২৮. বংশী দেখতে পেয়েই দৌড়তে

বংশী দেখতে পেয়েই দৌড়তে দৌড়তে এল।-কোথায় ছিলেন শালাবাবু চৌপর দিন, আপনাকে অত পই পই করে বললাম—সন্ধ্যেবেলা কোথাও বেরোবেন না, জার্মা কাপড় পরে তৈরি হয়ে থাকবেন—আর ছোটমা’র কাছে আমার যাচ্ছে তাই হেনস্থা হলো।

–-কি হলো, কি?

—ছোটমা তৈরি হচ্ছে যে।

—কিন্তু আমি তো দেরি করিনি, তুমি ছোটবাবুর জন্যে কাপড় কোঁচাতে গেলে, আর আমিও ভাবলাম বসে বসে কি করবো, একটু ঘুরে আসিবেলা তো অনেক আছে।

—কোথায় গিয়েছিলেন শুনি?

—আর কোথায়, একটু চাকরির চেষ্টায় গিয়েছিলুম যেমন যাই আর কি।

কথাটা ঠিক সত্যি বলা হলো না। চাকরির চেষ্টাতেই যথারীতি বেরিয়েছিল ভূতনাথ, কিন্তু কোন্ ঘটনাচক্রে কোথা দিয়ে কমন করে জবাদের বাড়ি চলে যাবে কে জানতো। অথচ কি প্রয়োজন ছিল যাবার। তাকে কেউ যাবার জন্যে মাথার দিব্যি দেয়নি। আর তা ছাড়া না বেরোলে তো লোচনের সঙ্গে দেখা হতো না অমন জায়গায়!

বংশী বললে—আপনি বসুন গিয়ে আপনার ঘরে—আমি দেখি গিয়ে ছোটমা’র কদর।

নতুন একটা কোম্পানী হবার কথা আছে। কয়েকজন লোক নেবে খবর পাওয়া গিয়েছিল। দইয়েহাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে দর্মাহাটায়। টা টা করছে রোদ্দর। মিছিমিছি এতদূর আসা। কোথায় কোম্পানী, কোথায় কি! পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন হচ্ছে। এখনও কিছুই হয়নি।

একজন বললে—এখন কোথায় কি বাবু, আগে বাড়ি সারা হোক, তবে তো লোক নেওয়া।

—কতদিন লাগবে আরো?

—সে বাবু আরো ছ’ মাসের ধাক্কা।

লোকটা বোধ হয় নতুন কোম্পানীর দারোয়ান। টুলের ওপর বসে বসে খইনি টিপছিল। গলায় লম্বা পৈতে। কথা বলে আবার হাতের রামায়ণটা পড়তে লাগলো। ঘেষাঘেঁষি বাড়ি। পেঁচানো গলি। তবু ওই সরু গলিটার বাঁকের মুখেই একটা বিরাট বটগাছ। শেকড়টা প্রায় রাস্তা জুড়ে আছে। কাছাকাছি কোথাও বসলে বেশ আরাম হতো। লোহার চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি ভর্তি মাল গড়গড় করে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কুলীরা।

–এখানে কোনো চাকরি-বাকরি খালি আছে ভাইয়া—সামনে যাকে পাওয়া গেল তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো ভূতনাথ।—এই ধরো সাত-আট টাকা মাইনে, আর কাজ বলতে সবই পারবো।

এমনি করে কয়েকদিন ঘুরলে একটা-না-একটা চাকরি হবেই। চীনেবাজার, সুর্তিবাগান, রাধাবাজার, সোয়ালো লেন, লিয়ন্স রেঞ্জ—এই সব পাড়ায় আজকাল অনেক আপিস হয়েছে। পাথরের সাইন-বোর্ডের ওপর সব নাম লেখা।

সুবিনয়বাবু বলতেন–বাঙালীরা আজকালই যা ব্যবসায় পেছনে হটে এসেছে, কিন্তু সেকালে সবই তো ছিল বাঙালী। নকু ধর টাকা ধার না দিলে ইংরেজরা কোথায় থাকতো আজ ভূতনাথবাবু। মুর্শিদাবাদের নবাবদের কাছে জগৎশেঠ যা ছিলেন, ইংরেজদের কাছে নকু ধরও ছিলেন তাই। এই কলকাতার প্রথম যৌবনে যারা তার সেবা করেছিলেন তারা তো বাঙালীই। দ্বারকানাথ ঠাকুর করেছিলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’। রাজা সুখময়, তিনি ছিলেন স্যার ইলাইজা ইম্পের দেওয়ান। ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের একমাত্র বাঙালী ডিরেক্টর। তারপর বিলিতি কোম্পানীর সব বেনিয়ানরা প্রায় সবই তো বাঙালী। ধরো, আশুতোষ দে, গোরাদ দত্ত,প্রাণকৃষ্ণ লাহা, শম্ভু মল্লিক।

কিন্তু ননীলাল বলে—এটা হলো কয়লাখনি লোহা আর স্টীমইঞ্জিনের যুগ।

সেদিন ননীলালের বাড়িতে রাত্রে এই কথাই হচ্ছিলো। ননীলালের বসবার ঘরখানায় কিন্তু ফরাশ পাতা নেই। গোটাকতক চেয়ার টেবিল বসিয়েছে।

ননী বললে—ওসব বড় বড় লোকদের কথা ছেড়ে দেওয়া ছিল ইংরেজদের পুষ্যিপুত্তর, এটা নতুন দেশ, বিদেশ বিভূই—এখানে বাস করতে গেলে এখানকার কয়েকজন লোকের সাহায্য নিতে হবেই—তাই ওদের সব বেনিয়ান মুৎছুদ্দি করে নিয়েছিল আর কিছু কিছু সুবিধেও ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু কত জমিদারকে ভিটে-মাটি ছাড়া করেছে জানিস? সেকালে বাকি খাজনার দায়ে নাটোরের রাজাকে রাজবাড়িতে বন্দী করে রেখেছিল। দিনাজপুরের রাজবংশের সমস্ত সম্পত্তি ১৮০০ সালে নীলেম হয়ে যায়। নদীয়ারাজের তো সব গেল বাকি খাজানার দায়ে। রাজা শুধু লাখ টাকা করে ভাতা পেতে।

ভূতনাথ বললে—এবার রাত হলো বাড়ি যাই।

—যাবি, আর একটু বোস।

–তুই ভাত খাবি না—বউ কিছু বলে না?

ননী গ্লাশটা শেষ করে বললে-মেয়েমানুষে আর নেশা নেই ভাই—ও যে-বিন্দী, সে-ই মিসেস গ্রিয়ারসন, সে-ই বউ-ও সবাই এক—এখন কেবল টাকা। এটা টাকার যুগ। আর সেই টাকার গোড়া হলো কয়লাখনি আর কলকারখানা। দেখবি তোকে বলে রাখছি, একদিন রাণীগঞ্জ, আসানসোল, কুলটি আর হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, মানভূম, সিংভূম—এই সমস্ত জায়গাটা একেবারে সোনা হয়ে উঠবে—কলকাতার চেয়ে দশ গুণ বড় হয়ে উঠবে—আর সমস্ত কলকারখানা গড়ে উঠবে ওইখানেই।

—তুই স্বপ্ন দেখিস নাকি?

—স্বপ্ন দেখি বৈকি—কিন্তু জেগে জেগে-আমার আর কোনো স্বপ্ন নেই, কেবল ভাবি হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক খাটছে আমার কারখানায়, মজুররা সার বেঁধে চলেছে কাজ করতে আর আমার গাড়িটার সামনে এলেই সেলাম করছে।

তারপর থেমে বললে—তাই তো সেদিন চূড়োকে বললামযদি টাকা করতে চাস তত কোলিয়ারি কিনে ফেল—কয়লা না হলে কিছু হবে না, আজকাল সব স্টীমের যুগ—স্টীমের জন্যে কয়লার দরকার—কিন্তু ওর কাকাদের তাতে মত নেই।

ভূতনাথ বললে-ছুটুকবাবু আজ-কাল খুব লেখা-পড়ায় মন দিয়েছে। বললে—গান-বাজনা ছেড়ে দিয়েছে।

—আরে কিছুই হবে না ওর, আমাকে বলছিল, জমিদারী থেকে তেমন আয় হচ্ছে না আগেকার মতন, সবাই চুরি-চামারি করতে আরম্ভ করেছে, প্রজারাও সব শহরে আসছে কলকারখানায় কাজ করতে, তাতে আয় বেশি। এবার ওর বিয়েতে মহাল থেকে কেউ কিছু নাকি পাঠায়নি—কেবল খেয়ে গিয়েছে পেট পুরে—সেদিন দেখ না, ওর মেজকাকা গাড়িটা কিনলে, নগদ টাকা দিতে পারলে না বলে বেচে দিতে হলো—মাঝখান থেকে লোকসান হলো কিছু টাকা।

—কিন্তু নান্নেবাঈ তো সেদিন আবার এসেছিল নাচতে, শুনলাম—তিন শ’ টাকা নিয়ে গেল!

–ওই যে, প্রেস্টিজ, আর কিছু নয়, আমি আনিয়েছিলুম নাবোঈকে লক্ষ্ণৌ থেকে পাঁচ শ’ টাকা খরচ করে, সাহেবমেমদের একটা পার্টি দিয়েছিলাম, বেটারা আমাদের দেশের গান শুনতে চেয়েছিল, তাই—কিন্তু তেমনি পাঁচ শ’ টাকা খরচ করে যে পাঁচ হাজার টাকা উসুল করে নিয়েছি।

-সে কি রকম?

-ওই তো তফাৎ-চৌধুরীরা জানে টাকা জমাতে নয়, জানে শুধু খরচ করতে—কিন্তু টাকার বাচ্চা পাড়াতে তত জানে

—চূড়োকে তাই তো বলছিলাম। বললাম-যদি ব্যবসা করতে চাস তো আমার ফার্মে আয়, কিছু টাকা ঢাল, যাতায়াত কর দু’-চার দিন ঘোরা-ফেরা কর-কেমন করে লোকের সঙ্গে মেলামেশা করি দ্যাখ শোন—তা তত করবে না। ওর কাকা সেদিন পুতুলের বিয়ে দিয়েছে শুনলুম তার ঝি-এর পুতুলের সঙ্গে। খুব নাকি খাওয়া-দাওয়া হয়েছে—চূড়োই বলছিল।

সে এক কাণ্ড। ছুটুকবাবুর বিয়ের দু’দিন আগে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ নেমন্তন্ন হয়ে গেল ভূতনাথেরও।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে হঠাৎ নেমন্তন্ন কিসের?

—আজ্ঞে, আজ মেজমা’র পুতুলের বিয়ে যে—গিরির মেয়ে আর মেজমা’র ছেলে।

গিরি বলে—আমার টাকা কোথায় মেজমা-মেয়েকে আমি গয়না-গাটি কিছু দিতে পারবো না।

মেজমা বলে—আমার ছেলের বউ, আমি গা সাজিয়ে দেবোতুই বিয়ের যোগাড় যন্তর কর।

তা যোগাড় যন্তর কম নয়। টাকা সব মেজমা’র। বলে— গরীবের মেয়ে বলে জাকজমক কম হলে চলবে না, যা টাকা লাগে আমি দেবো।

ন’বৎ বসলো দেউড়িতে। রীতিমতো ঘরে ঘরে নেমন্তন্ন হলো। গায়ে হলুদের তত্ত্ব পাঠালে মেজমা। দেখবার মতো জিনিষ সব। কাচের চুড়ি, সোনার বেঁকি চুড়ি, পাটি হার, ছানার পুতুল, দশ চাঙারি শাড়ি সেমিজ। দরজির দোকান থেকে তৈরি হয়ে এসেছে কনের জামা সেমিজ। যেমন হয় সাধারণ বিয়েতে। গিরিও পাঠালে ফুলশয্যা। সিঁদুরেপটি থেকে ফুল, ফুলের মালা এল। রূপলাল ঠাকুর সিধে পেলেন। রাত্রিবেলা সার বেঁধে বড়বাড়ির চাকর বাকর ঝি ঝিউড়ী কর্মচারি সব খেতে বসলো। শাখ বাজলো। উলু দিলে মেয়েরা। অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটি নেই।

গিরির মেয়ের বিয়েতে কিছু ধার দেনা করতে হলো। মাঝখান থেকে হাজার বারো শ’ টাকা খাজাঞ্চীখানা থেকে বেরিয়ে গেল মবলক।

ননী বললে-যুগ যে বদলে গিয়েছে সে খবর তো আর রাখে না ওরা। ওকে বললাম তো, আস্তে-আস্তে জমিদারীটা গুটিয়ে আন, কালেক্টরিতে দরখাস্ত কর কিম্বা ভূমিস্বত্ব উপস্বত্ব যা কিছু আছে সব বেচে দে। কেনবার ললাকের অভাব নেই, আমিই কিনে নিতে পারি, কিন্তু তার থেকে যে নগদ টাকাটা পাওয়া যাবে, সেইটে দিয়ে কিছু যদি না-ও করিস, সব চেয়ে নিরাপদ কয়লার খনি কেনা, একটা খনি শেষ হতেই একটা পুরুষ কেটে যায়। তারপর সেখানে চুপ করে থাকলেই চলবে না, কয়লার খনি কেনো তারপর কারখানা চালাও। আজকাল তো লোহার যুগ-অঙ্ক কষে লাভ-লোকসান খতিয়ে সব দেখিয়ে দিলাম সেদিন।

—ছুটুকবাবু কী বললে?

—আসলে চুড়ো কী বলবে, হাবুল দত্তই তো ওকে চালাচ্ছে–দিনরাত জামাইকে পরামর্শ দিচ্ছে, এটা করে, সেটা করো। বিয়ের আগে হাবুল দত্ত আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—ছেলে কেমন। আমি বলেছিলুম—গগাবর গণেশ ছেলে, ভালো-মন্দর বালাই নেই। মনটা ঝড়-ঝাপটা, আপনি চালিয়ে নিতে পারেন তো দিন মেয়ে। বনেদীঘর, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই, তবে আজকাল বনেদীর কোনো দাম নেই। এখন ও-সব সামন্তযুগ চলে গিয়েছে। এখন ক্যাপিটালিজম-এর যুগ। ক্যাপিটাল মানে মূলধন যার আছে তারই খাতির। দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতে গিয়ে দু’হাতে টাকা ছড়ালেন, নুনের এজেন্ট প্লাউডেন সাহেবের দেওয়ানী করলেন, নীলের ব্যবসা করলেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক করলেন, চিনির কল করলেন, কয়লার খনি করলেন, তাই করেই প্রিন্স হলেনপ্রিন্স দ্বারকানাথের মতো লোক ভারতবর্ষে আর দুটো জন্মালে না, লোকে সব নাম করে রামমোহনের, কিন্তু লোক তো প্রিন্স।

বেশ রাত হয়ে এসেছিল। ননীলাল ইজি-চেয়ারটায় হেলান দিয়ে পা তুলে দিয়েছিল। পটলডাঙার এ-বাড়িটাও বেশ বড়। দু’ মহল। পূজোর দালান, দেউড়ি সবই বড়বাড়ির ছাদে। চারদিকে চেয়ে বোঝা যায়, এ-বাড়ির মালিকও একদিন কলকাতার পত্তনের সময়ে ঐশ্বর্য আহরণ শুরু করেছিলেন। মালিক আজ নেই। ননীলালের শ্বশুর নেই। নাবালক শ্যালকরা সব ননীলালের তাবে। একদিন এই বাড়ির মালিকও যা কল্পনা করতে পারেননি, ননীলাল তাই সফল করেছে। বার-বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠে এ-ঘরে আসতে হয়। খুব ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গরাই এখানে আসবার অনুমতি পায় বুঝি। খান কয়েক বিলিতি ছবি টাঙানো দেয়ালে। অর্ধ-অনাবৃত মেম-সাহেবদের চেহারা।

ননী বললে—ভাবছি একবার বিলেতে যাবো।

-সেকি, বউ কিছু বলবে না?

—কারোর বলার তোয়াক্কা করলে আর চলে না, অনেকদিন ধরে সবাই যেতে লিখছে, অনেকগুলো নতুন মেশিনের অর্ডার দিয়েছি, সেগুলো নিজে দেখে কেনবার ইচ্ছে আছে, তা ছাড়া ওই যে বললুম-প্রিন্স দ্বারকানাথ আমার আদর্শ।

হঠাৎ বাইরে দরজার কাছে যেন কার পায়ের শব্দ হলো।

ননীলাল চিৎকার করে উঠলো—কে রে, বদরি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।

–ক’টা বাজলো রে?

—হুজুর অনেক রাত হয়েছে–কী খাবেন আজকে?

–কী খাওয়াবি বল তো?

—হুজুরের মরজি হলে যা চাইবেন সব খাওয়াতে পারি।

–যা তুই এখন, যা খুশি তোর রাঁধ।

বদরি চলে গেল। চাপ-দাড়ি। মাথায় পাগড়ি। কোমরে তকমা আঁটা। খানসামার মতো চেহারা।

ননী বললে—ওর নাম বদরুদ্দিন, আমি ওকে হিন্দু বদরিনারায়ণ বানিয়ে দিয়েছি।

—মোছলমান নাকি?

-হ্যাঁ, কিন্তু খুব চমৎকার বাঁধে, ওর ঠাকুরদা ছিল দ্বারকা নাথের বাবুর্চি।

-বাড়ির রান্না খাস না?

-রাত্তিরের খাবারটা বদরিই রাঁধে, ঠিক নেই তো কখন খাবো–খাবো, তা ছাড়া আমাদের সরকারী রান্নাঘরের অনেক বাছবিচার, অন্দরমহলের বাসন বাইরে যদি আসে তো আর ভেতরে ঢুকতে পারে না। আমার বাইরের জন্য থালা বাসন সব আলাদা–আমি ভেতরে ঢুকলে কিছু আপত্তি নেই কিন্তু বাইরের বাস ঢুকলেই সব গোশ্লায় যাবে।

ভূতনাথ এতক্ষণে বলি-বলি করে এবার হঠাৎ বলে ফেললে আমার সেই চাকরির কথাটা আর কিছু ভেবেছিলি?

ননীলাল বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ খুলে বললে নিশ্চয়ই, আমি তো বলেইছি তোকে তোর চাকরি হবে—আমার ফার্মেই হবে-সে তো বলেই রেখেছি।

ভূতনাথ বললে—অনেক জায়গায় ঘুরছি কিনা—সবাই কেবল

ননীলালের হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল। বললো ভালো কথা, তোর সেই পার্টির কী হলো রে—অনেক টাকা আছে বলছিলি?

ভূতনাথ অপরাধীর মতো কুষ্ঠিত হয়ে পড়লো। বললে–সুবিনয়বাবুর কথা? তা চাকরির ধান্দায় আর ওদিকে যেতে পারিনি ভাই। বড় ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে এ ক’দিন–কালই যাবে।

কিন্তু পরদিনই ঠিক যাওয়া হয়নি জবাদের বাড়ি। অনেক রকম সঙ্কোচ এসে বাধা দেয়। কী অজুহাত নিয়ে যাবে, গিয়ে কী বলবে —এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি। অথচ এত সঙ্কোচ থাকবার কী যে কারণ থাকতে পারে কে জানে।

ননীলালের বাড়ি থেকে বেরোতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল প্রকাশের সঙ্গে।

রাত্রের অন্ধকারেও প্রকাশকে চিনতে বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়।

প্রকাশ অন্যমনস্ক ছিল। ভূতনাথকে দেখতেও পায়নি।

–প্রকাশ না!

চমকে উঠেছে প্রকাশ ময়রা।–ঠাকুর মশাই, আপনি এখেনে?

—এই এসেছিলাম এদিকে! এত রাত্রে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন?

-এই তো সাহেবের বাড়ি আমাদের, সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করবো ভাবছি, রাত্তির করেই তো ফেরেন সাহেব-বাড়ি ঢোকবার সময় ধরবে পা জড়িয়ে—যা থাকে কপালে—হয় এপার নয় ওস্পার—কী বলেন আপনি।

—কী হয়েছে তোমার?

—আজ্ঞে, চাকরিটা চলে গেল।

—গেল কেন?

-আজ্ঞে, কপালের ফের—আর কী বলবো, আমি ভাবছিলাম আপনার কথাটা সাহেবকে বলবো একবার, তা আমার চাকরিটাই চলে গেল—দেখি একবার সাহেবকে ধরে-ক’দিন ধরে চেষ্টা করছি, কিছুতেই ধরতে পারছিনে। আজ ধরবো পা জড়িয়ে–কী বলেন।

প্রকাশের জন্যে কেমন যেন মায়া হয়েছিল ভূতনাথের সেদিন। লোকটা কোনো কিছুতে টিকে থাকতে পারলে না। হয় তো পারবেও না। কপালের ফেরই বটে! জিলিপীর ব্যবসা, ঘটকালি, চাকরি, সবগুলোই ক্ষণস্থায়ী হয় ওর জীবনে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—তুমি দোষটা করেছিলে কী?

—আজ্ঞে, ঠাকুর মশাই, কোনো দোষ তো করিনি জ্ঞানত।

—আর কারো চাকরি গিয়েছে তোমার সঙ্গে?

–না আজ্ঞে।

তারপর একটু থেমে বললে–তবে হ্যাঁ, একদিন সাহেবের ঘরে গিয়ে মাইনে বাড়াবার কথা বলেছিলাম বটে, বলেছিলাম—আট টাকা পাচ্ছি হুজুর, এতে কুলোতে পারছি না। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, কিছু দেনা হয়ে গিয়েছে বাজারে—এই সব কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম—দু’ এক টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিন হুজুর।

-তারপর?

—তারপর আর কি, চাকরি গেল—ম্যানেজারবাবু চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে হঠাৎ। আমি জানতেও পারিনি আগে—আগে জানলে বলতাম, দু’ টাকা মাইনে বরং কমিয়ে দিন হুজুর, তবু, চাকরিটা রাখুন দয়া করে।

মনে আছে প্রকাশ ময়রার কথা শুনে বেশ হাসি পেয়েছিল সেদিন। হাসিটা অবজ্ঞার নয়, ঠাট্টারও নয়। অনেকটা কান্নার মতো করুণ হাসি সেটা। জীবনে এমন হাসি অনেকবার হাসতে হয়েছে ভূতনাথকে। ননীলাল শেষ পর্যন্ত অবশ্য চাকরি দেয়নি তাকে। কিন্তু সে-দোষ ঠিক ননীলালেরও নয়। ননীলালরা অমন করেই থাকে সংসারের সব ভূতনাথদের সঙ্গে। তার জন্যে ভূতনাথ জীবনে কখনও অনুশোচনা করেনি। কিন্তু দুঃখ কি হয়নি? হয়েছে, কিন্তু নিজের জন্যে নয়! ছোটবৌঠানের জন্যে এখনও এই মুহূর্তেও কেমন ভারী হয়ে ওঠে গলা, ভিজে আসে চোখ দুটো।

জবা কিন্তু সেদিন সেই কথাই বললে। অবশ্য হাসতে হাঁসতেই বললে। বললে—আপনার নিজের অপমান করবার সাহস নেই বলে বুঝি ননীবাবুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?

–কী বলছো তুমি? কোন্ ননীবাবু?

—আপনার বন্ধু ননীবাবু?

–সে এসেছিল নাকি?

…কিন্তু গোড়া থেকেই সমস্তটা বলা ভালো। বহুদিন পরে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে যেদিন আবার গিয়ে ভূতনাথ ‘মোহিনী সিঁদুর’ আপিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, আজ ভাবলে মনে হয়, সে-দিন না-গেলেই যেন ভালো হতো। অন্তত ঠিক এই সময়ে! বাড়িময় অত ব্যস্ততা। কিন্তু ভূতনাথের তো তখন সেকথা জানবার নয়। সমস্ত বাড়িটার চেহারাই যেন বদলে গিয়েছে। সব ছবি নামিয়ে নিয়েছে। নানা জিনিষ পাকার হয়ে পড়ে আছে চারিদিকে। এখানে ওখানে নোংরা। এখুনি যেন এবাড়িতে এসে উঠলো কেউ, কিম্বা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এরা।

ভূতনাথ বললে—এসব কী জবা?

জবা বললে—আমরা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

—সে কি? কবে?

–আজই, এখুনি।

–কেন?

জবা শাড়িটাকে কোমরে জড়িয়েছে। সমস্ত মুখময় ঘামের বিন্দুগুলো ফুটে উঠেছে। সকাল থেকে যেন অনেক কাজ করতে হচ্ছে তাকে। কথা বলতে বলতে এক ফাঁকে কোথায় চলে গেল একটা কাজের ছুতোয়। তারপর এসেই আবার বললে—আপনি তো বেশ লোক, পাঁচ শ’ টাকা নিয়ে সেই যে চলে গেলেন, আর দেখা নেই—বাবা প্রায়ই আপনার নাম করেন।

-কেমন আছেন বাবা?

–দেখলেই বুঝতে পারবেন।

—কিন্তু আসতে আমি পারিনি সত্যি, চারদিকে চাকরির জন্যে ঘোরাফেরা করছি। সমস্ত দিন ডালহৌসি স্কোয়ারে ঘুরি ফিরি, তারপর এমন ক্লান্ত হয়ে থাকি, আর এতদূর হাঁটতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু মাঝখানে সুপবিত্রবাবুর সঙ্গে রাস্তায় একদিন দেখা হয়েছে। খবর পেয়েছিলাম—বাবা ভালো আছেন—তা ছাড়া পরের বাড়িতে থাকি খাই, আর ওদের ওখানে বেশিদিন হয় তো থাকা চলবেও না—আর কী সূত্রেই বা থাকবো বলো না—ওরা খেতে দিচ্ছে এই তো যথেষ্ট।

জবা বললে—ততক্ষণ চলুন বাবার কাছে বসবেন—আমি হাতের কাজগুলো সেরেনি।

সুবিনয়বাবু বিছানার ওপর চুপ করে শুয়েছিলেন। বললেন— কে ভূতনাথবাবু এসো।

ভূতনাথ পাশে গিয়ে বসলো। এ-ঘরেরও সব পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে অনেক। ঘরের দেয়ালে মনে আছে রাজারাণীর এক জোড়া মস্ত ছবি টাঙানো ছিল উত্তরের দেয়ালে। জমকালো ভেলভেটের পোষাক। আর তার ওপরে জবার মা’র ছুচের কাজ করা একটা ফ্রেমে বাঁধানো কার্পেটের ওপর লেখা “God Save the King”। তারপর ছিল জবার মায়ের একটা অয়েল পেন্টিং। পা গুটিয়ে বসে আছেন আসনের ওপর। মাথায় আধ-ঘোমটা। লম্বা হাতা জামা। আস্তিনের ওপর সোনার চুড়ি অনেক গাছা করে। চওড়া পাড় ঢাকাই শাড়ি।

একদিন প্রথম এই ঘরে এসে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল— আচ্ছা, তোমার কোনো ছবি দেখছিনে জবা—ছোটবেলার কোনো ছবি?

-আমি কি ছোটবেলায় মা’র কাছে ছিলুম যে আমার ছবি থাকবে। আমি তো কলকাতায় এসেছি যখন আমার বয়স আট ন’ বছর। তার আগে তো বলরামপুরেই থাকতাম।

-কোথায় থাকতে তুমি? বলরামপুরে?

জবা বলে—জানেন, বলরামপুরে আমার ঠাকুর্দাকে আমি বাবা বলতাম। ঠাকুর্দা পূজো করতেন—আমি একদিন নৈবিদ্যির ফল-টল সব খেয়ে ফেলেছিলাম, চোখে তো তিনি ভালো দেখতে পেতেন, শেষে ঠাকমা বললে—ওমা, তোমার নৈবিদ্যির কলা কী হলো?

ঠাকুর্দাও হাত দিয়ে দিয়ে দেখলেন তখন। বললেন—সত্যিই তো কলা কে নিলে?

খোঁজ খোঁজকে কলা খেলে। আমি তখন পেছনের মকরতলার আমগাছে উঠে লুকিয়েছি। ঠাকুর্দা খাওয়া ছেড়ে উঠলেন। খাওয়া হলো না তার। কোথায় গেল জবা! একবার খাওয়া ছেড়ে উঠলে আর তত হিন্দুদের খেতে নেই। খুজতে লাগলেন সব জায়গায়। আমি গাছে উঠে তখন সব দেখছি চুপটি করে। ভয় হলো তার! কোথায় গেল! বললেন—বোধহয় গুপী এসে নিয়ে গিয়েছে—বাবাকে গুপী বলে ডাকতেন কিনা। ঠাকুর্দা তো বাবার মুখ দেখতেন না, মারা যাবার শেষ দিন পর্যন্ত সে-প্রতিজ্ঞা কখনও ভাঙেন নি।

–তারপর?

—তারপর, ঠাকুর্দা তত ছিলেন অন্ধ, শনিবার সারাদিন উপোস করে রোববার সকালে হয় তত খেতে বসেছেন, আমাকে ঠাকুমা পাতের কাছে বসিয়ে রেখেছে পাহারা দিতে, আমার তো খুব সুবিধে—পাত থেকে সব তুলে খাচ্ছি, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ ঠাকুর্দার খেয়াল হয়েছে—বললেন—মাছ হয়নি আজ?

ঠাকুমা বললে—সেকি? তবে বোধ হয় বেরালে নিয়ে গেল।

কিন্তু বেরাল আসবে কী করে! আমি তো পাহারা দিচ্ছি।

ঠাকুমা বললে—হয়েছে, বেরাল নয়—ও জবাই খেয়ে নিয়েছে পাত থেকে।

-ওমা তাই নাকি? ঠাকুর্দা হাসলেন। ঠাকুর্দার একটা তও ছিল না। ফোগলা দাতে হা হা করে হাসতে লাগলেন। বললেন—তুমি এতো দুষ্ট হচ্ছে দিন দিন তোমাকে এবার গুপীর কাছে ঠিক পাঠিয়ে দেবো-ও থাকুক গিয়ে কলকাতায়।

—তখন কলকাতায় পাঠিয়ে দেবার নাম করলেই ভারী ভয় হতো আমার।

ভূতনাথ বলেছিল–কেন, ভয় হতো কেন?

—কী জানি, বয়েস তত বেশি ছিল না। শুনতুম সবাই বলতে বাবা-মা নাকি স্নেচ্ছে হয়ে গিয়েছে, বাবার কাছে গেলে জাত যাবে, তখন জাত মানে কি তা বুঝতুম না কিন্তু মনে হতো জাত যাওয়াটা একটা খুব ভীষণ ব্যাপার—বলে জবা হেসে উঠলো। তারপর আবার বললে—এখনও বলরামপুরের কথা মনে পড়লে কিন্তু খুব ভালো লাগে।

ভূতনাথ বললে-কতদিন পর্যন্ত কেটেছে তোমার সেখানে?

-এই আট ন’ বছর বয়েস পর্যন্ত তো ঠাকুর্দার কাছেই কাটিয়েছি। বাবা-মাকে চোখেও কখনও দেখিনি—বাবা চিঠি লিখতেন ঠাকুমাকে। ঠাকুমা আবার সেই চিঠি নিয়ে পড়িয়ে আসতে পাড়ার লোকের কাছে। ঠাকুর্দা জানতে পারলে তো একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠবেন।

ঠাকুমা বলতেন—এই দ্যাখ তোর বাবা তোর কথা লিখেছে। যাবি তো তোর বাপের কাছে?

বলতাম—না, যাবে না, আমার যদি জাত যায়? তা আমি জন্মেছিলাম কিন্তু কলকাতায়—আশ্চর্য।

—এই বাড়িতে?

—না, তখন আমাদের বাড়ি ছিল বার-শিমলেয়। বাবা এ-বাড়ি নতুন করেছেন, আমার ভাই হবার পর কিন্তু আমি শুনেছি জন্মের দু’ মাস পরেই ঠাকুর্দা আমায় চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন বলরামপুরে।

–চুরি করে?

জবা একদিন বলেছিল সে গল্প। জবা বলে—আমি কি তা দেখেছি নাকি? আমি যা শুনেছি বাবার কাছে আর ঠাকুমার কাছে, তা-ই জানি।

সে অনেককাল আগেকার কথা। সুবিনয়বাবুর বাবা রামহরি ভট্টাচার্য একবার গুণ্ডা লাগিয়েছিলেন। বিশ টাকা খরচও করেছিলেন। বলেছিলেন–গুপীকে গাঁয়ে দেখতে পেলে খুন করবি তোরা, যে ছেলে জাত খুইয়েছে সে আমার ছেলেই নয় জানবি। ওর মুখদর্শন করবো না আমি প্রতিজ্ঞা করছি।

বলরামপুর থেকে কলকাতা হাঁটাপথে দেড়দিনের পথ। রামহরি ভট্টাচার্য বারোয়ারিতলার বটগাছের তলায় মাচার ওপর বসে থাকতেন সন্ধ্যেবেলা। গ্রীষ্মকালের দুপুরে ভিজে গামছা মাথায় দিয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেন খেয়ে দেয়ে। তারপর একবার রথতলায় গিয়ে বসতেন দাবার আডড়ায়। সেখানে খানিকক্ষণ খেলা দেখে উঠতেন। তারপর যেতেন বিলের ধারে কলমি শাকের চেষ্টায়। মল্লিকদের বাগানে কাঁঠাল পাকার খবর পেয়ে যেতেন সেখানে। বলতেন—গাছে তোমাদের কাঁঠাল পাকলো আর বামুনকে দিলে না যে। তারপর সন্ধ্যেবেলা এসে বসতেন নারাণ ময়রার দোকানের সামনে মাচায়। বলতেন—দাও তত নারাণ বামুনের ঘটিতে একটু জল।

নারাণ ময়রা চিনির বাতাস করতো। পালা-পার্বণে ছানার সন্দেশ করতো। আর করতে গজা। এমন গজা যে বুট জুতো দিয়ে মাড়ালেও ভাঙবে না। সেই গজা চৈত্র সংক্রান্তির সময় দোকানে উঠতো। তারপর যে-ক’টা বিক্রি না হতো তা আবার রসে ফেলে নিয়ে টাটকা করে বেচতে আষাঢ় মাসে রথের দিন। তাতেও যদি বিক্রি না হতো তো ভাদ্রমাসের তালনবমীতে আবার সাজিয়ে রাখতে থালায়। আর তারপরেও যে-গুলো পড়ে থাকতে সেগুলো বিক্রি হয়ে যেতে দুর্গাপূজোর বিজয়াদশমীর দিন। কিন্তু নারাণ ময়রার সব চেয়ে বেশি নাম ছিল চিনির বাসায়। এমন হাল্কা, জলে ফেলে দিলে ভাসতো।

তা রামহরি ভট্টাচার্য বললেন—শুধু জল দিলি নারাণ, কেমন বাতাসা করলি দেখি?

বাড়িতে এক-একদিন আনতেন। বাড়িতে ঢুকেই জবাকে ডাকতেন—কই রে?

একটিমাত্র বাতাস। কিম্বা এক টুকরো পূজোর প্রসাদ। কলা কি বাতাবী নেবুর টুকরো। হয় তো চারখানা লুচি একটু মোহনভোগ, সঙ্গে গোটাকয় বোঁদের টুকরো। দিয়ে বলতেনখা, ফেলিসনে যেন মাটিতে—পেসাদ।

জবা বলে—আমার খুব ভালো লাগতো ঠাকুর্দাকে। সেই পাড়া গাঁ, সেই মল্লিকদের আমবাগান, সেই বোসেদের রথতলা

—সে আনন্দ ছেড়ে কলকাতায় আসতে ভালো লাগতো না। তখন মোটে।

রামহরি ভট্টাচার্য শেষের দিকে চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। কিন্তু তবু ভাবলেই সে-দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সংস্কৃত পুথি নিয়ে রাত্রিবেলা রেড়ির তেলের আলোয় বসে শব্দ করে শ্লোক পড়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছে করলে তিনি কি আর বড়লোক হতে পারতেন না!!

শুক্রবার ছিল ‘মোহিমী-সিঁদুর’ দেবার দিন। কত দূর দূর থেকে যে লোক আসতো ওই সিঁদুর নিতে।

—তোমার কী হয়েছে মা?

একটি করে পয়সা দক্ষিণা! মাত্র একটি পয়সা। তা-ও আবার সময় সময় দুটো আধলা জড়িয়ে একটা পয়সা হতো। গ্রামের লোকগুলো ছিল আরো গরীব। শাক কলা মূলল আম কাঁঠাল খেতে পেতে বটে। কিন্তু পয়সা দিতে গেলে যেন মাথায় বজ্রাঘাত হতো তাদের।

—এই আমার মেয়ে ঠাকুর মশাই, জামাই একে নেয় না। একে আপনার সিঁদুর পরিয়ে দিন।

এমনি সব অসংখ্য আবেদন। অসংখ্য দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী। শুনতে শুনতে অত যে শক্ত মানুষ, তারও চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরতো।

এক একদিন রাত্রে জবার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। জেগে দেখে ঠাকুর্দা পাশে নেই। পাশেই ঠাকুর ঘর। অন্ধকার রাত। অমাবস্যার অন্ধকারে চারিদিক ঘুরঘুট্টি। মনে হলো ঠাকুরঘর থেকে যেন ঠাকুর্দার গলার আওয়াজ আসছে। স্তব পড়ছেন তিনি। কেমন ভয় ভয় করতে সে শব্দ শুনে। মনে হতে সমস্ত পৃথিবী যেন থরথর করে কেঁপে উঠছে। যেমন সেই বলরামপুরে ভূমিকম্প হয়েছিল সেবার, ঠিক সেইরকম।

রামহরি ভট্টাচার্য সেবার লোকমুখে শুনলেন—গুপীর মেয়ে হয়েছে—সেই রাত্রেই আস্তে আস্তে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলেন। ওস্তাদদের ডাকলেন গিয়ে মালোপাড়ায়। বললেনএক কাজ করতে হবে তোদের।

—কী কাজ দাদাঠাকুর?

অত রাত্রে দাদাঠাকুরকে দেখে ওরাও কম অবাক হয়নি। সবে মাছ ধরে এসে খেয়ে দেয়ে তরজার আসর থেকে বাড়িতে এসেছে। তখন ঘুমোতে যাবে।

রামহরি বললেন—এই বিশটে টাকা নে।

বিশ টাকা! কালো তেল-চকচকে নধর চেহারাগুলো যেন কিলবিল করে উঠলো। বিশ টাকা পেলে যা কিছু করা যায়। মানুষও খুন করা যায়। বিনা কারণে কত মানুষ খুন করেছে তারা। মন্বন্তরের সময় সব কিছু করতে হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের। নিরীহ মানুষকে মাত্র একখানা গামছার লোভে খুন করতে পেছ-পা হয়নি তারা!

রামহরি বললেন—খুনখারাপি নয়—চুরি করতে হবে।

—রাজী। কার কী চুরি, বলুন।

তারপর শেষ রাত্রের দিকে চুপি-চুপি এসে রামহরি আবার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছেন।

কিন্তু ব্রাহ্মণী টের পেয়ে গিয়েছে। বললে—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

কথা বললেন না রামহরি।

কিন্তু দু’দিন পরে ভোর রাত্রে দরজায় টোকা পড়লো। রামহরি উঠে দরজা খুলে দিতেই একটি দু’ মাসের মেয়ে তার কোলে দিলে তারা। তারপর নিঃশব্দে আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন রামহরি ভট্টাচার্য।

ব্রাহ্মণী সকালবেলা কান্নার শব্দে জেগে উঠেছেন। বললেন— এ কে?

রামহরি বললেন-গুপীর মেয়ে।

—একে এখানে কে আনলো!

রামহরি বললেন—চুপ! ছেলে আমার মরে গিয়েছে জানি, কিন্তু আমার নাতনির আমি জাত খোয়াতে দেবো না।

—তুমি ওই দু’ মাসের মেয়েকে বাঁচাবে কী করে?

–মা আমার সহায়, আমি একে এখানে রাখবো, আমি এর ভরণপোষণ করবে—বিয়ে দেবো-ওর নাম দেবো আমি জবা— আমার মায়ের ফুলের নাম।

ব্রাহ্মণী কেঁদে ফেললেন।-তুমি কী পাগল হয়েছে গো?

ব্রাহ্মণী গোপনে পত্র দিয়ে দিলেন কলকাতায় ছেলের কাছে। গুপীকে আসতে বারণ করে দিলেন। এলেই কর্তা আর আস্ত রাখবেন না। কর্তা বলেছেন–যে ছেলে বেহ্ম হয়েছে, আমার বংশের নাম ড়ুবিয়েছে, তার আমি সর্বনাশ করে ছাড়বো। আরও জানালেন—মেয়ে ভালো আছে।

গুপী আসে। গ্রামের এক প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। খবর নিয়ে যায়। একবার দেখতে ইচ্ছে হয় সন্তানকে। জামাকাপড় পাঠিয়ে দেয় লোক মারফৎ। পয়সা কড়িও।

রামহরির সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে।-এত দুধ আসছে কোত্থেকে শুনি? পয়সা তো ছিল না বাক্সতে?

তারপর সেই মেয়ে বড় হলো। সুন্দরী হলো। এমনি করে দিন। কাটলো, বছর কাটলো।

একদিন চিঠি লিখলে গুপীর স্ত্রী। গুপীর ভারী অসুখ। বাবা যদি দেখতে চান তো যেন শেষ দেখা দেখে যান। আর বেশি দিন বাকি নেই। ছেলে মৃত্যুশয্যায়।

ব্রাহ্মণী বললে—তুমি পাথর হতে পারে কিন্তু আমার মায়ের প্রাণ, আমি যাবোই।

—যাবে কী করে?

—যেমন করে পারি যাবে, পায়ে হেঁটে যাবো, ছেলে যার মরে। মরে, সে কি না গিয়ে থাকতে পারে?

রামহরি চাদরটা কাঁধে নিলেন। ব্রাহ্মণীর দু’গাছা তাগা ভোলা স্যাকরার কাছে বাঁধা রেখে নগদ পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পেছনে পেছনে ঘোমটা দিয়ে চললে ব্রাহ্মণী।

সুবিনয়বাবু বলতেন—তখন আমার খুব অসুখ, বুঝলে ভূতনাথবাবু, জবার মা পাশে বসে আছে—হঠাৎ চোখ মেলে দেখি আমার মা—কতকাল পরে দেখা, কিন্তু মা’কে চিনতে কি ছেলের কষ্ট হয় বললাম—মা—

মা সেই যে আমার বিছানার পাশে বসলেন, সাতদিন আর উঠলেন না। বললাম—বাবা আসেন নি মা?

মা বললেন—তিনি বসে আছেন রাস্তার মোড়ে, ডাক্তারবাবুকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সেখানেই বসে আছেন, এলেন না এখানে।

কী অদ্ভুত ছিল বাবার রাগ! তাঁর ভালোবাসাও যেমন, রাগও তেমনি। তার রাগ ভালোবাসারই নামান্তর। তেমন করে যে রাগতে পারে, সে-ই যথার্থ ভালোবাসতে পারে, উপনিষদের ঋষি বলছেন…

সুবিনয়বাবু মাঝে মাঝে বলতেন—জবার যখন ন’ বছর বয়েস তখন ও আমার কাছে এল, বাবার মৃত্যুর পর। নতুন করে ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলুম। বলরামপুরে থেকে তখন ও তো লেখাপড়া কিছু শেখেনি, কিন্তু জবার ভাই তখন মারা গিয়েছে। জবা যখন এল এ-বাড়িতে, জবার মা’র তখন শোক পেয়ে পেয়ে প্রায় শেষ অবস্থা-মেয়েকে চিনতে পারলে না সে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তারপর আপনি আর দেশে যাননি?

–গিয়েছিলাম ভূতনাথবাবু, শেষকৃত্য আমি আর কোন্ অধিকারে করবো, আমার সে অধিকার নেই আর, কিন্তু তবু গিয়েছিলাম। আমার জন্মভূমি, ছোটবেলায় কত বছর কাটিয়েছি ওখানে, কতদিন প্রাণ কাদতো ওখানে যাবার জন্যে—কিন্তু বাবার শপথের কথা ভেবে যাইনি—কিন্তু গিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে চোখের জল আটকাতে পারিনি—খানিক থামেন সুবিনয়বাবু। তারপর দাড়িতে হাত বুলোতে বুলাতে বলতেন-তখন আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ফাঁকা বাড়ি—হা হা করছে সমস্ত ঘরগুলো—একা একা ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম সমস্ত দিন। মনে হলো যেন বাবার সেই স্তোত্রপাঠ শুনতে পাচ্ছি নির্জন ঘরের মধ্যে—ত্বমেকং বিশ্বরূপম্‌ জগৎকারণম্‌—ত্বমেকম্‌ সাক্ষীরূপ জগৎকারণম্‌—

তারপর ভোরবেলা একটা গরুর গাড়ি ডেকে সব জিনিষপত্র তুললুম। বাবার স্মৃতিমাখানো যত জিনিষ ছিল সব সঙ্গে নিলাম। একটা পুরোনো কাঠের বাক্সে–ওই দেখো না ভূতনাথবাবু, ওরই ভেতর বাবার যত কাগজপত্র, হিসেব, দলিল, চিঠির ভূপ, তার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর—সব সঙ্গে করে এনেছি।

ভূতনাথ দেখেছে—সুবিনয়বাবুর শোবার ঘরে আজো সেই কাঠের বাক্সটা রাখা আছে।

—দুঃখ এই, বাবার একটা ছবি পর্যন্ত নেই যে, তাঁর দিকে চেয়ে থাকি দু’দণ্ড। মাঝে মাঝে বড় দেখতে ইচ্ছে হয় তাকে। একদিক থেকে আমার কাছে আদর্শ কে জানো ভূতনাথবাবু?

—কে?

—দুজন, এক ব্ৰহ্মানন্দ কেশব সেন আর আমার বাবা-অমন জ্বলন্ত নিষ্ঠা এ-যুগে আর কারো দেখতে পাই না এক ব্ৰহ্মানন্দ ছাড়া। আবার খানিক থেমে বলেন—ভাবে তো ভূতনাথবাবু, ব্ৰহ্মানন্দ যেদিন ছোটবেলায় পরীক্ষার হ-এ খাতা দেখে নকল করছিলেন বলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো—তারপর তার সেই নিষ্ঠা, লেখাপড়া, শাস্ত্রচর্চা সব বিষয়ে সে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আর একদিন, যেদিন ব্ৰহ্মানন্দকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন বলে—তিনি সস্ত্রীক গিয়ে আশ্রয় নিলেন মহর্ষি দেবেন ঠাকুরের কাছে। ভাবতে পারে! তোমাদের ইয়ংম্যানদের মধ্যে এতখানি নিষ্ঠা ক’জনের আছে—ক’জন নারীর আছে?

ভূতনাথের মনে পড়ে আরও একজনের কথা। সেদিন ১৯০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। খুব কনকনে শীত পড়েছে। ব্ৰজরাখাল এল সেই রাত্রে। গায়ে কিছু নেই। শুধু একটা চাদর।

ভূতনাথ তখন শোবার আয়োজন করছে। ব্রজরাখালকে দেখে বললে—এ কি ব্রজরাখাল-খালি গা যে?

ব্ৰজরাখাল তখন গুন গুন করে গান গাইছে–

আর তো ব্ৰজে যাবো না ভাই,
যেতে প্রাণ আর নাহি চায়,
ব্রজের খেলা ফুরিয়ে গেছে,
তাই এসেছি মথুরায়—

থেমে ব্ৰজরাখাল বললে—গান গাইলে আর শীত করে না। খুব যখন শীত করবে বড়কুটুম—গান গেয়ে দেখোশীত পালিয়ে যাবে।

—তা জামা কোথায় ফেলে রেখে এলে ব্ৰজরাখাল?

ব্ৰজরাখাল ঢাকা ভাত খুলে তখন খেতে বসেছে। খেতে খেতে বললে—ফুলদাসী মারা গেল আজ।

ভূতনাথও চমকে উঠলো। মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না।

ব্রজরাখাল বললেওই ফুলদাসীকে কত কষ্টে বাঁচানো হয়েছে পাদ্রিদের হাত থেকে, পাদ্রিরা নিয়ে গিয়ে প্রায় খ্রীস্টান করে ফেলেছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী খবর পেয়ে উদ্ধার করে আনেন-আর আজ কিনা..বলতে বলতে চুপ করলো ব্রজরাখাল। খুব তাড়াতাড়ি ভাত খেতে লাগলো। খাওয়া নয় গেলা। খাওয়াটা কোনো দিন ধীরে সুস্থে হলো না ব্ৰজরাখালের।

—আর দুটি ভাত দেবো ব্রজরাখাল? রয়েছে অনেক।

—দেখো মজাটা, কলেরা থেকে বাঁচালাম, প্লেগের হাত থেকে বাঁচালাম, গুণ্ডার হাত থেকেও একবার বাঁচিয়েছি, কিন্তু যে যাবার তাকে বাঁচাবে কে? দাও বড়কুটুম, ভাতই দাও, আরও দুটো গিলে নিই।

ব্ৰজরাখাল এমন কখনও ভাত চেয়ে খায় না। আজ যেন ওর কী হয়েছে।

খেতে খেতে বললে—এমনভাবে মরবে জানতেই পারিনি বড়কুটুম!

ভূতনাথ বললে—শ্মশানে গিয়েছিলে বুঝি?

—হ্যাঁ, তাই তো জামা-কাপড় সব ডোমদের দিয়ে এলুম, কাপড়টা শুধু ভিজিয়েছিলুম গঙ্গার জলে—তাও এখন গায়ে লেগে লেগে শুকিয়ে গেল।

—কী অসুখ হয়েছিল?

—অসুখ বিসুখ কিছু নয়, ভালোই তো ছিল, বাড়ি ভাড়াটা চাঁদা করে দেওয়া হচ্ছিলো, আর খাওয়া খরচটা দিতাম আমি, কিন্তু সইলো না ওর, খ্রীস্টান হবার পর তো আত্মীয়-স্বজন কেউ নিতে। না। শিবনাথ শাস্ত্রী মশাইও অনেকদিন পর্যন্ত যোগাতেন সব।

—না খেতে পেয়েই মরলে বুঝি শেষে?

—না, তাও নয়, খেয়েই মরলো।

–কী খেয়ে?

—বিষ! খানিকক্ষণ চুপ করে রইল ব্রজরাখাল। তারপর বললে—পুলিশ থেকে লাশ ছাড়তে চায় না, পেটের মধ্যে ছেলে পাওয়া গিয়েছিল কিনা! কিন্তু আমি বলি বড়কুটুম ও মরতে গেল কেন? মরে কি ও বাঁচতে পেরেছে? খাওয়া থামিয়ে ব্রজরাখাল উঠলো।

—এ কি, আর খেলে না?

—না বড়কুটুম, জ্ঞানযোগের ওপর আমার বিশ্বাস চলে গেল আজ থেকে, দেখো গিরীশবাবু ঠিক বলতেন-নরেন কেবল বলে— জ্ঞানযোগ কর্মযোগ। গিরীশবাবু, গিরীশ ঘোষকে চেনো তে— ‘চৈতন্যলীলা’ লিখেছেন, তিনি একদিন বললেন নরেনকে—জ্ঞানযোগ জ্ঞানযোগ করো, সংসারের সব দুঃখ তুমি জ্ঞানযোগ দিয়ে দূর করতে পারবে? জ্ঞানযোগ কর্মযোগের একটা সীমা আছে, একটা জায়গায় গিয়ে আর তুমি এগোতে পারবে না—কিন্তু ভক্তি ‘বিশ্বাসে মিলয়ে ভক্তি তর্কে বহুদূর’—আজ কেবল সকাল থেকে কথাটা আমার মাথায় ঘুরছে। শ্মশানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফুলদাসীর মুখখানার দিকে চেয়ে তাই ভাবছিলাম। কই, এইসব হতভাগিনীদের তো আমরা বাঁচাতে পারিনি তর্কশাস্ত্র কি মীমাংসা শাস্ত্র দিয়ে তো এদের দুঃখ ঘুচবে না। কী জানি বড়কুটুম, প্লেগের সময় দিন রাত চোখের সামনে অনেক মৃত্যু দেখেছি, মা, বাপ, ছেলে, এক বছরের কোলের মেয়ে সকলকে এক বাড়িতে এক ঘরে এক শয্যায় মরতে দেখেছি তবু মন আমার এতটা টলেনি!

আর ঠিক এই ঘটনার ক’দিন পরেই ব্ৰজরাখাল কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আজ এতদিন পরে সুবিনয়বাবুর ঘরে দাঁড়িয়ে ব্রজরাখালের কথাটা মনে পড়ার একটা কারণ আছে। সুবিনয়বাবুর দিকে চেয়ে বোঝা যায়—এ-মানুষটির অন্তরে কোথায় যেন একটা বজ্রকঠোর ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে। অথচ সামনে সব সময় সদা-হাসি মুখ। সদাপ্রসন্ন, সদাসুখী। একদিন এবাড়িতেই ঐশ্বর্যের আড়ম্বরের মধ্যেও যেমন দেখেছে তাঁকে, আজ রোগকাতর ঐশ্বর্যরিক্ত অসহায় অবস্থাতেও যেন তার কোনো বৈলক্ষণ্য নেই। তেমনি প্রশান্ত দৃষ্টি, অবিচলিত নিষ্ঠা।

সমস্ত বাড়িটা ব্যস্ত-চঞ্চল, কর্মমুখর। যেখানকার যে-জিনিষ, আজ সেখানে তা নেই। রাজা-রাণীর ছবি দুটো নামানো হয়েছে মেঝের ওপর।

সুবিনয়বাবু চিত হয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে শুয়েছিলেন। পাশ ফিরে বললেন—অনেকদিন দেখিনি তোমাকে চাকরির কিছু

সুবিধে হলো তোমার?

ভূতনাথ বললে—কই, কিছুই তো হলো না।

–আমি কয়েকখানা চিঠি লিখেছি কয়েকজনকে তোমার জন্যে, জবাবও পেয়েছি অনেক জায়গা থেকে, আমি একটু সেরে উঠলে নিজে একবার চেষ্টা করবো। ব্ৰজরাখালবাবুর খবর কী ভূতনাথবাবু, কিছু খবর পেয়েছে? তারপর খানিকক্ষণ আবার চুপচাপ। বললেন—বড় খুশি হলাম তোমাকে দেখে। জবার বিয়েতে তোমার কিন্তু আসা চাই-ই ভূতনাথবাবু, আসছে অঘ্রান মাসেই ঠিক করেছি।

ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে একবার দেখে নিলে তারপর বললে— কিন্তু বিয়েটার এত দেরি হচ্ছে কেন?

–খানিকটা ওদের ইচ্ছে আর তাছাড়া আমার এ অসুখটা না হলে ওটা তো আগেই হয়ে যেতো—কিন্তু এবার আমি বলেছি ভূতনাথবাবু, তোমাদের দুজনের যখন অনুরাগ হয়েছে আর মিলনে যখন কোনো বাধা নেই, উভয়ে উভয়কে ভালো করে চিনেছে, পরস্পরকে তোমরা গ্রহণ করছে মনে মনে, তখন বুঝতে হবে ঈশ্বরেরও তাই অভিপ্রায়। কী বলল ভূতনাথবাবু, অন্যায় কিছু বলেছি আমি?

ভূতনাথ বললেন, ঠিক কথাই বলেছেন আপনি।

—আমিও তাই বলি, অর্থ টা অনেক সময়েই অনর্থের সৃষ্টি করে, আবার আমাদের সাংসারিক জীবনে অর্থের প্রয়োজনও অস্বীকার করবার নয়। আমার বাবা বলতেন-টাকা পয়সা হাতের ময়লাতাই বাবার মতো পুণ্যাত্মা মানুষ আজীবন শান্তিতে কাটিয়েছেন— কিন্তু আমি পারিনি ভূতনাথবাবু, প্রথম যৌবনে অর্থের নেশায় মেতেছিলাম, সঞ্চয়ের নেশায় ড়ুবেছিলাম, তাই আজ আমি রিক্ত, সমস্ত অর্থ থেকেও আমি রিক্ত—কিন্তু আজ সমস্ত ত্যাগ করে, সর্বস্ব দান করে আমি আবার আমার যথার্থ বিত্ত ফিরে পেলাম, এতদিন ধর্মচ্যুত ছিলাম এখন আবার স্বধর্মে আশ্রয় পেয়েছি—কী বলল ভূতনাথবাবু, ভুল করেছি আমি?

–না, ঠিকই করেছেন আপনি—ভূতনাথ বললে।

–এই দেখো না, আজ আমি এ-বাড়ি ত্যাগ করছি, হাসপাতাল হবে এখানে, জবা-মা’র বোধহয় মনে মনে একটু দ্বিধা ছিল, কিন্তু যখন বুঝিয়ে দিলুম মাকে, যে এ ত্যাগ নয় মা, এ ভোগ, বিশ্বের সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একযোগে কাজ করা, উপনিষদের ঋষি বলেছেন, “তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জিথা’—বললুম যে, এ-আমার শুধু অনুভূতি নয় উপলব্ধি, এ আমার শুধু প্রিয়ই নয়—শ্রেয়ও জবা-মা বুঝলো। বললে—বাবা তুমি কখনও অন্যায় করতে পারো না তারপর খানিক থেমে সুবিনয়বাবু আবার বলতে লাগলেন— তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম——সুপবিত্রকে তুমি সমস্ত কথা খুলে বলেছো মা? বলেছো তত যে, সে তোমাকে গ্রহণ করলে তোমাকেই শুধু পাবে–‘মোহিনী-সিঁদুরে’র অর্থের ওপর তার বা তোমার বা আমার কোনোই অধিকার নেই—বলেছে মা এ-কথা? জবা-মা বললে—বলেছি বাবা।

—শুনে বড় শান্তি পেলাম ভূতনাথবাবু, তবু বললাম—তুমি যদি অনুমতি দাও মা তবে আমিও তাকে সব বিশদ করে বলতে পারি।—জবা-মা বললে—অনুমতির কথা কেন বলছেন, আপনি বা ভালো বুঝবেন তাই করবেন বাবা। বললাম—তোমার তো মা নেই মা, আমিও বৃদ্ধ হয়েছি—তোমার মায়ের কর্তব্যটুকুও আমাকে করতে দিও মা। তোমার মা-ই মৃত্যুর শেষ দিনে আমাকে বলে গিয়েছিলেন, তোমাকে মুক্তি দিতে—তোমার মায়ের ইচ্ছে আর আমারও ইচ্ছে তুমি মুক্তি পাও—সবরকমের মুক্তি, মিথ্যা থেকে গ্লানি থেকে, সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি। ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যও তো একটা বন্ধন—কী বলো ভূতনাথবাবু, তোমার কি মত? সুবিনয়বাবু কথা বলতে পেলে আর কিছু চান না।

ভূতনাথ বললে—আজকেই কি এ-বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন?

—হ্যাঁ, ভূতনাথবাবু, আজই—যত শীঘ্র মুক্ত হওয়া যায় ততোই তো ভালো। বাবার মৃত্যুর পর আমি এই ‘মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তার আগে তুমি তো জানো আমি আইন ব্যবসা করতাম। সামান্য আয় হতো সে-কাজে, তবু সেই আয়টুকু রেখে আর সমস্ত আমি ত্যাগ করেছি। এ-বাড়ির ওপর আমার তো কোনো অধিকার নেই। সুবিনয়বাবু আবার বললেন–অন্যায় যা আমি করেছি, তার জন্যে অনেক অনুতাপও করেছি ভূতনাথবাবু, দুঃখ কষ্টও কম পাইনি। ভাবতে পারো, একদিন বাড়ি এসে শুনলাম, আমার একমাত্র সন্তানকে কার হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, গেলাম পুলিশের কাছে, কত অনুসন্ধান করলাম—সেদিন স্বামীস্ত্রীতে আমরা সারা রাত ঘুমুতে পারিনি—তা সেই কথাই বললাম সেদিন সুপবিত্রকে। বললাম তুমি একাধারে জবার পিতা, মাতা, স্বামীর কর্তব্য করবে, জবা তার মায়ের স্নেহ পায়নি, আর আমার আয়ু তো ফুরিয়েই এসেছে।

—সুপবিত্র আমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বললে—আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন সে-কর্তব্যে কোনোদিন অবহেলা না করি। সুপবিত্রর বাবা ছিলেন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। সুপবিত্রকে আমি তার জন্ম থেকে জানি, সুপবিত্রর হাতে জবাকে তুলে দিয়ে আমিও নিশ্চিত হয়ে যেতে পারবে—তা তোমাকে সংবাদ দেবো ভূতনাথবাবু— আসছে অঘ্রানেই সমস্ত ব্যবস্থা হবে—তা ততদিনে আমি উঠে হেঁটে বেড়াতে পারবো।

হঠাৎ জবা ঘরে ঢুকলো। বললে—বাবা আপনি আবার কথা বলছেন! আসুন ভূতনাথবাবু—কেবল গল্প আপনার-আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। এসেছেন যখন এ-বাড়িতে একটু খাটিয়ে নেবে। তারপর বাবার দিকে চেয়ে বললে—সেই পুরোনো কথা সব বলছিলেন বুঝি।

—বলছিলাম মা, তোমার কথাই ভূতনাথবাবুকে বলছিলাম, এখন থেকে তোমার নিজের হাতে সব কাজ করতে হবে। কাজ করা তো তোমার অভ্যেস নেই মা।

—কেন বাবা, ঠাকুর চলে যাবার পর সেবার রাঁধিনি আমি?

—আমি কি তাই বলেছি মা।

-থাক বাবা, এখন ও-সব কথা থাক—কত কাজ পড়ে রয়েছে জানেন। ভূতনাথবাবুকে আমি নিয়ে যাচ্ছি—আপনি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন তো। আসুন—বলে জবা আগে আগে চলতে লাগলো। ভূতনাথ দেখলে জবার সারা গায়ে ধুলো ময়লা লেগেছে। একেবারে ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে থামলে জবা। বললে কী দেখছেন অমন করে?

ভূতনাথ চোখ সরিয়ে নিলে।

জবা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। বললে-অমন করে তাকাতে লজ্জা করে না।

ভাঁড়ার ঘরটা বেশ অন্ধকার। এক রাশ কাঁসা আর পিতলের বাসন নামানো রয়েছে একদিকে। অন্যান্য জিনিষও অগোছালো

পড়ে আছে এদিক-ওদিক।

প্রসঙ্গটি এড়াবার জন্যে ভূতনাথ সেইদিকে চেয়ে বললে— এগুলো কি যাবে তোমাদের সঙ্গে?

জবা বললে—এই ঝুড়িটার ভেতরে একে একে সব ভরে দিন দেখি।

ভূতনাথ কামিজের হাতাটা গুটিয়ে কাজে লাগতে যাচ্ছিলো।

জবা বললে—ভাববেন না, আপনাকেই শুধু খাটাচ্ছি, সুপবিত্রকেও কাজে পাঠিয়েছি আমি। এই রোদে বাজারে গিয়েছে সে-সকাল থেকে ঘুরছে—একটু বসতে দিইনি। আর আপনিই শুধু আরাম করে বসে থাকবেন তাই কি হয়!

বাসনের ঝোড়াটা সরাতে সরাতে ভূতনাথ শুধু বললে—আমি কি সে-কথা বলেছি?

জবা শাড়ির আঁচলটা আর একবার ভালো করে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে বললে—মুখে হয় তো বলবেন না কিন্তু মনে মনে হয় তো রাগ করবেন—গালাগালি দেবেন।

ভূতনাথ আর সহ্য করতে পারলে না। বললে—তুমি আমার কী এমন ক্ষতি করেছে। যে—তোমাকে আমি গালাগালি দেবে। তোমার সঙ্গে কি আমার সেই সম্পর্ক?

জবা পেছন ফিরে কাজ করছিল। সেই অবস্থাতেই বললে

আপনি সব কথায় চিরকাল সম্পর্ক তুলে কথা বলেন কেন?

ভূতনাথ পিছন ফিরে যে-জবাবটা দিতে যাচ্ছিলো সেটা অনেক কষ্টে সম্বরণ করলে। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলে। বললে—এগুলো তো হলো—এবার আর কি কাজ আছে বলে?

জবা উঠে দাঁড়িয়ে বললে—ওই যে সিন্দুকটা দেখছেন, ওর ভেতর থেকে সব জিনিষপত্র বের করতে হবে—পারবেন একলা? যদি না পারেন তো সুপবিত্র আসুক।

সুপবিত্রর নাম শুনে ভূতনাথ কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠলো। বললে-দেখি, আমি একলাই পারবো।

জবা বললে-ঝি-চাকর কেউ-ই তো নেই, সব ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন থেকে সবই তো আমার একলা করতে হবে।

ভূতনাথ বললে—একলা যে কী করে তুমি সব করবে তাই ভাবছি।

জবা বললে-ভগবান দুটো হাত দিয়েছেন শুধু ভাত খাবার জন্যে নয়। কাজ না করলে পা-ই বলুন আর হাতই বলুন সব অকেজো হয়ে যায়।

এরপর ভূতনাথের আর কোনো উত্তর দেওয়া চলে না। ভারী লোহার সিন্দুকটা এক হাতেই খোলবার চেষ্টা করতে লাগলো। খুবই ভারী ডালাটা। তবু কে জানে কেন, যেন অসুরের মতো ক্ষমতা ফিরে এল গায়ে। তারপর দু’হাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে চাড় দিতেই ডালাটা এক সময় খুলে গেল। কিন্তু ততক্ষণে দরদর করে ঘেমে নেয়ে উঠেছে ভূতনাথ।

জবাও কম বিস্মিত হয়নি।

জবার বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে ভূতনাথ হাসতে হাসতে বললে —অবাক হলে যে? আমি পাড়াগায়ের ছেলে—তা ভুলে গিয়েছে নাকি?

জবা কিছু কথা বলতে পারলে না। তখনও যেন তার বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি।

ভূতনাথ তেমনি হাসতে হাসতেই বললে-অঘ্রান মাসে তোমার বিয়েতে যদি নেমন্তন্ন হয়, তো আরো দেখবে আমরা শুধু বেশি ভাতই যে খেতে পারি তাই নয়—ইচ্ছে করলে লুচিও খেতে পারি অনেক।

জবা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল। তারপর হাসলো। বললে নেমন্তন্ন করবার মালিক আমি নই, নেমন্তন্ন করবেন বাবা—কিন্তু শুধু পেট ভরে লুচি খেতে পাওয়াটাই বুঝি আপনার লক্ষ্য?

ভূতনাথ তখন আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে। প্রকাণ্ড একটা ভারী জিনিষ নামাতে নামাতে বললে—এ ছাড়া আমার আর কি লক্ষ্য থাকতে পারে বলো। আমরা বরপক্ষও নই, কন্যাপক্ষও নই, আমরা শুধু ইতরপক্ষ–একটু মিষ্টান্ন পেলেই খুশি হবো।

জবা হাসলো আবার।—বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণ পরিচয় পড়েছেন তো?

—না পড়ে পার পাবার কি উপায় ছিল? শরৎ পণ্ডিতের বেত দেখোনি তো? সে যে কী কষ্ট করে লেখা-পড়া শেখা, বর্ণপরিচয় আর নামতা তো মাটিতে লিখেছি, খাতা কলম পাইনি পিঠের শিরদাঁড়া ব্যথা হয়ে যেতো—যাক, আজ মনে হচ্ছে লেখাপড়া শেখাটা একেবারে ব্যর্থ হয়নি।

–কেন?

—লেখাপড়া শিখি আর না-শিখি শরৎ পণ্ডিতের বেত শরীরটাকে মজবুত করে দিয়েছে।

জবা বললে আপনার তো ভারী অহঙ্কার।

—অহঙ্কারের কি দেখলে আমার?

—লোহার সিন্দুকটা খুলতে পেরেছেন বলে ভেবেছেন বুঝি খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি আমি?

—তোমাকে আশ্চর্য করার স্পর্ধা যদি কখনও হয়ে থাকে আমার তো ধিক আমাকে বলে ভূতনাথ আবার নিজের কাজে মন দেবার চেষ্টা করলে।

খানিক পরে জবা বললে-রাগ করলেন নাকি?

ভূতনাথ কাজ করতে করতে থামলো। বললে—আমাকে আগে কতদিন কতবার কত কী বলছো তুমি-তখনও যদি রাগ না করে থাকি—এখনও করিনি।

জবা বললে—কিন্তু আমার এমনি কপাল ভূতনাথবাবু আমাকে সবাই ভুল বোঝে!

ভূতনাথ সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে এতক্ষণে। জবা নিজের মনেই কাজ করে চলেছে। পরিশ্রমে সারা শরীর ঘেমে উঠেছে। মাথার বেণীটা পিঠের ওপর দিয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে। ভাড়ার ঘরের সেই স্বল্প-অন্ধকার পরিবেশে যেন আজ নতুন করে আবিষ্কার করলে জবাকে।

ভূতনাথ বললে—সবাই-ই কি ভুল বুঝেছে তোমাকে?

—সবাই।

ভূতনাথ একটু দ্বিধা কাটিয়ে বললে—একজনও কি বাদ পড়ে না?

–একজনও না।

ভূতনাথ বললে—সকলের খবর রাখি না, নিজের কথা বলতে পারি এই যে…না, নিজের কথা আজ থাক—কিন্তু সুপবিত্রবাবু?

জবা বললে—সুপবিত্র? সুপবিত্র নিজেকেই বুঝতে পারে না তা বুঝবে আমাকে! আপনি এমন মানুষ দেখেছেন ভূতনাথবাবু, দিনের মধ্যে দশবার ওর চশমার খাপ হারিয়ে যায়, ভাত খেতে ভুলে যায় এক-একদিন এমনি পাগল। ওর মা এখনও ঘুম পাড়িয়ে দেয় ওকে বিশ্বাস করতে পারেন—ও যে কেমন করে বিয়ে করে সংসার করবে কে জানে—আমার তো সত্যি এক-একসময়ে ভারী ভয় হয়।

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে ভেবে পেলে না। শেষে বললেকাজের লোকরা হয় তো ভালো করে সংসার করতে পারে—কিন্তু ভালো স্বামী হওয়া তো অন্য জিনিষ।

জবা বললে—কিন্তু সুপবিত্র বড় ছেলেমানুষ, এখনও ওর নিজের ইচ্ছে বলে কিছুই নেই—ও যে কী করে এম-এ. পাশ করলো, কে জানে! আমি যখন বললাম ওকে—চাকরি খোঁজো একটা চাকরি না করলে কী করবে? তখন ও চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো—অথচ বিয়ের আগে যে সে-দিকটা ভাবতে হয় সেজ্ঞানও নেই। জানেও না যে বিয়ে মানে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া,—অথচ আর মাত্র এক মাস বাকি।

ভূতনাথ চুপ করে রইল।

জবা বললে—কিন্তু প্রশংসা করতে হয় ওর একনিষ্ঠতার। আমাদের সমাজের আরো অনেক ছেলের সঙ্গেই তো মিশেছি, কেউ চেয়েছে আমার টাকা, কেউ চেয়েছে রূপ, কেউ কেউ বেশ সংসারী, জন্মদিনে উপহার দিয়েছে দামী দামী, কিন্তু সুপবিত্র গরীব, তবু কত কী বলেছি কতদিন, কতদিন রাগ করেছি ওর ওপর, জানেন বাড়িতে ঢুকতে দিইনি কতবার, ও যতবার যা বলেছে, তার উল্টো করেছি আমি, সব বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ওকে অপদস্থ করেছি আমি, কিন্তু তবু দেখেছি কিছু বলেনি। এক-একদিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে চেয়ে থেকেছে আমাদের বাড়িটার দিকে। খানিক থেমে জবা আবার বললে—কী জানি এক-একবার মনে হয় ভুল করছি না তো-বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি—বাবা মত দিয়েছেন। বাবারও সুপবিত্ৰকেই পছন্দ—কিন্তু তবু ভয় করে এক-একবার।

তারপর হঠাৎ মাথা তুলে জবা বললে—এক-একবার ভাবি ভূতনাথবাবু, যদি হিন্দু হয়ে জন্মাতাম ভালো হতো। বাবা-মা যার সঙ্গে বিয়ে দিতেন তাকেই স্বামী বলে গ্রহণ করতাম, এত সমস্যা থাকতো না তাতে—অন্তত নিজের ভাবনাটা ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

ভূতনাথ এবারও কোনো উত্তর দিলে না। আর উত্তর দেবার ছিলই বা কী? সেদিন সেই ভাঁড়ার ঘরের ধুলো ময়লার মধ্যে জবা যে এমন সব কথা বলবে এ যেন কল্পনাও করা যায়নি। অথচ সে-কথা যে ভূতনাথকে লক্ষ্য করেই বলছিল এমন ভুল ধারণাও করেনি ভূতনাথ। ওগুলো জবার স্বগতোক্তি বলে ধরে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছিল তার। ভূতনাথ হঠাৎ বলেছিল-বেলা অনেক হলো—দেরি হচ্ছে না তো?

—দেখেছেন কাণ্ড-বলে জবা চমকে উঠেছিল। বলেছিল—ছি ছি—কোনো কাজই হলো না। শুধু গল্পই হলো—-বলে উঠে পড়লো জবা। তারপর বললে–আপনাকে খুব খাটালাম আজকে—কিছু মনে করবেন না তো…কিন্তু এ, আপনার জামা কাপড়ের কী

অবস্থা হয়েছে।

-–তা হোক—ভূতনাথ বললে—কিন্তু একটা অনুরোধ করবো, রাখবে?

–কী আবার আপনার অনুরোধ!

–রাখবে কিনা শুনি আগে, এমন কিছু অন্যায় অনুরোধ করবো না আমি।

—রাখবো, বলুন।

—তোমার জীবনে যখনি কোনো প্রয়োজন হবে, আমাকে ডেকো, তোমার কিছু উপকার আমি করতে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

জবা হাসলো। বললে—আমার কাছ থেকে যদি কৃতজ্ঞতা পান, তবুও?

–হ্যাঁ, তবুও।

জবা বললে—কিন্তু কেন আপনার এ অদ্ভুত খেয়াল বলতে পারেন?

-খেয়াল নয়, এ আমার…

—এ আপনার কী? নেশা?

–নেশা হলে তো বাঁচতুম জবা, কারণ নেশা একদিন কাটলেও কাটতে পারে কিন্তু এ আর যাবার নয়, বলতে পারে এ-ও একরকম ব্রত।

–তাতে আপনার লাভ?

—লাভ লোকসান তো কষে দেখিনি আমি, দান-প্রতিদানের কথাও ভেবে দেখিনি, শুধু প্রাণ দিয়ে তোমার উপকার করবো প্রয়োজন হলে।

জবা যেন কী ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষণ। তারপর বললে–কিন্তু আমি যদি কখনও ভুল করি, অন্যায় করি বা আঘাত করি আপনাকে?

—কিন্তু ভুল কি কখনও করোনি, না অন্যায়ও করোনি, না আঘাতও কখনও দাওনি আমাকে?

জবা এবার চোখ নামালো। বললে—দেখুন, এই আমার কপাল—কেউ আমাকে বুঝলো না, বুঝতে চাইলেও না কোনোদিন।

ভূতনাথ কী যেন বলতে যাচ্ছিলো। জবা হঠাৎ বললে— আপনিও শেষে আমায় ভুল বুঝলেন ভূতনাথবাবু, আট ন’ বছর পর্যন্ত যার কেটেছে পাড়াগাঁয়ে অন্য এক সমাজে, যার লেখা-পড়া শেখবার অবকাশ হলো না, বাপ-মা’র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেল যাকে গুণ্ডার দল, তারপর হঠাৎ চলে এলাম আর এক সমাজে, যেখানে এসে দেখলাম মা আমাকে চিনতে পারে না, এতদিন যে-সমাজে মানুষ হয়েছি সেখানে যা ছিল গুণ এখানে এসে তা হয়ে গেল দোষ, ঘষে-মেজে যাকে আবার সভ্য মানুষ করা হলো, তার তখন আর কী বাকি আছে? আপনারা সবাই আমার মুখের কথাটা সত্যি বলে মেনে নিলেন—বাইরের খোলসটাকেই আসল রূপ বলে ধরে নিলেন—অন্যায় যদি করেই থাকি, আঘাত যদি দিয়েই থাকি কোনো দিন তো আজকে অন্তত আমায় ক্ষমা করবেন। সুপবিত্রর মতো আপনি বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল জবা।

ভূতনাথ চেয়ে দেখলে সুপবিত্র এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।

জবা বললে—সব ঠিক করে এলে তো?

সুপবিত্র বললে—সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।

—বাড়িটার ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়েছে?

সুপবিত্রর দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। আজকে আর আলপাকার কোট নয়। বেনিয়ান পরেছে একটা। চোখের মোটা চশমার নিচে চোখ দুটো কাঁপছে। দেখেই মনে হয় যেন সারা জীবন লেখা-পড়া নিয়ে কেটেছে তার। অন্তত জবার দিকে যে-দৃষ্টি নিয়ে দেখছে, বই-এর পাতার দিকে সেই দৃষ্টি নিয়েই বুঝি দেখে সে। মনে হয় সুপবিত্রর কাছে সমস্ত মানুষ, সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত সংসার যেন একটা বিরাট গ্রন্থ। বই-এর বাইরে যে একটা পৃথিবী আছে তা যেন সে ভাবতে পারে না। ভাবলেও তা জোর করে ভুলে থাকতে চায়। অন্তত তাতে সুখ না থাক শান্তি আছে। তাতে ঝুকি কম। তাই জবাকেও সেই দৃষ্টি নিয়েই দেখছে। জবাও যেন তার কাছে একটা বই ছাড়া আর কিছু নয়। পড়বার আগে বা পরে হাত দিয়ে যেন স্পর্শ করতেও তৃপ্তি।

জবা আবার বললে—আর গাড়ি, গাড়ির কী বন্দোবস্ত করলে?

সুপবিত্র যেন আকাশ থেকে পড়লো। বললে—যাঃ, গাড়ির কথাটা তো একেবারে ভুলে গিয়েছি। আমি এখনি যাচ্ছিবলে পেছন ফিরতে যাচ্ছিলো।

জবা বললে—যাক, আর গিয়ে কাজ নেই, রোদ্দ রে ঘুরে ঘুরে যে চেহারা হয়েছে তোমার!

সুপবিত্র তবু বললেন, আমি যেতে পারবো, আমার কিছু কষ্ট হবে না বলে সত্যিই চলে যেতে চাইছিল।

কিন্তু জবা সুপবিত্রর হাতটা ধরে ফেললে। বললে-সকাল থেকে ঘুরছে—আর যেতে হবে না। শেষে মা’র কাছে বকুনি খেতে হবে তো আমাকেই। ওপরে গিয়ে আয়নাতে মুখখানা একবার দেখো তো নিজের, কী দশা হয়েছে চেহারার। এমনি ঘুরলেই স্বাস্থ্য খুব ভালো থাকবে বটে! ভূতনাথবাবু আছেন, তোমায় আর কিছু করতে হবে না।

সত্যি এবার নিরস্ত হলে সুপবিত্র।

জবা বললে—ভূতনাথবাবু, একটা গাড়ি আনতে পারবেন?

ভূতনাথ বললে—কখন যাবে?

এই বিকেল বেলা, সেকেণ্ড ক্লাশ গাড়ি একটা, বার-শিমলে যাবে, বারো আনার বেশি যেন ভাড়া বলবেন না।

ভূতনাথ বললেবার-শিমলে যাবে তা বারো আনা কেন? আট আনা দিলেই তো যথেষ্ট।

শেষ পর্যন্ত আট আনাতেই গাড়ি ঠিক করে এনেছিল ভূতনাথ। আস্তে আস্তে সমস্ত মালপত্র পাঠানো হলো গরুর গাড়িতে। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। একদিন এই বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন সুবিনয়বাবু স্ত্রীর হাত ধরে। সে অনেকদিন আগের কথা। এখানে এসেই তার নতুন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে একদিন। সেই শিশুর কান্নার শব্দে এ-বাড়ি একদিন মুখরিত হয়ে উঠেছে। আবার এখানেই সে-শিশু অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলেছে। সে-ও একদিন গিয়েছে। এখানেই জবার মা’র সুস্থ মস্তিষ্ক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে তিলে তিলে শোকে দুঃখে নিঃসঙ্গতায়। একদিন এ-বাড়িতে সুবিনয়বাবু উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন বাবার পরিত্যক্ত জিনিষপত্র। সঙ্গে করে এনেছেন জবাকে। এই বাড়িতেই জবার নতুন করে পুনর্জন্ম হয়েছে। হাতে খড়ি হয়েছে। এই বাড়িতেই কতদিন কত উৎসব, কত মাঘোৎসবের অনুষ্ঠান হয়েছে। এইখানে এসেছেন বিদ্যাসাগর মশাই, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন। এই বাড়িতেই বঙ্কিমচন্দ্র এসেছিলেন। ১৮৬৪ সালে। যেবার কলকাতায় আশ্বিনে-ঝড় হয়েছিল খুব। দুর্গেশনন্দিনী’ সেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। নিজের হাতে এক খণ্ড বই উপহার দিয়ে গিয়েছেন সুবিনয়বাবুকে। এই বড় হল ঘরটায় বসেই একদিন সুবিনয়বাবু জবাকে দীক্ষা দিয়েছেন।

সুবিনয়বাবু বললেন—যেবার কেশববাবু বিলেত গেলেন, বোধহয় ১৮৭০ সাল। যাবার আগে এখানে এসেছিলেন—ওই চেয়ারটায় বসেছিলেন তিনি। তিনি আমাদের কয়েকজনকে ডেকে কিছু বলেছিলেন, সব মনে নেই, কিছু কিছু মনে আছে, বলেছিলেনমহাপুরুষরা যেন চশমা, চশমা যেমন চোখকে আবরণ করে না, অথচ দৃষ্টির উজ্জ্বলতা বাড়ায়, মহাপুরুষরাও হলেন তেমনি মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে তারা কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন না, কিন্তু ঈশ্বর দর্শনে সাহায্য করেন আবার আর একটা উপমা দিয়েছিলেন মনে আছে। বলেছিলেন-মহাপুরুষরা যেন দারোয়ান-দারোয়ান যেমন আগন্তুককে প্রভুর কাছে নিয়ে যান, আর তারপর আর কোনো কাজ থাকে না তার, মহাপুরুষরাও তেমনি ঈশ্বর চরণে মানুষকে নিয়ে যান।

সুবিনয়বাবুর আজ যেন কথা আর শেষ হতে চায় না।

জবা বলে-বাবা সন্ধ্যে হয়ে আসছে এইবার চলুন।

সুবিনয়বাবু বললেন–আর একটু দাঁড়াও মা, এ-বাড়িতে তো আর আসা হবে না—আর একটু বলেনি মা। ভূতনাথবাবু তো সব কথা জানে না। সুপবিত্রবাবু, তোমার শুনতে খারাপ লাগছে না তো?

সুপবিত্র মাথা নিচু করলো।

–এই বাড়িতে কি কম ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এখনও চোখ বুজলে সব যে দেখতে পাই। কেশববাবু তখন ফিরে এসেছেন বিলেত থেকে–কত কাজ আমাদের-Indian Reform Association নামে আমাদের সভা হলো একটা—তার প্রথম অধিবেশন হলো এইখানে। কত কী করবার ইচ্ছে ছিল তার Temperance, Education, Cheap literature, Technical education-কত বিভাগ হলো, শিবনাথ শাস্ত্রী বই লিখলেন ‘মদ না গরল’, তারপর ‘সুলভ-সমাচার’ নামে এক পয়সা দামের খবরে কাগজ বেরুলে—তাতেও আমি লিখতাম।

সুপবিত্র চুপ করে বসে বেনিয়ানের বোতামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। জবা সব কাজ শেষ করে এসেছে। সমস্ত বাড়িটা কাল সকালেই একটা হাসপাতালে পরিণত হবে। এখানে ঘরে ঘরে রোগীর শুশ্রুষা চলবে। সুবিনয়বাবুর বহুদিনের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। কিন্তু আজ এই বিকেলবেলার সন্ধিক্ষণে বাড়ির ঘরগুলোর দিকে চেয়ে যেন মনে হলো—সমস্ত মৃত আত্মারা হঠাৎ আবার বুঝি পদচারণা শুরু করেছে। কান পেতে শুনলে যেন অতীতের আত্মাদের কথা শুনতে পাওয়া যাবে। মনে পড়লে জবার মা’র কথা। ওইখানে একটা আরামকেদারায় বসে বসে পশম বুনছেন আর যেন আপন মনে কী ভেবে চলেছেন। আর সেই গান।—“তুমি ব্ৰহ্মা তুমি বিষ্ণু। ব্রজরাখালের সঙ্গে ভূতনাথ যেদিন প্রথম এ-বাড়িতে এসেছিল সেদিনের সে-ছবিটা যেন চোখের সামনে ভাসে।

সুবিনয়বাবু বলে চলেছেন, কিন্তু ভূতনাথের যেন কিছুই কানে যায় না। বড়বাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে এ-বাড়ির ইতিহাসের যেন কোনো মিল নেই। অথচ এত কাছাকাছি। এত সমসাময়িক। ভূমিপতি চৌধুরী যখন ইটালিয়ান শিল্পীর মেমকে নিয়ে ঘরে এনে তুললেন, তখন কলকাতার প্রথম আমল। সমাজ তখন ছিল ক্ষয়িষ্ণু। কিন্তু ভূমিপতি চৌধুরীর বংশধর বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি, কৌস্তুভমণি, চূড়ামণি ওরা তো নতুন যুগের মানুষ! তবু তারাও তখন পূর্বপুরুষের বনেদীয়ানার নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে অচৈতন্য হয়ে। কিন্তু পাশাপাশি এই সুবিনয়বাবুর বাড়িতেই তখন অন্য ইতিহাস রচনা চলেছে। রাজনারায়ণ বসু বক্তৃতা করলেন—’হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ নিয়ে। বিলেতের টাইমস পত্রিকায় সে-রিপোর্ট ছাপা হলো। রাজনারায়ণ বসু বললেন—ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্মেরই উন্নতরূপ। ব্রহ্মানন্দ বিলেত থেকে এসে ‘ভারত-আশ্রম’ করলেন। এখন যেখানে সিটি কলেজ, ওইখানে ১৩ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটের বাড়িতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হলো। সুবিনয়বাবু গিয়ে উঠলেন একদিন ‘ভারত-আশ্রমে।

জবা আবার বললে-এবার চলুন বাবা।

—হ্যাঁ মা, যাই, কিন্তু চলে গেলে তো আর বলা হবে না, তোমার ভালো লাগছে তো সুপবিত্র?

জবা বললে—সুপবিত্রবাবুকে আজ অনেক খাটিয়েছি বাবাওঁর মা হয় তো খুব বকুনি দেবেন আমাকে।

–তাই নাকি মা? তবে তো দেরি করা উচিত নয়—কিন্তু সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের গোড়াকার গল্পটা শুনবে না আজ-মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেমন করে…

—না বাবা, সে-গল্পটা আজ থাক—অনেক দেরি হয়ে যাবে—

–তবে চলো। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। সেকেণ্ড ক্লাশ ঘোড়ার গাড়ি।

এবার শেষ যাত্রা। সন্ধ্যে হবো হবো। সমস্ত ঘরে তালা লাগিয়ে দিলো ভূতনাথ। পুব দিকের ঘরের কাছে আসতেই জবা পেছনে এসে দাঁড়ালো। বললে—একটু দাঁড়ান ভূতনাথবাবু।

চমকে উঠেছে ভূতনাথ। এদিকটা অল্প-অল্প অন্ধকার। জিনিষপত্র খালি হয়ে যাবার পর একটুখানি গলার শব্দ সমস্ত বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। খাঁ খাঁ করা আবহাওয়ার মধ্যে যেন দম আটকে আসে। ভূতনাথ তখন সমস্ত দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত। হঠাৎ বলে উঠলো—কে?

জবা বললে—একটা কথা ছিল আমার।

জবার মুখখানা যেন রাগে কালো হয়ে উঠেছে। অন্ধকারে ভালো করে দেখা না গেলেও অনুমান করে নিলে ভূতনাথ—যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। বললে-বলো না?

জবা বললে—আর যদি কখনও দেখা না হয় আপনার সঙ্গে, তাই বলে রাখাই ভালো।

ভূতনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বললে—খুব জরুরি কথা কি?

খুব জরুরি কথা না হলেও খুব দরকারী।

—সে কথা কি সকলের সামনে বলা যায় না?

-সকলের সামনে শুনতে চান তো তাও বলতে পারি–কিন্তু তাতে আপনার মর্যাদা বাড়বে না।

-তোমার কাছে আজ নতুন কথা শুনছি জবা, মর্যাদার কথা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না—কিন্তু যে-কথাই হোক

সেটা পরে বললেও তো চলতে–এখন তো তুমি খুব ব্যস্ত।

—যত ব্যস্ততাই থাক, আমি কাজের মধ্যে এতক্ষণ ভুলে ছিলাম—কিন্তু মনে পড়েছে এখন।

-কিছু অন্যায় করেছি আমি?

-আপনার নিজের সাহস নেই বলে বাবার কাছে ননীলালকে পাঠিয়েছিলেন কী বলে?

—কে, ননীলাল?

—শুধু তাই নয়, আপনার ছাড়পত্র না থাকলে এখানে ঢোকে সে কোন্ সাহসে? আপনি তাকে কেন বাবার কাছে পাঠিয়েছিলেন শুনি?

–বিশ্বাস করো…

–বাবার সমস্ত সম্পত্তি সে আত্মসাৎ করতে চায়—এই সহজ কথাটাই সে বলতে পারতো কিন্তু ব্যাঙ্কের নাম করে সে ঠকাতে চায় কেন? কেমন করে সে খবর পেলে যে আমরা আমাদের সমস্ত সম্পত্তি সমাজে দিয়ে দিচ্ছি।

ভূতনাথ অপরাধীর মতো বললে সেটা আমিই বলেছিলুম।

–শুধু বলেননি, তাকে আবার পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে, সে তো আপনার নাম করেই কথাটা পাড়লেনইলে ননীলালের এত সাহস হবে না যে আমার সামনে সে মুখ দেখায়। সমাজের কোনো মেয়ের সম্ভম সে রাখতে পারেনি, কারো বিশ্বাস সে অর্জন করতে পারেনি, হতে পারে বড়লোক হয়েছে সে, বড় বড় জায়গায় তার খাতির হয়, কিন্তু আপনি তো জানেন আমরা সে-দলের নই। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা সব আলাদা, আমরা টাকা দিয়ে ঐশ্বর্য দিয়ে মানুষের বিচার করি না। মনুষ্যত্ব যার নেই, তাকে বাবা প্রশ্রয় দেন না, আমরা যে-সমাজের লোক সে-সমাজে সকলের চেয়ে বড় মনুষ্যত্ব-বাবার কাছে এই শিক্ষাই আমি পেয়েছি এতদিন।

ভূতনাথ তালাচাবি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললে— হয় তো আমি দোষীই জবা, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তাকে এখানে পাঠাঁইনি।

জবা বললে—তা হলে সে এল কোন্ সাহসে?

ভূতনাথ বললে—সে আমি জানি না, আর ননীলালকে যদি তুমি ভালো করে চিনেই থাকো তো বুঝতে পারে যে আমার পাঠানোর ধার সে ধারে না। —কিন্তু আপনি তার বন্ধু! ভাবতেই যে ঘেন্না হচ্ছে।

—বিশ্বাস করো জবা…

হঠাৎ দূর থেকে সুবিনয়বাবুর গলা শোনা গেল—জবা-মা

—আসি বাবা বলে জবা চলে গেল।

ভূতনাথের শরীরের সমস্ত শক্তি এক নিমেষে যেন অন্তর্ধান করেছে। তালা নিয়ে খোলা দরজাটার সামনে যেন পাথরের মতন দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর অনেকক্ষণ পরে চাবির হিসেব করে যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো তখন বেশ অন্ধকার হয়েছে। সুবিনয়বাবুকে মুখ দেখাতেও লজ্জা হলো তার। ননীলাল কেন অমন করলো। সে তো সঙ্গে করেই নিয়ে যাবে বলেছিল!

সুবিনয়বাবু সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামছিলেন। তাঁর হাত ধরে জবাও নামছিল। পেছনে পেছনে সুপবিত্র। সমাজের কয়েকজন ভদ্রলোকও এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট লোকও ছিলেন। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। ভূতনাথ গিয়ে ধরলো সুবিনয়বাবুকে। ধরে আস্তে আস্তে নামিয়ে আনলে।

গাড়িতে প্রচুর জিনিষপত্র বোঝাই হয়েছে। ছাদের ওপর আর জায়গা নেই। কয়েকটা দামী জিনিষ গাড়ির ভেতরে। পেছনেও বাঁধা রয়েছে কিছু মাল।

ধীরে ধীরে সুবিনয়বাবুকে গাড়িতে তুলে দিলে ভূতনাথ। বললে—একটু সাবধানে উঠবেন, মাথাটা বাঁচিয়ে।

তারপর জবা উঠলো। উঠে সামনের বেঞ্চিতে বসলো।

সুবিনয়বাবু উপস্থিত ভদ্রলোকদের সঙ্গে দু একটা কথা বলে সুপবিত্রকে ডাকলেন—উঠে এসো, আর দেরি নয়, রাত হচ্ছে।

ভূতনাথও সুপবিত্রকে বললে—উঠুন আপনি।

নিঃশব্দে সুপবিত্রও গিয়ে উঠলো গাড়িতে।

আর জায়গা নেই কোথাও।

সুবিনয়বাবু বললেন—ভূতনাথবাবু তুমিও উঠে এসো—

ভূতনাথ বললে—আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমি যা হোক করবে খন।

সুবিনয়বাবু যেন একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন—তাহলে মা, ভূতনাথবাবু কোথায় বসবেন?

ভূতনাথ তাড়তাড়ি বললে—আমি হেঁটেই যাবো খন।

–-ছাদে জায়গা নেই? নয় তো পেছনে?

–আমি হেঁটেই যাবো পেছন পেছন আপনি ভাববেন না। জবাও এতক্ষণে বললেহ্যাঁ, উনি হেঁটেই যেতে পারবেন। ওঁর হাঁটা অভ্যেস আছে খুব।

ভূতনাথ বলে উঠলো, আমার হাটা অভ্যেস আছে, গাভোয়ান গাড়ি ছেড়ে দাও।

আর কেউ কিছু উচ্চবাচ্য করলো না। গাড়োয়ান ছেড়ে দিলে গাড়ি। একটা ঢি ঢি শব্দ করলে মুখ দিয়ে। ঘোড় দুটো প্রথমে একটু নড়ে উঠলো। তারপর কলকাতার খোয়ার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির চাকার কর্কশ শব্দ কানে আসতে লাগলো শুধু। সুবিনয়বাবুর ইতিহাস চলতে লাগলো কর্কশ বন্ধুর পথ ধরে। সে ইতিহাস বড়বাড়ির মতো নিশ্চল স্থাণুর ইতিহাস নয়। অনেক পথ, অনেক ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তাকে পৌঁছতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দর ধারা ধরে ধরে এসে পৌঁছুবে নতুন সভ্যতার সিংহদ্বারে।

ভূতনাথও হাঁফাতে হাঁফাতে চলতে লাগলো। গাড়ির পেছনে দুটো লাল আলোর বিন্দু দেখা যায়। সেই অন্ধকারে লাল দুটো বিন্দুকে নিশানা করে চলা। কোথায় বাগবাজার, কোথায় বারশিমলে! তা হোক, সে তো পাড়াগাঁয়ের ছেলে! সে ভাত খায় বেশি, তার হাঁটা অভ্যেস আছে। অভ্যেস নেই সুপবিত্রর। সে বড় ভুলো মানুষ। ‘ভাত খাবার কথা মনে থাকে না তার। এখনও তার মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কেমন করে যে সে সংসার করবে কে জানে! বেশি পরিশ্রম করলে সে বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মুখের চেহারা খারাপ হয়ে যায়। সে-ই বরং গাড়িতে যাক।

হাঁটতে হাঁটতে এক-একবার রাস্তার খেয়ায় হোঁচট লাগে ভূতনাথের। তা হোক। সুপবিত্র তো গাড়িতে চড়েছে। সুপবিত্র অত হাঁটতে পারবে কেন। সুপবিত্রকে অত হাঁটালে হয় তো তার মা রাগ করবে। রাগ করবে জবার ওপর।

সন্ধ্যে অনেকক্ষণ উৎরে গিয়েছে। কয়েকটা খোলার বাড়ি ট্রাম রাস্তার ধারে। রাস্তায় গ্যাসের আলো হয়েছে। বাড়ির ভেতরে সব টিম টিম করে তেলের আলো জ্বলছে। একটা মোড় ঘুরতেই গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *