মুঙ্লার যৌতুকে পাওয়া জমিতে এপক্ষ থেকে এই প্রথম চাষ পড়বে।
রামচন্দ্র বললো, মহিম সরকার কিন্তু ভালো চাষ জানে।
আমরাও তাগরে তাক লাগায়ে দিবো।
কস কী?
ছিদাম হাসে হাসে কয়ছে, জান কবুল।
আলোচনায় এও স্থির হলো মুঙ্লারা আগেই রওনা হয়ে যাবে। রামচন্দ্র যাবে ভান্মতিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে।
আলাপের একসময়ে রামচন্দ্রর স্ত্রী বললো, সব তো ঠিক করলা, এদিকে কী হইচে তা তো জানো নাই।
কয়ে দিলে, মা। বলে মুঙ্লা মুখটায় যতদূর সম্ভব বিপন্নতা ফুটিয়ে তুলো।
পরিকল্পনাটা ভান্মতির। সে বুদ্ধিমতী, উপরন্তু বয়স্কা দিদি বউদিদিদের মধ্যে মানুষ হয়ে তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণবুদ্ধি অভিজ্ঞতার পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে। সে ঘুমন্ত রামচন্দ্রর পায়ের ছাপ কাগজে তুলে মুঙ্লাকে দিয়েছিলো এবং সেই মাপেমিলিয়ে জুতো সহজে না পেলেও অবশেষে এক দোকান থেকে একজোড়া যোগাড় করে এনেছে সে।
রামচন্দ্র অত্যন্ত লজ্জিত এবং বিব্রত বোধ করে নানা’করে উঠলো। কিন্তু ততক্ষণে ভান্মতি জুতো নিয়ে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে কাগজের মোড়ক খুলতে লেগে গেছে।
রামচন্দ্র হেসে বললো, এ যে নৌকা!
তার স্ত্রী বললো, লোকটা তুমি কোন পাখির মতো?
জুতো পরানোর চেষ্টাটা কিন্তু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। প্রথমে রামচন্দ্র নিজে, তারপরে ভান্মতি তারপর ভান্মতি এবং সনকা, শেষ পর্যন্ত মুঙ্লা এবং রামচন্দ্র চেষ্টা করে গলদঘর্ম হয়ে উঠলো। তথাপি যে পা দুখানা দীর্ঘ দিন ধরে দু-মনী দেহটা মাঠের উঁচুনিচু জমিতে, কখনো আতপ্ত ধুলোর কখনো বা হড়হড়ে কাদার পথে মাইলের পর মাইল বহন করতে অভ্যস্ত হয়েছে। তারা কি জুতোর বাঁধন পরতে রাজী হয়? বাঁ পাটিতে অবশেষে পা গেলো। মুঙ্লা স্ফুর্তি প্রকাশ করতে গিয়ে দেখলো গোড়ালির দিকে খানিকটা জুতো তার হাতে ছিঁড়ে এসেছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুঙ্লা হায় হায় করে উঠলো, কিন্তু রামচন্দ্র হো হো করে হেসে উঠলো এবং কিছুপরে মুও সে হাসিতে যোগ দিলো।
শুধু ভান্মতি রাগ করে কাঁদতে বসলো।
রামচন্দ্র বললো, কাঁদিস নে, মা, কাঁদিস নে।
ওরা কী কবি, আমার ভগ্নিপোতরা ঠাট্টা করে।
হুম্। একটু ভেবে রামচন্দ্র বললো, তোর বাপেক জিগাস মা, জুতা না থাকলিও আমাদের কিছু থাকে কিনা। রামচন্দ্র তার গোঁফ জোড়াও পাকিয়ে দিলো।
প্রত্যুষে রামচন্দ্রর গাড়ি জমির ধারে তাকে নামিয়ে দিয়ে ভান্মতিকে নিয়ে মহিম সরকারের বাড়ির দিকে গেলো।
মুঙ্লা আর ছিদাম কোনোদিনই কর্তব্যকর্মে অবহেলা করে না। আজ তারা যেন অনুপ্রেরিত হয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে তারা পোয়াটেক জমি চাষ ফেলেছে।
রামচন্দ্র সাড়া দিলো, আ-হৈ।
মুঙ্লা আর ছিদাম দুজনে প্রতিধ্বনি তুলে লাঙলের মোড় ফিরিয়ে কাছে এলো।
দুই জোড়া বলদই দ্রষ্টব্য। গহরজানের কাছ থেকে ছিদাম যে জোড়া চেয়ে এনেছে সে দুটি পশ্চিমী, শাদা দুটি চলন্ত পাহাড়। মুঙ্লার জোড়া দেশী, কিন্তু এত পরিপুষ্ট যে ষাঁড় বলে ভুল হয়। বলদগুলি হাঁপাচ্ছে।
রামচন্দ্র বললো হাসিমুখে, দেখিস, বলদেক মারে ফেলিস নে।
মহিম সরকার এলো খবর পেয়ে। তার হাতে একটা চটের থলে, তাতে তামাক, সোলা, ঠাকুরদাদার আমলের চমকি পাথর ও আঁকড়া লোহা, থলের গায়ে লোহার আঁকড়ায় ডাবা হুঁকো ঝুলছে।
রামচন্দ্রর কাছে এসে মহিম বললো, কে, বেহাই যে!
কে, কাকা আসছেন? পেন্নাম হই। আমাক আর বেহাই কন্ কেন; আমি সামাইন্য।
মহিম তামাক সেজে রামচন্দ্রর হাতে দিয়ে বললো, খাও বিহাই।
রামচন্দ্র লজ্জিত মুখে তামাক নিয়ে খেতে খেতে বললো, কন, কী ভাগ্য আমার, কাকা!
মহিম বললো, একজন তো তোমার ছাওয়াল, আর একজন কে?
গোঁসাইয়ের বেটা ছিদাম।
ছিদাম? কেষ্টদাসের ছাওয়াল? এমন জোয়ান হইছে? চলো, দেখে আসি চাষ।
দুই বেহাই জমিতে নেমে ঘুরতে ঘুরতে ছিদাম মুঙ্লার কাছে গিয়ে পৌঁছলো। মহিম সরকার বলদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। একথা-ওকথা বলতে বলতে খ করে বলে বসলো, বেহাই, আমরা কি এদের মতো চাষ দিতে পারতাম? তাইলে বোধায় আরও কিছু হবের পারতো।
রামচন্দ্র বললো, কন্ কী, কাকা, আপনে সাক্ষাৎ বলরাম।
মহিম বললো, তা ধরো যে একটু। সে মুঙ্লার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার লাঙলের মুঠিতে হাত রাখলো।
ইঙ্গিতটা বুঝে সলজ্জভাবে রামচন্দ্রও ছিদামের লাঙলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
হেদি।
মুঙ্লা, ছিদাম ও রামচন্দ্র দেখলো, সড়সড় করে জমি কাটতে কাটতে মহিম সরকারের লাঙল এগিয়ে যাচ্ছে। তখন রামচন্দ্রও বললো, হেদি। একটা ঝাঁকি দিয়ে তার লাঙলও ছুটে চললো।
মহিম সরকার বললো, বেহাই, লক্ষ্য রাখো ছাওয়ালরা না হাসে।
রামচন্দ্র বললো, কাকা, মহিম সরকার লাঙল ধরলি হাসে কেডা।
মহিম সরকার মোড় ঘুরে বললো, হয়, মিছে কও নাই, মহিম সরকার মানি এখন রামচন্দ্র। বুঝলা না, বেহাই-হেদি, ও বলদ, কথা শুনে হাসোনা; বুঝলা বেহাই, তখন মনে হতো, পৃথিমি পাই চষি। একদিন মনে হইছিলো চাদে অত জমি দেখি, চাষা দেখি না।
মহিম সরকারের দুই ছেলে এসেছিলো। তারা বললো, জামাই আর তার বন্ধুকে তখনই তাদের মা যেতে বলেছে, অত রৌদ্রে চাষ দেওয়ার দরকার নেই।
মহিম বললো, শুনছোনা, বেহাই, তোমার কাকির কথা? আমিনাকি সুবিধা পালে জামাইকে খেত-লোখা করবো, তার মেয়ের কষ্টের কারণ হবো। কও, আমি আর তুমি কি খেত-রোখা?
ছেলেদের সম্মুখে এমন আলাপ করতে সংকোচ হলো রামচন্দ্রর কিন্তু তাকে উত্তর দিতে হলো : তা হতি পারলাম কবে?
আজ চাষের দিন নয়, আনন্দের দিন। মহিম সরকার অতঃপর মুঙ্লা, ছিদাম ও রামচন্দ্রকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা হলো। তার দুই ছেলে লাঙল উল্টো করে জোয়াল চাপিয়ে বলদগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে পিছন পিছন আসতে লাগলো।
দুপুরে রামচন্দ্র ও মহিম আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ছিলো। মহিমের বড়োছেলে দুটিও যোগ দিয়েছিলো। এমন সময়ে মহিম সরকারের বড়োজামাই এলো। এ লোকটি মুঙ্লার বিয়ের সময়ে আসতে পারেনি। সে জামালপুরে রেলের কারখানায় কাজ করে। অল্পবয়সে সাধারণ শ্রমিক হয়ে রেলের কাজ নিয়েছিলো, এখন অনেকটা দূর উঠেছে। তার ছেলেমেয়েরা সকলেই ইংরেজি স্কুলে পড়ে। তার একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিলো, অনেক ব্যাপারেই মূলীভূত বিষয়টি তার চোখে যেমন পড়ে আর কারো তেমন পড়ে না।
আলাপের মাঝখানে সে বললো, মানুষ ভাবে এক, কিন্তু অন্য হয়ে যায়।
তা হয়।
অনেকে অপুত্রক অবস্থায় জামাইকে ছেলে বলে মানুষ করে কিন্তু বুড়োবয়সে ছেলেপুলে হলে জামাইকে আর আপন মনে হয় না।
এরকমও হয়। মহিম সরকার বললো, আমার ছাওয়াল আছে, জামাইকে কিন্তুক পর করি নাই।
আমার-আপনার কথা নয়। এমনকী এরকম দেখা গেছে, জামাইকে বঞ্চিত করার জন্যে পুত্রের আশায় মানুষ দ্বিতীয় বিবাহ করেছে। মানুষের অসাধ্য কী? বললো রামচন্দ্র।
আলাপটা মহিমের ভালো লাগলো না। সে এর আগের আলাপের জের টেনে বললো, তাইলে মুঙ্লা কয়দিন আমার কাছে থাকবি?
তা থাক, কাকা, আপনের কাছে ছাওয়াল বিগড়ায় না।
তাইলে, ভানুও কি থাকবি? মহিম এ প্রশ্নটা যেন ভয়ে ভয়ে উত্থাপন করলো।
রামচন্দ্র হেসে বললো, আপনের ইচ্ছা।
ভান্মতি ঘরের ভিতর থেকে শুনছিলো, সে বেরিয়ে এসে বললো, আমি কৈল চিকন্দিতে যাবো। আমার শাশুড়ি কয়ে দিছে তাড়াতাড়ি ফিরতি।
মহিমের চোখে অশ্রুবিন্দু দেখা দিলে, সে হাসতে হাসতে বললো, দেখলা, রামচন্দ্র, দেখলা।
রামচন্দ্র বিমুগ্ধ হয়ে বললো, চল, মা, চল তাই।
সন্ধ্যার দিকে মহিম সরকারের গাড়ি করে রামচন্দ্র ও ভান্মতি ফিরে চললল। রামচন্দ্রর খুশি খুশি লাগছিলো কিন্তু তার মধ্যেও কী একটা সমস্যা যেন ওত পেতে আছে। সেটা সামনে এসে স্বরূপ প্রকাশ করছে না, কিন্তু তার নিশ্বাসের, কখনো বা তার নড়াচড়ার শব্দ কানে এসে গা শিরশির করছে।
মহিমের বড়োজামাইয়ের বক্তব্যটুকু মনে পড়লো তার। রামচন্দ্র ভাবলো, আচ্ছা, সে কি আমাক লক্ষ্য করে কইছে। তা না কবের পারে, কিন্তু এমন কথা ওগরে সকলের মনে হবের পারে। ধরো, যদি ভান্মতিও মনে করে অবশেষে জোতজমা কিছুই মুঙ্লাক দিবো না? তাইলে ভান্মতির মনে সুখ থাকবি নে, তার ভালোবাসা শুকায়ে যাবি। তারপর রামচন্দ্র নিজের মনের অন্দরে প্রবেশ করে সেখানে যারা ছিলো তাদের পরিচয় নিতে লাগলো। মুঙ্লাকে জ্ঞাতসারে কোনোদিন অনাদর করেছে এমন কারো সাক্ষাৎ সেখানে পাওয়া গেলো না। নিজের ছেলে হলে ভালো হতো এমন দু-একটি ইচ্ছার সঙ্গে দেখা হলো বটে কিন্তু তারা নিতান্ত অযত্নে অপুষ্ট। রামচন্দ্র স্থির করলো এই যে নিজের মনের কথা লোকে জানুক আর না জানুক, যা করতে হবে সেটা প্রকাশ করে বলাই ভালো। তার অভাবে মুঙ্লা সম্পত্তি পাবে এটা সকলেই আন্দাজ করে, তবে সেটা সকলে জানলেই-বা কী ক্ষতি! লাভ আছে বরং। মহিমের বড়ো জামাইয়ের মতো যাদের মন তারা মুঙ্লাকে আর একটু শ্রদ্ধা করবে। তাছাড়া, ব্যবস্থাগুলি পাকাঁপোক্ত রকমে
করে গিয়ে অনেক মানুষ উত্তরাধিকারীকে ফ্যাসাদে ফেলেছে।
রামচন্দ্র বললো, ভানু, ঘুমাইছো?
না, বাবা।
সদরে যাওয়া লাগবি। ভাবি যে সম্পত্তি সব মুঙ্লার নামে লিখে দিবো।
কেন, তা দেওয়া লাগে কেন্? আমার ও বাপ তা দেয় না।
তোর বাপ বুঝি তোর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করে? তাইলে আমিও তাই করবো। জমি সব মুঙ্লাক লিখে দিবো।
তারপর সে যদি আমাক আর আপনেক তাড়ায়ে দেয়?
আমাক দিলেও দিতে পারে, তোক দিবে কেন্?
আপনেক তাড়ালে সে আমাকও হলো।
রামচন্দ্র জানে যে বয়সে স্বামী পৃথিবীর সকলের চাইতে আপন হয়, সে বয়স হলে ভান্মতির এই মত বদলাবে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত সে তার জীবন ধন্য করতে পারে।
তবু কথাটা অত সহজে ভুলবার নয়।
.
প্রায় একমাস পরে। সান্যালমশাইয়ের নায়েব গ্রামের অপেক্ষাকৃত শক্ত চাষীদের সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্রকেও ডেকে পাঠালো। সকলে সমবেত হলে নায়েব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো। বুধেডাঙায় সান্দাররা ফৌত হওয়ার দরুন কিছু খাস জমি পড়ে আছে, কিছু জমি তারা ইস্তফাও দিয়েছিলো। আর তাছাড়াও বুধেডাঙার লাগোয়া সিকস্তি এবার চাষযোগ্য হবে।তা তিনশো বিঘা হবে চাষযোগ্য সিকস্তি।পত্তনি দেওয়া হবে?না, বর্গাদারি। খাসেই থাকবে, বরং আরও খাজনা বাকি জমি খাস করা হবে। কীভাবে বর্গা হবে? হাল-বলদ বীজ যদি চাষীর হয়, তিন ভাগের দুই ভাগ চাষীর; হাল বলদ বীজ যদি রাজার হয় আধাআধি ভাগ।
রামচন্দ্রর পাশে ছিম উসখুস করে উঠলো। রামচন্দ্র চাপা স্বরে ধমক দিয়ে বললো, বোস। নায়েব আরও বিশদ করে বললো, বিল-মহল থেকে দশ ঘর লোক আনাবেন কর্তা। দাদপুর ভাঙছে নদীতে, তাদেরও প্রায় দশ বারো ঘর আসবে। এখন তোমাদের মধ্যে কারা জমি নেবে স্থির করে এসে জানাবে। পরে যেন বলল না–রাজা তোমাদের না জানিয়ে অন্যায় করেছেন।
কৃষকদের মধ্যে পরিপকরা যখন ইতিকর্তব্যতার চিন্তায় ব্যস্ত, বুধেভাঙার পাঁচ-ছয়জন সান্দার যেখানে মুখনীচু করে বসেছিলো তার মধ্যে থেকে হঠাৎ একটি অপরিচিত লোক উঠে দাঁড়ালো। আঠারো-উনিশ বছর বয়স হবে তার। সে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ধপ করে বসে পড়লো।
নায়েব বললো, তুমি কে, কিছু বলবে?
লোকটি আবার উঠে দাঁড়ালো। ঘরের একটা থাম হাতের কাছে পেয়ে সেটাকে অবলম্বন করে কিছু সাহস পেলো। বললো, জে, ইজু।
ইজু কে?
জে, ইজু সান্দার।
তা না হয় বুঝলাম। কার ছেলে তুমি? বাপ বড় বাপের নাম বলো।
লোকটি মুখ চৈত্রের ঝলসানোনতুন আমপাতার মতো ঝরে গেলো। সে বললো, ইয়াকুব সান্দার আমার ধর্মবাপ। কও না, আজা, লোকজনের মধ্যে আমাকে বেহাল করো কেন। তখন রজব আলি উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, নায়েবকে নয়, রামচন্দ্রকে লক্ষ্য করে, বুঝলেন না মোণ্ডল, আমার কাছেই থাকে ও। ইয়াকুবের ছাওয়াল। আমার সেই ইয়াকুব, তার।
তোমরা জমি চাও? কিন্তু রজব আলি, তোমার পত্তনিটুকুও তো তুমি ইস্তফা দিয়েছে।
জে।
বর্গা চষতে পারবে?
জে।
কতটুকু চাও?
ক, ইজু, ক’ বলে রজব আলি ইয়াজকে আবার তুলে দিলো।
ইয়াজ বললো, জে, বেশি চাই না। একা একা দুইজন আমরা, লাতি আর আজা। দশ বিঘা কি পনরো, জলের ধার ঘেঁষে দেন।
হাল বলদ নেই তো? পাঁচ পাবে। তা বেশ, পরে এসে টিপসই দিয়ে কাগজ কলম ঠিক করে নিয়ে। কিন্তু, রামচন্দ্র, তুমি কিছু বলছে না?
অধম আর কী বলবি। গোঁফ চুমরে রামচন্দ্র মাথা নোয়ালো।
ছিদাম ফিসফিস করে বললো, জ্যাঠা, রজব আলি তার লাতির জন্য কয়,কও জ্যাঠা, আমার জন্যে আমি কবো?
ক এবার।
ছিদাম বললো, হুজুর—
তুমি কেষ্টদাসের ছেলে না?
আঁগে।
তুমি জমি চাও?
আঁগে।
কতটা পারবে?
আঁগে, ষাট কি সত্ত্বর বিঘা।
দূর পালা! এ কি গান বাঁধা?
ছিদামের কান লাল হয়ে উঠলো। সে বললো, আঁগে, যদি না পারি প্রাণ দিবো।
তুমি কি চাকর রেখে জমি চষতে পারবে, এমন মূলধন আছে? হাল-বলদ আছে?
একটু পাবো না জমি? ছিদামের দু চোখ জলে ভরে এলো।
পাঁচ-দশ যা হয় দিতে পারি যদি রামচন্দ্র তোমার হয়ে কথা দেয়। এখন সকলে চিন্তা করো, পাগলের মতো কথা বলো না। কিন্তু রামচন্দ্র, কর্তা তোমার জন্যে বিশেষ করে কিছু জমি দেগে রেখেছেন একলপ্তে ত্রিশ বিঘা।
রামচন্দ্র বললো, আজ্ঞা।
কোথায় তা বুঝতে পেরেছো? সিঙ্গী জমিদারের সীমানা সামিল।
আজ্ঞা, বুঝলাম।
ভয় পাও নাকি?
আজ্ঞা, রাজার হুকুম হলে লাঙলও ধরতে হবি।
আচ্ছা, তাহলে এখন তোমরা যাও। সাতদিন পরে আবার হাটবারে এসো।
সকলে চলে গেলে রামচন্দ্র বললো, নায়েবমশা–
বলো। আরও চাও বুঝি জমি? দাদপুরের দশ-বারো ঘর প্রজার ঘরদোর জমিজিরাত পদ্মায় গিয়েছে। তাদের জন্যও জমি রাখতে হবে তো। আর বিলমহলের তাতীরাকর্তার খাতিরের লোক তাও জানো।তবে তোমার জন্যে যে জমির কথা বললাম, একলপ্তে অত বড়ো জমি আর কোথাও নেই। সেটেলমেন্টের দাগি নিয়ে যা গণ্ডগোল।
আজ্ঞা পরে আপনেক কবো। একটা কথা আপনেক জিজ্ঞাস করবার চাই। সামাইন্য কথা। ধরেন যে আমার ঘরবাড়ি যদি কারো নামে লিখে দিই তাইলে সে কি আমাক তাড়ায়ে দিবের পারে?
তা তো পারেই।
রামচন্দ্র একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, আপনে উকিল পাস। কন, এমন কী উপায় আছে যে জমি আমারই থাকবি কিন্তুক আমার অভাবে আর একজন হার হবি কিন্তু আমার পোষ্যদের অযত্ন করবি নে।
তা আছে। তাকে উইল বলে।
উইল? সে কাগজ লেখা যায়?
তা যায়। কিন্তু উইল করার মত বুড়ো তুমি হওনি। আর তাছাড়া তোমাদের পরিবারের হক নিয়ে গোল হবার কারণ দেখি না।
না, গোল আর কী।
কাছারি থেকে বেরিয়ে রামচন্দ্র স্থির করলো সদরে গিয়ে তার উকিলকে দিয়ে উইল লিখিয়ে নেবে।
রামচন্দ্র চলে গেলে নায়েব চিন্তা করলোলোকটার এমন হঠাৎ পরিবর্তন হলো কেন? এমন চপলমতি নয় যে জমির কথা শোনামাত্রই মাথা খারাপ করে হৈচৈ শুরু করবে। কিন্তু ধীরে সুস্থে হলেও জমি নেওয়া সম্বন্ধে তার মতো চরিত্রের লোকের কাছে নির্দিষ্ট একটা প্রস্তাব আশা করা গিয়েছিলো। এমন সুযোগ প্রতি বৎসর আসে না।