২৭. মা

২৭
১৯৭১ সাল ৷ ফেব্রুয়ারি মাস ৷ আজাদ বাসায় বসে পত্রিকা পড়ছিল ৷ একটা সুবিধা হয়েছে ইদানীং ৷ আবুল বাশার সাংবাদিক হওয়ায় দুটো পত্রিকা ফ্রি পাওয়া যায় ৷ আর একটা আজাদ পয়সা দিয়ে রাখে ৷ সকালবেলা তিনটা পত্রিকা পড়তে পড়তে অনেকটা সময় চলে যায় ৷ আজকে আজাদের বাইরে তেমন কোনো কাজও ছিল না ৷ বেলা ১১টা পর্যন্ত সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনটা পত্রিকাই পড়ে ৷ দেশের পরিস্থিতিও এমন যে, খবরের কাগজ না পড়লে আর ভালো লাগে না ৷
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে ৷ উভয় পাকিস্তান মিলে এটাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ৷ বাংলায় তো সংখ্যাগরিষ্ঠ বটেই ৷ আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে কী হয়, এটাই এখন দেখার বিষয় ৷ পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টো অবশ্য ইতিমধ্যেই ঢাকার অধিবেশনকে কসাইখানা বলে চিহ্নিত করেছেন ৷ আর বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ যদি ৬ দফা পুর্নবিন্যাসের আশ্বাস না দেয়, তাহলে তার দল জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাবে না ৷
এইসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে ৷
পত্রিকা পড়া শেষ করে আজাদ বাথরুমে যায় গোসল করতে ৷
এই সময় সৈয়দ আশরাফুল হক আজাদদের বাসার সামনে আসে তার ভঙ্ ওয়াগনটা নিয়ে ৷ দু বার হর্ন বাজায় ৷ তারপর গাড়ি থেকে নেমে এসে ঢোকে বাসার ভেতরে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হকের কোনো ঘটনাই নয় ৷ প্রায়ই আসে সে ৷ কিন্তু আজকে তার আগমনের মধ্যে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে ৷ সে হাঁক পাড়ে, ‘মা, মা, আজাদ ভাই কই ?’
আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে সাফিয়া বেগম এগিয়ে আসেন-’আজাদ তো এ ঘরেই ছিল ৷ কই যে গেল ৷’
আশরাফুল সাফিয়া বেগমের পায়ের কাছে বসে পড়ে তাঁকে কদমবুসি করে ৷
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘হঠাৎ সালাম যে ৷ কী ব্যাপার, বাবু ?’
আশরাফুল বলে, ‘আছে ব্যাপার ৷ আগে তোমাকে কওন যাইব না মা ৷ তুমি আবার আমার বাসায় কইয়া দিবা ৷ ইট্স আ সিক্রেট ৷’
আজাদ আসে ৷ তার হাতে তোয়ালে ৷ সে মাথা মুছছে ৷
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘কী ব্যাপার আজাদ ৷ বাবু আমার পায়ে সালাম করল কেন রে ?’
আজাদ কিছু বুঝে উঠতে পারে না ৷ সে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘটনা কী ?’
আশরাফুল বলে, ‘আছে ঘটনা আজাদ ভাই, চলো ৷’
‘কই ?’
‘আরে গেলেই তো বুঝবা ৷ আগেই সব কথা কওন লাগব নাকি ? হারি আপ, লেটস গো ৷ মুভ ৷ মা, আমারে দোয়া কইরো ৷ প্রে ফর মি ৷ ইউ আর আ পিয়োর লেডি ৷ আল্লাহ উইল হিয়ার ইয়োর প্রেয়ার ৷’
আজাদ কাপড়-চোপড় গায়ে চাপায় ৷ জুতো পরে ৷ গায়ে সুগন্ধি স্প্রে করে ৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নেয় নিজেকে ৷
সৈয়দ আশরাফুল বলে, ‘আরে, তোমারে এলভিস প্রিসলির মতনই দেখা যাইতেছে ৷ আর সাজতে হইব না ৷ টুডে ইজ নট ইয়োর ডে ৷ দিস ইজ মাই ডে ৷’
‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার বাবু ?’ আজাদ চোখ সরু করে তাকায় আশরাফুলের দিকে-‘সাবেরা কই ?’
‘চলো তো তাড়াতাড়ি ৷’
তারা গেটের বাইরে আসে ৷ আজাদ দেখে, আশরাফুলের ভঙ্ ওয়াগন গাড়িটা দাঁড়িয়ে ৷ সে সামনের সিটে আশরাফুলের পাশে বসে ৷
‘কী ব্যাপার বলো তো ?’ আজাদ রিয়ার ভিউ মিররের দিকে হেলে পড়ে নিজের চেহারাটা দেখে নিয়ে বলে ৷
‘আছে ব্যাপার ৷ বিয়া করনের লাইগা যাইতাছি ৷’
‘বলো কি ?’
‘হ ৷ দেশের যে পরিস্থিতি, সাবেরা কই থাকব, আমি কই থাকুম, উই শুড নট টেক এনি রিস্ক, ইটস বেটার টু গেট ম্যারিড নাউ ৷ তার উপরে আবার নিউজিল্যান্ড টিম আসতেছে ৷ খেলা দেখতে হইব না ?’
‘ওকে ৷ শুভস্য শীঘ্রম ৷ দ্যাটস আ গুড নিউজ ৷ এখন আমরা কোনদিকে যাচ্ছি ?’
‘নিউমার্কেটের মোড় থাইকা সাবেরাকে তুলতে হইব ৷ হ্যারিস, জুয়েল, ফারুক-অরা সব মগবাজার কাজি অফিসে গেছে ৷ সবকিছু রেডি কইরা রাখব ৷ আমরা খালি যামু আর বিয়া পড়ুম ৷’
আজাদ চুপ করে থাকে ৷
‘ডোন্ট ইউ লাইক দিস আইডিয়া ?’
‘অফ কোর্স ৷ হোয়াই নট ৷ সাবেরা থাকবে তো ?’
‘শিয়োর ৷ ওরে ঘরের থন বাইর কইরা না আমি তোমারে নিতে আইলাম ৷’
‘আর যদি না আসে ?’
‘এ কথা ক্যান কইলা আজাদ ভাই ৷ তুমি তো সাবেরারে খুব ভালো কইরাই জানো ৷ সে কি যেমন-তেমন মেয়ে ? শি ইজ সিরিয়াস ৷’
‘আরে না ৷ বিয়ে সম্পর্কে মেয়েদের কতগুলো স্বপ্ন থাকে ৷ তারা বেশ ঘটা করে বউ-টউ সেজে গায়ে হলুদ করে বিয়ে করতে চায় ৷ সেই জন্যে বললাম আর কি ?’
‘সেটাও করন যাইব ৷ দ্যাট উই উইল শিয়োরলি ডু ৷ আগে রেজিস্ট্রি কইরা ফালাই তো ৷’
ভঙ্ ওয়াগন নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছে ৷ বসন্তকাল এসে গেছে ৷ রমনার সামনের রাস্তার গাছে গাছে বেগুনি রঙের ফুল, মনে হচ্ছে আশরাফুল আর সাবেরার বিয়ে উপলক্ষে এই বিশেষ আয়োজন ৷ গাড়ির জানালা দিয়ে আসা বাতাসটাও দারুণ আরামদায়ক ৷ আমগাছের পাশ দিয়ে গেলে মুকুলের গন্ধ এসে নাকে লাগে ৷ রাস্তায় একটা মিছিলও চোখে পড়ে ৷ কোনো একটা পেশাজীবী সংগঠনের মিছিল ৷ দু লাইনে সার বেঁধে খুবই ভদ্রতা বজায় রেখে যাচ্ছে ৷ সামনের ব্যানারে লেখা: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা ৷’ আজাদও এই স্লোগানটা অনেকবার মিছিলে দিয়েছে বটে, কিন্তু মানেটা ঠিক বুঝতে পারেনি ৷ তবে ‘পিন্ডি না ঢাকা ? ঢাকা ঢাকা’-এই স্লোগানটার মানে তার কাছে স্পষ্ট ৷
নিউমার্কেটের আজিমপুরের দিকের গেটের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায় ৷ এখানেই সাবেরার থাকার কথা ৷ কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না ? আশরাফুলের বুকটা কেঁপে ওঠে ৷
সে হর্ন দেয় ৷
তখনই নিউমার্কেটের ভেতর থেকে সাবেরা উদিত হয় ৷ শাড়ি পরা সাবেরাকে দেখতে সত্যি সুন্দর লাগছে ৷ বিয়ের আগে মেয়েরা কি বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে ? আজাদ ভাবে ৷
আজাদ গাড়ি থেকে নামে ৷ বলে, ‘সাবেরা, ইউ বেটার সিট ইন দ্য ফ্রন্ট সিট ৷’
আশরাফুল ড্রাইভিং সিটে বসা, সে জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলে, ‘না, না ৷ কেউ দেখে ফেলতে পারে ৷ সাবধানের মার নাই ৷ সাবেরা, তুমি পেছনে ওঠো ৷’
সাবেরা গাড়িতে উঠে বলে, ‘দ্যাখেন তো আজাদ ভাই, আশরাফুলের কাণ্ড…’
আজাদ বলে, ‘রাইট মোমেন্টে এটা হলো রাইট ডিসিশন ৷ ইউ আর ডুয়িং দ্য রাইট থিং ৷’
গাড়ি একটানে চলে আসে মগবাজার কাজি অফিসের সামনে ৷ জুয়েল এগিয়ে আসে, ‘হেই এত দেরি ক্যান ? আমি তো ভাবলাম, আমগো বসায়া রাইখা তোমরা গাছের মগডালে উইঠা পড়ছ, টোনাটুনি ডাকিয়া উঠিল, টুন-টুন-টুন ৷’
তারা কাজি অফিসের ভেতরে ঢোকে ৷ হ্যারিস, ফারুককেও দেখা যায় ভেতরে ৷
একটা অফিসঘরের মতো ঘর ৷ দেয়ালে মক্কা ও মদিনা শরিফের ছবি ৷ এক কোণে কাজি সাহেবের চেয়ার-টেবিল ৷ একটা দেয়ালের পাশে লম্বা সোফা ৷ কাজি সাহেব মধ্যবয়স্ক, শ্মশ্রুমণ্ডিত ৷ সম্ভবত দাড়িতে মেহেদি মাখা ৷ তার মুখটা হাসি হাসি ৷ মাথায় জিন্নাহ টুপি ৷ তাঁর চেহারার মধ্যে এমন কিছু আছে, দেখলে মনে হয় পান খেয়ে দাঁত লাল করে রেখেছেন ৷ কিন্তু আশ্চর্য যে তাঁর দাঁত খুবই পরিষ্কার ৷ মনে হয় তিনি পাঁচ ওয়াক্ত মেসওয়াক করেন ৷
জুয়েল বলে, ‘কাজি সাহেব, এই যে বর আর কন্যা আইসা পড়ছে ৷ নেন ৷ আল্লাহর নামে শুরু করেন ৷’
কাজি সাহেব তার মোটা রেজিস্ট্রি খাতা বের করেন ৷ আশরাফুল আর সাবেরার সামনে ফরম মেলে ধরেন ৷ তারা পূরণ করতে লেগে যায় ৷ হ্যারিস যায় মিষ্টি কিনে আনতে ৷
কাজি সাহেব বলেন, ‘মেয়ের ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট আনছেন ?’
‘না ৷ তা তো আনা হয় নাই’-আশরাফুল বলে ৷ তার বুক কেঁপে ওঠে ৷ তীরে এসে না তরী ডুবে যায় ৷
জুয়েল বলে, ‘ম্যাট্রিক পাস ছাড়া মেয়ে বিয়া দেওন যায় না, নাকি ? নতুন নিয়ম ? ইয়াহিয়া খানের ?’
কাজি সাহেব হেসে বলেন, ‘না, কনের বয়সের প্রমাণ ৷’
জুয়েল বলে, ‘ও তো আমগো চাইতে বড় ৷ আমরা সবাই বিএ পাস ৷ মেয়েও এমএ পাস ৷’
আজাদ বলে, ‘এই জুয়েল, ইয়ারকি কোরো না ৷ হুজুর পাজ্লড হয়ে যাবেন ৷’
ফরম পূরণ করা হয়ে গেলে সাক্ষীর ঘরে জুয়েল, আজাদ আর ফারুক স্বাক্ষর করে ৷
কাজি সাহেব দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেন ৷ সাবেরা তার ঘোমটাটা বাড়িয়ে দেয় ৷ আশরাফুল একটা টুপি মাথায় চাপায় ৷
কাজি সাহেব মোনাজাতের সময় চমৎকার চমৎকার কথা বলেন ৷ হজরত আদমের সঙ্গে বিবি হাওয়ার যে সম্পর্ক ছিল, হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে হজরত আয়েশা(রা)-র যে এশ্ক ছিল, সে রকম মহব্বত যেন এই মিয়া-বিবির মধ্যে পয়দা হয়, এবং রোজ কিয়ামত পর্যন্ত যেন তাদের এশ্ক অটুট থাকে, তিনি দোয়া করতে থাকেন ৷
দোয়া শেষ হলে ফারুক কাজি সাহেবের পাওনা বুঝিয়ে দেয় ৷
ব্যস ৷ বিয়ে হয়ে গেল ৷ আজাদ বিস্মিত ৷ বিয়ে করা এত সোজা ? এই জন্যে তো লোকে বলে, মিয়া-বিবি রাজি তো কিয়া করেগা কাজি ৷
জুয়েল বলে, ‘লেটস গো টু দি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল ৷ উই উইল হ্যাভ আওয়ার লাঞ্চ দেয়ার ৷’
আশরাফুল বলে, ‘অত টাকা তো নাই ৷ কাজি সাহেবের ফি দিতেই তো ফতুর ৷ ক্যাফে ডি তাজে চলো, বিরিয়ানি খাওয়ায়া দেই ৷’
আজাদ বলে, ‘দরকার কী ? আমার বাসায় চলো সবাই ৷ মাকে বললেই তো মা নাচতে নাচতে রাঁধতে বসে যাবে ৷ চলো ৷’
‘সেই ভালো ৷ ইলিশ-পোলাও হইব ৷ আম্মার হাতের ইলিশ-পোলাও ? উফ্ ৷ মাই মাউথ ইজ অলরেডি ওয়াটার্ড’-জুয়েল বলে ৷
তারা আজাদদের বাসায় যায় ৷ আজাদ জায়েদকে কাওরানবাজারে পাঠায় ইলিশ মাছ কিনতে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হক আর সাবেরা গিয়ে সালাম করে আজাদের মাকে ৷
মা হাসেন, ‘কী ব্যাপার ?’
আশরাফুল হেসে বলে, ‘আছে ব্যাপার ৷ ইলিশ-পোলাওটা আজকা স্পেশাল কইরা রাইন্ধো তো মা ৷’
মা আশরাফুল আর সাবেরার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *