অনেক চেষ্টা করেও অতীন জ্বর কিংবা কোনো শক্ত অসুখ বাধাতে পারেনি, কিন্তু গেঞ্জি গায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তার এমন ঠাণ্ডা লেগেছে যে বুকে সর্দি বসে গেছে। সে ঘঙ ঘঙ করে কাশে, একবার কাশি শুরু হলে আর থামতে চায় না। এদিককার ঠাণ্ডা একবার লেগে গেলে আর ছাড়তে চায় না সহজে। সাধে কি আর এদেশের লোক এত জামা কাপড় পরে থাকে! একমাত্র রোদ পোহাবার সময় এরা পোশাকের জবরজং থেকে মুক্ত হয়।
শীতকালে ঠাণ্ডা লাগেনি অতীনের, লেগে গেল বসন্তকালে। সকালবেলা বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না, দুর্বল লাগে শরীরটা। কেউ কি এক কাপ চা নিয়ে এসে তার ঘুম ভাঙাবে? সে বিছানা না ছাড়লে কেউ তাকে ডাকবেও না। কেউ ফোনও করবে না। শর্মিলা ছাড়া আর তো কেউ চেনা নেই এখানে। সে যদি এই বিছানায় শুয়ে হঠাৎ হার্ট ফেইলিয়রে মারা যায়, তা হলে যতক্ষণ না এ ঘর থেকে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে…
অতীন উঠে স্টোভ জ্বালিয়ে কেটলি বসালো। চা বানাবার অনেক ঝামেলা, টি-ব্যাগে ঠিক মতন স্বাদ হয় না, তাই সে কফি খায়। তার ঘরে ফ্রিজ নেই, তাই দুধও থাকে না। নিচের রান্নাঘর পর্যন্ত কে যাবে, দুধ ছাড়া কালো কফিই চালিয়ে দেয় অতীন।
অ্যামেরিকানদের মতন পর পর তিন চার কাপ কফি না খেলে তার শরীরটা ধাতস্থ হয় না। তারপর দিনের প্রথম সিগারেট। সেটা ধরানোমাত্র কাশির দমক শুরু হয়ে যাবে, তবু না ধরিয়েও তো উপায় নেই। বাথরুম যাওয়ার আগে সিগারেট ধরানো অভ্যেস হয়ে গেছে।
বুকে হাত দিয়ে কাশতে লাগলো অতীন। আগের দিন এত কাশি হয়েছিল যে পিঠটা ব্যথা হয়ে আছে। কোনো রকম ওষুধ খাচ্ছে না অতীন। সর্দি কাশির আবার ওষুধ কী? দেশে থাকতে, ছোটবেলায় কখনো বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে মা নানারকম জিনিস মিশিয়ে সেদ্ধ করে একটা পাঁচন বানাতো, সেটা গরম গরম খেতে হতো। স্বাদটা বেশ ভালোই লাগতো। তালমিছরি আদা গোলমরিচ ছাড়া আর কী কী থাকতো কে জানে! অতীন সুপার মার্কেট থেকে খানিকটা টাটকা আদা কিনে এনেছে, তারই একটা টুকরো মুখে দিল।
মায়ের একটা চিঠি এসেছে গতকাল। এ পর্যন্ত অন্তত সাতবার পড়া হয়েছে চিঠিটা, অতীন আর একবার চোখ বুলোলো। চিঠিটাতে যে বিশেষ কোনো খবর আছে তা নয়, মায়ের চিঠিতে কোনো অভিযোগ, আফসোসও থাকে না। এমনি, অতীন বুঝতে পারে, মা ইচ্ছে করে কলকাতার কোনো খারাপ খবরও লেখে না। প্রত্যেক চিঠির শেষে মা লেখে, আমরা সবাই বেশ ভালো আছি। তুমি ভালো থেকো, শরীরের যত্ন নিও।
অতীন উত্তর না দিলেও মায়ের চিঠি আসে প্রত্যেক সপ্তাহে। অতীন প্রায় পনেরো কুড়ি দিন বাড়িতে চিঠি লিখতে পারেনি। মা অতীনের এই বস্টনের নতুন বাড়ির একটা ছবি পাঠাতে অনুরোধ করেছে। একটা শস্তায় ক্যামেরা কিনে কিছু ছবি তুলতে হবে।
সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছোতে হবে ইস্কুলে। এখানে প্রায় সবাই ইউনিভার্সিটিকে স্কুল বলে। সিদ্ধার্থ ঠাট্টা করে বলে, তোর তো আর বয়েস বাড়লো না, ইস্কুলের পড়াশোনা মন দিয়ে করিস! শরীর খারাপ লাগলেও অতীনের না গিয়ে উপায় নেই, সকালের দিকটায় তাকে ল্যাব-অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করতে হয়, কামাই করা চলে না। আধ ঘণ্টা দেরি করে গেলেও মাইনে কাটে। অতীনের কাছে এখন প্রতিটি ডলার মহা মূল্যবান।
হাতঘড়িটা পরে নিয়ে অতীন বাথরুমে গেল। খবরের কাগজ আনতে গেলে নিচে যেতে হবে, আর নিচে যেতে হলে গায়ে ড্রেসিং গাউন জড়াতে হবে কিংবা পুরো প্যান্ট শার্ট পরে নিতে হবে। অতীনের ড্রেসিং গাউন নেই, শ্লিপিং সুট নেই, সে এখনো দেশ থেকে আনা পাজামা-গেঞ্জি পরে শোয়। এই পোশাকে নিচে নামা বাড়িওয়ালা পছন্দ করেন না। খবরের কাগজের বদলে অতীন একটা ডিটেকটিভ বই নিয়ে গেল টয়লেটে, কিন্তু তাতেও এক বিন্দু মন বসলো না।
ঠিক আটটা দশে দাড়ি কামিয়ে, জুতো মোজা পরে অতীন নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। একতলায় সোমেনের ঘরে গীটারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মৃদু গলায় গান গাইছে সোমেন। একটুখানি দাঁড়িয়ে গানটা শুনলো অতীন, তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। এই গানের কথা যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই : মন তুই পড়গা ইস্কুলে, নইলে কষ্ট পাবি শেষ কালে, পড়গা ইস্কুলে…। সোমন এইসব ফোক সঙই ভালো গায়, একদিন ওর ঘরে বসে ভালো করে গান শুনতে হবে।
সাইকেলটা বারান্দা থেকে নামালো অতীন। ঠিক পনেরো মিনিট লাগল তার পোঁছোতে। বাইরের হাওয়ায় প্রথম ঝাঁপটাতেই তার কাশি শুরু হলো। কাশতে কাশতে যেন গলা চিড়ে যায়, কিন্তু রক্ত পড়েনি এখনও।
শর্মিলা বস্টনে ফিরে এসেছে, অতীন জানে। তবু শর্মিলা একবারও যোগাযোগ করেনি। অতীনের সঙ্গে। শর্মিলার মতন মেয়েও যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে, তা আগে কল্পনাই করা যায়নি। অতীনকে সে সরাসরি অবজ্ঞা করছে, যেন অতীন একটা মানুষই না, তার সঙ্গে একটা। কথাও বলা যায় না। শর্মিলার কাছাকাছি থাকতে পারবে বলেই অতীন এখানকার এই কাজটা নিয়েছে, এর থেকেও আর একটা ভালো অফার সে পেয়েছিল ফিলাডেলফিয়ায়। এখন শর্মিলা তার মুখও দেখতে চায় না।
ঠাণ্ডামাথায় অতীন অনেক ভেবে দেখেছে, শর্মিলার হঠাৎ এইরকম ভাবে বদলে যাবার কারণ কী হতে পারে? একটাই কারণ থাকা সম্ভব, শর্মিলা হঠাৎ উপলব্ধি করেছে যে অতীন একজন খুনী, তার সঙ্গে মেলামেশা করা বিপজ্জনক। সেই ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে অতীন একটা কুড়োনো খবরের কাগজ পড়ছিল, তাতে অনেক খুন জখমের কথা ছিল, একটা সদ্য খুন হওয়া মেয়ের ছবিও ছিল, সেই কাগজটা দেখেই শর্মিলার ভাবান্তর হলো। তখনই কি শর্মিলা ভাবলো যে অতীনও তার গলা টিপে মেরে ব্রীজ থেকে জলে ফেলে দিতে পারে? একবার যে খুন করে, সে খুনীই থেকে যায়?
অতীন ঐ ব্যাপারটা শর্মিলার কাছে একটুও লুকোয়নি। উত্তর বাংলার একটা ফাঁকা মাঠে মেঘলা বিকেলে একজন সমাজবিরোধীর দিকে কেন রিভলভার চালিয়েছিল, তা অতীন অনেকবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলেছে। সেই লোকটা আগে বোমা চার্জ করেছিল, তারপর লোহার ডান্ডা দিয়ে মারতে এসেছিল, সে ছিল প্রকৃত খুনী, মানিকদাকে খতম করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য, অতীনকেও ছাড়তো না, সেই লোকটার হাতে অসহায়ভাবে প্রাণ দেওয়াটাই ছিল গৌরবের? শর্মিলা প্রত্যেকবার শুনে বলতো, বেশ করেছো, তুমি ঠিকই করেছো, একটা পাগলা কুকুর কামড়াতে এলে তাকে মেরে ফেলা মোটেই দোষের নয় …কোর্টে মামলাটা সাজানো হয়েছিল অন্যভাবে, ষড়যন্ত্রের রঙ দেওয়া হয়েছিল গাঢ় ভাবে, একজন কলেজের অধ্যাপক। হয়েও অতীন ঐ নির্জন মাঠে রিভলভার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কেন, সেই প্রশ্নই তোলা হয়েছিল বারবার। কিন্তু শর্মিলা অতীনকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিল। সেই বিশ্বাস তার ভেঙে গেল একটা রগরগে খবরের কাগজের ছবি দেখে! অতীনকে সে এখন ভয় পায়। মেয়েরা এমন বদলে যায়! অতীনের সঙ্গে এতদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সে অস্বীকার করলো একেবারে?
যাক, চুলোয় যাক, শর্মিলাকে সে মন থেকে মুছে ফেলবে একেবারে। একটু সময় লাগবে, এখনো নামটা মনে পড়লেই বুকটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে, তার নিজের বিছানায় সে শর্মিলার গন্ধ পায়…আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অলির কাছে সে অন্যায় করেছে, সেইজন্য তার এই শাস্তি। অলি কোনোদিন তার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করতে পারতো না।
সাড়ে আটটা বাজার দু মিনিট আগে অতীন পৌঁছে গেল ল্যাবে। ছাত্রছাত্রীরা এখনো কেউ আসেনি, অতীন ঝট করে একটা ওভারঅল পরে তৈরি হয়ে নিল। কাজে ডুবে গেলে এসব। কথা আর মনে পড়ে না। অতীনের এখন দুটো উদ্দেশ্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পি-এইচ ডি শেষ করতে হবে, আর দেশে ফেরার জন্য ভাড়ার টাকা জমাতে হবে। টাকাটা যদি আগেই জমে যায়, তা হলে সে পি. এইচ ডি শেষ না করেই পালাবে এই দেশ থেকে।
দেশে যাদের ডেমনস্ট্রেটর বলে, এখানে তাদেরই নাম ল্যাব-টিচার। ফাঁকি মারার উপায় নেই, ছাত্রছাত্রীরা খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মারে। এখানে ছাত্রছাত্রীরাও যে ফাঁকি দেয় না তার কারণ আছে। অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বাবার টাকা নেয় না, নিজেরা উপার্জন করে পড়াশুনোর খরচ চালায়। হোটেল রেস্তোরাঁয় ডিশ ধোয়ার কাজ করে, সুপার মার্কেটে সেলসম্যান বা সেলস গার্ল হয়। অনেকে ছ’মাস চাকরি করে টাকা জমিয়ে বাকি ছ’মাস ইউনিভার্সিটিতে একটা কোর্স পড়ে নেয়। এখানে পড়াশুনোর খরচও যথেষ্ট। একটা সেমেস্টার ফেল করলে আবার দ্বিগুণ টাকা। খরচ করতে হবে এই ভয়ে এরা দিরাত খেটে “স করার চেষ্টা করে।
তিনটি ভারতীয় ছাত্রও আছে এখানে। তাদের পড়াশুনোর প্রতি নিষ্ঠা দেখলে দেশের মা বাবারা হাঁ হয়ে যাবে। এরা তিনজনেই পার্ট টাইম চাকরি করে পড়ছে, দৈত্যের মতন খাটে। নিজেদের উপার্জন করা পয়সায় পড়তে হচ্ছে বলেই এদের পাস করার এত গরজ। অথচ দেশে থাকতে এইসব ছেলেরাই বাপ-মায়ের আদরের দুলাল, হোটেলে বাসন মাজার চাকরির কথা কল্পনাও করতে পারে না। এদের মধ্যে একটি ছাত্রের নাম ভূপিন্দর সিং, সে এক ধনী পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীর ছেলে, কিন্তু অতীন তাকে দেখেছে ম্যাকডোনাল্ডের দোকানে মাথায় টুপি পরে রান্না ঘরে আলু ভাজার কাজ করতে।
সর্দিকাশির জন্য অতীন একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে। কাশি উঠলে চেপে রাখা যায় না, আবার ল্যাবের ভেতরটায় কনকনে ঠাণ্ডা বলে নাক দিয়ে পাতলা সর্দিও গড়াচ্ছে। রুমালে কুলোচ্ছে। না। শ্রাদ্ধ হচ্ছে টিসু পেপারের। কাশির শব্দ শুনে পাশের ডেস্কের জুড়ি বড় বড় চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে।
অ্যামেরিকানদের দারুণ স্বাস্থ্যবাতিক। কারুর সর্দি হলে অন্য কেউ তার হাতটা পর্যন্ত ছোঁয়। নিঃশ্বাসের দুরত্বের থেকেও দুরে থাকে। জুডি অন্যদিন তার টেবল থেকে এটা সেটা জিনিসপত্র নেয়, মাঝে মাঝে হেসে গল্প করে। আজ অতীন প্রথম দর্শনে হাই জুডি, হাউ হ্যাভ ইউ বীন, এইটুকু শুধু বলেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছে। এ দেশে যখন তখন ছুটি নেবার প্রশ্নই ওঠে না, সর্দি হয়েছে বলে অতীন তো আর তার মাইনে খোয়াতে পারে না!
জুড়ি মেয়েটি বেশ লম্বা, পাঁচ ফুট আট ন’ইঞ্চি তো হবেই, অতীনের প্রায় মাথায় মাথায় সমান। সুতরাং মেয়েদের তুলনায় সে যথেষ্টই লম্বা, কিন্তু ধ্যাঙ্গো নয়, স্বাস্থ্যটিও ভালো, তাকে অনায়াসেই দৈত্যবংশের কন্যা বলা যায়। মাথার চুল ভালো করে আঁচড়ায় না জুড়ি, সাজ-পোশাকেরও কোনো যত্ন নেই।
এখানে স্টিভ নামে আর একজন ল্যাব টিচার আছে, তার সঙ্গে অতীনের মোটামুটি ভাব আছে। পড়াশুনোয় খুব তীক্ষ্ণ, কিন্তু স্টিভ মাঝে মাঝে বেশ খারাপ কথা বলতে ভালোবাসে। স্টিভ একদিন বলেছিল, বেচারা জুডির কোনো বয় ফ্রেন্ড নেই কেন জানো? ওর সঙ্গে কেউ ডেটিং করে না, এর কারণ, অত লম্বা মেয়ের পাশাপাশি হাঁটতে কোনো ছেলে পছন্দ করে না। ছেলেরা চায়, মেয়েদের মুখটা তাদের বুকের কাছাকাছি থাকবে, চুমু খাওয়ার সময় মেয়েরা মুখটা ওপরের দিকে তুলবে, ছেলেরা মুখটা নামিয়ে আনবে, দ্যাট ইজ দা আইডিয়াল পজিশান, মেয়েদের লোয়ার পোরশান কিন্তু ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশী লম্বা হয়, সেটা দেখেছো তো! সেইজন্য আলিঙ্গনের সময় বেঁটে মেয়েদের অ্যাবডোমেনও ছেলেদের সঙ্গে ঠেকে থাকে।
স্টিভ বেচারি অবশ্য বেশ বেটে, জুডির তুলনায় অনেকখানি ছোট লাগে। জুডির কাছে প্রেম জানিয়ে সে কখনো ব্যর্থ হয়েছে কি না কে জানে! শুধু লম্বা বলেই জুডির ওপর তার বেশ রাগ। অবশ্য স্টিভের বান্ধবীর সংখ্যা একাধিক।
স্টিভ অতীনের তুলনায় এক বছরের বেশী অভিজ্ঞ। কাজের ব্যাপারে অতীনকে মাঝে মাঝে স্টিভের সাহায্য নিতে হয়। স্টিভ ভারতীয় পুরাণ ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহী। ওপেন হাইমারের সূত্র ধরে এ দেশের বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে ভগবদ গীতা বইটির নাম মোটামুটি পরিচিত। স্টিভ কখনো গীতা বিষয়ে প্রশ্ন করলে অতীন হকচকিয়ে যায়। সে গীতা টিতা পড়ে নি কক্ষনো, তাদের বাড়িতেও এ সবের চর্চা ছিল না।
লাঞ্চ আওয়ারে অতীন কোনোরকমে গোটা দুয়েক সান্ডউইচ খেয়ে নিয়ে লাইব্রেরিতে খবরের কাগজ পড়তে যায়। যে-সব দোকানে আগে সে শর্মিলার সঙ্গে কখনো কখনো খেতে গেছে, সে-সব দোকানের ধারেকাছেও সে ঘেঁষে না। শর্মিলার মুখোমুখি পড়তে চায় না সে। লাইব্রেরিতে লুকিয়ে বসে থাকে। ভারতীয় সংবাদপত্রও যে এখানে পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে তার আগে কোনো ধারণাই ছিল না। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে এমনকি বাংলা কাগজও পাওয়া যায়, একদিন সে আনন্দবাজার দেখেছে। কত দেশের কাগজই যে এরা রাখে!
নিজেদের লাইব্রেরিতে বসে সে স্টেটসম্যানের ওভারসীজ এডিশান পড়ে। এতদিন অতীন যেন ইচ্ছে করেই দেশের খবর রাখতে চায়নি। সে নিবাসিত, সেই অভিমানে সে মহাসমুদ্রের ওপারের দেশের দিকে ফিরে তাকাতে চায়নি আর। দমদম জেলে পনেরোজন নকশাল খুনের খবরটা শোনার পর থেকে সে আর স্থির থাকতে পারছে না। মানিকদা কিংবা কৌশিক তাকে এ পর্যন্ত একটা চিঠি লেখেনি, অলির চিঠিও আসেনি বেশ কিছুদিন। দেশ ছাড়ার সময় কৌশিক তাকে বলেছিল, তুই আমাদের চিঠি লিখিস না, আমরা কখন কোথায় থাকবো তুই জানতে পারবি না, কিন্তু আমরা লিখবো। অলির কাছ থেকে ঠিকানা যোগাড় করে আমরা তোকে নিয়মিত সব খবর দেবো। কথা রাখেনি কৌশিক।
দেশের খবরের কাগজে পাকিস্তান বাংলাদেশের খবরই এখন বেশী থাকছে। পশ্চিমবাংলায়, অন্ধ্রে, পাঞ্জাবে বিপ্লবের প্রস্তুতিও চাপা থাকছে না। পশ্চিমবাংলায় রিভলভার বন্দুক কাড়া চলছে নিয়মিত। জোড়াতালি দেওয়া সরকার ভেঙে এখন সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন। বীরভূমের সব থানার ও সি বদলি করা হয়েছে। অতীনের বরাবরই ধারণা ছিল বীরভূম আর মেদিনীপুরে তাদের শক্ত ঘাঁটি হবে। কানু সান্যাল, অসীম, সন্তোষদের নামের উল্লেখ থাকে মাঝে মাঝে, মানিকদা-কৌশিকদের কোনো খবর পাওয়া যায় কি না, অতীন। তন্ন তন্ন করে খোঁজে।
গতকাল এ দেশের সংবাদপত্রে একটা বড় খবর বেরিয়েছে। অধিকাংশ কাগজেই হেড লাইন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিকসনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। হেনরি কিসিংগার গোপনে গিয়েছিল পাকিস্তানে। পাকিস্তানের মাধ্যমেই চীনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এই জন্যই পাকিস্তান সরকারের প্রতি কিসিংগার-নিকসনের এত দরদ!
খবরটার মর্ম ঠিক বুঝতে পারেনি অতীন। চীন এতকাল বলে এসেছে যে শোষিত দুনিয়ার এক নম্বরের শত্রু হলো আমেরিকান সরকার। সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো চীন? মাও সে তুং এই লোকটার সঙ্গে হেসে কথা বলবেন? শুধু তাই নয়, চৌ এন লাই বিবৃতি দিয়েছেন যে শান্তিপূর্ণ পথেই বিশ্বের সমস্যাগুলির সমাধান করতে হবে।
শান্তিপূর্ণ পথ! চৌ এন লাই হঠাৎ গান্ধীবাদী হয়ে গেলেন নাকি?
সন্ধেবেলা নিজে ল্যাবে কাজ করার বদলে অতীন বাড়ি ফিরবে ঠিক করলো। হঠাৎ শনশনে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। সমুদ্রের ধারের শহরের এই একটা মুশকিল, আবহাওয়ার স্বভাব চরিত্র ঠিক থাকে না। আকাশের অবস্থা ভালো নয়, রাত্তিরে বৃষ্টি হতে পারে। চমৎকার রোদ চলছে ক’দিন, এখন বৃষ্টি হলে আবার মন খারাপ লাগবে।
বাড়ি ফিরে আবার রাত্তিরের খাওয়ার জন্য বেরুবার কোনো মানে হয় না। একটা দোকান থেকে অতীন কিছু ব্রাউন ব্রেড, মাখন আর স্যালামি কিনে নিল। এতেই চলে যাবে। অন্তত দিন সাতেক অতীন বীয়ার কিংবা মদ কেনেনি, পয়সা বাঁচাতে হচ্ছে। প্রতিটি ডাইম গুনে গুনে খরচ করবে। ড্রাইভিং লেন নেওয়াও আপাতত বন্ধ, গাড়ি-ফাড়ি কেনার কোনো দরকার নেই, সাইকেলেই বেশ চলে যাচ্ছে। গাড়ি কেনার কথা সে ভেবেছিল শর্মিলার জন্য। শর্মিলা বেড়াতে ভালোবাসে।
হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়লো অতীনের। টানা আট দিন সে একবারও ভাত খায়নি। মা জানতে পারলে আঁতকে উঠতো। দেশে থাকতে অতীন অসুখ-বিসুখ হলেও রুটি খেতে চাইতো না। অতীন বেশী রাত করে ফিরলেও মা ভাত গরম করে দিত।
অতীন নিজে এখন ভালোই রান্না করতে পারে। শিলিগুড়িতে মানিকদাদের সঙ্গে থাকবার সময় রান্না শিখেছিল, নিউ ইয়র্কে সিদ্ধার্থর কাছে থাকবার সময় তো রান্নার পুরো দায়িত্বই ছিল তার ওপর। এখানেও সে শর্মিলাকে স্যামন মাছের ঝোল রেধে খাইয়েছে। এখানে পাওয়া যায় তো সব কিছুই। অনেকরকম মাছ, নানা ধরনের তরকারি, বেগুন আর ফুলকপিগুলো বিরাট বিরাট, আর মুসুরির ডালের চমৎকার স্বাদ। মুসুরির ইংরিজি যে লেনটিল সেটা অতীন জানতো না আগে, ইটালিয়ানরা খুব লেনটিল সুপ খায়, সেটা তো প্রায় সম্ভার না দেওয়া মুসুরির ডাল সেদ্ধ! আর একটা ইংরিজি ভুল শেখানো হয় দেশের ছেলেমেয়েদের, অতীনও শিখেছিল বেগুনের ইংরিজি ব্রিঞ্জাল! অথচ এ দেশে বেগুনকে বলে এগপ্ল্যান্ট, ব্রিঞ্জাল বললে কেউ বোঝেই না। দইকেও কেউ কার্ড বলে না। বলে ইউগার্ট। এ দেশের দইয়ের স্বাদ বড় ভালো।
শুধু নিজের জন্য কি আর রান্না করতে ইচ্ছে করে! স্টিভ বলেছিল, ওকে একদিন ভারতীয় খাবার খাওয়াতে। কোনো একটা ছুটির দিন দেখে স্টিভকে নেমন্তন্ন করে অতীন ভাত রাঁধবে। কিংবা স্টিভকে খিচুড়িও খাওয়ানো যায়।
একটা মাফলার কিংবা স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। সাইকেলটা একটু জোরে চালাতে গেলেই বেশ শীত শীত করছে আর কাশি হচ্ছে। সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে লাগলো অতীন, তার এমন কিছু তাড়া নেই।
একটু পরেই সে দেখতে পেল, উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছে জুডি, তার দুহাতে দুটি বেশ পেল্লায় শপিং ব্যাগ, তাছাড়া বেশ কয়েকখানা বই ও পত্রিকা, রীতিমতন ব্যালান্স করে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। জুডি বোধ হয় এক সপ্তাহের বাজার করে ফেলেছে।
দেখা মাত্রই অতীন বললো, হাই জুড়ি! মে আই ক্যারি ইয়োর ব্যাস?
এটা প্রায় অভ্যেস বশেই বলা। চেনা কোনো মহিলাকে ভারী ভারী বোঝা বহন করতে দেখলে যে-কোনো পুরুষই এমন প্রস্তাব দেবে।
জুডি বললো, তুমি একটা ব্যাগ ধরো তা হলে, আটিন্!
অতীন দু’টো শপিং ব্যাগই ঝুলিয়ে নিল তার সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলে। তারপর বললো, চলো, তোমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি।
জুডি বললো, আমার বাড়ি বেশী দূর নয়। তোমার কোনো তাড়া ছিল না তো?
অতীন দু’দিকে মাথা নাড়লো। তারপর বললো, দেখছো, আজ রাত্তিরে বোধ হয় আবার বৃষ্টি আসবে।
জুডি বললো, আই লাভ ইট! বিশেষত রাত্রে বৃষ্টির শব্দ আমার খুব ভালো লাগে।
অতীন একটু অবাক হলো। এটা একটু অন্যরকম কথা। এ দেশের কোনো ছেলেমেয়েই বৃষ্টি পছন্দ করে না। এরা রৌদ্র-প্রিয়।
জুডি জিজ্ঞেস করলো, তুমি ভারতীয় হয়ে বৃষ্টি ভালোবাসো না? তোমাদের দেশে তো এখন বৃষ্টির সিজন শুরু হয়ে গেছে। আমার জন্ম ইন্দোনেশিয়ায়, আমার বাবা ওখানে পোস্টেড ছিলেন, ছেলেবেলায় আমি খুব বৃষ্টি দেখেছি।
অতীন বললো, আমাদের দেশে বৃষ্টিতে ভিজলে এরকম চট করে ঠাণ্ডা লাগে না।
জুডি বললো, ওঃ হো, আজ তো সকালে তোমার রানিং নোজ দেখেছি। খুব ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসেছো বুঝি?
অতীন শঙ্কিত বোধ করলো। এই রে, সর্দি-নাকে সে জুডির পাশাপাশি হাঁটছে, এটা তো ঠিক হয়নি! জুডির শপিং ব্যাগ সে হাতে ছুঁয়েছে, তাতে সব কিছু অশুচি হয়ে যাবে না তো?
জুডিকে দেখে সাহায্য করার সময় এই কথাটা তার মনেই ছিল না। জুডিও তো আপত্তি করলে। পারতো।
জুডি বললো, তুমি কিছু ওষুধ খেয়েছো?
–ওষুধে কি সর্দি সারে?
–তা সারে না বটে! হ্যাভ ইউ ট্রায়েড গ্ৰগ?
–গ্রগ? সেটা আবার কী?
–একটা কনককশান। দু’বছর আগে আমি যখন ফ্রান্সে গিয়েছিলাম, তখন আমারও খুব ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছিল। শীতকালে ঠাণ্ডা লাগে না, এইরকম ওয়েদারেই অসাবধান থাকলে চট করে বুকে ঠাণ্ডা বসে যায়, তখন ওখানে এগ খেয়ে বেশ উপকার পেয়েছিলাম।
অতীন ভাবলো, এখানকার ছেলেমেয়েরা গোটা পৃথিবীটাকেই হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। জুডির জন্ম ইন্দোনেশিয়ায়, এক সময় ফ্রান্সে গিয়েছিল, কিছু দিন সে সাউথ আমেরিকায় ছিল, তা অতীন আগেই শুনেছে, সেইজন্য সে স্প্যানীশ ভাষা জানে। অনেক
ছেলেমেয়েই পৃথিবীর এদিক-ওদিক ঘুরে এসেছে।
জুডির বাড়ি কাছেই একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে। তিনতলা বাড়ির ওপরের তলায় থাকে জুডি। পর্চে ব্যাগ দু’টো নামিয়ে রাখলে জুডি দু’বারে এসে নিয়ে যেতে পারবে। অতীন বললো, গুড নাইট, জুডি। সী ইউ টুমরো!
জুডি বললো, খুব যদি ব্যস্ত না থাকো, ওপরে এলে তোমাকে আমি গ্ৰগ খাওয়াতে পারি।
অতীনের এত সর্দি জেনেও যে জুড়ি তাকে ওপরে ডাকলো, এতে সে কৃতজ্ঞ বোধ করলো। তা হলে ওপরে না যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই!
সাইকেলটা ওপরে তুলে তালা দিয়ে সে দু’টো ব্যাগই নিয়ে উঠে এলো তিনতলায়। জুডির ঘরটা প্রায় ঠিক তার ঘরেরই মতন অ্যাটিকে। অতীনের চেয়েও এলোমেলো স্বভাব জুডির, মেঝেতে পর্যন্ত বইপত্র ছড়ানো, বিছানার ওপর ব্রা, প্যান্টিহোস। সারা ঘরে মেয়েলি গন্ধ।
অত বড় চেহারা জুডির, মনে হয় যেন তার মাথা ছাদে ঠেকে যাবে, তার হাঁটার সময় কাঠের মেঝেতে দুম দুম শব্দ হয়। দ্রুত হাতে জিনিসপত্র কিছুটা সাফসুতরো করে জুডি বললো, বসো, আটি। আমার ঘরে অনেকদিন কেউ আসেনি! তুমি এখানে সিগারেট খেতে পারো। অ্যাশট্রে নেই, একটা সসার দিচ্ছি।
ঘরে একটাই আরাম কেদারা, তার খোলের মধ্যে অনেক বই-খাতা। খাটে না বসে অতীন। বই-খাতা সরিয়ে সেই চেয়ারেই বসলো। এক পাশে পদ না-টানা অনেকখানি কাচের জানলা। সারা দেয়ালে প্রচুর ছবির প্রিন্ট সাঁটা, তার মধ্যে অতীন একটাই চিনতে পারলো ভ্যান গঘের ‘সূর্যমুখী’। আগে অতীন বিদেশী চিত্রকলা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতো না। এখন খানিকটা বুঝতে শিখেছে। এ দেশের বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরাও ছবি-গান-সাহিত্য সম্পর্কেও মোটামুটি খবর রাখে।
কাবার্ড থেকে একটা জামাইকান রামের বোতল বার করে জুড়ি জিজ্ঞেস করলো, তোমার অ্যালকোহল পান করার অভ্যেস আছে তো? তুমি কি অধিকাংশ ভারতীয়ের মতই নিরামিষাশী?
অতীন বললো, ভারতীয়দের মধ্যে আমরা আবার বাঙালী। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমাদের বিশেষ বাছ-বিচার নেই। তাঁ, অ্যালকোহলও আমার সহ্য হয়।
জুডি বললো, তা হলে এগ বানানোটা শিখে নাও!
একটা ছোট সসপ্যানে সে খানিকটা রাম ঢাললো। তাতে মেশালো কয়েক চামচ চিনি। তারপর দিল একটুখানি গোলমরিচ। এবার তাতে কিছুটা জল মিশিয়ে সপ্যানটা রাখলো জ্বলন্ত স্টোভে। একবার ফুটে উঠতেই নামিয়ে নিয়ে সে সেই তরল পদার্থটি একটা গেলাসে ঢেলে বললো, একটু একটু চুমুক দিয়ে পান করো, গরম থাকতে থাকতে।
দু’তিনবার চুমুক দিয়েই অতীনের মুখে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠলো। তার মা তালমিছরি-আদা দিয়ে যে পাঁচনটা বানাতো, এর স্বাদও অনেকটা সেইরকম। সর্দির সময় মিষ্টি গরম কিছু খেতে হয়, আইডিয়াটা একই।
কিন্তু এই কথাটা জুডিকে বলা যাবে না। মায়ের কথা তুললেই সে ভাববে যে তার বয়েস সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। এ দেশের মেয়েরা বয়েস সম্পর্কে বড় স্পর্শকাতর।
সে বললো, চমৎকার হয়েছে তো! খেতে খুব ভালো লাগছে।
জুডি বললো, মাঝে মাঝে বানিয়ে খেয়ো। কাশি অনেক কমে যাবে।
অতীন বললো, আমি এ দেশে এসে আগে কক্ষনো রাম খাইনি। তুমি বুঝি জ্যামাইকান রাম ভালোবাসো?
জুডি বললো, আমি রাম খাই না, স্কচ বারবান খাই না, আমি পারতপক্ষে হার্ড ড্রিংক্স খেতে চাই না। তবে রাম, ব্র্যান্ডি বাড়িতে রাখি, অনেক রান্নার রেসিপিতে লাগে। রান্না করা আমার শখ। রান্নাও তো কেমিস্ত্রি, তাই না? তুমি আজ আমার সঙ্গে খেয়ে যাও না, আটি। আমি এখন রান্না করবো।
অতীন বললো, আমার খাবার কিনে এনেছি। নষ্ট হবে।
–নষ্ট কেন হবে, ফ্রিজে রেখে দিও। এরপর তুমি একদিন আমাকে রান্না করে খাইয়ো। আমি অবশ্য ইন্ডিয়ান রান্না দু’একটা জানি। লন্ডনে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় কারি খেয়েছি, সেখান থেকে কারি রান্নাও শিখে নিয়েছি। তুমি ওয়াইল্ড রাইস খেয়েছো?
–না। নাম শুনেছি বটে। সত্যি ওয়াইল্ড রাইস কিনতে পাওয়া যায়?
–হ্যাঁ, দাম একটু বেশী। ওয়াইল্ড রাইস-এর সঙ্গে কর্ড বীফের একটা খুব ভালো প্রিপারেশান হয়। আমি রান্না শুরু করি, তুমি আমার সঙ্গে গল্প করো, আমাকে ইন্ডিয়ার গল্প বলো!
গ্ৰগ পান করতে করতে অতীনের খুব গরম লাগছে, ঘামের বিন্দু ফুটে উঠেছে কপালে। তা দেখতে পেয়ে জুডি বললো, এই তো তুমি ঘামছে, অর্থাৎ তোমার কাজ হচ্ছে। দাঁড়াও, ঘাম মোছার জন্য তোমাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, না, না, রুমাল ব্যবহার করো না, একটু ধৈর্য ধরো!
সিঙ্কে গরম জলের কলটা খুলে দিয়ে অনেকখানি জল আগে ছেড়ে দিল জুডি। যখন গরম জল থেকে ধোঁয়া বেরুতে লাগলো, তখন তাতে একটা ছোট ভোয়ালে ভেজাতে লাগলো সে। তার আগে সে দু’হাতে দ্রুত দস্তানা পরে নিয়েছে। মিনিট দু’এক সেই আগুন-গরম জলে তোয়ালেটা ভেজাবার পর চিপড়ে নিয়েই সে সেটা এনে অতীনের মুখে চেপে ধরলো। তারপর খুব যত্ন করে মুছিয়ে দিতে লাগলো অতীনের মুখ।
এত সর্দি হয়েছে জেনেও জুডি তাকে একটুও অবজ্ঞা করছে না, অতি আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করছে। অতীন এরকম স্বপ্নেও ভাবেনি। জুডির সঙ্গে তার ভালো করে ভাবই হয়নি আগে।
তোয়ালেটা ঠাণ্ডা হয়ে যেতেই জুডি আবার সেটা গরম জলে ভিজিয়ে এনে অতীনের মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো, এরকম রোজ দু’তিনবার করবে, দেখবে নাক পরিষ্কার হয়ে যাবে, রাত্রে ভালো ঘুম হবে।
জুডির বিশাল উরুর স্পর্শ লেগেছে অতীনের বাহুতে। এক একবার তার স্তনের ছোঁয়া লাগছে অতীনের মাথায়। অতীন আরামে চোখ বুজে আছে।
এ দেশে আসার পর প্রথম প্রথম, সিদ্ধার্থ যখন জানতো না যে অলি বা শর্মিলার সঙ্গে অতীনের আগে থেকেই সম্পর্ক আছে, তখন সিদ্ধার্থ অতীনকে নানারকম উপদেশ দিত। সিদ্ধার্থ বলেছিল, এ দেশের মেয়েদের সঙ্গে ডেটিং করার নিয়ম কী জানিস? শিখে নে! যখন তখন অসভ্যতা করে ফেলিসনি। ফোনে মেয়ের সঙ্গে ডেট করে তাকে নিয়ে সিনেমায় যেতে পারিস, কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে পারিস, কিন্তু প্রথম দুতিনদিন গায়ে-টায়ে হাত দিস না যেন। মেয়েটি যদি সন্ধের পর বাড়ি পৌঁছে দিতে বলে, বাড়ির দরজায় পৌঁছেই যদি হাত নেড়ে বিদায় জানায়, তা হলে তক্ষুনি চলে যাবি। কিন্তু মেয়েটি যদি সঙ্গে সঙ্গে গুড নাইট না বলে পর্চে দাঁড়িয়ে দু’মিনিট গল্প করে, তা হলে বুঝতে হবে, সে তোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা হলে তাকে একটা চুমু খেতে চাইবি। না, না, গালে-টালে না, গালে চুমু খেলে মেয়েটা তোর সঙ্গে আর কথাই বলবে না, ঠোঁটে চুমু খাবি, মাত্র একবার। হ্যাংলামি করতে নেই প্রথম প্রথম। সেইসময় ঠোঁটে চুমু খেতে না চাইলে মেয়েটি অপমানিত বোধ করবে। তারপর তার রি-অ্যাকশান লক্ষ করবি। চুমু খাওয়ার পরেও মেয়েটি যদি বলে, ওপরে এসো না, আমার ঘরে একটা ড্রিংক নাও, কিংবা একটু কফি খেয়ে যাও, তা হলে বুঝবি, কী বুঝবি? গাড়লের মতন তাকিয়ে আছিস কেন? মেয়েরা একা বেড রুমে ডেকে নিয়ে গেলে সেই বেড রুমের পুরোপুরি ব্যবহার করতে হয়!
সিদ্ধার্থর সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল অতীনের। জুডির সঙ্গে সে ডেট করেনি, এমনিই হঠাৎ রাস্তায় দেখা। পর্চে দাঁড়িয়ে সে জুডিকে চুমু খায়নি, সে প্রশ্নই ওঠে না। জুডি তাকে ওপরে ডেকে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ, জুডি তাকে অনেকক্ষণ থাকতে বলছে। এর কি সত্যিই অন্য কোনো মানে আছে? সেক্স ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক হতে পারে না মেয়েদের
জুডিকে এক একবার তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ঠিকই। কিন্তু এই ইচ্ছেটাও তেমন তীব্র নয়। শর্মিলার ওপর তার যতই রাগ বা অভিমান হোক, শর্মিলার বদলে অন্য কোনো মেয়েকে তেমনভাবে স্পর্শ করতে তার মন চাইছে না। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে শর্মিলার কথা।
এরপর দেড় ঘণ্টা সেখানে রইলো অতীন। আরও এক গেলাস এগ পান করলো। জুডি তাকে বন্য চাল ও মাংসের কিমা দিয়ে নতুন ধরনের একটা রান্না খাওয়ালো, গল্প করলো অনেক। কিন্তু জুডির ব্যবহারে কোনোরকম শারীরিক ইঙ্গিত নেই। অতীনকে সে শুধু একজন বন্ধু বলে ধরে নিয়েছে। এ দেশে নারী ও পুরুষের বন্ধুত্ব হলেই তার মধ্যে বিছানায় স্থান অবধারিত। কিন্তু জুডি যেন সে ব্যাপারটা জানেই না। অতীনের হাত ধরে টেনে সে একবার নিয়ে গেল রান্না ঘরে, কিন্তু চোখে মুখে লাস্য ফোঁটালো না।
বিদায় নেবার সময় তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো জুডি। নির্জন, আধো-অন্ধকার সিঁড়ি, মনে হয় যেন সারা বাড়িতে আর জনপ্রাণী নেই।
জুডি তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললো, তোমার সর্দি অনেকটা সেরে গেছে না?
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে জুডিকে জড়িয়ে ধরলো অতীন। ফিস ফিস করে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ জুডি, থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং!
জুডি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না, আবার চুম্বনের প্রতীক্ষাও রাখলো না ওষ্ঠে। সুন্দর করে হাসলো। অতীনেরও চুমু খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। এই আলিঙ্গনের মধ্যেও অন্য কিছু নেই, শুধু বন্ধুত্বের বন্ধনটা দৃঢ় করা।
বাইরে বেরিয়ে তার মনটা হঠাৎ ভালো লাগলো অনেক দিন পর।