২৭. সম্রাট হুমায়ূন লাইব্রেরিতে

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। সম্রাট হুমায়ূন লাইব্রেরিতে। ছবির রঙ-বিষয়ক একটি পাণ্ডুলিপি তার হাতে এসেছে। তিনি মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে রঙ তৈরির কলাকৌশল শিখছেন। পানিতে অদ্রবণীয় রঙ কী করে দ্রবণীয় করা যায় সেই কৌশল পড়ে তিনি মুগ্ধ। তাঁর ইচ্ছা করছে এখনই পরীক্ষা করে দেখতে।

কে যেন সম্রাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করল। লাইব্রেরির চারদিকে বৈরাম খাঁ’র বিশেষ বাহিনী পাহারা দিচ্ছে। তাদের এড়িয়ে একটি মাছিরও হুমায়ূনের কাছে আসা সম্ভব না। হুমায়ূন চমকে তাকালেন। হামিদা বানু কুর্নিশ করছেন।

হুমায়ূন বললেন, এই মুহুর্তে আমি একটি রাজকীয় ফরমান জারি করছি—সম্রাটকে তার স্ত্রী হামিদা বানুর কুর্নিশ করার প্রয়োজন নেই।

হামিদা বানু হাসলেন। সম্রাট বললেন, এত রাতে এখানে কেন?

হামিদা বানু বললেন, সম্রাট গভীর মন দিয়ে বই পড়ছেন। এই দৃশ্য দেখতে আমার ভালো লাগে। আপনি জানেন না প্রায়ই আমি আড়াল থেকে পাঠরত অবস্থায় আপনাকে দেখি। আজ সামনে এসেছি।

আজ সামনে আসার পেছনে কি কোনো কারণ আছে?

একটা আর্জি নিয়ে এসেছি।

আর্জি মঞ্জুর।

না শুনেই আর্জি মঞ্জুর?

সম্রাট হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, এখন তোমার আর্জি বলো।

হামিদা বানু বললেন, আমরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন এক রাতে আমরা খোলা প্ৰান্তরে ছিলাম। অচেনা এক গাছের নিচে বসেছিলাম। আপনার কি মনে আছে?

আমার মনে আছে।

হামিদা বানু বললেন, আমার খুব শখ আপনাকে নিয়ে ওই জায়গায় আবার যাই।

সম্রাট বললেন, তোমাকে আগেই বলেছি আর্জি মঞ্জুর।

 

ফিনিক ফোটা জোছনাস্নাত রজনী। হুমায়ূন-পত্নী হামিদা বানু অচেনা এক বৃক্ষে হেলান দিয়ে বসে আছেন। হুমায়ূন কোনো কারণ ছাড়াই বৃক্ষের চারপাশে ঘুরছেন।

সম্রাট একা আসেন নি। তার নিরাপত্তার জন্যে বিশাল বাহিনী নিয়ে বৈরাম খাঁ এসেছেন। সেনাবাহিনী দৃষ্টির আড়ালে আছে।

হুমায়ূন বললেন, হামিদা আনন্দ পাচ্ছ?

হামিদা জবাব দিলেন না। ওই রাতে তিনি খিলখিল করে হাসছিলেন। আজ তার চোখভর্তি অশ্রু।

হুমায়ূন হঠাৎ লক্ষ করলেন, হামিদা বানু যেখানে বসে আছেন তার উল্টাদিকে দুটি কিশোরী মেয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। এদের তিনি চেনেন। একজন তার কন্যা আকিকা বেগম। অন্যজন তার বান্ধবী। যার নাম মনে পড়ছে না। সম্রাট নিশ্চিত আফিমের নেশার কারণে হয়তো এ ধরনের বিভ্রম তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে। এই মেয়ে এবং তার বান্ধবীকে তিনি রাজপ্রাসাদেও কয়েকবার দেখেছেন।

হুমায়ূন তাদের দিকে কয়েক পা এগুতেই মেয়ে দুটি খিলখিল করে হেসে দৌড়ে পালাল।

হামিদা বানু চমকে উঠে বললেন, কে হাসে? কে হাসে?

হুমায়ূন বললেন, কেউ হাসে না হামিদা। হিন্দুস্থানে এক বিচিত্র পাখি আছে, যখন সেই পাখি ডাকে মনে হয় কিশোরী মেয়ে হাসছে। হিন্দুস্থান অতি অদ্ভুত দেশ।

হামিদা বানু বললেন, আপনি কি আমার হাত ধরে একটু বসবেন? হঠাৎ পাখির ডাক শুনে ভয় পেয়েছি।

হুমায়ূন স্ত্রীর পাশে এসে বসেছেন। তাঁদের গায়ে অবাক জোছনা গলে গলে পড়ছে। দুজনই অপেক্ষা করছেন হিন্দুস্থানের অদ্ভুত পাখির ডাক আরেকবার শোনার জন্যে।

 

রাজা যায় রাজা আসে। প্ৰজাও যায়, নতুন প্ৰজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ক্ষুধার্ত সময় সবকিছু গিলে ফেলে, তবে গল্প গিলতে পারে না। গল্প থেকে যায়।

বাদশা নামদারের কিছু গল্প শোনানো শেষ হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *