ট্রেন থেকে নেমেই দবির মিয়া খবরটা শুনল–সাইফুল ইসলামকে বিশ বার কানে ধরে ওঠ-বস করা হয়েছে।
সে একটা কাণ্ড দবির ভাই, বাজারের সব লোক আসছিল মজা দেখতে। সাইফুল ইসলামের কান্দন যদি দেখতেন। হা-হা-হা-।
বিষয় কি?
আর বলেন কেন, মেয়েছেলেদের কাছে লেখা খারাপ খারাপ চিঠি পাওয়া গেছে। চৌধুরী সাহেবের কাছে সব আছে।
কানে ধরে উঠ-বস করিয়েছে কে?
সালিসি হয়েছে। চৌধুরী সাহেব ছিলেন। থানাওয়ালারা ছিল। মোক্তার সাব ছিল। সরদার বাড়ির লোকও ছিল। ধুন্ধুমার কাণ্ড।
দবির মিয়া নিজের দোকানে এসে পৌছাবার আগে আরো তিন বার সমস্ত ব্যাপারটা শুনল। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করছে, ব্যাপার শুনছেন নাকি?
হুঁ, শুনেছি।
কানে ধরে উঠ-বস করয়েছে। হা-হা-হা।
শুনেছি।
আর কান্দা যদি দেখতেন। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যান। চিঠি সব। আছে তাঁর কাছে।
চিঠি দিয়ে আমি করব কি?
আপনার মেয়ের কাছে লেখা চিঠিও তো থাকতে পারে। সেও তো গান শিখেছে।
দবির মিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলে কি।
কোনো ভদ্রলোকের ছেলে এমন চিঠি লেখতে পারে। চিঠিতে হাত দিলে হাত দেওয়া লাগে সাবান দিয়ে, বুঝলেন। হা-হা-হা।
সন্ধ্যার পর দবির মিয়া চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। চৌধুরী সাহেব বললেন, ঘটনা শুনেছ?
জ্বি, শুনলাম।
অনেকে বলছিল মাথা কামিয়ে দিতে। সেটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।
যেটা করেছেন, সেটাই বিরাট বাড়াবাড়ি হয়েছে চৌধুরী সাব।
বল কি তুমি দবির।
নিজের ঘরে বসে চিঠি লিখেছে, তাতে কী যায় আসে?
পড়ে দেখ তুমি। তোমার মেয়ের কাছে লেখা চিঠিও আছে।
থাকুক। চিঠি তো সে পাঠায় নাই।
চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, সব চিঠি যে পাঠায় না, তা-ও ঠিক না। থানাওয়ালাদের কাছে দুইটা চিঠি লিখেছে। পত্রিকা অফিসে লিখেছে। আমার কাছে লিখেছে।
আপনার কাছে কী লিখেছে?
আমি নাকি খুনখারাবি করি। আমি নাকি বুড়া শয়তান। ছোটলোকের আস্পর্ধা দেখ!
চৌধুরী সাহেব একদলা থুথু ফেললেন। তাঁর ভাব দেখে মনে হল পুরনো শক্তিসামৰ্থ্য ফিরে পাচ্ছেন। তিনি শক্ত সুরে বললেন, একে আমি নীলগঞ্জ ছাড়া করব। আমার সাথে ফাইজামি।
দবির মিয়া বাড়ি ফিরল অনেক রাত্রে। ঘর অন্ধকার। ইলেকট্রসিটি নেই। রান্নাঘরে শুধু হারিকেন জ্বলছে। জহুর বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল। দুলাভাইকে দেখে ফেলে দিল। দবির মিয়া শান্ত সুরে বলল, বাজারের ঘটনা শুনেছ?
জি, শুনেছি।
বাজারে গিয়েছিলে?
জ্বি-না।
দবির মিয়া বেঞ্চির উপর বসল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এত বড়ো একটা অন্যায় হয়েছে, আর তুমি কিছুই করলা না?
জহুর চুপ করে রইল।
তুমি মাছের মতো হয়ে গেছ জহুর।
জহুর জবাব দিল না। দবির মিয়া দীর্ঘ সময় অন্ধকারে বসে রইল। একটি সিগারেট ধরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল, সব মানুষ মাছের মত হলে বাঁচা যায় না। দুএক জন অন্যরকম মানুষ লাগে। জহুর অস্পষ্টভাবে কী বলল, পরিষ্কার বোঝা গেল না।
টুনী এসে বলল, ভাত দেওয়া হয়েছে বাবা।
দবির মিয়া নড়ল না, বসেই রইল।