সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
মানুষকে সাফল্যের পথে নেওয়া
আমি পিট বার্লোকে চিনতাম। পিট কুকুর আর ঘোড়ার খেলা দেখাত। সার্কাস নিয়ে তিনি সারাজীবন দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পিট নতুন নতুন কুকুরকে যেমন করে শিক্ষা দিতেন আমার দেখতে ভালো লাগতো। আমি লক্ষ্য করতাম কোন কুকুর একটু উন্নতি করলেই পিট তাকে প্রশংসা আর আদর করে মাংস খেতে দিয়ে আরও ভালো করার আগ্রহ জাগিয়ে তুলত।
ব্যাপারটা নতুন নয়। পশুদের শিক্ষা দেবার কাজে এটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই চলেছিল।
আমি অবাক হচ্ছি, কুকুরদের শিক্ষার কাছে আমরা যে নীতি কাজে লাগাই মানুষের বেলা তা লাগানই না কেন? চাবুকের বদলে মাংস দিতে চাই না কেন? সমালোচনার বদলে কেনই বা প্রশংসা করি না? সামান্য উন্নতি করলেও আসুন প্রশংসা করি এতে অপর লোকটির আরও উন্নতি করার আগ্রহ জাগে।
ওয়ার্ডেন লুইস ই. লজ দেখেছেন সামান্য প্রশংসাতেও কাজ হয়। তিনি ছিলেন সিংসিং কারাগারের জাঁদরেল একজন রক্ষী। এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় তাঁর কাছ থেকে এই চিঠিটা পাই : ‘আমি লক্ষ্য করে দেখেছি অপরাধীদের দোষের জন্য সব সময় সমালোচনা আর নিন্দা করার বদলে তাদের কোন কোন সময় প্রশংসা করলে ঢের বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়।‘
‘আমাকে এখনও সিংসিং-এ ভর্তি করা হয়নি–অন্তত এখনও নয়–তবু নিজের জীবনের অতীতকে যখন মনের পর্দায় দেখি তখন বুঝি একটা মাত্র কথায় কেমন ভাবে আমার ভবিষ্যণ্টা দ্রুত বদলে যায়। আপনার নিজের সম্পর্কে একথা বলতে পারেন না! ইতিহাসে প্রশংসার অসামান্য যাদুকরী ক্ষমতার অসংখ্য প্রমাণ আছে।‘
উদাহরণ হিসেবে, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে নেপলসে ১২ বছরের একটি ছেলে কোন কারখানায় কাজ করতো। সে চাইতো গায়ক হতে, কিন্তু তার প্রথম শিক্ষক তাকে উৎসাহ দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘তুমি গাইতে পারো না। তোমার গানের গলা নেই। গলার স্বর জানালার খড়খড়ির শব্দের মতো।
কিন্তু ছেলেটির মা, এক গরিব চাষীর মেয়ে, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলতো তার গলায় গান অদ্ভুত চমৎকার। সে ছেলেকে খুবই প্রশংসা করতো। শুধু তাই নয় তার মা বহু কষ্ট সহ্য করে ছেলের গান গাইবার ব্যবস্থা করে। গরীব চাষী মার উৎসাহ আর প্রশংসা ফলে ছেলেটির জীবনধারাই বদলে গেল। আপনারা হয়তো তার নাম শুনে থাকবেন। তার নাম কারুসো।
বেশ কয়েক বছর আগে লণ্ডনে এক তরুণ লেখক হতে চাইছিল। কিন্তু সব কিছু তার বিরুদ্ধে বলেই মনে হতো। সে চার বছরের বেশি স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। তার বাবার জেল হয় কারণ তিনি দেনা শোধ করতে পারেন নি। ছেলেটিও দারিদ্র্যের জ্বালা মর্মে মর্মে টের পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে ইঁদুর ভরা একটা গুদামে লেবেল আটকানোর চাকরি পেল। রাতের বেলায় সে আরও দুটো ছেলের সঙ্গে নীচু একটা চিলে কোঠায় ঘুমোত-জায়গাটা লণ্ডনের বস্তি এলাকার কোথাও ছিল। নিজের লেখার ক্ষমতার উপর তার বিশ্বাস এতই কম ছিল যে, অন্য কেউ যাতে টের না পায় আর না হাসে তাই গভীর রাতে ডাকে সে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিত। গল্পের পর গল্প অমনোনীত হতে লাগল। এটা সত্যি যে এর জন্য সে এক শিলিংও পেল না, তবু একজন সম্পাদক তার প্রশংসা করেছিল। একজন সম্পাদক তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ছেলেটি এতই বিচলিত বোধ করল যে সারা রাস্তায় সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালো আর অশ্রুধারায় তার বুক ভেসে গেল।
ওই প্রশংসা, গল্প ছাপা হওয়ায় যে স্বীকৃতি সে পেল সেটা তার সমস্ত জীবনই একদম পালটে দিল। এই উৎসাহ সে না পেলে সারা জীবনই সে হয়তো ইঁদুর ভর্তি কারখানাতেই কাটাতে বাধ্য হতো। এ ছেলেটির নামও আপনারা জানেন। তিনি আর কেউ নন, চার্লস্ ডিকেন্স।
অর্ধশতাব্দী আগে লণ্ডনের এক শুকনো জিনিসের গুদামে আর একটি ছেলে কাজ করত। তাকে ভোর পাঁচটায় উঠে গুদাম ঝাড় দিতে হতো আর সারাদিন চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করতে হতো। দুঃখময় এই জীবনকে সে ঘৃণা করত। দুবছর পর এটা আর তার সহ্য হলো না, তাই একদিন ভোরবেলা প্রাতরাশের জন্য অপেক্ষায় না থেকে পনেরো মাইল হেঁটে মার সঙ্গে কথা বলতে গেল। মা কোন বাড়িতে দেখাশোনার কাজ করতেন।
ছেলেটি প্রায় পাগলের মতই হয়ে গিয়েছিল। সে কেঁদে মাকে নানাভাবে সব বোঝাতে চাইল। ওই দোকানে থাকতে হলে সে আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখাল। তারপর সে তার আগেকার স্কুল শিক্ষককে লম্বা একটা বেদনা ভারাক্রান্ত চিঠি লিখে জানাল, আর সে বাঁচতে চায় না। তার পুরনো শিক্ষক তাকে একটু প্রশংসা করে লিখলেন সে বুদ্ধিমান ছেলে, তার অনেক ভালো কাজ করার আছে। তিনি তাকে একটা স্কুলে শিক্ষকের চাকরিও দিতে চাইলেন।
এই প্রশংসা ছেলেটির ভবিষ্যতটাই বদলে দিল, আর ছেলেটি ইংরেজী সাহিত্যের জগতে একটা অমরত্বের ছাপ রেখে দিয়েছিল। কারণ ছেলেটি শেষ পর্যন্ত সাতাত্তরটি বই লেখে আর কলমের জোরে দশ লক্ষ ডলার আয় করে। এই পরিচিত নামটিও আপনাদের জানা। তিনি এইচ. জি. ওয়েলস্।
১৯২২ সাল নাগাত এক তরুণ ক্যালিফোর্নিয়ায় তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রচণ্ড কষ্টে বাস করতো। সে গীর্জায় রবিবারে গান গেয়ে পাঁচ ডলারের মতো আর বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে কিছু রোজগার করতো। তার এতই টানাটানি ছিল যে শহরে থাকার উপায় না থাকায় আঙুর খেতের মাঝখানে একটা নড়বড়ে বাড়িতে থাকতো। এতে মাসে তার সাড়ে বারো ডলার খরচ হতো। কিন্তু ভাড়া কম হলেও সে তা দিতে পারতো না, ভাড়া বাকি পড়েছিল দশমাসের। ও আমায় বলেছিল এমন সময়ও গেছে যখন ওর শুধু আঙুর ছাড়া অন্য কিছু খাদ্য জোটেনি। সে এমনই হতাশায় ভেঙে পড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত গানের জীবিকা ছেড়ে লরী বিক্রির কাজে যোগ দেবে বলেই ঠিক করল। ঠিক তখনই রিউপার্ট হিউজেসের এক ছোট্ট প্রশংসা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। রিউপার্ট হিউজেস বলেছিলেন, ‘তোমার গানের গলা চমৎকার। তোমার নিউ ইয়র্কে গিয়ে গান শেখা উচিত।’
ওই তরুণ সম্প্রতি আমায় বলেছে যে ওই সামান্য প্রশংসাই তার জীবনের মোড় ঘোরানোর দাবী রাখে। কারণ এতে উৎসাহ হয়ে সে আড়াই হাজার ডলার ধার করে পূর্ব দিকে রওয়ানা হয়। ওর নামও আপনারা শুনেছেন–তিনি হলেন লরেন্স টিবেট।
লোকেদের পরিবর্তন করে দেবার কথাই ধরুন। যদি আমি বা আপনি রোজ যাদের সংস্পর্শে আসি তাদের ভিতর সম্পদের কথা প্রকাশ করি, তাহলে মানুষকে আমরা কেবল বদলে দেব না, তাদের আমুল পরিবর্তিত করতে পারি।
বাড়িয়ে বলছি? তাহলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উইলিয়াম জেমসের জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো শুনে নিন। আমেরিকার তিনি হলেন সবসেরা মনস্তাত্ত্বিক আর দার্শনিক। তিনি বলেছিলেন :
‘আমাদের কি রকম হওয়া উচিত তার তুলনা করলে বলতে হয়, আমরা কেবল অর্ধেকটা সম্বন্ধেই সচেতন। আমরা আমাদের শারীরিক আর মানসিক সম্পদের সামান্যই মাত্র কাজে লাগাই। সোজাসুজি বলতে গেলে বলতে হয় একজন মানুষ তার সীমার মধ্যেই কেবল বাস করে। তার মধ্যে নানা ধরনের শক্তি থাকলেও সাধারণতঃ সে তা ব্যবহার করে না।’
হ্যাঁ, আপনারা যারা এই লাইনগুলো পড়ছেন তারা তাদের ক্ষমতার বেশ কিছু সাধারণতঃ কাজে লাগান না। আর আপনার যে ক্ষমতায় অন্য লোকদের প্রশংসা করতে পারেন তাও আপনি করছেন না। তা করলে তারা তাদের সুপ্ত শক্তি সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে।
অতএব অপরকে কুদ্ধ বা বিরক্ত না করে বদলাতে হলে ৬ নম্বর নিয়ম হল :
‘সামান্য উন্নতিতেই প্রশংসা করুন–যেটুকু উন্নতি দেখতে পাচ্ছেন তারই প্রশংসা করুন। আর সেটা আন্তরিকতায় সঙ্গেই করুন।‘