২৭. হেগেল

২৭. হেগেল

… যা টিকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটাই যৌক্তিক..

হিল্ডা ছেড়ে দিতে রিং বাইন্ডারটা বেশ ভারি একটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। সিলিং-এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। তার মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে।

এবার তার বাবা তার মাথাটা আসলেই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পাজী কোথাকার।

কী করে পারলেনতিনি এমন কাজ করতে?

সোফি তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছে। হিল্ডাকে সে বলেছে তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে। আর, হিল্ডার মনের ভেতর একটা আইডিয়া সে শেষমেষ সত্যিই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। একটা আইডিয়া…।

 সোফি আর অ্যালবার্টো তার বাবার মাথার একটা চুলও ছুঁতে পারবে না, কিন্তু হিল্ডা পারবে। আর হিল্ডার মাধ্যমে সোফি তার বাবার কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।

সোফি আর অ্যালবার্টোর সঙ্গে সে একমত যে তার বাবা তার ছায়ার খেলাটা নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করছেন। হলোই বা অ্যালবার্টো আর সোফি তার কল্পনার সৃষ্টি ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু কতটুকু ক্ষমতা প্রদর্শনের এক্তিয়ার তিনি নিজেকে দেবেন তার একটা সীমা থাকতে হবে তো।

বেচারি সোফি আর অ্যালবার্টো! মেজর লোকটার কল্পনার বিরুদ্ধে ওরা ঠিক ততটাই অসহায় ছবির পর্দা যতটা অসহায় ফিল্ম প্রোজেক্টরের বিরুদ্ধে।

বাবা বাড়ি ফিরলে হিল্ডা যে তাঁকে একটা শিক্ষা দেবে তাতে কোনো ভুল নেই! দুর্দান্ত ভালো একটা প্ল্যানের আবছা কাঠামো সে এরিমধ্যে দেখতে পাচ্ছে।

উঠে পড়ল সে, উপসাগরের দিকে তাকাবার জন্যে এগিয়ে গেল। প্রায় দুটো বাজে। জানালা খুলে বোট হাউসটা লক্ষ্য করে ডেকে উঠল।

মা!

ওর মা বেরিয়ে এলেন।

কিছু স্যান্ডউইচ নিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিচে আসছি আমি, ঠিক আছে?

ফাইন।

হেগেল-এর ওপর একটা চ্যাপ্টার পড়তে হবে শুধু।

লেকের দিকে মুখ করা জানলাটার পাশে দুটো চেয়ারে বসেছেন অ্যালবার্টো আর সোফি।

গিয়র্গ উইলহেম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhem Friedrich Hegel) ছিলেন রোমান্টিসিজমের বৈধ উত্তরসুরী, শুরু করলেন অ্যালবার্টো। এ-কথা একরকম বলা-ই যেতে পারে যে জার্মান সত্তা যখন জার্মানীতে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল তখন তার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে স্টুটগার্টে জন্ম হয় তাঁর তারপর আঠারো বছর বয়েসে ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন টুবিঙ্গেন-এ। ১৭৯৯ সালে জেনা শহরে শেলিং-এর সঙ্গে যখন তিনি কাজ শুরু করেন রোমান্টিক আন্দোলন তখন রীতিমত বিস্ফোরক বিকাশ লাভ করছে। জেনাতে কিছুকাল সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাটাবার পর জার্মান জাতীয় রোমান্টিসিজমের কেন্দ্র হাইডেলবার্গে তিনি অধ্যাপক পদ লাভ করেন। ১৮১৮-তে যখন বার্লিনে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন, তখনই শহরটি ইউরোপের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হয়ে উঠছিল। ১৮৩১-এ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি, কিন্তু তার আগেই হেগেলবাদ-এর প্রচুর অনুসারী তৈরি হয়ে গেছে জার্মানীর প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তাহলে তার প্রভাব তো কম ছিল না দেখছি।

হ্যাঁ আর সে-কথা তাঁর দর্শনের বেলাতেও প্রযোজ্য। রোমান্টিক যুগে উদ্ভব হওয়া প্রায় সমস্ত ধারণা একত্রিত এবং সেগুলোর বিকাশ সাধন করেছিলেন তিনি। তবে শেলিংসহ অনেক রোমান্টিক সম্পর্কেই তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি।

ঠিক কোন বিষয়টির সমালোচনা করেছিলেন তিনি?

শেলিং এবং অন্যান্য রোমান্টিকেরা বলেছিলেন যে জীবনের গভীরতম অর্থ নিহিত রয়েছে, তাদের ভাষায় বিশ্ব চিদাত্মা-র মধ্যে। হেগেল-ও বিশ্ব চিদাত্মা কথাটি ব্যবহার করেছেন, তবে এক নতুন অর্থে। তিনি যখন বিশ্ব চিদাত্মা বা বিশ্ব প্রজ্ঞা-র কথা বলেন তখন তিনি বোঝাতে চান সমগ্র মানবিক উচ্চারণকে, কারণ কেবল মানুষেরই চিদাত্মা রয়েছে।

এই অর্থে তিনি সমগ্র ইতিহাস জুড়ে বিশ্ব চিদাত্মা-র অগ্রযাত্রার কথা বলতে পারছেন। তবে সে যা-ই হোক, এ-কথা আমরা যেন না ভুলি যে তিনি আসলে বলছেন মানব জীবন, মানব ইতিহাস আর মানব সংস্কৃতির কথা।

এতে করে এই চিদাত্মা-টি অনেক কম ভূতুড়ে রূপ নিচ্ছে। পাথর আর গাছের মধ্যে সেটা এখন আর একটা ঘুমন্ত বুদ্ধিমত্তা-র মতো ওঁৎ পেতে থাকছে না।

 তো, এখন, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে das Ding an sich বলে একটা জিনিসের কথা বলেছিলেন কান্ট। প্রকৃতির গূঢ়তম রহস্য সম্পর্কে মানুষ কোনো স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারে বলে তিনি মনে না করলেও এক অপ্রাপনীয় সত্য-র অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। হেগেল বললেন, সত্য বিষয়ীগত (subjective), অর্থাৎ মানবিক প্রজ্ঞার অতিরিক্ত বা বাইরের কোনো সত্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন তিনি। তার বক্তব্য হচ্ছে, সমস্ত জ্ঞানই মানবিক জ্ঞান।

দার্শনিকদের আবার মাটিতে নামিয়ে আনতে হয়েছিল তাকে, তাই না?

 হ্যাঁ, তা বোধকরি তুমি বলতে পারো। সে যাই হোক, হেগেলের দর্শন এমনই সর্বব্যাপী আর বিচিত্রমুখী যে আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্যের খাতিরে প্রধান প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আলাপ করেই সন্তুষ্ট থাকব আমরা। অবশ্য, হেগেলের আদৌ কোনো নিজস্ব দর্শন ছিল বলে দাবি করা যায় কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। হেগেলের দর্শন বলে যা পরিচিত তা প্রধানত ইতিহাসের অগ্রযাত্রাকে বোঝার বা অনুধাবন করার একটা পদ্ধতি মাত্র। জীবনের অন্তঃপ্রকৃতি সম্পর্কে হেগেলের দর্শন কিছুই শেখায় না আমাদের, তবে তা সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে শেখাতে পারে।

সেটাও বা কম কীসে?

হেগেলের পূর্ববর্তী সমস্ত দার্শনিক পদ্ধতির ভেতরেই একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল আর তা হলো মানুষ এ-জগৎ সম্পর্কে কী জানতে পারে সে-ব্যাপারে একটি চিরন্তন মাপকাঠি স্থাপনের চেষ্টা। দেকার্ত, স্পিনোজা, হিউম আর কান্টের বেলাতে এ-কথা সত্য। প্রত্যেকেই মানবিক বোধ-এর ভিত্তিটাকে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তবে তাঁদের প্রত্যেকেই জগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের চিরন্তন দিকটির কথা বলেছেন।

সেটাই তো দার্শনিকের কাজ, তাই না?

ব্যাপারটা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন না হেগেল। তিনি মনে করতেন যে মানবিক বোধ-এর ভিত্তি প্রজন্ম ভেদে পরিবর্তিত হয়। কাজেই চিরন্তন সত্য বলে কিছু নেই, নেই কোনো চিরন্তন প্রজ্ঞা। একমাত্র যে স্থির বিন্দুটি দর্শন আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে তা হলো খোদ ইতিহাস।

আপনাকে বোধকরি এটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। ইতিহাস তো অনবরত বদলাচ্ছে, সেটা কী করে একটা স্থির বিন্দু হয়?

নদীরও তো নিত্যই পরিবর্তন ঘটছে। তার মানে তো এই নয় যে সেটা নিয়ে তুমি কথা বলতে পারবে না। তবে উপত্যকার ঠিক কোনখানটায় যে একটা নদী সবচেয়ে খাঁটি বা আসল নদী তা কিন্তু তুমি বলতে পারবে না।

তা ঠিক, কারণ আগাগোড়া-ই সেটা একই নদী।

কাজেই হেগেলের কাছে ইতিহাস ছিল ছুটে চলা এক নদীর মতো। নদীর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পানির প্রতিটি ক্ষুদ্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রিত হয় অনেক উজানে পানির ঢল আর ঘূর্ণির কারণে। কিন্তু তুমি নদীটার যেখানে তাকিয়ে আছো সেখানকার পাথর-টাথর আর বাঁকও এইসব আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করে।

মনে হয় বুঝতে পারছি…

আর চিন্তা বা প্রজ্ঞার ইতিহাস এই নদীর মতো। অতীত ঐতিহ্যের স্রোতের ধারায় যে-সব চিন্তা-ভাবনা ধৌত হয়ে আসে সেসব আর সে-সময়কার বস্তুগত অবস্থা, এই দুটি জিনিস তোমার চিন্তার ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই তুমি কখনোই এমন দাবি করতে পারো না যে বিশেষ একটা চিন্তা সর্বকালের জন্যে সঠিক। অবশ্য তুমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ওটা সঠিক হতে পারে।

এ-কথা বলার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে প্রতিটি জিনিস-ই একই রকম ন্যায় বা সঠিক অথবা একই রকম অন্যায় বা ভুল, ঠিক কি না?

তা তো বটেই, তবে বিশেষ একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কিছু জিনিস সঠিক বা ভুল হতে পারে। আজ যদি তুমি দাসপ্রথার কথা প্রচার করতে তাহলে তোমাকে একটা নির্বোধ ছাড়া কিছু ভাবা হতো না। কিন্তু ২,৫০০ বছর আগে কিন্তু নির্বোধ ভাবা হতো না তোমাকে, যদিও দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে সেই সময়-ও প্রগতিশীল কথা-বার্তা বলা হচ্ছিল। অবশ্য আমরা আরো কাছের একটা উদাহরণ নিতে পারি। একশো বছর আগেও চাষবাসের জন্যে বনভূমির বিশাল একটা এলাকা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলাটা অসঙ্গত বলে ভাবা হতো না। কিন্তু আজ কাজটা ভীষণরকমের অসঙ্গত হবে। এ-ধরনের বিচার-বিবেচনার জন্যে আজ আমরা একেবারে ভিন্ন এবং আরো ভালো একটা ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছি।

এখন বুঝতে পারছি।

হেগেল মন্তব্য করেছেন যে দর্শনগত অনুচিন্তন-এর (reflection) ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞা যথেষ্ট শক্তিশালী; সত্যি বলতে, এটা একটা প্রক্রিয়া। আর সত্য হচ্ছে এই একই প্রক্রিয়া, যেহেতু খোদ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো মানদণ্ড নেই যা নির্ণয় করতে পারে কোনটি সবচেয়ে সত্যি বা সবচেয়ে যৌক্তিক।

উদাহরণ, প্লীজ।

প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, রেনেসাঁ বা আলোকপ্রাপ্তির সময় থেকে বিশেষ কিছু চিন্তা ভাবনা বা ধ্যান-ধারণা বেছে নিয়ে সেগুলোকে সঠিক বা ভুল আখ্যা দেয়া যায় না। ঠিক একইভাবে তুমি বলতে পারো না যে প্লেটোর কথা ভুল বা অ্যারিস্টটলের কথা ঠিক। তুমি এ-ও বলতে পারো না যে হিউম ভুল বলেছিলেন, কিন্তু কান্ট আর শেলিং ঠিক বলেছিলেন। বললে সেটা হবে চিন্তার একটা অনৈতিহাসিক পদ্ধতি।

হ্যাঁ, কথাটা ঠিক শোনায় না।

সত্যি বলতে কী, কোনো দার্শনিককে বা আদৌ কোনো চিন্তাকে তুমি সেই দার্শনিকের বা সেই চিন্তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারো না। তবে– এখানে আমরা অন্য একটা প্রসঙ্গে এসে পড়ছি– নতুন কিছু যেহেতু সবসময়ই যোগ হচ্ছে, তাই প্রজ্ঞা প্রগতিশীল। অন্য ভাবে বলতে গেলে, মানবিক জ্ঞান নিত্যই সম্প্রসারিত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে।

তার অর্থ কি এই যে তারপরও কান্টের দর্শন প্লেটোর দর্শনের চেয়ে ঠিক?

 হ্যাঁ, বিশ্ব চিদাত্মা প্লেটো থেকে কান্ট পর্যন্ত বিকাশ লাভ করেছে, এগিয়ে গেছে। এবং ব্যাপারটা খারাপ কিছু হয়নি। সেই নদীর উদাহরণে ফিরে গেলে বলতে হয় সেখানে এখন আরো অনেক পানি এসে জড়ো হয়েছে। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বয়ে চলেছে নদীটা। কথা শুধু, কান্টের এ-কথা ভাবলে চলবে না যে তার সত্যগুলো নদীটার তীরে অটল অনড় পাথরের মতো রয়ে যাবে। কান্টের চিন্তা ভাবনাও প্রক্রিয়াজাত হতে পারে আর তার প্রজ্ঞা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমালোচনার বিষয়-বস্তু হতে পারে। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে।

কিন্তু আপনি যে-নদীটার কথা বলেছিলেন…

 হ্যাঁ?

 সেটা কোথায় যায়?

হেগেল দাবি করেছেন বিশ্ব চিদাত্মা তার নিজের সম্পর্কে এক ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের দিকে বিকশিত হচ্ছে। ব্যাপারটা ঠিক নদীর মতোই, নদী যতই সমুদ্রের নিকটবর্তী হয় ততোই তা চওড়া হতে থাকে। হেগেল-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ইতিহাস হচ্ছে বিশ্ব চিদাত্মা-র ক্রমেই সচেতন হয়ে ওঠার গল্প। জগৎ যদিও বরাবরই অস্তিত্বশীল কিন্তু মানব-সংস্কৃতি আর মানব-প্রগতি বিশ্ব চিদাত্মাকে ক্রমবর্ধমানভাবে নিজের অন্তর্নিহিত মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে।

তিনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?

ব্যাপারটাকে তিনি দাবি করেছেন ঐতিহাসিক বাস্তবতা হিসেবে। এটা কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়। ইতিহাস অধ্যয়ন করেন এমন যে-কেউ-ই দেখতে পাবেন যে মানবতা ক্রমবর্ধমান জ্ঞান আর সু-উন্নয়নের দিকে এগিয়ে গেছে। হেগেল এর বক্তব্য অনুযায়ী, অধ্যয়ন আমাদের দেখিয়ে দেয় যে মানবতা এগিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর যৌক্তিকতা (rationality) আর স্বাধীনতার দিকে। ইতিহাসগত বিকাশ বা উন্নয়ন সেটার সমস্ত লম্ফ-ঝম্ফ সত্ত্বেও, প্রগতিশীল। আমরা বলি, ইতিহাস নির্দিষ্ট লক্ষ্য সাধনে নিয়োজিত।

সেজন্যেই তা বিকাশ লাভ করে। সেটা খুব পরিষ্কার।

ঠিক। ইতিহাস হচ্ছে অনুধ্যানের দীর্ঘ একটি শেকল। অনুধ্যানের এই শেকল সম্পর্কে বিশেষ কিছু নিয়ম-নীতির দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন হেগেল। গভীরভাবে ইতিহাস চর্চা করছেন এমন কেউ লক্ষ করবেন যে একটি চিন্তা বা ধারণার প্রস্তাব দেয়া হয় পূর্ববর্তী অন্যান্য প্রস্তাবিত চিন্তা বা ধারণার ভিত্তিতে। কিন্তু চিন্তাটি প্রস্তাবিত হতে না হতেই আরেকটি চিন্তা বা ধারণা সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। এই দুই বিপরীতধর্মী চিন্তা-পদ্ধতির মধ্যে তৈরি হয় একটি দ্বন্দ্ব। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে তৃতীয় আরেকটি চিন্তার প্রস্তাবের মাধ্যমে, যেখানে ঠাই পায় আগের দুটো বক্তব্যের সেরা অংশটি। হেগেল একে বলছেন দ্বান্দ্বিক (dialectic) প্রক্রিয়া।

একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?

প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকেরা আদিম সারবস্তু (primeval substance) আর পরিবর্তনের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, মনে আছে তোমার?

অল্প-বিস্তর।

এরপর ইলিয়াটিকরা (Eliatics) এসে বললেন পরিবর্তন জিনিসটা আদপেই অসম্ভব। কাজেই ইন্দ্রিয় দিয়ে পরিবর্তন লক্ষ করার পরেও সেগুলো অস্বীকার করতে বাধ্য হলেন তাঁরা। এলিয়াটিকরা একটা দাবি বা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন এবং এ-ধরনের একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে হেগেল বলেছেন থিসিস (thesis) বা মত।

আচ্ছা?

কিন্তু কোথাও এ-রকম চরম কোনো দাবি উত্থাপিত হলে তার একটি বিরুদ্ধ দাবি উঠবে। হেগেল ব্যাপারটিকে বলছেন অস্বীকৃতি (negation)। ইলিয়াটিক দর্শনের অস্বীকৃতি ছিল হেরাক্লিটাস, যিনি বললেন সব কিছুই পরিবর্তনশীল। তো, এবার নাটকীয় রকমের বিপরীতমুখী এই দুই ঘরানার চিন্তার মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। কিন্তু এম্পিডক্লেস যখন দেখিয়ে দিলেন যে দুটো দাবিই অংশত সঠিক, অংশত ভুল তখন এই দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটল।

হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি আমি..

ইলিয়াটিকরা এই দিক দিয়ে ঠিক বলেছিলেন যে আসলে কিছুই বদলায় না, তবে তারা এ-কথাটি ঠিক বলেননি যে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর ভরসা রাখতে পারি না। হেরাক্লিটাস এ-কথা ঠিকই বলেছিলেন যে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর ভরসা করতে পারি, কিন্তু একটা তিনি ঠিক বলেননি যে সব কিছু বদলে যায়।

কারণ সারবস্তু আছে একাধিক। এই সারবস্তুগুলোর কম্বিনেশনটা বদলায়, সারবস্তুগুলো নয়।

ঠিক! এম্পিডক্লেসের দৃষ্টিভঙ্গি– যা দুই ঘরনার চিন্তার মধ্যে একটা আপোষরফা করে দিয়েছে– সেটাকে হেগেল বলছেন অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি।

কী ভয়ংকর নাম!

জ্ঞানের এই তিনটে ধাপকে তিনি আরো বলেছেন থিসিস, অ্যান্টিথিসিস আর সিন্থেসিস। যেমন ধরো, তুমি বলতে পারো দেকার্তের বুদ্ধিবাদ (rationalism) ছিল একটা থিসিস, যার প্রতিবাদ করল হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী অ্যান্টিথিসিস। কিন্তু সেই বিরুদ্ধতা বা দুই ধরনের চিন্তার মধ্যেকার দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটালো কান্টের সিন্থেসিস। কান্ট বুদ্ধিবাদীদের কিছু কথার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন, আবার অভিজ্ঞতাবাদীদের কিছু কথার সঙ্গেও একমত হলেন। কিন্তু কান্টের সঙ্গে সঙ্গেই গল্পটা শেষ হয়ে গেল না। কান্টের সিন্থেসিস এবার অনুচিন্তার আরেকটি শৃঙ্খল বা ত্রিপদী-র যাত্রা বিন্দু হয়ে দাঁড়াল। কারণ একটা সিন্থেসিস-এর বিরুদ্ধে সব সময়ই আরেকটা অ্যান্টিথিসিস দাঁড়িয়ে যাবে।

এর সবই বড্ড বেশি তাত্ত্বিক!

হা, আলবাৎ তাত্ত্বিক। কিন্তু বিষয়টিকে হেগেল এমনভাবে দেখেননি যে এটা ইতিহাসকে বিশেষ কোনো কাঠামোর মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করতেন ইতিহাস নিজেই এই দ্বান্দ্বিক প্যাটার্নটির প্রকাশ ঘটিয়েছে। ফলে হেগেল দাবি করলেন প্রজ্ঞার বিকাশের বা ইতিহাসের মাধ্যমে বিশ্ব চিদাত্মা-র বিকাশ লাভের কিছু সূত্র আবিষ্কার করেছেন তিনি।

সেই কথাই এলো ঘুরে ফিরে।

কিন্তু হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা শুধু যে ইতিহাসের বেলাতেই প্রযোজ্য তা নয়। চিন্তা করার সময়ও দ্বান্দ্বিকভাবে চিন্তা করি আমরা। যুক্তির ভেতরে দোষ খুঁজতে চেষ্টা করি আমরা। হেগেল একে বলছেন নেতিবাচক চিন্তা। তবে একটা যুক্তিতে দোষ খুঁজে পাবার পর আমরা কিন্তু যুক্তিটার সবচেয়ে ভালো অংশটা খারিজ করে দিই না, বরং সেটুকুকে তুলে রাখি।

একটা উদাহরণ দিন।

এই যেমন, একজন সমাজবাদী আর একজন রক্ষণশীল মানুষ যখন একসঙ্গে বসে সামাজিক একটা সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেন তখন তাঁদের চিন্তার বিপরীতমুখী ধরনের মধ্যে শিগগিরই একটা দ্বন্দ্ব ফুটে উঠবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একটি পুরোপুরি সঠিক অন্যটি পুরোপুরি ভুল। এটা খুবই সম্ভব যে দুটোই আংশিক সঠিক, আংশিক ভুল। আর, তর্কটা জমে উঠতে থাকলে দুটো যুক্তির-ই সবচেয়ে ভালোটুকু দানা বেঁধে উঠবে।

আশা করি।

কিন্তু আমরা যখন এ-রকমের একটা আলোচনার সংকটপূর্ণ অবস্থায় থাকি তখন কোন অবস্থানটা বেশি যৌক্তিক তা ঠিক করা খুব সহজ নয়। এক অর্থে, কোনটা ঠিক আর কোনটা নয় সে-সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ইতিহাসের ওপর। যা টিকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটাই যৌক্তিক।

যা টিকে থাকে সেটাই ঠিক।

বা তার উল্টো: যেটা ঠিক সেটাই টিকে থাকে।

আমার জন্যে ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যাবে না?

দেড়শ বছর আগে বেশ কিছু মানুষ নারীর অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করছিলেন। আবার অনেকেই নারীকে সমানাধিকার দেবার প্রচণ্ড বিরোধিতাও করেছিলেন। আজ যখন আমরা দুপক্ষের যুক্তি পড়ি তখন এটা বুঝতে কষ্ট হয় না কাদের মত বেশি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে আমাদের এই জ্ঞানটা ঘটনা-পরবর্তী জ্ঞান। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে যারা সমানাধিকারের জন্যে লড়েছিলেন তাঁরাই ঠিক ছিলেন। অনেকেই আজ নিঃসন্দেহে কুঁকড়ে যেতো যদি তারা ছাপার অক্ষরে দেখতো তাদের পূর্বপুরুষেরা এই বিষয়টি সম্পর্কে কী বলেছিলেন।

আমি নিশ্চিত আসলেই তাই হতো তারা। তা, হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রসঙ্গে?

সেটা নিয়েই তো কথা বলছি আমরা, তাই না?

একটা উদ্ধৃতি শুনবে?

অবশ্যই।

হেগেল বলছেন, পুরুষ এবং নারীর মধ্যে পার্থক্য জীব-জন্তু আর উদ্ভিদের মধ্যে পার্থক্যের মতো। পুরুষ হচ্ছে জীব-জন্তুর মতো, অন্যদিকে নারী উদ্ভিদের মতো, কারণ তাদের বিকাশটা অপেক্ষাকৃত শান্ত রকমের আর সেটার নেপথ্যে যে। নীতিটা কাজ করে তা হচ্ছে অনুভূতির এক ধরনের অস্পষ্ট ঐক্য। নারী যখন সরকারের হাল ধরে রাষ্ট্র তখন মুহূর্তের মধ্যে ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়, কারণ নারী সার্বজনীনতার দাবির সাহায্যে নিজের ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে না, করে খেয়ালি ঝোঁক আর মতামত-এর সাহায্যে। নারী শিক্ষা লাভ করে-কে জানে কীভাবে যেন নানান ধ্যান-ধারণার বাতাস টেনে নিয়ে, জ্ঞান আহরণ করে নয় বরং স্রেফ বেঁচে থেকে। অন্য দিকে পুরুষত্বের মর্যাদা অর্জিত হয় কেবল চিন্তার পীড়ন আর প্রায়োগিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

ধন্যবাদ, ঢের হয়েছে। এমনধারা কথাবার্তা আর শুনে কাজ নেই আমার।

কিন্তু কোন বিষয়টি যৌক্তিক বা বিচার-বিবেচনাপ্রসূত আর কোনটি নয় সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা কীভাবে পাল্টে যায় তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ এটা।

এতে প্রমাণ হয় হেগেলও ছিলেন তার সময়েরই সন্তান। আমরাও তাই। আমাদের সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিগুলিও কালের পরীক্ষায় উতরাতে পারবে না।

কোন দৃষ্টিভঙ্গিগুলো, উদাহরণ দিন।

সে-রকম কোনো উদাহরণ আমার কাছে নেই।

কেন নেই?

কারণ যে-সব জিনিসের উদাহরণ আমি দেবো সেগুলো এরিমধ্যে একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরো, আমি বলতে পারি গাড়ি চালানো নির্বুদ্ধিতা, কারণ গাড়ি পরিবেশ দূষণ করে। এরিমধ্যে অনেক মানুষ এ-রকম ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু ইতিহাস এ-কথা প্রমাণ করবে যে যে-সব ব্যাপার আমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে বোধগম্য তার অনেকগুলোই ইতিহাসের আলো দেখলে মুখ লুকোবে।

আচ্ছা।

আরেকটা ব্যাপারও দেখতে পাবো আমরা: হেগেলের সময়ের অনেক মানুষ, যারা নারীর হীনতর অবস্থা সম্পর্কে ও-রকম অশালীন কথাবার্তা আওড়াতো তারাই কিন্তু নারীদের বিকাশ ত্বরান্বিত করেছিল।

কীভাবে?

 তারা একটা থিসিস উপস্থাপন করেছিল। কেন? কারণ তখনই নারীরা বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিল। যে-বিষয়ে সবাই একমত তা নিয়ে তো আর মন্তব্য করার দরকার হয় না। তো, যত অশালীনভাবে তারা নারীর হীনতর অবস্থা সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য রাখছিল ততোই জোরালো হয়ে উঠছিল অস্বীকৃতিটা।

হ্যাঁ, তাই তো হবে।

তুমি হয়ত বলতে পারো যে সবচেয়ে ভালো যে-ব্যাপারটা ঘটতে পারে তা হচ্ছে প্রবল রকমের সক্রিয় বিরুদ্ধপক্ষ জোটা। তারা যতই প্রবল হয়ে উঠবে, ততোই শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে তাদের। নিখাদ যুক্তিবিদ্যা বা দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে, দুটি ধারণার মধ্যে প্রায়ই একটা দ্বান্দ্বিক উত্তেজনা দেখা দেবে।

যেমন?

আমি যদি সত্তা নামক ধারণাটি নিয়ে চিন্তা করি তাহলে তার বিরুদ্ধ ধারণা অসত্তা বা নেতি-র (nothing) কথাও ভাবতে বাধ্য হবো আমি। তোমার অস্তিত্বের কথা চিন্তা করতে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুমি এ-কথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে তুমি চিরদিন থাকবে না। সত্তা আর অসত্তা বা নেতি-র মধে,কার দ্বন্দ্ব ঘুচে যায় হয়ে ওঠা বা পরিবর্তন-এর (becoming) ধারণার মধ্যে। কারণ কোনো কিছু যদি হয়ে ওঠা বা পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে তবে তা একই সঙ্গে অস্তিমান বা বর্তমান আবার তা নয়।

বুঝতে পারছি।

হেগেলের প্রজ্ঞা তাই গতিবাদী যুক্তিবিদ্যা (dynamic logic)। বাস্তবতা যেহেতু বিপরীতধর্মীতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, বাস্তবতার বর্ণনা তাই অবশ্যই নানান বিপরীত জিনিসে পরিপূর্ণ থাকবে। এবার তোমার জন্যে আরেকটা উদাহরণ: ডেনমার্কের পারমাণবিক পদার্থবিদ নীলস বোর নাকি একটা গল্প বলেছিলেন যে নিউটন তার সদর দরজার ওপর ঘোড়ার খুরের নাল লাগিয়ে রাখতেন।

ওটা সৌভাগ্যের চিহ্ন।

কিন্তু ওটা নেহাতই একটা কুসংস্কার এবং নিউটন আর যাই হোক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। সত্যি-ই তিনি এ-ধরনের জিনিসে বিশ্বাস করেন কিনা এ কথা জিগ্যেস করাতে তিনি বলেছিলেন, না, তা করি না, তবে জিনিসটা নাকি কাজ করে শুনেছি।

আশ্চর্য তো।

কিন্তু তাঁর উক্তিটা ছিল একেবারে দ্বান্দ্বিক, প্রায় পরস্পর-বিরোধী শব্দে গড়া একটা উক্তি। নীলস বোর, যিনি তার দ্ব্যর্থবোধকতার জন্যে আমাদের নরওয়ের কবি ভিনিয়ে-র মতোই বিখ্যাত ছিলেন, তিনি একবার বলেছিলেন: দুধরনের সত্য আছে। এক হচ্ছে উপরিগত সত্য (superficial truths), যার উল্টোটা অবশ্যই মিথ্যে বা ভুল। কিন্তু সেই সঙ্গে আছে গভীর সত্য (profound truths), যার বিপরীতটাও ঠিক একই রকমের সত্য বা সঠিক।

সে-সব আবার কেমন সত্য?

যেমন ধরো, যদি আমি বলি জীবন ছোট…

আমি মেনে নেবো।

কিন্তু অন্য একটা সময় আমি আমার দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলতে পারি জীবন খুব বড়।

ঠিকই বলেছেন। এক অর্থে সেটাও ঠিক।

সবশেষে, দ্বান্দ্বিক উত্তেজনা একটা স্বতঃস্ফূর্ত কাজে রূপ নিয়ে কীভাবে একটা পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে সে-ব্যাপারে তোমাকে আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

ঠিক আছে, দিন।

একটা কিশোরীর কথা কল্পনা করো যে সব সময়ই তার মায়ের কথার উত্তরে বলে হ্যাঁ, মা… ঠিক আছে, মা…তোমার যা ইচ্ছা, মা…এক্ষুণি করছি, মা।

আমার। তো শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

তো, শেষ পর্যন্ত মেয়েটার মা তার মেয়ের অতি বাধ্যতায় পুরোপুরি পাগল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন থামতো, তোকে এতো সুবোধ বালিকা হতে হবে না। আর তখন মেয়েটা বলে: ঠিক আছে মা।

আমি হলে একটা চড় লাগিয়ে দিতাম মেয়েটাকে।

হয়ত। কিন্তু তখন কী হতো যদি মেয়েটা তার বদলে উত্তরে এ-কথা বলে উঠত: কিন্তু আমি তো সুবোধ বালিকা-ই হতে চাই?

সেটা খুবই অদ্ভুত জবাব হতো। সে যাই হোক, আমি হয়ত তারপরেও চড়টা মারতাম ওকে।

অন্য কথায়, পরিস্থিতিটাকে একটা অচলবস্থা বলা যেতে পারে। দ্বান্দ্বিক উত্তেজনাটা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যেখানে একটা কিছু ঘটা খুব দরকার।

গালে একটা চড়ের মতোন?

হেগেলের দর্শনের শেষ একটা দিকের কথা উল্লেখ করা দরকার এখানে।

আমি শুনছি।

তোমার কি মনে আছে রোমান্টিকদের আমরা স্বাতন্ত্রবাদী বলেছিলাম?

রহস্যের পথ অন্তর্মুখী…

হেগেলের দর্শনে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদিতাও সেটার অস্বীকৃতি বা বিপরীতের মুখোমুখি হয়েছিল। হেগেল জোর দিয়েছিলেন, তাঁর ভাষায়, বিষয়গত বা নৈর্ব্যক্তিক (objective) শক্তির ওপর। এ-ধরনের শক্তিগুলোর মধ্যে আবার হেগেল জোর দিয়েছেন পরিবার, সুশীল সমাজ আর রাষ্ট্রের গুরুত্বের ওপর। তুমি এমনও বলতে পারো যে ব্যক্তির ব্যাপারে হেগেল সংশয়বাদী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি হচ্ছে সম্প্রদায়ের একটা জৈবিক অংশ। প্রজ্ঞা বা বিশ্ব চিদাত্মা প্রথম এবং প্রধানত প্রকাশিত হয়েছিল জনগণের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে।

আরো পরিষ্কার করে বলুন, দয়া করে।

প্রজ্ঞা নিজেকে প্রকাশিত করে প্রথমত ভাষার মধ্যে। আর, একটা ভাষা হচ্ছে এমন জিনিস যার ভেতর আমরা জন্ম নেই। নরওয়েজিয় ভাষা হ্যাঁনসেন সাহেবের তোয়াক্কা না করেই ভালোভাবে চলতে পারবে, কিন্তু হ্যাঁনসেন সাহেব নরওয়েজিয় ভাষা ছাড়া অচল। তার মানে ব্যক্তি ভাষা তৈরি করে না, ভাষা-ই ব্যক্তিকে তৈরি করে।

সে-কথা বোধ করি বলা যায়।

একটি শিশু যেমন একটি ভাষার ভেতর জন্ম নেয়, ঠিক তেমনি সে তার ঐতিহাসিক পটভূমির ভেতর-ও জন্ম নেয়। এবং এ-ধরনের পটভূমিকার সঙ্গে কারোরই স্বাধীন কোনো সম্পর্কে নেই। যে-মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে তার অবস্থান খুঁজে পায় না, সে তাই এক অনৈতিহাসিক মানুষ। তোমার হয়ত মনে পড়বে, এই ধারণাটি মহান এথেনীয় দার্শনিকদের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নাগরিকদের ছাড়া যেমন রাষ্ট্রের কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র ছাড়াও নাগরিকদের কথা ভাবা যায় না।

অবশ্যই।

হেগেলের বক্তব্য অনুযায়ী, রাষ্ট্র ব্যক্তি নাগরিকের চেয়েও বেশি বা বড়। তাছাড়া, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সমষ্টি থেকেও বড়। কাজেই হেগেলের বক্তব্য হচ্ছে কেউ সমাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। নিজের সমাজের প্রতি স্রেফ উদাসীন হয়েও যে নিজের স্লা খুঁজে পেতে চায় তাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি-ই করবে শুধু।

ঠিক বুঝতে পারছি না আমি পুরোপুরি একমত কিনা, তারপরেও ঠিক আছে।

হেগেলের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যক্তি নিজেকে খুঁজে পায় না, বিশ্ব চিদাত্মা পায়।

বিশ্ব চিদাত্মা নিজেকে খুঁজে পায়?

হেগেল বলেছেন বিশ্ব চিদাত্মা তিনটে পর্যায়ে নিজের কাছে ফিরে যায়। এই কথার মাধ্যমে তিনি বলতে চাইছেন যে বিশ্ব চিদাত্মা তিনটি পর্যায়ে নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়।

যেমন?

 বিশ্ব চিদাত্মা প্রথমে নিজের সম্পর্কে সচেতন হয় ব্যক্তির মধ্যে। এটাকে হেগেল বলছেন বিষয়ী চিদাত্মা (subjective spirit)। পরিবার, সুশীল সমাজ এবং সমাজে এটা একটা উচ্চতর চেতনায় পৌঁছোয়। হেগেল একে বলছেন বিষয়গত চিদাত্মা, কারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এটা আবির্ভূত হয়। কিন্তু একটা তৃতীয় পর্যায় রয়েছে…

আর সেটা হলো…?

বিশ্ব চিদাত্মা সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্রাপলব্ধিতে পৌঁছোয় পরম চিদাত্মায়। আর এই পরম চিদাত্মা হচ্ছে শিল্প, ধর্ম আর দর্শন। এবং এদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান হচ্ছে দর্শন, কারণ দর্শনের মধ্যেই বিশ্ব চিদাত্মা ইতিহাসের ওপর তার নিজের প্রভাব-এর কথা বিবেচনা করে। কাজেই বিশ্ব চিদাত্মা প্রথমে নিজের মুখোমুখি হয় দর্শনের মধ্যে। তুমি বোধকরি বলতে পারো যে দর্শন-ই বিশ্ব চিদাত্মার আয়না।

ব্যাপারটা এতো রহস্যজনক যে এটা নিয়ে চিন্তা করার জন্য সময় দরকার আমার। কিন্তু শেষ যে-কথাটা বললেন সেটা পছন্দ হয়েছে আমার।

কোন কথাটা, দর্শন যে বিশ্ব স্যার আয়না, এটা?

হ্যাঁ, কথাটা খুব সুন্দর। আপনার কি মনে হয় এর সঙ্গে পেতলের আয়নাটার কোনো সম্পর্ক আছে?

জিজ্ঞেস করছো যখন, হ্যাঁ, আছে।

কী বলতে চাইছেন?

আমার ধারণা, পেতলের আয়নাটা যেহেতু যেখানে-সেখানে হুট করে উদয় হচ্ছে ওটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে?

সেই বিশেষ গুরুত্বটা কী সেটা সম্পর্কে আপনার নিশ্চয়ই একটা ধারণা আছে?

না নেই। আমি বলেছি যে হিল্ডা আর তার বাবার জন্যে বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন না করলে এটা এ-রকমভাবে আসতে থাকত না। সেই গুরুত্বটা কী সে-কথা জানে কেবল হিল্ডা।

এটা কি একটা রোমান্টিক আয়রনি?

প্রশ্নটার কোনো মানে হয় না, সোফি।

 কেন?

কারণ আমরা নিজেরা এটা নিয়ে কাজ করছি না। আমরা কেবল সেই আয়রনির অসহায় শিকার। কোনো ইচড়ে পাকা শিশু কাগজের ওপর কিছু আঁকলে তুমি সেই কাগজটাকে জিগ্যেস করতে পারো না সেই ছবিটার মানে কী।

আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছেন আপনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *