প্যান্ট-শার্টে, এমনকী সাঁতারের পোশাক পরেও। ছবি দেখে পেরিনকে একেবারেই সুন্দরী মনে হয় নি। কিন্তু ব্রিজমোহনকে কখনও সে কথা বলিনি, মির্জাসাব। কে কাকে সুন্দর দেখবে, সে তার চোখের ব্যাপার। ওই যে বলে না, আমারই চেতনার রঙে পান্না হয়ে উঠল সবুজ। পেরিন সম্পর্কে ব্রিজমোহনের কাছে আমি কিছুই জানতে চাইনি। ব্রিজমোহনও আমাকে যেচে কিছু বলেনি। শুধু আমি জানতাম, প্রতি রবিবার নাস্তা করে ব্রিজমোহন বান্দ্রা যাওয়ার জন্য আমার কাছে এসে আট আনা চাইবে, আর আমাকে ওই পয়সাটুকু দিয়ে দিতে হবে। দুপুরের মধ্যেই ব্রিজমোহন ফিরে আসত। এক রবিবার ফিরে এসে ব্রিজমোহন বলল, সব খতম করে দিলাম।
-মানে?
-মান্টোভাই, আগে তোমাকে কখনও বলিনি। আসলে পেরিন আমার জীবনের কুফা। ওর সঙ্গে যখনই রেগুলার দেখা করি, আমার কোনও কাজ থাকে না। ওই কথাটাই আজ পেরিনকে বলেছি।
-শুনে কী বলল?
-বলল, তা হলে আর দেখা কোরো না। দ্যাখো কোনও চাকরি পাও কি না। তুমি ভাবো, আমার জন্য কাজ পাও না, আসলে দোষ তোমারই। তুমি কাজ করতে চাও না।
-তুমি কী বললে?
-ওসব কথা বাদ দাও, মান্টোভাই। কাল আমি একটা কাজ জোগাড় করবই। তুমি শুধু কাল সকালে আমাকে চার আনা দিও। আমি শেঠ নানুভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাব।
শেঠ নানুভাই ছিলেন সিনেমা পরিচালক। আগেও অনেকবার তিনি ব্রিজমোহনকে কাজ দেননি। তবু পরদিন সকালে আমি ব্রিজমোহনকে বাসভাড়া দিলাম। রাতে ফিরে শুনলাম, নানুভাই ব্রিজমোহন কে কাজ দিয়েছেন।মাসে আড়াইশো টাকা মাইনে। ব্রিজমোহন পকেট থেকে একশো টাকা বার করে বলল, এই যে অ্যাডভান্স। খুব ইচ্ছে করছিল বান্দ্রায় গিয়ে পেরিনকে জানিয়ে আসি। তারপরেই মনে হল, ওর কাছে গেলেই পরদিন কাজটা চলে যাবে। এমনটাই সবসময় হয়েছে, মান্টোভাই। কাজ পেয়েছি, পেরিনকে জানাতে গেছি, তারপরেই বরখাস্ত হয়েছি। ভগবানই জানে, কোন গ্রহনক্ষত্রে ওর জন্ম। তবে গ্রহটা যে অশুভ, তা আমি জানি। শোনো মান্টোভাই, অন্তত এক বছর আমি ওর থেকে দূরে থাকব। থাকতেই হবে। জামাকাপড়ের অবস্থা দেখেছ? একবছর ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে, কয়েকটা জামাপ্যান্ট তো বানানো যাবে।
ছমাসের মধ্যে ব্রিজমোহন পেরিনের কাছে গেল না, মির্জাসাব। মজাসে চাকরি করছে, নতুন জামাকাপড় হয়েছে। ওর ছিল খুব রুমালের শখ। সুন্দর সুন্দর সুতোর কাজ করা অনেক রুমাল কিনেছে। হঠাৎ একদিন ওর নামে একটা চিঠি এল। চিঠিটা হাতে নিয়েই ব্রিজমোহন বলে উঠল, সব খতম হয়ে গেল, মান্টোভাই।
-কেন?
-পেরিনের চিঠি।
কী লিখেছে?
রোববার যেতে লিখেছে। আমাকে নাকি অনেক কথা বলার আছে। আজ শনিবার তো?
-হ্যাঁ। তাতে কী?
-তার মানে পর
মাকে লাথ মারবে।
-তা হলে পেরিনের কাছে যেও না।
-তা হয় না, মান্টোভাই। ও চাইলে আমাকে যেতেই হবে।
-কেন?
ব্রিজমোহন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, আমিও কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, মান্টোভাই। ছমাস তো হয়ে গেল।
পরদিন বান্দ্রায় গেল ব্রিজমোহন। ফিরে এসে আমাকে পেরিনের কথা কিছুই বলল না। হাজির হোটেলে খেতে বসে একবার শুধু বলল, দেখা যাক কাল কী হয়!
সোমবার ব্রিজমোহন ফিরে এসে হা-হা করে হাসতে শুরু করল।-আমি জানতাম মান্টোভাই, আমি জানতাম। পেরিন ওর কাজ ঠিক করেছে।
-কী হল?
-স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেল, মান্টোভাই। শুধু আমার জন্য। আমি কাল পেরিনের কাছে না গেলে বলতে বলতে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল ব্রিজমোহন। এত রাতে ক্যামেরা নিয়ে ও কোথায় যাবে?
ব্রিজমোহন আবার বেকার হয়ে গেল। জমানো যা টাকা ছিল, ফুরিয়ে গেল। আবার সেই
পুরনো নিয়ম চালু হল। প্রত্যেক রবিবার নাস্তার পর সে আমার কাছে এসে আট আনা নিয়ে বান্দ্রায় যায়, কয়েক ঘণ্টা পেরিনের সঙ্গে কাটিয়ে খোলিতে ফিরে আসে। একদিন ব্রিজমোহনকে জিজ্ঞেস করলাম, পেরিন তোমাকে ভালবাসে?
-না।
-তা হলে, প্রতি রবিবার যাও কেন?
-না গিয়ে পারি না, মান্টোভাই।
-পেরিন কি—
-ব্রিজমোহন ঝাঝিয়ে ওঠে, হ্যাঁ, হ্যাঁ। পেরিন অন্য একজনকে ভালবাসে। কিন্তু তাতে দোষ কোথায়?
-দোষ কিছু নেই। তোমাকে ডেকে পাঠায় কেন?
-পেরিনের খুব একা লাগে।
-কেন?
-জানি না। ও কখনও বলেনি।
ব্রিজমোহন তার বিছানায় শুয়ে পড়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, হয়তো আমাকে দেখে মজা পায়। মান্টোভাই, জীবনে এমন মানুষও তো দরকার, যাকে দেখে মজা পাওয়া যায়। হয়তো আমি ওর ছবি তুলি বলে। ছবিতে ওকে অনেক সুন্দর দেখায় তো, কে জানে, হয়তো শব্দজব্দ সমাধান করে দিই বলে। মান্টোভাই, এই মেয়েদের তুমি বুঝতে পারবে না।
-কেন?
-তুমি ভালবাসা চাও।
-আর তুমি?
-জানি না। তবে পেরিনের মতো মেয়েদের জানি।
-কীরকম ওরা?
-ওরা অন্য কাউকে ভালবাসে, তার ভেতরে যা পায় না, অন্যের মধ্যে তা খুঁজে পায়, তখন তাকে শঙ্খলাগা সাপের মতো জড়িয়ে ধরে মনে মনে। শরীরের কাছে কিছুতেই পৌঁছতেই দেয় না।
-তা হলে তুমি যাও কেন?
-ভাল লাগে।
-কী ভাল লাগে? পেরিন তো তোমাকে কিছু দেয় না।
ব্রিজমোহন হাসে। -দেয় তো। ওর নক্ষত্রের দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দেয়, মান্টোভাই। আমি তো একটা খেলাই খেলে যাচ্ছি। কত কালো মেঘ ও আমার জীবনে নিয়ে আসতে পারে। পেরিনের তুলনা নেই। যতবার ওর কাছে গেছি, আমি কাজ থেকে বরখাস্ত হয়েছি। আমার শুধু একটাই ইচ্ছে।
কী?
-পেরিনকে আমি একবার ঠকাব।
-কী করে?
ব্রিজমোহন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শুনতে পাই, একটা ইঁদুর ঘরের ভিতরে কটকট করে কিছু কেটে যাচ্ছে। ব্রিজমোহন বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করতে থাকে। আমি আবার বলি, পেরিনকে ঠকানোর প্ল্যানটা ঠিক করেছ?
-হুঁ।
-কীরকম?
-চাকরি থেকে তাড়ানোর আগে আমি ইস্তাফা দিয়ে দেব। মালিককে সরাসরি বলে দেব, আমি জানি, আপনি আমাকে তাড়াবেন, কিন্তু এমন খারাপ কাজ করতে না দেওয়ার জন্য আমিই। ইস্তাফা দিচ্ছি। আমি তাঁকে আর একটা কথাও বলব। আসলে আপনি নন, পেরিন আমাকে বরখাস্ত করছে। এটুকুই আমার ইচ্ছে, মান্টোভাই।
-অদ্ভুত ইচ্ছে।
-হ্যাঁ।
ব্রিজমোহন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর ফিরে আসে। আমি জিগ্যেস করি, কোথায় গিয়েছিলে?
-আকাশ দেখতে। মান্টোভাই, রাত্তিরবেলা আমি বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারি না। খোলিতে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই আকাশ দেখতে যাই।
-কী দেখ, ব্রিজমোহন?
-কিছু না।
-তারা দেখ?
-অন্ধকার নীল দেখি শুধু, মান্টোভাই, তার ভেতরে আমার অদ্ভুত ইচ্ছেরা ফুটে আছে। আগের রোববারেই পেরিনের একটা ফটো তুলেছি। ফটোটা ওর লাভার নিজের নামে একটা কম্পিটিশনে পাঠাবে। আমি শিওর ছবিটা প্রাইজ পাবেই।
-লোকটাকে তুমি চেনো?
-না। এর আগেও কতবার আমার তোলা পেরিনের ছবি পাঠিয়ে লোকটা প্রাইজ পেয়েছে।
-পেরিন তোমাকে কিছু বলেনি?
-না।
এক রবিবার বান্দ্রা থেকে ফিরে এসে ব্রিজমোহন বলল, এবার সত্যিই সব শেষ করে এলাম, মান্টোভাই। কয়েকদিনের মধ্যে চাকরি জোগাড় করব। শেঠ নিয়াজ আলি নতুন সিনেমা তৈরি করছে। শেঠের ঠিকানাটা জোগাড় করে দিতে পারো?
-দেখি।
এক বন্ধুকে ফোন করে শেঠ নিয়াজ আলির ঠিকানা পাওয়া গেল। পরদিন ব্রিজমোহন শেঠের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল। কাজটা পেয়ে গেলাম, মান্টোভাই। মাসে দুশো টাকা দেবে। তবে খুব তাড়াতাড়ি মাইনে বাড়াবে বলেছে। খুশি তো?
-তুমি খুশ হলে আমিও খুশ।
-ওঃ বাঁচা গেল। ব্রিজমোহন বিছানায় ঝাঁপ দিল।
পরদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, পেরিনের সঙ্গে দেখা করতে যাবে না?
ব্রিজমোহন মিটিমিটি হেসে বলল, ইচ্ছে তো করছে। কিন্তু না, মান্টোভাই, এবার আর তাড়াহুড়ো নয়। কয়েকটা নতুন জামা প্যান্ট কিনতে হবে। এই যে -এই যে -পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছি। তুমি পঁচিশ টাকা রাখো।
-কেন?
-ধার শোধ।
এরপর দিনগুলো খারাপ কাটছিল না, মির্জাসাব। আমি শখানেক টাকা রোজগার করি। ব্রিজমোহন অবশ্য আমার দ্বিগুন পায়। টাকার খুব একটা অভাব ছিল না। খোলির জীবনে বেশ যথেষ্টই বলা যায়।
মাস পাঁচেক পরে ব্রিজমোহনের নামে একটা চিঠি এল। খামের ওপর চোখ বুলিয়ে সে বলল, মওত কা রানি। আমি বুঝলাম, পেরিনের চিঠি।
ব্রিজমোহন হাসতে হাসতে চিঠি খুলল। চিঠি পড়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রোববার দেখা করতে বলেছে। জরুরি দরকার।
-তুমি যাবে?
ব্রিজমোহন লাফিয়ে উঠল। -যাব না? মান্টোভাই, তুমি কী করে ভাবলে, পেরিন ডাকলে আমি যাব না?
নতুন একটা হিন্দি সিনেমার গান শিস দিতে দিতে ব্রিজমোহন বিছানায় বসে পা নাচাতে থাকল। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, পেরিনের কাছে আর গিয়ে কাজ নেই ব্রিজমোহন। ওর সঙ্গে দেখা করে আসার পর কত কষ্ট করে তোমাকে প্রতি রোববার আট আনা দিই, তুমি ভাবতে পারবে না।
ব্রিজমোহন হা- হা করে হেসে উঠল। আমি জানি। মান্টোভাই, সেইসব দিন আবার ফিরে আসছে, তবে তুমি কোথা থেকে প্রতি রোববার আমাকে আটা আনা দেবে, কে জানে!
পরদিন সকালেই পেরিনের কাছে চলে গেল ব্রিজমোহন। রাতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলল পেরিন?
-কিছুই না।
-জরুরি দরকার লিখেছিল।
-ওইরকম লেখা ওর অভ্যেস। সবসময় বোধহয় ভয় পায়।
-কেন?
-কে জানে। তবে আমি ওকে বলে এসেছি, এই নিয়ে বারো বার তোমার জন্য আমি ছাটাই হব। জরাথুস্ট্র তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
-পেরিন কী বলল?
-তুমি একটা বুরবাক।
-ঠিক। আমি হেসে বললাম।
-একশোবার ঠিক। ব্রিজমোহন হেসে উঠল। -কাল অফিসে গিয়েই আমি ইস্তাফা দেব।
-কেন?
-ওরা যাতে বরখাস্ত করতে না পারে। পেরিনের ঘরে বসেই ইস্তাফার চিঠি লিখে এনেছি।
সে আমার হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিল।
পরদিন সকাল-সকাল ব্রিজমোহন বেরিয়ে গেল। রাতে ফিরে দেখি, সে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এবার কার কাছে চাকরি চাইতে যাবে?
-কেন? ব্রিজমোহন উঠে বসল।
-পেরিনের দয়া পাওনি?
ব্রিজমোহন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি দেখলাম তার দুচোখে জলের পর্দা দুলছে। ফ্যাসফেসে গলায় সে বলল, শেঠ নিয়াজ আলির হাতে ইস্তাফার চিঠি দিয়েছিলাম, মান্টোভাই। কিছুক্ষণ পরে শেঠ আমাকে একটা চিঠি দিলেন। আমার মাইনে দুশো থেকে বাড়িয়ে তিনশো করা হয়েছে। মির্জাসাব, সেইদিনের পর থেকে পেরিনের প্রতি আর কোনও আগ্রহ ছিল না ব্রিজমোহনের।
একদিন সে আমাকে বলেছিল, পেরিনের অভিশাপ যখন নেই, মান্টোভাই, পেরিনও আর নেই। আমার জীবনের সব রং হারিয়ে গেল। এখন আমি কার জন্য কাজ ছেড়ে দেব বলতে পারো?
সেদিন প্রথম আমি পেরিনকে দেখতে পেলাম। আরবসাগরের বেলাভূমিতে ঘুমিয়ে পড়েছে পেরিন। অদূরে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসছে একটা অন্ধকার জাহাজ। মির্জাসাব, বম্বে এমনই এক অলীক মানুষদের শহর।