মিলির চিঠি এসছে।
দু’টি চিঠি। দু’টি চিঠিতে একই কথা লেখা। একই বক্তব্য। একটি শব্দও এদিক ওদিক নয়। দু’টি চিঠি পাঠানোর কারণ ওসমান সাহেব ধরতে পারলেন। একটি হারিয়ে গেলেও অন্যটি যাতে পৌঁছে সেই ব্যবস্থা। অদ্ভুত সব চিন্তা মিলির মাথাতেই খেলে।
চিঠির ভাষা গুরু গম্ভীর। এবং আপনি আপনি করে লেখা। যেন পরীক্ষার খাতায় চিঠি লেখা হচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলে নম্বর কাটা যাবে।
শ্রদ্ধেয় ভাইয়া, আমার সালাম জানবেন। আপনি বিগত এক সপ্তাহ যাবত বাইরে আছেন। আমরা সবাই অত্যন্ত চিন্তগ্রস্ত। এদিকে কয়েকদিন আগে আমি একটি পত্রিকায় পড়লাম। এই মাস বৃশ্চিক রাশির জাতকের জন্যে খুব খারাপ মাস। আমি পত্রিকার লেখাটি আপনার জন্যে লিখে দিচ্ছি।
বৃশ্চিক রাশির জাতকের ওপর শনি এ মাসে পূর্ণ প্রভাব ফেলবে। দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যহানী, আত্মীয় বিয়োগ প্রভৃতি ঘটার সম্ভাবনা। নতুন বন্ধু তৈরিতে বিরত থাকুন। নিতান্ত প্রয়ােজন না হলে ভ্রমণে না যাওয়াই ভাল।
ভাইয়া। আপনি তো এসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু এগুলি সত্যি। প্রথম প্রথম আমিও বিশ্বাস করতাম না। একদিন পত্রিকায় দেখলাম ধনু রাশির জন্যে আজকের দিনটি অশুভ। দুর্ঘটনা যোগ আছে।
তবু আমি গেলাম। পরে কী হল তা তো আপনি জানেন। রিকশা একসিডেন্ট করে পা ভেঙে এক মাস হাসপাতালে।
যাই হোক চিঠি পাওয়া মাত্র আপনি চলে আসবেন। টগর, আপনার জন্যে খুব কান্নাকাটি করছে। সেদিন গিয়েছিলাম ভাবীর কাছে নিউ পল্টন লাইনে। আপনার কথা উঠতেই টগর এমন কাঁদতে লাগল যে আমি নিজেও কাদলাম। তাছাড়া টগরের শরীরও খুব খারাপ। কয়েকদিন ধরে একশ তিন জ্বর চলছে। ডাক্তাররা আশংকা করছে হয়তবা টাইফয়েড।
পুনশ্চ দিয়ে লেখা, ভাইয়া, ও আমাকে একটুও ঘর থেকে বের হতে দেয় না। গেটে তালা বন্ধ করে রাখে।
ও ভাল কথা, আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি চিকিৎসার জন্যে। আপনার জন্যে কিছু আনতে হলে জানাবেন। ওসমান সাহেব চিঠিটি বেশ কয়েকবার পড়লেন। মিলি, তার স্বভাবমত মিথ্যায় চিঠি ভরিয়ে দিয়েছে। পা ভাঙার কোনো ব্যাপার তার জীবনে ঘটেনি।
টগর, তার জন্যে কাঁদছিল এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। টগরের মধ্যে এ জাতীয় আবেগ নেই। থাকলেও তা গোপনে, অন্য কেউ তাঁর খোঁজ জানবে না। আর জুরের ব্যাপারটি তো শেষ মুহূর্তে বানানো হয়েছে। গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য লেখা হয়েছে–ডাক্তাররা আশঙ্কা করছে হয়তবা টাইফয়েড। ডাক্তাররা অর্থাৎ একজন ডাক্তার নয়। কয়েকজন ডাক্তার। খবরগুলি যে মিথ্যা তার সবচে বড় প্রমাণ হচ্ছে রানুরা এখন নিউ পল্টন লাইনে থাকে না।
তিনি নিজের মনেই খুব হাসলেন। মন ভাল করে দেবার মত চমৎকার একটি চিঠি। একজন কেউ বলছে–ফিরে এসো। সেই বলার আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে প্রতিটি অক্ষরে। মানুষ বাধা পড়বার জীবন নয়। কিন্তু তাকে বধিবার আয়োজনই বোধ হয় সবচে প্রবল।
তিনি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলেন। চমৎকার একটি চিঠি লিখলেন, মিলিকে। সেখানে কিং-কংয়ের কথা লেখা হল। ওসমান সাহেব লিখলেন, আমার কেন জানি মনে হয়। আমি সারা জীবন একেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। তার ছায়া দেখতে চেয়েছি প্রিয়জনদের মধ্যে। একটা অলৌকিক বিশ্বাস লালন করেছি নিজের মধ্যে যে একদিন না একদিন কিং-কং ফিরে আসবে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া কেউ বোধ হয়। কখনো ফেরে না।
চিঠিটি পাঠানো হল না। তার মনে হল মিলি এই চিঠির অর্থ বুঝতে পারবে না মনগড়া মানে দাঁড়া করিয়ে নিজের মনে কাদৰে। মিলি বড় ভাল মেয়ে। তাকে কাদাতে ইচ্ছা করে না।
দোতালার ঘর, বারান্দা, বাড়ির পেছনের পুকুরঘাট এর মধ্যেই ওসমান সাহেবের জীবনযাত্রা চলতে লাগল। খারাপ লাগল না মোটেই। বরং ভালই লাগতে লাগল। কাক তাড়ানোর ব্যাপারে বাতাসীকে সাহায্য করবার জন্যেও তিনি বসতে শুরু করলেন। আইনুদ্দিন এবং তার স্ত্রী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এই মানুষটিকে তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। গ্রামের মানুষেরা রহস্যময়তা পছন্দ করে না।
আইনুদিনের ধারণা ছোট সাহেবের মাথায় ছিট আছে। তার স্ত্রী তাকে ঠিক সমর্থন করেনি। কিন্তু গত রাতে তার মনেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ আইনুদ্দিনকে ডেকে ওসমান সাহেব বলেছেন, একটা কাল রঙের কুকুরের বাচ্চ জোগাড় করে দিতে পারো? আইনুদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়েছে। তিনি বলেছেন, আমি একটি কুকুর পুষতে চাই। তবে কাল রঙে হতে হবে।
ক্যান?
কিং-কংয়ের রঙ ছিল কাল।
আইনুদ্দিন এবার বলতে চাইল. কিং-কং কে? সে বলল না। কুকুর-ছানা খুঁজে আনল একটি। তাকে দেখা মাত্র ওসমান সাহেব রেগে গেলেন।
এক্ষুণি একে ফেলে দিয়ে এসো।
আইনুদ্দিন ফেলে দিয়ে এল। সে রাতে ওসমান সাহেব কিছু খেলেন না। অনবরত বারান্দায় পায়চারি করলেন। আইনুদ্দিন ও তার স্ত্রী দূর থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
তিনি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। খিলখিল হাসির শব্দে ঘুম ভাঙিল। বাতাসী হাসছে। তার মানে রাত হয়নি। রাত বেশি হলে বাতাসী জেগে থাকত না। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে অনেক রাত; আইনুদ্দিন ঘরে কোনো আলো দিয়ে যায়নি। অবশ্যি তার দরকার ও নেই। ঘরে প্রচুর আলো। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে। কিংবা কে জানে আজ হয়ত হঠাৎ কোনো কারণে দু’টি চাঁদ উঠেছে।
ওসমান সাহেব উঠে বসলেন। বিছানার এক অংশ, পড়ার টেবিল এবং আলনায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সে আলো নদীর জলের মত কাঁপিছে। এ রকম মনে হচ্ছে কেন? চোখের ভুল নাকি? তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বিস্তীর্ণ মাঠে সত্যি সত্যি জোছনার ঢেউ। মাঝে মাঝেই ফুলেফোঁপে উঠছে। তার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। তিনি কাঁপা গলায় ডাকলেন, আইনুদ্দিন, আইনুদ্দিন।
আইনুদ্দিন তার ডাক শুনতে পেল না। সে উঠোনে বসে চাদের আলোয় দড়ি পাকাচ্ছে। লম্বা ঘোমটা দিয়ে তার বেী বসে আছে তার পাশে। বাতাসী একটি কঞ্চি হাতে নিয়ে উঠোনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে ছুটে যাচ্ছে এবং অনবরত হাসছে। চমৎকার একটি ছবি। এত চমৎকার যে মনে হয়।এ রকম কিছু সত্যি সত্যি ঘটছে না। এ ছবিটি বিশুদ্ধ কল্পনা। ওসমান সাহেব দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন মাঠে আবার তাঁর ভয় ভয় করতে লাগল। তিনি আবার ডাকলেন, আইনুদ্দিন, আইনুদ্দিন। আইনুদ্দিন দড়ি ফেলে উঠে এল। তার বৌ মাথার ঘোমটা অনেকখানি টেনে দিল। বাতাসী হাতের কঞ্চি ফেলে তার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে বিজ বিজ করে কী সব বলতে লাগল। কোনো গ্রাম্য ছড়া বোধ হয়। এই মেয়েটি প্রচুর ছড়া জানে। এক মুহূর্তের জন্যে না থেমেও সে অনবরত নতুন ছড়া বলতে পারে। তার মার কাছে থেকেই শিখেছে নিশ্চয়ই কারণ বাতাসীকে তিনি কখনো বাড়ির বাইরে যেতে দেখেননি। আইনুদ্দিন হাতে একটি হারিকেন নিয়ে বারান্দায় উঁকি দিল। নিচু গলায় বলল, ভাই জানের শইলটা এখন কেমুন?
শরীর ভালই। কটা বাজে আইনুদ্দিন?
আইনুদ্দিন বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। এ বাড়িতে কোনো ঘড়ি নেই। আইনুদ্দিন কার কাছ থেকে ঘড়ি একটা নিয়ে এসেছিল। তিনি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, বন্ধনহীন অবস্থায় সময়কে দেখতে ভালই লাগবে। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে জানা যাবে না। কটা বাজে, রাত কাটতে কত দেরি। সময়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই সময় জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।
আইনুদ্দিন।
জি।
কটা বাজে জেনে আসতে পারবে?
পারমু।
যাও জেনে আস।
চা খাইবেন ভাইজান?
না। চা-টা কিছু খাব না। আইনুদ্দিন আজ কী পূর্ণিমা?
জে না। কাইল। কাইল লক্ষ্মীপূজা।
ওসমান সাহেব খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মাঠের উপর চাদের আলো এমন উঠানামা করছে কেন? দেখতে পাচ্ছি। আইনুদ্দিন? আইনুদ্দিন অবাক হয়ে তাকাল মাঠের দিকে। সে তেমন কিছু দেখতে পেল না।
দেখতে পাচ্ছে না? বাতাসে ঘাস কঁপতাছে হেই জনো এমুন মনে হয়। ভাইজান, আপনে ভিতরে গিয়া বসেন। কেন?
আপনের শইলডা ভাল না।
আজি কী বার?
বুধবার।
তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। বুধবার টগরকে দেখতে যাবার দিন। অনেক দিন তাকে দেখতে যাওয়া হয় না। টগর প্রতি বুধবার তার জন্য অপেক্ষা করে? কিছু দিন করবে তারপর আর করবে না। কোনো একটি বিশেষ কিছুর জন্যে মানুষ দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারে না। মানুষ প্রতিবারই নতুন কিছুর জন্যে প্রতীক্ষা করতে ভালবাসে।
ভাইজান।
বল।
ডাক্তার সাবরে খবর দেই?
কেন?
আপনার শইলড়া ভাল না।
আমার শরীর ভালই আছে। আর শোন, ঘড়ি আনার দরকার নেই।
রাইতে কী খাইবেন?
কিছুই খাব না। হারিকেন রেখে তুমি নিচে চলে যাও।
আইনুদ্দিন চিন্তিত মুখে নেমে গেল। ওসমান সাহেব নিশ্চিত সে উঠোনে বসা তার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গুজ গুজ করে কথা বলবে, তারপর রওনা হবে ডাক্তারের কাছে। সময় জেনে আসবে, এবং খুব সম্ভবত ডাক্তারকেও সঙ্গে নিয়ে আসবে। ডাক্তার ভদ্রলোক এসে আর উঠতে চাইবেন না। অনবরত কথা বলবেন। এখানে তার কথা বলার মত লোক নেই হয়ত।
গতকাল ভদ্রলোক প্রথম এসেছিলেন। বুড়ো ধরনের একজন মানুষ। এই গরমেও সু্যট পরা। সুটটি পুরনো এবং ময়লা কিন্তু গলায় টাইটি ঝক ঝক করছে। সম্ভবত আজই ট্রাংক খুলে বের করা হয়েছে।
আপনি যে এখানে আছেন জানতামই না। আইনুদিনের কাছে শুনে অবাকই হলাম। আমার স্ত্রীকে বললাম সেও আসতে চাচিছিল। আমার ছেলে মেয়েরা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। ওরা আবার খুব সাহিত্য পাগল; একজন কবিতা লিখে ছদ্মনামে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখা বের হয়। আপনার চোখে পড়েছে বোধ হয়, সানজা করিম। একটা কবিতার বই বের করতে চায়। বহু খরচান্ত ব্যাপার। কী বলেন? এদিকে আবার বই না হলে কবি বলে কেউ স্বীকার করতে চায় না। ভাল লিখছে না খারাপ লিখছে এটা কেউ দেখতে চায় না। দেখতে চায় বই কটা আছে। কোয়ালিটি নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই, সবাই চায় কোয়ান্টিটি। ঠিক বলছি কি না বলেন?
ভদ্রলোক অনবরত কথা বলতে লাগলেন। নিজেই প্রশ্ন করছেন নিজেই জবাব দিচ্ছেন। আবার প্রশ্ন করছেন আবার জবাব দিচ্ছেন। অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থা। আইনুদ্দিন কী মনে করে তাকে নিয়ে এসেছে কে জানে। ভদ্রলোকের সঙ্গে ডাক্তারি ব্যাগ। প্রেসার মাপার যন্ত্র। কাজেই দেখা সাক্ষাতের জন্য আসেননি চিকিৎসার জন্যই এসেছেন।
ভাই এখন বলেন, আপনার কী অসুবিধা?
আমার কোনো অসুবিধা নেই।
সে কী আইনুদ্দিন যে বলল.
ও ঠিক বলেনি।
ঘুম হচ্ছে না নাকি। সারারাত হাঁটাহাঁটি, করেন?
আমি এমনিতেই রাত জাগি।
তা তো জাগতেই হয়। লেখক মানুষ। আপনারা নাক ডাকিয়ে ঘুমুলে চলে না কী?
ওসমান সাহেব ঠাণ্ডা, গলায় বললেন, আপনি অন্য একদিন আসুন। আজ আমি একটু ব্যস্ত।
ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, প্রেসার মাপবেন না?
জি না।
টেবিলের উপর হারিকেন জ্বলছে। সুন্দর করে সাজানো টেবিল। কাগজ, কলম, পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস। ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন দু’টি পেনসিলও রাখা আছে। পেনসিল দু’টি কাল ছিল না। আজই আনা হয়েছে এবং আইনুদিনের স্ত্রী এক ফাঁকে রেখে গেছে। তার মনে হল এই টেবিলে কোথাও যেন মিলির ছোঁয়া আছে। ওসমান সাহেব বুঝতে পারলেন না হঠাৎ করে মিলির কথা কেন মনে হল। এ রকম মনে হবার কারণ কী পেনসিল দু’টি? মিলিও লেখার টেবিল গোছাবার সময় কলমের পাশাপাশি দু’টি পেনসিল রাখত। পেনসিল তিনি ব্যবহার করেন না। মিলিকে বলেছেন অনেকবার। লিখতে বসে প্রতিবারই তিনি পেনসিল দু’টি ড্রয়ারে রাখতেন। এবং প্রতিবারই মিলি তা বের করে টেবিলে সাজিয়ে রাখত। মজার ব্যাপার হচ্ছে মিলির আগ্রহ এই টেবিলেই সীমাবদ্ধ ছিল। কী লেখা হল না হল তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিয়ের পরও রোজ রানুকে টেলিফোন।
হ্যাঁলো ভাবী, ভাইয়ার টেবিল গোছানো হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
টেবিল ক্লথ বদলে দিয়েছ তো? রোজ নতুন টেবিল ক্লথ না দিলে সে লিখতে পারে না। সাতটা টেবিল ক্লথ আছে তার জন্যে। কোণায় শনি, রবি লিখে দিয়েছি।
আমি জানি তুমি আমাকে বলেছ অনেকবার।
ভাবী দেখ তো আজ কী সোমবার লেখা টেবিল ক্লথ আছে কিনা। না থাকলে ভাইয়া কিন্তু লিখতে পারবে না।
শোন মিলি, লেখাটা তৈরি হয় মাথায়। টেবিল ক্লথের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
তুমি কাইন্ডলি একটু দেখে আস না ভাবী এক মিনিটের ব্যাপার।
ঠিক আছে যাচ্ছি।
আরেকটা কথা ভাবী, উপন্যাসটা শুরু করেছিল সেটা ক’ পৃষ্ঠা লিখেছে সেটাও আমাকে বলবে।
ঠিক আছে বলব। এখন টেলিফোন নামিয়ে রাখি?
না ভাবী এখনই রাখবে না। আরেকটু কথা বলি।
ওসমান সাহেব টেবিলের সামনে বসলেন। হারিকেনের আলো কমিয়ে দিলেন। এক চুমুক পানি খেলেন।
গ্রাসের নিচে রাখা রানুর চিঠিটি আবার পড়লেন। পাঁচ-ছলাইনে লিখেছে মিলিকে রাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজটা ভাল হয়নি। সম্ভব হলে তুমি ওকে দেশে নিয়ে আসার চেষ্টা কর।
কী চেষ্টা তিনি করবেন? কার কাছে যাবেন। এবং ওরাই বা তার কথা কেন শুনবে।
বাতাসী এসে দাঁড়িয়েছে পর্দা ধরে। সে ভেতরে ঢোকে না। এ ঘরে ঢোকা বোধ হয় নিষেধ আছে। ওসমান সাহেব বললেন,
কী খবর বাতাসী?
বাতাসী হাসি মুখে বলল,
ইরল বিরল চিরল পাতা
হাত্তীর মাথাত কলাপাতা।
বলেই সে ছুটে নেমে গেল নিচে। মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গি-ছুটে পালাবার ভঙ্গির মাঝে কী মিলির কোন ছাপ আছে? সে কী ছেলেবেলায় এ রকম ছড়া বলত? কিছুই মনে পড়ছে না। কোন প্রিয়জন হঠাৎ করে অনেক দূরে চলে গেলে তার কথা বারবার মনে পড়ে। পুরনো সব স্মৃতি ভেসে ওঠে কথাটা কী ঠিক? বোধ হয় না। অনেক চেষ্টা করেও তিনি মিলি প্রসঙ্গে পুরোনো কিছু মনে করতে পারলেন না।
ওসমান সাহেব কাগজের ওপর ঝুকে পড়লেন এবং অত্যন্ত দ্রুত লিখতে শুরু করলেন,
কল্যাণীয়াষু, মিলি, আজ আমাদের গ্রামের বাড়িতে অদ্ভুত একটা কাণ্ড হয়েছে। প্রচণ্ড জোছনা হয়েছে। অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ জেগে দেখি ঘরে আলোর বন্যা। বন্যার জলের মতই থৈ থৈ করছে জোছনা। একবার ভাবলাম দুটো চাঁদ উঠল নাকি আকাশে। বারান্দায় গিয়ে দেখি আইনুদ্দিন তার স্ত্রীকে নিয়ে দড়ি পাকাচ্ছে। তাদের ছোট্ট মেয়েটি কঞ্চি হাতে ছোটাছুটি করছে। কী অপূর্ব একটি ছবি, এ ছবি এ ভুবনের নয় অন্য কোনো ভুবনের। আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠল।
মিলি, সমগ্র জীবনে আমি এমন একজন মানুষ হতে চেয়েছিলাম, যার ভেতর কোন রকম ক্ষুদ্রতা থাকবে না। যে এ পৃথিবীর সুন্দর যা কিছু আছে তাকে স্পর্শ করবে…
বাতাসী আবার এসে দাঁড়িয়েছে। আবার কী একটা ছড়া বলল। ওসমান সাহেব তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আবার লিখতে শুরু করলেন। বাতাসী তাকিয়ে আছে। সে ভেতরে এসে ঢুকাল। এই অদ্ভুত মানুষটিকে তার বড় ভাল লাগে। আজ কেন জানি অন্য দিনের চেয়েও ভাল লাগছে।