আসলে অপু কিন্তু ঘুমায় নাই, সে জাগিয়া ছিল। চোখ বুজিয়া শুইয়া রাত্রে মায়ের সঙ্গে বাবার যেসব কথাবার্তা হইতেছিল, সে সব শুনিয়াছে। তাহারা এদেশের বাস উঠাইয়া কাশী যাইতেছে। এদেশ অপেক্ষা কাশীতে থাকিবার নানা সুবিধার কথা বাবা গল্প করিতেছিল মায়ের কাছে। বাবা অল্প বয়সে সেখানে অনেকদিন ছিল, সে দেশের সকলের সঙ্গে বাবার আলাপ ও বন্ধুত্ব, সকলে চেনে বা মানে। জিনিসপত্রও সস্তা। তাহার মা খুব আগ্রহ প্রকাশ করিল, সে সব সোনার দেশে কখনও কাহারও অভাব নাই–দুঃখ এ-দেশে বারোমাস লাগিয়াই আছে, সাহস করিয়া সেখানে যাইতে পারিলেই সব দুঃখ ঘুচিবে। মা আজ যাইতে পাইলে আজই যায়, একদিনও আর থাকিবার ইচ্ছা নাই। শেষে স্থির হইল বৈশাখ মাসের দিকে তাহদের যাওয়া হইবে।…
গঙ্গানন্দপুরের সিদ্ধেশ্বরী ঠাকুর-বাড়িতে সর্বজয়ার পূজা মানত ছিল। কোশ তিনেক দূরে কে পূজা দিতে যায়—এইজন্য এ-পর্যন্ত মানত শোধ হয় নাই। এবার এদেশ হইতে যাইবার পূর্বে পূজা দিয়া যাওয়া দরকার, কিন্তু খুঁজিয়া লোক মিলিল না। অপু বলিল-সে পূজা দিয়া আসিবে ও ওই গ্রামে তাহার পিসিমা থাকেন, তাহার সহিত কখনও দেখাশোনা হয় নাই, আমনি দেখা করিয়া আসিবে। তাহার মা বলিল-যাঃ, বকিস নে তুই, একলা যাবি বই কি? এখান থেকে প্রায় চার-ক্লোশ পথ।
অপু মায়ের সঙ্গে তর্ক শুরু করিল-আমি বুঝি সবদিন এইরকম বাড়িতে বসে থাকবো? যেতে পাববো না কোথাও বুঝি? আমার বুঝি চোখ নেই, কান নেই, পা নেই?
–সব আছে, উনি একলা যাবেন সেই গঙ্গানন্দপুর-বড় সাহসী পুরুষ কিনা!
অবশেষে কিন্তু অপুর নির্বন্ধতিশয্যে তাহাকেই পাঠাইতে হইল।
সোনাডাঙা মাঠের বুক চিরিয়া উঁচু মাটির পথ। পথের দু’ধারে মাঠের মধ্যে শুধুই আকন্দযুলের বন, দীর্ঘ শ্বেতাভ ডাটাগুলি ফুলের ভারে নত হইয়া দূৰ্বাঘাসের উপর লুটাইয়া পড়িয়াছে। পথে কোনো লোক নাই, দুপুরের অল্পই দেরি আছে, গাছপালার ছায়া ছোট হইয়া আসিতেছে। অপুর খালি পায়ে বেলেমাটির তাত লাগিতেছিল-তোহাতে বেশ আরাম হয়। পথের ধারের বন-ঝোপে কত কি ফুল ফুটিয়াছে, সাইবাবলা গাছের নতুন ফোটা ফুলের শিষ সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে, ছোট এক রকমের গাছে রাঙা রাঙা বনভুমুরের মতো কি ফল অজস্র পাকিয়া টুকটুক করিতেছে, মাটির মধ্য হইতে কেমন রোদপোড়া সোদা সোদা গন্ধ বাহির হইতেছে..সে মাঝে মাঝে নিচু হইয়া ঝোপের ভিতর হইতে খুঁজিয়া খুঁজিয়া বৈঁচিফল তুলিয়া হাতে-সেলাই-করা রাঙা সাটিনের জামাটার দু’পকেট ভর্তি করিয়া লইতেছিল।
যাইতে যাইতে তাহার মন পুলকে ভরিয়া উঠিতেছিল। সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারে না যে, সে কী ভালোবাসে এই মাটির তাজা রোদপোড়া গন্ধটা, এই ছায়াভিরা দূৰ্বাঘাস, সূর্যের আলোমাখানো মাঠ, পথ, গাছপালা, পাখি, বনঝোপ, ওই দোলানো ফুলফুলের থোলো, আলকুশি, বনকালমি, নীল অপরাজিতা। ঘরে থাকিতে তাহার মোটেই ইচ্ছা হয় না; ভারি মজা হয় যদি বাবা তাহাকে বলে-খোকা, তুমি শুধু পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াও, তাহা হইলে এইরকম বনফুল-ঝুলানো ছায়াচ্ছন্ন ঝোপের তলা দিয়া ঘুঘু-ডাকা দূর বনের দিকে চোখ বাখিয়া এই রকম মাটির পথটি বাহিয়া শুধুই হ্যাঁটে—শুধুই হ্যাঁটে।…মাঝে মাঝে হয়তো বাঁশবনের কঞ্চির ডালে ডালে শরশিরা শব্দ, বৈকালের রোদে সোনার সিঁদুর ছড়ানো আর নানা রঙ-বেরঙ-এর পাখির গান।
অপুর শৈশব কাটিতেছিল এই প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। এক ঋতু কাটিয়া গিয়া কখন অন্য ঋতু পড়ে-গাছপালায়, আকাশে বাতাসে, পাখির কাকলীতে তাহার বার্তা রাটে। ঋতুতে ঋতুতে ইছামতীর নব নব পরিবর্তনশীল রূপ সম্বন্ধে তাহার চেতনা জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছিল–কোন ঋতু গাছপালায় জলে-স্থলে-শূন্যে ফুলে ফলে কি পরিবর্তন ঘটায় তাহা সে ভালো করিয়া চিনিয়া ফেলিয়াছিল। ইহাদের সহিত এই ঘনিষ্ঠ যোগ সে ভালোবাসে, ইহাদের ছাড়া সে জীবন কল্পনা করিতে পারে না। এই বিরাট অপরূপ ছবি চোখের উপরে রাখিয়া সে মানুষ হইতেছিল। গ্ৰীষ্মের খরতাপ ও গুমোটের অবসানে সারা দিকচক্ৰবাল জুড়িয়া ঘননীল মেঘসজ্জার গভীর সুন্দর রূপ, অস্তবেলায় সোনাডাঙার মাঠের উপরকার আকাশে। কত বর্ণের মেঘের খেলা, ভদ্রের শেষে ফুটন্ত কাশ-ফুলেভরা মাধবপুরের দূরপ্রসারিত চর, চাঁদিনী রাতে জ্যোৎস্নাজালের খুপরি-কাটা বাঁশবনেব তলা,–অপুর স্মৃটিনোমুখ কৈশোরের সতেজ আগ্রহভরা অনাবিল মনে ইহাদের অপূর্ব বিশাল সৌন্দর্য চিরস্থায়ী ছাপ মারিয়া দিয়াছিল, কাস্তিরসের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল, চুপি চুপি তাহার কানে অমৃতের দীক্ষামন্ত্র শুনাইয়াছিল।–অপু কখনও জীবনে এ শিক্ষা বিস্মৃত হয় নাই। চিবজীবন সৌন্দর্যের পূজারি হইবার ব্ৰত, নিজের অলক্ষিতে মুক্তরূপা প্রকৃতি তাহাকে তাহা ধীরে ধীবে গ্রহণ করাইতেছিলেন।…
নতিডাঙার বঁওড়ে কাহারা মাছ ধরিয়াছে। সে খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল। গ্রামেব মধ্যে একটা কানা ভিখারি একতারা বাজাইয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিতেছে-ও গান তো অপু জানে– কতবার গাহিয়াছে–
দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহানো হোল ভার।…
বোষ্টম দাদু গানটা খুব ভালো গায়।
হরিশপুরের মধ্যে ঢুকিয়া পথের ধারে একটা ছোট্ট চালাঘরে পাঠশালা বসিয়াছে, ছেলেরা সুর করিয়া নামতা পড়িতেছে, সে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল। গুরুমশায়ের বয়স বেশি নয়, তাহদের গাঁয়েব প্রসন্ন গুরুমশায়ের চেয়ে অনেক কম।
আর এক কথা তাহার বার বার মনে হইতেছিল। এই তো সে বড় হইয়াছে, আর ছোট নাই, ছোট থাকিলে কি আর মা একা কোথাও ছাড়িয়া দিত?…এখন কেবলই চলা, কেবলই সামনে আগাঁইয়া যাওয়া। তাহা ছাড়া, আসচে। মাসের এই দিনটিতে তাহারা কতদূর, কোথায় চলিয়া যাইবে! কোথায় সেই কাশী-সেখানে!
বৈকালের দিকে গঙ্গানন্দপুরে গিয়া পৌঁছিল। পাড়ার মধ্যে পৌঁছিতেই কোথা হইতে রাজ্যের লজ্জা তাহাকে এমন পাইয়া বসিল যে, সে কোনো দিকে চাহিতেই পারিল না। কায়ক্লেশে সম্মুখের পথে দৃষ্টি রাখিয়া কোনোরকমে পথ চলিতে লাগিল। তাহার মনে হইল সকলেই তাহার দিকে চাহিতেছে। সে যে আজ আসিবে তাহা যেন সকলেই জানো; হয়তো ইহারা এতক্ষণ মনে মনে বলিতেছে-এই সেই যাচ্ছে, দ্যাখা দ্যাখ্য’ চেয়ে।…সে যে পুঁটুলির ভিতর বাঁধিয়া নারিকেল-নাড় লইয়া যাইতেছে, তাহাও যেন সকলেই জানে। তাহার পিসেমশায় কুঞ্জ চক্ৰবতীর বাড়িটা কোনদিকে এ কথাটা পর্যন্ত সে কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না।
অবশেষে এক বুড়িকে নির্জনে পাইয়া তাহাকেই জিজ্ঞাসা করাতে সে বাড়ি দেখাইয়া দিল। বাড়িটার সামনে পাঁচিল-ঘেরা। উঠানে ঢুকিয়া সে কাহারও সাক্ষাৎ পাইল না। দু’একবার কাশিল, মুখ দিয়া কথা বাহির হয়। সাধ্য কি? কতক্ষণ সে চৈত্রমাসের খররেীদ্রে বাহিরের উঠানে দাঁড়াইয়া থাকিত ঠিকানা নাই, কিন্তু খানিকটা পরে একজন আঠারো-উনিশ বছরের শ্যামবর্ণ মেয়ে কি কাজে বাহিরে আসিয়া রোয়াকে পা দিতেই দেখিল-দরজার কাছে কাহাদের একটি অপরিচিত প্রিয়দর্শন বালক পুঁটুলি-হাতে লজ্জাকুষ্ঠিত ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েটি বিস্মিতভাবে বলিল–
তুমি কে খোকা? কোথেকে আসচো?…
অপু আনাড়ির মতো আগাইয়া আসিয়া অতিকষ্টে উচ্চারণ করিল–এই আমার বাড়ি–নিশ্চিন্দিপুরে, আমার-নাম অ-অপু।
তাহার মনে হইতেছিল, না আসিলেই ভালো হইত। হয়তো তাহার পিসিমা তাহার এরূপ অপ্রত্যাশিত আগমনে বিরক্ত হইবে, হয়তো ভাবিবে কোথা হইতে আবার এক আপদ আসিয়া জুটিল।…তাহা ছাড়া,-কে জানিত আগে যে অপরিচিত স্থানে আসিয়া কথাবার্তা কওয়া এত কঠিন কাজ? তাহার কপাল ঘামিয়া উঠিল।
কিন্তু মেয়েটি তখনই ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া মহা-আদরে রোয়াকে উঠাইয়া লইয়া গেল। তাহার মা-বাবা কেমন আছেন সেকথা জিজ্ঞাসা করিল। তাহার চিবুকে হাত দিয়া কত আদরের কথা বলিল। দিদিকে যদিও কখনও দেখে নাই। তবুও দিদির নাম করিয়া খুব দুঃখ করিল। নিজের হাতে তাহার গায়ের জামা খুলিয়া হাতমুখ ধোয়াইয়া শুকনা গামছা দিয়া মুছইয়া তাড়াতাড়ি এক গ্লাস চিনির শরবৎ করিয়া আনিল। পিসি বলিতে সে যাহা ভাবিয়ছিল তাহা নয়, অল্প বয়স, রাজীর দিদির চেয়ে একটু বড়।
তাহার পিসিও তাহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। জ্ঞাতি-সম্পর্কের ভাইপোটি যে দেখিতে এত সুন্দর বা তাহার বয়স এত কম তাহার পিসি বোধ হয় ইতিপূর্বে জানিত না। তাই পাশের বাড়ি হইতে একজন প্রতিবেশিনী আসিয়া অপুর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে সে একটু গর্বের সহিত বলিল-আমার ভাইপো, নিশ্চিন্দিপুরে বাড়ি, খুড়তুতো ভায়ের ছেলে; সম্পর্কে খুবই আপন, তবে আসা-যাওয়া নেই। তাই!… পরে সে পুনরায় গর্বের চোখে অপুর দিকে চাহিয়া রহিল। ভাবটা এই–দ্যাখো আমার ভাইপোর কেমন রাজপুত্ত্বরের মতো চেহারা, এখন বোঝে কী দরের-কী বংশের মেয়ে আমি!…
সন্ধ্যার পর কুঞ্জ চক্ৰবতী বাড়ি আসিল। পাকশিটে-মারা চোয়াড়ে-চোয়াড়ে চেহারা, বয়স বুঝিবার উপায় নাই। তাহার পিসিকে দেখিয়া তাহার যেমন লজ্জা হইয়াছিল, পিসেমশায়কে তেমনি তাহার ভয় হইল। ছেলেবেলায় সে যে প্ৰসন্ন গুরুমশায়ের কাছে পড়িত, তেমনি যেন চেহারাটা। মনে হইল এ লোক যেন এখনই বলিতে পারে-বড্ড জ্যাঠা ছেলে দেখচি তো তুমি?…
পরদিন সকালে উঠিয়া অপু পাড়ার পথে এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরিয়া আসিল। চারিদিক জঙ্গলে ভরা, ফাঁকা জমি-দূৰ্বাঘাস প্রায় নাই, এমন জঙ্গল। এই একটা বাড়ি, আবার বনে-ঘেরা সুড়িপথ বাহিয়া গিয়া আবার দূরে একটা বাড়ি। অনেক সময় লোকের বাড়ির উঠানের উপর দিয়া পথ। তাহার বয়সি দু’চারজনকে খেলা করিতে দেখিল বটে, কিন্তু সকলেই তাহার দিকে এমন হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল যে, তাহাদের সঙ্গে আলাপ করিবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, সে তাহাদের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না।
পিসির বাড়ির দিকে ফিরিবার সময়ও বিপদ। এরূপ সকালে মার কাছে সে চিড়া, মুড়ি, নাড়ু বা বাসি-ভাত খাইয়া থাকে। এখানে কি উহারা দিবে? কাল তো রাত্ৰে ভাত খাইবার সময় দুধের সঙ্গে সন্দেশ কিনিয়া আনিয়া দিয়াছে। আজ যদি সে এখনই ফিরে, তবে হয়তো উহারা ভাবিবে ছেলেটা ভারি পেটুক; খাবার খাইবার লোভে-লোভে এত সকালে বাড়ি ফিরিল। রোজ রোজ খাবার খাওয়া কি ভালো?…এখন সে কি করে? নাঃ, বাড়ি ফিরিবে না। আরও খানিক পথে পথে ফিরিয়া একেবারে সেই ভাত খাওয়ার সময়ের একটু আগে বাড়ি যাইবে। অপরিচিত জায়গায় এতক্ষণ পথেই বা কোথায় দাঁড়াইয়া থাকে?
পায়ে পায়ে সে অবশেষে বাড়িতেই আসিয়া পৌঁছিল।
একটি ছয়-সাত বছরের মেয়ে একটা কাঁসার বাটি হাতে বাড়ি ঢুকিয়া উঠান হইতে ডাকিয়া কহিল-নাউ রেঁধেচো জেঠিমা, মোরে একটু দেবে?…
অপুর পিসিমা ঘরের ভিতর হইতে বলিল-কে রে, গুলকী? না, ওবেলা রাধবো, এসে নিয়ে যাস…
গুলকী বাটি নামাইয়া রোয়াকের ধারে দাঁড়াইয়া রহিল। মাথার চুলগুলা কাঁকড়া ঝাকড়া, ছেলেদের চুলের মতো খাটো। ময়লা কাপড় পরনে, মাথায় তেল নাই, রং শ্যামবর্ণ। অপুর দিকে চাহিয়া, কি বুঝিয়া একবার ফিক করিয়া হাসিয়া সে বাটি উঠাইয়া চলিয়া গেল।
অপু জিজ্ঞাসা করিল-মেয়েটা কাদের পিসিমা?
তাহার পিসি বলিল-কে, গুলকী? ওদের বাড়ি এখানে না-ওর মা-বাপ কেউ কোথাও নেই। নিবারণ মুখুজ্যের বৌ-এই যে পাশের বাড়ি, ওর দূর-সম্পর্কের জেঠি-সেখানেই থাকে।
পরদিন পাড়ার একটা ছেলে আসিয়া যাচিয়া তাহার সঙ্গে ভাব করিল ও সঙ্গে করিয়া গ্রামের সকল পাড়া ঘুরাইয়া দেখাইয়া বেড়াইল। বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিল-সেই অনাথা মেয়ে গুলকী পথের ধারে পা ছড়াইয়া একলাটি বসিয়া কী খাইতেছে। তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আঁচল গুটািইতে গেল-আঁচলে একরাশ আধাপাকা বকুল ফল। অপু। ইতিমধ্যে পিসিমার কাছে তাহার আরও পরিচয় লইয়াছে; নিবারণ মুখুজ্যের বৌ ভালো ব্যবহার করে না, লোক ভালো নয়। পিসিমা বলিতেছিল– জেঠি তো নয় রণচণ্ডী, কত দিন খেতেও দেয় না, এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়ায়। নিজের পুষ্যিই সাতগাণ্ডা—তাদেরই জোটে না, তায় আবার পর!.গুলকীকে দেখিয়া অপুর মোটেই লজ্জা হয় নাছোট্ট একটুকু মেয়েটা, আহা কেহ নাই! তাহার সঙ্গে ভোব করিতে অপুর বড় ইচ্ছা হইল। সে কাছে গিয়া বলিল-আঁচলে কি লুকুচ্চিস দেখি খুকি?..
গুলকী হঠাৎ আঁচল গুটািইয়া লইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া নিচু হইয়া দৌড় দিল। তাহার কাণ্ড দেখিয়া অপুর হাসি পাইল। ছুটিবার সময় গুলকীর আঁচলের বকুল ফল পড়িতে পড়িতে চলিয়াছিল, সেগুলি সে কুড়াইতে কুড়াইতে বলিল-পড়ে গেল, সব পড়ে গেল, নিয়ে যা তোর বকুল ও খুকি, কিছু বলবো না, ও খুকি!..
গুলকী ততক্ষণে উধাও হইয়াছে।
পুকুরে স্নান সারিয়া আসিয়া সে বসিয়া আছে, এমন সময় দেখিতে পাইল খিড়কি দরজার আড়াল হইতে গুলকী একবার একটুখানি করিয়া উঁকি মারিতেছে আর একবার মুখ লুকাইতেছে। তাহার সহিত চোখোচে্যুখি হওয়াতে গুলকী ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিল। অপু দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল-দীড়া, তোকে ধরচি এক দৌড়ে—বলিয়া সে খিড়কি-দরজার দিকে ছুটিল।
গুলকী আর পেছন দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া সোজা পুকুরপাড়ের দিকে ছুটু দিল। কিন্তু অপুর সঙ্গে পরিবে কেন? নিরূপায় দেখিয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেই অপু তাহার কাঁকড়া চুলগুৱা মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া বলিল-বড় ছুটি দিচ্ছিলি যে? আমার সঙ্গে ছুটে বুঝি তুই পারবি, খুকি?
গুলকীর প্রথম ভয় হইয়াছিল বুঝি বা তাহাকে মারিবে! কিন্তু অপু চুলের মুঠি ছাড়িয়া দিয়া হাসিয়া ফেলায়, সে বুঝিল এ একটা খেলা। সে আবার সেই রকম হাসিয়া ফেলিল।
অপুর বড় দয়া হইল। তাহার মুখের হাসিতে এমন একটা আভাস ছিল যাহাতে অপুর মনে হইল এ তাহার সঙ্গে ভোব করিতে চায়-খেলা করিতে চায়; কিন্তু ছেলেমানুষ, কথা কহিতে জানে না বলিয়া এইরকম উকিঝুকি মারিয়া-ফিক করিয়া হাসিয়া-দৌড়িয়া পলাইয়া-তাহার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অন্য উপায় ইহার জানা নাই। এ যেন ঠিক তাহার দিদি: এই বয়সে দিদি যেন এই রকমই ছিল–এই রকম আঁচলে কুল-বেল-বৈঁচি বাঁধিয়া আপন মনে ঘুরিয়া বেড়াইত, কেহ বুঝিত না, কেহ দেখিত না, এই রকম পেটুক-এই রকম বুদ্ধিহীন ছোট মেয়ে!
অপু ভাবিল-এর সঙ্গে কেউ খেলা করে না, একে নিয়ে একটু খেলি। আহা, মা-বাপ-হারা দুঃখী মেয়ে, আপন মনে বেড়ায়!—সে গুলকীর চুলের মুঠ ছাড়িয়া দিয়া হাত ধরিয়াছিল, বলিলখেলা করবি খুকি? চল ওই পুকুরের পাড়ে। না, এক কাজ করা খুঁকি, আমি তোকে ধরবো-আর তুই ছুটে যাবি; ওই কাঁঠাল গাছটা বুড়ি। আয়
মুঠ ছাড়িয়া দিতেই গুলকী আর না দাঁড়াইয়া আবার নিচু হইয়া দৌড় দিল। অপু চেঁচাইয়া বলিল–আচ্ছা যা, যা দেখি কদূর যাবি-ঠিক তোকে ধরব দেখিস। আচ্ছা ওই গেলি তো এই দ্যাখ-বলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া সে এক দৌড় দিল-চু-উ-উ-উ। গুলকী পিছন দিকে চাহিয়া অপুকে দৌড়িতে দেখিয়া প্ৰাণপণে যতটুকু তাহার ক্ষুদ্র শক্তিতে কুলায় দৌড়িবার চেষ্টা করিল–কিন্তু অপু একটুখানি ছুটিয়া গিয়াই তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ভারি ছুটতে শিখিচিস খুঁকি না? তা কি তুই আমার সঙ্গে পারিস? চল চোর-চৌকিদার খেলা করবি-তুই হবি চোর-এই কাঁঠাল পাতা চুরি
গুলকীর মুখে হাসি আর ধরিতেছিল না-হয়তো সে এতক্ষণ মনে মনে চাহিতেছিল এই সুন্দর ছেলেটির সঙ্গে ভাব করিতে। মাথা নাড়িয়া আশ্বাস দিবার সুরে বলিল-কাইবিচি নেবে?
অপু মনে ভাবিল চাষার গ্রামে থাকিয়া ও এই সব কথা শিখিয়াছে।–তাহদের গ্রামে যেমন গোয়ালা কি সদগোপের ছেলেমেয়েরা কথা বলে তেমনি।
দুপুরবেলা তাহার পিসিমা ডাকিলে পিছনে পিছনে গুলকী আসিল! অপুর খাওয়া হইয়া গেলে তাহার পিসি জিজ্ঞাসা করিল-ভাত খাবি গুলকী? অপুর পাতে বোস-মোচার ঘণ্ট আছে—ডাল দিচ্ছি, অপু ভাবিল–আহা, ও খাবে জানলে দুখানা মাছ ওর জন্যে রেখে দিতাম। গুলকী দ্বিরুক্তি না। করিয়া নির্লজ্জভাবে খাইতে বসিল। অনেকগুলি ভাত চাহিয়া লইয়া ডাল দিয়া সেগুলি মাখিল, পরে অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া অত ভাত না খাইতে পারিয়া পাতের পাশে রাশীকৃত ঠেলিয়া রাখিল। তবুও উঠিবার নাম করে না। অপুর পিসিমা হাসিয়া বলিল-আর খেতে হবে না গুলকী-হ্যাঁসফাঁস কচ্চিাস-নে ওঠ, কত ভাত নিয়ে ফেললি দ্যাখা তো? তোর কেবল দিষ্টি-খিদে-পরে বলিল, জেঠিমার কাণ্ড দ্যাখো-এতখানি বেলা হয়েচে-কাঁচা মেয়েট-ভাত খেতে ডাকেও না? হলাইবা পর-তা হলেও কচি তো?…
শনিবারে সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে অপু পূজা দিতে গেল। আচার্য ঠাকুরের খুব লম্বা সাদা দাড়ি বুকের ওপর পড়িয়াছে, বেশ চেহারা। তাহার বিধবা মেয়ে বাপের সঙ্গে সঙ্গে আসে, পূজার আয়োজন করিয়া দেয়, বৃদ্ধ বাপকে খুব সাহায্য করে। মেয়েটি বলিল-চার পয়সা দক্ষিণে কেন খোকা? এতে তো হবে না, বারের পুজোতে দু’আনা দক্ষিণে লাগবে—।
অপু বলিল-আমার মা যে চার পয়সা দিয়েচে মোটে, আর তো আমার কাছে নেই?
মেয়েটি খানকতক কলা মূলা বাছিয়া একখানা পাতায় মুড়িয়া তাহার হাতে দিয়া বলিলঠাকুরের প্রসাদ এতে রৈল, বেলপাতা আর সিঁদুরও দিলাম, তোমাদের বাড়ির মেয়েদের দিয়ে। অপু ভাবিলে—বেশ লোক এরা, আমার যদি পয়সা থাকতো আরও দু’পয়সা দিতাম—-
পিসিমার বাড়ি ফিরিয়া সে বাহিরের রোয়াকে জ্যোৎস্নার আলোতে বসিয়া পিসিমার সঙ্গে পূজার গল্প করিতেছে, পাশের গুলকীদের ঝড়িতে হঠাৎ গুলকীর সবু গলার আকাশ-ফাটানো চিৎকার শোনা গেল-ওরে জেঠি, অমন করে মেরো না-ওরে বাবারে-ও জেঠি, মোর পিঠ কেটে অক্ত পড়চে-মেরো না জেঠি–
সঙ্গে সঙ্গে একটা কর্কশ গলার চিৎকার শোনা গেল-হারামজাদী-বদমায়েশ-চৌধুরীদের বাড়ি গিয়েচো নেমতান্ন খেতে এমনি তোমার নোলা? তোমার নোলায় যদি আজ হাতা পুড়িয়ে হেঁকা না দিই:-লোকের বাড়ি খেয়ে খেয়ে বেড়াবে আর শতেকক্ষোয়ারীরা চোখের মাথা খেয়ে দেখতে পায় না, বলে কি না খেতে দেয় না-আপদ বালাই কোথাকার-বাড়িতে তোমায় খেতে দেয় না?…তোমায় আজ–
অপুর পিসিমা বলিল-দেখচো, ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে বলচে? সত্যি কথা বল্পেই লোকের সঙ্গে আর ভাব থাকে না-তা হলেই তুমি খারাপ—।
অপুর মনটা আকুলি-বিকুলি করিতেছিল। চোখের জলে গলা আড়ষ্ট হওয়ার দরুন কোনো কথা মুখ দিয়া বাহির হইল না।
পরদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আহারাদি সারিয়া অপু গোয়ালাপাড়ার দিকে চলিল। আগেব দিন তাহার পিসেমশায় ঠিক করিয়া দিয়াছে। এ গ্রাম হইতে নবাবগঞ্জে তামাক বোঝাই গাড়ি যাইবে, সেই গাড়িতে উঠিয়া সন্ধ্যার সময় রওনা হইলে সকালের দিকে নিশ্চিন্দিপুরের পথে তাহাকে উহারা নামাইয়া দিবে।
অল্পদূরে গিয়া বামুনপাড়ার পথের মোড়ে গুলকীর সঙ্গে দেখা। সে সন্ধ্যায় খেলা করিয়া বাড়ি ফিরিতেছে। অপু বলিল-বাড়ি চলে যাচ্ছি রে খুকি। আজ-সারাদিন ছিলি কোথায়? খেলতে এলিনে কিছু না-। পরে গুলকী অবিশ্বাসের হাসি হাসিতেছে দেখিয়া বলিল-সত্যি রে, সত্যি বলচি, এই দ্যাখ পুটলি, কার্তিক গোয়ালার বাড়ি গিয়ে গাড়ি উঠবো-আয় না। আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে দিবি?
গুলকী পিছনে পিছনে অনেকদূর চলিল। বামুনপাড়া ছাড়িয়া খানিকটা ফাকা মাঠ। তাহার পরেই গোয়ালাপাড়া। গুলকী মাঠের ধার পর্যন্ত আসিল। অপুর রাঙা সাটিনের জামটার দিকে আঙুল দেখাইয়া কহিল-তোমার এই আঙা জামাটা ক’পয়সা?
অপু হাসিমুখে বলিল-দুটাকা-তুই নিবি?
গুলকী ফিক্ করিয়া হাসিল। অর্থাৎ তুমি যদি দাও, এখখনি..
হঠাৎ সামনের পথে চোখ ফিরাইতেই অপু দেখিতে পাইল, মাঠের শেষে গাছপালার ফাকে আলো হইয়া উঠিয়াছে।–অমনি কেমন করিয়া তাহার মনে হইল আগামী মাসের এমন দিনটাতে তাহারা কোথায় কতদূরে চলিয়া যাইবে। পরে গুলকীকে বলিল-আর আসিস নে খুকি, তুই চলে যা-অনেকদূরে এসে গিাইচিস-তোর বাড়িতে হয়তো আবার বকবে-চলে যা খুকি।-আবার এলে দেখা হবে, কেমন তো? হয়তো আর আসবো না, আমরা কাশী চলে যাবো বোশেখ মাসে, সেখানে বাস করবো-গুলকী আর একবার ফিক করিয়া হাসিল।
সেদিন পূর্ণিমা কি চতুর্দশী এমনি একটা তিথি। সে এদিকে আর কখনও আসে নাই, কিন্তু বাল্যের এই এক প্রথম বিদেশ-গমন সম্পর্কিত একটা ছবি অনেক দিন পর্যন্ত তাহার মনে ছিল– সোজা মাঠের পথে দূর-প্রান্তে গাছপালার ফাঁকে পূৰ্ণচন্দ্ৰ উঠিতেছে (বা চতুর্দশীর চন্দ্র, তাহার ঠিক মনে ছিল না।) পিছনে পিছনে অল্পদিনের পরিচিতা, অনাথা, অবোধ কাঁকড়াচুল ছোট একটি মেয়ে তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিয়াছে।