1 of 2

২৭. শেষ পর্যন্ত অলিকে

শেষ পর্যন্ত অলিকে একলা যেতে দিতে রাজি হয়নি পমপম। তার শরীর যতই দুর্বল হোক, তার মন এখনও সুদৃঢ় ধনুকের ছিলার মতন টানটান। চোখদুটো অনেকখানি কোটরগত, তাতে তার দৃষ্টি যেন আরও বেশী তীক্ষ্ণ। তাকে যে নার্ভের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, তার একটার বদলে তিনটে ট্যাবলেট সে খেয়ে ফেললো অলিকে লুকিয়ে। অন্য ওষুধও প্রত্যেকটাই দ্বিগুণ করে খেল। তার ঘণ্টাখানেক পরে, উঠোনের তারে যে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়েছিল তা সে পাড়লো লাফিয়ে লাফিয়ে, ঠাকুর্দার ঘর থেকে সুপুরির পুঁটুলি চুরি হয়ে গেছে বলে সে নিপুণ অভিনয়ে ধমকালো বাড়ির প্রত্যেকটি লোককে। তার শোয়ার ঘরের বারান্দার এক প্রান্তে। দাঁড়িয়ে সে বললো, দ্যাখ অলি, আমি একদম ভালো হয়ে গেছি। দেখবি, এখান থেকে নীচে ঝাঁপাবো, ছেলেবেলার মতন।

অলি তার হাত চেপে ধরে বললো, থাক, অত আর বাড়াবাড়ি করতে হবে না। তবে তোর চোখ-মুখ আজ অনেকটাই ভালো দেখাচ্ছে। আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যেতে পারবো। যদিও কলকাতায় ফিরতে আমার একটুও ভালো লাগছে না!

পমপম বললো, তোর বাবা খবর পাঠিয়েছেন, তোক তো ফিরতেই হবে রে! বাইরে যাওয়ার কত রকম ফর্মালিটি আছে। আমি তোকে স্টেশানে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

অলির তাতে ঘোর আপত্তি। পমপমের স্টেশানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। এ বাড়ির একজন মুনিষ তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। কিংবা একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে সে একাও চলে যেতে পারে। পমপমের যাবার কোনো দরকার নেই।

কিন্তু অলি একা আর পমপমকে কতখানি বাধা দেবে। এ বাড়িতে সব কিছুই কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। ঠাকুর্দা চোখে দেখতে পান না, পমপমের এক বিধবা পিসি ও কাকা কাকীমা রয়েছেন, তাঁরা পমপমের কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামান না। কথাই বলতে চান না ভালো করে। পমপম এখানে থাকবে না চলে যাবে, তাতে যেন তাঁদের কিছু যায় আসে না। পমপম যেন অনেকটা অচ্ছুৎ! অলি ঠিক বুঝতে পারে না, কেন তাঁদের এরকম মনোভাব। পমপম তার বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্যরকম রাজনীতি করেছে বলে? কিংবা, লালবাজার লকআপে পমপমের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছিল, তারই কোনো অতিরঞ্জিত কাহিনীতে তারা পমপমকে ধর্ষিতা মনে করে?

এরকম উদাসীন বা বিরূপ আত্মীয়দের মধ্যে পমপমকে একা রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না অলির, অথচ এখন তার আর থাকার উপায় নেই। কলকাতার বাড়িতেও পমপম যেতে চায় না, তা হলে সে থাকবে কোথায়?

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে হতেই অলি চঞ্চল হয়ে উঠলো। তাকে পাঁচটা কুড়ির ট্রেন ধরতেই হবে। সে অনুনয় করে বললো, পমপম, লক্ষ্মীটি, তুই স্টেশনে আসিস না, ফিরতে ফিরতে তোর রাত হয়ে যাবে। আমি যদি বিদেশে যাই, তার আগে আর একবার এসে দেখা করে যাবো তোর সঙ্গে।

পমপম একটা ছোট্ট ব্যাগ তুলে নিয়ে বললো, আমি মত পাল্টে ফেলেছি, আমি তোকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি না, আমিও তোর সঙ্গে ফিরবো। এখানে আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে না।

অলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বললো, তুই আজই ফিরবি? আর দুদিন অন্তত থাক, তোর বাবা আবার এখানে আসবেন বলে গেলেন, তার সঙ্গে তুই গাড়িতে চলে যেতে পারিস কলকাতায়।

অলির চোখের দিকে গাঢ় ভাবে কয়েকপলক তাকিয়ে থেকে পমপম বললো, জিপে এতখানি রাস্তা যাওয়ার চেয়ে ট্রেনে যাওয়া অনেক বেশী আরামের। তোর সঙ্গে এসেছি, তোর সঙ্গেই ফিরবো।

অলি তবু আমতা আমতা করে বললো, আমি ভাবছিলুম, সোজা কলকাতায় না গিয়ে কৃষ্ণনগর হয়ে ফিরবো। ট্রেন থেকে নেমে বাস বদল করতে হবে, নদী পার হতে হবে, তোর খুব কষ্ট হবে পমপম, তুই পারবি না!

পমপম অলির বাহুতে হাত রেখে বললো, তোর তো মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস নেই। তুই আমাকে ভোলাতে পারবি না। আমরা প্রায় স্কুল থেকেই রাজনীতি করছি, আমরা যখন তখন মিথ্যে কথা বলতে পারি। একটাও চোখের পাতা কাঁপে না। আমি জানতুম, তুই সোজা কলকাতায় ফিরবি না।

–পমপম, এই শরীর নিয়ে তোর যাওয়াটা কিছুতেই ঠিক হবে না।

–আমি যদি না যাই, তা হলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোর জন্য দুশ্চিন্তায় এতখানি দগ্ধাবো যে তাতে আমার শরীরের আরও বেশী ক্ষতি হবে! চল, আর দেরি করে লাভ নেই।

সারাদিনই ঝেকে ঝেকে বৃষ্টি আসছে। এখন বৃষ্টি ইলশেগুড়ি। রিকশার সামনের পর্দাটাও ফেলে দিতে হলো। রাস্তায় বেশ কাদা। একটু আগেই একটা ট্রেন এসে পৌঁছেছে, তাই এ পথ দিয়ে অনেক রিকশা আর সাইকেল ফিরছে।

রিকশার ঝাঁকুনিতে কষ্ট হচ্ছে পমপমের, তার শরীরের সমস্ত হাড় পাঁজরা যেন আলগা হয়ে গেছে। বেশী নড়াচড়া করলেই তার নিম্ন উদরে একটা ব্যথা শুরু হয়, বারবার হিসি পায়। অনর্গল কথা বলে গেলে ব্যথার উপলব্ধিটা অনেক কম হয়।

পমপম বললো, তুই কৌশিককে কতদিন চিনিস, অলি? নিশ্চয়ই অতীনের বন্ধু হিসেবে

অলি বললো, হ্যাঁ, বাবলুদার বি এসসি পরীক্ষার পর কৌশিক প্রথম একদিন বাবলুদার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। খুব লাজুক মনে হয়েছিল প্রথম দিনটায়।

পমপম বললো, আমি ওকে চিনি প্রায় বাচ্চা বয়েস থেকে। এক সময় ওরা আমাদের পাড়ায় থাকতো। মানিকতলায় আমাদের বাড়ির ঠিক দুখানা বাড়ি পরে। ঐ পাড়াতেই অতুল্য। ঘোষের বাড়ি জানিস তো? অতুল্য ঘোষের ভাইপো ভাইঝিদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল, ওদের বাড়িতে খেলতে যেতুম, তাদের সঙ্গে আমার এখনও বন্ধুত্ব আছে। সেই বাড়িতে কৌশিক ও যেত। ঐ বাড়ির দিলীপদার সঙ্গে তো কিছুদিন আগেও দেখা হয়েছে, দিলীপদা রাজনীতিতে যান নি।

–তুই কংগ্রেসীদের বাড়িতে যেতিস?

–হ্যাঁ। ছেলেবেলায় অত শত তো বুঝতুম না। তবে ওদের বাড়ির পরিবেশটা খুব ভালো লাগতো আমার। অতুল্যবাবুকেও জ্যেঠু জ্যেঠু বলতুম, তিনি বেশ হেসে হেসে,গল্প করতেন, কয়েকবার প্রফুল্ল সেনকেও দেখেছি ঐ বাড়িতে। ওঁরা দু’জনেই খুব পাওয়ারফুল নেতা, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে খুব অমায়িক, সেটা স্বীকার করতেই হবে। আমার বাবা সি পি আই-এর নেতা, ছেলেবেলায় আমি কমুনিস্ট আর কংগ্রেসী অনেক নেতাকেই দেখেছি খুব কাছ থেকে, সি পি আই-এর বয়স্ক নেতারাও অনেকে একসময় কংগ্রেসী ছিল, আমার বাবাও স্বাধীনতার আগে ছিলেন কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে, অতুল্যবাবু তো আমাকে দেখলেই বলতেন, হ্যাঁরে খুকী, তোর মা কেমন আছেন? তোর মা যা চমৎকার ধোকার ডালনা রাঁধে…অতুল্যবাবু একবার আমাদের এই মেমারির বাড়িতেও এসেছিলেন, আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছেন, আমার মা তখন হাঁপানিতে শয্যাশায়ী, হ্যাঁ, যা বলছিলুম, ঐ বাড়িতেই কৌশিকের সঙ্গে পরিচয়, তখন আমাদের প্রায় পুতুলখেলার বয়েস। তারপর কৌশিকরা একসময় নিউ আলিপুরে বাড়ি করে উঠে গেল, তারপরেও যোগাযোগ নষ্ট হয় নি, কৌশিকের মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আমার মা মারা যাবার পর তিনি আমাকে নিউ আলিপুরের বাড়িতে মাঝে মাঝে নিয়ে গিয়ে সারাদিন রেখে দিতেন।

হঠাৎ কথা থামিয়ে পমপম রিকশাটাকে থামাতে বললো। সে আর অবদমন করতে পারছে না। অন্ধকার রাস্তা। এরমধ্যে যানবাহন কিছুটা কমে এসেছে। পমপম রিকশা থেকে নেমে চলে গেল একটা ঝোঁপের আড়ালে। লজ্জা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ছোট বাথরুম করতে গেলেই তার মাথা ঝিমঝিম করে, এ কথা সে এ পর্যন্ত কারুকে বলেনি, ডাক্তারকেও না।

আস্তে আস্তে পা ফেলে সে ফিরে এসে রিকশায় উঠে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, অলি, একটা লবঙ্গ দে তো! আর মিনিট দশেকের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে যাবো।

অলি আড়ষ্ট গলায় বললো, লালবাজারে তোকে খুব কষ্ট দিয়েছে, নারে?

পমপম বললো, ওসব কথা এখন থাক। কৌশিকের কথা শোন। কৌশিক ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট ছিল, অতীনের চেয়ে অনেক ভালো, অতীন তো স্কুল ফাইনালেও ভাল রেজাল্ট করেনি, ফাঁকিবাজ টাইপের ছিল।

অলি বললো, বাবলুদার কাছে শুনেছি, ওর পড়াশুনোয় তেমন মন ছিল না, খেলাধুলোর দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। কিন্তু ওর দাদা, সে ছিল সত্যিকারের ব্রিলিয়ান্ট, সে হঠাৎ জলে ডুবে মারা যায়, তখন বাবলুদা ওর বাবা-মায়ের দুঃখ কিছুটা ঘোচাবার জন্যই পড়াশুনোয় মন দেয়।

–ওর দাদা ওর জীবনে একটা ছায়া ফেলে আছে। তুই জানিস না, অলি, অতীন মাঝে মধ্যেই আফসোস করে বলতো, দাদাটা মরে গিয়ে আসলে আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। আমার সব সময় একটা পিছুটান। দাদা বেঁচে থাকলে বাবা-মাকে খুশী রাখতে পারতো, আমি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে যা খুশী করতে পারতুম! একসময় অতীনকে নেপাল ঘুরে চীনে পাঠাবার প্রস্তাব হয়েছিল আর একজনের সঙ্গে, খুবই রিস্কি জানি, শেষ পর্যন্ত অতীন যেতে পারেনি তার বাবা-মায়ের কথা কনসিডার করে! কিন্তু আলটিমেটলি তো ছাড়তেই হলো, এখন ইংল্যান্ড না আমেরিকা কোথায় গিয়ে যেন বসে আছে!

–তুই কৌশিকের কথা বলছিলি!

–কৌশিক ছিল সত্যিকারের পড়ুয়া। ইনট্রোভার্ট। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতো। সেই কৌশিক সেকেন্ড ইয়ারে উঠে প্রেম নিবেদন করে ফেললো আমাকে।

–তাকে?

–কেন, আমায় বুঝি কেউ প্রেম নিবেদন করতে পারে না। আমাকে এতই নীরস আর কাঠখোট্টা মনে করিস?

–না, না, সেজন্য নয়। কৌশিকের সঙ্গে তার অন্যরকম সম্পর্ক দেখেছি।

–আমি কৌশিককে শুনিয়েছিলুম সুভাষবাবুর একটা কবিতার লাইন, ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা… তখন আমি ছাত্র রাজনীতিতে দরুণভাবে জড়িয়ে পড়েছি। আমি বুঝতে পেরেছিলুম, আমার বাবাদের জেনারেশান আমাদের দারুণভাবে বিট্রে করেছে। আমাদের বাড়িতে বাবার বন্ধু আর পাটি ওয়ার্কারদের মুখে আমি কতবার বিপ্লবের কথা শুনেছি। একটা টোটাল রেভলিউশান ছাড়া এদেশের সমাজ ব্যবস্থার কোনো বদল হতে পারে না। বিপ্লব শব্দটা শুনলেই আমার রোমাঞ্চ হতো। আমি স্বপ্ন দেখতুম, সারা দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেছে লড়াই, আমিও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, আমার হাতে লাল পতাকা… কিন্তু কোথায় সেই বিপ্লবের প্রস্তুতি? আমাদের বাবা-কাকারা মুখেই বিপ্লবের কথা বলেন, কিন্তু আসলে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির নিশ্চিন্ত পথের দিকেই তাঁদের ঝোঁক। এই সব ব্যাপার। নিয়ে আমি খুব রেগে আছি। তার মধ্যে হঠাৎ কারুর মুখে প্রেমের প্যানপ্যানানির কথা কি সহ্য করা যায়? তবে ন্যাকা মেয়েদের মতন আমি কৌশিকের কথা শুনে বিগলিতও হইনি, আবার ফোঁস করে উঠে তাকে কামড়ে দিতেও যাইনি। আমি ঠিক করেছিলুম, কৌশিককে আমি নিজের হাতে তৈরি করবো। কৌশিককে আমি প্রায় জোর করে নিয়ে এলুম আমাদের পার্টিতে।

–তার আগে কৌশিক রাজনীতি করতো না?

-–একদম মাথাই ঘামাতো না। ওদের বাড়িতেও কোনো পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। বুর্জোয়া মিডল ক্লাশ বাড়ির টিপিক্যাল ভালো ছেলেদের মতন কৌশিকের বিলেত আমেরিকায় গিয়ে সো কলড উচ্চশিক্ষা নেবার কথা ছিল। কিন্তু কৌশিক কতখানি বদলেছে। তুই ভেবে দ্যাখ। তার মতন লাজুক ছেলের মধ্যেও যে এতখানি সংগঠন শক্তি থাকতে পারে তা কজন কল্পনা করতে পারে? আমাদের স্টাডি সার্কেলটা তো কৌশিকই মেইনলি অর্গানাইজ করেছে। কৌশিকই তো ডেকে এনেছে অতীনকে। অনুনয়, তপেশ্বর, বারীন, জয়শ্রী এদের মতন আরও অনেকে কৌশিকের রিক্রুট। চারু মজুমদারের সঙ্গে কলকাতার বিপ্লবী ছাত্রদের প্রথম দিকের লিংকও কৌশিক। বুঝলি অলি, আমি যদি কৌশিককে দলে না টানতুম, তা হলে তোর বাবলুদাও এসবের মধ্যে আসতো না, তাকে এরকম ফেরার হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো না। তোকেও এরকম জলকাদার মধ্যে গ্রামে আসতে হতো না, একটা অসুস্থ মেয়ের নার্সগিরি করতে হতো না। তা হলে বুঝে দ্যাখ, তোর সব বিপদের মূলে আমিই।

–আরও বেশী মূলে যেতে গেলে তোর বাবাকেই কৃতিত্ব দিতে হয়। কারণ তিনি তোর মতন একটি বিপদের আগুনের জন্ম দিয়েছেন, তাই না?

–জন্ম দেবার কোনো কৃতিত্ব নেই। ওটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। রোজই তো লাখ লাখ জন্মাচ্ছে। আমি নিজেকে নিজে তৈরি করেছি। কৌশিকও কতটা নিজেকে তৈরি করেছে ভাব। যে একদিন আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল, সে এরপর কত জায়গায়, কত রকম পরিবেশে আমার পাশে শুয়ে থেকেছে, কিন্তু কোনোদিন আমার শরীরে একবারও হাত ছোঁয়ায়নি। এই না হলে পুরুষ? সেই কৌশিক পায়ে গুলি খেয়ে এক জায়গায় মরো মরো অবস্থায় পড়ে আছে, সে খবর জেনেও আমি তাকে দেখতে যাবো না? নিজে বাঁচবার চেষ্টা করবো? সবাই তোর অতীনদার মতন স্বার্থপর হয় না।

–বাবলুদা বিদেশে চলে গিয়ে জেল খাটলেই বুঝি ভালো ছিল? মার্ডার চার্জে তার। ফাঁসীও হতে পারতো।

–কেন, সেও কৌশিকের মতন জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করতে পারতো না? কৌশিক পারে, সে পারবে না কেন?

–তুই বুঝি বাবলুদাকে ঘেন্না করিস, পমপম। একথা আগে কোনোদিন বলিস নি তো! মানিকদাকে বাঁচাবার জন্য বাবলুদা একজন মানুষকে মারতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর সেই মাড়ার চার্জে সে যখন ধরা পড়ে, তখন কেউ তাকে সাহায্য করতে আসেনি। আমি নিজে জানি, মানিকদাই খবর পাঠিয়েছিলেন তাকে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে।

অলিকে জড়িয়ে ধরে পমপম বললো, না রে, না রে, আমি অতীনকে মোটেই ঘেন্না করি না। এটা আমার রাগের কথা। অভিমানের কথা। কৌশিকের এই রকম অবস্থার কথা শুনে আমার যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কৌশিক যদি মরতে বসে থাকে, তা হলে এই সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অতীন তার পাশে নেই, এই কথাটাই মনে হচ্ছে বারবার। অতীন যখন খুনটা করে, সেই সময় আমাদের অ্যানিহিলেশনের প্রোগ্রাম শুরুই হয়নি, সেইজন্য ও একা পড়ে গিয়েছিল। জেলেও ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল না। ও দেশের বাইরে চলে গিয়ে ঠিকই করেছে।

অলি তার ক্ষোভের সঙ্গে বললো, বাবলুদাকে তোরা আর যা কিছু মনে করতে পারিস, সে স্বার্থপর নয়। আমি ঠিকই বুঝতে পারি, বিদেশে বসে থেকে সে খুবই কষ্ট পাচ্ছে, সেইজন্য চিঠিপত্র পর্যন্ত লেখে না।

পমপম নরম গলায় বললো, এইবার তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, অলি, তুই আমাদের পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে দিয়েছিলি। অতীনও তোকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দলে রাখতে পারেনি। তোর প্রসঙ্গ উঠলে অতীন এক এক সময় বলতো, ও বড়লোকের আদুরী মেয়ে, ওর দ্বারা কিছু হবে না! তবু তুই আমাদের মধ্যে ফিরে এলি কেন? বিশেষ করে এখন চতুর্দিকে বিপদ।

–আমি তো ফিরে আসি নি। তোদের পার্টির কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই। মারামারি, খুনোখুনি, ওরে বাবা, আমি রক্ত সহ্যই করতে পারি না।

–তুই যে আমার জন্য এতটা করলি–

–তোমার জন্য কিছুই করা হয় নি। পার্টির মেম্বার ছাড়া বুঝি বন্ধু থাকে না? বন্ধুর অসুখ হলে বুঝি বন্ধু দেখতে আসে না?

–আমাকে তুই দেখতে এসেছিস, সেটাও না হয় বুঝলুম। আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি, আমার বাবা ইলেকশানে জিতেছেন, পুলিশ এখন আর চট করে আমাদের বিশেষ ঘাঁটাবে না। কিন্তু কৌশিক জেল ভেঙে পালিয়েছে পুলিস তাকে খুঁজছে, দেখলেই পাগলা কুকুরের মতন গুলি করে মারবে। তবু তুই কৌশিকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস কোন সাহসে?

অলি সরলভাবে বললো, কেন, পুলিশ কি আমাকেও গুলি করে মারবে নাকি?

দাঁতে দাঁত চেপে পমপম বললো, এ দেশের পুলিশই হলো সবচেয়ে বড় অর্গানাইজড গুণ্ডা বাহিনী। মেয়েদের দিকে গুলি ছুঁড়তেও তাদের হাত একটুও কাঁপে না। পুলিশ যে কতখানি হিংস্র, অমানুষ হতে পারে, তা তো আমি জানি

পমপমের পিঠে হাত দিয়ে অলি ব্যাকুল ভাবে বললো, পমপম, তোর সারা শরীরটা কাঁপছে। কেন রে? তোর খুব কষ্ট হচ্ছে?

–না, আমি ঠিক আছি। অলি, পুলিসের গুলি যদি তোর গায়ে নাও লাগে, ঐ জায়গায় ধরা পড়লেও পুলিস তোকে সহজে ছাড়বে না। তা হলে ইউ এস গভর্নমেন্ট তোর ভিসা আটকে দেবে, ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টও তার পাসপোর্ট ইমপাউন্ড করবে। আর এক সপ্তাহের মধ্যে তার বাইরে যাওয়ার কথা।

–তাতে আর কী হবে, আমার বাইরে যাওয়া হবে না! যাবো না!

–প্লীজ পাগলামি করিসনি, অলি, এবার তোকে আমার কথা শুনতেই হবে। তুই সোজা কলকাতায় ফিরে যা। আমি তো যাচ্ছিই কৌশিকের কাছে। দু’জনে মিলে যাবার দরকার নেই। প্লীজ, অলি, আমার এই কথাটা শোন!

–কী অদ্ভুত কথা বলছিস, পমপম। তোর শরীরের এই অবস্থা, আমি তোকে একলা ছেড়ে দেবো? আমার বিদেশ যাওয়ার অত গরজ নেই।

–অলি, তুই বুঝতে পারছিস না। আমি কমিটেড। আমার যাই হোক না কেন, আমি শেষ দেখে ছাড়বো না। কৌশিকের কাছে আমাকে যেতেই হবে। সে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি। কৌশিকের জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেলে আমার বেঁচে থাকার কোনো মানেই থাকবে না। কিন্তু কৌশিকের সঙ্গে তো তোর এতখানি ঘনিষ্ঠতা হয় নি কখনো! কৌশিক তোক দেখলে খুশীও হবে না। তুই মাঝপথে পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলি বলে তোর ওপর কৌশিকের রাগ আছে।

–তা রাগ করুক না। তবু আমি যাবোই।

–তুই অতীনের কথা ভাবছিস?

–অনেকটা তাই। ওরা দু’জনে প্রাণের বন্ধু, বাবলুদা যদি জেল থেকে পালাতে গিয়ে এরকম ভাবে ইনজিওরড হতো, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যেতুম না? বহরমপুর জেলে। আমি কৌশিকের সঙ্গে দেখা করে তোর খবর বাবলুদার খবর ওকে পৌঁছে দিয়েছি। তা ছাড়া ধর, সত্যি যদি আমার বিদেশে যাওয়া হয়, বাবলুদার সঙ্গে দেখা হলে সে প্রথমেই কৌশিকের খবর জিজ্ঞেস করবে। আমি কী বলবো, জানি না? কিংবা বলবো, জেল থেকে পালাতে গিয়ে। তার গায়ে দু তিনটে বুলেট লেগেছে, সেই অবস্থায় সে কোনো জঙ্গলের মধ্যে পালিয়েছে। সেই খবর জেনেও আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি? তুই বাবলুদার মেজাজ জানিস না? একথা শুনলে সে হয়তো আমাকে চড় মেরেই বসবে, জীবনে আর আমার মুখ দেখতে চাইবে না!

–আমি তবু বলছি, অলি, রিসক বড় বেশি। তুই কলকাতায় ফিরে যা, আমি তোকে কৌশিকের সব খবর জানাবো।

স্টেশান এসে গেছে। রিক্সা থেকে নেমে অলি পয়সা মেটাতে লাগলো, আর পমপম প্রায় ছুটে চলে গেল প্ল্যাটফর্মের বাথরুমে। তার মাথাটা ঘুরছে, নিম্নাঙ্গে অসহ্য ব্যথা। হঠাৎ যেন সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। দেয়াল ধরে সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তাদের দলে আরও তো কয়েকটি মেয়ে ছিল, তাদের কেউ এলো না, অলিকেই আসতে হলো? পমপম একলা বোধহয় সত্যিই পৌঁছোতে পারবে না। কৌশিকের কাছ থেকে যে ছেলেদুটি এসেছিল, তারা অলির সঙ্গেই যোগাযোগের ব্যবস্থাটা ঠিক করে গেছে।

এই সময় বর্ধমানের দিকের ট্রেনে বেশ ভিড়। কলকাতার নিত্যযাত্রীরা ফিরছে। বসবার জায়গা পেল না ওরা, দাঁড়িয়ে যেতে হলো, অলি ধরে থাকলো পমপমের কাঁধ।

বর্ধমান স্টেশানে নেমে ওরা দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো, কেউ তাদের অনুসরণ করছে কিনা। অনুসরণকারীদের চোখ মুখ সে দেখতে লাগলো, সে তাদের অনেকটা চিনতে শিখেছে। নিজেদের ব্যাগ দুটো নামিয়ে রাখলো পায়ের কাছে।

ভিড় পাতলা হয়ে যাবার পর একজন কুলি এসে ওদের ব্যাগদুটো তুলে নিয়ে বললো, আসুন, রিক্সায় যাবেন তো?

অলি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অনুসরণ করলো কুলিটিকে। বাইরে এসে একটি রিক্সায় বসে সে কুলিটিকে দুটি টাকা দিল। কুলিটি নমস্কার জানিয়ে চলে যাবার পর সে তাকালো পমপমের দিকে। তারা দু’জনেই তপনকে চিনতে পেরেছে।

সাইকেল রিক্সার চালকটিকে অবশ্য চিনতে পারলো না। অলি অন্যদের শুনিয়ে তাকে বললো, সুধা হোটেলে যাবো।

সুধা হোটেলটি শহরের মধ্যেই, কিন্তু সাইকেল রিক্সাটি শহর ছাড়িয়ে চললো জঙ্গল মহলের দিকে। পমপম অলির কাঁধে মাথা দিয়ে আছে। ওষুধ খাওয়ার কৃত্রিম তেজ ফুরিয়ে আসছে, সে এখন খুবই অবসন্ন বোধ করছে। রিক্সার ঝাঁকুনিতেই তার বেশী কষ্ট হয়, হাঁটলে এতটা হয় না। তবু কৌশিকের সামনে তাকে স্বাভাবিক ব্যবহার করতেই হবে।

প্রায় এক ঘণ্টা রিক্সাটা চলার পর রাস্তার পাশে একটা হোটেলের সামনে থামলো। এটা সুধা হোটেল নয়, পাঞ্জাবীদের ধাবা। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে অলিরা তার ভেতরে ঢুকে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিল। এক গেলাস চা খাবার পর পমপম বললো, আমার আরও একটু চা চাই। গরম চায়ে তার উপকার হচ্ছে। আরও দু গেলাস চা খেল ওরা।

তারপর অলি বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের এখানে বাথরুম আছে!

বেয়ারাটি বললো, হ্যাঁ, আছে, আসুন।

দোকানের পেছন দিকে বাইরে মাঠের মধ্যে চট দিয়ে ঘেরা বাথরুম। পমপম ঢুকে পড়লো সেখানেই। পাশেই জঙ্গল, একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অলি তাকিয়ে রইলো সেই অন্ধকারের দিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তা হলে কি তারা তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে?

একটু পরে সেই জঙ্গলের মধ্যে খুব মৃদু ক্রিং ক্রিং সাইকেলের বেলের শব্দ হলো দুবার। পমপম বাথরুম থেকে বেরোবার পর অলি তার হাত ধরে সেই বেলের আওয়াজের দিকে এগিয়ে গেল।

দুখানা সাইকেল নিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তাদের মধ্যে একজন তপন, সে পৌঁছে গেছে এরই মধ্যে।

তপন পমপমকে মৃদু ধমক দিয়ে বললো, তুমি এলে কেন? তোমার তো আসার দরকার ছিল না?

দলের কর্মীদের মধ্যে তপনের স্থান পমপমের অনেক নীচে, তার ধমক দেবার অধিকার নেই। পমপমই রাগের সঙ্গে হিসহিস করে বললো, অ্যামেচারিস প্ল্যান। যেকোনো মোমেন্টে পুলিস ধরে ফেলতে পারতো। এবার কী করে যেতে হবে, বল।

তপন বললো, দুটো সাইকেল আছে, তোমাদের দু’জনকে ক্যারি করবো।

পমপম শিউরে উঠলো। আবার সাইকেল? তাকে পা ঝুলিয়ে বসে যেতে হবে। কিন্তু অন্য কোনো ব্যবস্থা এখন নিশ্চয়ই আর করা যাবে না। সে তপনের সাইকেলের মাঝখানের রডে উঠে বসলো।

আলো নেই, ঠিক মতন রাস্তা নেই, সাইকেলটা অনবরত লাফাচ্ছে। যাতে যন্ত্রণার শব্দ না বেরিয়ে যায়, সেইজন্য নিজের ঠোঁট কামড়ে আছে পমপম! কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ পারবে না। কথা বলতে হবে, কথা বলে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে হবে।

সে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁরে তপন, ও কি মানিকদার খবর জানে?

তপন বললো, চুপ।

পমপম তবু বললো, এই, তোকে যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দে!

–এখন কথা বলা চলবে না।

–হ্যাঁ, চলবে। না হলে আমাকে নামিয়ে দে। আমি হেঁটে যাবো।

–সাত-আট মাইল রাস্তা, তুমি কতক্ষণ ধরে হাঁটবে, না, কৌশিক মানিকদার কথা এখনো কিছু জানে না।

–কৌশিকের কোন পায়ে গুলি লেগেছে?

–এসব কথা এখন বলা চলবে না।

–ইডিয়েট, একটু বাদে গিয়েই তো আমি কৌশিককে দেখতে পাবো। যা বলছি, সত্যি করে উত্তর দে। কৌশিক বেঁচে আছে?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেঁচে আছে।

–শুধু পায়ে গুলি লেগেছে, না আরও কোথাও?

–পায়ে আসলে গুলি লাগেই নি। ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় পা ভেঙেছে। গুলি লেগেছে একটা পেটে আর একটা বাঁ কাঁধে। এর মধ্যে পেটের গুলিটা এখনও বার করা যায়নি।

–জেলের মধ্যে কজন মারা গেছে? কাগজে বেরিয়েছে ষোলোজন।

–মিথ্যে কথা লিখেছে। অন্তত পয়তিরিশজনকে ওরা গুলি করে মেরেছে। সবাইকে মেরে ফেলতো। আমাদের সেদিন জেল ভাঙার কোনো প্ল্যান ছিল না। ওরা দুএকটা গেট খুলে দিলে, ফলস অ্যালার্ম বাজিয়ে গুলি করতে শুরু করলো, জেলের গার্ড সেন্ট্রি ছাড়াও বাইরে থেকে সি আর পি এনেছিল। শুয়ারের বাচ্চা গভর্নমেন্ট সব নকশালদের শেষ করতে চেয়েছিল একদিনে। কিন্তু আমরা কিছু আর্মস জোগাড় করে রেখেছিলাম। তাই দিয়ে রেজিস্ট করেছি বলেই এই কজন পালাতে পেরেছি।

–আমাদের চেনার মধ্যে কে কে গেছে?

–মুর্শিদাবাদ আর নদীয়া গ্রুপের ছেলেরাই মরেছে বেশী। আর কথা নয়, পমপম, সামনে একটা গ্রাম আছে।

দেড়ঘণ্টা সাইকেল চালাবার পর তপন আর তার সঙ্গী থামলো একটা ঝুপড়ির সামনে। বাইরে পাহারা দিচ্ছে সাত আটজন। ঝুপড়ির ভেতরে শুধু একটা মোমের আলো।

সাইকেল থেকে নেমেই হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল পমপম। সঙ্গে সঙ্গেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি ঠিক আছি।

পমপমের শাড়ী ভেজা, তার গা দিয়ে হিসির গন্ধ বেরুচ্ছে, এতটা পথ সে সামলাতে পারেনি। তবু এখানে সে নেত্রীর ভূমিকা নিয়ে আদেশের সুরে বললো, কৌশিকের সঙ্গে প্রথম শুধু আমি আর অলি কথা বলবো। তখন আর কেউ সেখানে থাকবে না।

ভেতরে একটা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে বসে আছে কৌশিক। একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা পা সামনে ছড়ানো। তার পেটে ব্যান্ডেজ, বুক জুড়ে ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ মানে কী, ধুতি শার্ট ছিডে বাঁধা। খালি গা। মাথায় বড় বড় চুল, গালে সাত আট দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মোমের আলোয় তার মুখোনি দেখেই চমকে উঠলো দুই তরুণী। সেই মুখে পরিষ্কার মৃত্যুর ছায়া। যে কখনো মৃত্যু দেখেনি, সেও এই ছায়া চিনতে পারে।

সেই ঝুপড়ির মধ্যে শুয়ে আছে আরও চার পাঁচজন, সম্ভবত তারাও আহত কিংবা ঘুমন্ত। একমাত্র জেগে আছে কৌশিক। সে মুখ তুলে প্রথমে চমকে উঠলো, তারপর বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল।

সে কর্কশ ভাবে বললো, আরে এখানে মেয়েদের কে আসতে বললো? এই তপন, এই বিদ্যুৎ, কে তোদের অর্ডার দিয়েছে?

দরজার কাছে তপন দাঁড়িয়ে, সে কোনো সাড়া দিল না।

পমপম হাঁটু গেড়ে বসলো কৌশিকের পাশে। তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বললো, আমি যখন এসে পড়েছি, এবার থেকে আমিই অর্ডার দেবো।–পমপম কৌশিকের মাথায় হাত রাখতে যেতেই কৌশিক ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো, এসব কী ন্যাকামি হচ্ছে, পমপম? যে কোনো সময় এনকাউন্টার হতে পারে। এখানে তোরা এসে আরও বিপদ বাড়িয়ে দিলি? জানিস, সুবীরকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখেছি। সুবীর আমার পাশে পাশে দৌড়োচ্ছিল।

দরজার আড়াল থেকে তপন বললো, না, না, সুবীর বেঁচে আছে। সুবীর এখানেই আছে। কৌশিক পাগলাটে গলায় বললো, আর ইউ সিয়োর? কোথায় সুবীর, তাকে আমি দেখতে চাই। আমার দু পাশ থেকে আমার নিজের হাত-পা খসে যাবার মতন কে কে চলে গেল, আমার জানা দরকার।

পমপম জিজ্ঞেস করলো। তোকে কোনো ডাক্তার দেখেছে, কৌশিক?

কৌশিক বললো, বিদ্যুৎ দেখেছে, বিদ্যুৎ ডাক্তারির থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছে। আই অ্যাম ফাইন।

তারপরই হঠাৎ সে গলা চড়িয়ে বললো, কে এই মেয়েদুটোকে এখানে এনেছে। এক্ষুনি

এদের ডাবল মার্চ করিয়ে জঙ্গলের বাইরে দিয়ে আয়।

পমপম ধমক দিয়ে বললো, আস্তে আস্তে। কমরেড কৌশিক রায়, আমি মানিকদার কাছ থেকে একটা জরুরি অর্ডার নিয়ে এসেছি।

কৌশিক দারুণ অবাক হয়ে বললো, মানিকদা? কোথায় আছেন মানিকদা? এরা কেউ মানিকদার সঙ্গে কনটাক্ট করতে পারছে না। আমি সবাইকে বলছি।

–মানিকদা যেখানেই থাকুন, তিনি আমার থু দিয়ে অর্ডার পাঠিয়েছেন।

–মানিকদার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে? কবে?

–অফ কোর্স দেখা হয়েছে। মানিকদা বলে পাঠিয়েছেন, তোদের এই জঙ্গল মহল থেকে ডিসপার্স করতে হবে। এখানে বসে থেকে পুলিশ আর্মির সঙ্গে কনফ্রনটেশানে যাওয়াটা মুখামি হবে।

–এখানকার ট্রাইবালরা আমাদের সাপোর্ট করছে। পুলিস সহজে ঢুকতে পারবে না। আমি এখানকার কমান্ডার, শুধু উঠে দাঁড়াতে পারছি না।

–কমরেড কৌশিক রায়, তোমার সম্পর্কে স্পেশাল ইনস্ট্রাকশান আছে। আজ রাত্তিরেই তোমাকে এখান থেকে রিমুভ করতে হবে। প্রথমে যাবে ঘাটশিলায়। সেখানে আমাদের নিজস্ব একটা হসপিটাল সেট আপ করা হয়েছে। সেখান থেকে একটু সুস্থ হলেই তুমি প্রসিড় করবে বাঙ্গালোরে। সেখানে আমার মাসির বাড়িতে থাকবে তুমি।

–কেন, হঠাৎ বাঙ্গালোরে কেন? তোর মাসির বাড়িতে দুধ ভাত খেতে যাবো? যা ভাগ, বাজে বক বক করিস নি, পমপম। এখানে আমরা ব্যস্ত আছি। কুত্তার বাচ্চাদের যে কটাকে পারি খতম করবো।

–তোমাকে বাঙ্গালোরে যেতে হবে, কারণ অন্ধ্র ইউনিট তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে সেখানে। কমরেড নাগি রেড়ি আসবেন। ফারদার ইনস্ট্রাকশান না পাওয়া পর্যন্ত তুমি বাঙ্গালোরে অপেক্ষা করবে। এটাই মানিকদার নির্দেশ। আমি তোমায় বাঙ্গালোরে নিয়ে যাবো।

–এটা মানিকদার নির্দেশ? রিটেন কিছু আছে? কই, দেখি।

–মানিকদা কমরেড চারু মজুমদারের সঙ্গে ঘুরছেন। এখন রিটেন কিছু দেবার তার সময় আছে?

–আমি তোকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

পমপম মুখ তুলে একবার তীব্র দৃষ্টিপাত করলো অলির দিকে। তারপর আবার কৌশিকের। দিকে ফিরে বললো, সেইজন্য আমি অলিকে সঙ্গে এনেছি। মানিকদা যখন দেখা করতে আসেন তখন অলি আমার পাশে ছিল। একথা সবাই জানে যে অলি কক্ষনো মিথ্যে কথা বলে না। মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতাই ওর নেই। অলি তুই বলতে মানিকদা কী কী নির্দেশ দিয়েছেন?

অলি একটুও গলা না কাঁপিয়ে বলল, মানিকদা বলেছেন, আমি নিজের কানে শুনেছি, কৌশিককে এক্ষুনি ঘাটশিলায় যেতে হবে। হয়তো সেখানেই মানিকদার সঙ্গে তার দেখা হয়ে। যাবে। ঘাটশিলা থেকে কৌশিককে যেতে হবে বাঙ্গালোরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *