1 of 2

২৮. নীলগঞ্জ থানার ওসি ছদারুল আমিন

১৪ এপ্রিল, বুধবার।

নীলগঞ্জ থানার ওসি ছদারুল আমিন তার বাসার সামনে মোড়ায় বসে। আছেন। তিনি অসম্ভব ক্ষুধার্তা। ক্ষুধার কথা বলতে পারছেন না, কারণ তাঁর স্ত্রী প্রসবব্যথায় সকাল থেকে ছটফট করছে। অবস্থা মোটেই ভালো না। প্রথম পোয়াতি, সমস্যা হবে জানা কথা। এই পর্যায়ের হবে ছদরুল আমিন বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারলে স্ত্রীকে অবশ্যই তার বাপের বাড়িতে রেখে আসতেন। ডাক্তার কবিরাজ নিয়ে ছোটাছুটি যা করার তারাই করত। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাম পেতেন–

A boy
Congratulations.

তিনি মিষ্টি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হতেন। তা না করে বেকুবের মতো স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। এখন ম্যাও সামলাতে পারছেন না। নান্দিনায় একজন এমবিসিএস ডাক্তার আছেন। তাকে আনতে গতকাল একজন কনষ্টেবল পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তার আসে নি, কনষ্টেবিলও আসে নি। ছদরুল আমিনের ধারণা, কনষ্টেবল নান্দিনা না গিয়ে বাড়ি চলে গেছে। হুকুম বলে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যে যার মতো কাজ করছে। থানায় দশজন কনষ্টেবল, একজন সেকেন্ড অফিসার এবং একজন জমাদার থাকার কথা। আছে মাত্র চার জন। তারা কোনো ডিউটি করছে না। দিনরাত ঘুমুচ্ছে। আরামের ঘুম। থানার ওসিকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করবে–তাও কেউ করছে না। বিছানায় পাশ ফিরে হাই তুলছে।

থানা হাজতে তিনটা ডাকাত আছে। পনেরো দিন ধরে। হারুন মাঝি আর তার দুই সঙ্গী। এদের নিয়ে কী করা যায় তাও বুঝতে পারছেন না। হারুন মাঝি ভয়াবহ ডাকাত। দিনকাল ঠিক থাকলে হারুন মাঝিকে ধরার জন্যে পাকিস্তান পুলিশ মেডেল পেয়ে যেতেন। এখন যা পাচ্ছেন তার নাম যন্ত্রণা। এদের সদরে পাঠাতে পারছেন না। নিজের বাড়ি থেকে রান্না করে খাওয়াতে হচ্ছে। সবচে ভালো হতো, যদি হারুন মাঝিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি তার স্ত্রী নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতেন। দেশ ঠিকঠাক হলে আবার ফিরে আসা। দেশটা এখন কোন অবস্থায় আছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। না পাকিস্তান, না বাংলাদেশ।

এইভাবে তো মানুষ বাঁচতে পারে না। সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থায় বাঁচে বনের পশুপাখি। তাদের থানা নেই, কোট-কাঁচারি নেই। মানুষের আছে।

ওসি সাহেবের বাসা থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে। থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে বাইরের মহিলারা আসেন না। থানাকে ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ছদরুল আমিন সাহেবের ভাগ্য ভালো, দুজন মহিলা এখন তার স্ত্রীর দেখাশোনা করছেন। একজন হলেন হাজী সাহেবের স্ত্রী। অন্যজন ধাই— সতী। সতী এই অঞ্চলের এক্সপার্ট ধাই। তার উপর ভরসা করা যায়। হাজী সাহেবের স্ত্রী বয়স্ক মহিলা। এদের উপরও ভরসা করা যায়। বয়স্ক মহিলারা অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারেন।

ছদরুল আমিন তেমন ভরসা করতে পারছেন না। সকাল থেকে তার মনে কু ডাক ডাকছে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। সেই ভয়ঙ্করটা কি স্ত্রীর মৃত্যু? এ চিন্তা মাথায় এলেই শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের ক্ষুধাবোধ তীব্ৰ হয়। ছদরুল আমিন ক্ষিধের কষ্টেই এখন বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। ঘরে চিড়-মুড়ি আছে। গুড় আছে। কাউকে বললে এনে দেয়, কিন্তু কাউকে বলতে লজ্জা লাগছে। স্ত্রীর এখন-তখন অবস্থা আর তিনি ধামা ভর্তি গুড়মুড়ি নিয়ে বসেছেন, তা হয় না।

স্ত্রীর পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছা করছে। বেচারি নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। এরকম অবস্থায় মা-খালারা পাশে থাকেন। তার কেউ নেই। স্বামী হাত ধরে পাশে বসে থাকলে অনেকটা ভরসা পেত। তাও সম্ভব না। এই অঞ্চলের নিয়মকানুন কড়া–আতুরঘরে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। নবজাত শিশু নিয়ে মা আতুরঘর থেকে অন্য ঘরে যখন যাবেন, তখন শুধু পুরুষরা যেতে পারবে। তার আগে না। তাঁর একবার মনে হচ্ছে, নিয়মের গুষ্ঠি কিলাই। বসি কমলার পাশে। গতকাল রাতে বড় লজ্জা পেয়েছেন। পোলাও কোরমা দেখে অবাক হয়ে বলেছেন, ঘটনা। কী? কমলা কিছু বলে নি। শুধু হেসেছে। ইরতাজউদ্দিন দাওয়াত খেতে আসার পর জানতে পারলেন, আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। এই তারিখ ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হয়েছে।

ছদরুল আমিন সিগারেট ধরালেন। খালি পেটে সিগারেট ধরানোর জন্যে সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। মনে হলো বমি হয়ে যাবে। হাজী সাহেবের স্ত্রী বের হলেন। এই মহিলাও হাজী। স্বামীর সঙ্গে হজ করে এসেছেন। তার প্রমাণ হিসেবে সব সময় আলখাল্লার মতো একটা বোরকা পরেন। বোরকা পরলেও ভদ্রমহিলা আধুনিক। পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন। নীলগঞ্জের অন্য মেয়েদের মতো পুরুষ দেখলেই পালিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন না কিংবা শক্ত খাম্বার মতো হয়ে পড়েন না।

ভদ্রমহিলা ছদরুল আমিনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন, গতিক ভালো না। আল্লাহর নাম নেন। কলসহাটির মৌলানা সাবের কাছ লোক পাঠান উতার-এর জন্যে। উতার দিয়া নাভি ধুইতে হবে।

উতারটা কী?

পানি পড়া। কলসহাটির মৌলানা সাবের উতার হইল শেষ চিকিৎসা। তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠাইয়া দেন।

জি আচ্ছা।

ছদরুল আমিন থানার দিকে রওনা হলেন। টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ মেঘলা। সবকিছুই কেমন আধাখেচড়া। বৃষ্টি হলে ঝমঝমিয়ে হবে, আকাশ হবে ঘন কালো।

হাজতঘরের দরজায় ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। ছদারুল আমিনকে দেখে হারুন মাঝি তার ধবধবে সাদা দাঁত বের করে বলল, ওসি সাব, ভুখ লাগছে। খানা দিবেন না? কাইল খাইলাম পোলাও কোরমা। আইজ খালি পানি।

চুপ থাক।

ভুখ লাগছে তো। ফাঁস দিলে ফাঁস দিবেন। না খাওয়াইয়া মারবেন–এইটা কেমন বিচার?

হারামজাদা চুপ।

হারুন মাঝি হেসে ফেলল। তার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। সুন্দর মায়া কাড়া চেহারা। এই লোক ঠাণ্ডা মাথায় দশ-বারোটা খুন করেছে ভাবাই যায় না। ছদরুল আমিন বললেন, ঘরে অসুবিধা আছে। পাক হয় নাই।

না খাইয়া থাকমু? চিড়া-মুড়ির ব্যবস্থা করেন।

চিড়া-মুড়ির ব্যবস্থা অবশ্যি করা যায়। সেটাই ভালো হয়। তিনি খানিকটা খেয়ে নেবেন। উতারের জন্যেও কাউকে পাঠাতে হবে। তিনি আশপাশে কোনো কনষ্টেবল দেখলেন না। কী দিন ছিল আর কী দিন হয়েছে। আগে চব্বিশ ঘণ্টা সেন্ট্রি ডিউটি থাকত। ঘন্টায় ঘণ্টায়। ঘণ্টি পিটে সময় জানানো হতো। গ্রামের মানুষ থানা-ঘন্টি শুনে সময় বুঝত। আজ কিছুই নেই। ছদরুল আমিন থানার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন–আর তখনি চোখে পড়ল দুটা জিপ আর তিনটা ট্রাক আসছে। আস্তে আস্তে আসছে। রাস্তা ভালো না–দ্রুত আসার উপায়ও নেই। তার বুক ধ্বক করে উঠল— মিলিটারি। আসছে! ইয়া গফরুর রহিম-মিলিটারি।

 

মিলিটারি কনভয় নিয়ে যাচ্ছিলেন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর মোশতাক। তার গন্তব্য ভৈরব। হঠাৎ তাকে বলা হলো ভৈরব না গিয়ে নীলগঞ্জ থানায় হল্ট করতে। কারণ কিছুই ব্যাখ্যা করা হলো না। ওয়ারলেসের সংক্ষিপ্ত ম্যাসেজ। পথে কোনো ঝামেলা হয়তো আছে। ছোটখাটো ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। গুরুত্বহীন ঝামেলা। অতি উৎসাহী কিছু ছেলে।পুলে মিলিটারি কনভয় দেখে থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি ছুঁড়ে বসল। হাস্যকর কাণ্ড তো বটেই। হাস্যকর কাণ্ডগুলোর ফলাফল মাঝে মাঝে অশুভ হয়। তবে এখনো তার ইউনিটে কিছু হয় নি। বাঙালি সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে এমন খবর নেই। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্ৰও নেই। অন্ত্রের সমস্যা তারা অবশ্যি মিটিয়ে ফেলতে পারবে। গায়ের সঙ্গে গা লেগে আছে হিন্দুস্থান। পাকিস্তানকে একটা শিক্ষা দেবার জন্যে ১৯৪৭ সাল থেকেই তারা খাপ ধরে বসে আছে। এই তাদের সুযোগ। মুর্থ বাঙালি বোঝে না হিন্দুস্থান আসলে কী চায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান গিলে খেতে চায়। তবে সেই সুযোগ তারা পাবে না। উচিত শিক্ষা তাদের দেয়া হবে। সেই সঙ্গে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে বদমাশ বাঙালিদের।

প্রবল ঝাকুনি খেয়ে মেজর মোশতাকের জিপ থেমে গেল। তিনি জানালা দিয়ে বিরক্তমুখে গাড়ির চাকা দেখার চেষ্টা করলেন। বোঝাই যাচ্ছে চাকা পাংচার হয়েছে। মিনিট দশেক সময় নষ্ট হবে। চলন্ত কনভয়ের কাছে মিনিট দশোক সময় অনেক সময়। এই সময়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। দেশে গেরিলা একটিভিটিজ নেই। যদি থাকত তিনি তার বাহিনীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সতর্ক অবস্থায় নিয়ে যেতেন। এখন তেমন সাবধানতা গ্রহণের সময় আসে নি। দরিদ্র একটা অঞ্চলের কাঁচা রাস্তা। দুপাশে ধানক্ষেত। ভয়ের কিছুই নেই। মেজর সাহেব জিপ থেকে নেমে গাড়ির চাকার বদল দেখতে লাগলেন। গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। নীলগঞ্জ থানায় রাত কাটাতে হলে একটা শাওয়ার নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

গত তিনদিন ধরে তিনি খাকি পোশাক গায়ে নিয়ে ঘুরছেন। শরীর ঘামছে। সেই ঘাম শরীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। কুৎসিত অবস্থা। গত সপ্তাহের নিউজ উইক সঙ্গে আছে–এখনো পড়া হয় নি। রাতে পড়া যেতে পারে। গাড়ির চাকা বদলাতে অনেক সময় লাগল। সব কী রকম ঢিলাঢ়ালা হয়ে গেছে। যুদ্ধ অবস্থায় কোচকালেন। মনের বিরক্তি প্ৰকাশ করলেন না।

 

নীলগঞ্জ থানার ওসি মেজর সাহেবকে স্যালুট দিলেন। তার পেছনে তিনজন কনষ্টেবল। তারা প্রেজেন্ট আর্ম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

মেজর সাহেব বললেন, সব ঠিক হ্যায়?

ছদরুল আমিন বললেন, ইয়েস স্যার।

ভেরি গুড। হোয়াটস ইয়োর নেম?

ছদরুল আমিন।

নাম তো বহুত আচ্ছ হ্যায়।

মেজর মোশতাক আবারো হাসলেন। ছদারুল আমিনের বুকের রক্ত এবং পেটের ক্ষুধা দুই-ই মিলিটারি দেখে পানি হয়ে গিয়েছিল। মেজর সাহেবের মুখের হাসি দেখেও লাভ হলো না। বুক ধ্বক ধ্বক করেই যাচ্ছে।

মেজর সাহেব হ্যান্ডশোকের জন্যে হাত বাড়ালেন; ছদারুল আমিন হ্যান্ডশেক করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ডরতা কেউ ডরো মাৎ।

এই ঘটনা ঘটল দুপুর তিনটায়। বিকেল পাঁচটায় ঘটল সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা। ছদরুল আমিনকে সোহাগী নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ছদরুল আমিন সাহেব একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচজন হিন্দু, দুজন আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র–এরা মুসলমান।

মৃত্যুর আগে আগে ছদরুল আমিন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেনউতার আনতে যাকে পাঠানো হয়েছে, সে কি এসেছে?

মৃত্যুর আগে মানুষ কত কী ভাবে–তার মাথায় শুধু ঘুরতে লাগল। উতার–এর পানি। উতার শব্দটা বারবার উচ্চারণ করতেও তাঁর খুব মজা লাগছিল।

 

নীলগঞ্জ থানা কম্পাউন্ড খুব জমজমাট। গেটে মিলিটারি সেন্ট্রি। থানার মূল বিল্ডিং-এর বারান্দায় দুটা পেট্রোম্যাক্স জুলছে। রাজ্যের পোকা এসে জড়ো হয়েছে। পোকাদের আনন্দের সীমা নেই।

থানার পেছনেই বঁধানো কুয়া। কুয়ার পাশে মেজর সাহেবের থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। আজ রাত মেজর সাহেবকে নীলগঞ্জে থাকতে হবে। মেজর মোশতাক আহমেদ তার তাবুর সামনে চেয়ারে বসে আছেন। টুলের উপর পা তুলে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি গা থেকে দুদিনের বাসি কাপড় এখনো খোলেন নি। তবে শিগগিরই খুলবেন। তাঁর গোসলের জন্য কুয়া থেকে বালতিভর্তি ঠাণ্ডা পানি তোলা হয়েছে। তিনি মানে যাওয়ার আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান যে, তার দলটির রাতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। জোয়ানদের রাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা তেমন জরুরি নয়, তবে খাওয়ার ব্যবস্থােটা জরুরি। পুরো দলটি বলতে গেলে সারাদিন না খাওয়া।

মোশতাক আহমেদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন— খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রামে বাজার-হাটের সুবিধা নেই। চট করে কিছু জোগাড় করা মুশকিল। এখানে সব জোগাড় হয়েছে। দুটা খাসি জবেহ হয়েছে। রান্নাও শুরু হয়েছে। রুটিগোশত করা যাচ্ছে না, চাল-গোশত হচ্ছে। বাঙালের দেশে এসে বাঙালি ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো খাবারই খারাপ লাগবে না।

মোশতাক আহমেদ চুরুট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। এখন আকাশ পরিষ্কার। তারায় তারায় ঝলমল করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। শহর থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল ভালোমতো দেখা যায় না। এই সাতটি তারা দিগন্তরেখার কাছাকাছি। এদের দেখতে হলে খোলা জায়গায় যেতে হবে। থানা কম্পাউন্ডটা খুব খোলামেলা। দুশ গজের ভেতর গাছপালার সংখ্যা কম। বর্তমান সময়ের জন্য এটা খুব জরুরি। প্রতিটি থানাকে থাকতে হবে থ্রি নট থ্রি রাইফেল রেঞ্জের বাইরে। গাছপালার কভারে কোনো অতি-উৎসাহী যেন গুলি করার স্পর্ধা না করে।

মগভর্তি এক মগ কফি মোশতাক আহমেদের পাশে এনে রাখা হলো। কফি নিয়ে এসেছেন নীলগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার ফরিদ উদ্দিন। থানার চার্জ বর্তমানে তাকে দেওয়া হয়েছে। ফরিদ উদ্দিন মেজর সাহেবের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চলে যেতে পারছেন না, আবার দাড়িয়ে থাকতেও পারছেন না। তার পা অল্প অল্প কাপছে। তিনি যেন তার সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন। মোশতাক আহমেদ কফির মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, Do you have something in your mind?

প্রশ্ন না বুঝেই ফরিদ উদ্দিন বললেন, Yes sir.

Speak out.

ফরিদ উদ্দিন আগে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। মেজর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। সেই ইশারাও তিনি বুঝতে পাবলেন না। ফরিদ উদিনের মাথা আসলে এলোমেলো হয়ে গেছে। এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে এতগুলি মানুষকে মেরে ফেলা যায়! নদীর পাড়ে নিয়ে লাইন করে দাঁড়া করাল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই একজন হাই তুলে বলল, ফায়ার। দ্রুত বাজনার মতো কিছু গুলি হয়ে গেল। গুলি করা হচ্ছে তাও ফরিদ উদ্দিন বুঝতে পারেন নি। পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে স্বপ্লের মধ্যে ঘটে গেছে। কে জানে, হয়তো স্বপ্লই। স্বপ্ন ছাড়া বাস্তবে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে না। বাস্তবে কেউ হাই তুলতে তুলতে ফায়ার বলে না। হাই তোলার ব্যাপারটা বানানো না। যে ফায়ার বলেছে তিনি তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তালগাছের মতো লম্বা একটা মানুষ। পাতলা গোফ আছে। নিচের ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ। ফরিদ উদ্দিন নিশ্চিত জানেন–বাকি জীবনে তিনি অসংখ্যবার দুঃস্বপ্নের ভেতর এই মানুষটাকে দেখবেন।

মেজর সাহেব। আবারো হাত ইশারা করে ফরিদ উদ্দিনকে যেতে বললেন। কফি খেতে ভালো হয়েছে। তিনি একা একা আরাম করে কফি খেতে চান। ক্ষুধা নষ্ট করার জন্যও কফি দরকার। রাতের খাবার খেতে দেরি হবে।

ফরিদ উদ্দিন থানায় ওসি সাহেবের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর খুব ঘাম হচ্ছে। থানার ভেতর মিলিটারিদের কেউ নেই। দুজন কনস্টেবল আছে–তারা ংশুমুখে বসে আছে লম্বা বেঞ্চটায়। ফরিদ উদ্দিনের সামনের চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে আছে হারুন মাঝি। মেজর সাহেব সব হাজতিদের ছেড়ে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন।

সব হুকুমই মুখে। কাগজপত্রে কিছু নেই। পরবর্তীতে এই নিয়ে নিশ্চয়ই ঝামেলা হবে। এক ফাঁকে জেনারেল ডায়েরিতে লিখতে হবে–মেজর মোশতাক আহমেদের মৌখিক নির্দেশে থানার সকল হাজতিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাজতিদের মধ্যে ছিল কুখ্যাত ডাকাত হারুন মাঝি।

নদীর পাড়ে যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়–তার কথাও লেখা থাকা দরকার। কীভাবে লিখবেন? ঘটনার সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। কোনো এক সময় যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়–পুলিশের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটল, পুলিশ কেন বাধা দিল না? স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো পুলিশের। তাকে যদি বলা হয়, ফরিদ উদ্দিন, দণ্ডবিধির ৩২৪ নম্বর ধারায় তুমি কেন মিলিটারিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে না? ৩২৪ নম্বর ধারা তো অতি স্পষ্ট, বিপজ্জনক অস্ত্র দ্বারা বা বিপজ্জনক উপায়ে ইচ্ছাকৃত আঘাত করা। ১৪৮ ধারায় মামলা হতে পারে–মারাত্মক অন্ত্রে সজ্জিত হইয়া দাঙ্গা।

ওসি সাহেব!

ফরিদ উদ্দিন চমকে উঠলেন। হারুন মাঝি হাত বাড়িয়ে বসে আছে। হারুন মাঝির মুখ হাসি হাসি। ফরিদ উদ্দিন বললেন, কী হয়েছে?

বিড়ি সিগারেট কিছু একটা দেন ওসি সাহেব, দুইটা টান দেই।

ফরিদ উদ্দিন কথা বাড়ালেন না। একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন। তার নিজেরও সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না।

অবস্থা তো ওসি সাহেব গুরুতর।

হুঁ।

এক কথায় আটজনের মৃত্যু–সাক্ষাৎ আজরাইল। কী বলেন ওসি সাহেব?

হুঁ!

এর নাম পাক-মিলিটারি, ইচ্ছা হইল গুলি কইরা হিসাব শেষ কইরা দিল। নগদ হিসাব। বাকির কারবার নাই।

বেশি কথা বলিস না হারুন। হারুন মাঝি গলা নামিয়ে বলল, মৃত্যুর সময় আমরার আগের ওসি সাহেব কী করল? কান্দাকাটি কবল?

জানি না।

জানেন না বললেন ক্যান? আপনে তো লগে ছিলেন।

না, আমি ছিলাম না।

কয়েকটা হিন্দু ধইরা আনতে বলল – আপনে না ধইরা আনলেন?

ফরিদ উদ্দিন তিক্ত গলায় বললেন, হারুন, সময় খুবই খারাপ। কথা যত কম বলবি তত ভালো। তোকে ছেড়ে দিয়েছে–তুই চলে যা। ডাকাতি শুরু কর। এত কিসের কথা?

মিলিটারি কি এইখানেই থাকব?

জানি না।

আগের ওসি সাহেবের যে সন্তান হওনের কথা ছিল সেই বিষয়ে কিছু জানেন? সন্তান হইছে?

জানি না।

উতারের পানির জন্য ওসি সাহেব লোক পাঠাইছিল। পানি নিয়া আসছে কিনা জানেন না?

হারুন, চুপ।

জি আইচ্ছা, এই চুপ করলাম। দেন, আরেকটা সিগ্রেট দেন।

ফরিদ উদ্দিন নিঃশব্দে আরেকটা সিগারেট দিলেন। হারুন মাঝি প্রথম সিগারেটের আগুন দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমরার আগের ওসি সাহেব, ছদরুল সাহেব বিরাট সাহসী লোক ছিল। বাঘের কইলজা ছিল।

ফরিদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। হঠাৎ করে তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। তিনি মাথা তুলতেই পারছেন না। এরকম কখনো হয় না। আজ কেন হচ্ছে?

ওসি সাহেব, ছদরুল স্যার আমারে ক্যামনে ধরছে হেই গল্প শুনেন। সে এক ইতিহাস।

ইতিহাস বলতে হবে না। চুপ করে থাক।

আমি গেছি আমার বড় শ্যালকের বাড়িত। তার একটা পুত্রসন্তান হয়েছেসংবাদ পেয়ে গিয়েছি। সন্তানের মুখ দেখে একশ টাকার একটা চকচকা নোট দিলাম। শ্যালক বলল, দুলাভাই রাতটা থাকেন–ভালোমন্দ চারটা খান। আমি রাজি হইলাম। শেষ রাইতে বাড়ি ঘেরাও দিল পুলিশে। ব্যাগের ভিতরে আমার গুলিভরা বন্দুক। টান দিয়া হাতে নিতেই দরজা খুইল্যা ওসি সাহেব ঢুকলেন। বললাম, ওসি সাব, গুলি কইরা দেব। ওসি সাহেব বললেন, কর, গুলি কর। বন্দুকের সামনে এই রকম কথা বলা সহজ না। কইলজা লাগে। বাঘের কইলজা লাগে। ওসি সাহেবের ছিল বাঘের কইলজা।

হারুন, আর কথা না। আরেকটা কথা বললে হাজতে নিয়ে ঢোকাব।

হারুন মাঝি দাত বের করে হাসতে হাসতে বলল, এইটা পারবেন না! মিলিটারি মুক্তি দিছে, আফনের কিছু করনের ক্ষ্যামতা নাই। ছদারুল আমিন স্যার হইলেও একটা কথা ছিল। তার ছিল বাঘের কইলজা। আর আফনের হইল খাটাসের কইলজা। হিহিহি। মনে কষ্ট নিয়েন না। ওসি সাব। সত্য কথা শুইন্যা মনে কষ্ট নিতে নাই।

 

রান্না হয়ে গেছে। জোয়ানদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। মেজর সাহেব কুয়ার পাড়ে গোসল করছেন। তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিচু একটা জলচৌকিতে বসে আছেন। দুজন ব্যাটম্যান হিমশীতল পানি বালতি বালতি তুলে তার মাথায় ঢালছে। স্নানপর্ব মেজর সাহেবের অসাধারণ লাগছে। শরীরের ক্লান্তি সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে। এখন নেশার মতো লাগছে। কয়েকটা বিয়ার খেয়ে নিলে হতোব্যাপারটা আরো জমত। সঙ্গে বিয়ার নেই। এক বোতল ভদকা আছে, ভালো এক বোতল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন আছে। ওয়াইনের বোতলটা আনন্দময় উৎসবের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই আনন্দময় উৎসবের তারিখটা হলো মে মাসের এগারো তারিখ, তার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। রোজিনা তাকে বলে দিয়েছে–সে যেভাবেই হোক মে মাসের এগার তারিখে বাঙািল মুলুকে উপস্থিত হবে। তের বছরের বিবাহিত জীবনে সব ম্যারেজ ডে-তে তারা একসঙ্গে ছিলেন। এ বছর ব্যতিক্রম হবে না। যুদ্ধবিগ্রহের এই ভয়াবহ সময়ে রোজিনা কী করে বাঙাল মুলুকে আসলে তিনি জানেন না। তবে এসে যেতে পারে। রোজিনার বুদ্ধি ও সাহস সীমাহীন। তারচে বড় কথা রোজিন লে. জে. গুলহাসান খানের ভাগ্নি। পাকিস্তানের লেফটেনেন্ট জেনারেলরা অনেক কিছু পারেন।

গোসল করতে করতেই ওয়্যারলেসে খবর এলো–কর্নেল মোশতাককে তার দল নিয়ে এই মুহুর্তেই দুর্গাপুরে রওনা হতে হবে। কর্নেল সাহেব খবরটা শুনে নিচু গলায় বললেন, বাস্টার্ডস! কাদেরকে বললেন তা বোঝা গেল না।

দলটাি দুৰ্গাপুরের দিকে রওয়ানা হলো রাত তিনটায়। সেই সময়ই ওসি ছদরুল আমিন সাহেবের স্ত্রী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। শিশুটির ফুসফুসে অসম্ভব জোর। সে ওঁয়া ওঁয়া চিৎকারে থানা কম্পিাউন্ড মাতিয়ে দিল। জিপে উঠতে উঠতে কর্নেল সাহেল সেই ওঁয়া ওঁয়া চিৎকার শুনলেন। চিৎকার শুনেই বোঝা যাচ্ছে নিউবর্ন বেবি। নিউবর্ন বেবির কান্নার শব্দ অত্যন্ত শুভ। কর্নেল সাহেবের যাত্রা শুভ হবে। তিনি আনন্দিত মুখে জিপে উঠে বসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *