২৭. শক্তির নবায়ন

২৭. শক্তির নবায়ন

পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসকে সহজভাবে বলা যায় শক্তি ব্যবহারের ইতিহাস–এখানে শক্তি শব্দটা কিন্তু সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয় নি, বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে শক্তি বলতে বোঝানো হচ্ছে তাপ কিংবা বিদ্যুতের মতো শক্তিকে, রাজনৈতিক বা সামাজিক শক্তির মতো শক্তিকে নয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, কোনো দেশ কতটা উন্নত সেটা বোঝার একটা সহজ উপায় হচ্ছে মাথাপ্রতি তারা কতটুকু বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে তার একটা হিসেব নেয়া। উদাহরণ দেবার জন্যে বলা যায় আমরা মাথাপিছু যেটুকু বিদ্যুৎ খরচ করি–যুক্তরাষ্ট্র খরচ করে তার থেকে একশগুণ বেশি। কাজেই এটা অনুমান করা কঠিন নয় আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে তাদের দৈনন্দিন জীবন সম্ভবত, একশগুণ বেশি আরাম আয়েশের।

আমরা আমাদের জীবনে যে কয় ধরনের শক্তি ব্যবহার করি তার মাঝে চট করে যে দুটোর নাম মনে আসে সেগুলো হচ্ছে তাপ আর বিদ্যুৎ। আমরা রান্নাবান্না করার জন্যে তাপ শক্তি ব্যবহার করি। কখনো সেটা আসে গ্যাসের চুলোর আগুনে, কখনো লাকড়ির আগুনে কখনোবা বৈদ্যুতিক হিটারে। জীবনকে আরামদায়ক করার জন্যে যে শক্তিটা ব্যবহার করি সেটা হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি। লোড শেডিংয়ের কারণে যখন বিদ্যুৎ চলে যায় তখন আমরা এর গুরুত্বটা হাড়ে হাড়ে টের পাই। তখন ঘরে আলো জ্বলে না, ফ্যান ঘুরে না, টেলিভিশন চলে না। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার সবকিছুই মোটামুটি বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। সে জন্যে আমরা বিদ্যুৎকে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাই। যে কয় ধরনের শক্তি আমরা ব্যবহার করি তার মাঝে বিদ্যুৎ সবচেয়ে জনপ্রিয় শক্তি কারণ বিদ্যুৎকে সবচেয়ে সহজে অন্য রূপে পরিবর্তন করা যায়। আমরা লাইট বাল্ব ব্যবহার করে বিদ্যুৎকে আলোতে রূপান্তর করি। হিটার দিয়ে তাপে রূপান্তর করি, ফ্যান দিয়ে যান্ত্রিক শক্তিতে আর স্পিকার দিয়ে শব্দ শক্তিতে। শুধু যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পাল্টে দিতে পারি তা নয়–এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সেটা খুব সহজে নিয়ে যেতে পারি। প্রয়োজন হলে ব্যাটারির মাঝে আমরা বিদ্যুৎ শক্তিকে জমা করেও রাখতে পারি, যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে তারা সবাই সেটা জানে!

পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসটা যেহেতু শক্তি ব্যবহারের ইতিহাস তাই আমরা দেখতে পাই সারা পৃথিবীতেই সব দেশ সব জাতির ভেতরেই শক্তির জন্যে এক ধরনের ক্ষুধা কাজ করছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবে শক্তির অনুসন্ধান করছে, শক্তিকে ব্যবহার করছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তেল, গ্যাস বা কয়লা। অনেক দেশ নিউক্লিয়ার শক্তিকে ব্যবহার করছে। সেখানেও এক ধরনের জ্বালানির দরকার হয়, সেই জ্বালানি হচ্ছে ইউরেনিয়াম। এই শক্তিগুলোর মাঝে একটা মিল রয়েছে–এগুলো ব্যবহার করলে খরচ হয়ে যায়। মাটির নিচে কতটুকু তেল, গ্যাস, কয়লা আছে কিংবা পৃথিবীতে কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে মানুষ এর মাঝে সেটা অনুমান করে বের করে ফেলেছে। দেখা গেছে পৃথিবীর মানুষ যে হারে শক্তি ব্যবহার করছে যদি সেই হারে শক্তি ব্যবহার করতে থাকে তাহলে পৃথিবীর শক্তির উৎস তেল, গ্যাস, কয়লা বা ইউরেনিয়াম দিয়ে টেনেটুনে বড় জোর দুইশত বৎসর চলবে। তারপর আমাদের পরিচিত উৎস যাবে ফুরিয়ে। তখন কী হবে?

পৃথিবীর মানুষ সেটা নিয়ে খুব বেশি দুর্ভাবনায় নেই, তার কারণ মানুষ মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর মাঝে অন্য কিছু বের করে ফেলা হবে–যেমন নিউক্লিয়ার ফিউসান, যেটা ব্যবহার করে সূর্য কিংবা নক্ষত্রেরা তাদের শক্তি তৈরি করে। ফিউসানের জন্যে জ্বালানি আসে হাইড্রোজেনের একটা আইসোটপ থেকে, আর পানির প্রত্যেকটা অণুতে দুটো করে হাইড্রোজেন, কাজেই সেটা ফুরিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই।

শুধু যে ভবিষ্যতে নূতন ধরনের শক্তির উপর মানুষ ভরসা করে আছে তা নয়, এই মুহূর্তেও তারা এমন শক্তির উপর ভরসা করে আছে যেগুলো কখনো ফুরিয়ে যাবে না। সেই শক্তি আসে সূর্যের আলো থেকে, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা কিংবা ঢেউ থেকে, উন্মুক্ত প্রান্তরের বাতাস থেকে, পৃথিবীর গভীরের উত্তপ্ত ম্যাগমা থেকে কিংবা নদীর বহমান পানি থেকে। আমাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে এই শক্তিগুলো বলতে গেলে অফুরন্ত। এর একটি গালভরা নামও দেয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে নবায়নযোগ্য (Renewable Energy) শক্তি–অর্থাৎ যে শক্তিকে নবায়ন করা যায়, যে কারণে এটার ফুরিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব মানুষ যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এই নবায়নযোগ্য শক্তি। যত দিন যাচ্ছে মানুষ ততই পরিবেশ সচেতন হচ্ছে তাই এরকম শক্তির ব্যবহার আরো বেড়ে যাচ্ছে। বাতাস ব্যবহার করে যে শক্তি তৈরি করা হয় প্রতি বছর তার ব্যবহার বাড়ছে প্রায় ত্রিশ শতাংশ, এই সংখ্যাটি কিন্তু কোনো ছোট সংখ্যা নয়।

পৃথিবীর পুরো শক্তির পাঁচ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি। সেই এক ভাগের বেশিরভাগ হচ্ছে। জলবিদ্যুৎ, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা–আমাদের কাপ্তাই লেকের মতো। নদীর পানি যেহেতু ফুরিয়ে যায় তাই এরকম বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শক্তির উৎসও ফুরিয়ে যায় না এটা হচ্ছে প্রচলিত ধারণা। কিন্তু নদীতে বাঁধ দেয়া হলে পরিবেশের অনেক বড় ক্ষতি হয় সে কারণে পৃথিবীর মানুষ অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। যাদের একটু দুরদৃষ্টি আছে তারা এরকম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আর তৈরি করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে অনেক বড় বড় বাঁধ তৈরি করেছিল এখন ধীরে ধীরে সেগুলো ভেঙে আগের জায়গায় যাবার পরিকল্পনা করছে। জলবিদ্যুৎ করার জন্যে নদীতে বাঁধ দেবার বেলায় সবচেয়ে উদ্যোগী দুটি দেশ হচ্ছে চীন এবং ভারত। ভারতের টিপাইমুখ বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা কে না শুনেছে?

জলবিদ্যুতের পর সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য শক্তি আসে বায়োমাস (Biomass) থেকে। বায়োমাস কথাটার মাঝে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক গন্ধ আছে এবং মনে হতে পারে এটা বুঝি চমকপ্রদ কোনো শক্তির উৎস–আসলে সেরকম কিছু নয়। এটা বলতে বোঝানো হয় লাকড়ি, খড়কুটো এই সব জ্বালানিকে। পৃথিবীর একটা বড় অংশের মানুষের কাছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ নেই-তাদের দৈনন্দিন জীবন কাটে লাকড়ি, খড়কুটো জ্বালিয়ে। এই দরিদ্র মানুষগুলোর ব্যবহারী শক্তি পৃথিবীর পুরো শক্তির একটা বড় অংশ। যদিও শুকনো গাছ খড়কুটো পুড়িয়ে ফেললে সেটা শেষ হয়ে যায় তারপরেও বায়োমাসকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস বলার কারণ নূতন করে আবার গাছপালা জন্মানো যায়। তেল, গ্যাস বা কয়লার মতো পৃথিবী থেকে এটা চিরদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যায় না।

বায়নযোগ্য শক্তির এই দুটি রূপ, জলবিদ্যুৎ আর বায়োমাসকে যদি আমাদের খুব পছন্দের শক্তির উৎস হিসেবে না ধরি তাহলে যে কয়টি বাকি থাকে তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণগুলো হচ্ছে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়ো ফুয়েল আর জিওথার্মাল।

শীতের দিনে রোদের উষ্ণতা যে একবারও উপভোগ করেছে সেই আসলে সৌরশক্তির কথাটি জানে। সূর্য পৃথিবীকে অবারিতভাবে শক্তি দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই আমরা সে কথাটা ভুলে যাই। ভারত টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি করার পরিকল্পনা করছে সেটা একটা নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের কাছাকাছি, অর্থাৎ প্রায় হাজার মেগাওয়াট। শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যাবে, মাত্র এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় সূর্য থেকে আলো তাপ হিসেবে সেই পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। তার একটা অংশ বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়ে যায়, রাতের বেলা সেটা থাকে না, মেঘ বৃষ্টির কারণে সেটা অনিয়ন্ত্রিত, শক্তিটা আসে তাপ কিংবা আলো হিসেবে বিদ্যুতে রূপান্তর করার একটা ধাপ অতিক্রম করতে হয়–তারপরেও বলা যায় এটা আমাদের খুব নির্ভরশীল একটা শক্তির উৎস। সূর্যের তাপকে ব্যবহার করে সেটা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। তার চাইতে বেশি জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে সেটাকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তর করা। আজকাল পৃথিবীর একটা পরিচিত দৃশ্য হচ্ছে সোলার প্যানেল, বাসার ছাদে লাগিয়ে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজের বাসায় তৈরি করে নেয়।

সৌরশক্তির পরই যেটি খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ফেলছে সেটা হচ্ছে বায়ুশক্তি। আমাদের দেশে আমরা এখনো বায়ু বিদ্যুতের বিশাল টারবাইন দেখে অভ্যস্ত নই কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশেই সেটা খুব পরিচিত একটা দৃশ্য। যেখানে এটা বসানো হয় সেখান থেকে শুধু একটা খাম্বা উপরে উঠে যায়, তাই মোটেও জায়গা নষ্ট হয় না সে জন্যে পরিবেশবাদীরা এটা খুব পছন্দ করেন। বিস্তীর্ণ মাঠ বা সমুদ্রোপকূলে বিশাল টারবাইনের পাখাগুলো মন্থর ভঙ্গিতে ঘোরায় দৃশ্যটি বেশ সুন্দর! আজকাল একটা বায়ু টারবাইন থেকে কয়েক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব! আমাদের দেশের সমুদ্রোপকূলেও বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে–খানিক দূর এগিয়ে সেটা কেন জানি থমকে আছে!

পৃথিবীর মানুষ বহুদিন থেকে পান করার জন্যে এলকোহল তৈরি করে আসছে–সেটা এক ধরনের জ্বালানি। ভুট্টা, আখ এ ধরনের খাবার থেকে জ্বালানির জন্যে এলকোহল তৈরি করা মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। রান্না করার জন্যে আমরা যে তেল ব্যবহার করি সেটা ডিজেলের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। পৃথিবীতে অনেক ধরনের গাছপালা আছে যেখান থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, অনেক দেশই (যেমন ব্রাজিল) এ ধরনের বায়োফুয়েল বেশ বড় আকারে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তবে পৃথিবীর অনেক মানুষ এখনো অভুক্ত, তারা যে খাবারটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত সেটা ব্যবহার করে বিলাসী গাড়ি চালানোর জন্যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করার মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

নবায়নযোগ্য শক্তির গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি হচ্ছে জিওথার্মাল (geothermal)। আমাদের পৃথিবীর ভেতরের অংশ উত্তপ্ত, আগ্নেয়গিরি দিয়ে যখন সেটা বের হয়ে আসে তখন আমরা সেটা টের পাই। তাই কেউ যদি কয়েক কিলোমিটার গর্ত করে যেতে পারে তাহলেই তাপশক্তির একটা বিশাল উৎস পেয়ে যায়। প্রক্রিয়াটা এখনো সহজ নয় তাই ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয় নি। কোনো কোনো জায়গায় তার ভূ-প্রকৃতির কারণে সেখানে এ ধরনের শক্তি সহজেই পাওয়া যায় সেখানে সেগুলো ব্যবহার শুরু হয়েছে। আইসল্যান্ড খুব ঠাণ্ডা একটি দেশ তারা তাদের প্রায় সব মানুষকেই শীতের সময় এই পদ্ধতি থেকে তাপ নিয়ে উষ্ণ রাখে। শুধু তাই নয়, তারা প্রায় কয়েকশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে।

সারা পৃথিবীতেই এখন মানুষেরা পরিবেশ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছে। উন্নতির জন্যে দরকার শক্তি, কিন্তু শক্তির জন্যে যদি পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয় আধুনিক পৃথিবীর মানুষ কিন্তু সেটা মেনে নেয় না। সে কারণে আমরা সারা পৃথিবীতেই একটা পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর মানুষ এখন যে কোনো শক্তি যে কোনোভাবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত নয়। আমাদের এই অত্যন্ত কোমল পৃথিবীটার সর্বনাশ না করে, প্রকৃতির সাথে বিরোধ না করে আমরা তার মাঝে লুকানো শক্তিটুকু ব্যবহার করতে চাই।

বর্তমান পৃথিবী সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে–অন্তত এগিয়ে যাবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *