আঠাশ
ঘরের বাইরে এসে চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল স্বজন। একটি সুস্থ মানুষকে সাময়িক সংজ্ঞাহীন করে অপারেশন করা এক জিনিস আর জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দুলতে থাকা একজনকে অপারেশন টেবিলে পাওয়া আর এক জিনিস। দূর্ঘটনায় বিকৃত হয়ে যাওয়া শরীরকে ঠিকঠাক করে একটা আদলে ফিরিয়ে আনার অভিজ্ঞতা তার অনেকবার হয়েছে। কিন্তু এরকম কখনও হয়নি।
এরা যে সমস্ত সহযোগী এনেছিল তারা স্বজনের নির্দেশ পুতুলের মতো মেনেছে। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই তারা নিজেদের মুখ আড়াল করে নিয়েছিল বলে কাউকেই সে বাইরে দেখলে চিনতে পারবে না। চিনবার দরকারও নেই। এখন ভালভাবে কলকাতায় ফিরে যেতে পারলেই হয়।
পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে স্বজন দেখল ত্রিভুবন এগিয়ে আসছে। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল ত্রিভুবন, ‘সব ঠিক আছে?’
স্বজন মাথা নাড়ল। কিছু বলল না।
‘আপনি ইচ্ছে করলে ঘরে ফিরে যেতে পারেন।’
‘আমরা কখন রওনা হচ্ছি?’ স্বজন সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।
‘আপনার তো এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে।’
‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা বুঝিয়ে দিলে নার্সই করতে পারবে। এখন শুধু অপেক্ষা করা যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখের সব দাগ মিলিয়ে যায়।’
‘যদি না যায়?’
‘মানে?’
‘যদি আপনার অপারশনের কোনও চিহ্ন বিশ্রীভাবে ধরা পড়ে?’
‘তা হলে আপনারা আমাকে আনতেন না এখানে।’ স্বজন দৃঢ় গলায় বলল।
‘ঠিক আছে ডক্টর। আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’
স্বজনকে নীচে পাঠিয়ে ত্রিভুবন নীচের তলার একটি ঘরে ঢুকল। সেখানে দুজন টেলিফোন অপারেটর সতর্কভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খবরগুলো শোনার জন্যে বসে আছে। খবর শুনে ওরা যে কাগজে নোট করে রাখে সেটা তুলল ত্রিভুবন। হেডকোয়ার্টার্সে ঢোকার পর মহিলা রিপোর্টার অনীকার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, সম্ভবত তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ডেভিডের মৃতদেহ দেখা যায়নি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেসব বিস্ফোরণ হয়েছে তাতে সরকার পক্ষের মানুষই আহত অথবা নিহত হয়েছে।
এই সময় হায়দার ঘরে ঢুকল, ‘ত্রিভুবন।’
ত্রিভুবন তাকাল। হায়দার বলল, ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই বাড়ি আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তেই ভার্গিসের কাছে এই বাড়ির খবর পৌঁছে যেতে পারে।’
‘তাহলে?’
‘মোটামুটি আগের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করব আমরা। কিন্তু কারফিউ রিলাক্সেশন তুলে নিয়েছে ভার্গিস। আমি তাই সোর্স ব্যবহার করে রাত্রে এখান থেকে বেরুবার ব্যবস্থা করেছি। দুটো দলে আমরা যাব। একদলে দুই ডাক্তার আর ওই ভদ্রমহিলা থাকবেন। অন্যদলে লিডারকে নিয়ে যাওয়া হবে। ভ্যানের মধ্যে বিছানা করে ওকে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ছজন মানুষ ওই ভ্যানে যেতে পারবে। বাকিদের রিলিজ করে দিতে হবে। আমরা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র যারা ওয়ান্টেড নয় তারা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যাক।’ হায়দার বলল।
ত্রিভুবনের ভাল লাগছিল না প্রস্তাব। সে বলল, ‘কারফিউ-এর ভেতরে বাইরে যাওয়া মানে বেশি মাত্রায় ঝুঁকি নেওয়া। তুমি যাদের ম্যানেজ করেছ তাদের বাইরেও ভার্গিসের পুলিশ আছে।’
‘হ্যাঁ ঝুঁকি আছে। কিন্তু এখানে থাকলে আমাদের অবস্থা ডেভিডের মতো হবে।’ হায়দারের চোয়াল শক্ত হল। আকাশলাল এখানে ধরা পড়ুক সে চায় না। মিনিস্ট্রিতে তার যে লোক আছে সে একটু আগে পরিষ্কার জানিয়েছে এই বাড়িতে থাকা তাদের পক্ষে আর নিরাপদ নয়।
‘তুমি কোন দলে যাবে? লিডারের সঙ্গে কি?’ ত্রিভুবন প্রশ্ন করল।
‘কিছুই ভাবিনি।’ হায়দার জবাব দিল।
‘আমি ডাক্তারদের নিয়ে যাব। ওরা আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক। তিনজনের যে কেউ মুখ খুললে সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে।’ ত্রিভুবন দূরে বসা অপারেটরদের দিকে তাকিয়ে নিল, ‘এদের বাঁচিয়ে রাখাও আমাদের পক্ষে বেশ ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে।’
‘নো।’ হায়দার মাথা নাড়ল, ‘কাজ করিয়ে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। ঠিক আছে, তুমি তাহলে ওদের নিয়ে সীমান্তের দিকে যাবে ভাবছ?’
‘তোমার আপত্তি আছে?’
‘একদম না। দুজনের একজনকে যেতে হতই। এদের দায়িত্ব অন্য কারোর ওপর ছাড়তে রাজি নই। তা হলে আমি লিডারকে নিয়ে যাচ্ছি। রাত্রের মধ্যেই আমরা নামভঞ্জন পৌঁছে যাব। গ্রামের লোক জানতেও পারবে না নতুন লোক এসেছে। তুমি যদি সেই রাত্রে ওখানে ফিরতে না পার তাহলে পরের রাতের জন্যে অপেক্ষা করবে। দিনের বেলায় ওখানে যেয়ো না।’ হায়দার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ত্রিভূবন হাসল। কথা বলার সময় তার কেবলই আশঙ্কা হচ্ছিল হায়দার তার ওপর নামভঞ্জনে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়ে নিজে ডাক্তারদের নিয়ে বর্ডার পার হবে। লোকটা সেরকম চিন্তা করেনি বলেই মনে হয়।
ত্রিভূবন জানে এই ভাবনাটা ঠিক নয়। মাসখানেক আগেও সে ভাবতে পারত না। কিন্তু ডেভিডের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তার কেবলই মনে হচ্ছে তাকেও ধরে ফেলবে ভার্গিস। ডেভিড ধরা পড়ল, মারা গেল অথচ তারা কিছুই করতে পারল না। সে ধরা পড়লেও দল চুপচাপ থাকতে বাধ্য হবে। মনের মধ্যে কেউ যেন ক্রমাগত সতর্ক করে যাচ্ছে, পালাও, পালাও। ধরা পড়ার আগে ডেভিডেরও কি তাই মনে হয়েছিল। নইলে সে কেন বিপ্লবের বিপক্ষে কথা বলবে? এইসময় হঠাৎ তার হেনার মুখ মনে এল। সে পালিয়ে যাচ্ছে জানলে হেনার কি প্রতিক্রিয়া হবে?
ভারী দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই ভার্গিস বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে খোশগল্প করার জন্যে ডেকে আনা হয়নি। লম্বা টেবিলের ওপাশে বোর্ডের মেম্বাররা বসে আছেন তাঁর দিকে তাকিয়ে। ওদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে মিনিস্টার।
‘মে আই কাম ইন?’
‘ইয়েস প্লিজ।’
‘বসুন কমিশনার।’
ভার্গিস বসেছিলেন টেবিলের উল্টোদিকের একমাত্র চেয়ারে। বসেই বুঝেছিলেন, এটা চেয়ার নয়, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। বোর্ডের মেম্বাররা তাঁর দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছেন তাতে ওঁদের মনের কথা বোঝা যাচ্ছে না। অথচ এঁদের অনেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাঁকে দিয়ে কত কাজ করিয়ে নিয়েছেন। ভার্গিস নিজেকে সহজ রাখার চেষ্টা করছিলেন।
মিনিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিস্টার কমিশনার, শহরের অবস্থা এখন কেমন?’
ভার্গিস জবাব দিলেন, ‘আবার চব্বিশ ঘণ্টা কারফিউ জারি হয়েছে।’
‘কেন?’
‘সাধারণ মানুষ যাতে জিনিসপত্র কিনতে পারে তাই আমি কারফিউ রিল্যাক্স করেছিলাম, কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসবাদীরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বোমা ছুঁড়তে শুরু করেছিল।’
‘এতদিন ওদের এমন কাজ করতে দেখা যায়নি। হঠাৎ কেন শুরু করল?’
‘দুটো কারণ হতে পারে। এক, ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে নেতৃত্বের অভাবে। দুই, ডেভিডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে এমন কাণ্ড করেছে।’
‘মিস্টার কমিশনার, আপনার ওপর এই শহর এবং স্টেটের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আপনার কি মনে হয় আপনি সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছেন?’
‘আমার কাজে কোনও গাফিলতি নেই।’
‘বোর্ডের তরফ থেকে আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করব। আকাশলাল কেন আপনার কাছে ঢাকঢোল পিটিয়ে ধরা দিল?’
‘ওর পক্ষে লুকিয়ে থাকা আর সম্ভব ছিল না। পুলিশি হামলায় মারা পড়ার সম্ভাবনা ছিল ওর। ভেবেছিল হাজার হাজার লোকের সামনে ধরা দিলে সে বেঁচে থাকবে।’
‘ও কি জানত যে ওর হার্ট অ্যাটাকড্ হবে?’
‘এটা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়।’
‘তাহলে ও নিশ্চয়ই জানত আপনি ওকে মেরে ফেলবেন?’
‘হ্যাঁ বিচারক নিশ্চয়ই বিচারের শেষে ওর ফাঁসির হুকুম দিতেন।’
‘সেটা বিচারের শেষে। এ দেশের আইন অনুযায়ী আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়। ফলে বিচারের রায় পেতে কয়েক মাস পেরিয়ে যায়। তাই না?’
‘হ্যাঁ। ঠিক কথা।’
‘কিন্তু আকাশলাল জানত ধরা পড়ার দু-একদিনের মধ্যেই সে মারা যাবে।’
‘ও যে জানত তা আমি কি করে বলব?’
‘না জানলে ও সুড়ঙ্গ তৈরি করে রাখত না। মিস্টার কমিশনার আপনি কল্পনা করুন, মারা যাওয়ার আগেই আকাশলাল তার শরীর কবর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে। কেন? সে এও জানত তাকে তার পারিবারিক জায়গাতেই কবর দেওয়া হবে। ওর লোকজন দিনের পর দিন ধরে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ল অথচ আপনার বাহিনী টের পেল না। কেন খুঁড়েছিল সেই তথ্য কি আপনি জানতে পেরেছেন?’
‘ওর মৃতদেহ পুলিশ কবর দেবে এটা সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি।’
‘মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়ার সময় ধরা পড়ার প্রচণ্ড সম্ভাবনা আছে জানা থাকলেও ওরা শুধু এই কারণে ঝুঁকি নিয়েছিল এমন কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় কমিশনার।’
‘আমি ডেভিডের কাছ থেকে খবর বের করার চেষ্টা করছিলাম।’
‘কি করেছিলেন আপনি?’
‘আমি চাপ দেওয়া শুরু করেছিলাম।’
‘আর তার পর শহরের বাইরে একটা বাংলোর লনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেললেন যাতে ওর কাছ থেকে কোনও দিনই খবর না পাওয়া যায়।’
‘আমি প্রতিবাদ করছি স্যার। ডেভিড পালিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওর পায়ে গুলি করতে চেয়েছিলাম। সেইসময়, ও হোঁচট খেয়ে বসে পড়ায় ওপরে গুলি লাগে।’
‘আকাশলাল মৃত, এ-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত?’
‘হ্যাঁ। আমি নিজে তাকে দেখেছি। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন।’
‘আপনার কি কখনও সন্দেহ হয়েছে আকাশলাল বেঁচে থাকতে পারে?’
‘না। হয়নি।’
‘কেউ কিছু বলেনি?’
সেই মহিলা রিপোর্টারের মুখ মনে পড়ল তাঁর। কিন্তু কিছু না বলে মাথা নাড়লেন ভার্গিস। মিনিস্টার একাই তাঁকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। প্রতি শব্দ রেকর্ড করা হচ্ছে।
‘আমরা খবর পেয়েছি সোমকে একজন সার্জেন্ট গুলি করে মেরেছিল।’
‘না। তার আগেই সে মারা গিয়েছিল। পোস্টমর্টেমে ওর শরীরে বিষ পাওয়া গেছে।’
‘আকাশলালকে পোস্টমর্টেম করা হয়নি কেন?’
‘দুটো কারণ। ডাক্তার স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। দুই, সেই রাতের মধ্যেই যদি ওকে কবর না দেওয়া হত তাহলে ওর মৃতদেহকে কেন্দ্র করে শহরে ঝামেলা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি ঝুঁকি নিইনি।’
‘বাবু বসন্তলালের বাংলোতে সার্জেন্টকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি কি তদন্ত করেছেন? কেন সার্জেন্ট সেখানে গিয়েছিলেন?’
ভার্গিস বুঝলেন তাঁর ঘাম হচ্ছে। এই একটা বিষয় যা নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চান না। এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই ম্যাডামের প্রসঙ্গ এসে যাবে। একটুও দ্বিধা না করে তিনি জবাব দিলেন, ‘না। ওর মৃতদেহ আমিই আবিষ্কার করি। ওকে ওখানে দেখব আশা করিনি। সোমের মৃত্যুর পর থেকেই ও নিখোঁজ ছিল।’
‘ওই বাংলোর কম্পাউন্ডে ওখানকার চৌকিদার মৃত অবস্থায় গাছে ঝুলছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘লোকটার মাথা প্রকৃতিস্থ ছিল না বলে শুনেছি।’
‘মিস্টার কমিশনার, জীবিত আকাশলালকে আপনি ধরতে পারেননি। কিন্তু কবর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া আকাশলালের শরীরকে আপনি এই কদিনেও আবিষ্কার করতে পারলেন না। এই ব্যাপারে আপনার কোনও কৈফিয়ত আছে?’
‘আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি।’
‘যে সাংবাদিক মহিলাটিকে আপনি টুরিস্ট লজ থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সে কি আপনাকে কোনও বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। সে বলেছে আকাশলালের স্বর খোঁড়ার আগেই কেউ একজন সেখানকার মাটিতে কান পেতে কিছু শুনতে চেষ্টা করছিল। মেয়েটাকে আকাশলালের লোকজন ওখান থেকে সরিয়ে দেয়। তার বিশ্বাস, এই মৃতদেহ চুরি যাওয়াটা পূর্বপরিকল্পিত এবং এমনও হতে পারে আকাশলাল মারা যায়নি।’
‘আপনার বিশ্বাস হয়নি?’
‘না। কারণ আকাশলালকে মৃত অবস্থায় আমরা দেখেছি। আর মেয়েটি চেয়েছিল ডেভিডের মৃতদেহ সৎকার করতে। সে অবশ্যই সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যুক্ত, নইলে এই সময়ে এত বড় ঝুঁকি সে নিত না। ওর কথা বিশ্বাস করার কারণ নেই।’
‘ওই টুরিস্ট লজে এক দম্পতি কিছুদিন আগে বেড়াতে এসেছিলেন ইন্ডিয়া থেকে। ওদের সম্বন্ধে সন্দেহ হওয়ায় আপনি ভদ্রলোককে হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে গিয়ে জেরাও করেছিলেন। সেই দম্পতি পরের দিনই উধাও হয়ে যান। তাঁদের খুঁজে বের করেছেন?’
‘প্রথমে খোঁজ নেওয়া চলছিল কিন্তু পরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার চাপে ওদের নিয়ে আর মাথা ঘামানো হয়নি।’
‘ভদ্রলোক ডাক্তার ছিলেন?’
‘যতদূর মনে পড়ছে, হ্যাঁ। কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ওদের কোনও সংযোগ ছিল না। একথা আমি ইন্ডিয়ার পলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছি।’
মিস্টার কমিশনার, আপনার রাজ্যে কেউ নিখোঁজ হয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না, এক্ষেত্রে এক দম্পতিই নিখোঁজ হয়েছেন। জীবিত বা মৃতদেহ কাউকেই আপনি খুঁজে বের করতে পারেন না। আপনাকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল তার অপব্যবহার করেছেন আপনি। এ ব্যাপারে আপনার কোনও বক্তব্য আছে?’
‘আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি।’
‘বাবু বসন্তলালের বাংলোতে আপনি একটি ড্রাইভারকে গুলি করে মেরেছিলেন?’
‘আমি জানতাম না সে ড্রাইভার। সে যেভাবে গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল তাতে আমার তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে মনে হয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্যেই আমাকে গুলি চালাতে হয়।’
‘লোকটি কি সশস্ত্র ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওর কাছে কি কোনও অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল?’
ভার্গিসের মেরুদণ্ড কনকন করে উঠল। ম্যাডামের নাম অনিবার্যভাবে এসে যাবে এখন। কিন্তু ভার্গিস বুঝতে পারছিলেন তাঁর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বোর্ড ইচ্ছে করেই এই জেরার ব্যবস্থা করেছে। যখন কেউ আস্থাভাজন থাকে না তখন তার ত্রুটি খুঁজে পেতে দেরি হয় না। এখন তিনি চোখের সামনে নিজের পরিণতি দেখতে পাচ্ছিলেন। ভার্গিস সোজা হয়ে বসলেন। তারপর খুব সহজ গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘স্যার! আপনি তো জানতে চাইলেন না কেন আমি আসামি ডেভিডকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের পাহারায় বাবু বসন্তলালের বাংলোয় গিয়েছিলাম যখন শহরে এমন টেনশন ছিল!’
মিনিস্টার বললেন, ‘মিস্টার কমিশনার, আপনাকে কি প্রশ্ন করা হবে তা আপনি ডিকটেট করতে পারেন না। আপনি এখানে এসেছেন শুধুই উত্তর দিতে। বোর্ড আপনার কাছে সঠিক জবাব চায়।’
এইসময় বোর্ডের তিন নম্বর মেম্বারের টেবিলের সামনে আলো জ্বলে উঠল। মিনিস্টার সেটা লক্ষ করে বিনীত ভঙ্গিতে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলেন। মাথা নিচু করে সদস্যের বক্তব্য শুনলেন। কিছু বলার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত ফিরে এলেন নিজের জায়গায়।
‘আপনি যদি ডেভিডকে নিয়ে হেডকোয়ার্টার্স থেকে অত দূরে না যেতেন তা হলে সে পালাবার চেষ্টা করত না এবং আপনাকে গুলি করতে হত না।’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘মাননীয় সদস্য মনে করেন যে একই সঙ্গে সার্জেন্ট এবং চৌকিদারের মৃতদেহ পাওয়া, ডেভিড এবং ড্রাইভারের মৃত্যু কাকতালীয় ব্যাপার নয়। একই স্পটে এতগুলো মৃত্যু বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য?’
‘যা ঘটেছে তা স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে।’
‘আমরা আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি আপিন আকাশলালের অন্তধার্নরহস্য সম্পর্কে রিপোর্ট না দিতে পারেন তাহলে আপনাকে বরখাস্ত করা হবে।’
ভার্গিস ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মনে হল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যা সিদ্ধান্ত নেবার তা বোর্ড নিয়ে নিয়েছে। এই চব্বিশ ঘণ্টা সময় ওরাই নিয়েছে তাঁর উত্তরাধিকারীকে বেছে নেওয়ার জন্যে। ম্যাডামের প্রসঙ্গ টেনে আনতে প্রথমে তিনি চাননি। পরে কোণঠাসা হতে হতে মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মিনিস্টার কায়দা করে সেদিকটা এড়িয়ে গেলেন। ওদের হাতে তিনি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। কেন তাঁকে বাংলোয় যেতে হয়েছিল তা বলতে দিলেই ম্যাডামের প্রসঙ্গ এসে যেত। ভার্গিস বুঝে গেলেন প্রসঙ্গটি তুলতে মিনিস্টার চাননি। আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। এর মধ্যে আকাশলালের শরীর খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব। দুজন মানুষের মুখ মনে পড়ল তাঁর এই মুহূর্তে। একজন সেই মহিলা রিপোর্টার, যাকে তিনি তাঁর জিপে বসিয়ে রেখেছেন পুলিশ পাহারায়। দ্বিতীয়জন, ম্যাডাম। এই দুজনের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে হবে। প্রথমজনের কাছ থেকে কিছু হদিশ পাওয়া গেলেও যেতে পারে, দ্বিতীয়জনের সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে।
ভার্গিস নেমে এলেন রাস্তায়। তাঁর জিপের পেছনের আসনে বসে আছে অনীকা। দরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাকে কে পাঠিয়েছে ডেভিডের মৃতদেহ নিয়ে কথা বলার জন্যে?’
‘একটি লোক, ওকে আমি চিনি না!’
‘খুকি, মিথ্যা কথা বোলো না। কেউ একজন বলল, আর তুমি রাজি হয়ে গেলে?’
‘আমার মনে হয়েছিল মৃতদেহের কোনও অপরাধ থাকে না।’
‘আকাশলালের ডেডবডি কোথায় আছে?’ দাঁতে দাঁত চাপলেন ভার্গিস।
‘আমি জানব কি করে?’
‘তুমি সব জানো। ওর মৃত্যু নিয়ে এত কথা বললে আর ওটা জানো না?’
‘আমি শুধু বলেছি ওর মৃত্যুটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
‘সুতরাং তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে আকাশলালকে।’
‘আমি কি করে পারব? আপনি যেখানে পারছেন না।’
‘ভার্গিস সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, ‘তুমি বিপদ ডেকে আনছ!’
‘আপনার হাতে ক্ষমতা আছে আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। আমি বিদেশি, আমার কিছু হলে আপনাকে কিন্তু কৈফিয়ত দিতে হবে। মনে রাখবেন আমি একজন সাংবাদিক।’
‘কিন্তু সেই মর্যাদা তুমি রাখোনি।’
‘আশ্চর্য! আপনাদের এই শহরের কোন বাড়িতে লোকটার শরীর লুকিয়ে রেখেছে, তা আমি জানব কি করে? আমি এখানকার রাস্তাঘাটই ভাল করে চিনি না। একদিকে ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর একদিকে বাগানওয়ালা প্রাসাদের মতো বাড়ি, এদের কারও সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমি শুধু টুরিস্ট লজটা চিনি।’ ‘অনীকা বলল।
শব্দগুলো ভার্গিসকে হঠাৎই নাড়িয়ে দিল। মেয়েটা কি বলল? বাগানওয়ালা প্রাসাদের মতো বাড়ি? হ্যাঁ, শহরের ঘনবসতি এলাকাগুলোয় তাঁর লোক চিরুনি-তল্লাশি চালিয়েছে কিন্তু বাগানওয়ালা প্রাসাদের দিকে পা বাড়ায়নি। ওইসব বাড়ি ধনী এবং বিশ্বস্তদের। সেখানে তল্লাশি চালাতে গেলে বোর্ডের বা মিনিস্টারের অনুমতি নিতে হবে। মহান সদস্যদের প্রত্যেকেই এইরকম বাড়ির মালিক। ভার্গিসের মনে পড়ল ম্যাডামের বাড়ির কথা। সেটিও ওই একই পর্যায়ের। অনীকাকে অন্য গাড়িতে হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন তিনি!
ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার জন্যে ভার্গিসের জিপে, এসকর্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল শহরের বর্ধিষ্ণু পাড়ার মধ্যে দিয়ে। কয়েক পুরুষ ধরে এইসব বাগানওয়ালা বাড়ির মালিকরা সবরকম বৈভব ভোগ করছে। সাধারণ মানুষের জীবন এদের ইচ্ছাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। ভার্গিস বাড়িগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন। বিশাল এলাকা জুড়ে এক একটা বাগান। রাস্তা থেকে মূল বাড়ি দেখাই যায় না। লেডি প্রধানের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর খারাপ লাগল। বৃদ্ধা আর বেঁচে নেই। ইনি খুব কমই বাইরে যেতেন। লেডি প্রধানের কোনও উত্তরসূরি নেই বলেই তিনি জানেন। তার মানে বাড়িটি খালি আছে। এরকম বাড়িতে সন্ত্রাসবাদীরা চমৎকার লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু লেডি মারা গেছেন সম্প্রতি। তিনি বেঁচে থাকতে ওদের নিশ্চয়ই উৎসাহ দেবেন না। ভার্গিস মাথা নাড়লেন। সন্দেহ যখন হচ্ছে তখন একবার রুটিন চেকআপ করলেই হয়। লেডির বাড়িতে তল্লাশি করলে এখন আপত্তি করার কেউ থাকবে না। অবশ্য সেটা রাতের বেলায় করাই ভাল। আজ তাঁর কমিশনার হিসেবে শেষ রাত।
ম্যাডামের বাগানের গেট পেরিয়ে তাঁর গাড়ি যখন ভেতরে ঢুকছিল তখন দ্বিতীয় সন্দেহ হল। তিনি যদি নিজের ক্ষমতার বলে এই বাড়িটি সার্চ করতে পারতেন তাহলে! যে মহিলা নিজের পিস্তল ড্রাইভারকে দিয়ে তাকেই খুন করিয়ে আবার অস্ত্রটি ফেরত নিয়ে যেতে পারেন তিনি স্বচ্ছন্দে সন্ত্রাসবাদীদের এই বিশাল প্রাসাদে আশ্রয় দিতে পারেন। বাঁ দিকের খোপ থেকে মিনি টেপরেকর্ডার বের করে পকেটে পুরে এক লাফে জিপ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ভার্গিস হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘ম্যাডামকে বলো আমি দেখা করতে এসেছি। এক্ষুনি! আমার হাতে সময় নেই। বাঁ হাতে পকেটের টেপরেকর্ডার চালু করলেন ভার্গিস। শক্তিশালী রেকডারটি একঘণ্টা চলবে।