ভাষার চরিত্ৰহানি
জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর টাকাকড়ি রেখে গিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার বানান সংস্কারের জন্যে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় চলে গেছে। তবু কেউ ইংরেজি বানান সংস্কার করেননি, অথবা করতে পারেননি। তার কারণ, ভাষার পরিবর্তন সম্পর্কে সবাই কমবেশি রক্ষণশীল। কিন্তু এ রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার বিবর্তন হবে–এটা না-মেনে উপায় নেই। জীবন্ত ভাষা কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না। নিরন্তর তার মধ্যে ঘটতে থাকে পরিবর্তন। তবে বিবর্তন মাত্ৰই যে উন্নতি, সে কথা বলা যায় না। বাংলা ভাষায়, বিশেষ করে বাংলা গদ্যে, গত এক শো বছরে যে-পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তা সত্যিকার অর্থেই যুগান্তকারী। যুগান্তকারী, কারণ এ সময়ে সাধু ভাষার যুগ শেষ হয়ে চালু হয় চলিত ভাষার যুগ। তাই বলে এই এক শতাব্দীতে বাংলা ভাষা কি কেবলই সামনের দিকে এগিয়েছে?
বাংলা ভাষায় যুগান্তর আনায় প্রধান ভূমিকা ছিলো রবীন্দ্রনাথের। চলিত ভাষার প্রতি গোড়া থেকেই তার পক্ষপাত ছিলো। একেবারে প্রথম যৌবনে ইউরোপ থেকে যে-চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন প্রকাশের জন্যে, তা লিখেছিলেন চলিত ভাষায়। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোও। কেবল চিঠি নয়, ১৮৯০-এর দশকে তিনি গল্পগুচ্ছের ভাষায় ক্রিয়া-বিভক্তিগুলো সাধু ভাষায় লিখলেও, সর্বনামে পরিবর্তন আনতে আরম্ভ করেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তখন প্রমথ চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তাঁর সব রচনাই তিনি লিখতে আরম্ভ করেন চলিত বাংলায়। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে তাঁর এই ভাষাই প্রামাণ্য বাংলা হিশেবেই গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ একাই ছিলেন এক শো। তাঁর অতুলনীয় প্রতিভা দিয়ে তিনি যা কিছু স্পর্শ করেছেন, তাকেই নতুন জীবন দিয়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা ইত্যাদি সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য নয়, এ কথা পুরোপুরি সত্য বাংলা ভাষা সম্পর্কেও। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে আমরা তাঁর ভাষায় কথা বলি, তার ভাষাতে লিখি এবং তার ভাষাতে চিন্তা করি। বাংলা ভাষার বিবর্তনে যদি ব্যক্তির অবদানের কথা বলতে হয়, তা হলে যে-দুজনের নাম সবার আগে মনে পড়বে তাঁরা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ। তবে সাধু ভাষার যুগ শেষ করে একেবারে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এঁরা দুজনেই ছিলেন অসামান্য শক্তির অধিকারী। অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন। বহুজনের অবদানে ভাষায় যে-বীর পরিবর্তন আসে, তাদের আনা পরিবর্তন সে প্রকৃতির নয়। তাঁরা বাংলা ভাষায় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মতোন দুজন শিল্পী। তাঁদের পথ অনুসরণ করে আমরা বাংলা ভাষাকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু বাংলা ভাষায় গত পঞ্চাশ বছরে যে-নেতৃত্ব লক্ষ্য করছি, তা মধ্যম শ্রেণীর লোকেদের। তার ফলে বাংলা ভাষা তার উর্ধ্বগতি অক্ষুন্ন রাখতে পারছে কিনা, আমাদের প্রশ্ন সেটাই।
চলিত রীতির বাংলায় কেবল ক্রিয়া-বিভক্তি এবং সর্বনামগুলোই সাধু ভাষা থেকে ভিন্ন নয়। সাধু ভাষার অনেক শব্দও চলিত ভাষায় অচল। তাই সাধু ভাষার যুগ শেষ হওয়ার ফলে অসংখ্য শব্দ অপ্রচলিত শব্দ হিশেবে অব্যবহার্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া, সাধারণভাবে বলা যায়, চলিত ভাষার চরিত্রও তরল। এই দুই লক্ষণ মিলে বাংলা ভাষার প্রকাশক্ষমতা কমেছে বলেই ধারণা হয়। সৌন্দৰ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের মতো অতুলনীয় শিল্পীর হাতে বাংলা ভাষা সরল হয়েও, তার সৌন্দর্য এবং প্রকাশক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছিলো। কিন্তু তাঁর পরে অসংখ্য সাধারণ লেখকের হাতে পড়ে চলিত রীতির বাংলা ভাষা অতীতের অর্জনকে ধরে রাখতে পেরেছে কিনা, তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন করা যেতে পারে। অন্তত সাম্প্রতিক কালের বাংলা গদ্য–বিশেষ করে খবরের কাগজের গদ্য পড়ে এ কথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
কলকাতার খবরের কাগজের ভাষা পড়লে, বিশেষ করে সে ভাষার পদক্রম দেখলে, ধারণা হয় যে, এলিয়ে-পড়া সেই গদ্যের কোনো মেরুদণ্ড নেই। তিনবার কাশলেন রাজ্যপাল–এটি কোনো সংবাদ-শিরোনামে আমি পড়িনি, কিন্তু বেশির ভাগ শিরোনামই এ রকম। “কোটে আত্মসমৰ্পণ করতে ফোন নেতার”–এ বাক্যটি আমার বানানো নয়, পত্রিকা থেকেই উদ্ধৃত করেছি। একবার পড়ে এর অর্থ উদ্ধার করতে হলে রীতিমতো প্রতিভার প্রয়ােজন। “সরকারী গাড়িতেই বেশি দূষণ, মানলেন সুভাষ”, “চাপে পড়েই দেশে ফেরার প্রস্তাব দাউদের” ইত্যাদি বাক্য অথবা অনুবাক্য দুর্বোধ্য হওয়ার কারণ পদক্রমের সাধারণ নিয়ম লঙ্ঘন। কাব্যে এ ধরনের পদক্রম সব সময়ই চলে। গদ্যেও বৈচিত্ৰ্য বাড়ানোর জন্যে মাঝে-মাঝে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সেটাই বারবার ব্যবহার করলে তা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। আচার দিয়ে খাদ্যকে আমরা সুস্বাদু করতে পারি। কিন্তু শুধু আচার খাদ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না।
কেবল শিরোনাম নয়, অনেক সময় বাক্যগঠনেও শৈথিল্য লক্ষ্য করি। যেমন, “কাশীর সমস্যার সঙ্গে দাউদ প্রত্যার্পণের বিষয়টিকে সরাসরি যুক্ত না করলেও, সুযোগ পেলেই আন্তর্জাতিক মহলকে বিদেশ মন্ত্রক যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছে।”— বাক্য হিশেবেই এটি ত্রুটিপূর্ণ–এর অর্থ হয় না। কিন্তু কলকাতার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোয় এ ধরনের বাংলা লেখা হচ্ছে। আর-একটি অসাধারণ জিনিশ লক্ষ্য করি সংখ্যার সঙ্গে টা, টি, জন ইত্যাদি সংখ্যাচক বিভক্তি ব্যবহার না-করার প্রবণতা। ফলে “নিহত ৩, আহত ২”, “৫ পুলিশ বরখাস্ত”-এর মতো অদ্ভুত প্রয়োগ লক্ষ্য করি। এটা ইংরেজি, বাংলা নয়। বর্তমান কলকাতার পত্রিকায় যে-ভাষা। ষাটের দশক থেকে গড়ে উঠেছে, এক কথায় বললে, তার প্রকাশক্ষমতা সীমিত। সে গদ্যের চরিত্র উচ্ছাসপূর্ণ, ফেনানো, কাব্যিক। শব্দ ব্যবহারের কথা বললে তাতে ক্রমবর্ধমান হিন্দীর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়।
কলকাতার টেলিভিশনেও এ ধরনের ভাষায় বাংলা খবর শুনতে পাই। খবরের কাগজের তুলনায় টেলিভিশনের ভাষা সাধারণত মুখের ভাষার আরও কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু সে ভাষাকে ক্রমশ নিম্নগামী হতে দেখে বিষন্ন না-হয়ে পারিনে। বিলেতের টেলিভিশনে দেখতে পাই, নাট্যানুষ্ঠান অথবা সোপ অপেরায় একেবারে সাধারণ মানুষের ভাষাও ব্যবহৃত হয়। এমন কি, খবরের মধ্যেও যখন সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার থাকে, তাতেও শোনা যায় এ ভাষা। কিন্তু মূল খবরের ভাষা হলো প্রামাণ্য চলিত ভাষা। তার উচ্চারণও প্রামাণ্য–আঞ্চলিক নয়। ডকুমেন্টারি সম্পর্কেও এই কথা প্রযোজ্য। পোশাকের সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারি, বাড়িতে লুঙ্গি পরা যায়, কিন্তু বাইরে যেতে হলে প্যান্ট-শার্ট পরতে হয়। একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার ওপর টাই না-হোক অন্তত একটা কোট চাপাতে হয়। আর চাকরির সাক্ষাৎকারে যেতে হলে সুট পরে যেতে হয়। খবরের ভাষা–তা লেখ্য মাধ্যম, অথবা ইলেট্রনিক মাধ্যম যাতেই হোক না কেন–তাকে খানিকটা আনুষ্ঠানিক ভাষা হতে হয়। প্রবন্ধের ভাষা হতে হয়। সবচেয়ে ফর্ম্যাল। শিবনারায়ণ রায় অথবা মুনীর চৌধুরীর মতো লেখকরা প্রবন্ধের ভাষায় সেই আনুষ্ঠানিকতা অনেকটাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম ভাষাকে অতি তরল করে দিয়েছে।
চলিত বাংলা প্রথম প্ৰচলিত হয়েছিলো কলকাতাতেই। এই বিবর্তনকে গ্ৰহণ করার ব্যাপারে পূর্ব বাংলা ছিলো পিছিয়ে। এখন চরিত্ৰহানির যুগেও কলকাতা সামনে এগিয়ে আছে, ঢাকা আছে খানিকটা পিছিয়ে। কিন্তু ঢাকা যে কলকাতাকে অনুসরণ করে একই পথে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে বিশেষ সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের শিরোনামেও সংখ্যাবাচক এবং তারিখবাচক বিভক্তি লোপ পেয়েছে। তবে ঢাকার ভাষা এখনো কলকাতার মতো অতোটা “আধুনিক” হতে পারেনি। বাংলাদেশের খবরের কাগজের ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাতে কলকাতার দোষগুলোকাব্যিক পদক্রম, অতি-চলিত শব্দ (স্ল্যাং), সংখ্যাবাচক বিভক্তি লোপ–ইত্যাদি। তুলনামূলকভাবে কম হলেও এগুলো ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। তা ছাড়া, ঢাকাই সংবাদপত্রের ভাষায় আছে সংস্কৃত ও আভিধানিক পরিভাষা, আরবি-ফারসির অত্যধিক ব্যবহার এবং আঞ্চলিক শব্দ ও প্রয়োগের ছড়াছড়ি। তবে এক কথায় বলা যায়, ঢাকার পত্রিকার ভাষা কলকাতার মতো ফেনানো নয়; তাতে সাধু ভাষার প্রভাব এখনো খানিকটা রয়ে গেছে এবং পদক্রম এখনো অতোট এলিয়ে পড়েনি। কিন্তু ঢাকার সংবাদ মাধ্যমও কলকাতার মতো “আধুনিক” হয়ে উঠতে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে।
বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ— যারা বাংলা গদ্যকে নির্মাণ করেছিলেন, তারা দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন না। খবরের কাগজ পড়েও তারা বাংলা শেখেননি। বরং তাদের ভাষা শিখেই প্রভাবিত হয়েছেন খবরের কাগজের রিপোর্টার। বস্তুত, সংবাদপত্র চিরকাল প্রামাণ্য ভাষাকে অনুসরণ করেছে–সংবাদপত্র প্রামাণ্য ভাষা গড়ে তোলেনি।
আমার আশঙ্কা হচ্ছে: লেখাপড়া থেকে আরম্ভ করে সবকিছু যখন নিম্নমুখী, তখন ভাষাও উল্টো পথে চলতে শুরু করবে। অর্থাৎ যোগ্য লেখকরা ভাষাকে নতুন পথ দেখাবেন না, বরং মাঝারি সাংবাদিক ভাষাকে অধঃপথে নিয়ে যাবেন। খবরের কাগজের এই ভাষা সব ধরনের ভাষাকেই ধীরে ধীরে প্রভাবিত করবে। খবরের কাগজের ভাষা দিয়ে নব্য ঔপন্যাসিক তার উপন্যাস লিখবেন। সংবাদপত্রের ভাষাকেই অনুসরণ করবেন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ। গুরুগম্ভীর শব্দ এবং সমাসবদ্ধ পদ উধাও হয়ে যাওয়ার ফলে বাংলা ভাষার যে-প্রকাশক্ষমতা, পৌরুষ এবং সৌন্দর্য ছিলো, তা হ্রাস পাবে। এলিয়ে-পড়া এবং কাব্যিক পদক্রমই প্রামাণ্য বলে বিবেচিত হবে। এর দরুন সবচেয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে প্ৰবন্ধের ভাষা।
খবরের কাগজী মেরুদণ্ডহীন ভাষা দিয়ে কোনো মতে একটা খবর যদি বা প্ৰকাশ করা যায়, একটা প্ৰবন্ধ, বিশেষ করে কোনো গুরুগম্ভীর বিষয়ে, লেখা যায় না। আমার ধারণা, বঙ্কিমচন্দ্রের আরও কিছুকাল বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিলো। অতো কম বয়সে মরে গিয়ে তিনি আমাদের ভাষাকে মেরে গেছেন। তিনি যেমন বাংলায় গল্প লেখার অসাধারণ ভাষা নির্মাণ করেছিলেন; তেমনি প্রবন্ধের ভাষাও তার হাত ধরেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলো। এমন কি, তিনি যখন তাঁর ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলো লিখেছেন, তখনো বুদ্ধিদীপ্ত ভাষাকে তরল করে ফেলেননি। স্থূলতারও আশ্রয় নেননি। বরং শব্দচাতুর্য দিয়ে পাঠকের মন রাঙিয়েছেন। প্রবন্ধের একটা ঋজু এবং দৃঢ় কাঠামোও তিনি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধে যেমন বিষয়বস্তু সম্পর্কে তথ্য এবং বিশ্লেষণ থাকতো, তেমনি তার মধ্যে দেখা যেতো তাঁর একেবারে নিজস্ব স্টাইল।
রবীন্দ্ৰনাথ বাংলা ভাষায় পরিবর্তন এনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়েও বেশি। তিনি তাকে যে-সরলতা এবং সৌন্দৰ্য দান করেছিলেন, সেটাই অতঃপর অন্য লেখকরা গত আশি নকবুই বছর ধরে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তিনি সাহিত্যের অন্যান্য ধারার প্রভূত উন্নতি করলেও, আমার ধারণা, পরোক্ষভাবে প্রবন্ধ সাহিত্যকে দুর্বল করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্ৰ প্ৰবন্ধকে যে-কাঠামো এবং দৃঢ়তাপূর্ণ ভাষা দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাকে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছিলেন। তাঁর চলিত রীতির গদ্য এবং ব্যক্তিগত ও কাব্যিক প্ৰবন্ধ লেখার স্টাইল দিয়ে বাংলা প্ৰবন্ধ সাহিত্যকে উন্নতির পথ থেকে বিচলিত করেছিলেন। তবে অসামান্য প্ৰতিভাবান লেখক হিশেবে তিনি তার ভাষা এবং স্টাইল দিয়ে যা পেরেছিলেন, কম ক্ষমতাশালী লেখকের জন্যে তা ছিলো চোরাবালিতে পা দেওয়ার মতোন। বাংলা আনুষ্ঠানিক ভাষা এখন সেই চোরাবালিতেই ডুবে যাচ্ছে।
প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, কলমের ভাষাকে মুখে দিলে মুখে কালি লেগে যায়। তাঁর এ কথার মধ্যে সত্য আছে ঠিকই, কিন্তু এর পুরোটা সত্য নয়। তিনি নিজেও সত্যিকার মুখের ভাষায় লিখতে পারেননি। অথবা তিনি যে-ভাষায় লিখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ বর্জন করে তিনি প্রতিদিন কথাবার্তা বলতে পারেননি। আসলে মানুষ একএকটা পরিবেশে এক একটা ভাষায় কথা বলে। পরিবার-পরিজনের মধ্যে প্রতিদিন যে-কাজের ভাষা ব্যবহৃত হয়, বন্ধুদের সঙ্গে মননশীল আলোচনায় সে ভাষা চলে না। একটা খবর যা দিয়ে বলা যায়, সে ভাষায় একটা তত্ত্ব আলোচনা করা যায় না। যেভাষায় গল্প লেখা যায়, তা দিয়ে দার্শনিক প্ৰবন্ধ রচনা করা সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক কালে বঙ্কিমচন্দ্ৰ অথবা রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো শিল্পী আমাদের পথ দেখাচ্ছেন না। সাধারণ পাঠকও এখন আর প্রামাণ্য সাহিত্য পড়েন না। স্কুলকলেজেও ভাষা শিক্ষার মান নিচে নেমে গেছে। সাধারণ মানুষ যা এখনো মাঝেমধ্যে পড়েন, তা হলো সংবাদপত্র। ফলে সংবাদপত্রের ভাষাকেই তারা আদর্শ ভাষা হিশেবে গ্রহণ করছেন। সৎ সংবাদপত্র চিরদিনই একটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে। আমার বিশ্বাস, বাংলা ভাষার মান যখন লক্ষণীয়ভাবে নেমে যাচ্ছে, সেই সংকটের সময়ে সংবাদপত্রের উচিত ভাষাকে আবার খানিকটা শক্তি দেওয়া; আনুষ্ঠানিকতা দেওয়া; এবং বানানকে প্রামাণ্য রূপ দেওয়া।
(দৈনিক স্টেটসম্যান, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬)