২৮. কিয়ের্কেগার্ড

২৮. কিয়ের্কেগার্ড

…ইউরোপ দেউলিয়া হওয়ার পথে..

নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল হিল্ডা। সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেছে এরিমধ্যে। সে তার রিং বাইন্ডারটা ডেস্কের ওপর রেখে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরে চলে এলো। তার মা তার জন্যে অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার আগেই বোট হাউসে নেমে যেতে হবে তাকে। যেতে যেতে পেতলের আয়নাটার দিকে একবার তাকাল সে।

চায়ের জন্য তাড়াতাড়ি কেতলিটা চাপিয়ে দিয়ে কিছু স্যান্ডউইচ বানালো সে।

বাবার ওপর কয়েকটা ফন্দি খাটাবে বলে মনে মনে ঠিক করেছে সে। ক্রমেই সোফি আর অ্যালবার্টোর সঙ্গে বেশি করে এ বোধ করতে শুরু করেছে হিল্ডা। বাবা কোপেনহেগেন পৌঁছুলেই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হবে।

বড়সড় একটা রেকাবি নিয়ে বোটহাউসে নেমে এলো সে।

 এই নিয়ে এসেছি আমাদের ব্রাঞ্চ, বলল হিল্ডা।

সিরিষ কাগজ মোড়া একটা ব্লক ধরে আছেন তার মা। কপালের ওপর এসে পড়া এক গোছা চুল হাত দিয়ে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিলেন তিনি। তার চুলেও বালু লেগে রয়েছে।

ডিনারটা বাদ দেই তাহলে চল।

বাইরে ডকের ওপর বসলেন দুজনে, তারপর খেতে শুরু করলেন।

বাবা কবে আসছে? খানিক পর জিগ্যেস করল হিল্ডা।

শনিবার। আমি তো ভেবেছিলাম তুই জানিস।

 কিন্তু কখন? তুমি বলেছিলে না কোপেনহেগেন-এ প্লেন বদলাবে বাবা?

তা ঠিক?

স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসালেন তার মা।

প্রায় পাঁচটার দিকে কোপেনহেগেন পৌঁছুবে ও। ক্রিসটিয়ানস্যান্ডের প্লেন ছাড়ে পৌনে আটটায়। সম্ভবত সাড়ে নটায় কিয়েভিক ল্যান্ড করবে ও।

আচ্ছা, তাহলে কাট্রাপে কয়েক ঘন্টা সময় থাকবে বাবার হাতে…

হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলছিস?

এমনি। স্রেফ ভাবছিলাম।

হিল্ডার যখন মনে হলো যথেষ্ট সময় কেটে গেছে তখন সে হালকা চালে জিগ্যেস করল, অ্যান আর ওলের কোনো খবর শুনেছো ইদানীং?

মাঝে মাঝেই তো ফোন করে। জুলাই-এর কোনো এক সময় ছুটিতে বাড়ি আসবে দুজন।

তার আগে না তো?

না, তা মনে হয় না।

 তার মানে এই হপ্তায় কোপেনহেগেন থাকছে ওরা…?

এতো সব প্রশ্ন করছিস কেন, হিল্ডা?

কোনো কারণ নেই। এই কথার কথা আর কী।

 এই নিয়ে দুবার কোপেনহেগেনের কথা বললি তুই।

বলেছি বুঝি?

 আমরা বলছিলাম বাবা নামছে…

 সেজন্যেই বোধহয় অ্যান আর ওলে-র কথা মনে পড়েছিল আমার।

দুজনের খাওয়া শেষ হতেই মগ আর প্লেটগুলো রেকাবির ওপর উঠিয়ে রাখল হিল্ডা।

আমাকে আমার পড়াটা শুরু করতে হবে আবার, মা।

তা তো বটেই।

মা-র গলায় একটু ভর্ৎসনার সুর ফুটল কি? বাবা বাড়ি ফেরার আগে তারা দুজনে মিলে নৌকোটা ঠিকঠাক করে রাখার কথা ছিল।

বাবা আমাকে দিয়ে প্রায় দিব্যি করিয়ে রেখেছে সে বাড়ি ফেরার আগেই বইটা শেষ করার ব্যাপারে।

ব্যাপারটা একটু উদ্ভট। বাড়ির বাইরে থাকার সময় বাড়িতে আমাদের হুকুম করে বেড়াবার তো দরকার নেই তার।

 তুমি যদি জানতে, বাবা লোককে কী রকম হুকুম করে বেড়ায়, রহস্যের সুরে বলে উঠল হিল্ডা। আর, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ব্যাপারটা কতটা এনজয় করে বাবা।

নিজের ঘরে ফিরে পড়তে শুরু করল হিল্ডা।

.

হঠাৎ দরজায় একটা করাঘাতের শব্দ শুনতে পেল সোফি। গরম চোখে তার দিকে তাকালেন অ্যালবার্টো।

আমরা চাই না কেউ আমাদের বিরক্ত করুক।

করাঘাতের শব্দ আগের চেয়ে জোরাল হয়ে উঠল।

তোমাকে আমি হেগেলের দর্শনের ওপর মহাক্রুদ্ধ হয়ে ওঠা এক দিনেমার (Danish) দার্শনিকের কথা বলতে যাচ্ছি, অ্যালবার্টো বললেন।

করাঘাত এতো প্রচণ্ড হয়ে উঠল যে পুরো দরজাটা কেঁপে উঠল।

নিশ্চয়ই সেই মেজর কোনো ভূত-টুত পাঠিয়ে দিয়ে দেখছে আমরা টোপটা গিলি কিনা, অ্যালবার্টো বললেন। এতে তার কোনো কষ্টই করতে হয় না।

কিন্তু আমরা যদি দরজা খুলে না দেখি কে এসেছে তাহলে পুরো বাড়িটা ভেঙে ফেলতেও তো কোনো কষ্ট করতে হবে না তাকে।

এটা অবশ্য একটা ভালো কথা বলেছ। ঠিক আছে, তাহলে ভোলাই যাক। দরজাটা।

দুজনেই এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। করাঘাতটা যেহেতু খুবই জোরাল ছিল, সোফি তাই রীতিমত বড় সড় কোনো লোক দেখবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু দেখল সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা সোনালী চুলের ছোট্ট একটা মেয়ে, পরনে নীল পোশাক। তার দুই হাতে একটা করে ছোট্ট বোতল। একটা বোতল লাল, অন্যটা নীল।

হাই, সোফি বলল, কে তুমি?

 আমার নাম এলিস, লাজুকভাবে মাথাটা একটু নুইয়ে মেয়েটা বলল।

আমিও তাই ভেবেছিলাম, মাথা ঝাঁকিয়ে অ্যালবার্টো বললেন। এ হচ্ছে এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড।

ও কী করে পথ চিনে আমাদের কাছে এলো?

এলিস-ই সেটা ব্যাখ্যা করল: ওয়ান্ডারল্যান্ড হলো একেবারে কোনো সীমানা ছাড়া একটা দেশ। তার মানে, ওয়ান্ডারল্যান্ডটা সবখানেই আছে, অনেকটা ঐ জাতিসংঘের মতো। জাতিসংঘের অনারারি সদস্য হওয়া উচিত ওয়ান্ডারল্যান্ডের। সব কমিটিতেই আমাদের প্রতিনিধি থাকা দরকার, কারণ জাতিসংঘেরও সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বিস্ময় থেকে।

হুম… সেই মেজর! বিড়বিড়িয়ে বললেন অ্যালবার্টো!

 তা, তোমার আগমনের হেতু? সোফি শুধাল।

সোফিকে এই দুটো দর্শনের বোতল দিতে এসেছি আমি।

বোতল দুটো সোফির হাতে তুলে দিল সে। একটাতে লাল তরল, অন্যটাতে নীল। লাল বোতলের লেবেলে লেখা: আমাকে পান করো, নীল বোতলের লেবেলেও লেখা: আমাকে পান করো।

পরমুহূর্তেই সাদা একটা খরগোশ ছুটে এলো কেবিনটার পাশ দিয়ে। সোজা হয়ে দুপায়ে হাঁটছে সেটা, পরনে একটা ওয়েস্টকোট আর জ্যাকেট, কেবিনের ঠিক সামনে এসে সে তার ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একটা হাতঘড়ি বের করে বলে উঠল:

এই সেরেছে! এই সেরেছে! বড্ড দেরি হয়ে যাবে আমার।

এরপরই ছুট লাগাল সে। এলিসও দৌড়তে শুরু করল তার পিছু পিছু। বনের ভেতর ঢুকে পড়ার ঠিক আগে আবারো মাথাটা একটু নুইয়ে ভদ্রতা দেখিয়ে সে বলে উঠল, এই তো ফের শুরু হলো বলে।

দিনা আর রানীকে আমার শুভেচ্ছা দিও, মেয়েটার পেছন থেকে বলে উঠল সোফি। সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বোতল দুটো ভালো করে দেখলেন অ্যালবার্টো আর সোফি।

আমাকে পান করো, আমাকে পান করো, পড়ল সোফি। বুঝতে পারছি না সাহস করবো কিনা। তরলটা বিষাক্তও হতে পারে।

অ্যালবার্টো স্রেফ কাঁধ ঝাঁকালেন।

মেজর পাঠিয়েছে ওগুলো আর মেজর যে-সব জিনিস পাঠায় সেগুলো পুরোপুরি মনের জিনিস। কাজেই এ-শুধু নকল-জুস।

লাল বোতলের ছিপিটা খুলে ফেলে সাবধানে বোতলের মুখটা নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াল সোফি। অদ্ভুত মিষ্টি স্বাদ জ্ঞসটার, কিন্তু সেটাই সব নয়। জুসটা পান করতেই সোফির চারপাশে কিছু একটা ঘটতে শুরু করল।

মনে হলো লেক, বন আর কেবিন মিলেমিশে একটা জিনিস হয়ে গেছে। শিগগিরই এমন মনে হলো যে সোফি যা-কিছু দেখছে সবই যেন একই ব্যক্তি আর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে সোফি নিজে। অ্যালবার্টোর দিকে মুখ তুলে তাকাল সে, কিন্তু তাকেও সোফির আ-র অংশ বলে মনে হলো তার কাছে।

 সোফি বলল, সব কিছুই ঠিক আগের মতোই দেখাচ্ছে, কিন্তু এখন এগুলো সব একটা জিনিস। আমার মনে হচ্ছে যেন প্রত্যেকটা জিনিসই একটাই চিন্তা।

মাথা ঝাঁকালেন অ্যালবার্টো ওপর-নিচ, কিন্তু সোফির কাছে মনে হলো যেন সে নিজেই নিজের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাঁচ্ছে।

এটা হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদ বা ভাববাদ, তিনি বললেন। এটা হচ্ছে রোমন্টিকদের বিশ্ব চিদাত্মা। সব কিছুকেই তারা প্রত্যক্ষ করেছেন এক বিশাল অহম হিসেবে। আবার হেগেল-ই ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনামুখর ছিলেন আর তিনিই সব কিছুকে দেখতেন এক এবং একমাত্র বিশ্ব প্রজ্ঞার প্রকাশ হিসেবে।

অন্য বোতলটা থেকেও পান করব?

লেবেল-এ তো সে-রকমই বলা আছে।

নীল বোতলটার ছিপি খুলে বড় এক ঢোক খেয়ে নিল সোফি। এই জুসটা আগের চেয়ে টাটকা আর তীব্র বলে বোধ হলো তার কাছে। হঠাৎ করে তার চারপাশের সব কিছু আবারো বদলে গেল।

লাল বোতলের প্রভাব মুহূর্তেই কেটে গেল আর সবকিছুই ফিরে এলো যার যার স্বাভাবিক অবস্থায়। অ্যালবার্টো হয়ে গেলেন অ্যালবাটো, গাছগুলো ফিরে গেল বনে। আর পানিটাকে ফের লেক-এর মতোই দেখালো।

কিন্তু ব্যাপারটা স্থায়ী হলো এক মুহূর্ত মাত্র, কারণ জিনিসগুলো সব পিছলে সরে যেতে থাকল পরস্পরের কাছ থেকে। বন আর বন রইল না, প্রত্যেকটা গাছকেইএকেকটা জগৎ বলে মনে হতে লাগল। সবচেয়ে ছোট ডালটাকেও একটা রূপকথার জগৎ বলে মনে হতে লাগল যে-জগৎ সম্পর্কে হাজারটা গল্প বলা যেতে পারে।

ছোট্ট লেকটা হঠাৎ করেই হয়ে গেল কূল-কিনারাহীন একটা মহাসমুদ্র, গভীরতা বা প্রশস্ততার দিক দিয়ে নয়, বরং সেটার ঝকমকে বিস্তার আর ঢেউগুলোর জটিল নকশায়। সোফির মনে হলো এই পানির দিকে তাকিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে সে অথচ তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এটা একটা অথৈ রহস্যই থেকে যাবে তার কাছে।

 একটা গাছের মাথার দিকে তাকাল সে। অদ্ভুত একটা খেলায় মগ্ন হয়ে আছে তিনটে চড়ুই পাখি। লুকোচুরি খেলা খেলছে ওরা? লাল বোতলের জুস খাওয়ার পরেও সোফি কোনোভাবে জানত যে এই গাছটায় কিছু পাখি রয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে আসলে ঠিকভাবে দেখতে পায়নি সে। লাল জুসটা সব ধরনের বৈপরীত্য আর বিশেষ পার্থক্য মুছে দিয়েছিল।

বড় যে চ্যাপ্টা পাথরের সিঁড়ি ধাপের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল ওরা সেটা থেকে লাফ দিয়ে নেমে ঝুঁকে পড়ল সোফি ঘাসের দিকে তাকাবার জন্যে। ওখানে সে আবিষ্কার করল আরেকটা নতুন জগৎ, যেন পানির নিচে প্রথমবারের মতো দৃষ্টি মেলে দিয়েছে গভীর সমুদ্রের এক ডুবুরি। নানান শাখা-পল্লব আর শুকনো ঘাসের গুচ্ছের ভেতর জলাভূমিটা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নানান জিনিসে ভরে আছে। সোফি দেখল একটা মাকড়সা দৃঢ়পায়ে স্থিরলক্ষ্যে দৌড়ে গেল জলাভূমির ওপর দিয়ে, লাল একটা গেছে উকুন ঘাসের একটা ফলা বেয়ে ওপর-নিচ ছুটোছুটি করছে আর পিপঁড়ের একটা গোটা সৈন্যদল সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে ঘাসের মধ্যে। কিন্তু ক্ষুদে ক্ষুদে প্রতিটি পিপঁড়াই যার যার পাগুলো নাড়াচ্ছে স্বকীয় ভঙ্গিমায়।

কিন্তু সে যখন ফের উঠে অ্যালবার্টোর দিকে তাকাল তখনই এসবের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার; তখনও কেবিনের সামনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তো, অ্যালবার্টোর ভেতর সোফি দেখতে পেল এক অদ্ভুত ব্যক্তিকে, ভিনগ্রহ থেকে আসা একটা প্রাণীর মতো দেখাচ্ছে তাঁকে বা যেন কোনো রূপকথা থেকে উঠে আসা এক মন্ত্রমুগ্ধ চরিত্র। ঠিক একই সঙ্গে নিজেকে সে পুরোপুরি নতুনভাবে এক অনুপম ব্যক্তি হিসেবে উপলব্ধি করল। স্রেফ একজন মানুষের চেয়ে, পনেরো বছর বয়েসী এক কিশোরীর চেয়ে অতিরিক্ত একটা কিছু। সে। সে সোফি আমুন্ডসেন আর, কেবল সে-ই তাই।

কী দেখতে পাচ্ছো? জিগ্যেস করলেন অ্যালবার্টো।

 দেখতে পাচ্ছি, আপনি একটা অদ্ভুত পাখি হয়ে গেছেন।

তাই বুঝি?

আমার তো মনে হয় না অন্য একজন হওয়াটা কেমন সেটা আমি কোনোদিন বুঝতে পারবো। দুনিয়াতে দুটো মানুষ কোনো দিনই একই রকম নয়।

আর বনটা?

সেটাকেও তো আর আগের মতো মনে হচ্ছে না। সেটা যেন অদ্ভুত সব গল্পে ভর্তি গোটা একটা মহাবিশ্ব।

ঠিক এটাই সন্দেহ করেছিলাম। নীল বোতলটা হলো ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ। এটা হলো, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রোমান্টিকদের ভাববাদ-এর বিরুদ্ধে সোরেন কিয়ের্কেগার্ড-এর (Soren Kierkegaard) প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এর সঙ্গে আরেকজন দিনেমারেরও নাম জড়িত, যিনি কিয়ের্কেগার্ডের সমসাময়িক। আর তিনি হচ্ছেন রূপকথার লেখক বিখ্যাত হ্যাঁন্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন। তাঁরা দুজনেই ছিলেন প্রকৃতিতে সূক্ষ্ম জিনিসের অবিশ্বাস্য রকমের প্রাচুর্যের ব্যাপারে একই রকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী। অবশ্য একশো বছর আগে যে-দার্শনিক একই ব্যাপার লক্ষ করেছিলেন তিনি হচ্ছেন জার্মান লাইবনিজ। কিয়ের্কেগার্ড যে-রকম হেগেলের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, লাইবনিজ-ও তেমনি স্পিনোজার ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।

আপনার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আপনার কথাগুলো এমনই মজার শোনাচ্ছে যে হাসতে ইচ্ছে আমার।

সেটা ঠিক আছে। লাল বোতলটা থেকে আরেকটা সিপ নাও শুধু। এসো, এই সিঁড়ির ধাপে বসা যাক। আজকের মতো থামবার আগে কিয়েকগার্ড নিয়ে কিছু কথা বলি।

অ্যালবার্টোর পাশে বসে পড়ল সোফি সিঁড়ির ধাপের ওপর। লাল বোতল থেকে খানিকটা পান করল সে। সব কিছু আবার এক হয়ে যেতে শুরু করল। একটু বেশি। পরিমাণেই এক হয়ে গেল আসলে; আবারো তার একটা অনুভূতি হলো যে কোনো। পার্থক্যেই কিছু আসে যায় না আদৌ। তবে নীল বোতলটা তার ঠোঁটে ছোঁয়ানোর অপেক্ষামাত্র, তারপরেই তার চারপাশের জগত্তা কম-বেশি সেই সময়ের মতো হয়ে গেল যখন এলিস এসে পৌঁছেছিল বোতল দুটো নিয়ে।

কিন্তু কোনটা সত্যি এবার জিগ্যেস করল সে। লাল না নীল বোতল, কোনটার চিত্র আসল?

লাল নীল দুটোরই, সাফি। একটিই মাত্র বাস্তবতা রয়েছে এ-কথা বলে রোমান্টিকরা যে ভুল করেছিলেন সেটা আমরা বলতে পারি না। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা হয়ত খানিকটা সংকীর্ণ ছিল।

আর নীল বোতলটার ব্যাপারটা কী?

আমার ধারণা কিয়ের্কেগার্ড ঐ বোতলটা থেকে তাড়াহুড়ো করে কয়েক ঢোক খেয়ে নিয়েছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই, ব্যক্তির গুরুত্বের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আমরা কেবল আমাদের সময়ের সন্তান নই, তার চেয়েও বেশি কিছু। আর তাছাড়া, আমাদের প্রত্যেকেই একেকজন অনুপম ব্যক্তি যে কেবল একবারই বাঁচে।

এবং হেগেল এ-ব্যাপারটিকে সে-রকম গুরুত্ব দেননি?

না, তিনি বরং আগ্রহী ছিলেন ইতিহাসের বৃহৎ ক্ষেত্রের ব্যাপারে। আর এই বিষয়টি-ই বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল কিয়ের্কেগার্ড-কে। তিনি মনে করতেন রোমান্টিকদের ভাববাদ এবং হেগেলের ইতিহাসবাদ এই দুই-ই নিজের জীবনের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্বের বিষয়টি অস্পষ্ট করে দিয়েছে। কাজেই কিয়ের্কেগার্ডের বিবেচনায় হেগেল আর রোমান্টিকরা একই দোষে দুষ্ট।

এখন বুঝতে পারছি কেন তিনি এমন পাগল ছিলেন।

সোরেন কিয়ের্কেগার্ড-এর জন্ম ১৮১৩ সালে, তার বাবা খুবই কড়া শাসনে মানুষ করেছিলেন তাকে। তার ধর্মীয় বিষণ্ণতা বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন তিনি।

শুনতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।

এই বিষণ্ণতা বা বিষাদগ্রস্থতার কারণেই তিনি তাঁর এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে বাধ্য হন আর এ-ব্যাপারটিকে কোপেনহেগেনের বুর্জোয়া সমাজ খুব ভালো চোখে দেখেনি। কাজেই, প্রথম থেকেই একজন সমাজবিচ্ছিন্ন এবং নিন্দনীয় মানুষে পরিণত হন তিনি। যাই হোক, ধীরে ধীরে তিনি এসবের প্রত্যুত্তর দিতে শিখলেন এবং ক্রমেই পরিণত হলেন ইবসেন যাকে বর্ণনা করেছেন একজন গণশত্রু হিসেবে ঠিক তাই।

স্রেফ একটা এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছিলেন বলে এত কিছু?

না, শুধু সেই কারণেই নয় অবশ্য। বিশেষ করে জীবনের শেষ দিকে এসে সমাজের সমালোচনায় একেবারে মুখিয়ে থাকতেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, গোটা ইউরোপ দেউলিয়া হওয়ার পথে। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি এমন এক যুগে বাস করছেন যা পুরোপুরি প্যাশন এবং দায়বদ্ধতাশূন্য। তিনি বিশেষ করে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ডেনিশ লুথারান গির্জার নীরসতায়। যাকে তুমি বলতে পারো সানডে ক্রিশ্চিয়ানিটি তার নির্দয় সমালোচক ছিলেন তিনি।

ইদানীং আমরা বলি কনফার্মেশন ক্রিশ্চিয়ানিটি-র কথা। বেশির ভাগ বাচ্চাই কনফার্মড হয় ওরা যে-সব উপহার পায় সেগুলোর কারণে।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। কিয়েকগার্ডের বিবেচনায়, খ্রিস্টধর্ম একইসঙ্গে এমনই অদম্য আর অযৌক্তিক যে তা হয় এটানিয় ওটা (either/or) এরকম না হয়ে যায় না। এক অর্থে অথবা খানিকটা ধার্মিক হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। তার কারণ, ইস্টারের দিন যীশু হয় পুনরুত্থিত হয়েছিলেন, নয়ত হননি। আর তিনি যদি সত্যিই পুনরুত্থিত হয়ে থাকেন, সত্যিই যদি তিনি আমাদের জন্যে মৃত্যুবরণ করে থাকেন তাহলে সেটা এতোই অভিভূত করার মতো ব্যাপার যে তা আমাদের গোটা জীবনের ভেতরে চারিয়ে যাবেই যাবে।

হ্যাঁ, বোধকরি বুঝতে পারছি।

 কিন্তু ধর্মীয় প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে মানুষ এবং গির্জা এই দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি যে কীরকম দায়বদ্ধতাহীন সেটা কিয়ের্কেগার্ড লক্ষ করেছিলেন। কিয়ের্কেগার্ডের কাছে ধর্ম এবং জ্ঞান ছিল আগুন এবং পানির মতো। খ্রিস্টধর্ম সত্য, এটা বিশ্বাস করাটাই যথেষ্ট নয়। খ্রিস্টিয় বিশ্বাস-এ বিশ্বাসী হওয়ার অর্থ খ্রিস্টিয় জীবনধারা অনুসরণ করা।

এর সঙ্গে হেগেল-এর সম্পর্ক কোথায়?

তুমি ঠিকই বলেছে। আমরা বোধকরি ভুল জায়গা থেকে শুরু করেছি।

তাই আমার পরামর্শ হলো ফিরতি পথে গিয়ে গোড়া থেকে শুরু করুন।

সতেরো বছর বয়েসে ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কিয়ের্কেগার্ড, কিন্তু ক্রমেই তিনি মগ্ন হয়ে পড়েন বিভিন্ন দার্শনিক প্রশ্নের ভেতর। সাতাশ বছর বয়েসে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি আয়রনি সম্পর্কিত ধারণা এই শিরোনামের একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে। এই কাজটিতে তিনি রোমান্টিক আয়রনি আর মায়া বা বিভ্রান্তি (illusion) নিয়ে রোমান্টিকদের দায়বদ্ধতাহীন খেলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এর বিপরীতে তিনি উপস্থাপন করেছেন সক্রেটিক আয়রনি। সক্রেটিস যদিও আয়রনিকে অনেক বড় কাজে লাগিয়েছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল জীবন সম্পর্কে মৌলিক সত্যগুলো বের করে আনা। সক্রেটিস ছিলেন কিয়ের্কেগার্ড যাকে বলেছেন একজন অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদ, রোমান্টিকরা যা ছিলেন না। তার মানে, সক্রেটিস এমন একজন চিন্তাবিদ যিনি তাঁর দার্শনিক ভাবনা-চিন্তায় তার সমগ্র অস্তিত্বকে জড়িয়ে নেন।

তো?

১৮৪১ সালে এনগেজমেন্টটা ভেঙে দিয়ে কিয়ের্কেগার্ড বার্লিন চলে যান শেলিং এর বক্তৃতা শুনতে।

হেগেল-এর সঙ্গে কি দেখা করেছিলেন তিনি?

না, তার দশ বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন হেগেল, যদিও বার্লিন এবং ইউরোপের অনেক জায়গাতেই তার চিন্তা-ভাবনাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। হেগেলের পদ্ধতি (system) ব্যবহৃত হচ্ছিল সব ধরনের প্রশ্নের একটা সব-খোল চাবির মতো। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড বললেন যে হেগেলিয়বাদ যে-ধরনের বিষয়গত সত্য-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে-সব সত্য একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক।

তাহলে কোন ধরনের সত্য প্রাসঙ্গিক?

কিয়ের্কেগার্ডের বক্তব্য অনুযায়ী, বড় বা মহৎ কোনো সত্যের অনুসন্ধানের চেয়ে জরুরি হচ্ছে সেইসব সত্য আবিষ্কার করা যে-সব সত্য ব্যক্তির জীবনের জন্যে অর্থপূর্ণ। আমার নিজের জন্যে সত্য আবিষ্কার করা-টাই জরুরি। এভাবেই তিনি ব্যক্তিকে বা প্রত্যেকটি মানুষকে পদ্ধতি-র বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন। কিয়ের্কেগার্ড মনে করতেন হেগেল ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি একজন মানুষ। হেগেলিয় অধ্যাপক সম্পর্কে তিনি যা লিখেছিলেন তা এই: ভারিক্কি স্যার প্রফেসর যখন জীবনের গোটা রহস্য ব্যাখ্যা করছিলেন তখন চিত্তবিক্ষেপবশে তিনি তাঁর নিজের নাম ভুলে গিয়েছিলেন; ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি একজন মানুষ, তার বেশিও নয় কমও নয়, একটা প্যারাগ্রাফের চমৎকার আটভাগের তিন ভাগও নয়।

তাহলে কিয়ের্কেগার্ডের মত অনুযায়ী মানুষ কী?

সেটা ঠিক সরলভাবে বলা যাবে না। মানব প্রকৃতি বা মানুষ সম্পর্কে বড়সড় কোনো সংজ্ঞার ব্যাপারে একেবারেই কোনো উৎসাহ ছিল না কিয়ের্কেগার্ডের। একমাত্র জরুরি বিষয়টি হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অস্তিত্ব। আর, কেউ তো তার নিজের অস্তিত্ব ডেস্কের পেছন থেকে টের পায় না। আমরা যখন কাজ করি, বিশেষ করে যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো পছন্দ বা বাছাই করি তখনই আমরা অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হই। কিয়ের্কেগার্ড ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা বোঝা যাবে বুদ্ধ সম্পর্কে এই গল্পটায়।

বুদ্ধ সম্পর্কে?

হ্যাঁ, যেহেতু বুদ্ধের দর্শনও মানুষের অস্তিত্বকেই সেটার সূচনাবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করেছিল। একবার এক সন্ন্যাসী বুদ্ধকে শুধোলেন তিনি তাকে জগৎ কী এবং মানুষ কী এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেন কিনা। গায়ে বিষাক্ত তীর বেঁধা এক মানুষের সঙ্গে সন্ন্যাসীকে তুলনা করে বুদ্ধ সে প্রশ্নের জবাব দিলেন। তিনি বললেন, তীরটা কী দিয়ে তৈরি, কোন ধরনের বিষ সেটার গায়ে লাগানো হয়েছে বা তীরটা কোন দিক থেকে এসেছে তা নিয়ে কোনো তাত্ত্বিক প্রশ্নে আহত লোকটার বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকত না।

খুব সম্ভবত তখন তার চাওয়া শুধু কেউ তীরটা টান দিয়ে বের করে তার ক্ষতটার চিকিৎসা করুক।

ঠিক তাই। অস্তিত্বগতভাবে সেটাই জরুরি হতো তার কাছে। বুদ্ধ এবং কিয়ের্কেগার্ড দুজনের মধ্যেই শুধু অল্প কিছুক্ষণ অস্তিত্বশীল থাকার ব্যাপারে প্রবল একটা বোধ ক্রিয়াশীল ছিল। আর কেবল সেটা থাকলেই তুমি ডেস্কের পেছনে বসে বিশ্ব চিদাত্মার স্বরূপ সম্পর্কে দার্শনিক তত্ত্ব ফলাবে না।

না, অবশ্যই না।

 কিয়ের্কেগার্ড আরো বলেছিলেন যে সত্য বিষয়ীগত(subjective)। এ-কথা বলে তিনি এটা বোঝননি যে আমরা কী ভাবি বা বিশ্বাস করি তার কোনো গুরুত্ব নেই। তিনি বোছাতে চেয়েছেন যে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো ব্যক্তিগত। কেবল এই সত্যগুলোই আমার জন্য সত্য।

বিষয়ীগত সত্যের একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?

এই যেমন, একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম সত্য কিনা। তত্ত্বগত বা কেতাবীভাবে নেয়ার মতো কোনো প্রশ্ন এটা নয়। যে মানুষটি এই জীবনে নিজেকে চিনতে পেরেছে তার কাছে এটা জীবন-মরণ-এর প্রশ্ন। এটা এমন কোনো কিছু নয় যা নিয়ে তুমি বসে বসে স্রেফ আলোচনার খাতিরে আলোচনা করতে পারো। এটা এমন একটা ব্যাপার যার দিকে তোমাকে এগোতে হবে সর্বোচ্চ আবেগ বা আসক্তি আর আন্তরিকতার সঙ্গে।

তা বোঝাই যায়।

তুমি যদি পানিতে পড়ে যাও তাহলে তুমি ডুববে কি না তা নিয়ে তোমার মধ্যে কোনো তত্ত্বগত আগ্রহ থাকে না, পানিতে কুমির আছে কিনা সে-বিষয়টা ইন্টারেস্টিং-ও না আবার আনইন্টারেস্টিং-ও না। প্রশ্নটা জীবন-মৃত্যু সংক্রান্ত।

বুঝতে পারছি, অনেক ধন্যবাদ।

কাজেই আমাদেরকে অবশ্যই ঈশ্বর আছেন কিনা এই দার্শনিক প্রশ্ন আর এই প্রশ্নের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে; এটা এমন একটা পরিস্থিতি বা অবস্থা যেখানে প্রত্যেকটি মানুষই পুরোপুরি একা। এ-ধরনের মৌলিক প্রশ্নের দিকে কেবল বিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। যে-সমস্ত জিনিস আমরা প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের মাধ্যমে জানতে পারি সেগুলো, কিয়ের্কেগার্ড-এর মত অনুযায়ী, নিতান্তই গুরুত্বহীন।

আমার মনে হয় ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বললে ভালো হয়।

আট আর চার যোগ করলে বারো হয়। এ-ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত। এটা সেই ধরনের প্রজ্ঞালব্ধ সত্য-র (reasoned truth) একটা উদাহরণ যে সত্যের কথা দেকার্ত থেকে পরবর্তী প্রত্যেক দার্শনিকই বলে এসেছেন, কিন্তু এটাকে কি আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রার্থনায় অন্তর্ভুক্ত করি? এটা কি এমন কোনো বিষয় যা নিয়ে আমরা আমাদের মৃত্যুর সময় চিন্তা করবো? মোটেই না। ওই ধরনের সত্য বিষয়গত বা সাধারণ দুটোই হতে পারে, কিন্তু তারপরেও সে-সব একটি মানুষের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে নিতান্তই অর্থহীন।

আর বিশ্বাস?

কোনো মানুষের সঙ্গে যখন তুমি কোনো অন্যায় আচরণ করো তখন তুমি কখনোই জানতে পারো না লোকটি তোমাকে ক্ষমা করল কিনা। কাজেই ব্যাপারটা তোমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা এমন একটা প্রশ্ন যার সঙ্গে তুমি প্রবলভাবে জড়িত। আবার, কোনো ব্যক্তি তোমাকে ভালোবাসে কিনা সেটাও তুমি জানতে পারো না। এটা এমন একটা বিষয় যেটা তোমাকে স্রেফ বিশ্বাস বা আশা করতে হবে। কিন্তু একটা ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি এই সত্যটির চাইতে এই বিষয়গুলো তোমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার প্রথম চুম্বনের মাঝপথে তুমি কার্য-কারণ সূত্র বা প্রত্যক্ষণের উপায়গুলো নিয়ে চিন্তা করো না।

কেউ তা করলে সেটা বড় অদ্ভুত হবে।

ধর্মীয় প্রশ্নগুলোর বেলায় বিশ্বাস-ই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিয়ের্কেগার্ড লিখছেন ঈশ্বরকে যদি আমি বিষয়গতভাবে (objectively) উপলব্ধি করতে পারি, আমি তাকে বিশ্বাস করি না আর যেহেতু আমি তা করতে পারি না ঠিক সে-কারণেই আমি অবশ্যই বিশ্বাস করব। নিজেকে যদি আমি বিশ্বাসে স্থির রাখতে চাই সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাকে প্রতিনিয়ত বিষয়গত অনিশ্চয়তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকায় মন দিতে হবে যাতে করে সেই অতল সত্তর হাজার ফ্যাদম গভীর জলাশয়ের ওপর আমার বিশ্বাস বজায় রেখে অবস্থান করতে পারি।

বড় গুরুপাক জিনিস।

 অনেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন বা অন্ততপক্ষে তাঁকে বিচার বুদ্ধির আওতার মধ্যে আনতে চেয়েছেন। কিন্তু তুমি যদি এ-ধরনের কোনো প্রমাণ বা যৌক্তিক তর্ক নিয়ে তুষ্ট থাক তখন তুমি বিশ্বাস হারাও আর সেই সঙ্গে হারাও ধর্মীয় গভীর আবেগ। কারণ যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম তোমার জন্য সত্য কিনা, খ্রিস্টধর্ম সত্য কিনা তা নয়। এই একই চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে মধ্যযুগের এই বাণীতে: credo quia absurdum।

মানে?

এর মানে হচ্ছে আমি বিশ্বাস করি কারণ ব্যাপারটা অযৌক্তিক। খ্রিস্টধর্ম যদি আমাদের যুক্তি বা প্রজ্ঞার কাছে আবেদন সৃষ্টি করত, আমাদের অন্য দিকগুলোর কাছে নয়, তাহলে এটা বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার হতো না।

তা ঠিক, বুঝতে পারছি এখন।

তো, কিয়ের্কেগার্ড অস্তিত্বসংক্রান্ত বলতে কী বুঝিয়েছেন, বিষয়ীগত সত্য বলতেই বা কী বুঝিয়েছেন আর বিশ্বাস-সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী ছিল সে-সব আমরা দেখলাম। এই তিনটে ধারণা তৈরি করা হয়েছিল সাধারণভাবে দার্শনিক ঐতিহ্যকে আর বিশেষ করে হেগেলের দর্শনকে সমালোচনা করে। কিন্তু সেই সঙ্গে এগুলো তীক্ষ্ণ সামাজিক সমালোচনা-রও মূর্ত প্রকাশ। তিনি বললেন আধুনিক শহুরে সমাজে ব্যক্তি পরিণত হয়েছিল জনতা-য় (the public) আর জনতা বা জনসাধারণের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো তার দায়বদ্ধতাহীন কথাবার্তা। আজ সম্ভবত আমরা ব্যবহার করব অনুরূপতা (conformity) শব্দটা; তার মানে যখন প্রত্যেকে কোনো কিছু সম্পর্কে গভীরভাবে কিছু অনুভব না করেই একই জিনিস ভাবে এবং বিশ্বাস করে।

ভাবছি, কিয়ের্কেগার্ড জোয়ানার বাবা-মা সম্পর্কে না জানি কী বলতেন।

উনি তার বিচার-বিবেচনায় সব সময় খুব একটা সদয় ছিলেন না। চোখা একটা কলম আর তিক্ত একটা সেন্স অ আয়রনি ছিল তার। এই যেমন ধরো তিনি এ ধরনের কথা বলতেন যে জনসাধারণ-ই হচ্ছে অসত্য (untruth) বা সত্য আছে সব সময়ই সংখ্যালঘুদের ভেতর, তাছাড়া তিনি এ-ও বলতেন যে বেশিরভাগ মানুষই জীবনটাকে দেখে ভাসাভাসা ভাবে।

বার্বি ডল কালেক্ট করা এক কথা। কিন্তু একটা বার্বি ডল হয়ে যাওয়াটা আরো খারাপ।

তো, এই প্রসঙ্গে আমরা চলে আসবো কিয়ের্কেগার্ডের সেই তত্ত্বে যাকে তিনি বলছেন জীবনের পথে তিনটি স্তর।

মাফ করবেন?

কিয়ের্কেগার্ড বিশ্বাস করতেন তিন ধরনের জীবন রয়েছে। তিনি নিজে ব্যবহার করেছিলেন স্তর (stage) শব্দটা। এই তিনটে স্তরকে তিনি বলছেন ভোগী (aesthetic) স্তর, নৈতিক স্তর এবং ধর্মীয় স্তর। স্তর কথাটা তিনি এই বিষয়টি জোর দিয়ে বলার জন্যে ব্যবহার করেছেন যে লোকে অপেক্ষাকৃত নিচু দুটো স্তরের। যে কোনো একটাতে বাস করতে পারে আর তারপর হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠে যেতে পারে উচ্চতর একটা স্তরে। অনেকে আবার সারা জীবন এক স্তরেই বাস করে যায়।

বাজি ধরে বলতে পারি এর একটা ব্যাখ্যা আসছে একটু পরই। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আমি কোন স্তরে আছি।

 যে ভোগী স্তরে বাস করে সে বর্তমান মুহূর্তের জন্যেই বাঁচে, আনন্দ উপভোগের প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। যা সুন্দর, যা তৃপ্তিদায়ক বা মনোরম তাই-ই। ভালো। এই লোকটি বাস করে পুরোপুরি ইন্দ্রিয়ের জগতে এবং সে তার নিজের কামনা বাসনা আর মেজাজ-মর্জির দাস। যা কিছু একঘেয়ে তাই-ই মন্দ।

হ্যাঁ, ধন্যবাদ, আমার মনে হয় আমি এ-ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত।

 টিপিকাল রোমান্টিক তাই টিপিকাল aesthete, যেহেতু নিখাদ ইন্দ্রিয় সুখের চাইতে বাড়তি কিছু আছে এর মধ্যে। যে-মানুষ চিন্তাশীলতার সঙ্গে বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বা সেই অর্থে যে-শিল্প বা দর্শনের সঙ্গে সে জড়িত তার মুখোমুখি হয়, সে বাস করছে ভোগীস্তরে। দুঃখ বা যন্ত্রণাভোগের ব্যাপারেও কিন্তু একটা ভোগী বা চিন্তাশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সম্ভব। সেক্ষেত্রে অহংকার (vanity) ব্যাপারটার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ইবসেন-এর পীয়ার গিন্ট এক টিপিকাল aesthete-এর প্রতিকৃতি।

আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন।

এ-রকম কাউকে চেনো নাকি তুমি?

পুরোপুরি নয়। তবে বোধকরি মেজরের মতোই শোনাচ্ছে খানিকটা।

হতে পারে, হতে পারে, সোফি…যদিও সেটা ছিল লোকটার অসুস্থ রোমান্টিক আয়রনির আরেকটা উদাহরণ। তুমি মুখটা ভাল করে পরিষ্কার করে নিও।

কী?

ঠিক আছে, দোষটা তোমার নয়।

তাহলে বলে যান।

ভোগী স্তরে বাসরত একজন মানুষের খুব সহজেই একটি উদ্বেগের বোধ (angst) বা একটা আতংকের অনুভূতি হতে পারে, সেই সঙ্গে হতে পারে একটা শূন্যতার অনুভূতিও। তা যদি ঘটে তাহলে আশাও থাকে। কিয়ের্কেগার্ডের বক্তব্য অনুযায়ী উদ্বেগের বোধ হচ্ছে প্রায় ইতিবাচক। এটা এই সত্যের প্রকাশ যে ব্যতি হচ্ছে একটি অস্তিত্বহীন পরিস্থিতি এবং এবার সে একটি উচ্চতর স্তরে বিরাট লাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হয় ঘটে, নয় ঘটে না। লাফটা যদি পুরোপুরি না দেয়া যায় তাহলে শুধু লাফ দেয়ার উপক্রম করলে কোনো উপকার হয় না। এটা হচ্ছে হয় এটা / নয় ওটা এ-রকম ব্যাপার। কিন্তু কাজটা কেউ-ই তোমার হয়ে করতে পারে না। এটা একান্তই তোমার নিজের পছন্দ।

ব্যাপারটা খানিকটা মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়া বা ড্রাগ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবার মতো।

 হ্যাঁ, তা হবে হয়ত। কিয়ের্কেগার্ডের এই ধরনের সিদ্ধান্ত-র বর্ণনাখোনিকটা সক্রেটিসের এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা মনে পড়িয়ে দেয় যে সমস্ত সত্য অন্তদৃষ্টি-ই আসে ভেতর থেকে। যে পছন্দের কারণে একজন মানুষ একটি ভোগী স্তর থেকে একটি নৈতিক বা ধর্মীয় স্তরের দিকে লাফ দেবে সেই পছন্দটি অবশ্যই ভেতর থেকে আসতে হবে। পীয়ার গিন্টএ ইবসেন এই বিষয়টিই চিহ্নিত করেছেন। অস্তিত্বশীল পছন্দ কীভাবে ভেতরের প্রয়োজন এবং হতাশা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে তার আরেকটি অসাধারণ বর্ণনা পাওয়া যেতে পারে দস্তয়ভস্কির (Dostoevsky) মহৎ উপন্যাস ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট-এ।

আরেক ধরনের জীবন পছন্দ করে নেয়াটাই সবচেয়ে ভাল কাজ।

আর তাই সম্ভবত তুমি নৈতিক স্তরে বাস করতে শুরু করবে। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নৈতিক পছন্দগুলোর ব্যাপারে আন্তরিকতা এবং দৃঢ়তা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা কান্টের কর্তব্যের নীতিবিদ্যার মতোই। যার অর্থ হচ্ছে, নৈতিকতার রীতি-নীতি মেনে বাঁচা। কিয়ের্কগার্ড, কান্টের মতোই, প্রথম এবং প্রধানভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন মানুষের মেজাজ-মর্জির (temperament) দিকে। তুমি যা ভাবো তা একেবারে ঠিক না বেঠিক সেটা জরুরি বিষয় নয়। কোনটি ঠিক, কোনটি নয় সে-বিষয়ে যে তুমি একটি মত প্রকাশ করছ সেটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। aesthete-এর একমাত্র চিন্তা হচ্ছে একটা জিনিস মজার না একঘেয়ে সেটা।

খুবসিরিয়াস হওয়ার বা সে-রকম জীবন যাপন করাটায় একটা ঝুঁকি থেকে যায় না?

আলবাৎ! কিয়ের্কেগার্ড কখনোই এটা দাবি করেননি যে নৈতিক স্তরটা তৃপ্তিদায়ক। এমনকী একজন কর্তব্যপরায়ণ লোকও সব সময় নিবেদিত প্রাণ আর খুঁতখুঁতে হওয়ার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। অনেক মানুষই জীবনের শেষ দিকে এ-ধরনের অবসাদজনিত প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কেউ কেউ আবার ফিরে যায় তাদের ভোগী স্তরের চিন্তাশীল জীবনে।

কিন্তু অন্যরা একটা নতুন লাফ দেয় ধর্মীয় স্তরের দিকে। বিশ্বাসের সত্তর হাজার ফ্যাদম-এর অতল গহ্বরে লাফ দেয় তারা। aesthetic আনন্দ এবং প্রজ্ঞার কর্তব্যের প্রতি আহ্বানের বদলে বিশ্বাসকে বেছে নেয় তারা আর কিয়ের্কেগার্ড বলছেন, যদিও এটা জাগ্রত ঈশ্বর-এর উন্মুক্ত বাহুর ভেতর একটি ভয়ংকর লাফ হতে পারে, কিন্তু তার পরেও, মোক্ষ লাভের এটাই একমাত্র উপায়।

অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম, সেটাই তো বোঝাতে চাইছেন?

হ্যাঁ, কারণ কিয়ের্কেগার্ডের কাছে ধর্মীয় স্তরটা ছিল খ্রিস্টধর্ম। কিন্তু অখ্রিস্টিয় চিন্তাবিদদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এই দিনেমার দার্শনিকের কাছ থেকে প্রাণশক্তি পেয়ে বিংশ শতাব্দীতে অস্তিত্ববাদ বিপুল প্রসার লাভ করে।

নিজের ঘড়ির দিতে তাকাল সোফি।

 প্রায় সাতটা বাজে। আমাকে দৌড় দিতে হবে। মা-র মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

দার্শনিকের উদ্দেশে হাত নেড়ে নৌকোটার দিকে দৌড় লাগাল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *