২৮. প্লুটো কেন গ্রহ নয়

২৮. প্লুটো কেন গ্রহ নয়

অন্য যে কোনো গ্রহ থেকে প্লুটোর জীবন কাহিনী বেশি চমকপ্রদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরেনাস এবং নেপুচন গ্রহের গতিপথে খানিকটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে জ্যোতির্বিদরা ধারণা করলেন সৌরজগতের আরো বাইরের কোনো গ্রহের আকর্ষণে এই ব্যাপারটা ঘটছে। তারা সবাই মিলে এই গ্রহটার নাম দিলেন প্ল্যানেট এক্স বা এক্স গ্রহ এবং সেটাকে খুঁজতে শুরু করলেন। 1915 সালে একবার এবং 1919 সালে আরেকবার প্লুটোর ছবি তোলা হয়েছিল কিন্তু কেউ সেটাকে গুরুত্ব দেয় নি কারণ সেটা ছিল খুবই ছোট আর অনুজ্জ্বল। ইউরেনাস আর নেপচুনের গতিপথ পাল্টাতে পারে এরকম একটা গ্রহ হিসেবে মনে মনে সবাই আরো বড় কিছু খোঁজ করছিল।

কিছু খুঁজে না পেয়ে জ্যোতির্বিদরা মাঝখানে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। যিনি প্রথমে সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পারসিভেল লোভেল মারা গেলেন 1916 সালে। ধীরে ধীরে কেমন জানি উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করল।

1929 সালে আরিজনার লোভেল অবজারভেটরিতে আবার নূতন করে রহস্যময় প্ল্যানেট এক্স খোঁজা শুরু হলো। 16 ইঞ্চি। একটা টেলিস্কোপ আর ক্যামেরা নিয়ে আকাশের ছবি তোলা শুরু করা হলো, দায়িত্ব দেয়া হলো একজন কমবয়সী শখের জ্যোতির্বিদ ক্লাইড টমবোকে।

ক্লাইড টমবো-এর জীবনটা প্লুটোর জীবনীর মতোই চমকপ্রদ। খুব ছেলেবেলা থেকেই তার শখ গ্রহ-নক্ষত্রে। চাচার একটা ছোট টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একটু বড় হয়ে নিজেই আট ইঞ্চি রিফ্লেক্টর দিয়ে একটা টেলিস্কোপ বানিয়ে ফেললেন, প্রথম টেলিস্কোপটা খুব সূক্ষ্ম না হলেও ক্লাইড টমবো-এর টেলিস্কোপ তৈরি করার শখ সেটা দিয়েই শুরু। তার সারা জীবনে তিনি প্রায় চল্লিশটা টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন।

1928 সালে স্লাইড টমবো 9 ইঞ্চি রিফ্লেক্টর দিয়ে খুব চমৎকার টেলিস্কোপ তৈরি করেন। সেই বছরেই তার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এস্ট্রোনমি পড়ার কথা। তিনি উৎসাহে টগবগ করছেন ঠিক তখন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে তাদের পরিবারের সকল ফসল ধ্বংস হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর আর্থিক দুরবস্থা। ক্লাইড টমবো-এর তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই। হতাশা বুকে চেপে রেখে তিনি পরিবারের চাষ আবাদের কাজে মন দিলেন, মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে তিনি রাতের বেলা তার টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহ দেখে দেখে তিনি খুর সূক্ষ্মভাবে তাদের ছবি এঁকে একদিন সেটা লোভেল অবজারভেটরিতে পাঠিয়ে দিলেন। সেই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে অবজারভেটরি তখন তাকে একটা চাকরি দিল, তাদের হাতে টাকা-পয়সা ছিল কম, সত্যিকার জ্যোতির্বিদকে বেতন দিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই তবে এই শখের কমবয়সী জ্যোতির্বিদকে কম বেতনে রাখা যায়।

ক্লাইড টমবো মহাউৎসাহে কাজে লেগে গেলেন। কাজটি খুব আনন্দময় নয়, আকাশের যে অংশে “এক্স গ্রহ”টি পাবার কথা সেই অংশের বিন্দু বিন্দু এলাকায় ছবি তুলে গ্রহটিকে খোঁজা। 1930 সালের 18 ফেব্রুয়ারি ক্লাইড টমবোর পরিশ্রমের ফল বের হয়ে এলো, তিনি ক্যামেরার প্লেটে একটা ছোট বিন্দু খুঁজে পেলেন যেটা সরে যাচ্ছে–একটা নূতন গ্রহ। এক মাস পর খুঁজে পাওয়া এই নূতন গ্রহটির কথা ঘোষণা করা হলো, তার নাম দেয়া হলো প্লুটো। প্লুটো হচ্ছে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীর মৃতদের দেবতা এবং অন্ধকার জগতের শাসনকর্তা। প্লুটো সূর্য থেকে এত দূরে যে তার কাছে আলো প্রায় পৌঁছায়ই না তাই এই নামকরণটাকে সবাই সঠিক বলেই মেনে নিল।

নূতন একটা গ্রহ খুঁজে পাবার পর তরুণ শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি নেই, একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পড়াশোনার জন্যে একটা স্কলারশিপ দেয়ার আগ্রহ দেখাল। ক্লাইড টমবো তখন (1932 সালে) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্যে ভর্তি হলেন। 1939 সালে তিনি ব্যাচেলর আর মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে বের হয়ে এলেন। বাকি জীবনেও জ্যোতির্বিদ্যার জন্যে তার ভালোবাসাটুকু অক্ষুণ্ণ ছিল, তিনি সারাজীবনই জ্যোতির্বিদ্যার জন্যে কাজ করেছেন।

1930 সালে শেষ পর্যন্ত গ্রহটিকে খুঁজে পাবার পর সকল রহস্যের সমাধান হবার পরিবর্তে নূতন করে সমস্যার জন্ম হতে শুরু করল। তার প্রধান কারণ নূতন খুঁজে পাওয়া প্লুটো নামের গ্রহটি খুব ছোট। এর ব্যাস মাত্র 1375 মাইল, পৃথিবীর 5 ভাগের এক ভাগ। প্লুটোকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা যে এর কক্ষপথ মোটেও গোলাকার নয়, সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে যখন থাকে তখন তার দূরত্ব 4.5 বিলিয়ন মাইল, যখন কাছে আসে তখন তার দূরত্ব 2.7 বিলিয়ন মাইল। শুধু তাই নয়, এটা যখন সূর্যের কাছে আসে তখন সব নিয়ম ভঙ্গ করে নেপচুন গ্রহের কক্ষপথ ভেদ করে ভেতরে চলে আসে! সৌরজগতের অন্য সব গ্রহ মোটামুটি একই সমতলে, শুধু দুটোর কক্ষপথ এই সমতলের সাথে 17° কোণে রয়েছে যেটা খুব বিচিত্র। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মাঝে একটা মিল রয়েছে, প্রথম প্রথম চারটা গ্রহ পাথুরে, পরের গ্রহগুলো বায়বীয়, সেই হিসেবে প্লুটোরও বায়বীয় হবার কথা। কিন্তু প্লুটো বায়বীয় নয়, সূর্যকে ঘিরে ঘুরে আসতে পৃথিবীর হিসেবে প্লুটোর 248 বছর লেগে যায়। সেই হিসেবে প্লুটোর একদিন হয় পৃথিবীর 6 দিন 9 ঘণ্টায়। সূর্য থেকে এত দূরে বলে প্লুটো খুব শীতল, তাপমাত্রা শূন্যের নিচে 212 থেকে 228 ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সৌরজগতের একেবারে শেষ মাথায় থাকার কারণে প্লুটো সম্পর্কে জানা তথ্য খুব কম। জ্যোতির্বিদরা ভালো করে এটাকে পর্যবেক্ষণও করতে পারেন নি। তাই এটা খুঁজে পাবার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর তারা যখন আবিষ্কার করলেন এই প্লুটো গ্রহটির আবার একটি চাঁদও আছে তারা খুব অবাক হলেন। তার প্রধান কারণ চাঁদটার ব্যাস প্লটোর ব্যাসের অর্ধেক এবং সেটা প্লুটো থেকে মাত্র 12 হাজার মাইল দূরে। সৌরজগতে আর কোনো গ্রহ নেই যার চাঁদ গ্রহটির ব্যাসের অর্ধেক। প্লুটোর এই বিচিত্র চাঁদটির নাম দেওয়া হলো কেরেন।

জ্যোতির্বিদরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আরো কিছু বিষয় আবিষ্কার করলেন, তার মাঝে একটা হচ্ছে সৌরজগতের শেষ মাথায় প্লুটোকে ছাড়িয়েও আরো দূরে একটা বস্তু পাওয়া গেছে যার আকার প্লুটো থেকেও বড়। তার নাম দেয়া হয়েছে 2003 UB313 এবং সহজ করে জেনা’ ডাকা যায়। যদি প্লুটো গ্রহ হয়ে থাকে তাহলে প্লুটো থেকেও বড় একটা কিছু কেন গ্রহ হবে না?

জ্যোতির্বিদদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশান এই বছর আগে একটা জরুরি সভায় প্লুটোর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে বসলেন। সেই আলোচনায় তারা নূতন করে গ্রহ বলতে কী বোঝায় তার সংজ্ঞা তৈরি করলেন। সংজ্ঞাটি এরকম–সৌরজগতে শুধু সেই সব বস্তুকেই গ্রহ বলা হয় যেগুলো আলাদা আলাদাভাবে সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, যার আকার যথেষ্ট বড় যেন নিজেদের মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে গোলাকৃতি ধারণ করে এবং তার কক্ষপথে ঘোরার সময় তার আশেপাশের এলাকায় নিজের একটা প্রভাব ফেলতে পারে।

নূতন এই সংজ্ঞার কারণে প্লুটো বেচারা গ্রহের সম্মান থেকে বঞ্চিত হলো। এটি সূর্যকে ঘিরে ঘুরে, তার আকৃতি গোলাকার কিন্তু এটি তার কক্ষপথে নিজের প্রভাব ফেলতে পারে নি। অন্যসব গ্রহ সূর্যকে ঘিরে ঘোরার সময় তার কক্ষপথের কাছাকাছি যত জঞ্জাল রয়েছে তার সবকিছু পরিষ্কার করে ফেলেছে। গ্রহাণু যা অন্য বা কিছু আছে মূল গ্রহটির তুলনায় সেটি খুব নগণ্য, প্লুটো একমাত্র ব্যতিক্রম। এই গ্রহটির কক্ষপথে অসংখ্য ছোট-বড় জঞ্জাল। যে বস্তু নিজের কক্ষপথকে পরিষ্কার করতে পারে না তাকে গ্রহ বলতে সবার আপত্তি! তাকে এখন বলা হচ্ছে “বামন গ্রহ”–এরকম বামন গ্রহ সৌরজগতে রয়েছে 44টি!

তবে জ্যোতির্বিদরা সবাই যে একমত হয়েছেন তা নয়, তারা এখনো নিজেদের মতো করে তর্ক-বিতর্ক করে যাচ্ছেন। অনেকেই এত সহজে প্লুটোকে গ্রহের অবস্থান থেকে সরাতে রাজি নন। প্লুটো এতদিন গ্রহের সম্মান পেয়ে এসেছে হঠাৎ করে তাকে সরিয়ে দেওয়া খুব সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা থেকে একটা মহাকাশযান পাঠানো হয়েছিল যেটা 1915 সালে প্লুটো এবং তার চাঁদ কেরেনের কাছে পৌঁছাবে। আবার সবাই তখন দুটো নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে, হোক না সে বামন গ্রহ তবুও তার সম্মান অন্য সব বামন গ্রহ থেকে যে আলাদা সে বিষয়ে এখনো সন্দেহ নেই!

ইতোমধ্যে টেক্সট বই বা প্ল্যানেটরিয়াম-এ গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটো গ্রহকে সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। যে গ্রহটি ঐতিহাসিকভাবে এতদিন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে রেখেছিল হঠাৎ করে সেটাকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বামন গ্রহ হিসেবে আরো 40টি থেকে বেশি বামন গ্রহের তালিকায় ফেলে দিতে সবারই যে একটু মন খারাপ হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু করার নেই, বিজ্ঞানের জগতে মনের অনুভূতিটুকু সরিয়ে যুক্তি-তর্ক আর বিশ্লেষণকে নিয়েই অগ্রসর হতে হয়।

কাজেই বিদায় প্রটো, আমরা তোমার অভাবটুকু অনুভব করব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *