২৭. বিয়ে

বিয়ে

: তোমার বয়স কত, মেয়ে?

: আটাশ।

: তুমি আমার মেয়ের বয়সি।

: আপনার মেয়ে আছে? সে কোথায়?

: নিরুত্তর।

: বললেন না তো আপনার মেয়ে কোথায়!

: নাই। অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খাওয়াতে নষ্ট হয়ে গেছে।

: অহ্। কিন্তু ঘুমের ওষুধে বাচ্চা নষ্ট হয়?

: হয় বোধ হয়। আমার নাম দেখো মরিয়ম, ডাকনাম মেরি। মরিয়ম বা মেরিদের বিয়ে হলে বাচ্চা হয় না। বাচ্চা হলে বিয়ে হয় না।

মমতাজের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ছাড়াও মরিয়মের আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়েটা তাকে ধরেবেঁধে দেয় মহল্লার লোকজন একটা ভুল লোকের সঙ্গে। আবেদ সামিরকে আটকে রেখে কাজি এনে বিয়ে পড়ালে তা-ও কথা ছিল। তাহলে আজ ২৪ বছরের একটা সন্তান থাকত মরিয়মের। তবে বললাম না আমার ভালো নাম মরিয়ম, ডাকনাম মেরি!

মরিয়ম পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টের পর বুঝতে পারে তার পেটে বাচ্চা এসেছে। তখন সে কপর্দকশূন্য। ভাত খাওয়ার টাকা নেই, গর্ভপাত করাবে কী দিয়ে। খিদায় আর দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অন্ধকারে ঘর-বাহির করে। ঠিক ২৫ মার্চের আগের দিনগুলোর মতো–মন্টু বাড়ি চলে গেছে আর মেরি অপেক্ষা করছে আবেদ জাহাঙ্গীরের। চারপাশটাও তখনকার মতো থমথমে। হাজি সাহেবের বাড়ির সামনের ইলেকট্রিক পিলারে বাঁধা নতুন আরেকটা কুকুর সারা রাত চিৎকার করত। দেশে সামরিক শাসন চলছে। মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ। সাড়ে চার বছর পর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবেদ জাহাঙ্গীর কুকুরের চিৎকার উপেক্ষা করে কালো গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। লোহার পাল্লায় টোকা দিয়ে ডাকে–মেরি!

মরিয়ম জেগেই ছিল। সে ভাবে দরজায় টোকা মারছে যে, সে আবেদ সামিরই হবে। কাব্যসাধনার পথ বড় পিছল। তাই পিছলে পিছলে ফের এ বাড়ির দরজায় চলে এসেছে। মরিয়মের আনন্দ হয়, স্বস্তিও লাগে। সে শুয়ে শুয়ে সুখ উপভোগ করে। কিন্তু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যে, তার মনে সুখ নেই। সামান্য বিলম্বে সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। সে অধৈর্য হয়ে বারবার ডাকে–মেরি! মেরি! গলাটা এবার মনে হয় অচেনা। এত রাতে আবার কে আসলো। আমি আবেদ, আবেদ, মেরি! একটানে মরিয়ম গেটের হুড়কো খুলে দিতে যে লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাস্নাহেনার ঝোঁপের পাশে এসে দাঁড়ায়, সে আবেদ সামির নয়, আবেদ জাহাঙ্গীর। এটা কি ১৯৭১ সাল, না ’৭৫? মরিয়ম মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়।

আবেদ জাহাঙ্গীর দিনরাত ঘরে লুকিয়ে থাকে আর পকেট থেকে টাকা বের করে। মরিয়ম সেই টাকা দিয়ে বাজার করে কেরোসিনের স্টোভে রান্না চড়ায়। খাওয়ার মতো সুখ কিছুতে নেই। এদিকে পেটটা বড় হচ্ছে। আবেদ মরিয়মের গর্ভপাতের খরচ বহন করে। আর দিন গোনে। অক্টোবর মাসটা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। নভেম্বরের ৩ তারিখ আবেদ গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে কু হয়েছে। শোনা যায়, তিনি আওয়ামী লীগের সাপোর্টার আর ভারতপন্থি। যদিও তার তদারকিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সেদিনই বিমানযোগে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবেদ জাহাঙ্গীর ৪ নভেম্বর বিজয় মিছিল থেকে ফিরে এসে মরিয়মকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মেরি, ইতিহাস থেকে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আমরা সুখী হব।’ পরদিন সেন্ট্রাল জেলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতার খুন হওয়ার বিলম্বিত সংবাদ আসে। দুদিন পর আরো খারাপ খবর। ক্যান্টনমেন্টে সিপাহিরা বিপ্লব করেছে–সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। অথচ খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে তারা ক্ষমতায় বসায় জিয়াউর রহমানকে, যিনি সেপাই নন। দেশে এসব কী হচ্ছে! আবেদ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বিয়ের ব্যাপারে আর উচ্চবাচ্য করলেও ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সে এ বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে শুরু হয় তার বাইরে ঘোরাঘুরি। ‘দেশ স্থিতাবস্থার দিকে যাচ্ছে, মেরি’, একেক দিন ফিরে এসে আবেদ বলে, ‘রক্তারক্তির পর পরিস্থিতি মনে হয় শান্ত হচ্ছে। তবে কখন কী হয় বলা যায় না।’

মরিয়মের বুকে খালি বুটের দুপদাপ আওয়াজ। একদল বেরিয়ে যায় তো আরেক দল ঢোকে। যদিও দেশ নিয়ে সে ভাবে না, আবেদের বিয়ের প্রতিশ্রুতিতেও তার আস্থা নেই, তবে তার অন্নদাতা যেভাবে বাইরে ঘুরাঘুরি করছে, সে যে দিন শেষে ফিরে আসবে ভরসা কী। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এত দিন পর মরিয়ম নিজেকে হঠাৎ এতিম ভাবে। ‘তোরা আমার মা, তোরা বীরাঙ্গনা।’ পুতুলমাস্টারের অনুপস্থিতিতে ঝুলকালি মাখা পরিত্যক্ত পুতুলের দশা হয়েছে ওর। কোনোদিন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় জনসমক্ষে আর নাচা হবে না। ঘরের কোণে পড়ে পড়ে জীবনটা শেষ হবে।

‘মেরি, আজ আমার বাসায় গিয়ে দেখলাম আড়শোলা-চামচিকা নেত্য করছে । দুজন লোক লাগাতে হলো বাড়িটা মানুষ করার জন্যে।’ আবেদের বাড়ি সাফ করার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনতে শুনতে মরিয়ম জনসমক্ষে নাচতে না-পারার দুঃখটুকুও ভুলে যায়। এই লোকটা চলে গেলে তো না খেয়ে মরতে হবে তাকে। পরাজিত সেনাপতিরা সব কি মরে গেল, আরেকটা পাল্টা কু হচ্ছে না কেন? আবেদ তাহলে গা-ঢাকা দিয়ে এ বাড়িতেই থাকত। আর মরিয়ম টাকা হাতে চলে যেত বাজারে–চাল-ডাল তরিতরকারি সওদা করে খুশিতে ডগমগিয়ে ফিরত। দেশ যাক রসাতলে। জীবনে খাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবনা নেই। এ সময়টায় মরিয়ম গায়ে-গতরে এত মোটা হয় যে, ব্লাউজের সেলাই খুলে পরতে হচ্ছিল। যা হোক, সে আরেকটা কুয়ের আশঙ্কার কথা বলতে আবেদ হাসে, ‘না মেরি, তার আর সম্ভাবনা নাই। গতকাল কাকডাকা ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়ে গেছে।’ এবার সে মরিয়মের ওপর বিরক্ত হয়। ‘সারা দিন ঘরে বসে কী করো? খবরের কাগজটাও ঠিকমতো পড়ো না দেখি! জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে বসেছেন। ব্যবসার লাইনঘাট ঠিক করার এখনই সময়।’

ব্যবসার লাইনঘাট করে আবেদ নিজের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। ‘আমার কী হবে, আবেদ?’ মরিয়ম ওর জামা খামচে ধরে, ‘আমার জীবন কাটবে কীভাবে?’ আবেদ বলে, ‘জামা ছাড়ো, মেরি। এমন আচরণ বাজে মেয়েরা করে। চিন্তা কারো না। তোমার চাকরির জন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছি।’

সপ্তাহ খানেক পর একটা ভালো খবর, আরেকটা খারাপ খবর নিয়ে আসে আবেদ। একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে মরিয়মের চাকরি প্রায় হয়েই গেছে বলা যায়। দুই মিনিটের ছোট্ট একটা মৌখিক ইন্টারভিউয়ের পর সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগপত্র দিয়ে দেবে। বেতন শুরুতে বারো শ’। এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেলে পরের বছর বেড়ে দ্বিগুণ হবে।

কতগুলো টাকা মাস শেষে! আহা এজেন্সিটা দাঁড়ায় যেন। মরিয়ম চেয়ার এগিয়ে দিলেও আবেদ বসে না, দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। কীসের যেন তাড়া ওর। চলে যাওয়ার আগে জরুরি ভিত্তিতে শুধু বলে যায়, তিন দিন হয় স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে ফিরেছে পাকিস্তান থেকে। এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আবেদের বাসায় মেরির যাওয়াটাও শোভন দেখাবে না। তার আরেকটা কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যেরকম উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে, তার শ্বশুর শাশুড়ি যে-কোনো সময় এখানে চলে আসতে পারেন। ‘আসলে বাড়ি-ব্যবসা সব তো ওনাদের,’ আবেদ বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘আমি হেফাজতকারী মাত্র।

আবেদ চলে যাওয়ার পর মরিয়ম একবার হাসে আরেকবার কাঁদে। ইতিহাসের প্রহসন আর তার ব্যক্তিগত জীবন মেশিনের ববিনের সুতোর মতো জড়িয়ে গেছে। তবে উপযুপরি হাসি-কান্নার পর তার মনে হয়, বিয়ের চেয়ে চাকরিটাই ভালো। বাহাত্তর সালে মরিয়ম তো চাকরি চাইতেই আবেদের কাছে গিয়েছিল। তাকে সে ঠকায়নি। চার বছর পর ঠিকই জোগাড় করে দিয়েছে। মতিঝিলে অফিস। সুয়িং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে ছিমছাম কক্ষ। মেঝেতে পুরু কার্পেট। গদি-আঁটা সোফা। কাঁচ ঢাকা টেবিল। স্টাফ মাত্র পাঁচজন। মরিয়ম ছাড়া আরেকটা কমবয়সি মেয়ে আছে। তাদের দুজনের কাজ কাঁচের ঘরে বসে টিকিট বিক্রি করা, টেলিফোন ধরা বা টাইপ করা। আবেদের বন্ধু জামান সাহেব এজেন্সির মালিক কাম ম্যানেজার। মরিয়ম একটা ভুল করে তার কাছে দশটা ধমক খায়। অথচ অন্য মেয়েটিকে তিনি বকাঝকা তো করেনই না, প্রায় দিন কাফে ঝিলে বা স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলায় লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যান। লোকটা প্রথম দিন থেকেই মরিয়মের ওপর বিরক্ত। একদিন ক্লায়েন্টকে ভুল করে দশ টাকা বেশি দিয়ে ফেলে মরিয়ম। অঙ্কে লেটার পাওয়া মেয়ে, তার কেন বারবার হিসাবে ভুল হয়? অথবা হিসাবে তার ভুল হবে না তো কার হবে? মাঝখানে গোনা-গুনতির বাইরে এমন সব ঘটনা ঘটে গেছে, একদিন যে লেটার মার্ক পেয়েছিল, সে মেয়ে আর এ মেয়েতে আজ আকাশ-পাতাল ফারাক। তার ওপর যুদ্ধের বছর সার্টিফিকেট, মার্কশিট খোয়া গেছে। চাকুরি ঠিক করার সময় আবেদ এসব কথা ভেঙে বললেও ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার তা আধাআধি বিশ্বাস করেছেন। ধর্ষণের রগরগে চিত্র তার শরীরে উত্তেজনা জোগালেও পরমুহূর্তে জ্বালা ধরায়। সেই জ্বলুনি থেকে। মেয়েটার অন্য গুণাবলিসহ তিনি খারিজ করে দেন প্রমাণহীন অঙ্কে লেটার মার্ক। ‘ফলস–ভুয়া।’ সেদিন জামান সাহেব দশ টাকার জন্য অফিস মাথায় তুললেন। ভালোমানুষ পেয়ে একাত্তরের ধর্ষিতাকে তার ঘাড়ে চাপিয়েছে আবেদ। ‘এ অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব!’ মরিয়মের কান গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু অফিসে সশরীরে একজন বীরাঙ্গনা আছে শুনেও অন্য স্টাফদের ভাবান্তর হয় না। ঘাড় গুঁজে একমনে টকটক শব্দে টাইপ করে যাচ্ছে। নিঃশব্দে হিসাব মেলায় কেউ, আরেকজন কানে ফোন চেপে ব্যক্তিগত আলাপ সেরে নেয় এই ফাঁকে।

’৭২ সালে পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে মরিয়মদের যখন চাকরি দেওয়া হয়েছিল রেডক্রস বিল্ডিংয়ে, সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগে থাকত ওখানে। ‘কী ব্যাপার? কী চান আপনারা?’ জিগ্যেস করলে বলত, ‘আমরা বীরাঙ্গনা দেখতে আইছি।’ মানুষের কৌতূহলে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কিছু মেয়ে তখন চাকরি ছেড়ে দেয়। মাত্র চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বীরাঙ্গনাদের প্রতি! নাকি এ দেশে যে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, তা-ও তারা ভুলে গেছে?

বছর শেষ হওয়ার আগে এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেল। মরিয়মের বেতন দ্বিগুণ হওয়া দূরে থাক এক কানাকড়িও বাড়েনি। একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ বলেই, জামান সাহেব উঠতে-বসতে মনে করিয়ে দেন, একাত্তরের ধর্ষিতাকে তিনি মাসে মাসে বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য কেউ হলে কবেই গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিত!

কাঁচের ঘরে মরিয়মের দিন কাটে, মাস ঘুরে বছর শেষ হয়। তার হাত থেকে টিকিট কিনে মানুষ কোথায় কোথায় চলে যায়। কলেজের বান্ধবী রিনা, সাপলুডু খেলতে খেলতে যুদ্ধের বছর যে প্রেমে পড়েছিল, সে মরিয়মের কাছ থেকে টিকিট নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল কাতার চলে গেল। যাওয়ার সময় গভীর আবেগে বলেছিল, ‘মেরি, তোর জন্য আমার দুঃখ হয়। কত দিন আর আইবুড়ো থাকবি? সারা দিন হাটের মধ্যেই তো বসে থাকিস। দেখেশুনে এইবার একটা বিয়ে কর!’ আবেদ জাহাঙ্গীর বছরে তিন-চারবার আসে পিআইএর টিকিট কিনতে। সঙ্গে বউ-বাচ্চা কখনো শ্বশুর-শাশুড়ি। ম্যানেজারের রুমে বসে তারা কোক-ফানটা খায়। আর ছেলের স্কুলে ভর্তি, মেয়ের দাঁত পড়ে দাঁত ওঠা, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ যে হাজার গুণ পিছিয়ে আছে, করাচির শানশওকত না দেখলে তা বিশ্বাস হয় না–এমন সব খুচরা আলাপ করে চলে যায়। দেশে-বিদেশে মমতাজের চিহ্নমাত্র নেই। বীরাঙ্গনাদের কখনো প্লেনের টিকিট কাটতে দেখা যায় না। পাচারকারীর হাত দিয়ে তারা হয়তো বর্ডার পার হয় রোডে। পুনর্বাসনকেন্দ্রের নেত্রীরা সেমিনার-ওয়ার্কশপে বা প্রবাসী ছেলেমেয়ের আমন্ত্রণে বিদেশ ভ্রমণ করেন। টিকিট নিতে এসে মরিয়মের সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়। তখন একে অন্যকে তারা না-চেনার ভান করে। যেন এভাবে অচেনা। থাকাটাই বীরাঙ্গনা সমস্যার আসল সমাধান। যারা অতিরিক্ত সময় মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকেন, মরিয়ম কাজের ফাঁকে তাদের দিকে চোরা চোখে তাকায়। সবার বয়স বাড়ছে। বয়সের ভারের চেয়েও চোখেমুখে বাড়তি যে ক্লান্তিবোধ, তা হয়তো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমানের খাল কাটার বিপ্লবে শরিক হতে হচ্ছে বলে। বা কোনো ফাংশনে সভাপতিত্ব করতে গেলে এখন যে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়-এ কারণেও হতে পারে। কত চড়া মূল্যে স্বাধীনতা এসেছে-মরিয়মকে দেখে পুনরায় তারা তা স্মরণ করেন। এ থেকে বিবেকদংশন অনুভব করেন কেউ কেউ। তারা তো দিব্যি হেসেখেলে দিন গোজার করছেন, বছরে তিন-চারবার বিদেশ সফর করেন, শিক্ষা বা সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপদেষ্টা হয়েছেন কেউ কেউ, মাঝখান থেকে কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট হলো। তারা উঠে যাওয়ার সময় ফোন নম্বর লেখা এক টুকরো কাগজ মরিয়মের সামনের টেবিলে এমনভাবে ফেলে যান, যেন তাদের এলোমেলো স্বভাবের কারণে ব্যাগ থেকে কাগজটা হঠাৎ পড়ে গেছে। আর চোখ দিয়ে বলেন, ‘মেয়েরা, তোমরা কে কোথায় আছো, কেমন আছো আমাদের জানাও। এর নিরিখে ভবিষ্যতে বিচার হবে, বীরাঙ্গনা পুনর্বাসনে আমরা কতখানি সার্থক হয়েছিলাম।’

মরিয়ম ভুলেও সমাজকর্মীদের ফোন করে না। সে শুধু মতিঝিল, দিলখুশা, ফকিরাপুর এলাকার এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আরেক ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি বদল করে। সর্বত্র সেই কাঁচের ঘর, টাইপরাইটার আর একই ধরনের টেলিফোন সেট। বসদের মধ্যেও তেমন কোনো তারতম্য নেই। একজন ছাড়া সবাই তার কাজের খুঁত ধরে। সেই ব্যতিক্রমধর্মী লোকটা ছিল মাঝবয়সি। বউ পাগল। বাসা থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্বামীকে সে টেলিফোন করত। আর ফোনে না পেলে বাসার কাপড় পরে অফিসে চলে আসাটা ছিল মহিলার পাগলামির অন্যতম লক্ষণ। মরিয়ম হিসাবে ভুল করুক তাতে ক্ষতি নেই, লোকটার একটাই চাওয়া ছিল, ছুটির পর কিছুটা বাড়তি সময় সে যেন অফিসে থাকে। মতিঝিল অফিসপাড়া যখন নির্জন, বেশিরভাগ বিল্ডিং ফাঁকা হয়ে গেছে, তখন সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর দু’পা ফাঁক করে লোকটা বসত তার বেলে মাছের মতো লুলুতে নির্জীব পুরুষাঙ্গটি বের করে। মরিয়ম চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কয়েক বছর পর লোকটি ফুসফুস ক্যানসারে মারা যায়। মৃত্যুশয্যায় বারবার খবর দেওয়া সত্ত্বেও তার যাওয়া হয়নি। গেছে একেবারে শেষাবস্থায়। মরিয়মই ছিল সেদিনের প্রথম ভিজিটর, যে চাদরের তলা থেকে হাত উঠিয়ে দেখে পালস নেই। উনি মারা গেছেন।

একের পর এক অফিস বদল করতে করতে কখন যে বীরাঙ্গনার লেবাস গা থেকে খসে পড়েছে, মরিয়ম নিজেও জানে না। সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দিয়ে পুনর্বাসনকেন্দ্রের সুনির্দিষ্ট পেশা থেকে সে বহু আগেই সরে এসেছিল। তাকে তাঁতের শাড়ি, লম্বা হাতার ব্লাউজে আর দেখা যেত না। তখন কাঁচের খোপে পায়রার মতো বসে থাকা আর দশটা মেয়ের সে-ও একজন। সাজ-পোশাকও তাদের এক রকম। মাথার চুল হেনা রঞ্জিত, মুখের ভাঁজে ঘন সাদা পাউডারের প্রলেপ, ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক, এক গজ কাপড়েও ব্লাউজ হয় না, মাংস-চর্বির মোটা ভাঁজ শিফন বা জর্জেট শাড়ির স্বচ্ছতা ভেদ করে বাইরে গড়িয়ে পড়ে। মরিয়মদের মুখোমুখি চেয়ারে বসে টিকিট ক্রেতারা সময় নষ্ট করার কোনো কারণ দেখে না। যতই লিপস্টিক রাঙা ঠোঁট নেড়ে মোলায়েম সুরে কথা বলুক, তারা নিশ্চিত মহিলাগুলো বিবাহিত, তাদের স্বামীরা হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী, ছেলেপেলে কলেজে পড়ছে আর মেয়ের যৌতুকের জন্য আগাম সোনার গয়না কেনা হচ্ছে ঈদ বোনাস দিয়ে। একজন ক্রেতা এর মধ্যে ব্যতিক্রম। সে মরিয়মের বীরাঙ্গনা খেতাব আবিষ্কারের আগেই জানতে পারে যে, তার হাই ব্লাডপ্রেসারের স্বামী নেই, ছেলে কলেজে যায় না বা ঈদ বোনাস জমিয়ে সে মেয়ের বিয়ের সোনাদানাও খরিদ করে না। ছেলেটিকে অবশ্য ক্রেতা না বলে ভিজিটর বলাই ভালো। কারণ সে টিকিট কিনতে আসে না, মাসের বেতন পেয়ে টিকিটের দাম জানতে আসে। সব সময় তার না-কেনা প্লেন টিকিটের গন্তব্যস্থল বার্লিন।

‘কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন না, কেন খালি খালি আমার সময় নষ্ট করছেন?’ অন্য টিকিট বিক্রেতারা যখন ছেলেটিকে আসতে দেখলেই সিট থেকে উঠে যায়, মরিয়ম তাকে বিমানবন্দর শুল্ক, ভ্রমণকরসহ আনুষঙ্গিক হিসেব বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকে কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্নটা করে। ছেলেটি যে জার্মানি যাচ্ছে না, তা সে মানতে রাজি নয়। উত্তেজিত হয়ে রংচটা কাপড়ের ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে সে বের করে ততধিক রংচটা একটা ফটোগ্রাফ। তাতে শপিং সেন্টারের এসক্যালেটরে চড়ে একদল লোক ওপরে উঠছে। ভিড়ের মধ্যের কালো চুল আর বাদামি চামড়ার ছেলেটিই তার বন্ধু। নাম আশিক খন্দকার। আর ছেলেটির নিজের নাম হচ্ছে দেবাশিস দত্ত। আশিক খন্দকার আর দেবাশিস দত্ত ছোটবেলার বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়কার রুমমেট, আর করতও তারা একই রাজনৈতিক দল। ছয় বছর আগে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম নিয়ে আশিক জার্মানি চলে গেছে। দেবাশিস অপেক্ষা করছে ভিসার। ‘ভিসা পেলেই’ দেবাশিস দত্ত বলে, ‘আপনার কাছ থেকে আমি টিকিট কিনব।’ কারণ মরিয়মের মতো এ দুনিয়ায় খুব কম লোকই আছে, যারা অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে বা বুঝতে পারে।

মরিয়মকে ছবিটা দেখানোর পর থেকে দেবাশিসের কথা আর শেষ হয় না। বিষয় একটাই–ছোটবেলার বন্ধু, হলের রুমমেট কমরেড আশিক খন্দকার, যে প্রবাসে গিয়ে প্রাণের বন্ধু দেবাশিসকে ভুলে গেছে।

‘আচ্ছা মরিয়ম, আপনার কী মনে হয়?’

‘কোন ব্যাপারে?’

‘এই যে এক বছর ছয় মাস আট দিন হলো, আশিকের কোনো চিঠিপত্র পাচ্ছি না?’

‘হয়তো ব্যস্ত আছে। অথবা কাজ পাচ্ছে না–বেকার। বিদেশের জীবন তো খুব টাফ।’

‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু!’

‘কিন্তু কী?’

‘ওর মাকে তো নিয়মিত লিখছে।’

‘মাকে তো সবাই লেখে।’ কথাটা বলেই মরিয়মের মনে পড়ে, মনোয়ারা বেগমকে তার বহুদিন চিঠি লেখা হয় না। কফিলউদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন আজ দশ বছর হতে চলল। তার মৃত্যুটা ছিল সবার জন্য স্বস্তির। তিনি জমিজমা বেচে প্রায় শেষ করে গেছেন। আর বছর দুই বাঁচলে ফুলতলির ভিটেবাড়িসহ রায়েরবাজারের বাসাটাও বেহাত হয়ে যেত। শুরুতে বৈধব্য মেনে নিলেও মনোয়ারা বেগম দিনে দিনে কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন। রত্না স্বামীর সঙ্গে থাকে সৌদি আরব। ছন্দা মন্টুর নামের স্কুলটার হেডমিস্ট্রেস। বিয়ের পর সে-ও দূরে চলে যাবে। মা তখন একা। কিন্তু ঢাকা এসে মরিয়মের কাছে তিনি থাকতে নারাজ। সেই আট মাস এখনো তার কাছে। বিভীষিকা। তিনি বোধ হয় তখন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে কথা নেই বার্তা নেই একজন সম্মানিত ব্যক্তির স্ত্রী বাড়ির বাইরে এসে এমন বেলাল্লাপনা করবে কেন? অথবা নিজের স্বামীকে কেউ লিখতে পারে ‘৭৫ সালে মা হবো না!’ সব দোষ মেরির। এমন মেয়ে সে, যে নিজের মায়েরেও নষ্ট করে। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে মনোয়ারা বেগম এখনো দু’গালে থাপ্পড় মেরে তওবা কাটেন। আল্লার দরবারে কেঁদে কেটে আরজি জানান, যেন ছন্দার বিয়ের আগেই তার মরণ হয়। মেরি চিঠি লিখলে তিনি নিজে জবাব না দিয়ে ছন্দাকে বলেন কিছু একটা জানিয়ে দিতে। তাকে বাড়ি যেতে কখনো বলেন না। বীরাঙ্গনা মেয়ের প্রতি এতটাই বিমুখ মা।

‘আশিকের মা কেমন?’

‘কেমন মানে?’

‘মানে ছেলেকে ভালোবাসেন?’

দেবাশিস মরিয়মের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সন্তানকে ভালোবাসে না, এমন মা সারা দুনিয়াতেই বিরল। তার নিজের মা অবশ্য চিঠির পর চিঠি লিখে ইদানীং খুব বিরক্ত করছেন। তার একটাই কথা, হয় নিজের পছন্দে বিয়ে করো, না হয় মেয়ে পছন্দ করতে দাও আমাদের। তবে পাত্রীকে অবশ্য অবশ্য হিন্দু কায়স্থ হতে হবে। দেবাশিস ঠিক করেছে, জীবনে সে কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে না, তা আবার হিন্দু আর কায়স্থ। কিন্তু আশিকের কী হলো?

জার্মানিতে আশিকের বিয়ে করার খবর শুনে দেবাশিস মাঝরাতে রায়েরবাজারের বাসায় হাজির। মরিয়মের চল্লিশ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কেউ বিপদে না। পড়লে এ বাড়িতে মধ্যরাতে ছুটে আসে না। কিন্তু একটা ছেলে কেন আরেকটা ছেলের বিয়ের খবরে ভেঙে পড়বে? তবে চোরের যা উপদ্রব, রাতে পাশের ঘরে থাকার একজন লোক পেয়ে সে খুশিই হয়। মন্টু বেঁচে থাকলে যে ঘরে থাকতে পারত, যেখানে ছোট একটা পরিবার পাঁচ বছর সাবলেট থেকে গত মাসে মরিয়মের সঙ্গে তুচ্ছ কথা-কাটাকাটির পর ঝগড়া বাধিয়ে চলে গেছে, সেই ঘরের তালা খুলতে দেবাশিস ভয়ে পিছিয়ে আসে। ‘মরিয়ম, আপনার পায়ে পড়ি, আজ রাতটা অন্তত আমাকে একা থাকতে বলবেন না! আপনার ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে আমি শুয়ে থাকব, প্লিজ।’

আজ যাচ্ছি, কাল যাব করে মরিয়মের বাড়ি ছেড়ে দেবাশিসের আর যাওয়ার নাম নেই। জার্মানিতে আশিক বিয়ে করে তাকে একদম বেদিশা করে দিয়েছে। চাকরির টাকা তিলে তিলে জমিয়ে তার যখন বার্লিনগামী প্লেনের টিকিট কেনার সামর্থ্য হয়েছে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিয়ের খবরটা এসে পৌঁছায়। এখন টাকা দিয়ে কী করবে সে। চাকরি করাও অর্থহীন। তবে মরিয়মকে কাছ থেকে দেখে দেবাশিসের বিশ্বাস জন্মায় যে, মৃত্যুর অভাবে মানুষ বেঁচে থাকে এবং এভাবে বছরের পর বছর বাঁচা যায়। সে তাই অফিস ছুটির পর মরিয়মের কাছে ফিরে আসে।

‘মেরি, আপনার কী মনে হয়?’

‘কোন ব্যাপারে?’

‘এই ধরেন, বিয়ের ব্যাপারটা। মানুষ কি ভালোবাসা থেকে বিয়ে করে, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে বিয়ে করার পেছনে?’

‘আমি জানি না।’ মমতাজকে মরিয়ম বিয়ে করেছিল, কারণ সমাজে তার পুনর্বাসিত হওয়ার দরকার ছিল। নাকি সে বাচ্চা চেয়েছিল? অথবা স্বামী? সবার যেমন থাকে? তাহলে তো নিজের মা আর বোনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনাত্মীয় পরিবেশে এভাবে জীবন যাপন করতে হয় না।

‘অবশ্য,’ মরিয়ম আগের কথার সঙ্গে যোগ করে, ‘একটা বিয়ের পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাক, বিয়েটা কিন্তু দরকার।’

‘আপনি জানেন না,’ দেবাশিস হাসি হাসি মুখ করে বলে, ‘আমি কিন্তু জানি।’

‘কী জানো তুমি?’

‘আমি জানি, আশিক বিয়ে করেছে জার্মান সিটিজেনশিপ পাবার জন্য। সে মেয়েটিকে ভালোবাসে না।’

ভালো ভালো। এভাবে ভাবতে পারলে খুব ভালো। জীবনটা অনেক সহজ হয়। দেবাশিস ভাবছে, আশিকের বিয়েটা ভাড়া করা। ওখানে অনেক মেয়ে টাকা নিয়ে যেমন বিদেশি ছেলে বিয়ে করে, তেমনি ভালোবেসেও করে। কোনটা সত্য–এত দূরে বসে দেবাশিস তা জানবে কী করে। তাকে তো গত দুই বছরে এক লাইন চিঠিও লিখেনি আশিক। বিয়ের খবরটাও সে জানতে পেয়েছে আশিকের মায়ের কাছ থেকে।

দিনটা কাজের ভেতর আর দুরাশায় কাটে। রাতে মরিয়মের সঙ্গে চলে তার রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা। বেঁচে থাকলে যে ঘরে মন্টু থাকতে পারত, সেখানে শুয়ে। দেবাশিস স্বপ্ন দেখে বিশ্বের গোলাকার মানচিত্রের। এর গা বেয়ে সে ভারত-পাকিস্তান আফগানিস্তান হয়ে ইরানে প্রবেশ করে। মধ্যপ্রাচের তেলের খনি থেকে দুধের নহর বইছে। দেখতে দেখতে জায়গাটা গ্রেসিয়ারে পরিণত হয়। যে পর্বতশৃঙ্গ থেকে সবেগে পানির ঢল নামছে, দেবাশিস তার পাদদেশে। জায়গাটা সবুজ সবুজ, শ্যাওলা পড়া। পিচ্ছিল ভয়ানক। আশিকের কাছে পৌঁছতে হলে তাকে এই পিচ্ছিল, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ওই চূড়ায় উঠতে হবে। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, এ বাবদে মানুষ আর পিঁপড়ায় কোনো ফারাক নেই। সে তখন পিঁপড়া হয়ে ডোঙায় চেপে বসে। পিঁপড়া পিঁপড়া কয়টা নাও/ সাতটা আটটা নয়টা নাও। সব কটি নাও স্রোতের এক ধাক্কায় যাত্রীদের নিয়ে উল্টে যায়। অন্ধকারে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে দেবাশিস। বুঝতে পারে না, সে এখানে কেন। তার শরীরটা মানুষের না পিপড়ার। অনেকটা পথ এগিয়ে জার্মানির দোরগড়া থেকে তাকে ফিরে আসতে হলো! ফের শুয়ে পড়ে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে সেদিকে এগিয়ে যাওয়া নিরর্থক। আশিক খন্দকার স্ত্রী নিয়ে সুখে সংসার করছে। নৌকাডুবির দৃশ্যটা ভাবতে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে ওঠে।

প্রত্যেক রাতে কাঁথা-বালিশ নিয়ে এঘর-ওঘর টানাটানি, মরিয়ম ঘ্যানঘ্যান করে, এত বড় ছেলে একা ঘরে ঘুমাতে পারে না, লোকে কী ভাববে। ঠিকা ঝি রোজ সকালে দেবাশিসকে মরিয়মের ঘর থেকে বেরোতে দেখছে। হাজির বাড়ির দোতলা থেকেও নজর রাখা হচ্ছে, এ বাড়ির ওপর। তবে মরিয়মের বয়স এখন চল্লিশ। ঘাট ছেড়ে নৌকা চলে গেছে বহুদূর, ঘাটে আর ফেরা হবে না। সংসার হলো না, স্বামী হলো না, সন্তান হলো না। সমাজে থেকেও নেই। নিজদেশে পরবাসী। পাড়াপড়শি নিয়ে অযথা ভাবতে যাবে কেন সে? অনেকগুলো বছর ভাবনা-চিন্তা করে খালি খালি সময় নষ্ট করেছে। ছেলেটা মন্টুর ঘরে থাকতে ভয় পাচ্ছে, এখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাক। তার নিজেরও ঘুম দরকার। সকালে দুজনেরই অফিস।

একদিন সকালে গেট খুলে দিতে ঠিকাঝির বদলে সাত-আটজন লোক বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দেবাশিস কলতলায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিল। মুখভর্তি পেস্টের ফেনা । তাকে কুলি করারও সময় দেয় না লোকগুলো। এ অবস্থায় পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। কী হচ্ছে কী হচ্ছে, তোমরা কে? এ আমার বাড়ির মেহমান। মরিয়মকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় একজন। গেট দিয়ে মৌলবি নিয়ে ঢোকে হাজির ছেলে। ‘দেখেন তো ভাইজান…’ মরিয়ম বিচার দেওয়ার আগে বিচারক, হাজি সাহেবের ছেলে বলে ওঠে, ‘পাড়ায় বেলাল্লাপনা চলবে না। মৌলবি সাহেব আপনে রেডি হন।’

মরিয়ম কি দুঃস্বপ্ন দেখছে? দশ বছর আগে হলে না-হয় কথা ছিল। এ বয়সে এমন কেলেঙ্কারি! নাকি লোকগুলো ঠাট্টা করছে? এ কেমন মশকরা যে, ঘণ্টা খানেক পর মরিয়ম আর দেবাশিসকে যখন অফিসে যেতে হবে, তার মধ্যে এমন উদ্ভট কাণ্ডকারখানা। হাজির ছেলে বলে, ‘অফিস-টফিস সব বন্ধ। পাড়া চলবে এখন থাইক্কা আমার নির্দেশে।’

বটে! বাপের পর তিনি নেতা হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দশ বছর পর আরেক ১৫ আগস্টের ভোর রাতে হাজি সাহেব এন্তেকাল করেন। তবে তার স্বাভাবিক মৃত্যু। ত্যাজ্যপুত্র ফিরে এসেছে পৈতৃক ভিটায়। সত্তর-একাত্তরে সে ছিল বাঙালির স্বাধিকারের পক্ষে। অষ্টাশিতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কায়েম করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শরিয়া আইনে দেশ চলছে না। অথচ হাজির ত্যাজ্যপুত্র মরিয়মের উঠোনে পা ঠুকে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘এহানে গর্ত খুড়ো। পুইত্তা ফালাও বেলাজ-বেশরম মাগিরে। বিয়েতে রাজি না থাকলে একশ এক পাথর মারা হবে। হুজুর আপনে রেডি?’

পাত্থর মারার ফতোয়া শুনে হাজির বৃদ্ধা স্ত্রী ছুটে আসেন, ‘মা তোর আল্লাহর দোহাই, রাজি হইয়্যা যা। ছেলেডা আমার পাগল। বাপের স্বভাব পাইছে।’

‘কিন্তু খালাম্মা, আপনারা এসব কী বলেন?’ মরিয়ম আপত্তি জানায়, ‘ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো!’

‘ভাই হোক আর যা হোক, নিজের মায়ের পেডের ভাই তো না, মা তুই রাজি হইয়্যা যা। এ ছেলে মুখে যা বলে, তা কইরা ছাড়ে।’

ঘণ্টা খানেক পর মামা গোলাম মোস্তফা এসে হাজির। গত মাসে স্ট্রোক করে শরীরের বাঁ পাশ অবশ। লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ‘কি ভাগনি, তুমি নাকি লিভ-টুগেদার করতাছ? নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ। তোমার মামি আসতাছে শাড়ি নিয়া। বাদ জোহর বিয়ে পড়ানো হবে।’

বিয়ে পড়াতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। দেবাশিস যে হিন্দু, মরিয়ম ছাড়া কেউ জানত না। যে মৌলবিকে পাথর মারার জন্য আনা হয়েছিল, তিনি অজু করে দেবাশিসকে মুসলমান বানাতে বসে গেলেন। এ বয়সে খতনা করানোর ঝুঁকি আছে। টিটেনাস হয়ে যেতে পারে। গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘পাঁচ কলমাই সই।’ কলেমা তৈয়ব পড়া শুরু হতে দেবাশিস ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ভিড়ের ভেতর তখন হাসির হুল্লোড় আর কটুক্তি, ‘ফাউ শুতে পারছো শালা মালু, এহন কান্দন আহে কলমা পড়তে?’ কাঁদতে কাঁদতে হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে দেবাশিস বলে চলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্।’ মুখ খারাপ করা লোকগুলো বিনা কুলকুচিতে, বিনা-অজুতে হুজুরের সঙ্গে মোনাজাত ধরে। একটা পুণ্যের কাজ করতে এসে আরেকটা পুণ্য হয়ে গেল। মালাউনকে মুসলমান করার সওয়াবের ভাগিদার তারাও। সাত পুরুষের জন্য বেহেশত বুকড হয়ে গেছে। দেবাশিসের বুক পকেটে তখনো মায়ের সেই চিঠি—‘মেয়েকে অবশ্য অবশ্য হিন্দু কায়স্থ হতে হবে।’

মুসলমান হওয়ার পর দেবাশিস নামটা আর চলছে না। একটা মুসলমান নাম দেওয়া দরকার। স্ট্রোক করে গোলাম মোস্তফার মাথাটা গেছে। নিজের ছেলেদের নামও আজকাল মনে থাকছে না। তিনি অন্দরমহলের উদ্দেশে হাঁক দেন, ‘ভাগনি, তুমি তো স্বাধীন জেনানা, একটা নাম দেও দেখি তোমার স্বামীর।’

কয়েক মুখ ঘুরে পাশের ঘর থেকে একটা নাম আসে–আবেদ ইশতিয়াক।

দেবাশিসের জানার উপায় নেই যে, নামটা এসেছে মরিয়মের কাছ থেকে। আবেদ এবং ইশতিয়াক দুটি নামই তার পরিচিত। মরিয়মের মুখ থেকে শোনা। তবে তা দুজনের। এখন একসঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেও চমকে ওঠা বা ভয় পাওয়ার মতো মনের অবস্থা তার নেই। শুধু মনে হচ্ছে, এখন যা ঘটছে, গত রাতের দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। তবে তাদের যে মেরে ফেলা হচ্ছে না, এই যথেষ্ট।

মরিয়মের আরেকটা ফাড়া কাটল। মৃত্যুর মুখ থেকে বারবার ফিরে আসা তার নিয়তি। মামি জ্বলেখা বিবি বললেন, ‘মরিয়ম, খোদার কাছে শোকর করো, এ বয়সে তোমার বিয়ে হইছে। তোমার আব্বা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হইতেন।’ তেলাপোকা কাটা কাতান শাড়ি মরিয়মকে তিনি পরিয়ে দেন। শাড়িটা ন্যাফথালিনের ভুরভুর গন্ধ ছাড়ছে। তাড়াহুড়োয় শাড়ি-গয়না কিনতে বাজারে যাওয়া হয়নি। জ্বলেখা বিবি নিজের সম্বল যা ছিল, তা দিয়ে কনে সাজালেন। দৌড়ঝাঁপ করে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে ঠিকাঝি। কুটনামি করে আজ সে সার্থক। হাজির ব্যাটা পুণ্যের কাজ করেছে। সে তো বেশ্যাপাড়ায় কাজ করে না যে, রোজ সকালে মাগিলোকের নোংরামি দেখতে হবে! আগামীকাল থেকে ঠিকাঝির এ বাড়ির কর্তাগিন্নি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী।

বিয়ে পড়ানোর পর স্বামী-স্ত্রীকে বারান্দার বেঞ্চিতে শতরঞ্জি পেতে বসানো হয়েছে, যেখানে দর্জিগিরি করার সময় মরিয়মের কাস্টমাররা পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। দেবাশিসের পরনে শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি। কলেমা পড়ে একবেলায় তার চেহারার যে পরিবর্তন এসেছে তাতে মনে হয়, সর্বান্তকরণে সে বিশ্বাস করে–আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। মিষ্টিমুখ করার সময় গোটা রসগোল্লা সে একবারে গিলে ফেলে। গতরাতের পর কিছু খাওয়া হয়নি, খিদা পেয়েছে নিশ্চয়। বর-কনের মুখ দেখার জন্য যে আয়নাটা সামনে ধরা হয়েছে, সেটি দেবাশিসের খেউরি করার বাথরুমের আয়না। আকারে ছোট। একবারে মুখের আধখানা শুধু দৃশ্যমান হয়। মরিয়মকে সেখানে সে দেখতে পায় না। তবু নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আয়নাটার দিকে। পাড়াপড়শি বিয়ে নিয়ে নাচলেও মরিয়ম কেবল জানে, দেবাশিস অপেক্ষা করছে যার, সে কোনোভাবে নারী নয়–একজন জলজ্যান্ত পুরুষ। রাত নেমে আসছে। খানাপিনার পর গোলাম মোস্তফা সস্ত্রীক ফিরে যাবেন। পাড়ার লোকজন ইহকালের বাহাদুরির মজা লুটে, পরকালের বেহেশতের সার্টিফিকেট নিয়ে যে যার মতো চলে যাবে। দেবাশিস আর মরিয়ম তখন একা। একটা অবাস্তব বিয়ের ভার তারা বহন করবে কীভাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *