২৭. সোবাহান সাহেব ঘুমুবার আয়োজন করছিলেন

সোবাহান সাহেব ঘুমুবার আয়োজন করছিলেন। এই সময় মিলি এসে কিছুক্ষণ বাবার সঙ্গে হালকা গল্প গুজব করে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। পিঠ চুলকে দেয়। আজো সে এসেছে। তাবে আজ তার মুখ পাথরের মত। বসেছে চেয়ারে। তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। মনে হচ্ছে কঠিন কিছু বলবে। সোবাহান সাহেব তরল গলায় বললেন, কেমন আছিসরে মা?

ভাল আছি। বাবা।

কিছু বলবি?

হ্যাঁ।

বলে ফেল।

মিলি এবার বাবার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলায়, আমি একজনকে বিয়ে করে ফেলব বলে মন ঠিক করে ফেলেছি। বাবা। আমার সব কথা আমি সবার আগে তোমাকে বলি। আজও বললাম। সোবাহান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন,

ব্যাপারটা কি বলতো?

আমি কষ্ট পাচ্ছি। বাবা। আর সহ্য কতে পারছি না।

সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তোমার চিন্তায়, কাজে-কর্মে কখনো বাধা দেই না। এখনো দেব না। যদি তোমার কোন ছেলেকে সত্যি সত্যি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই বিয়ে করবে। ছেলেটা কে?

ছেলে নিচে বসে আছে।

ও আচ্ছা।

এখানে নিয়ে আসব?

তার দরকার দেখি না।

তাহলে তুমি পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে নিচে আস।

তোর হল কি মা বলতো? তুইতো এ রকম ছিলি না।

মিলির চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলে বলল, ছেলেটা সব কিছু জট পাকিয়ে ফেলে বাবা। ভাবে একটা করে আরেকটা। নিজে কষ্ট পায় অন্যকে কষ্ট দেয়। কাজেই আমার মনে হয় বিয়েটা অতি দ্রুত হওয়া দরকার।

হবে, দ্রুতই হবে।

আজ রাতে হলেই ভাল হয় বাবা।

তুই কি বলছিস মা?

মিলির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সোবাহান সাহেব উঠে এসে মেয়ের হাতে হাত রাখলেন। জ্বরে মিলির গা পুরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কিভাবে কে জানে। স্বাভাবিকভাইে যে কথা বলছে তা ভাবাও ঠিক না। কথা বলার ভঙ্গি এবং বিষয়বস্তু দুই-ই অস্বাভাবিক। সোবাহান সাহেব মেয়ের হাত ধরে নিচে নেমে এলেন।

ডাক্তার সোফায় বসে আছে। বাড়ির সব সদস্যই উপস্থিত। শুধু তাই না একজন কাজি সাহেবও আছেন। যে কোন কারণেই হোক কাজি সাহেবকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।

সোবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত আয়োজন কখন হল, কি ভাবে হল, কেনইবা হল? তিনি কেন কিছু জানেন না?

মনসুর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যারের শরীর কেমন?

ভাল।

ব্যাপার কি মনসুর?

বিয়ে হচ্ছে স্যার।

তা তো দেখছি। রহস্যটা কি?

মিনু শান্ত গলায় বললেন, তোমাকে রহস্য জানতে হবে না। তুমি চুপ করে বস।

মিনু রহস্য ভাঙ্গাতে চান না। অতি দ্রুত পুরো ব্যাপারটা ঘটার মূলে তাঁর হাত আছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তিনি কি কারণে মিলির ঘরে গেছেন। দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার, মিলি নেই। তিনি ঘরে ঢুকে বাতি জুলালেন। মিলি টেবিলে মুখ বন্ধ করা খাম। খামের উপরে লেখা, বাবা ও মাকে।

তিনি খাম খুলে আঁৎকে উঠলেন। গোটা গোটা হরফে লেখা- মা আমি কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। বেঁচে থাকা আমার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। তোমরা আমাকে বিদায় দাও।

অন্য কোন সুন্দর ভুবনে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। চিঠি পড়ে তাঁর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

মিনু খোঁজ নিয়ে জানলেন কিছুক্ষণ আগে মিলি ডাক্তারখানায় গেছে মাথা ব্যথার ওষুধ কিনতে। তিনি তৎক্ষণাৎ ডাক্তারখানায় ছুটে গেলেন। ফিরলেন ডাক্তারকে সঙ্গে করে। কাদেরকে পাঠিয়ে মগবাজারের কাজি সাহেবকে আনলেন। সোবাহান সাহেবকে জানানো হল সবার পরে কারণ তার ধারণা ছিল— সোবাহান সাহেব বেঁকে বসবেন।

কাজি সাহেব বললেন, দেন মোহরানা কত ধার্য হল?

মনসুর হড়বড় করে বলল, যা ইচ্ছা ধাৰ্য করেন। শুধু আমাকে একটা মিনিট সময় দিন। আমি যাব। আর আসব। আমার একটা নতুন পাঞ্জাবী আছে— রাজশাহী সিল্ক। ঐটা গায়ে দিয়ে আসি। আমি যাব। আর আসব।

কারোর অনুমতির অপেক্ষা না করেই মনসুর উল্কার বেগে বের হয়ে গেল। রাস্তা পার হবার সময় দুজন পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে নিজে চলন্ত রিকশার সামনে পড়ে গেল। তার জ্ঞান হল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। চোখ মেলে তাকানো মাত্র সে শুনল ফরিদের গলা— মিলি, গাধাটার জ্ঞান ফিরেছে মনে হয়, কষে একটা চড় দে তো!

মনসুর তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। অজ্ঞান হবার ভান করাই ভাল। মিলি পাশেই আছে। এই আনন্দই যথেষ্ট। শারীরিক কোন কষ্টকেই এখন আর কষ্ট মনে হচ্ছে না। তবে বা হাত ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে। কম্পাউন্ড ফেকচার কি-না কে জানে। হোক যা ইচ্ছা-মিলি পাশে। দুটা হাত ভেঙে গেলেও ক্ষতি নেই। এতে বরং মিলির সহানুভূতি বেশি পাওয়া যাবে।

রাত দুটার দিকে হাসপাতাল থেকে মনসুর ভাল আছে খবর পাবার পর সোবাহান সাহেব ঘুমুতে গেলেন। মিনু ঘুমুতে গেলেন না। তিনি জেগে রইলেন। এতবড় একটা সমস্যাতেও তাঁকে খুব একটা বিচলিত মনে হল না। সোবাহান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, মিনু তোমাকে একটা কথা বলি, রাগ করো না।

বল।

মিলি যেমন নিজের বর নিজে পছন্দ করেছে বিলু কি তাই করবে? তোমার কি মনে হয়?

মিনু জবাব দিলেন না। সোবাহান সাহেব বললেন, আমার মনে হয় না। বিলু সে রকম মেয়ে না। এই মেয়টাকে আমি আমার পছন্দের একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। আমার ধারণা আমি বললেই সে রাজি হবে।

ছেলেটা কে?

ছেলেটা হল আনিস। বুঝতে পারছি আমার কথা শুনেই তুমি চমকে উঠছ। চমকে উঠারই কথা। বিপত্নীক এটা ছেলে। বয়স বেশি– দুটা বাচ্চা আছে। তবু— মানে… অর্থাৎ ছেলেটাকে আমার খুবই পছন্দ।

মিনি চুপ করে রইলেন। তাঁকে খুব বিচলিত মনে হল না। সোবাহান সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে বিলুকে চিঠিতে আমার মতামতটা জানাই।

মিনি সহজ গলায় বললেন, তোমার মতামত জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিলু আনিসকে বিয়ে করে বসে আছে।

সে কি?

ভয়ে কাউকে জানায় নি। আমি আজই জানলাম।

আজই জানলে?

হ্যাঁ।

কার কাছ থেকে জানলে?

বিলুর কাছ থেকে।

বিলু এসেছে না-কি?

হুঁ! তোমরা সবাই যখন হাসপাতলে তখন এসেছে। ভয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করছে না।

যাও ডেকে নিয়ে আসে।

ও আনিসের ঘরে আছে। এখন ডাকা ঠিক হবে না।

হুঁ! সেটাও কথা।

বাতি কি নিভিয়ে দেব? ঘুমুবে?

বারান্দায় গিয়ে খানিকক্ষণ বসি। মিনু আজ কি পূর্ণিমা?

জানি না।

মনে হচ্ছে পূর্ণিমা।

সোবাহান সাহেব বারান্দায় এসে দেখলেন— সত্যি পূর্ণিমা। তিনি মনে মনে বললেন, এমন চাঁদের আলো। মারি যদি সেও ভাল। সে মরণও স্বৰ্গ সমান। অনেকদিন আগে পড়া এই লাইন দুটি কেন যে তার মনে এল কে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *