মিসেস গাঙ্গুলী রেডি হয়েই বসে আছেন। এক ঘণ্টা ধরে সমস্ত দেহে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চুনকাম করেছেন। নাক, চোখ, কপাল, ঠোঁট, কাঁধ, গ্রীবা থেকে আরম্ভ করে হাতের নখ, এমন কি পায়ের পাতায় প্রসাধনের সযত্ন প্রলেপ নজরে আসছে। নটবর মিত্তির রসিকতা করলেন, “আপনাকে চেনাই যাচ্ছে না—দুগ্গা ঠাকরুণ মনে হচ্ছে।”
বেশ খুশী হলেন মিসেস গাঙ্গুলী। বললেন, “গোয়েঙ্কা তো, তাই এরকম সাজলাম। ওরা একটু ঝলমলে জামাকাপড় পছন্দ করে, চড়া রুজ ওদের খুব ভালো লাগে। কিন্তু লিপস্টিক সম্বন্ধে ওদের খুব ভয়—পাঞ্জাবিতে বা গেঞ্জিতে লাগলে অনেক লিপস্টিকের রং উঠতেই চায় না। বাড়িতে বউ-এর কাছে ধরা পড়ে যাবার রিস্ক থাকে।”
মিসেস গাঙ্গুলী এবার সিগারেট ধরালেন। সামান্য একটু ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “কাস্টমারের সামনে আমি কিন্তু স্মোক, করি না। তাই এখন একটা খেয়ে নিচ্ছি।”
“একটা কেন, দশটা সিগারেট খেতে পারেন আপনি—হাতে যথেষ্ট সময় আছে,” নটবর মিত্র বললেন।
সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে, কমনীয় অথচ অটট দেহখানি ঈষৎ দুলিয়ে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “দুশো টাকায় আর চলে না মিত্তির মশাই। জিনিসপত্রের দাম যেরকম বাড়ছে, একবার সাজগোজেই উনিশ-কুড়ি টাকা খরচ হয়ে যায়। এই কাপড় কাচতেই পাঁচ টাকা নিয়ে নেবে—আমি আবার যে কাপড় পরে একবার কাজে বেরিয়েছি তা দুবার পরতে পারি না, ঘেন্না করে। তাছাড়া দামী ল্যাভেন্ডার পাউডার এবং স্যাচেট সেন্ট আমি ব্যাগের মধ্যে নিয়ে যাই। এক-একজন কাস্টমারের গায়ে যা ঘামের গন্ধ! আধ কৌটো পাউডার মাখাবার পরেও দুর্গন্ধে বমি ঠেলে আসে।”
“আপনার কাজের দাম কী আর টাকায় দেওয়া যায়? বিনয়ে বিগলিত নটবর উত্তর দিলেন। “হাই-লেভেলের লোকদের আপনার মতো আপ্যায়ন করতে কে পারবে?”
“তা আপনাদের আশীর্বাদে অনেক বাঘ-সিংহকে বশ করে পায়ের কাছে লুটোপুটি খাইয়েছি!” বেশ গর্বের সঙ্গেই উত্তর দিলেন মিসেস গাঙ্গুলী। “পোষ মানাতে না পারলে আপনারাই বা পয়সা ঢালবেন কেন? একটা কিছু, উদ্দেশ্য আছে বলেই তো পার্টির বিছানায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন।”
“আপনি তো সবই বোঝেন মিসেস গাঙ্গুলী। বিলেত-আমেরিকা হলে আপনার মতো স্পেশালিস্ট লাখ লাখ টাকা রোজগার করতেন,” বললেন নটবর মিত্র।
নাকের ডগায় পাউডার ঘষতে ঘষতে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “গোয়েঙ্কার কাছ থেকে কোনো খবর-টবর বার করবার থাকলে এখনই বলে দিন। তাহলে ভালো করে মদ-টদ খাওয়াবো।”
হেঁ-হেঁ করে হাসলেন নটবর। “কোনোরকম বিজনেস নেই। স্রেফ সৌজন্যের জন্যে আপ্যায়ন। মিস্টার গোয়েঙ্কা পুরোপুরি স্যাটিসফ্যাকশন পেলেই আমরা খুশী।”
“ফলেন পরিচিয়তে! পনেরো দিনের মধ্যে আমাকে আবার নিয়ে যাবার জন্যে গোয়েঙ্কা যদি আপনাদের ব্যতিব্যস্ত না করে তাহলে আমার নামে কুকুর রাখবেন,” এই বলে মিসেস মলিনা গাঙ্গুলী সোফা ছেড়ে উঠলেন।
এবার বিরাট এক কাঁচের গেলাসে ডাবের জল খেলেন মিসেস গাঙ্গুলী। বললেন, “আপনাদের দিতে পারলাম না—ঠিক দুটো ডাব ছিল। এটা আমাদের লাইনে ওষুধের মতো। শরীর বাঁচাবার জন্যে কাজে বেরোবার ঠিক আগে খেতে হয়।”
বেরোবার মুখেই কিন্তু গণ্ডগোল হলো। মিসেস গাঙ্গুলীর স্বামী ফিরলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে পথে কোথাও মদ খেয়ে এসেছেন। মুখে ভকভক করে গন্ধ ছাড়ছে।
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?” বেশ বিরক্তভাবে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। মিসেস গাঙ্গুলীর হাসি কোথায় মিলিয়ে গেলো। বললেন, “কাজে। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
ভদ্রলোক নেশার ঝোঁকে বললেন, “তোমাকে এতো ধকল সইতে আমি দেবো না, মলিনা। পর পর তিনদিন বেরোতে হয়েছে তোমাকে! আগামীকাল মিস্টার আগরওয়ালা তোমাকে নিতে আসবেন।”
মিসেস গাঙ্গুলী স্বামীকে সামলাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভদ্রলোক রেগে উঠলেন। “শালারা ভেবেছে কী? পয়সা দেয় বলে তোমার ওপর যা খুশী অত্যাচার করবে? কালকে তোমায় রাত দেড়টার সময় ফেরত পাঠিয়েছে। আমি তোমার স্বামী–আমি হুকুম করছি, আজ তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে।”
বিব্রত মিসেস গাঙ্গুলী মত্ত স্বামীকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলেন। বললেন, “এদের কথা দিয়েছি—এরা অসুবিধেয় পড়ে যাবেন।”
রক্তচক্ষু মিস্টার গাঙ্গুলী একবার সোমনাথ ও আরেকবার নটবরবাবুর দিকে তাকালেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেয়ে স্ত্রীকে বললেন, “আমি তো ফরেন হইস্কি ছেড়ে দিশী খাচ্ছি। মলিনা। অত টাকা তোমায় রোজগার করতে হবে না।”
অপারগ মিসেস গাঙ্গুলী অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। ক্ষমা চেয়ে বললেন, “আমাকে ভুল বুঝবেন না। ওর মাথায় যখন ভূত চেপেছে তখন ছাড়বে না। এখন যদি আপনাদের সঙ্গে বেরোই—বাড়ি ফিরে দেখবো সব ভেঙ্গে-চুরে ফেলেছে। কী হাঙ্গামা বলুন তো—এসব রটে গেলে আমার যে কী সর্বনাশ হবে ভেবে দ্যাখে না।”
সোমনাথ স্তম্ভিত। জেনেশুনে স্বামী এইভাবে বউকে ব্যবসায় নামিয়েছে। আর সোমনাথ তুমি কোথায় যাচ্ছ? কোনো এক অদর অন্ধকার গুহা থেকে আরেকজন সোমনাথ কাতরভাবে চিৎকার করছে।
কিন্তু সোমনাথ তো এই ডাকে বিচলিত হবে না। যে-সোমনাথ ভালো থাকতে চেয়েছিল তাকে তো সমাজের কেউ বেঁচে থাকতে দেয়নি। সোমনাথ এখন অরণ্যের আইনই মেনে চলবে।
নটবর মিত্রের অভিজ্ঞ মাথায় এখন নানা চিন্তা। টাকের ঘাম মুছে বললেন, “এই জন্যে বাঙালীদের কিছু হয় না। হতভাগা গাঙ্গুলীটা বাড়ি ফিরবার আর সময় পেলো না! কত পত্নীপ্রেম দেখলেন না? তোমার রেস্ট দরকার? তোমায় যেতে দেবো না! আর কি রকম সতী-সাধী স্ত্রী! স্বামী-দেবতার আদেশ অমান্য করলেন না!”
সোমনাথের চিতা, কাজের শুরুতেই বাধা পড়লো। এবার কী হবে?
নটবর নিজেই বললেন, “চলুন চলুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোলে কাজ হবে না। সময় হাতে নেই। মিস্টার গোয়েঙ্কার কাছে আপনার মানসম্মান রাখতেই হবে!”