২৭ মার্চ, শনিবার ১৯৭১
গতকালও সারারাত জাগা। গোলাগুলির শব্দ, আগুনের স্তম্ভ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সকালের দিকে গোলাগুলির শব্দটা খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হল। তখন সব বাড়ি থেকে মুখ বাইরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। বারেক-কাসেম সাহস করে গেটের বাইরে দাঁড়াল। একটু পরেই দৌড়ে এসে বলল, আম্মা, রাস্তায় লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া চলতাছে।
সেকি! রেডিওতে তো কারফিউ তোলার কথা বলেনি। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। রেডিওর ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি টেবিলে নাশতা দিতে বলে কাপড় বদলাতে গেলাম। সাড়ে আটটায় রেডিওতে কারফিউ তোলার ঘোষণা দেওয়ামাত্র আমি আর রুমী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কামাল বিদায় নিয়ে চলে গেল তার ভাইয়ের বাড়িতে। জামী থাকল বাসায় বাবার কাছে। শরীফ বলল, আমি রিকশা নিয়ে বাঁকার ওখান থেকে ঘুরে আসি।
এলিফ্যান্ট রোডে উঠে বললাম, প্রথম মায়ের বাসায় চল। তারপর হাসপাতালে।
রুমী বলল, আম্মা, আমাকে কিন্তু গাড়িটা দিতে হবে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য।
দেব। আগে দরকারি কাজ সেরে নিই।
নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারের সামনে পৌঁছেই রুমী হঠাৎ ও গড! বলে ব্রেক কষে ফেলল। সামনেই পুরো কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই হয়ে রয়েছে। এখনো কিছু কিছু ধোয়া উঠছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, মানুষও পুড়েছে। ওই সে পোড়া চালার ফাঁক দিয়ে
রুমী জোরে গাড়ি চালিয়ে–আম্মা, তাকায়ো না ওদিকে বলে ডানদিকে মিরপুর রোডে মোড় নিল।
ঢাকা কলেজের কাছ পর্যন্ত পৌঁছুতে দেখা গেল উল্টোদিক থেকে ওয়াহিদ আসছে হনহন করে হেঁটে, চারদিকে তাকাতে তাকাতে। জুবলী ভাইয়ের ছেলে ওয়াহিদ। রুমীর চেয়ে দুতিন বছরের বড় হলেও তার বন্ধু। রুমী গাড়ি থামিয়ে ওকে তুলে নিল, কোথায় যাচ্ছ বাবু ভাই?
জেবিসদের বাসায়। ওরা বেঁচে আছে কি না জানি না। থাকলে ওদেরকে নিয়ে আসব আমাদের বাড়িতে। ধানমণ্ডি এলাকা খানিকটা নিরাপদ।
আমি বললাম, আগে ছয় নম্বর রোডে গিয়ে মাকে একটু দেখে আসি? তারপর আমরাও যাৰ জুবলীদের বাসায়।
ধানমণ্ডির দিকে তেমন তাণ্ডব হয় নি, তবু দুনম্বর রোডের ই.পি.আর থেকে যে শব্দ এসেছে, তাতেই মা আর লালুর রাত-জাগা চেহারা উদভ্রান্ত। দ্রুত স্বরে ওদের কুশল জিগ্যেস করে, বাজার-সদাই কিছু লাগবে কি না জেনে নিয়ে, আবার রাস্তায় নামলাম। নীলক্ষেত ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সের পঁচিশ নম্বর বিল্ডিংয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকে। ওয়াহিদের ফুপা। আমাদের পরিবারের সঙ্গেও ওদের খুব ঘনিষ্ঠতা। ওদের ফ্ল্যাটে ঢোকামাত্র খোঁচা খোঁচা দাড়ি, রক্তাভ চোখ, উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে রফিক দৌড়ে এল আমাদের দিকে, ফোঁপানোর মত করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বুবু, বুবু, আমরা আর নেই! শিগগির নিয়ে যান আমাদের এখান থেকে।
রফিকের স্ত্রী জুবলী, ওদের ছেলেমেয়ে বর্ষণ ও মেঘলা–সকলেরই বিধ্বস্ত অবস্থা। পঁচিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের পেছনেই ইকবাল হল। অতএব শেল, মর্টারের ছিটকানো টুকরা, হেভি মেশিনগানের গুলি, সব এসে বাড়ি খেয়েছে পঁচিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দেয়ালে, জানালার কাচে। জানালা ভেদ করে এ পাশের দেয়ালে পর্যন্ত গেথে গেছে গুলি। রফিকরা সবাই দুরাত একদিন খাটের নিচে মেঝেতে মাথা গুঁজে পড়ে থেকেছে।
জুবলী ওয়াহিদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, ওয়াহিদ বলল, কেঁদ না জেবিস, তোমাদেরকে এক্ষুণি আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।
আমি বললাম, জুবলী, তোমরা তাড়াতাড়ি একটা দুটো সুটকেস গুছিয়ে নাও। হাসপাতালে আমার দেওরের মেয়ে আছে। ওকে দেখে এসেই তোমাদেরকে তুলে বাবুর বাসায় নিয়ে আসব।
পঁচিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাবার পথে লক্ষ্য করলাম, দলে দলে লোক বাক্স-বোচকা ঘাড়ে-মাথায় নিয়ে হেঁটে চলেছে। সমস্ত রিকশা লোকজন-বাস পেটরা বোঝাই হয়ে ছুটে চলেছে। একটাও খালি রিকশা চোখে পড়ল না। পথযাত্রীরা মাঝে-মাঝে প্রাইভেট গাড়ি থামানোর জন্য হাত তুলছে। দুতিনটি বাচ্চাসহ একটি পরিবার আমাদের গাড়িটি থামিয়ে বলল, আমাদের একটু মালিবাগে নামিয়ে দিবেন? একটাও রিকশা পাচ্ছি না।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, আমাদের নিজেদেরই আত্মীয়স্বজন আনা নেওয়া করতে হবে। হাসপাতালে আমাদের আগুনে-পোড়া রুগী আছে। আমাদের সময় নেই। মাপ করবেন।
না পেরে খুব খারাপ লাগল। কিন্তু এখন মালিবাগে যাবার সময় নেই আমাদের। হাসপাতালের আউটডোরে গেটে ঢোকার আগে রুমী আরেকবার ও গড! বলে ব্রেক কষে ফেলল। পাশেই শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো গোলার আঘাতে ভেঙে দুমড়ে মুখ থুবড়ে রয়েছে। আমার দুচোখ পানিতে ভরে গেল। একি করেছে ওরা! শহীদ মিনারের গায়ে হাত? চারদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথায় জাল-দেয়া হেলমেট পরা সৈন্য। আমি চাপাস্বরে বললাম, রুমী, ভেতরে ঢোক। সময় নেই বেশি।
গাড়ি পার্ক করে আমরা ছুটলাম আউটডোরের লম্বা করিডোর দিয়ে ভেতরে। পুরো হাসপাতাল লোকে লোকারণ্য। কেউ এসেছে আহত আত্মীয়-বন্ধু নিয়ে। কেউ এসেছে নিখোঁজ আত্মীয়-বন্ধুর খোঁজ করতে। ভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বহু লোক। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠবার মুখে বাধা পেলাম। বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হাই স্যারের স্ত্রী আনিসা বেগম, মেয়ে হাসিন জাহান, ওর বড় ভাই ও ভাবী এবং বাড়ির অন্য সবাই করিডোরে দাঁড়িয়ে। আনিসা ভাবী ও হাসিন জাহান দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। হাই স্যার কয়েক বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তার পরিবার এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটেই বাস করছেন। ওঁদের চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংটা শহীদ মিনারের ঠিক উল্টোদিকেই। আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনলাম, হাসিন জাহান কাঁদতে কাঁদতে বলছে, খালাম্মা, আমাদের বিল্ডিংয়ে আর্মি ঢুকে মেরে-ধরে সব একাকার করেছে, মনিরুজ্জামান স্যার মরে গেছেন, জ্যোতির্ময় স্যার গুরুতর জখম
আমি আঁতকে উঠলাম, আমাদের মনিরুজ্জামান স্যার?
না, বাংলার নয়। স্ট্যাটিস্টিকসের। খালাম্মা গো, আমাদের বিল্ডিং রক্তে ভেসে গেছে।
তোমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকেনি তো? আমরা বাইরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে সব খাটের তলায় চুপ করে পড়েছিলাম। অনেক ধাক্কাধাক্কি করেছে কিন্তু আমরা টু শব্দটি করি নি। তাই ভেবেছে কেউ নেই। তাই আমরা বেঁচে গেছি। আজ কারফিউ ওঠামাত্রই এককাপড়ে হাসপাতালে এসে আশ্রয় নিয়েছি।
ওদের সঙ্গে দুচার মিনিট কথা বলে ছুটলাম তিনতলার নিউ কেবিনে। এতবড় হাসপাতালের সব তলার প্রশস্ত করিডোরগুলো ভীত, সন্ত্রস্ত, ক্রন্দনরত লোকের ভিড়ে ঠাসা। দুহাতে লোক ঠেলে এগোতে হচ্ছে। ইমনের কেবিনে ঢুকে দেখলাম আনোয়ার ইতোমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। ইমন আধ-মরার মত বিছানায় শুয়ে আছে। ইমনের মা শেলী বরাবরই ধীর, স্থির, শান্ত–সব সময় হাসে। আজও তার স্থিতধী ভাব দেখে অবাক হলাম। এতবড় ধকলের ছাপ তার রাত-জাগা চোখে, এলোমেলো চুলে, কুঁচকানো শাড়িতে অবশ্যই আছে, কিন্তু মুখের হাসিটি অন্তর্হিত হয় নি। হাসপাতালে লাইট নেই, পানি নেই, খাবার নেই, শহীদ মিনারের ওপর ক্রমাগত শেলিংয়ে হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের ওই দিকটা প্রায় বিধ্বস্ত। একটা জানালারও কাচ নেই। দেয়ালগুলো গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা। বহু ডাক্তার সপরিবারে হাসপাতালে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এই রুগী সামাল দিলে কি করে? তুমি খেয়েছ কি এই কদিনে? ক্লান্ত মুখে একটু হেসে শেলী বল, কোনমতে রুটি, বিস্কুট, ডাবের পানি দিয়ে চালিয়েছি। আর, ডাক্তারের অভাব ছিল না বলে তেমন ঘাবড়াইনি।
মনে মনে শেলীকে ধন্য ধন্য করে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে রুমী বলল, আম্মা, একবার সাদের বাসা যেতে চাই। সাদ আন্দালিব রুমীর একমাত্র বন্ধু যে রুমীর চেয়ে বয়সে বড় নয় এবং একই ক্লাসে পড়ে।
রফিকদের আগে বাবুর বাসায় পৌঁছে দিই। কিছু বাজার-সদাই করে তোর নানীকে পৌঁছে দি, তারপর তুই গাড়ি নিয়ে যাস।
রুমী আমাকে বাড়িতে নামাবার জন্য গেটে গাড়ি ঢোকাতেই দেখি বদিউজ্জামান আমাদের পোর্চে সাইকেল থেকে নামছে।
বদিউজ্জামান বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে। বহু বছর থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তার শ্বশুর আবদুল কুদ্স ভূঁইয়ার বাড়ি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশেই। বদিউজ্জামানের স্ত্রী কাজল দুমাসের বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতে ছিল। বদিউজ্জামান ছিল এলিফ্যান্ট রোডে তার চাচার বাড়িতে। আজ সকালে কারফিউ উঠলে সে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে শোনে গত দুরাত একদিনে সেখানে কি তাণ্ডব হয়ে গেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশরা পাক আর্মির সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করার সময় ভুইয়া সাহেবের বাড়িসহ আশপাশের কয়েকটা বাড়িতেও পজিসান নেয়। পালাবার সময় তারা সারা বাড়িতে অস্ত্র, ইউনিফর্ম সব ফেলে ছড়িয়ে গেছে। এখন ওঁদের আর ঐ বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। তাই বদিউজ্জামান অন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছে। প্রথমে ওদের আত্মীয়, সাংবাদিক কে. জি. মোস্তাফার আজিমপুরের বাসায় যায়। কিন্তু কে. জি. মোস্তাফার কারণেই তার বাড়ি নিরাপদ নয়। বরং তারই অন্যত্র সরে যাওয়া উচিত। বদিউজ্জামান তার আরেক পরিচিত মিসেস মেহের দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতেও গিয়েছিল। এর ছেলেমেয়ের বদি কিছুদিন পড়িয়েছিল। উনি শুধু কাজলকে বাচ্চাসহ রাখতে পারবেন বলেছেন। এখন বাকিদের ব্যবস্থা করা দরকার।
আমি বললাম, মার বাড়ির একতলাটা খালি পড়ে আছে। ওখানে তোমরা সবাই স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে।
অতএব বদিকে নিয়ে আমার মার বাড়ি! মার সাথে কথা বলে বদিউজ্জামানদের ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে বাসায় ফিরে এলাম।
মিকির লাশের কথা সবাই ভুলে গেছি। ভুলব না-ই বা কেন? যা উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় সারা সকাল ছুটোছুটি করেছি। সারা ঢাকা জুড়ে সবাই ছুটোছুটি করছে। পরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে দুসেকেণ্ড দাড়িয়ে, যে যা শুনেছে, পরস্পরকে জানিয়ে যাচ্ছে। যত জানছি, ততই মন জগদ্দল পাথরের চাপে বসে যাচ্ছে। এর মধ্যে রুমী অস্থির হয়ে উঠেছে। আমাকে কোনমতে বাড়িতে নামিয়ে আবার ছুটবে বন্ধু-বান্ধবের খোঁজ নিতে।
যখন খেয়াল হয়েছে, তখন কারফিউ শুরু হতে আর ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট বাকি আছে। এর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে মেথর খুঁজে আনা অসম্ভব ব্যাপার। তবু শেষ মুহূর্তে বারেক-কাসেমকে পাঠালাম, পইপই করে বলে দিলাম বেশি দূরে না যেতে। কারফিউ শুরু হলে রাস্তায় দেখলেই মিলিটারি গুলি করবে। সেই ভয়ে তারা দশ মিনিট পরেই ছুটে বাড়ি ফিরে এসে বলল, কোথাও মেথর নেই।
এই আরেকটা মস্ত দুশ্চিন্তা চাপল মাথায়। কালকের আগে আর মিকির লাশ সরানো যাবেনা–এর মধ্যে পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে। একে বিভিন্ন দুঃসংবাদেমন বিধ্বস্ত তার ওপর এই ঝঞ্ঝাট।
শরীফ বাঁকার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে গাড়িতে বহু জায়গায় ঘুরে অনেক খবর যোগাড় করে এনেছে। রুমীও বন্ধুদের বাড়ি চরকি ঘুরোন দিয়ে অনেক খবর জেনে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিন আর নেই। পুড়ে ছাই হয়েছে। মধুদাও নেই। পাকসেনার গুলিতে মরেছে। স্ট্যাটিস্টিক্সের মনিরুজ্জামান সাহেব ছাড়াও আরো অনেক শিক্ষককে পাক আর্মি মেরে ফেলেছে। ডঃ জি. সি. দেব, ডঃ এফ. আর. খান, মিঃ এ.মুকতাদির। কলকাতা রেডিওতে নাকি বলেছে, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম ও বেগম সুফিয়া কামাল পাক আর্মির গুলিতে মারা গেছেন। নীলিমা আপা আর সুফিয়া কামাল আপার কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বাঙালি পুলিশরা বেশিরভাগ প্রাণ দিয়েছে। অল্প কয়েকজন পালাতে পেরেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন এখন পাকসেনার গুলিতে ঝাঁঝরা।
পাক আর্মি দি পিপল অফিস পুড়িয়েছে, পুড়িয়েছে ইত্তেফাক অফিস। ঢাকায় যত বাজার আছে, বস্তি আছে, সব জায়গা আগুনে পুড়ে ছাই–ছাই হয়েছে রায়েরবাজার, ঠাটারী বাজার, নয়াবাজার, শাঁখারী পট্টি।
শরীফ প্রত্যক্ষদর্শীর খবর এনেছে বাঁকার কাছ থেকে। বাঁকার বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেড কোয়ার্টার্স। রাত দুপুরে সেখানে গোলাগুলি শুরু হলে বকা আর তার সম্বন্ধী কাইয়ুম ছাদে গিয়ে ব্যাপার দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেন। সেখানে খুব গুলিগোলা চলছে বোঝা যায়, তবে ট্রেসার হাউই ও ছিটকে আসা গুলির জন্য ওঁরা বেশিক্ষণ ছাদে থাকতে পারেন নি। গোলাগুলির শব্দে ওঁদের বাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। বাঁকারা সবাই সিঁড়ির নিচে জড়ো হয়ে বসেছিলেন। ভোর চারটের দিকে কয়েকজন ই.পি.আরের লোক পালিয়ে বাঁকাদের বাড়িতে ঢোকে। ওঁদের গ্যারেজের পেছনে মাটির নিচে একটা ঘর আছে, সেই ঘরে আশ্রয় দেয়া হয় লোকগুলোকে। কিন্তু ই.পি.আর. হেড কোয়ার্টার্সের এত কাছে লুকিয়ে থাকতেও তাদের ভরসা হয় নি বোধহয়। তাই সকালের আলো পরিষ্কার হবার আগেই তারা ওখান থেকেও পালিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
বাঁকার বাসার ছাদের পতাকা নামানোর কথা কারো খেয়াল ছিল না। ২৬ তারিখের সকালে পাকিস্তান আর্মির মেশিনগান ফিট করা ট্রাক ধানমন্ডির রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে দিতে বাঁকার ছাদে পতাকা দেখে বাসার দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। বাঁকারা প্রথমে বুঝতে পারেন নি কেন তাদের বাসার দিকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। পরে বুঝতে পেরে প্রাণ হাতে নিয়ে বুকে হেঁটে অনেক কষ্টে পতাকা নামিয়ে আনেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক খবর ডাঃ খালেকের ভায়রাভাই কমাণ্ডার মোয়াজ্জেমকে পাক আর্মি মেরে ফেলেছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোডে কারম ফোমের মস্ত সাইনবোর্ড আঁকা তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় তার বাসা ছিল। সাধারণত রাতে তিনি বাড়িতে থাকতেন না, কারণ আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোয়াজ্জেমের ওপর আগে থেকেই আর্মির নজর ছিল। মোয়াজ্জেমের দুর্ভাগ্য, ঐ রাতটা তিনি বাড়িতে ছিলেন। মৃত্যু তাকে টেনেছিল, তাই বোধহয়। শুনে খুব কষ্ট হল। মাত্র তিনদিন আগে ২৩ মার্চ তাঁর সঙ্গে দেখা হল। কি হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, আশাবাদী যুবক। তার এই পরিণতি।
শেখ মুজিবের কথা কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না। কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলেছে, কেউ বলছে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা কে মরেছেন, কে পালাতে পেরেছেন কিছুই ঠিক করে কেউ বলতে পারছে না। ফোন বিকল, নইলে যারা বলতে পারত এমন লোকের কাছে ফোন করে জানা যেত।
মাথা ঝিমঝিম করছে। উপরে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল। খানিক পরে রুমী এসে বসল পাশে। গায়ের ওপর হাত রেখে আস্তে বলল, আম্মা, তবু তো আমরা পুরো ছবিটা জানি না।
আমি তার দিকে পাশ ফিরে বললাম, তার মানে?
আমরা কটা জায়গাতেই বা গেছি। অন্যরাও সব জায়গা নিজের চোখে দেখে নি। কিছু দেখা, কিছু শোনা মিলে যেটুকু জেনেছি, আমার ভয় হচ্ছে আসল ঘটনা তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। সবটা জানতে মনে হয় আরো কদিন লাগবে।
আমি চেঁচিয়ে কেঁদে ফেললাম, আর জানতে চাই না। যেটুকু জেনেছি, তাতেই কলজে ছিড়ে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ, একি সর্বনাশ হল আমাদের। ওরা কি মানুষ, না জানোয়ার?
ওরা জানোয়ামেরও অধম। ওরা যা করছে, তাতে দোজখেও ঠাঁই হবে না ওদের।