২৮
বিকেলে, একা ঘরে পৃথু বসেছিল। হঠাৎ মেরী এসে বলল, চাকলাদার সাহেব এসেছেন। রুষার এই বাড়িতে, ভিনোদ ইদুরকারছাড়া একমাত্র মণি চাকলাদারেরই অবাধ যাতায়াত আছে। ভিনোদের পদবিই ইদুরকার। আর মণিবাবুর চেহারাটাই ইঁদুরের মতো। কে জানে? রুষা হয়তো শুয়োরেরই মত ইঁদুর ভালবাসে।
পৃথু কিন্তু ইঁদুর ভালবাসে না। যদিও ইঁদুরের মাংস ওর খুবই প্রিয়। অবশ্য, জঙ্গলের ক্বচিৎ-খাদ্য হিসেবেই। জংলি অথবা মেঠো ইঁদুর আগুনে ঝলসে, পাথুরে নুন এবং কাঁচা-পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খেতে খুবই ভাল লাগে ওর। শুয়োরের তো কথাই নেই। স্বয়ং রামচন্দ্রই খেতেন। বন্য-বরাহ বলে ব্যাপার! তবে, বস্তির শুয়োর খেতে ঘেন্না লাগে। শুয়োরের নলা-পোড়া, কাবাব; অথবা ভিণ্ডালু। ডিল্লিসস।
অনেকদিন হয়ে গেল বনোশুয়োর অথবা ইঁদুর খায়নি পৃথু। একদিন খেতে হবে।
মেরী দাঁড়িয়েছিল।
পৃথু বলল, বসতে বল, মানে, বসাও সাহেবকে; বসার ঘরে।
নিজের লেখা-পড়ার ঘরে শুয়োর; তেলাপোকা, ইঁদুর ইত্যাদি মনুষ্যেতরদের ঢোকাতে ইচ্ছা করে না ওর একেবারেই। অথচ, মণি চাকলদারই হাটচান্দ্রার আঁতেল-শ্রেষ্ঠ।
বসার ঘরে গিয়ে পৃথু কর্তব্য-পরায়ণ গলায় বলল, কী খবর? মণিবাবু।
বালো। আমি বালোই। আপনি ক্যামোন?
হঠাৎ? কোনও খবর না দিয়ে? কোথাও কী এসেছিলেন এদিকে?
না। বইটি ফেরত দিতেই এলাম।
অন্যমনস্ক গলায় পৃথু বলল, বই? কী বই? তার বই কেউ যে পড়তে নিয়ে গিয়ে ফেরৎ দিয়েছে এমন অভিজ্ঞতা বেশি হয়নি। অবাকই হল। বই এবং বউ একবার হাতছাড়া হলে ফিরে আসে না।
এলিমেন্টস অফ রাইটিং। ক্লস-এর একটি বই। রুষারই বই।
তাইই বলুন!
আশ্বস্ত হয়ে পৃথু বলল। তারপর ভদ্রতার গলায় বলল : কী খাবেন? মণিবাবু? কফি, না চা? না ঠাণ্ডা কিছু?
রুষা বাড়িতে নেই বুজি?
নাঃ। ওরা সব ক্লাবে গেছে। আজ যে রবিবার।
ওঃ। দ্যাটস রাইট।
কী খাবেন?
কাবো? নন্না। কিছু কাবো না। রুষাই নেই।
পৃথুর মনে হল কথার ধরন দেখে যে, রুষাকেই যেন খেতে এসেছিলেন মণিবাবু। ওঁর ভাষায়, শব্দপ্রয়োগের গোলমাল আছে।
ফীল লাউক হ্যাভিং আ ড্রিঙ্ক। বাড়িতে…?
বাড়িতে তো কিছু থাকে না।
লজ্জিত গলায় বলল, পৃথু।
স্ট্রেনজ। রুষা তো আমাকে অনেক কিছুই কাইয়েচেন।
সে আপনার জন্যেই আনিয়েছিলেন হয়তো। পৃথু বলল।
মনে মনে বলল, কে কাকে কী খাওয়াচ্ছে তা আমি কী করে…
কফি খাবেন না?
কফি? নো। থ্যাঙ্ক উ্য। নট আফটার সানডাউন।
গিরিশদার সঙ্গে এই মানুষটির অনেকই অমিল। মিল শুধু এই একটি ব্যাপারে।
আমাদের পত্রিকার পরের সংখ্যা কবে বের করছেন? দু মাস দেরি তো ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে।
পৃথু শুধোল।
বিজ্ঞাপন। পৃতুবাবু; বিজ্ঞাপনই এখন সাহিত্য পত্রিকা এবং বিশেষ করে বাঙলা-সাহিত্যর, জনক। চুলের তেল এবং সাবানের বিজ্ঞাপনই তো এখন বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দিনকুড়ি বাদে একবার শান্তিনিকেতনে যাব, সেখান থেকে ফিরে এসেই কাজ আরম্ভ…
অন্যমনস্কর মতো বললেন মণিবাবু, চলি তাহলে। রুষাকে বলবেন। আপনি কিন্তু সত্যিই সৌভাগ্যসমৃদ্ধ। এমন স্ত্রী আপনার!
পৃথু নমস্কার করে হাসল।
মুখে কিছু না বলে, ভাবল, যাদেরই সুন্দরী স্ত্রী আছে তাঁরা সকলেই সৌভাগ্য-সমৃদ্ধ। পরস্ত্রী মাত্রই ভাল। পর মাত্রই ঈর্ষাযোগ্য।
মণিবাবু চলে যাবার জন্যে উঠলেন।
পৃথু বলল, ‘আপনার উপন্যাসটি আর কতদূর এগাল মণিবাবু? “সুধনা এবং তপতীর বেড়াল?”
জানেনই তো! কী সীরিন পটভূমিতে শুরু করেছিলাম। আপনাকে তো শুনিয়েছিলাম কিছুটা, তাই না?
হ্যাঁ। সামান্যই…তারপর কতখানি এগোল?
ব্যসস…ওইটুকুই…। আর একটুও এগোয়নি। কোনও মহৎ লেখাই অবশ্য তাড়াতাড়ি লেখা যায় না! আমি তো আর অর্ডারী-সাহিত্য করি না পৃতুবাবু। কখনও করবও না।
পৃথুর মনে হল, পৃথুকে বা মণি চাকলাদারকে অর্ডার দিচ্ছেটাই বা কে? যাঁদের লেখার জন্যে অর্ডার কেউই দেয় না তাঁদের প্রত্যেকেরই অর্ডারী-সাহিত্যের ওপর প্রচণ্ড রাগ দেখা যায়। জন্ম-অনিয়ন্ত্রিত-ঈর্ষা আর বন্ধ্যা-রাজনীতিই বাঙালিদের খেল! মণি চাকলাদারের ভাষায় “কেল”।
কেলোও বলা চলে।
মুখে বলল, লিখে যান মণিবাবু। যতটা সময় লাগে লাগুক। তেমন কিছু লিখতে হলে ফাঁকিবাজি দিয়ে তো হয় না। অ্যানা কারেনিনা, জাঁ ক্ৰিস্তফ, ম্যাজিক মাউনটেইন…
মণিবাবুর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বলল, দেকবেন, দেকবেন আপনি পৃতুবাবু। শেষ হোক। মধ্যপ্রদেশের উমেরিয়ার আকাশ বাতাস, জল, আলো, সেগুনবন, ইউক্যালিপটা, মাটির সুগন্ধ। এবং একজন নারী; একজন পরম নমনীয় এবং রমণীয় নারীকে কী করে প্রতিভাত করি এই উপন্যাসে! আমার সফলতার জন্যে প্রার্থনা করবেন কিন্তু পৃতুবাবু, পরমব্রহ্মর কাছে।
গলার দ্রবীভূত স্বর কেমন যেন পাতিহাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে হয়ে এল হঠাৎ, মণি চাকলাদারের। গেটে হাত রেখে বললেন, ‘চলি, ক্যামোন?
পৃথু ভাবছিল, প্রেম বড়ই খারাপ অসুখ। প্রাণঘাতী অসুখ। ইঁদুর এবং মানুষ, মৃগী এবং নিষাদ একই সঙ্গে হত হয় এই অসুখে। হাউ বাউট শুয়োর? শুয়োরদের হয় না এই, অসুখ?
মুখে বলল, আচ্ছা। আবার আসবেন। বলব, রুষাকে।
সী, উ্য। বলেই চলে গেলেন তিনি।
গেটের কাছে পৌঁছেই আবার দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোকের চরিত্রর সঙ্গে চড়ুই পাখিদের চরিত্রর মিল আছে। কোনও গন্তব্যেই বেশিক্ষণ একসঙ্গে যেতে পারেন না।
মুখ ঘুরিয়ে বললেন, সাম্প্রতিক ভবিষ্যতের এক দূর-সকালে আসুন না স্ত্রীর সঙ্গে আমার পর্ণকুটিরে। পায়ের ধূলো দিন না। বেকন এন্ড এগস খাওয়াব। ফর, লাঞ্চ। সঙ্গে বীয়ার। আসুন।
যাব একদিন।
মণিবাবু চলে গেলে পৃথু নিজের ঘরের লেখার টেবলে এসে আবার বসল। নস্যির ডিবে খুলে, চারধারে কেউ যে নেই তা দেখে নিয়ে, একটিপ নস্যি নিল। আঃ। মগজ একেবারে সাফ।
যে উপন্যাসটি মণিবাবু লিখছেন সেটি লিখে ফেলতে পারলে তা যে কালজয়ী হতই সে সম্বন্ধে মণিবাবুর নিজের কোনওই সন্দেহ ছিল না। উপন্যাসটির প্রথমটুকু একদিন পৃথুকে শুনিয়েছিলেন মণিবাবু। সাহিত্য-টাহিত্যও, দাঁত ওঠার মতো বড় কষ্টকর ব্যাপার। ভদ্রলোক এখনও টীথিং-ট্রাবল থেকেই উদ্ধার করতে পারছেন না নিজেকে। কথাটা, অবশ্য উদ্ধার হবে না; হবে উত্তীর্ণ। “উত্তীর্ণ” হতে পারাই হচ্ছে আসল কথা। মণি চাকলাদারের ভাষায় “কতা”। উত্তরণ! উত্তরণ যখন কোনও লেখকের অভ্যেস দাঁড়িয়ে যায় শুধুমাত্র তখনই তাঁর যশ, গাড়ি, বাড়ি হতে পারে। সফল লেখক হতে পারা কি অত সহজ কথা? “নাথিং সাকসীডস লাইক সাকসেস”। তখন লেখার দরকারই হয় না; পাতা ভরালেই চলে যায়।
মণি চাকলাদার “সুধন্য এবং তপতীর বেড়াল”-এর যতটুকু লিখেছিলেন তা এইরকম : “আকাশমণি গাছের বুকে আজ বড়ই ব্যথা। বাইগাপল্লীর দিক থেকে উদাস ঘুঘু ডাকছে। কথা হয়েছে সুধন্যর, তপতীর সঙ্গে; তাদের দেখা হবে গতকাল। তপতী এবার ধন্য করবেই সুধন্যকে। গাভীর নিঃশ্বাসেরই মতো উত্তেজনাময় গভীর নিঃশ্বাস বয় সুধন্যর। সেগুনবনে ধুলোর ঝড়, খোয়াইয়ে বাঁশি বাজায় ডাইনি হাওয়া, ঝরাপাতারা হাওয়ায় ঝুর-ঝার দৌড়য় নকশাল ছেলেদের মতো।
কিন্তু সুন্যর প্রেম?
সুধন্যর প্রেম কি ধন্য হবে না?
সমস্যা অতএব, তপতীর কালো কাবুলি বেড়াল। তপতীর অশেষ সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম যা মন কাড়ে সুধন্যর তা তার গর্বিত, শান্ত চিবুকের অনুলোম; যে অনুলোম দিয়েছিল তাকে আশ্চর্য যৌনতা। কিন্তু কালো কাবুলি বেড়াল তাকে ভালবেসেছিল সুধন্যর চেয়ে বেশি অনেকই : তাইই অন্তত তপতী মনে করত, ভাবত সুধন্য…
অতএব বেড়াল, সুতপা এবং সুধন্য, ধন্য একে অন্যকে করবে; কথা ছিল এমনই অথচ কিন্তু…”
মণি চাকলাদার উপন্যাসের এইটুকু পড়িয়ে পৃথুকে বলেছিলেন, দেকবেন। ভোরের প্রকৃতির স্নিগ্ধ নম্রতা এবং এক আপাত-দুর্বোধ্য কিন্তু সুউচ্চ ভাষার দাট্য গুঁড়িয়ে নিংড়ে, চিপে, ছেঁকে কি ক্লাসিক সাহিত্যই না গড়ে তুলি! যদিও বড়ই দুঃখের হবে শেষটুকু।
পৃথু হঠাৎ শুধিয়েছিল, কেন? কাবলি বেড়াল কি কামড়ে দেবে সুধন্যকে? অথবা, তপতীর কি ডিপথীরিয়া হবে?
আপনি বড়ই স্থূল পৃতুবাবু, বড় মানডেন আপনার ভাবনা। আপনার সঙ্গে আমার উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করাটাই ভুল হয়েছে। অবশ্য এও বুঝতে পারছি যে, প্রকৃত শিক্ষিতজনের পক্ষে উপন্যাস লেখা সম্ভবই নয়। সম্ভব নয় তার প্রকৃত মূল্যায়ন করাও। উপন্যাস সাধারণের জন্যে, তাদের সঙ্গে আমার কম্যুনিকেশান নেই। ঔপন্যাসিক হতে হলে ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প বলতে হয়। কথক হতে হয়। লেখক আর কথকের মধ্যে যে তফাৎ আছে! তাছাড়া, গল্প যে আমার নেই। ব্যথা, বড় ব্যথা, হৃদয় জুড়ে বিদগ্ধ ব্যথা!
পৃথু ভেবেছিল যে, বলে ওকে, উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন মেম্বারকে একদিন বলেছিলেন, “দি অনারেবল মেম্বার শুডনট ইনডালজ ইন মোর ইনডিগনেশান দ্যান হি ক্যান কনটেইন”। একজন মানুষের পক্ষে কতখানি পণ্ডিতমন্যতা বা উচ্চমন্যতা বিনাকেশে ধারণ করা সম্ভব সে সম্বন্ধেও প্রত্যেক পণ্ডিতমন্য, বা উচ্চমন্য মানুষেরই একটি স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। তাদের নিজেদেরই হিতার্থে।
জানেন পৃতুবাবু, মণিবাবু বলেছিলেন : একন বুঝি, উপন্যাস বোধহয় একমাত্র মুর্খজনদেরই চিন্তার বাহক। আসল হচ্ছে কবিতা। আমি আসলে কবিই। শরতের আকাশের নরম স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না দিয়ে টাইচুং চালের গোল গোল ভাত মেখে খেতে চাই আমি গরাস গরাস; গদ্যর মতো ইতর ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত হয়নি আমার আদৌ। তবুও চেষ্টা করব একটি মালটি-স্টোরিড আপার্টমেন্ট হাউসেরই মতো গেঁথে তোলার, “সুধন্য এবং তপতীর বেড়াল”কে।
মণি চাকলাদারের কথা মনে হলেই অনেক কথাই মনে এসে যায়। ভিড় করে। ভাবনার কোনও খেই থাকে না।
বুদ্ধিমতী রুষা হয়তো পৃথুর চেয়ে ভাল বুঝেছে মণিবাবুকে। খাবার টেবলে বসে ও একদিন বলেছিল মণিবাবু সম্বন্ধে, আই ফীল পীটি ফর হিম। হি ইজ আ স্ট্রেঞ্জ সাইকলজীক্যাল কেস; আ ভিক্টিম অফ হিজ ওওন ইডিঅসী এন্ড ইডিয়সীনক্রেসীস। পুওর, পুওর, চ্যাপ।
হতে পারে। পৃথু বলেছিল।
বাট হু’জ নট?
মণি চাকলাদারের সঙ্গে গিরিশদার ইকুয়েশানটা বিশেষই গোলমেলে। বিরোধী, দুই ভারতীয় রাজনৈতিক দলেরই মতো। সেই জন্যেই আশা হয় যে, কোনওদিন হঠাৎ-আঁতাত হয়েও বা যাবে হয়তো।