২৭. মুখের চেহারা এখন স্বাভাবিক

সাতাশ

মানুষটির মুখের চেহারা এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। চেতনা ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝেই সে সেটা জানান দিচ্ছে। বৃদ্ধ ডাক্তার এরকম সময়ে সমানে কথা বলে যান। যন্ত্রণা এড়াতে ঘুমের ওষুধ যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করার পক্ষপাতী তিনি, অন্তত এই পর্যায়ে। পেশেন্ট নিজে শক্তি অর্জন করুক। মানসিক জোর অসুস্থতাকে দ্রুত সারিয়ে ফেলে। আজ বৃদ্ধ ডাক্তারের পাশে স্বজন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দিয়ে এরা যেটা করাতে চাইছে সেটা করতে গেলে পেশেন্টকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে। আকাশলালকে সেই অবস্থায় পেতে গেলে এখনও দিন দশেক অপেক্ষা করতে হবে তাকে এবং সেটা আর সম্ভব নয়।

পৃথার পক্ষে আর এই বন্দি জীবনে থাকা সম্ভব নয়। বেচারার সহ্যশক্তি এখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। বই পড়ে এবং টেলিভিশন দেখে কোনও মানুষ দিনের পর দিন একটি ঘরে কাটিয়ে দিতে পারে না। এখন নিজেদের সম্পর্কটাও আগের মতো স্বাভাবিক নয়। একই ঘরে পাশাপাশি থেকেও পৃথা তাকে আদর করার কথা খেয়ালই করতে পারছে না। যে পৃথার শরীরের প্রতি স্বজনের যে টান এতদিন টানটান ছিল তাও যেন কোথায় হারিয়ে গেল। দুটো মানুষ একটা ঘরে প্রায় পুতুলের মতো বেঁচে থাকার জন্যে বেঁচে আছে।

পৃথা পালাতে চেয়েছিল। স্বজন উদ্যোগ নেয়নি। এই বাড়ি থেকে যদি বা কোনও মতে পালানো যায়, এই শহর থেকে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। টিভিতে বলছে শহরে কারফিউ চলছে। রাস্তাঘাটে একটাও মানুষ নেই, যানবাহন নেই। মাত্র দু’ঘণ্টার জন্যে যখন কারফিউ তুলে নেওয়া হচ্ছে আজ থেকে কিন্তু সেই সময়টায় কতদূরে যাওয়া সম্ভব? পুলিশ তো তাদের ইতিমধ্যেই এদের লোক বলে ধরে নিয়েছে। অতএব এদের সাহায্য ছাড়া শহর ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন, ‘আর কোনও বিপদ নেই। ব্লাড প্রেশার প্রায় নর্মাল, পাল্‌সও ঠিক আছে। কয়েকদিনের বিশ্রামে উন্ড ঠিক হয়ে যাবে। আমার আর থাকার কোনও প্রয়োজন নেই।

‘আপনারা একসঙ্গে যাবেন।’ নিচু স্বরে পাশে দাঁড়ানো ত্রিভুবন কথা বলল।

‘একসঙ্গে মানে?’

‘পুলিশের চোখ এড়িয়ে ওঁকেও বাইরে যেতে হবে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের পক্ষে বার বার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’

‘কি বুঝব? আমি সব কিছু বোঝাবুঝির বাইরে।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ‘দেশের বাইরে গিয়ে আমি কি করব? কোথায় যাব? না, না, পুলিশ আমাকে কিছু করবে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব কিছুদিন বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ইন্ডিয়ায় যেতে গেলে তো ভিসা লাগে না।’

ত্রিভুবন বলল, ‘এসব আলোচনা আমরা এ ঘরের বাইরে গিয়ে করতে পারি।’

এই সময় আকাশলাল চোখ খুলল। ওর মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। বৃদ্ধ ডাক্তার ঝুঁকে পড়লেন, ‘ইয়েস মাই বয়, ইউ আর অলরাইট। এনি প্রবলেম?’

আকাশলালের ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হল, ‘মাথা-মাথার-উঃ।’

‘মাথার ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছে? হুম্‌। আমি ওষুধ দিচ্ছি। ইট উইল বি অল রাইট!’

স্বজন জিজ্ঞাসা করল, ‘মাথায় যন্ত্রণা কেন?’

বৃদ্ধ ডাক্তার ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘এটা হওয়াই স্বাভাবিক।’

ত্রিভুবন সন্ত্রস্ত হল। স্বজন কোনও কিছুই জানে না। আকাশলালের শরীরে কেন দু-দুবার অপারেশন করা হয়েছে সে কথা ওকে বলার দরকার নেই। সে বৃদ্ধ ডাক্তারকে বলল, ‘ওঁকে ওষুধ দিন, কথা বলবেন না।’

‘কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেব না এমন শিক্ষা আমার নেই।’ বৃদ্ধ ডাক্তার জবাব দিলেন।

‘আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন।’ ত্রিভুবন গম্ভীর গলায় বলল।

বৃদ্ধ ডাক্তার এবার আকাশলালের দিকে মন দিলেন। আর একটা ইনজেকশন যেন বাধ্য হয়েই দিতে হল তাঁকে। ত্রিভুবন ওদের নিয়ে পাশের ঘরে ফিরে এসে দেখল হায়দার সেখানে অপেক্ষা করছে। হায়দার জিজ্ঞাসা করল, ‘ইমপ্রুভমেন্ট কতখানি?’

বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন, ‘অনেকটা। যা আশা করেছিলাম তার থেকে অনেক ভাল।’

ত্রিভুবন বলল, ‘কিন্তু এখনও সেন্স পুরো আসেনি।’

বৃদ্ধ ডাক্তার ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘কি রকম? একটা মানুষ তার শরীরের যন্ত্রণার কথা জানিয়ে দিচ্ছে এটা আপনার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না?’

‘আমি কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম, চিনতেই পারল না।’

‘আপনি কি মনে করেন অপারেশনের দুদিন পরে পেশেন্ট ফুটবল খেলবে?’

হায়দার জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিক আছে। উনি হেঁটে চলে বেড়াবার মতো সুস্থ কতদিনে হবেন?’

‘ওর শরীরের কন্ডিশনের ওপর সেটা নির্ভর করছে। এখন যেরকম অবস্থা তাতে দিন চারেক যথেষ্ট। এই সময় মাথার যন্ত্রণা হতে পারে, একটু জ্বর আসতে পারে। আমার ভয় ছিল ওর লাংসে জল জমে যেতে পারত। জমেনি। ওটা ঠিক আছে। ইনফ্যাক্ট এখন রুটিন চেক-আপ, নির্দিষ্ট ওষুধ আর পথ্য হলেই চলবে। আমার থাকার দরকার নেই।’ বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন।

ত্রিভুবন বলল, ‘উনি হেঁটে চলে বেড়ানো পর্যন্ত আপনি থাকবেন। আসুন আমার সঙ্গে।’

বৃদ্ধ ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকালেন। বিড়বিড় করতে করতে তিনি ত্রিভুবনকে অনুসরণ করলেন।

‘অপারেশন করতে হয়েছিল কেন?’ স্বজন জিজ্ঞাসা করল।

ওঁর হার্টের প্রবলেম ছিল।’ হায়দার তাকাল স্বজনের দিকে, ‘আমি খুবই দুঃখিত আপনাদের এভাবে থাকতে হচ্ছে বলে। কিন্তু আরও চার-পাঁচদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।’

‘আছে। আমি আগামী কাল অপারেশন করতে চাই।’

‘সে কী! এই অবস্থায়?’

‘দেখুন দুটো কারণের কথা আমি বলব। প্রথমটা হল, পেশেন্ট এখন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তার শরীর যন্ত্রণা পাচ্ছে। এই অবস্থায় আমার কাজ বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো ব্যাপার হবে। বাড়তি কষ্টটুকু পেশেন্ট টের পাবে না। সুস্থ স্টেজে ফিরে যাওয়ার পরেই আবার ওঁকে অসুস্থ করে তোলা অর্থহীন। আর দ্বিতীয়ত, আমার স্ত্রী এখানে আর দুটো দিন থাকলে পাগল হয়ে যাবেন। বুঝতেই পারছেন আমি সেটা চাই না।’

‘দেখুন ডাক্তার, আপনার সিনিয়ার আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনার ওপর আমরা ভরসা করছি। কিসে পেশেন্টের ক্ষতি হবে না তা আপনিই ভাল জানেন।’

‘নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা কথা— !’

‘বলুন।’

‘আমি যখন এসেছিলাম তখন উনি অসুস্থ ছিলেন। দেখে মনে হয়েছিল একটা বড় ধকল সামলে উনি তখন আরোগ্যের পথে। এরই মধ্যে আবার অপারেশন করতে হল কেন?’

‘প্রথম অপারেশন সম্পূর্ণ সফল হয়নি বলে দ্বিতীয়বার করা প্রয়োজন হয়েছিল।’

স্বজন কাঁধ নাচাল, ‘ঠিক আছে। আমি আগামী কাল সকালে কাজ শুরু করব। আমার যা যা প্রয়োজন আমি ওই ভদ্রলোককে তার একটা লিস্ট দিয়েছি বাকিটা আমার সঙ্গেই আছে। কালকের দিনটা আমি দেখতে চাই। কিন্তু পরশু আমি ফিরে যাবই।’

হায়দার বলল, ‘আপনি যদি বলেন অপারেশন সাকসেকফুল তা হলে আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা হবে।’

‘আমি তো মিথ্যেও বলতে পারি।’ স্বজন হাসল।

‘তাহলে আপনি নির্বাচিত হতেন না।’

ঘরে ফিরে এসে স্বজন দেখল পৃথা বিছানায় কুঁকড়ে পড়ে আছে। ওর মুখ বালিশে ডোবানো। পৃথা যে ঘুমোচ্ছে না তা স্বজন জানে। ওর নার্ভের যা অবস্থা তাতে ঘুম আসা সম্ভব নয়। সে বলল, ‘পৃথা, আমরা পরশু কলকাতায় ফিরছি।’

কথাটা শেষ হতেই পৃথা চমকে মুখ তুলল। তারপর লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটে এসে স্বজনকে জড়িয়ে ধরল। এবং তারপরেই ফোঁপানি শুনতে পেল স্বজন, ‘সত্যি বলছ, বলো, সত্যি তো?’

স্বজন ওকে জড়িয়ে ধরল, ‘একদম সত্যি।’ সে পৃথার শরীরের কাঁপুনি টের পাচ্ছিল। গত কয়েকদিনে পৃথা তাকে একবারও আলিঙ্গন করেনি। আজ এই অবস্থায় স্বজনের শরীরে বিদ্যুৎ এল। পৃথা বলল, ‘কাল নয় কেন?’ ওর মুখ স্বজনের বুকে চেপে রয়েছে।

‘কাল সকালে অপারেশন করব। ডাক্তার হিসেবে চব্বিশ ঘণ্টা আমার অপেক্ষা করা উচিত।’

‘ঠিক বলছ তো?’ পৃথা মুখ তুলল। ওর দুই চোখে জল, কিন্তু ওই জলে আনন্দ আছে।

‘হ্যাঁগো।’ স্বজন মুখ নামাল।

শুকনো তপ্ত ঠোঁটে ঠোঁট নেমে আসামাত্র ঝড় উঠল। এতদিনের কষ্ট, অভিমান, ক্রোধ মুছে গেল আচমকা। বিশ্বচরাচর বিস্মৃত হয়ে গেল আচম্বিতে। দুটো শরীর কিছুক্ষণ পৃথিবীর যাবতীয় ঝড় একত্রিত করে চুরমার হতে লাগল। তারপর বিছানায় পাশাপাশি নিথর হয়ে শুয়ে রইল ওরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে। একসময় পৃথা বলল, ‘পরশু কখন যাব?’

‘কারফিউ থাকলে যে-সময়টা শিথিল হয় সেই সময়ে।’

‘এখান থেকে সোজা কলকাতায় তো?’

‘একদম সোজা।’

পৃথা নিঃশ্বাস ফেলল। স্বস্তির নিঃশ্বাস। স্বজন পাশ ফিরল। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে ওকে অনেকটা স্বাভাবিক ঠেকছে। সে ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

হঠাৎ পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকটা খুব গম্ভীর ধরনের?’

‘কোন লোকটা?’

‘আকাশলাল?’

‘হ্যাঁ, ব্যক্তিত্ব আছে।’

‘ও কী হতে চায়?’

‘কী হতে চায় মানে?’

‘মুখের চেহারা কী রকম করতে চাইছে?’

কিছু বলেনি। ও ওর মুখাবয়ব পাল্টাতে চাইছে।’

পৃথা উঠল। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ কলম বের করে কীসব আঁকল মন দিয়ে। ওকে দেখছিল স্বজন। এতক্ষণে মেয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছে।

‘কী করছ?’

‘বিরক্ত কোরো না।’ কপট গাম্ভীর্য পৃথার মুখে।

স্বজন অপেক্ষা করল। কাগজটা নিয়ে পৃথাই চলে এল কাছে, ‘লোকটার মুখ এইরকম করা নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়!’

স্বজন হো হো করে হাসল, ‘এ তো হিটলারের মুখ।’

‘ও তো তাই। জোর করে আমাদের আটকে রেখেছে।’

‘তা বলতে পার, হিটলারি কায়দায়, কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। আকাশলাল তার দেশকে স্বৈরতন্ত্র থেকে উদ্ধার করতে চায়, জনসাধারণকে তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে চায়। নিজের নিরাপত্তা ঠিক রাখতেই ও আমাদের আটকে রাখতে বাধ্য হয়েছে।’

‘বাধ্য হয়েছে!’ তেতো গলায় বলল পৃথা, আমরা যদি টুরিস্ট লজে থাকতাম, নিজেরা ঘুরে বেড়াতাম আর ঠিক কাজের সময় তোমায় যদি ডেকে আনত, তাহলে কী অসুবিধে হত?’

‘সেটা বলতে পার। কিন্তু কারফিউ-এর মধ্যে কোথাও যেতে পারতে না তুমি।’ বলেই হেসে ফেলল স্বজন, ‘তুমি তিনদিন টিভি খুলতে দাওনি। পৃথিবীতে কী হচ্ছে আমি জানি না। এখন কি ম্যাডামের অনুমতি পেতে পারি?’

পৃথাও হাসল। তারপর উঠে গিয়ে রিমোট এনে টিভি চালু করল। সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় একটি রাজপথের ছবি ফুটে উঠল। ঘোষকের গলা শোনা গেল, ‘সন্ত্রাসবাদীরা শহরের রাজপথের নীচে গোপনে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল কবরখানায় পৌঁছানোর জন্যে। এই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে ঠিক কতদিন সময় লেগেছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করছেন। সুড়ঙ্গের মধ্যে যারা আটকেছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ অনেক গোপন তথ্য জানতে পেরেছে। পুলিশ কমিশনার মিস্টার ভার্গিস বলেছেন, ওই সব তথ্য পাওয়ার পর সন্ত্রাসবাদীদের ধ্বংস করতে বেশি সময় লাগবে না।

টিভিতে সুড়ঙ্গের ছবি ভেসে উঠল এবং সেইসঙ্গে কবরখানার। ঘোষকের গলা শোনা গেল, ‘আকাশলালের মৃতদেহ কবর দেওয়ার পর তাকে অপহরণ করার মধ্যে যে রহস্য রয়েছে তা পুলিশ মহল উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। আকাশলালের সহকারী ডেভিডের মৃত্যু না হলে পুলিশ এতদিনে আরও তথ্য জানতে পারতেন। গত রাত্রে ওয়াশিংটনে এক বোমা বিস্ফোরণে তিনজন মানুষ নিহত হয়েছেন। সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছেন— ।’ টিভি বন্ধ করে দিল পৃথা।

স্তম্ভিত স্বজন স্ত্রীর দিকে তাকাল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

পৃথা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আকাশলালের মৃতদেহের কথা বলল কী করে?’

‘শুনলাম। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না পৃথা। টিভিতে সুড়ঙ্গ দেখাল, আকাশলালের মৃতদেহ চুরি করার জন্যে সুড়ঙ্গ হয়েছে বলল অথচ— ।’ ওকে রীতিমত বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

‘তুমি নিজের চোখে একটু আগে আকাশলালকে দেখে এসেছ?’

‘নিশ্চয়ই। কাল সকালে লোকটাকে অপারেট করব।’

পৃথা মাথা নাড়ল, ‘তাহলে এটা পুলিশি অপপ্রচার। আকাশলাল মারা গিয়েছে বলে পাবলিককে বুঝিয়ে বোকা বানাতে চাইছে।’

‘আমার তা মনে হয় না।’

‘মনে হয় না?’

‘না। পুলিশ সত্যি মনে করছে আকাশলালের মৃতদেহ চুরি হয়ে গেছে। পুলিশের পক্ষে সবার নজর এড়িয়ে রাস্তার নীচে দিনের পর দিন ধরে সুড়ঙ্গ খোঁড়া সম্ভব নয়।’

‘তাহলে তুমি কাকে দেখে এলে?’

‘আমার কি দেখতে ভুল হয়েছে?’ বিড় বিড় করল স্বজন, ‘শুয়ে থাকলে মানুষের চেহারা অবশ্য একটু অন্যরকম দেখায়। নাঃ, এত বড় ভুল হবে না।’

‘আশ্চর্য! ডেডবডি কবর থেকে উঠে এখানে শুয়ে থাকবে কী করে?’

‘যদি ডেডবডি না হয়? যদি জীবিত অবস্থায় ওকে কবর দেওয়া হয়?’

‘তুমি কি পাগল? পুলিশ ওকে জীবিত অবস্থায় কবর দেবে কেন?’

‘পুলিশ যদি মৃত বলে ভুল করে থাকে?’

‘উল্টোপাল্টা বলছ। পুলিশের ডাক্তার নেই? ডাক্তার মৃত বা জীবিত বুঝবে না!’

‘নিশ্চয়ই বুঝবে। কিন্তু বুঝেসুঝেই যদি করে থাকে! পুলিশের ডাক্তার তো এদের লোক হতে পারে। পারে না? আকাশলাল জানত এভাবেই বেরিয়ে আসবে, তাই আগে থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়িয়ে রেখেছিল। মৃত্যুটা একটা ভাঁওতা। ওপরে যে লোকটা শুয়ে আছে তার ওপর দু-তিন দিন আগে একটা বড় অপারেশন হয়েছে। আমাকে বলা হল হার্টের ব্যাপার। যা অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখলাম তা বড় নার্সিংহোমের ভাল অপারেশন থিয়েটারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আমি বুঝতে পারছি না পৃথা। মৃত বা অর্ধমৃত কোনও মানুষকে কবরে শুইয়ে আবার তুলে এনে বাঁচানো আমার জ্ঞানে সম্ভব নয়। অথচ লোকটা বেঁচে আছে।’

পৃথা স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখল, ‘তুমি এ নিয়ে ভাবছ কেন? পরশুর পর তো আমরা এখানে থাকছি না। কাল তোমার কাজটুকু ঠিকঠাক করে দাও।’

টেলিফোন বাজল। ভার্গিস রিসিভার তুলে শুনলেন, ‘স্যার প্রধান বাস টার্মিনাসে একটু আগে বোমা ফেটেছে। আমাদের একটা জিপ আর দুজন কনস্টেবল প্রচণ্ড আহত হয়েছে।’

‘বোমাটা ছুঁড়ল কে?’

‘ধরতে পারা যায়নি। একটু আগে কারফিউ শিথিল হওয়ায় রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল।’

‘সার্চ পার্টি পৌঁছে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। এর এক মিনিট বাদেই ভিক্টোরিয়া সিনেমা হলের সামনে আর একটি পুলিশের ভ্যান আক্রান্ত হয়। সেখানেও আড়াল থেকে বোমা ছোঁড়া হয়েছে। কর্তব্যরত সার্জেন্ট গুলি চালালে একজন পথচারী নিহত হয়েছেন।’

‘পথচারী বলবেন না, টেররিস্ট বলে ঘোষণা করুন।’

‘এইমাত্র আর একটি ইনসিডেন্টের খবর এসেছে স্যার। বারো নম্বর রাস্তার মোড়ে এবার গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। হ্যাঁ স্যার, গ্রেনেড। একটা পুলিশ ভ্যান বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ছজন পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবল স্পট ডেড।’

দাঁতে দাঁত চাপলেন ভার্গিস, ‘ওরা হঠাৎ এটা শুরু করল কেন?’

‘স্যার, দুজন লোক টেলিফোন করে বলেছে ওরা ডেভিডের হত্যার বদলা নিচ্ছে।’

‘কারফিউ ইমপোজ করুন। ইমিডিয়েটলি। নো মোর রিল্যাক্সসেসন। রাস্তায় যাকে দেখা যাবে তাকেই গুলি করে মারা হবে।’ রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ভার্গিস। তাঁকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। লোকগুলো এবার মরিয়া হয়ে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে। ভয় দেখিয়ে কেউ তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ডেভিডের হত্যার বদলা? দরকার হলে ওর মৃতদেহ মেলার মাঠে ঝুলিয়ে রাখবেন তিনি। পচে পচে খসে না যাওয়া পর্যন্ত পাবলিক দেখুক। হঠাৎ সেই মেয়ে রিপোর্টারের কথা মনে পড়ল ভার্গিসের। ইন্টারকমে আদেশ দিলেন তাকে তাঁর ঘরে নিয়ে আসার জন্যে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভার্গিস অনীকাকে তাঁর সামনে দেখতে পেলেন। ততক্ষণে চুরুট ধরিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেই অবস্থায় বললেন, ‘আপনার বন্ধুরা বোমা ছুঁড়ছে, গ্রেনেড ছুঁড়ছে। এর বদলে আমাকে কিছু তো করতে হয়!’

‘আমার কোনও বন্ধু এখানে নেই।’

‘আলবত আছে। তারাই আপনাকে পাঠিয়েছিল। ডেভিডের সৎকারের জন্যে। আমি সেটা অ্যালাউ না করতে ওরা পুলিশ মারছে।’

‘এসব কথা অনর্থক আমাকে বলছেন!’

‘শুনুন মিস, বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই। কে আপনাকে পাঠিয়েছে?’

‘যে লোকটি আমাকে অনুরোধ করেছিল তাকে আমি চিনি না।’

‘আমি এখনও আপনার সম্মান বজায় রেখেছি। আমি যদি হুকুম দিই তাহলে আমার লোকজন আপনাকে মার্সিলেসলি রেপ করতে পারলে খুশি হবে।’

‘আমি জানি না কোনও রেপ মার্সি-সহকারে করা সম্ভব কিনা।’

‘ওঃ, আপনার কি ভয় বলে কিছু নেই?’

‘নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি, আপনি আপনার লোকদের দিয়ে ওই কাজটা করাবেন কেন? আমি কি এতই সাবস্ট্যান্ডার্ড?’

এমন সংলাপ জীবনে কখনও শোনেননি ভার্গিস। তাঁর চোয়াল ঝুলে গেল। তিনি কোনও মতে বলতে পারলেন, ‘বসুন।’

অনীকা বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কি এক কাপ ভাল কফি পেতে পারি?’

ভার্গিস মাথা নাড়লেন, ‘না। আপনি কিছুই পেতে পারেন না। ডেভিডের সৎকারের অধিকার যদি আপনাকে দিই তাহলে শহরে গোলমাল থেমে যাবে?’

‘বলতে পারছি না। কারণ কারা গোলমাল করছে আমি জানি না।’

‘ওয়েল! আপনি প্রথমবার কবরখানায় কেন গিয়েছিলেন?’

‘আকাশলালের মৃত্যুর খবর আমাকে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল ওর পারিবারিক কবরখানায় আগাম গিয়ে সৎকারের খবর নিয়ে আসি।’

‘হুম’! ‘দ্বিতীয়বার গেলেন কেন?’

‘আমার সন্দেহ হয়েছিল কোথাও কোনও গোলমাল হয়েছে।’

‘কী গোলমাল?’

‘ওর মৃত্যুটা আমার কাছে স্বাভাবিক নয়!’

‘ডাক্তার সেই সার্টিফিকেট দিয়েছে।’

‘হতে পারে। কিন্তু আমি একজন মানুষকে মাটিতে কান পেতে কিছু শুনতে দেখেছিলাম। পরে সুড়ঙ্গের খবরটা পাই। সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল আকাশলালের শরীর কবর থেকে তোলা হবে বলেই। অর্থাৎ আকাশলাল জীবিত অবস্থায় সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরিকল্পনা করেছিল। কারণ সে জানত আপনার এখানে পৌঁছে সে মারা যাবে অথবা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হবে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না।’

ঠিক তখনই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলতেই ডেস্ক থেকে তাঁকে জানানো হল মিনিস্টার তাঁকে এখনই দেখা করতে বলেছেন। এই প্রথম মিনিস্টার তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বললেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *