২৭
শরীর ছাড়া মানুষের আর কী আছে, আর কিসের প্রয়োজন তা বুঝতে পারে না চয়ন। কোনও দেবতা এসে যদি চয়নকে বলত, তোমাকে একটা মাত্র বর দেবো। যা খুশি চাইতে পারো। কী চাইবে চয়ন। করজোড়ে সমস্ত অন্তর দিয়ে সে বলবে, পৃথিবীর আর কোনও সম্পদ চাই না, শুধু আমার শরীরটাকে ভাল করে দাও। তাও ভাল বলতে সে পেশীফোলানো দেহশ্রী ব্যায়ামবীর হতে চায় না, সে লম্বাচওড়া জার্মান বা আফগানও হতে চায় না, সে শুধু চায় একটু সুস্থ থাকতে, যেখানে সেখানে যখন তখন অজ্ঞান না হয়ে যেতে। ব্যস এইটুকু মাত্র। কত সাধারণ হেটো মেঠো মানুষেরও তো এইটুকু আছে। এ কি খুব বেশী চাওয়া তার?
হয়তো-বা বেশীই। ডস্টয়েভস্কিই না জীবনের শেষ দিকে এসে বলেছিলেন, শরীর যে মানুষের কত বড় সম্পদ তা আজ আমি বুঝি। খ্যাতি, সফলতা সবকিছুর পরও কেন তার ওই বিলাপ যদি সেটা সত্যিই মহার্ঘ না হয়?
জাগা অবস্থায় সকাল থেকে রাত অবধি চয়নের কাছে পৃথিবীটা বিবর্ণতায় মোড়া, বিষণ্ণতায় মাখা। তার সঙ্গে পায়ে পায়ে পোষা বেড়ালের মতো ঘোরে শরীরের ভয়।
গতকাল রাতে চয়ন কেরোসিনের টেবিল বাতিটা জ্বালিয়ে বই পড়ছিল। চৌকিতে অস্থিসার মা ঘুমোচ্ছিল নিঃসাড়ে। হঠাৎ মায়ের শ্বাসের শব্দটা খেয়াল করল চয়ন। কেমন কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। হাঁফধরা। সঙ্গে কি ক্ষীণ একটা কোঁকানির শব্দও?
চয়ন উঠল, যা দেখল তাতে তার হাত-পা হিম। চোখ ওল্টানো, হাঁ করা মুখ, শ্বাস নিতে কী কষ্টই যে হচ্ছে।
মা! মা! বলে চয়ন কয়েকবার ডাকল। সাড়া পেল না।
দরজা খুলে উঠোন পেরিয়ে সে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দরজাটায় ধাক্কা দিয়ে ডাকল, দাদা! বউদি। শিগগির এসো! মা কেমন করছে।
কয়েকবার ডাবার পর ওপরের জানালা দিয়ে অয়ন বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, চেঁচাচ্ছিস কেন?
একটু এসো। মা কেমন করছে।
অয়ন নেমে এল। বউদি এল না। অয়নের হাবভাবে ব্যস্ততা নেই, উদ্বেগ নেই, উত্তেজনা নেই, এল, দেখল। তারপর চাবির গোছাটা চয়নের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ডাক্তার রাহাকে একটা খবর দে।
চয়ন এত ঘাবড়ে গেছে যে, একগোছ চাবির ভিতরে কোনটা সদরের চাবি তা খুঁজে পাচ্ছিল না। কাঁপা হাতে একটার পর একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করছিল খুলতে। হয়তো এক চাবিই দু’তিনবার লাগাল। অয়নকে জিজ্ঞেস করবে সে কথা মনেই হল না তার। কতদিন হল, তার কেবলই মনে হয় মা তার একার। এ মা অয়নের নয়। এ দায় তাকে একা বইতে হবে।
দরজা খুলে বেরোতেই সে গলদ্ঘর্ম হয়ে গিয়েছিল। যখন দুটো মোড় পেরিয়ে রাহার বাড়ির দরজায় পৌঁছোলো তখন তার শরীরে আর একটুও জোর নেই, বুকে নেই দম।
দোতলা থেকে একটি পুরুষকণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, কে?
চয়ন জবাব দিতে পারল না। তার গলায় শব্দ নেই। সে শুধু ক্লান্ত ঘাড়টা লটকে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে রইল। খরার আকাশের দিকে এভাবেই বোধ হয় হতাশ চাষী তাকিয়ে থাকে।
তবে ল্যাম্পপোষ্টের আলো পড়েছিল তার মুখে। ডাক্তারবাবু চিনতে পারলেন, কি রে চয়ন?
চয়ন তার প্রাণপণ শক্তিতে গলা ছিড়ে বলে উঠল, মা!
ডাক্তারবাবু নেমে এলেন। চয়ন তখন সিঁড়িতে বসে হাঁফাচ্ছে।
কী হয়েছে? স্ট্রোক নাকি?
চয়ন শুধু মাথা নেড়ে জানাল যে, সে জানে না।
সামান্য উত্তেজনা, সামান্য উদ্বেগ, একটু আচমকা দৌড়ঝাঁপ তাকে যেন রসাতলে ফেলে দেয়।
ডাক্তারবাবুর পিছু পিছু বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজের ওপর ঘেন্নায় মরে যাচ্ছিল। ডাক্তারবাবুর কোনও কথারই সে স্পষ্ট জবাব দিতে পারেনি।
ডাক্তার এসে মাকে দেখলেন, তারপর অয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন, কার্ডিয়াক অ্যাজমা ছিল নাকি?
অয়ন বলে, ঠিক জানি না।
হাসপাতালে নিতে পারবে?
হাসপাতাল! বলে অয়ন খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।
ডাক্তার একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, অবশ্য সেখানে নিয়েও খুব লাভ হবে না। শরীরে তো কিছুই নেই দেখছি, ক’খানা হাড় মাত্র। এক কাজ করো, নন্দী ফার্মাসি থেকে একটা অকসিজেন সিলিন্ডার আনাও। আর ওষুধ। ওদের দোকানের ভিতরে লোক থাকে। ডাকলেই উঠে ওষুধ দেবে। তাড়াতাড়ি করো। আমি বসছি।
কাঁচা ঘুম থেকে উঠে আসা বিরক্ত অয়নের মুখ দেখে কেরোসিনের আলোতেও চয়নের মনে হয়েছিল, বিছানায় ওই যে ক’খানা হাড়ের অস্তিত্ব নিয়ে পড়ে আছে মা, আজও নির্লজ্জের মতো পৃথিবীতে মা হয়ে জন্মানোর গুনাগার দিচ্ছে, এ মা অয়নের নয়। অয়নরা মায়ের পেটে জন্মায় না।
অয়নদের মা বলে কেউ থাকে না।
অয়ন চয়নের দিকে চেয়ে বলল, দৌড়ে যা।
চয়ন জানত তাকেই যেতে হবে। দ্বিরুক্তি না করে সে তোশকের তলা থেকে প্লাস্টিকের ছোট ব্যাগটা বের করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এবং তারপরই বুঝতে পারল, শরীরময় অস্তিত্বের কত অসুবিধে। তার হাঁটু ভেঙে আসছে। তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে।
তবু নন্দী ফার্মাসি অবধি গেল চয়ন। দরজা খোলালো। সিলিন্ডার আর ওষুধ নিল। তারপর তার পক্ষে গন্ধমাদন বওয়ার মতো ভারী সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে সে ফিরল।
উঠোনটা সে যে কী করে পেরোলো তা সে নিজেও জানে না। দরজার চৌকাঠটা কোনওক্রমে ডিঙিয়ে সে সিলিন্ডার সমেত পড়ে যাচ্ছিল মেঝেয়। ডাক্তারবাবু ধরলেন, আহা, ওরকম অস্থির হলে চলে? বিপদে মাথা ঠিক রাখতে হয়।
তখন কানে ঝিঝি পোকা ডাকছে চয়নের। তবু পকেট থেকে ওষুধ, ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ আর অ্যাম্পুলের প্যাকেটটা বের করে দিল।
আর সময় ছিল না তার। দরজার বাইরে নিজেকে নিক্ষেপ করল সে। কয়েক পা টলোমলো করে হেঁটে চৌবাচ্চার দিকে সরে গেল, যেখানে বাসন মাজবার ছাইগাদা, নোংরা ফেলার বালতি। সেখানেই অন্ধকারে নিজেকে ঢেলে দিল সে। তারপর নিশ্চিন্তে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কেউ একজন দেখেছিল তাকে। ওপর থেকে। সে জানত না।
কিন্তু চোখে মুখে জলের ঝাপটা খেয়ে যখন চোখ খুলে তাকাল তখনও খুব বেশী সময় যায়নি। হয়তো কয়েক মিনিট। সামনে বউদিদের কিশোরী ঝি রূপা দাঁড়ানো। হাতে মগ।
ওপর থেকে বউদি চাপা তীব্র স্বরে ডাকছিল, এই রূপা! কী করছিস ওখানে? চলে আয়!
রূপা অবশ্য পাত্তা দিল না। চয়নের দিকে চেয়ে ফ্রক পরা মেয়েটা বলল, আমার মায়েরও এ রোগ আছে। পীরবাবার জলপড়া দিলে সেরে যায়।
চয়ন ভেজা গায়ে উঠে বসল। শরীরে ভাঁটির টান। পরনির্ভর এই জীবনের ভার আর বইতে ইচ্ছে করে না।
মেয়েটা এগিয়ে এসে হাত ধরে বলল, ভর দিয়ে ওঠো, পারবে?
ওপর থেকে বউদি চেঁচাল, এরপর কিন্তু চুলের মুঠি ধরে হেঁচড়ে আনবো।
চয়ন বলল, তুই ওপরে যা রূপা। আমি পারব।
রূপা খুব একটা চাপা গলায় নয়, বরং একটু শুনিয়েই বলল, চেঁচাক না মাগী, সবসময়েই তো চেঁচায়। সামনের শনিবার খুড়ো এলে তার সঙ্গে চলে যাবো। মা গো! এ বাড়িতে মানুষ থাকতে পারে!
রূপার গলা নিশুত রাতে স্পষ্টই শুনতে পেল বউদি। তাই বোধ হয় আর একটাও কথা বলল না। জানালা বন্ধ করে দিল।
চয়ন ভয় পেল। সে জানে, জল অনেক দূর গড়াবে। বউদি সহজে ছাড়বে না। সে মৃদু গলায় বলে, ওপরে যা রূপা, নইলে হয়তো মারবে।
রূপা ফ্যাক করে হেসে বলে, অত সোজা নয়। প্রথম প্রথম চড়-চাপড় হজম করেছি, তারপর একদিন যেই মারতে এসেছে অমনি বেলনা তুলে আমিও তেড়ে গেছি। ব্যস মর্দানী সব ফুস করে উবে গেছে। আজকাল তো আমি গাল দিলেই উল্টে গাল দিই। ওঠো তো, ভর দিয়ে ওঠো।
ভর দিতেই হল চয়নকে। নইলে উঠতে পারত না।
তুমি যখন থাকো না তখন আমি এসে মাঝে মাঝে বুড়ি মাকে দেখে যাই। ইস, কেমন মড়ার মতো পড়ে থাকে। মনে হয় বুঝি শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।
চয়ন খুব বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগল।
বুড়ি মাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও না কেন?
চয়ন এ কথার কীই-বা জবাব দেবে? সে একটু হাসবার চেষ্টা করল মাত্র।
রূপা ওপরে গেল না। তার পিছু পিছু ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিয়ে নাকে নল লাগিয়েছে। তারপর নাড়ী ধরে বসে আছে। পাশে বিরক্ত অয়ন।
ডাক্তার মায়ের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, সবসময়ে অ্যালার্ট থেকো। অবস্থা খুব ভাল নয়। এ ঘরে আলো নেই কেন বলো তো!
অয়ন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, লাইনটা খারাপ।
আলো থাকাটা দরকার। আর ঘরটা ভীষণ স্টাফি। সম্ভব হলে দোতলায় শিফট কোরো। এখানে তো কেরোসিনের গ্যাস জমে আছে। স্টোভ জ্বলে নাকি?
অয়ন বলল, মাঝে মাঝে জ্বালতে হয়।
রুগীর পক্ষে খারাপ।
প্লাস্টিকের ব্যাগটা কোথায় ফেলেছে তা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিল না চয়ন। ডাক্তারের ভিজিটটা দিতে হবে।
কী খুঁজছো?
ছোট একটা কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ।
দাঁড়াও। বলে রূপা উপুর হয়ে এদিক ওদিক খুঁজে চৌকির পায়ার কাছ থেকে ব্যাগটা কুড়িয়ে এনে দিল।
ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পর সদর বন্ধ হলে চয়ন এসে মায়ের কাছে বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওপরে জানালা খুলে বউদি চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই রূপা হারামজাদী বজ্জাত, কতবার ওপরে আসতে বলেছি তোকে?
রূপা উঠোন থেকে সমান তেজে জবাব দিল, অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো কেন? বুড়ো মানুষটার অসুখ করেছে বলে দেখতে এসেছি সেই তখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কেন, কি কাজ তোমার?
ফের মুখে মুখে কথা! আমি হুকুম করেছি, তুই ওপরে আসবি। উল্টে চোপা করছিস।
যাবো না ওপরে, কী করবে? গলাটা কেটে ফেলবে? এঃ, হুকুম দেখাতে এসেছে!
এই শুনছো! ওকে কান ধরে নিয়ে এসো তো।
এ কথাটা অয়নকে উদ্দেশ করে বলা। অয়ন কিছু উপদেশ দেবে বলেই বোধ হয় দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রূপা আর বউয়ের ঝগড়ায় বিব্রত হয়ে চুপ করে ছিল। এবারে মুখ ফিরিয়ে রূপার দিকে চেয়ে বলল, যা না ওপরে।
রূপা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, কেন যাব? মাঝ রাত্তিরে তো আর ঘরের কাজ নেই। একটু দেখতে এসেছি, অমনি কেমন খ্যাঁকাচ্ছে দেখ। আচ্ছা মেয়েমানুষ বাবা!
ওপর থেকে বউদির গলায় একটা বিস্ফোরণ শোনা গেল, শুনলে! তুমি পুরুষমানুষ না কী। অ্যাঁ! চুলের ঝুঁটি ধরে ওকে দু ঘা দিতে পারছে না? মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ঝি-চাকর যা-খুশি বলে যাবে। তোমার ব্যক্তিত্ব নেই?
অয়ন যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা চয়ন খুব বুঝতে পারছে। রূপার গায়ে হাত তোলার মতো সাহস তার নেই, বউয়ের অবাধ্য হওয়ার মতো বুকের জোরেরও অভাব।
বউদি চেঁচিয়ে বলল, মেনীমুখো পুরুষ বলেই তো কেউ মানে না, ভয়ও খায় না। দিব্যি বাড়ি দখল করে আপদেরা বসে আছে। পারলে তাড়াতে? একদিন এ বাড়ি ওই ছোট তরফের ভোগেই যাবে। ভাল মানুষটি সেজে থাকে বলে সোজা পাত্র ভেবো না। ভিরমি খায়, চোখ উল্টে পড়ে থাকে—ওসব ন্যাকামি ঢের জানা আছে। তলায় তলায় কী করছে জানো? নইলে ওই সোমত্থ মেয়েটা রাতবিরেতে গিয়ে ওরকম ঝাঁপ খেয়ে পড়ে নাকি? মুখের অত জোরই বা আসছে কোত্থেকে যদি না তোমার যুধিষ্টির ভাইয়ের উসকানি থাকত!
এই অ্যাঙ্গেলটা খুব নতুন। রূপার সঙ্গে কত অনায়াসে তাকে জড়িয়ে নোংরা ইঙ্গিত করে ফেলল বউদি! প্রতিবাদ করার মতো জোর বা ক্ষমতা নেই চয়নের। অবাধ্য হৃৎপিণ্ডের একটা প্রবল দুরদুরুনি নিয়ে সে মায়ের মৃতপ্রায় মুখের দিকে চেয়ে বসে রইল।
জবাব দিল রূপা, বেশী কথা কইবে তো আমিও কথা কইতে জানি। যখন দেশ থেকে আনিয়েছিলে তখন তো কত ভাল ভাল কথা! ভাল হয়ে থাকবি, তোর বিয়ে অবধি আমরা দিয়ে দেবো। মেয়ের মতো ভালবাসবো। যাদের কথার ঠিক নেই তাদের সঙ্গে খানকীর তফাত নেই, বুঝলে!
খানকী আমি না তুই? মাঝরাতে উঠে একেবারে আলুথালু হয়ে গিয়ে বুকের ওপর পড়ল—যেন উত্তম-সুচিত্রা! ডুবে ডুবে জল খাস একাদশীর বাবাও টের পায় না, না? অত দরদ কিসের রে? ধুমসো মেয়ে, ফ্রক পরে কচি খুকি সেজে থাকলেই বুঝি লোকের চোখে ধূলো দেওয়া যায়? এই, তুমি এখনও দাঁড়িয়ে মজা দেখছো? পায়ের চটিটা খুলে ওর দু’গালে মারতে পারছো না?
অনেকক্ষণ বাদে অয়ন মানুষের মতো একটি আচরণ করল। ওপর দিকে চেয়ে বলল, কেন চিৎকার করছো বলো তো? মায়ের যে ভীষণ অসুখ।
আহা, মায়ের অসুখ! অসুখ তো নিত্যিদিন আছে। আর তোমার নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে যে মেয়েটা আমাকে যা খুশি বলছে! তোমার মতো পুরুষের ঘোমটা দিয়ে থাকা উচিত।
দ্বিধাবিভক্ত অয়ন নিজেকে জোড়া দিতে পারছে না। কেরোসিনের ম্লান আলোতেও তার অসহায় মুখখানা দেখতে পাচ্ছিল চয়ন। সে মৃদুস্বরে বলল, তুই ওপরে যা দাদা। আমি তো মায়ের কাছে আছিই।
অয়ন সামান্য দ্বিধার সঙ্গে বলল, তুই কি এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি! কই, দেখিনি তো!
লজ্জিত চয়ন বলে, হঠাৎ মায়ের এরকম হওয়ায় বোধ হয় মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। চৌবাচ্চার কাছে পড়ে গিয়েছিলাম। রূপা এসে চোখে মুখে জল দিয়েছিল।
অয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলে, এই তাহলে ব্যাপার!
উঠোনে রূপা হঠাৎ কি একটা কথার উত্তরে চেচিয়ে বলল, গলায় তুমি দড়ি দাও গে। সকাল হোক না, পাড়ার লোক যদি জড়ো না করি তাহলে আমার নামে কুকুরকে ভাত দিও। পাশের বাড়ির বিন্তি বলেছে, এ বাড়ির বউদিটা এক নম্বরের হারামি।
শুনলে! শুনলে তুমি?
অয়ন বিবর্ণ মুখে রূপার দিকে ফিরে বলল, কী করছিস তুই! কোন সাহসে এত কথা বলছিস?
কেন, আমি কি কাউকে ভয় পাই?
চুপ করবি কিনা!
আগে তোমার বউকে চুপ করাও!
অসহায় অয়ন একবার চয়নের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে ধীরে ধীরে ওপরে চলে গেল। চয়ন ঘর থেকে শুনতে পেল, ওপরে স্বামী-স্ত্রীতে প্রবল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। তবু ভাল। পাড়া জানান দিয়ে যা হচ্ছিল তার চেয়ে এটা বরং ভাল। ওদের স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া খুব হয়। কিন্তু পরদিন আবার বেশ ভাবসাব, হাসি-হাসি মুখ, ওগো-হ্যাঁ গা।
রূপা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা ফেটে পড়ছে রাগে।
চয়ন একবার তাকাল তার দিকে। বছর পনেরো-ষোলোর সতেজ মেয়ে। রংটা চাপা, মুখে একটা রুক্ষ উগ্ৰ ভাব আছে। মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল। মাত্র মাসখানেক হল এসেছে। চয়নের সঙ্গে ভাল করে দেখাও হয় না। তবে এক মাসে সে এটা লক্ষ করেছে যে, দাদার অন্য সব ঝি তার সঙ্গে যেমন খারাপ ব্যবহার করে, এ মেয়েটা তেমন করে না।
চয়ন মৃদু স্বরে বলল, ঝগড়া করলি কেন?
বাঃ, ওই তো ঝগড়া করল। আমি কি লাগতে গেছি? ওপর থেকে দেখলাম তুমি চৌবাচ্চার ধারে দড়াম করে পড়ে গেলে, তাই ছুটে নেমেছি। তাতে কি দোষ ছিল? মৃগী যে কেমন খারাপ ব্যায়রাম তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি।
এখন কী হবে? তোকে যদি তাড়িয়ে দেয়?
দিক না! জলে পড়ে যাবো না ঠিকই। সামনের চাটুজ্জে বাড়ি থেকে তো দুশো টাকায় সাধছে। বর-বউ চাকরিতে যায়, বাচ্চা রাখতে লোক চাই।
চয়ন একটু হাসল। এ বয়সের মেয়েদের আজকাল চাকরির অভাব হয় না ঠিকই। বরং প্রচণ্ড চাহিদা।
চয়ন পরিশ্রান্ত বোধ করছে, একটা গভীর মন খারাপের গহুর তৈরি হয়েছে বুকের মধ্যে। মা চলে যাচ্ছে। সে কিছুই করতে পারছে না। মায়ের নিবন্ত মুখের দিকে চেয়ে চয়ন বলল, আমার জন্যই তো অশান্তিটা হল তোর। কেন যে তুলতে এলি আমাকে। জানিস তো বউদি আমাকে পছন্দ করে না।
রূপা দরজার চৌকাঠে উবু হয়ে বসে তার দিকে চেয়ে বলে, শোনো দাদাবাবুর কথা! একটা লোক আঁস্তাকুড়ে পড়ে থাকবে, কিছু করব না বুঝি! মৃগী খুব খারাপ রোগ। মাকে সেজন্য আমরা পুকুরে বা নদীতে যেতে দিই না। উনুনের ধারেও যাওয়া উচিত নয়। একবার তো ভাতের হাঁড়িতে পড়ে গিয়ে মুখটুখ পুড়ে গিয়েছিল। তোমাকে দেখার তো কেউ নেই, না?
দরকারও হয় না। চলে যাচ্ছে।
তোমাকে ওই শয়তানটা দেখতে পারে না কেন বলো তো? সবসময়ে তোমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে।
বলুক গে। কী যায় আসে!
তোমার গায়ের চামড়া বেশ পুরু আছে বাপু। অত ভয় খাও কেন? দেখলে তো চোটপাট করলুম বলে কেমন চুপসে গেল!
চয়ন মৃদু হেসে বলে, তোর খুব সাহস, না?
আমি কাউকে ভয় খাই না।
দেশে থাকতে লেখাপড়া করিসনি?
রূপা মুখটা একটু ঝামরে বলল, সবাই কেন ওকথা জিজ্ঞেস করে বলো তো! লেখাপড়া করে কি তোমাদের আর দুটো করে হাত-পা গজিয়েছে? তোমার বউদি তো শুনি বি এ পাশ, আহা, কী বি এ পাশের ছিরি! মুখ তো আমাদের মতোই আঁস্তাকুড়! না বাপু, আমি বেশী পড়িটড়িনি তবে বাংলা অক্ষর চিনি। সোজা বই হলে একটু-আধটু পড়তেও পারি। কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং করে লিখতেও পারি একটু।
বাড়িতে কে আছে?
যেমন সকলের থাকে। মা বাপ তিনটে ভাই আর চারটে বোন। রোজগারপাতি নেই। বাবার একটা ভটভটি আছে, ভাগের। আর ক্ষেতে কিছু ধান হয়। একটা ভাই মাছের ভেড়িতে সদ্য কাজে ঢুকেছে।
তুই একটা বেশ মেয়ে। তবে একটু ঝগড়াটি, তাই না?
ঝগড়াটি না হলে শেয়ালে শকুনে টেনে নিয়ে যেত এত দিনে, বুঝলে? মুখের জোর আর গলার জোর না থাকলে আমাদের মতো মেয়েদের খুব বিপদ।
চয়ন একটু অবাক হয়ে বলে, বেশ বলেছিস তো!
নিজের কানেই তো শুনলে, তোমার বউদি তোমাকে আমাকে নিয়ে কেমন খারাপ কথা বলছে। কিছু করিনি তাও। মুখ বুজে থাকলেই পেয়ে বসত। আরও বলত। এমন ঝামা ঘষে দিয়েছি যে, আর বলবে না কখনও।
চয়ন মৃদু ম্লান একটু হাসল। তারপর নরম গলায় বলল, যা, ঘুমো গে।
তুমি কী করবে? মাকে আগলে বসে থাকবে?
মাকে নিয়েই তো থাকি।
অবস্থা কি খুব খারাপ?
মায়ের শরীরে কি কিছু আছে বল! ক’খানা হাড় শুধু।
জানি। আমি এসে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে যাই।
চয়ন কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়ে বলে, মাঝে মাঝে দেখিস। কেউ দেখে জানলে ভরসা পাই।
ভেবো না তুমি। এ বাড়িতে যে কদিন আছি, দেখব।
রূপা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল চয়ন। মা সারা রাত নানারকম শব্দ করল। শ্বাসের শব্দ, কষ্টের শব্দ। ভোরবেলার দিকে শান্ত হল যেন। ডাক্তার বেলা আটটা নাগাদ এসে দেখে-টেখে বলল, ফাঁড়াটা এ যাত্রা কেটেছে। কিন্তু এ রোগে কিছু বলা যায় না।
সকালে আজ টিউশনিতে যায়নি চয়ন। সারাদিন মায়ের পাশে বসে রইল চুপ করে। কিছু ভাবল না। কিছু করল না। এমন কি খেতে অবধি ইচ্ছে হল না।
বিকেলের দিকে সামলে উঠল তার মা। দুটো একটা কথা বলল।
টিউশনিতে কি যাবো মা? একা থাকতে পারবে?
যা বাবা। কামাই হলে যদি ছাড়িয়ে দেয়! যা। একাই তো থাকি। পারব।
সারাদিন খায়নি বলে যে খিদে পেয়েছিল তাও নয়। শরীরটা অবসন্ন লাগছিল তার। এর বেশী কিছু নয়।
কিন্তু মোহিনী তাকে দেখেই বলল, মাস্টারমশাই, আপনার কী হয়েছে?
চয়ন অপ্রতিভ মুখে বলল, তেমন কিছু নয়। মার শরীরটা ভাল নয়। রাত জাগতে হয়েছিল।
তাহলে আজ না এলেই হত। একটা ফোন করলেই পারতেন।
সারাক্ষণ ঘরে থাকতে ভালও লাগছিল না।
মায়ের কী হয়েছে?
হার্ট ভাল নয়।
মোহিনীর চোখ একটু ছলছল করল বোধ হয়। মুখের দিকে তাকায় না বলে স্পষ্ট দেখতে পেল না চয়ন। তবে মেয়েটা বড্ড মায়াবী। মনটা খুব নরম।
মোহিনী হঠাৎ বলল, আপনি বোধ হয় কিছু খাননি আজ।
না না, খেয়েছি।
দাঁড়ান তো। আসছি।
মোহিনী উঠে গেল। লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিল চয়ন। প্রাইভেট টিউটর হিসেবে সে কি বড্ড বেশী প্রশ্রয় পাচ্ছে না? এতটা কি তার পাওনা?