দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দু-তিনটি বছর এ-দেশে একটা অদ্ভুত বিহ্বলতার মধ্যে কেটেছে। প্রথম সারির নেতারা প্রত্যেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং সেটা ঢাকবার জন্য তাদের ছটফটানিও অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠল। যুদ্ধ যখন লাগবে লাগবে মনে হয়েছিল, তখন সকলেরই মনে আশা জেগেছিল যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটবে। যুদ্ধ যখন সত্যি সত্যি শুরু হল, তখন সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। স্বরাজ এবার আসবেই, কিন্তু কোন পথে আসবে? স্বরাজ কি অর্জন করে নিতে হবে না? দেশের লোক একটা কিছু নির্দেশ পাবার জন্য অধীর–কিন্তু কোনও নির্দেশ নেই।
মহাত্মা গান্ধী যুদ্ধটাকে নিলেন নৈতিক দিক থেকে। যে পরিচ্ছন্ন নীতি মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করে, সেই নীতিবোধ তিনি একটি দেশের দিকদিশারি হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলেন। যদিও দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না দেশ কাকে বলে–এবং রাষ্ট্রের কোনও আত্মা নেই। প্রায় পৌনে দুশো বছর ধরে যে ইংরাজ সম্পূর্ণ অমানবিক ভাবে ভারত শাসন ও শোষণ করল–সেই ইংরেজই শক্তিশালী জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিপন্ন হওয়ায় গান্ধীজি জানালেন, ইংরেজ এখন আক্রান্ত, এই সময় তাকে চাপ দেওয়া সুনীতির পরিপন্থী। দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলনেও তিনি সম্মতি দিলেন না কারণ তার পরিণতি অরাজকতা ও ধ্বংস। তিনি বড়লাটের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করতে লাগলেন। এই যুদ্ধে অগণতান্ত্রিক নাৎসি জার্মানির বিজয় তিনি চান না–আবার অহিংসা নীতির সম্মান রক্ষার জন্য মিত্রপক্ষের যুদ্ধকর্মেও তার দেশ সাহায্য করবে না।
ইংরেজদের সঙ্গে দর কষাকষির আগে ভারতীয় দলগুলির মধ্যে মতৈক্য আনতেও কেউ তখনও সক্ষম হয়নি। জিন্না সাহেবের মুসলিম লিগ ততদিনে কলসি থেকে বেরোনো মস্ত বড় দৈত্যে পরিণত হয়েছে–অথচ গান্ধীজি এবং কংগ্রেস তাকে বাস্তব বলে কিছুতেই স্বীকার করছেন না। ১৯৪০-এ লাহোরে পাকিস্তানের দাবি পর্যন্ত উঠে গেছে কিন্তু কংগ্রেস তা নিয়ে আলোচনা করতেই রাজি নয়। এর আগে, বাংলাদেশে ফজলুল হক যখন লিগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন তখন কংগ্রেস ফজলুল হকের সঙ্গে সহযোগিতা না করে এক চরম ভুল করেছিল। এবারও লিগের সঙ্গে আপোসে মীমাংসা না করে কংগ্রেস লিগকে আরও দূরে সরিয়ে দিল–যে লিগ আগে চেয়েছিল শুধু শাসন ক্ষমতার অংশ, এখন তারা চাইল দেশের অংশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে এই সময়েই সত্যিকারের সার জল পড়ল। জিন্না সাহেব আরও শক্ত হলেন, পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের যে-কোনও আলোচনা মুসলিম লিগকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এতে সুবিধে ছাড়া অসুবিধে বিন্দুমাত্র নেই।
কংগ্রেসের নিজের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কিছুতেই আর মেটে না। সুভাষ বোসকে নিয়ে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। মাঝে মাঝেই উত্তেজিত জওহরলালকে সামলাতে হচ্ছে। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সুভাষবাবুকে বললেন, “আমাদের উচিত হবে, সরকারকে একটা চরম পত্র দেওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের জাতীয় দাবি পূরণ করা না হলে সারা দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করা।…সকল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংঘ-প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, সকল চরমপন্থী দল মিলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর একযোগে চরম আঘাত হানতে হবে।”
সুভাষবাবুর কথাবার্তায় সন্ত্রাসবাদের গন্ধ। এতে কংগ্রেসের অহিংসার আদর্শে চিড় খায়। গান্ধীজি বলেছিলেন, অহিংসা আমার কাছে একটা আদর্শ, তোমরা যদি আদর্শ। হিসেবে মেনে নিতে না-ও চাও, পন্থা হিসেবে গ্রহণ করো। সুতরাং ওয়েলিংটন স্কোয়ারে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে সুভাষকে বেআইনি ভাবে সরিয়ে দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথ সুভাষের প্রতি সুবিচারের জন্য গান্ধীজিকে লিখলেন। উত্তরে গান্ধীজি বললেন, সুভাষকে নিয়ম মেনে চলতে বলুন। সুভাষকে তাতেও দমন করা যায় না। বাংলাদেশের প্রাদেশিক কংগ্রেস তিনি তখনও দখল করে আছেন। সেখান থেকেও তাঁকে বাদ দেবার পর তিনি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরি করলেন। সারা দেশের যুব সমাজ তার কথা শোনার জন্য উদগ্রিব।
যুদ্ধের গোড়ার দিকেই সুভাষ ঘোষণা করলেন, ডালহৌসি স্কোয়ারে হলওয়েলের যে কুখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ আছে বাংলার যুব সমাজ সেটা উপড়ে ফেলে দেবে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার নামে মিথ্যে কলঙ্ক লেপন করার জন্যই ব্রিটিশ সরকার ওই স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে রেখেছে। তিনি নিজে প্রথম আঘাত আনবেন ওই মিথ্যার স্তম্ভে।
সারা দেশে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়ে গেল এই আহ্বানে। এবং এ এমনই এক প্রশ্ন, যেখানে হিন্দু মুসলমানে কোনও মতান্তর নেই। এদিকে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সমস্ত মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলেও বাংলায় নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে লিগ মন্ত্রিসভা তখনও পুতুল খেলা খেলছে। পাছে হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়–এই ভয়ে লিগ মন্ত্রিসভা তখন সাহেবদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে দ্বিধাগ্রস্ত নয়-যদিও আসল ক্ষমতা কিছুই হাতে নেই–মনোনীত সদস্য এবং ইংরাজ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের ভোটে যে-কোনও প্রস্তাব নাকচ হতে পারে।
সুভাষবাবু আইন অমান্য করে হলওয়েল স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙার আহ্বান জানানোর জন্য নাজিমুদ্দিন সরকার তাকে বন্দি করলেন। সমস্ত দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের অন্তত কিছুটা শান্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত নাজিমুদ্দিন সরকারকেই সেই স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণ করতে হয়।
পরের বছর গৃহবন্দি অবস্থা থেকেই সুভাষবাবু হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেলেন। সে-খবর রটে যাওয়ার পর সারা কলকাতা শহরে গুজবে কান পাতা যায় না। কেউ বললে, ব্রিটিশরাজ সুভাষবাবুকে খাবারের সঙ্গে রোজ একটু একটু বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। কেউ বললে, শেষ রাত্রে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে–শিবপুরের কাছে গঙ্গায় ভাসতে দেখা গেছে তাঁর লাশ–কেউ বলে মন্ত্রবলে তিনি অদৃশ্য–কেন না দুর্ভেদ্য ব্রিটিশ পাহারা ফাঁকি দিয়ে কেউ কি পালাতে পারে? মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত বিচলিত হয়ে শরৎ বোসের কাছে টেলিগ্রাম পাঠালেন, সুভাষের সঠিক কী হয়েছে আমাকে জানাও। কিছু দিন বাদে রহস্যময় রেডিয়ো থেকে শোনা যেতে লাগল সুভাষের কণ্ঠস্বর।
ব্রিটেন হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের পক্ষ থেকে বড়লাট লর্ড লিনলিথগো জার্মানির সঙ্গে ভারতেরও যুদ্ধাবস্থা বলে ঘোষণা করেছিলেন। ভারতরক্ষা অর্ডিনান্স জারি হয়ে গেল, বড়লাটের হাতেই তাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। কংগ্রেসি নেতারা মনে বড়ই আঘাত পেলেন। এদিক-ওদিক কিছু মন্ত্রিত্ব এবং আলাপ আলোচনার ভড়ং চলছিল এতদিন–কিন্তু এখন প্রকট হয়ে পড়ল, ভারতের সর্বৈব মালিক এখনও ব্রিটিশ সরকার। ভারত কার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করবে কি করবে না–সে সম্পর্কে ভারতের কোনও জননেতার সঙ্গে পরামর্শ করার পর্যন্ত দরকার নেই। এখন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলনে নেমে না পড়লে কংগ্রেসের আর কোনও মান। থাকে না। কংগ্রেস প্রদেশে প্রদেশে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েছে কিন্তু সেটাকে তো আর সংগ্রাম বলা চলে না।
কংগ্রেসের অনেক বৈঠক আর বড়লাটের সঙ্গে নরম-গরম চিঠি চালাচালির পর গান্ধীজি নির্দেশ দিলেন ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের। কোনও সংগ্রাম নয়, কোনও সঙঘবদ্ধ আন্দোলন নয়। রাজনৈতিক কর্মীরা আইন অমান্য করার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যুদ্ধ বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে গ্রেপ্তার বরণ করবেন। যে-সময় দেশের সাধারণ মানুষ। পথনির্দেশ পাবার জন্য উন্মুখ, সেই সময় জননেতারা প্রায় বিলাসিতার সঙ্গে কারাগারের অভ্যন্তরে থাকাই মনস্থ করলেন। দেশব্যাপী একটা নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।
কংগ্রেসের এই জেল ভরানোর সিদ্ধান্তে লর্ড লিনলিথগো হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন কি না ইতিহাস তার কোনও দলিল রাখেনি। জিন্না সাহেব নাক কুঁচকে ছিলেন কি না সে সম্পর্কেও কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নেই। তবে, জিন্না সাহেব এই সুযোগে প্রচার করেছিলেন যে, দেখো, কংগ্রেস কত পৌরুষহীন! সে আসলে স্বাধীনতা চায় না, ইংরেজের সঙ্গে একলা একলা একটা সমঝোতা করে মুসলমানদের দমিয়ে। রাখতে চায়। এই প্রচারে বহু জাতীয়তাবাদী মুসলমানও লিগে যোগ দিয়েছিল।
স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করবে আর কে? সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলি উনিশশো পঁয়তিরিশের পর থেকে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকেই এসে আশ্রয় নিয়েছে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায়। সবাই এটুকু অন্তত উপলব্ধি করেছিল–একটা বিরাট আয়োজন ছাড়া এই সময় সংগ্রাম সার্থক হতে পারে না। এবং কংগ্রেসের মতন এত বড় একটা দলের নেতৃত্ব ছাড়া সেই বিরাট দায়িত্ব আর কে নিতে পারে? এরা সবাই কংগ্রেসের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল এবং নিরাশ হতে লাগল। ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে হাজার হাজার কর্মী যখন কারারুদ্ধ, তখন গান্ধীজি বললেন, “আপাতত আমাদের বাক স্বাধীনতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এ সংগ্রাম খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। যাদের নিজেদের স্বাধীনতাই আজ বিপন্ন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কেমন করে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করব? ইংরেজের কি এখন সে সময় আছে?”
বাকি রইল কমিউনিস্টরা। রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির সময় যারা চুপচাপ ছিল, হিটলার রুশ আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সরব হয়ে উঠল। কমিউনিস্টরা জাতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ গ্রহণের বিরোধী নয়–কিন্তু এখন ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটা তাদের কাছে মুলতুবি রইল। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধ ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সঙ্গে রুশের সমমর্মিতা হওয়ায়–এরাই হল মিত্রপক্ষ, এই যুদ্ধ হল জনযুদ্ধ। তারা দেশের মানুষকে বলল, এই যুদ্ধে ইংরেজকে সমর্থন করে পৃথিবীকে হিটলারের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। গ্রামে গ্রামে শোনা গেল, “কৃষাণ ভাই রে, কাস্তেটারে দিয়ে জোরে শান। এক নিমেষে আসবে স্বরাজ, পালাবে জাপান…।” অর্থাৎ যে জাপান তখনও আসেনি, সেই জাপান ভারতের স্বাধীনতার শত্রু।
বহু বছর ধরে নিষিদ্ধ ছিল যে কমিউনিস্ট পার্টি, এবার তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল। ব্রিটিশ সরকার বিনা মাইনের এক প্রচারসচিব দল পেয়ে বেশ খুশি।
যুদ্ধের আর একটি দিক হল, যুদ্ধদ্যমে টাটা-বিড়লা প্রভৃতি শিল্পপতিরা ফুলে লাল। হয়ে গেল কংগ্রেসের এরাই প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল। হাজার হাজার লোক চাকরি। পেতে লাগল যুদ্ধের সুবাদে। কৃত্রিম অর্থের ছড়াছড়িতে ফুলে-ফেঁপে উঠল বাজার। শেষ পর্যন্ত এমন হল, চাকরি খালি রয়েছে, অথচ লোক পাওয়া যায় না। গ্রামে আড়কাঠি। পাঠিয়ে তোক ধরে আনতে হয়। রাশি রাশি খুদে কন্ট্রাক্টর জন্মাল-উৎকোচ ও দুর্নীতি সত্যিকারের কাকে বলে মানুষ বুঝল এই প্রথম।
আসলে যুদ্ধের সময় নৈতিকতার প্রশ্নই দেশের সমস্ত সৎ নেতাদের দিশেহারা করেছিল।
নাৎসি জার্মানি এবং ফ্যাসিস্ট ইটালি ও জাপানকে নীতিগত ভাবে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। আবার ইংরেজকে সমর্থন করলে ভারতের স্বাধীনতা কবে আসবে? ইংরেজ বলুক, যুদ্ধ শেষে ভারতের স্বাধীনতা দেবে? কিন্তু বড়লাট ডোমিনিয়ন স্টেটাস ছাড়া আর কিছুই বলছেন না, সেক্ষেত্রে ভারতের কাছে প্রধান শত্রু কে? সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ, না নাৎসি জার্মানি? এই ব্যাপারে কিছুতেই কেউ মনস্থির করতে পারলেন না। জাপান যখন চিনের ওপর বেপরোয়া অত্যাচার চালাতে লাগল, তখন মহাত্মাজি বললেন, “আমার সহানুভূতি অবশ্য রুশিয়া ও চিনের দিকে। আজ দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি, আজ আমার মন আর ব্রিটেনকে নৈতিক সমর্থন দিতে চায় না। ভারতের প্রতি ব্রিটেনের ব্যবহারে আমি আজ মর্মাহত। অবশ্য আমি চাই না যে ব্রিটেন অপমানিত হোক বা যুদ্ধে পরাজিত হোক, কিন্তু আমার মন আর তাকে নৈতিক সমর্থন দিতে চায় না।” ভারতের দারুণ সংকটের সময় এ রকম অদ্ভুত নঞর্থক কথার মানেই অনেকে বুঝতে পারেনি।
তারপর জাপান মালয় সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মার দিকে এগোতেই ছবি আবার বদলে গেল। ব্রিটিশ সিংহ দৌড়াচ্ছে পেছন ফিরে–এই দৃশ্যে অনাহার ও ম্যালেরিয়া-জীর্ণ ভারতবাসীরও খানিকটা আরাম হয়-শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বলে মেনে নিতে ইচ্ছে হয়। অনেকের। সংবাদপত্রে নিদারুণ সেনসরশিপ থাকা সত্ত্বেও এ-খবর ছড়িয়ে পড়ল যে। সুভাষবাবু একদিন সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারত অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ইংরেজ অবশ্য সুভাষবাবুর মিথ্যে মৃতুসংবাদ ছাপিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টার কসুর করেনি। এবং এ কথাটাও সুকৌশলে রটানো হয়েছিল যে, দেশদ্রোহী সুভাষ জাপানিদের পথ দেখিয়ে আনছে। সুভাষবাবু যে সম্পূর্ণ ভারতবাসীদের নিয়ে গঠিত এক সেনাবাহিনীর অধিনায়ক, সেকথা জানানো হল না। লেনিন জার্মানির সহায়তায় রাশিয়াতে ছুটেছিলেন–আর জাপানিদের সাহায্য নিয়ে সুভাষ দেশ উদ্ধারে এগিয়ে আসার সময়। কংগ্রেস কমিউনিস্টরা একযোগে তার নিন্দে করল। জওহরলাল বললেন, বাইরে থেকে যারাই ভারত আক্রমণ করুক, আমি নিজে তলোয়ার হাতে নিয়ে তাদের বাধা দেব! গান্ধীজি বললেন, জাপানিরা মুক্তিদাতা হিসেবে আসবে না, আসবে লুঠের বখরা নিতে। সুতরাং সুভাষবাবুকে সমর্থন করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
যুদ্ধের পুরো চাপটা পড়ল বাংলাদেশে। রেঙ্গুন পতনের পর ব্রিটেনের ঘাঁটি উঠে এল। চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ আর বেশি দিন রাখা যাবে না, এই চিন্তাতেই ইস্টার্ন কমান্ডের মূল ঘাঁটি কলকাতা থেকে সরে গেল রাঁচিতে। সেখান থেকেও আবার বোম্বাইতে পালাবার জন্য রাস্তা তৈরি রইল। পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত এসে জাপানি সেনারা যাতে নদীনালা পেরোবার জন্য যানবাহন না পায়–তাই সমস্ত নৌকো সরকারি দখলে চলে গেল, খাবার যাতে না পায় সে জন্য সমস্ত চাল সরিয়ে নেওয়া হল বাজার থেকে। জেলেরা খেতে না পেয়ে ধুকতে লাগল, দুর্ভিক্ষের ধোঁয়া দেখা গেল দিগন্তে। কলকাতাতেও তখন পালাই পালাই রব-হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশনে প্রতিদিন ভিড়ের চাপে মাথা ফাটাফাটি।
জাপানিদের ঘৃণা করলেও জাপানিরা যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশে উপস্থিত হয় তা হলে তাদের সঙ্গে যাতে আলাপ-আলোচনায় বসা যায়–সেই মতন তৈরি হতে লাগল কংগ্রেস৷ কিন্তু এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজদের চূড়ান্ত ভাবে তাড়াবার কোনও পরিকল্পনা তখনও নেই। গান্ধীজি তখনও কুইট ইন্ডিয়া’ স্লোগান তোলেননি।
সর্বভারতীয় নেতৃত্বের যখন এই অবস্থা, তখন দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু ছোট ছোট দল মরণপণ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্রত নিয়েছিল। তাদের না ছিল সংগঠন, না ছিল শক্তি। কিন্তু তারা বহুকাল ঘরছাড়া ঘরে ফেরার টান আর নেই স্বাধীনতার স্বপ্ন একটা দুর্জয় স্নেহের মতন তাদের চোখে লেগে আছে–তারা আর কিছু দেখতে পায় না। নিজেদের ক্ষমতা তারা বোঝে না মনে করে, নিজের প্রাণ দেওয়াই বড় কথা। একটা প্রাণ গেলে আরও দশটা প্রাণ এগিয়ে এসে জায়গা নেবে। এরাই বিভ্রান্ত বিশৃঙ্খল বেয়াল্লিশের ভারতবর্ষে অকস্মাৎ আগস্ট আন্দোলনের ভূমিকা শুরু করে দেয়।
শিয়ালদার মেসে গভীর রাত্রে মিটিং সেরে ব্রজগোপাল এবং তার দলবল ছড়িয়ে পড়লেন ব্ল্যাক আউটের কলকাতায়। এখন ওঁদের গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে হবে। ব্রজগোপাল সূর্যর কাঁধে হাত দিয়ে এ আর পি’র দৃষ্টি এড়িয়ে চুপিসারে হাঁটতে লাগলেন।