২৮ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
নিরঞ্জনের একটা পা খোঁড়া। কিন্তু মুখে কথার খৈ। চৈতন্য কথা বলে কম, হাসে আরো কম, হাঁটে ধীরে। নিরঞ্জন ঠিক উল্টো। খোঁড়া পা নিয়েই তুরতুর করে চলে, অনর্গল কথা বলে, যখন-তখন হাসে।
আমি প্রায় প্রায়ই ওদের কাজ দেখার জন্য মোড়া নিয়ে বসি উঠানের একপাশে, নিরঞ্জন তার কাকার সঙ্গে হাত চালায়, সঙ্গে সঙ্গে তার মুখও চলতে থাকে। গুলশান, বনানী, বাড়ড়া অঞ্চলের সব খবর তার নখদর্পণে।
আজ বলল, দিদিমা, শোনছেন নি, মুনেম খাঁর লাশ নাকি কবর থনে উঠায়া ফেলছে?
আমি চমকে গেলাম! সে কি কথা? শুনি নি তো? কারা করল? কেন? বেশ একটা আত্মবিশ্বাসের ভাব নিয়ে নিরঞ্জন বলল, মুক্তিরা ওঠাইছে। অর মত বেইমানের লাশ নাকি এই দ্যাশে থাকতে দিব না।
চৈতন্য ধমক দিল, কি আজাইরা কথা কস্ নিরঞ্জন! এত কথা কস ক্যান?
আমি বললাম, আহা, বলতে দাও, আমি শুনতে চাই। চৈতন্য, আমার কাছে কোন কথা বলাতে তোমাদের ভয় নেই। আমার ছেলেওতো মুক্তি ছিল। নিরঞ্জন, তুমি মুক্তিদের কথা এত জান কি করে?
নিরঞ্জন উৎসাহ পেয়ে বলল, বারে জানমু না? আমাদের উইদিগে কি কম মুক্তি আছে? হেরা আকন করে, হ্যাগোর হাতে ইশটিনও আমি দেখছি না?
চৈতন্য নিরুপায়ের মত বলল, এই ছ্যারা ডুবাইবো আমারে। এত কথা কয়।
তোমার কোন ভয় নেই চৈতন্য। আমার কাছে বললে কোন ক্ষতি নেই। ওতো বাইরে কোথাও যায় না। হ্যাঁ নিরঞ্জন। তোমাদের গ্রামের মুক্তিদের কথা বল।
আমাগোর গেরামে তো মুক্তি নাই। তবে আশেপাশের গেরামে আছে। আমরা শুনি তাগোর কথা। অনেক পোলা আগরতলা থন টেরনিং লয়া আইছে। আমাগোর উইদিকের এক পোলাই তো মুনেম খারে মারছে। আমি সব জানি।
আমি ভয়ানক কৌতুহলী হয়ে উঠলাম, বল কি? তোমাদের ওদিককার ছেলে? তুমি ঠিক জান যারা মেরেছে, তারা মুক্তিবাহিনীর ছেলে?
হ, তারা আগরতলা থন টেরনিং লয়া আসছে। তাগোর হাতেইশূটিন আছে, তাগো কাছে গিরনেড আছে। একদম আনারসের লাহান দেখতে।
তুমি দেখেছ?
আমি নিজের চখে দেখি নাই। তবে শুনছি।
আচ্ছা নিরঞ্জন, তুমি মেলাঘর বলে কোন জায়গার নাম শুনেছ? ঐ আগরতলার কাছে?
শুনছি মনে লয়। মেলাঘর, আগরতলা, হ,–ঐ পোলারা মেলাঘরের পোলাই বটে।
বল দেখি, কিভাবে মোনেম খুঁকে মেরেছে? কি বৃত্তান্ত শুনেছ?
অগোর মইধ্যে এক পোলা মুনেম খারে মাইরা আসার পর কথাডা চাউর হয়া যায়। গেরামে কোন কথা তো গোপন থাকে না। ঐ পোলা অনেকদিন থেইকাই চেষ্টা করতাছিল–অয় নাকি মেলাঘর থেইকাই মুনেম ধরে মারনের অর্ডার লয়া আইছিল। মুনেম খার বাড়ির গরুর রাখাল অরে সাহায্য করছে। মুনেম খার মেলাই গরু আছিল তো–তার যে রাখাল, হেই রাখাল মুনেম খার উপর সন্তুষ্ট আছিল না। হেরে নাকি বেতন দিত না, বেতন চাইলেই পুলিশের ডর দেখাইত। মুনেম খালোক খুব খারাপ আছিল তো। অই রাখালের লগে কি কইরা যেন ঐ পোলা ভাব কইরা ফালায়। সইন্দা বেলায় রাখাল যখন গরুর পাল লয়া বাড়ির ভিতর ঢুকত, সেই সময় তার লগে ঐ মুক্তিপোলা বাড়ির ভিতর ঢুকে। তাছাড়া তো ঢুকন একদম অসাদ্য। সামনের গেটে বন্দুক হাতে পাহারা, ভিতরে পিস্তল হাতে মুনেম খার বোটিগাড়। ঐ পোলা একদিনে পারে নাই, দুই দিন সন্দায় ঢুকছে কিন্তু সুবিধা করতে পারে নাই, মুনেম খাঁ দুতলায় ছিল, শ্যাষে পিছনের পাচীর টপকায়া পলায় গেছে। তিন দিনের দিন মুনেম খাঁ একতলায় বসার ঘরে বইসা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা কইতেছিল, সেই সময় তারে মারছে ইশটিন দিয়া। তারপর পিছনের পাচীর টপকায়া পলাইছে। মুনেম খাঁর সেই রাখালও পলাইছে।
নিরঞ্জনের কথায় আমি চমৎকৃত হলাম, এই সব অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত গ্রামের কছেলেদের আমরা কতই না অবহেলার চোখে দেখি, অথচ এদের বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিতু, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, খবর সংগ্রহের তৎপরতায় এরা রয়টারের সংবাদদাতাকেও হার মানায়!
তুমি ওই মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছ? দেখছি, মুনেম খাঁ মরণের পরদিন তো অরে দেখতে আশপাশের গ্রামের অনেকেই যাইতেছিল। আমিও গেছিলাম। দূর থনে দেখছি। অত লোক জানাজানি হইতে অর বাপে কাকায় অরে কই জানি পাঠায়া দিছে।
নাম জান ছেলেটার?
নিরঞ্জন লজ্জিত হাসল, শুনছিলাম তো। ভুইলা গেছি। কেমন জানি খটোমটো নাম, জিব্বার আগায় আইতে চায় না।
আজ শরীফ দুপুরে ফিরল অন্যদিনের চেয়ে অনেক দেরি করে। প্রায় আড়াইটায়। দেখি মুখ লাল, চোখে উত্তেজনা। ঘরে ঢুকেই বলল, জবর খবর! জবর খবর! ডি.আই.টি. বিল্ডিংয়ে বোম ব্লাস্ট করেছে।
তাই নাকি? কখন? এই তো সোয়া একটার সময়। আমাদের অফিসের কাছেই তো। একটুখানি খবরাখবর যোগাড় করে আসতে দেরি হল।
কি সর্বনাশ। ব্লাস্ট শুনেই তো ভেগে চলে আসা উচিত ছিল।
শরীফ হাসতে লাগল, ব্লাস্ট শুনে রাস্তায় নামলে আর দেখতে হত না। মিলিটারিতে কাক করে ধরে নিত। অফিসের ভেতর বসে থাকাই তো নিরাপদ। ফোনে খবরটবর নিলাম। তারপর রাস্তাঘাট একটু ক্লিয়ার দেখে তবে বেরোলাম।
কি রকম ভেঙেছে? কোন কোন তলা?
সাততলায়। টাওয়ারের একদিকে মস্ত একটা গর্ত হয়ে গেছে। আমাদের অফিসের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল–সেই ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। আর ভেতরে আগুন জ্বলছিল।
আমি তাজ্জব। কি সাংঘাতিক কাণ্ড। একতলা নয়, দোতলা নয়, একেবারে সাততলায়? এখন তো শুনেছি, প্রতি তলাতেই সিঁড়ির মুখে আলাদা আলাদা চেকপোস্ট। নিচতলায় বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে গেটে চেকপোস্ট, বিল্ডিংয়ে উঠতে চেকপোস্ট, তারপরও প্রতি তলায়। এতগুলো চেকপোস্টে এতগুলো মিলিটারির চোখে ধুলো দিয়ে উঠলো কি করে? আর এতবড় বিস্ফোরণ ঘটাবার মত এত বিস্ফোরকই বা ভেতরে নিল কি করে? সত্যি, বিচ্ছুরা দেখাচ্ছে বটে! আমি বললাম, আমারো কিছু জবরখবর আছে।
বলো। তার বদলা আমিও আরো দুটো খবর বলতে পারব।
আমি শরীফকে নিরঞ্জনের খবর বললাম। শরীফ বলল, গতকাল ভোর রাতে মতিঝিল গার্লস হাই স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের বাসায় বোমা ছুড়েছে মুক্তিরা। তাতে বিল্ডিংয়ের বেশ ক্ষতি হয়েছে, তিনজন জখমও হয়েছে। আর গতকাল সন্ধ্যা রাতে বিচ্ছুরা খিলগাঁওয়ে একটা জায়গায় রেললাইনের খানিকটা অংশ ধসিয়ে দিয়েছে বোমা মেরে।
খবর শুনে আমি একটু হেসে বললাম, রোজই এই রেটে নতুন নতুন খবর শুনতে পেলে বেশ হয়!
শরীফও হাসল, আশা করি পেতে থাকব।