২৮ আগস্ট, শনিবার ১৯৭১
২৫ আগস্ট রাতের অ্যাকশনের গল্প আর ফুরোচ্ছেনা, মানে আমিই ফুরোতে দিচ্ছি না।
এর আগে ঢাকায় যত অপারেশন, অ্যাকশান হয়েছে, সবগুলোর বিবরণ লোকমুখে শোনা। এই প্রথম আমি প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রত্যক্ষকর্মীর মুখে জানতে পারছি অ্যাকশানের বিস্তারিত বিবরণ।
অন্যদিকে একটা অসুবিধাও হচ্ছে। আগের মত বন্ধুবান্ধব ও পড়শীদের সঙ্গে শোনা কথায় অংশ নিতে পারছিনা, মানে শুধু শুনেই যাচ্ছি, নিজের অনুমান কিছু যোগ করতে পারছি না। কি জানি যদি কেউ সন্দেহ করে বসে! তাই মোর্তুজা ভাইরা, বাঁকারা, ফকিররা যখন ২৫ রাতের অ্যাকশান সম্বন্ধে ডাল-পালা বিস্তারিত নানা কথা বলতে থাকেন, তখন শরীফ, জামী, আমি শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে অবাক হই আর চুপ করে শুনি!
আজ হ্যারিস এসেছে দুপুরে খাওয়ার সময়। রুমীর অনেকদিনের বন্ধু। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই বন্ধুত্ব। একটা শখে দুজনের মিল আছে–তবলা বাজানোতে। হ্যারিসের বাবা হাসিব সাহেবও ইঞ্জিনিয়ার, শরীফের কয়েক বছরের সিনিয়র।
২৫ তারিখ সন্ধ্যায় হ্যারিসদের অ্যাকশানের কি হয়েছিল, আজ তা শুনলাম ওর মুখে।
সেই সন্ধ্যায় হ্যারিসরা তাদের হাইজ্যাক করা ফিয়াট ৬০০তে ছয়জন ছেলে গাদাগাদি করে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারপাশের রাস্তা দিয়ে কয়েকবার চক্কর দেয়। কিন্তু আলমদের গাড়ির কোনো পাত্তা দেখতে পায় না। তারা তো আর জানে না, আলমরা কি ঘাপলার মধ্যে পড়েছে। খানিক পরে গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে, পানি দিতে হবে, কোথায় পানি পাওয়া যায় এই চিন্তাভাবনা করতে করতে ওরা শাজাহানপুর বাজারের কাছে মুক্তারের চেনা একটা পানের দোকানে গিয়ে পানি চাইল। ছেলেগুলো গাদাগাদি করে বসেছিল, নিজেরাও গাড়ি থেকে নামল একটু হাত-পা ছাড়িয়ে নেবার জন্য। স্টেন হাতে ওদের নামতে দেখে মুহূর্তে বাজারের লোকজন খালি। ওরা গাড়িতে পানি ভরে আবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারপাশের রাস্তা ধরে কয়েকটা চক্কর দিল। শেষে আলমদের না পেয়ে হতাশ হয়ে নিজেরাই কিছু একটা করবে বলে কাকরাইলের দিকে রওনা দেয়। কাকরাইলের মোড়ে কয়েকজন বাঙালি পুলিশ হল্ট বলে ওদের থামায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হ্যারিসরা বাঙালি পুলিশ মারব
বলে সিদ্ধান্ত নেয়, একই সঙ্গে বাঙালি পুলিশরাও ওরে বাবা! মুক্তিবাহিনী বলে ওদের দিক থেকে চোখ উঠিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। হ্যারিস দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে দারুল কাবাবের দিকে যায়। দারুল কাবাবে মাঝে-মাঝে পাঞ্জাবি আর্মি অফিসাররা টিক্কা তন্দুরী কাবাব এসব খেতে আসে। ওরা গিয়ে একটা আর্মি জীপ দাড়ানো দেখে। জিয়া বলে, গাড়িটা ইউটার্ন দিয়ে ঘুরিয়ে আন। তাহলে জীপটা মেরে মগবাজারের দিকে পালিয়ে যেতে সুবিধে হবে। হ্যারিসদের লাক খারাপ, ওরা ইউটার্ন করে ঘুরে দারুল কাবাবের সামনে এসে দেখে জীপ উধাও!
কথার মাঝখানে রুমী হাসতে হাসতে বলল, শুধু স্কিল হলেই হয় না, লাকও লাগে। লাক ফেভার না করলে হাজার স্কিলও ভণ্ডুল।
হ্যারিস বলল, তা ঠিক। কাউকে মারতে পারলাম না বটে কিন্তু লাক খুব খারাপ ছিল না। তাইতো দুই নম্বর রোডে ফেরার সময় মিলিটারি চেকপোস্টে ধরা পড়ি নি।
হ্যারিসরা দারুল কাবাব থেকে পিজি হাসপাতালের মোড় হয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে দুই নম্বর রোডে ঢোকার আগের ট্রাফিক পোস্টটার কাছে আসে। বাদিকে দুই নম্বর রোডেরমুখে একটা জীপনজরে পড়ে। হ্যারিস বলে লেটস অ্যাটাক দ্যাট জীপ। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া বলে ওঠে, থাম থাম্। জীপটার পেছনে লাইট নেভাননা কয়েকটা ট্রাক দেখা যায় যেন। তখন ওরা ঠাহর করে দেখে জীপটার পেছনে লাইট নেভানো বেশ কয়টা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। আরো খেয়াল হয় সোজা সামনে মিরপুর রোডেও যেন অনেক গাড়ি, লোকজন। ওরা তখনো বোঝে নি যে মাত্র বিশ পনের মিনিট আগেই ওইখানে আলমরা অ্যাকশন করে গেছে। ওরা বায়ে ঘুরে দুই নম্বর রোড দিয়ে সাতমসজিদ রোড পেরিয়ে ২৮ নম্বরে যায়।
আলমরা কথামত রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যায় নি বলে হ্যারিরা প্রথমে রাগ করেছিল, কিন্তু পরদিন দুপুরে যখন জানতে পারে যে কি রকম সাক্ষাত্মত্যুর ছোবল থেকে ওরা বেঁচে বেরিয়ে এসেছে, তখন আর রাগ থাকে না। এরকম দুঃসাহসিক অ্যাকশানের জন্য সবাই আলমদের ধন্য ধন্য করতে থাকে।
হ্যারিস বলল, চাচী, রুমী তো হিরো হয়ে গেছে। ও যেভাবে গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে গুলি করেছে, সে রকম কাহিনী আমরা এতদিন কমিক বইতে পড়েছি, বিদেশী সিনেমায় দেখেছি। আমারই বন্ধু এরকম একটা কাজ করেছে ভেবে আমারও খুব গর্ব হচ্ছে।
চেয়ে দেখলাম, রুমীর মুখ গর্বে, লজ্জায়, খুশিতে লাল হয়ে উঠেছে। কদিন থেকে বন্ধুদের মুখে ও এইসবকথাই শুনছে। আমি বললাম, এরকম কোনো একটা অ্যাকশানে কোন একজনকে কিন্তু হিরো বলা যায় না। আসল হিরো হচ্ছে পুরো টিমটাই। প্রত্যেকটি সদস্যের নির্ভুল রিফ্লেক্স আর পারফেক্ট সেন্স অব টাইমিং থাকলে যে নিখুঁত টিমওয়ার্ক হয় তার ফলেই অ্যাকশানে সাফল্য আসে।
হ্যারিস বলল, চাচী গতকাল আমি তুর্যদের বাড়িতে গেছিলাম। রুমীরা যে বাড়ির সামনে খানসেনা মেরেছে, তার উল্টোদিকের বাসায় তুর্যের বাবা-মা থাকে। তুর্যতো ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে রয়েছে। তুর্যকে চেনেন কি? ঐ যে খুব ভালো ফুটবল খেলে। সালাউদ্দিন ভালো নাম। আমার বন্ধু।
চিনি। শুধু তুর্য নয়, তুর্যের মা সিমকিকেও চিনি একেবারে ছোটবেলা থেকে। তুর্যের এক চাচা শুকুর সাহেব রুমীর আব্বার বন্ধু।
রুমীরা আসলে কতগুলো মারতে পেরেছে, সেটা জানবার জন্যই ওখানে গেলাম। কিন্তু মুখে বললাম, কেমন আছেন খালাম্মা? আপনাদের খোঁজ নেবার জন্য এলাম। তুর্যের মা বললেন, আর বোলো না বাবা, দুদিন আগে সন্ধ্যার মুখে একটা গাড়িতে মুক্তিবাহিনী এসে সামনের বাসার সবকটা গার্ডকে মেরে দিয়ে গেছে। তুর্যের মা সেই সময় সামনের বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলেন। গাড়ি থেকে গুলির শব্দ হতেই উনি তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে চুপিচুপি দোতলায় উঠে একটা জানালার ফাঁক দিয়ে সব দেখেন। বাড়ির সামনে যতগুলো গার্ড ছিল, সবকটা মরেছে।
বিকেল হতেই হ্যারিস চলে গেল। রুমী রেকর্ড প্লেয়ারে জিম রিভসের একটা রেকর্ড চড়িয়ে চৌকিতে আমার পাশে এসে বসল। আমি বললাম, তুই দেখছি এবার জিম রিভস বেশি শুনছিস!
রুমীর স্বভাবটা বরাবরই এরকম। যে শিল্পীর গান ওর ভালো লাগে, পারলে তার সবগুলো রেকর্ড কিনে ফেলে। এবং একেক সময় একেক শিল্পী ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে। এভাবেই গত কয়েক বছরে আমাদের বাড়িতে জমে উঠেছে শচীন দেব বর্মনের, ফিরোজা বেগমের, টম জোনসের, জিম রিভসের যতগুলো রেকর্ড ঢাকায় পাওয়া যায় সবগুলো। বইয়ের ব্যাপারেও তাই।
রুমী বলল, এই রেকর্ডটা আজ চুলু ভাইয়ের বাসা থেকে নিয়ে এসেছি। কালই ফেরত দিতে হবে।
আমি বললাম, আজ চু, আলম, ওরা কেউ আসে নি।
আলম ঢাকায় নেই। আজ ভোরে শাহাদত ভাইয়ের সঙ্গে মেলাঘরে গেছে।
হঠাৎ?
ওরা গেল ঢাকায় কিছু ভারি অস্ত্র আনা যায় কিনা, তার খোঁজ খবর করতে। তাছাড়া এখানে এখন প্রচুর টাইম-পেনসিল আর পি. কে. দরকার। সেগুলোও আনবে ওরা।
ভারি অস্ত্রটা কি?
এল.এম.জি,। ঢাকার গেরিলাদের এখনো পর্যন্ত হালকা অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে–স্টেন, এস.এম.জি, গ্রেনেড, বিস্ফোরক–এইসব। এল.এম.জি, ভারিও বটে, দামীও বটে। একটা ধরা পড়লে বহুত লস্। তবে ঢাকায় এখন যেরকম উন্নত ধরনের গেরিলা অ্যাকশান হচ্ছে, তাতে আমাদের খুব বিশ্বাস ভারি অস্ত্র এলে আরো বড় বড় টার্গেট হিট করতে পারব। তাই ঢাকার গেরিলাদের ইচ্ছে কয়েকটা এল.এম.জি, আসুক। আলম, শাহাদত ভাই, খালেদ মোশাররফ, হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য গেছে। জান আম্মা, যদি এল.এম.জি. আসে ঢাকায়, তাহলে প্ল্যান আছে ছয় সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটা বড় ধরনের অ্যাকশান করা হবে।
কেন, ছয় সেপ্টেম্বর কি জন্য?
পাকিস্তান সরকার ঐদিন প্রতিরক্ষা দিবস পালন করার আয়োজন করছে। সব যদি ঠিকঠাকমত চলে, তাহলে ঐদিন ঢাকার সমস্ত গেরিলা কয়েকটা গ্রুপে ভাগ হয়ে একই সময়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা পয়েন্ট হিট করতে পারে –রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্যারেড গ্রাউন্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ কেন?
ওখানে যে প্রতিরক্ষা দিবসের জন্য খুব প্যারেড, পিটির প্র্যাকটিস করানো হচ্ছে, তাই। জান আম্মা, ঢাকায় এখন নয়টা গেরিলা গ্রুপ রয়েছে। ছয় তারিখের প্ল্যানটা যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে আরো অনেক গেরিলা এর মধ্যে ঢাকা চলে আসবে।
আর তোদের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের প্ল্যানটা?
ওটাও আছে। ওটার জন্যও পি. কে. আনবে ওরা।
জিম রিভসের গলা থেমে গেল। রুমী উঠে রেকর্ডের পিঠ পাল্টে দিয়ে এসে আবার বসল, আচ্ছা আম্মা, তোমরা ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পার না?।
আমি চমকে বললাম, কেনরে?
তোমরা ঢাকায় না থাকলে আমার পক্ষে অ্যাকশান করতে আরো সুবিধে হত।
কোথায় যাব? আর যাবার জায়গা যদিবা পাই,খুঁজলে হয়ত পেয়েও যাব, তাহলেও তোর দাদাকে নিয়ে যাবই বা কি করে?
দাদাকে কিছুদিন ফুপুর বাড়িতে রেখে দিলে হয় না?
তাহলে তো আরো তুলকালাম লেগে যাবে। তোর দাদা তা হলে আসল ব্যাপার সব বুঝে যাবে, তখন আপসেট হয়ে তার ব্লাড প্রেসার ভীষণ বেড়ে যাবে। স্ট্রোক হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। না রুমী, তা হয় না।
রুমী একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। জিম রিক্স বেজে বেজে এক সময় থামল। রুমী উঠে আরেকটা রেকর্ড লাগাল, বলল, আম্মা গানটা শোন মন দিয়ে।
টম জোনসের গ্রীন গ্রীন গ্রাস গানটা বেজে উঠল। বহুবার শোনা এ গান। রুমী এটা প্রায়ই বাজায়। শুনতে শুনতে সুরটা আমারও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যদিও ইংরেজি গানের কথা বিশেষ বুঝি না। তিন মিনিটের গানটা শেষ হলে রুমী আস্তে আস্তে বলল, গানটার কথাগুলো শুনবে? এক ফাঁসির আসামী তার সেলের ভেতর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। সে ট্রেন থেকে নেমেই দেখে তার বাবা মা আর প্রেয়সী মেরী তাকে নিতে এসেছে। সে দেখল তার আজন্মের পুরনো বাড়ি সেই একই রকম রয়ে গেছে। তার চারপাশ দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সবুজ সবুজ ঘাস। তার এত ভালো লাগল তার মা-বাবাকে দেখে, তার প্রেয়সী মেরীকে দেখে। তার ভালো লাগল গ্রামের সবুজ সবুজ ঘাসে হাত রাখতে। তারপর হঠাৎ সে চমকে দেখে সে ধূসর পাথরের তৈরি চার দেয়ালের ভেতরে শুয়ে আছে। সে বুঝতে পারে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।–
আমি বলে উঠলাম, চুপ কর রুমী,চুপকর। আমার চোখে পানি টলমল করে এল। হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, রুমী। রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।
রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসল, মনে হল অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন একটা কথা আছেনা আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানি না, ভোগও করি নি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ-সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না।