বড়গাঙ থেকে এক-দেড়শ হাত দূরে নামশুদ্ৰ পাড়া। বাঁশের খুঁটির ওপর ছনের ছাউনি। শুকানো কলাপাতা এবং চটের বেড়া। কৈবৰ্তরা থাকে উত্তরে। এদের বাড়িঘরের অবস্থা আরো শোচনীয়। বাড়িঘর নৌকার ছাঁইয়ের মতো। এদের জীবিকা মূলত মাছধরা। শুকাতে দেয়া ছেড়া জাল দেখলেই এটা বোঝা যায়। কয়েক ঘর চামার এবং চুলি বাজারের কাছাকাছি থাকে। তাদের কারো ঘরেই চাল নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে এদের অভ্যাস আছে। খাদ্য সংগ্রহের প্রধান দায়িত্ব মেয়েরা পালন করে। জঙ্গল খুঁড়ে বন আলু নিয়ে আসে। কচুশাক সিদ্ধ খাদ্য হিসেবে অনেকদিন থেকেই চালু। কচুশাকের অভাব হয় নি। নামশূদ্ররা আগে শামুক-ঝিনুক খেত না। হাঁসের খাবার মানুষ কেন খাবে? ইদানীং খাচ্ছে। কৈবর্ত নরেশ পড়েছে বিপদে। তার মেয়ে লক্ষ্মী ভাত খাবে। সে না-কি স্বপ্নে দেখেছে, সোনার থালায় করে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখার পর থেকেই তার মুখে ভাত ছাড়া অন্য কথা নেই। লক্ষ্মীর বয়স আট। নরেশের ন্যাওর্টা। সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে আছে। বাবা যেখানে যাবে সে সঙ্গে যাবে। লক্ষ্মী গত পাঁচদিন ধরেই ভাত খেতে চাচ্ছে। তার না-কি শুধু একবার ভাত খেলেই হবে। আর ভাত চাইবে না। সোনার থালা লাগবে না। কলাপাতায় দিলেই হবে। নরেশ বলেছে, তোরে বুধবারে ভাত খাওয়ামু যা।
নরেশের স্ত্রী বলেছে, বুধবারে ভাত কই পাইবেন?
নরেশ বলেছে, সেটা আমার বিষয়।
আজ বুধবার। নরেশ মেয়েকে বলেছে, চল দেখি।
লক্ষ্মী বাবার হাত ধরে যাচ্ছে। তার চোখমুখ উজ্জ্বল। কতদিন সে ভাত খায় না। আজ ভাত খাবে ভাবতেই শরীর ঝিমঝিম করছে। মুখ লালায় ভর্তি হয়ে আসছে। লক্ষ্মী বলল, ভাত কী দিয়া খামু বাপজান? শিং, মাছ দিয়া?
নরেশ বলল, ভাত এমন জিনিস যে ভাতের উপরে লবণ ছিটা দিয়া খাইলেও অমৃত। একটা কাঁচামরিচ। যদি থাকে তাইলে তো কথাই নাই। এক নলা ভাত মুখে দিয়া কাঁচামরিচে কামুড়।
লক্ষ্মী বলল, দেশের ভাত কই গেছে বাপজান?
নরেশ বলল, যুদ্ধের কারণে দেশে ভাত নাই। যুদ্ধ শেষ হইলেই ভাত পাইবি। তখন কত ভাত খাইবি খা।
তখন আমি পুরা এক পাতিল ভাত খামু।
আচ্ছা যা খাবি।
যুদ্ধ শেষ হইব কবে? সময় ঘনায়া আসছে।
বাপজান, আমারে ঘাড়ে তোল।
নরেশ মেয়েকে ঘাড়ে উঠিয়ে নিল।
লক্ষ্মীর মুখে হাসি। বাবার কাঁধে চড়তে তার এত ভালো লাগে। ইস্ সে যদি সারাজীবন বাবার ঘাড়ে বসে থাকতে পারত!
নরেশ মেয়েকে এককড়ির দোকানঘরের সামনে ঘাড় থেকে নামাল। এককড়ির এই দোকানঘরটা নতুন। আগের দু’টা ঘর আগুনে পুড়ে যাবার পর এই ঘর বানানো হয়েছে। এককড়ি ক্যাশবাক্সের সামনে বসে ছিলেন। নরেশ দোকানে ঢুকাল না। ঢোকার নিয়ম নেই। যেহেতু কৈবৰ্তরা জল চল জাত না। তারা ঘরে ঢোকা মানে ঘরে রাখা সমস্ত পানি নষ্ট হওয়া।
কর্তা, একটা কথা ছিল।
এককড়ি বিরক্ত মুখে তাকালেন।
নরেশ হাতজোড় করে বলল, এক ছটাক চাউল দেন। মেয়েটা ভাত খাইতে চায়।
এককড়ি বললেন, দেশে কি চাউল আছে যে তোরে দিব? আমি নিজে একবেলা রুটি খাই। গলা দিয়া রুটি নামে না। তারপরেও খাই।
মেয়েটারে বলেছিলাম বুধবার ভাত খাইতে দিব। একটা সপ্তাহ মেয়েটা অপেক্ষা করেছে। কর্তা, আমার বড়ই আদরের সন্তান।
এককড়ি বললেন, পুলাপান অবুঝ হইলে তারারে বুঝ দিতে হয়। তারে বুঝায় বল যে দেশে চাউল নাই। আদর দিয়া নষ্ট করিস না। আদরে হয় বাঁদর।
নরেশ বলল, কর্তা, একটু ব্যবস্থা করেন।
আইজ তরে এক ছটাক চাউল দিলাম, কাইল আসব পঞ্চাশজন। তখন উপায়? আমি কি কুবীর? আমার কুবীরের ভাণ্ডার নাই। দোকানপাট গেছে আগুনে পুইড়া। মন্দির বানায়েছি। ট্যাকা গেছে জলের মতো।
নরেশ হাত কচলাতে কচলাতে বলল, দোকানের কাউরে গিন্নিমার কাছে পাঠান। উনারে বললেই ভাত আসব। মেয়েটা দোকানের সামনে বইসা খাইব। নুনের ছিটা দিয়া চারটা ভাত।
এককড়ি জবাব দিলেন না। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খেরো খাতার হিসাব দেখতে লাগলেন। এককড়ি নিশ্চিত নরেশ ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করে চলে যাবে। এদের পেছনে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না।
লক্ষ্মী ফিসফিস করে বলল, ভাত কি দিব বাপজান?
নরেশ জোরগলায় বলল, অবশ্যই দিব! কর্তার ম্যালা কাজ আমি করছি। সাহায্য কোনোদিন চাই নাই। আইজ প্রথম চাইলাম। চল ছায়াতে বসি, আইজ রইদও পড়ছে কড়া।,
পিতা-কন্যা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসা। এখান থেকে এককড়ির নতুন মন্দির দেখা যায়। মন্দিরের চূড়া উঁচু হয়ে উঠে গেছে। চূড়ায় পিতলের ত্রিশূল। রোদে ঝকমক করছে। নরেশ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। বাবার দেখাদেখি লক্ষ্মীও করল। সব দেবদেবীকে তুষ্ট রাখা দরকার। দেবদেবীদের যে-কোনো একজন বিরূপ হলে মহাবিপদ।
ভাত মনে হয় আসবে। নরেশ দেখল এককড়ি তার দোকানের এক কর্মচারীকে নিচুগলায় কী যেন বললেন। সে দোকান থেকে বের হয়ে এককড়ির বাড়ির দিকে যাচ্ছে। নরেশ হৃষ্টচিত্তে বিড়ি ধরাল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাত আসন্তাছে। ভাতের জন্যে লোক গেছে।
লক্ষ্মী বলল, কলাপাত কাঁইট্যা আনবা না?
নরেশ বলল, আগে ভাতটা আসুক। কলাপাতা কাটুতে কতক্ষণ?
যে কৰ্মচারী দোকান থেকে বের হয়েছিল সে ফিরল দেড় ঘণ্টা পর। তার হাতে ভাতের গামলা নেই। হিসাবের কিছু খাতপত্র।
নরেশ মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়ল। তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। ভয়ঙ্কর কিছু করতে ইচ্ছা করছে। ভয়ঙ্করটা কী বুঝতে পারছে না। সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, চল বাড়িত যাই। ভাতের চিন্তা বাদ।
লক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে বলল, আচ্ছা।
জগতে কাকতালীয় কিছু ব্যাপার সবসময় ঘটে। বিশ্বাসীরা এইসব ঘটনায় অলৌকিকত্ব আরোপ করতে পছন্দ করেন। একটা কাকতালীয় ঘটনা নরেশের জীবনে ঘটল। তার সঙ্গে দেখা হলো লাবুসের। লাবুস ছাতা মাথায় দিয়ে হন।হন করে আসছিল।
নরেশকে দেখে ছাতা বন্ধ করে বলল, মেয়েটাকে নিয়ে চল আমার ঘরে। ভাত খাবে।
নরেশ ভাবল সে ভুল শুনছে। ভাতের চিন্তায় অস্থির হয়েছে বলেই ভাতের কথা শুনছে। নরেশ বলল, কর্তা কী কইলেন?
লাবুস বলল, ভাত খেতে বলেছি। মুসলমানের ঘরে খেতে সমস্যা আছে?
নরেশ কিছু বলার আগেই লক্ষ্মী বলল, সমস্যা নাই।
লাবুস বলল, মা, বাপের ঘাড় থেকে নামো। আমার হাত ধর। গল্প করতে করতে যাই।
ঘটনা যতটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে ততটা না। এর মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব নেই। এককড়ির দোকানের সামনে এক নমশুদ্ৰ ভাত খাবে বলে বসে আছে, এই খবর লাবুসকে দিয়েছে হাদিস উদ্দিন। সে বাজারে এসেছিল মশুর ডাল কিনতে। তখনি ঘটনা দেখেছে।
লাবুস বলল, ভাত কি দিয়েছে?
হাদিস উদ্দিন বলল, জানি না। বাপ বেটিতে খুঁটি গাইড়া য্যামনে বসছে ভাত না দিয়া উপায় আছে? লাবুস সঙ্গে সঙ্গেই ছাতা নিয়ে বের হয়েছে।
পিতা এবং কন্যা দু’জনকেই খাবার দেয়া হয়েছে। অ্যালমুনিয়ামের গামলাভর্তি ভাত। ভাতের উপর গাওয়া ঘি। একপাশে ডিমের সালুন। আলাদা বাটিতে ডাল। ঘিয়ের গন্ধে জায়গাটা মা মা করছে। নরেশ খাচ্ছে না। হাত গুটিয়ে বসে। আছে। লাবুস বলল, নরেশ, তুমি খাবে না?
নরেশ বলল, না কর্তা।
খাবার তো আছে। খাবে না কেন?
লক্ষ্মীর মা পনেরোদিন ধইরা ভাত খায় না। তারে থুইয়া আমি খাব না।
লাবুস কিছু বলল না। লক্ষ্মী ডানহাতে ভাত খাচ্ছে, বামহাতে ডিমটা ধরে আছে। যেন কেউ হঠাৎ এসে ডিমটা নিয়ে যাবে। ডিম রক্ষা করা দরকার। নরেশ মেয়ের পিঠে হাত রেখে বলল, আস্তে আস্তে খাও গো মা।
সব আমি একলা খামু বাপজান?
পারলে খাইবা। পারবো?
হুঁ।
লাবুস বলল, নমশুদ্ৰপাড়ার সবারই কি তোমার মতো অবস্থা?
জে কর্তা। ভাতের কষ্ট বিরাট কষ্ট।
লক্ষ্মী খাওয়া শেষ করেছে। সে সামান্যই খেতে পেরেছে। ডিমটা খায় নি। এখনো হাতে ধরা। সে জেদ ধরেছে। গামলার সব ভাত বাড়িতে নিয়ে যাবে। নরেশ কঠিন গলায় বলেছে, না।
বিদায় নেবার সময় নরেশ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। লক্ষ্মী তার বাবার কাঁদার কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না। সে তার ছোট ছোট হাতে বাবাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে।
সন্ধ্যাবেলা লাবুস হাদিসকে ডেকে পাঠাল। হাদিস যথারীতি জ্বলন্ত কক্ষেতে ফুঁ দিতে দিতে হুক্কা এনে লাবুসের সামনে রাখল। সে নিশ্চিত কোনো এক বিশেষ দিনে ছোটকৰ্তা হুক্কায় টান দেবেন। কিছুই বলা যায় না। সেই বিশেষ দিনটা আজই হতে পারে।
হাদিস উদ্দিন! আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি ব্যবস্থা কর।
অবশ্যই ব্যবস্থা করব। সিদ্ধান্তটা কী?
বড়গাঙের পাড়ে আমি একটা লঙ্গরখানা দিব।
কী দিবেন?
লঙ্গরখানা। সেখানে যারা খেতে পায় না। তারা একবেলা ভরপেট খাবে।
ছোটকর্তা, পাগলের মতো এইসব কী বলতেছেন! কাঙালের গোষ্ঠী খাওয়ায়া আপনার লাভ কী?
হাদিস উদ্দিন, আমি তো ব্যবসায়ী না যে লাভ লোকসান দেখব।
মাগনার হোটেল চালু করবেন, দুনিয়ার কাঙালি ভিড় করব। কী জন্যে কাজটা করবেন?
লাবুস হাদিস উদ্দিনকে অবাক করে দিয়ে হুক্কার নল টেনে নিল। গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। আধুরী তামাকের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। লাবুস বলল, আমি যে হুক্কা খাচ্ছি। তুমি দেখে আনন্দ পাচ্ছ না?
হাদিস উদ্দিন মুগ্ধ গলায় বলল, ছোটকৰ্তা, খুবই আনন্দ পাইতেছি। এই দেখেন আমার চউক্ষে পানি।
লাবুস বলল, ক্ষুধার্ত মানুষরা যখন আরাম করে খিচুড়ি খাবে, সেই দৃশ্য দেখে আমিও আনন্দ পাব। আনন্দে আমার চোখে পানি আসবে। এরচে’ বড় কিছু আছে?
জে না। তামাক খায়া মজা পাইতেছেন?
পাচ্ছি।
আপনার জন্যে নেত্রকোনা থাইকা আরো ভালো তামাক আনায়ে দিব।
আচ্ছা।
একটা টান দিবেন। বান্ধবপুর জুইড়া বাস ছাড়ব।
ভালো তো।
লাবুস হুক্কা টানছে। গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। হাদিস উদ্দিনের এই দৃশ্যটা দেখে এত ভালো লাগছে। যেন তার দীর্ঘদিনের সাধনা সফল হয়েছে। তার চোখে আবারো পানি এসে গেছে।
ধনু শেখ দুপুরের খাওয়া শেষ করেছেন। এখন একটা চমচম খেয়ে দুপুরের খাবারের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন। পানদানিতে পান নিয়ে অপেক্ষা করছে। সদরুল। পান মুখে দিয়ে তিনি বাংলাঘরে পাটি পেতে শুয়ে থাকবেন। সদরুল নরম হাতে পিঠে ইলিবিলি করে তাকে ঘুম পাড়াবে। এই সময় পাংখাবরদার সারাক্ষণ টানা পাখায় তাকে বাতাস দিবে। এক মুহুর্তের জন্যেও থামতে পারবে না। থামা মানেই চাকরি শেষ। এর আগে দুইজনের এইভাবে চাকরি গেছে।
আতরের জন্যে ধনু শেখের মন মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। এই মন খারাপকে তিনি পাত্তা দেন না। মন ভালো করার নানান বুদ্ধি তার কাছে আছে। তাছাড়া তাঁর মেয়ে ভালো আছে এবং সুখে আছে, এই খবর তিনি পেয়েছেন। মেয়েকে তিনি একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মেয়ে তার উত্তরে এক লাইন লিখেছে— ‘আমি ভালো আছি।’ এই যথেষ্ট। মেয়ে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নাই। পৃথিবীতে চিন্তার অনেক বিষয় আছে।
গল্পগুজব করার জন্যে একজন কেউ থাকলে ভালো হতো। শরিফাকে তিনি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাকে কি আজ আবার আনাবেন? শরিফার জবুথরু ভাব কেটে গেছে। রঙিলা বাড়ির শিক্ষা। সে এখন কথার পিঠে কথা বলা শিখেছে। গুনগুন করে গানও গায়। ধনু শেখ মোটামুটি বিস্মিত হয়ে বললেন, গান কবে শিখলা?
শরিফা বলল, দিন তারিখের প্রয়োজন আছে? গান শুনতে চাইলে বলেন, শুনায়া দিব।
গান ছাড়া আর কিছু শিখেছ?
ভাব ভালোবাসা দিয়া অচেনা পুরুষের মন ভুলাইতে শিখেছি।
দেখি কেমন শিখেছি? আমারে দেখাও। আমার মন ভুলাও।
আপনেরে ভুলাইতে পারব না। আপনের মন নাই। আপনের আছে শরীর। তাও পুরাটা নাই! এক ঠ্যাং বাদ।
কটকটি ধরনের কথা। শুনতে খারাপ লাগে না। ধনু শেখ মাথা থেকে শরিফার বিষয় দূর করার চেষ্টা করতে লাগলেন। সারাক্ষণ এক ‘নটিবেটি’র কথা ভাবলে দিন চলবে না।
পানের পিক ফেলতে ফেলতে ধনু শেখ বললেন, শুনলাম লাবুস বড়গাঙের পারে লিঙ্গরখানা দিয়েছে?
সদরুল বলল, ঠিকই শুনছেন। বিরাট মচ্ছবি বসছে। দুপুর থাইকা খিচুড়ি রান্ধা হয়। চাইরটার সময় খানা দেওয়া হয়। দুই লাইনে খাওয়া। পুরুষ একদিকে, মেয়েছেলে আর পুলাপান আরেকদিকে।
খাওয়ায় কী?
চাইলে ডাইলে খিচুড়ি। সঙ্গে সবজি থাকে। লাবুস সাব নিজেও সবের সাথে বইসা খান।
বলো কী?
উনি আগে থাইকাই শুনেছি, একবেলা খান।
লঙ্গরখানায় লোক কেমন হয়?
দুনিয়ার মানুষ। আশেপাশে থাইকাও খবর পাইয়া আসতেছে। মিনি 39না श्i९33।
হিন্দু-মুসলমান আলাদা?
না, একত্রেই খায়।
লাবুস এই লঙ্গরখানা কতদিন চালাইব?
অতি অল্পদিন। মানুষ যেভাবে আসতেছে রাজার রাজত্বও ফুরায়া যাবে।
ঘুম জড়ানো গলায় ধনু শেখ বললেন, এরে বলে পরের ধনে পোদারি। একটা পয়সা লাবুসের নিজের রোজগার না। হরিচরণের পয়সা। উড়াইতাছে লাবুস।
সদরুল বলল, কথা সত্য।
ধনু শেখ হাই তুলতে তুলতে বললেন, তুমি দশ বস্তা চাউল আইজ লঙ্গরখানায় পাঠায়া দিবা।
সদরুল ভুল শুনল কি-না বুঝতে পারল না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতে সাহসে কুলালো না। ধনু শেখ চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। মনে হয় ঘুমে। সদরুলের কথা শুনে কাঁচাঘুম ভাঙলে বিরাট সমস্যা হবে।
ধনু শেখ শুধু একা যে সাহায্য পাঠালেন তা-না। বিশেষ এক জায়গা থেকে তিন হাজার টাকা চলে এলো। জায়গার নাম রঙিলা নটিবাড়ি। টাকা নিয়ে এসেছেন রঙিলা বাড়ির মালেকাইন নিজে। বোরকায় তার সারা শরীর ঢাকা। শুধু সুরমা পরা চোখ দেখা যায়।
মালেকাইন বললেন, পাপ মানুষের মধ্যে লেখা থাকে। টাকাতে পাপ লেখা থাকে না। আপনি কি আমাদের টাকা নিবেন?
লাবুস বলল, নিব।
শুনেছি। এখানকার খিচুড়ি খুব ভালো হয়। আমার মেয়েগুলার খুব ইচ্ছা, একবার খিচুড়ি খায়।
আমি খিচুড়ি পাঠায়ে দিব।
মালেকাইন বললেন, আপনার অনেক মেহেরবানি। আমার মেয়েগুলি বলে দিয়েছে, তাদের সবার হয়ে যেন আমি আপনাকে প্ৰণাম করি।
লাবুস কিছু বলার আগেই মালেকাইন মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে প্ৰণাম করলেন।
লঙ্গরখানায় শ্ৰীনাথ খুব ঝামেলা করার চেষ্টা করছে। তার বক্তব্য, হিন্দু হয়ে যবনের খাদ্য খাওয়া মহাপাতক হওয়ার ব্যবস্থা। জাত শেষ।
নরেশ বলল, আমরা নমশুদ্ৰ, আমরার আবার জাত কী?
শ্ৰীনাথ বলল, ইহকালের জাত না, পরকালের জাত।
পরকালেও জাত আছে জানতাম না তো।
এখন জানলা। রৌরব নরকে পুড়তে হবে খিয়াল রাখ।
নরেশ বলল, রৌরব নরকে আমরা একলা যাব না। আপনিও যাবেন। লাবুস সাহেবের বাড়িতে আপনি ম্যালা দিন ছিলেন। মুসলমানের খানা খেয়েছেন।
না জেনে কথা বলব না। আমি স্বপাক খেয়েছি। নিজের রান্না নিজে রেঁধেছি।
এইখানেও তো একই ব্যবস্থা। নিজেদের রান্না আমরা নিজেরা রান্দি। ওই দেখেন। দেখছেন? এখন বিদায় হন। আরেকবার যদি লঙ্গিরখানায় আপনেরে দেখি তাইলে ঘটনা আছে।
কী ঘটনা? কী করবা তুমি?
নরেশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, পাছা দিয়ে লঙ্গরখানার খিচুড়ি ঢুকায়া দিব।
শ্ৰীনাথ ঝাঁপিয়ে পড়ল। নরেশের ওপর। কিল ঘুসি চড় থাপ্পড় চলতে থাকল। নরেশ চুপ করেই রইল। ব্ৰাহ্মণের গায়ে হাত তোলা যায় না। নিচু জাতের কেউ ব্রাহ্মণের শরীরে হাত তোলা আর ভগবানের গায়ে হাত তোলা একই ব্যাপার। শ্ৰীনাথকে অনেক কষ্টে থামালেন মনিশংকর।
মনিশংকর ছেলেকে নিয়ে লঙ্গরখানা দেখতে এসেছিলেন। শিবশংকরকে নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। তার শরীর পুরোপুরি গেছে। মাথায়ও মনে হয় কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। প্রায় দেখা যায় সে বাড়ির সামনে খুঁটি পুঁতে ঝিম ধরে বসে থাকে।
আজ তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে এনেছেন।
মনিশংকর লঙ্গরখানার কর্মকাণ্ড মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। শিবশংকর হঠাৎ শরীরের ক্লান্তি এবং অসুস্থতা ঝেড়ে ফেলল। তাকে দেখা গেল একটা কাগজ এবং পেনসিল নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘুরছে। মোট কতজন খাবে, তাদের মধ্যে কতজন শিশু, কতজন মহিলা, সব গুছিয়ে লিখছে। এই কাজটা সে কেন করছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে কাজটা করে সে যে আনন্দ পাচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। মনিশংকর লাবুসকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেলেন। তিনি তাকে গোপন কিছু কথা বলবেন।
মনিশংকর বললেন, আমি গত রাতে শেষপ্রহরে একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করব।
লাবুস তাকিয়ে আছে। স্বপ্ন নিয়ে তার সঙ্গে কী আলাপ তা সে বুঝতে পারছে না।
শিবশংকর বললেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি হরিচরণ বাবুকে। তিনি যেন ঘরে এসেছেন। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমাকে জাগালেন। বিছানায় বসলেন। শিব শংকরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, ছেলের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তিনি বললেন, তাকে কাজে ব্যস্ত রাখি, শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বললাম, কী কাজে ব্যস্ত রাখব?
উনি বললেন, লঙ্গরখানার কাজ।
তখন ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি শিবশংকরকে নিয়ে এসেছি। তুমি তাকে কাজে লাগাও। সে খুব গোছানো ছেলে। যে কাজটা তাকে করতে দিবে। সে গুছিয়ে করবে।
লাবুস হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মনিশংকর বললেন, তুমি যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছ, তাতে জলের মতো টাকা যাওয়ার কথা। যাচ্ছে না?
যাচ্ছে।
শিবশংকরের মা তার পিতৃধন হিসেবে কিছু টাকা পেয়েছিল। এই টাকাটা কলিকাতায় শিবশংকরের নামে জমা আছে। আমি টাকাটা আনিয়ে তোমাকে দিব। আমার অর্থ গ্রহণ করতে তোমার আপত্তি নাই তো?
জি-না। আপনি দুর্গা পূজা উপলক্ষে আমার মা’কে একটা লাল শাড়ি দিয়েছিলেন। মা কী যে খুশি হয়েছিলেন! উনি শাড়িটা আমার গায়ে জড়ায়ে দিয়ে বলেছিলেন, কী সুন্দর শাড়ি, তুই একটু পরে দেখ।
তোমার মায়ের কোনো সন্ধান তোমার কাছে আছে?
না।
মনিশংকর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, বাবা, একটা কথা মনে রাখবে। মায়ের গায়ে কোনো দোষ লাগে না। ছেলে কখনো মায়ের ক্রটি দেখবে না। অন্যরা দেখলে দেখবে, সন্তান কখনো না। মনে থাকবে?
থাকবে।
খাবার দেয়া শুরু হয়েছে। একটা খিচুড়ির গামলা শিবশংকরের হাতে। সে মহাউৎসাহে খিচুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।
লাবুস খেতে বসেছে। তার একপাশে মীরা, অন্যপাশে নরেশের মেয়ে লক্ষ্মী।
লক্ষ্মীর পাশে বসেছে ইমাম করিম। করিম বলল, এই মেয়ে, গতকাল দেখলাম বিসমিল্লাহ না বলে ভাত মুখে দিলা। আজকেও যদি ভুল হয় তাহলে কী যে করব তার নাই ঠিক।
লক্ষ্মী বলল, আমি তো হিন্দু।
হিন্দু হও আর যাই হও বিসমিল্লাহ বলবা।
যদি না বলি আপনে কী করবেন?
করিম গম্ভীর গলায় বলল, আমি না খায় উঠে যাব।
সত্যিই?
অবশ্যই। আমি এককথার মানুষ।
লক্ষ্মী বলল, বিসমিল্লাহ।
আঠারোজিনের একটা নতুন দল এসেছে নিশাপুর থেকে। শিবশংকর তাদের কাছে গেল। গম্ভীর গলায় বলল, পরিশ্রম করে এসেছেন, এক্ষুণি খেতে বসবেন না। হাত মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবেন। আগন্তুক দলের অতি বৃদ্ধ একজন বলল, বাবা, খাওয়া থাকব তো?
অবশ্যই থাকবে।
শুনেছি পাঁচক মুসলমান। মুসলমানের রান্না তো বাবা খাব না। আমি ব্ৰাহ্মণ।
ব্ৰাহ্মণ পাঁচকের রান্নাও আছে। আপনার অসুবিধা হবে না।
যিনি খাওন দিচ্ছেন তাঁর জাত কী?
তাঁর মতো বড় ব্ৰাহ্মণ খুব কমই আছে।
বৃদ্ধের সঙ্গীদের মধ্যে একজন বলল, ঠাকুরে কিন্তু ভেজাল থাকে।
বৃদ্ধ বললেন, তা থাকে। তবে ‘বিপদে নিয়ম নাস্তি’।
সবাই এই কথায় একমত হলো।
বৃদ্ধ বলল, তাইলে আর অসুবিধা কিছু দেখি না।
প্রায় দুইশ’ মানুষ একসঙ্গে খাচ্ছে। লাবুস কিছুক্ষণের জন্যে খাওয়া বন্ধ করে চারদিক দেখল। একই সময়ে গভীর আনন্দ এবং গভীর বেদনায় তার হৃদয় পূর্ণ হলো। শুধু মানুষের পক্ষেই সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি আবেগ ধারণ করা সম্ভব।
সনটা বলি। ১৯৪৩, জুন মাস। ভারতবর্ষ মানুষের তৈরি করা দুর্ভিক্ষে কাতর। গান্ধিজি আগা খান প্রাসাদে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে বন্দি। বাপুজিকে ছাড়াই চলছে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। ইংরেজকে ভারত ছাড়তেই হবে। ইংরেজ সরকার নির্বিকারে কংগ্রেস কমী গ্রেফতার করে জেলে ঢোকাচ্ছে।
কোলকাতার পথে পথে থালা হাতে নিরন্ন মানুষ। তাদের কাছে ভারত ছাড় আন্দোলন, স্বরাজ, স্বাধীনতা, সব অর্থহীন। তারা ভাত চায়, আর কিছু না। ভাত ভিক্ষা চাইতেও এখন তাদের সংকোচ। তারা ক্ষীণ গলায় বলে, একটু ফ্যান দিবেন। মা-জননী?
এক মা তার কংকালসার শিশুকন্যা নিয়ে ডাস্টবিন ঘাঁটছেন। খাদ্য অনুসন্ধান। একটা নাদুসনুদুস কুকুর আগ্রহ নিয়ে এই দৃশ্য দেখছে। তাদের খাবারে ভাগ বসাতে আসা মানুষ দেখে সে অভ্যস্ত না। ডাস্টবিনে একটা কাক বসে আছে। সেও বিস্মিত হয়ে দৃশ্যটি দেখছে।
কোলকাতার পথেঘাটের অতি সাধারণ একটি দৃশ্য। এই সাধারণ দৃশ্যই এক তরুণ যুবক হাঁটু গেঢ়ে বসে আঁকছে। তরুণের ভরসা হাতে তৈরি কাগজ, পেন্সিল এবং কাঠকয়লা। তার কাধের ঝুলিতে চায়নিজ ইংকের কৌটা এবং তুলিও আছে। যুবকের হাতের টান স্পষ্ট এবং ঋজু। সে মুহুর্তের মধ্যেই দৃশ্যটা কাগজে নিয়ে এলো। যুবকের পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ বললেন, বাহ্!
যুবক বলল, ছবি আপনার পছন্দ হয়েছে?
বৃদ্ধ বলল, জি জনাব মাশাল্লাহ্।
বৃদ্ধকে আমরা চিনি। তিনি কোরানে হাফেজ মাওলানা ইদরিস। তার শরীর এখন কিছুটা সেরেছে। মাঝে মধ্যে তিনি কোলকাতা শহর দেখতে বের হন। বেশিদূর যান না, যমুনার বাড়ির আশেপাশেই থাকেন। এই শহর তাঁর পরিচিত না।
ইদরিস যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, জনাব, আপনার নাম?
তরুণ বলল, আমার নাম জয়নুল আবেদিন।
মুসলমান?
জি।
ইদরিস দুঃখিত গলায় বললেন, তাহলে তো জনাব বিরাট পাপ হয়েছে। যাদের জীবন আছে তাদের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ।
জয়নুল আবেদিন কপালের ঘাম মুছলেন। আজ তীব্ৰ গরম পড়েছে। ইদরিস বললেন, মহিলা এঁকেছেন তার জন্যে পাপ হবে। তার কোলের শিশুটার জন্যে পাপ হবে। কুকুর এবং কাক আঁকার জন্যে পাপ হবে। এদের জীবন আছে।
জয়নুল আবেদিন বললেন, সবচে’ কম পাপ মনে হয় কাকটা আঁকার জন্য হবে। সবচে’ ছোট প্ৰাণ।
আল্লাহপাকের কাছে প্ৰাণের কোনো ছোট বড় নাই। তার কাছে সব প্ৰাণ মূল্যবান।
আপনি মাওলানা?
জি জনাব। আমি কোরানে হাফেজ। আমার নাম ইদরিস। একটা কাজে বগুড়া যাওয়া ধরেছিলাম। জমিদার শশাংক পালের কাজ। আল্লাহপাক আমাকে কলিকাতা নিয়ে এসেছেন। উনার ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা।
জয়নুল বললেন, আপনি হাফেজ মানুষ। মনে হচ্ছে বিরাট মাওলানা। আপনার দাড়ি নাই কেন?
মাওলানা ইদরিস লজ্জায় পড়ে গেলেন। লজ্জা এবং দুঃখ মেশানো গলায় বললেন, দাড়ি ছিল। শিয়ালদা ইষ্টিশনে অসুখ হলো, তখন চুল দাড়ি সব পড়ে গেল। মনে হয় আমার কোনো পাপের শাস্তি।
আপনি পাপের শাস্তি ভয় পান। সারা দুপুর আমার ছবি আঁকা দেখেছেন, আপনার পাপ হয় নাই?
এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানা নাই। প্রাণীর ছবি অংকন করা পাপ। অংকন দেখা পাপ কি-না জানি না।
আগ্রহ করে ছবি আঁকা দেখলেন, এর কারণ কী?
চক্ষের নিমিষে এমন সুন্দর ছবি আঁকলেন। মন ভরে গেছে। মাশাল্লাহ।
এই ছবির কোনটা আপনার ভালো লেগেছে?
কাকটা।
জয়নুল বিস্মিত হয়ে বললেন, কাক! কেন?
ইদরিস বললেন, কাকটা দেখে মন হয় এক্ষণ উড়াল দিবে।
বাহ, ভালো বলেছেন তো!
ইদরিস ইতস্তত করে বললেন, জনাব, আরেকটা কাক কি আঁকবেন?
অবশ্যই। এই ছবিতেই আরেকটা কাক দিয়ে দেই। একটা উড়াল দেয়ার জন্যে তৈরি, আরেকটা তাকিয়ে আছে ডাস্টবিনের দিকে।
দেখতে দেখতে আরেকটা কাক তৈরি হলো। মাওলানা ইদরিস বললেন, সুবাহানাল্লাহ। জনাব, কাক কীভাবে আঁকেন?
আপনি কি কাক আঁকা শিখতে চান?
জি জনাব।
জয়নুল বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
আমার একটা মেয়ে আছে, নাম মীরা। তারে কাক ঐকে দেখাব। সে খুশি হবে। পুলাপানরা এইসব জিনিস দেখলে খুশি হয়।
সত্যি সত্যি কাক আঁকা শিখতে চান?
জি জনাব। যদি আপনার তোকলিফ না হয়।
জয়নুল ছবির খাতা বের করলেন। কাঠকয়লা বের করলেন। তিনি ছাত্রকে বসলেন তার পাশে।
মাওলানা সাহেব, কাকটা দেখতে পাচ্ছেন না? জি জনাব।
এক কাজ করি, কাকের ঠোঁটটা ঐকে ফেলি। ঠোঁট তীক্ষ্ণ। একটু বাঁকা না?
জি।
দেখুন তো হয়েছে?
জি।
ঠোঁট হয়ে গেছে, এখন ঠোঁটের মাপে শরীর। ঠোঁট বড় শরীর ছোট হলে তো হবে না। এখন মনে মনে মাপটা ঠিক করে ফেলি। মাপ ঠিক করে লেজটা আঁকি। এখান থেকে শুরু করি লেজ। হবে না?
মাওলানা বললেন, না লেজটা বড় হয়ে যাবে।
ঠিক ধরেছেন। তার মানে আমি কী বলছি বুঝতে পারছেন। লেজটা একটু ছোট করে দিলাম। এখন আঁকব পাখা। কাকের পাখার রঙ কী?
কালো!
পুরোপুরি কালো না। দাঁড়কাক হয় কুচকুচে কালো। যেন চাইনিজ ইংক। এই কাকগুলোর কালোর সঙ্গে সামান্য সাদা আছে। আমি কালো দিয়েই আঁকব, তারপর ঘাড়ের কাছে রঙটা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে পাতলা করে দিব।
কাক আঁকা শেষ হয়েছে। জয়নুল পাতাটা ছিড়ে মাওলানার হাতে দিয়ে বললেন, নিয়ে যান।
ইদরিস বললেন, জনাব শুকরিয়া।
জয়নুল বললেন, পান খাবেন? আমি এখন জর্দা দিয়ে একটা পান খাব। পান সিগারেট খাবার বিরাট বদঅভ্যাস হয়েছে।
ইদরিস বলল, আগে পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। একদিন মনে হলো, কী সর্বনাশ, আমাদের নবীজি তো পান খান না। তাঁর দেশে তো পান সুপারি নাই।
আপনি নবীভক্ত মানুষ?
জি।
আপনার মতো আরেকজন নবীভক্ত মানুষ ছিলেন। তিনিও কোরানে হাফেজ। বিরাট কবি ছিলেন। শিরাজ নগরে ছিল তার বাড়ি। আমার পছন্দের কবি। তাঁর কবিতার বইয়ের নাম ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’। কবি হাফিজের নাম শুনেছেন?
জি-না। আমি বিরাট মুর্থ।
আমরা সবাই মূর্খ। বলেই জয়নুল ব্যাগ থেকে পানের কৌটা বের করে পান মুখে দিলেন। আয়োজন করে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, এখন আপনার পরীক্ষা।
কী পরীক্ষা?
আপনি হচ্ছেন আমার জীবনের প্রথম ছাত্র। কাক আঁকা শিখিয়েছি। ছাত্র কাক আঁকতে পারল কি-না দেখব না? ওই কাকটা দেখে দেখে একটা কাক আঁকুন। এই নিন কাগজ। এই যে কয়লা। কয়লাটা শক্ত করে ধরবেন। কয়লাকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কয়লা আপনাকে কামড়াবে না।
মাওলানা কোনোরকম অস্বস্তি ছাড়াই আঁকতে বসলেন।
আমি যদি পা দুটা আগে আঁকি অসুবিধা আছে?
না। পা যেহেতু কাকের মাঝখানে, পা দিয়ে শুরু করাই ভালো হবে। Proportion ঠিক করা সহজ হবে।
কী বললেন বুঝলাম না।
আপনাকে বুঝতে হবে না। আপনি ছবি আঁকুন।
মাওলানা কাক এঁকে শেষ করলেন। লজ্জিত চোখে তাকালেন তার তরুণ শিক্ষকের দিকে। জয়নুল বললেন, আপনার কি ধারণা হয়েছে?
মাওলানা ক্ষীণ গলায় বললেন, হয়েছে।
জয়নুল বললেন, আমি আপনাকে দিলাম দশে আট। আমি ভালো শিক্ষক। ছাত্রকে ভালো নাম্বার দেই। কাকটার নিচে দশে আট লিখে জয়নুলা নিজের নাম সই করলেন। করে বললেন, এই কাকটা আমি রেখে দেব। পরীক্ষার খাতা টিচারের কাছে থাকে। এই নিয়ম। *
[* ১৯৬০ কিংবা ’৬৫-র দিকে জয়নুল আবেদিনের এই কাক এক ভক্ত অনেক টাকা দিয়ে মাদ্রিদে কিনে নিল। জয়নুলের নাম সই আছে। যে বিখ্যাত কাক বেচারা কিনল তা জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছিল না। (সূত্ৰ : অসমর্থিত)]
ইদরিস বাসায় ফিরলেন আনন্দ নিয়ে। তাঁর শরীর পুরোপুরি সারে নি। রাত করে জ্বর আসছে। শরীর কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর জুর। জ্বরের সময় তাঁর মনে হয় পৃথিবীর অতি শীতলতম স্থানে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে। যে শীত দোজখের আগুনের চেয়েও ভয়াবহ। এটা কি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা? মৃত্যুর আগে আগে মানুষ কি শীতের জগতে প্রবেশ করে? মৃত্যু কি চরম শৈত্য? জ্বরের ঘোরে তিনি লম্বা সাদা টুপি পরা কিছু মানুষজন দেখেন। তাদের মাথার টুপি যেমন লম্বা তারাও লম্বা। তাদের সবার গায়ে ভারী কম্বল। সেই কম্বলের রঙও সাদা। তিনি যেমন শীতে কষ্ট পাচ্ছেন তারাও পাচ্ছে। লোকগুলি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে। ইদরিস তাদের কথা শুনতে পারেন না, তবে তারা যখন মুখ নাড়ে তখন তাদের মুখ দিয়ে সাদা কুয়াশার মতো বের হয়।
মাওলানা তাঁর অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলেন না। তার লজ্জা লাগে। জ্বর বিকারে মানুষ অনেক কিছু দেখে, তা নিয়ে আলাপ করার কিছু নাই। অবশ্য মাঝে মাঝে গোপালনগর স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে এই বিষয়ে তার আলোচনা হয়। শিক্ষকের নাম বিভূতিভূষণ। ব্ৰাহ্মণ। পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শিক্ষক হঠাৎ হঠাৎ যমুনাদের বাড়িতে আসেন। তারাশংকর বাবুর সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলেন। একসময় ভূতের গল্প শুরু করেন। তখন তারাশংকর বিরক্ত গলায় বলেন, আপনার মতো লেখক যদি ভূতপ্ৰেত নিয়ে থাকেন তাহলে কি হয়? সাহিত্য জীবননির্ভর। ভুতনির্ভর না।
বিভূতিভূষণ আলাভুলা ধরনের মানুষ। খাওয়াদাওয়ার গল্প করতে খুব পছন্দ করেন। একদিন ইদরিসকে বললেন, শিং মাছের ডিমের পাতুরি কখনো খেয়েছেন?
ইদরিস বললেন, জি-না জনাব।
একদিন খেয়ে দেখবেন। অসাধারণ। কীভাবে রাধবেন বলে দেই? খুব সহজ।
জি বলুন।
শিং মাছের ডিমের সঙ্গে সামান্য মসলা দেবেন। কাঁচামরিচ লাগবে। পিঁয়াজ দেবেন না। কলাপাতা দিয়ে ডিম মুড়ে ভাতের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। মনে থাকবে?
জি জনাব থাকবে।
কচ্ছপের ডিমের একটা রন্ধন প্ৰণালি আমার কাছে আছে। আপনাকে দেব?
জি-না জনাব। আমি মুসলমান। কচ্ছপ খাই না।
আপনি মুসলমান আমি জানি। আমাদের এলাকার অনেক মুসলমান কচ্ছপ খান বলেই বলেছি। কিছু মনে করবেন না।
কিছুই মনে করি নাই।
বিভূতিভূষণ বললেন, আপনাদের যেমন এক ঈশ্বরবাদ, আমাদেরও কিন্তু এক অর্থে তাই। বেদান্ত গ্রন্থে আছে ‘একং ব্ৰহ্ম দ্বিতীয়ং নাস্তি, নেহ নানাস্তি কিজ্ঞন।’ এর অর্থ-ব্ৰহ্মা এক, তিনি ব্যতীত আর উপাস্য কেউ নেই।
মাওলানা জ্বরের সময় তাঁর অভিজজ্ঞতার কথা এই জ্ঞানী মানুষকে বলেছেন। বিভূতিভূষণ বলেছেন, মৃত্যুর আগে আগে সমস্ত মানুষকেই তার মৃত্যুসংবাদ দেয়া হয়। কেউ বুঝতে পারে, কেউ বুঝতে পারে না।
ইদরিস বললেন, এটা কি মৃত্যুসংবাদ?
বিভূতিভূষণ বললেন, হতে পারে। তবে আপনি ভয় পাবেন না। মৃত্যুর পরের জগৎ অতি আনন্দময়। সেই আনন্দ যে কী তা আমাদের ধারণা করা সম্ভব না।
শুধুই আনন্দ? দুঃখ নাই?
আমার মনে হয় নাই। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদের কষ্ট দেবেন তা আমি মনে করি না। মৃত্যুর পর তিনি আমাদের তীর জগৎ, তাঁর সৃষ্টিরহস্য দেখার সুযোগ করে দেবেন। পরকাল নিয়ে আমার একটা লেখা আছে। নাম ‘দেবযানী’। আপনি কি পড়তে চান?
ইদরিস বললেন, জি-না জনাব। গল্পকাহিনী আমার ভালো লাগে না। কাছাছুল আম্বিয়ার কাহিনী ভালো লাগে। অন্যকিছু ভালো লাগে না।
যমুনার কাছে ‘দেবযানী’ বইটা আছে। যদি পড়তে ইচ্ছা করে পড়বেন।
জি আচ্ছা জনাব। তবে পড়তে ইচ্ছা করবে না।
বিভূতিভূষণ হেসে ফেললেন। *
————-
* এই মহান ঔপন্যাসিক বান্ধবপুর এসেছিলেন। যথাসময়ে সেই গল্প করব। সেপ্টেম্বরের এক তারিখ ১৯৫১ সনে তিনি মারা যান। মৃত্যুর তিনদিন আগে তাঁর ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন সন্ধ্যাকাল। তিনি বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ দেখলেন একদল শ্মশানযাত্রী শব নিয়ে যাচ্ছে। তিনি কৌতূহলী হয়ে তাকালেন এবং অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, যে শব নিয়ে যাচ্ছে সে আর কেউ না। তিনি নিজে। বিভূতিভূষণ এই দৃশ্য দেখেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তৃতীয়দিনের দিন মারা গেলেন।