২৭. বিদ্যাবিনোদিনী বৃত্তান্ত ও দৌলতন নেছা

বিদ্যাবিনোদিনী বৃত্তান্ত ও দৌলতন নেছা

এক

বেগম রোকেয়া ভাগ্যবান। এখন বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে অতিপরিচিত নাম। তাঁর অবদান অসামান্য। কিন্তু মৃত্যুর পর অনেক দিন তিনি বিস্মৃতই ছিলেন। এমনকি কোথায় তাঁর কবর, সে খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। তাঁর সন্তানসন্ততি থাকলে নিশ্চয়ই নিতেন। তাঁর সম্পর্কে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরাও জানতেন না কোথায় রোকেয়া সমাহিত। কলকাতা থেকে কিছু দূরে সোদপুরের কাছে পানিহাটিতে তাকে কবর দেওয়া হয়। বহুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের সময় তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলার নারী জাগরণে রোকেয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু অনেক দিন তাঁর সম্পর্কে মানুষ বিশেষ জানত না। তিরিশের শেষের দিকে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ রোকেয়ার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করেন। জীবনীটি সুখপাঠ্য। সেটি প্রকাশের পরও রোকেয়াকে নিয়ে আগ্রহ খুব অল্প মানুষেরই ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) নিযুক্ত হন প্রখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই খুদা। তিনি শামসুন নাহার মাহমুদের রোকেয়া জীবনী নবম-দশম শ্রেণিতে পাঠ্য করেন। তাঁর জীবনী স্কুলপাঠ্য করায় রোকেয়ার পরিচিতি সাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা পায়। রোকেয়ার প্রতিষ্ঠার পেছনে ড, খুদা ও শামসুন। নাহার মাহমুদের অবদান সবচেয়ে বেশি, যদিও তাঁদের স্বীকৃতি নেই। এবং বর্তমানে রোকেয়ার খ্যাতি এতই বেশি যে তাঁর সমসাময়িক আরও যেসব নারী সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তাঁরা আড়ালে পড়ে গেছেন।

এখন কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কে নারী আর কে পুরুষ, এ প্রশ্ন কেউ তোলেন । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন নারী কবি-কথাশিল্পীরা। বাংলা সাহিত্যেও অনেক প্রধান কবি-সাহিত্যিক নারী। বাঙালি-আমেরিকান ঝুম্পা লাহিড়ী, যিনি ইংরেজি ভাষায় গল্প-উপন্যাস নিয়ে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন, তিনি নারী কি পুরুষ তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। বাংলা সাহিত্যে মহিলাদের অবদান বিরাট। তবে বাঙালি মুসলমান লেখিকাদের আবির্ভাব দেরিতে। সেই পথ যারা তৈরি করেছেন, অশেষ প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে তারা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতার আগে দু-একবার বাংলা একাডেমিতে দেখেছি নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীকে। তখন তিনি বৃদ্ধা। কী রকম সামাজিক অবস্থায় সাহিত্যজগতে তার প্রবেশ, সে সম্পর্কে তিনি তাঁর শৈশবস্মৃতিতে অতি প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন। তাঁর ভাষাতেই তাঁর কথা নিবেদন করি, যদিও উদ্ধৃতি দীর্ঘ না করে উপায় নেই :

‘উঁচু পাঁচিল-ঘেরা অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। গোলা বাড়ির সারি সারি ধানের মরাই এর পাশে মিষ্টি কুল, আম, লিচু, নিম গাছের মেলা। পাঁচিলের ওধারে কাজীর পুকুরের টলটলে পানি। খুব ছোটবেলায় ঘরে যখন মন টিকতো না, গিয়ে হাজির হতাম খামারবাড়িতে, যেখানে এক-এক দুই দুই করে একটানা সুরে জনমজুরেরা ধান মেপে তুলছে, সে জায়গা পার হয়ে চলে আসতাম বড় দীঘির পাড়ে। সেখানে হয়তো জেলেরা জাল গুটিয়ে তুলছে আর তাতে ধরা পড়ে ছটফট করছে ছোট বড় রূপোলী মাছগুলো। বাড়িরই কেউ পাড়ে দাঁড়িয়ে তদারক করছেন মাছ-ধরা।

‘কিন্তু আর একটু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হতে হলো। খান্দানী-ঘরের রেওয়াজই ছিল এই। এমনকি বাড়ির সদর দরজা মাড়ানও বন্ধ। দেয়ালের ফাটল, ঘুলঘুলী দিয়ে, চোরের মতো লুকিয়ে কখনো দেখতাম পাশের বাড়ির কর্মচাঞ্চল্য, ছোট মেয়েরা খেলা করছে, বৌ-ঝিরা করছে রান্না, বাড়ির গিন্নী ঘুরে ফিরে এসে দেখে যাচ্ছেন ওদের রান্না, ছেলেদের খেলাধুলা।-এমনি সব খুঁটিনাটি ছবি।

‘নিজেদের ঘর-সংসারের কাজের কোন দায়িত্ব নাই। ছোট মানুষ, কী কাজই বা জানি। মাঝে মাঝে ঘরের এলোমেলো জিনিষগুলো ঝেড়ে মুছে গুছাবার চেষ্টা করি। মা হাসেন, বলেন, খুব কাজের হয়েছে মেয়ে আমার! অবসর সময়ে নানাজান কেতাব পড়ান, সব দিন পড়াবারও সময় পান না তিনি। আবার অন্যের কাছে ত’ পড়তে দেন না নানাজান। বলেন, সহি পড়ানো না জানলে, তার কাছে পড়া ঠিক নয়। কোরান-কেতাব গলদ পড়ার চেয়ে না পড়াও ভালো। পড়া খুব ভালভাবেই মুখস্থ করে রাখি। ভুল হোলে নানাজান ভীষণ ধমকানি দেন। স্কুলের পড়াশুনার কোন বালাই নাই। মেয়েরা স্কুলে গিয়ে ইংরেজি, অঙ্ক ইতিহাস পড়বে, একথা তখনকার দিনে কারও কল্পনাতেই আসততা না।

‘অলস দিনে প্রচুর সময়। ভাইয়েরা ওস্তাদের কাছে, তাদের পড়া শেষ করে স্কুলে যায়। বাড়ি থাকলে তাদের সঙ্গে খেলা-ধুলা করি। ঝগড়া করি, মারামারিও যে হোত না তা নয়! খেয়েদেয়ে, বইখাতা নিয়ে ওরা বাড়ির বার হয়। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে উদাস মনে চেয়ে থাকি আমি, তাঁদের গমন-পথের পানে। যতোদূর দেখা যায় চেয়ে দেখি, দৃষ্টির বাইরে গেলে দু-হাতে চোখ মুছি। ভীষণ দুঃখ হয়, একটু আগের ঝগড়ার জন্যে মনে অনুতাপ হয়। আবার কখন ফিরবে ওরা, সেই আসা পথে চেয়ে থাকি। ফিরে এলে, ছুটে গিয়ে ওদের হাত থেকে বই-খাতা নিয়ে তুলে রাখি। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে সযতনে রাধা পোলাও, কোর্মা বাড়তে বসি। ভাইরা হাসিমুখে নিজ নিজ আসনে বসে পড়ে। তাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দেই, ধুলামাটির রান্না, জাফরানি রং এর পোলাও, টুকরো ইটের কোর্মা, ছোট ছোট কুলের ডিম রান্না, কলাপাতার উঁটার চাকা করে কাটা মাছ ভাজা, এটা-ওটা মিশিয়ে একটা ঘণ্টা, খড়িমাটি গোলার ফিরনী- এমনি সব। ছোটভাইরা, জিভ আর তালুতে আওয়াজ তুলে পরিতৃপ্তির সঙ্গে আহার করে, আর আমরা খুশিতে ডগমগ

মন্তব্য করে, একটুও মজা না, বিচ্ছিরি রান্না সেজ-বুবুর। অন্যটি বলে, না বিচ্ছিরি রান্না মেজ-বুবুর, সেজ-বুবুর রান্না খুব ভালো। ব্যস, বেধে যায় ঝগড়া! আর যদি তোকে খেতে বলি কোন দিন। সেজ-বুবু বলে, আমিও খাওয়াবো না খোকনকে আর। অর্থাৎ, ছোটর সঙ্গে বাধে আমার ঝগড়া, মেজর বাধে তার ছোটর সঙ্গে। সেই সব ঝগড়া-বিবাদ ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। পরক্ষণেই ভাইয়েরা গোলা বাড়িতে গিয়ে আম, জাম, পেয়ারা কুল যে সময়ের যা ফলমূল পেড়ে নিয়ে আসে কেঁচড় ভরে, আমরা মহাআনন্দে হাত-পা ছড়িয়ে খেতে বসে যাই ভাইবোনে মিলে। মধুর স্মৃতি-বিজড়িত দিনগুলো মানুষের জীবনে আর ফিরে আসে না। খুঁজে পাওয়া যায় না সেই হাসিকান্না ভরা আনন্দময় শৈশব-জীবনের ফেলে-আসা হারিয়ে-যাওয়া দিনগুলো।

[ছোটবেলার জীবন, মৃত্তিকা, ১৯৬১]

এক অতি সংবেদনশীল মন ও শিল্পীর চোখ ছিল নূরুন্নেছা খাতুনের। দেশাত্মবোধ জেগেছিল তাঁর মধ্যে শৈশবেই। তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর স্মৃতিকথায়। তাঁর ভাষায় :

‘কতো অতীত দিনের কাহিনী শুনতাম আব্বাজানের কাছে। শুনতাম, আমার এই মাতৃভূমি মুর্শিদাবাদের বুকে, তরুণ সিরাজের ভাগ্য বিড়ম্বনার করুণ ইতিহাস। বাংলার বীর নবাবদের বীরত্বকাহিনী। আবেগ-আপ্লুত মন বিদ্বেষে শিউরে উঠতো, মীরজাফরের উমিচাঁদের দলের বিশ্বাসঘাতকতার আলেখ্যে শিশুপ্রাণ ক্ষোভে রোষে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতো ক্ষণে ক্ষণে। সান্ত্বনা পেতে চাইতো ধুলামাটির খেলার মধ্যে, কাটাকুটি আর গেরুয়া মাটি দিয়ে তৈরী হ’তো গড়, কেল্লা, কামান, বন্দুক। মাথার কাঁটা দিয়ে খোঁড়া সরু নালার ওপারে ইংরেজ আর এ পাশে নবাবী ফৌজ। শুরু হতো যুদ্ধ। গুঁড়িয়ে একাকার হোয়ে যেত ওপারে ইংরেজদের দুর্গগুলো। শিশু-মন ভরে উঠতো আত্মতৃপ্তিতে।’

৭০-৮০ বছর আগে একজন বাঙালি নারীর নিসর্গ প্রেম যে অসাধারণ চিত্ররূপময় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, তা ভাবলে অবাক লাগে। এত সুন্দর প্রকৃতির। বর্ণনা খুব কম বাঙালি লেখকই দিতে পেরেছেন। সেই পঞ্চাশের দশকে নূরুন্নেছা খাতুন লিখেছেন :

‘বীরভূমের লাল-মাটির শেষে আবার মুর্শিদাবাদের চন্দনের মতো সাদা কোমল ধুলোর রাজ্য শুরু। ছোটবেলায় ওপারের জানালাটা ঘেঁষে বসে, প্রকৃতির বুকে ছয় ঋতুর আনাগোনা দেখা যেন আমার এক রকম নেশার মত ছিলো। শরৎ, হেমন্ত, শীত পার হয়ে আবার যখন চৈত্র-বৈশাখের দিনগুলো ফিরে আসততা, কেন জানি, আমার মনটা অকারণে খারাপ হয়ে যেতো। খড়কুটো ধূলিমাটি উড়িয়ে বওয়া শুকনো বাতাস, কাকের একটানা ডাক, আকাশের বুকে-ওড়া চিলের তীব্রতীক্ষ করুণ কান্নার সুর, শুকনো তাল-পাতার উদাস সুরের বাজনা বাজানো,– শুনি আর চেয়ে চেয়ে দেখি। মনটা উদাস ব্যথায় ভরে ওঠে। জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, আর অনাবশ্যক বেঁচে থাকার সার্থকতা কী?– এই মনোভাব নিয়ে, শেষের বেশে সজ্জিত পাতার দল, রিক্ত মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিসর্জন দিচ্ছে তাদের অবহেলিত প্রাণ। দেখতে দেখতে মনে হোত, কি যেন হারিয়ে গেছে, পালিয়ে গেছে কারা যেন! এখনও মনে পড়ে, আমরা ছোটরা, ক্লান্ত গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণে এই মন-উদাস-করা দিনগুলোর নাম দিয়েছিলাম, বাগড়া বাজা দিন।

‘(বাগড়ার অর্থ : শুকনো তালপাতা)! এমনি করে, শরতের বিকালে, জানালার গরাদ ধরে চেয়ে থাকতাম স্তব্ধ নীল আকাশের নীচে বিস্তৃত মাঠের পানে। সবুজ বনানী আর সুনীল আকাশ একসঙ্গে মিশে আছে মনে হয়। নীচে বিলের পানি দুধ নদীর মতো দেখায়। অলস গতি কৃষকেরা লাঙ্গল কাঁধে মাঠ থেকে ফেরে। রাখাল বালকেরা বটের ছায়ে বসে কড়ি খেলে। গরুগুলো এলোমেলোভাবে এখানে-সেখানে চরে ফেরে, ঘাস খায়। খেলায় রত রাখালেরা মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে, গরুগুলো ঠিক আছে কি-না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে রাখাল-বালক, পাঁচনবাড়ি দিয়ে গরু তাড়িয়ে গাঁয়ের পথ ধরে ওরা। কাক, শালিক, বকের সারি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বসে তাদের আশ্রয়স্থল বটবৃক্ষের শাখায়। নানা সুরের নানা কণ্ঠের কিচির-মিচির, কা, কা, ওয়াক-বক শব্দে মুখরিত করে তুলে চারদিক। আঁধার ঘনিয়ে আসে ধীরে ধীরে, কালো যবনিকায় ঢেকে ফেলে সব-কিছু।’

কীভাবে তিনি প্রতিকূলতার মধ্যে লেখিকা হয়ে উঠলেন সে কথা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলেছেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কথাশিল্পী হয়ে ওঠার কথা :

‘এতো অবরোধের মধ্যে মানুষ হয়েও কেমন করে সাহিত্যের দরবারে নিজের স্থান খুঁজে নিতে পেরেছিলাম, সে কথা জানতে নিশ্চয়ই অনেকের আগ্রহ হচ্ছে। সেই আশা-আগ্রহ ভরা সাধনার দিনগুলোর কথাও আজ বলবো। আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের পথে কোনই বাধা নেই, তাই অতো যুগ আগে বাংলার গ্রামের, অভিজাত-পরিবারের মেয়েদের পক্ষে লেখাপড়া শেখার চিন্তাও যে কতো। অসম্ভব ছিলো, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু বাল্যের কোন একদিনে, যে প্রেরণা আমি নিজের মধ্যে অনুভব করেছিলাম, তারই জন্যে আর শুভানুধ্যায়ীদের উৎসাহে, বাংলা-সাহিত্যের দরবারে কিছু পেশ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

‘দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে কেমন করে যেন কেটে গেলো কটা বছর। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটি ব্যস্ত পুতুলের বিয়ে নিয়ে। আর ছোট ভাইগুলো? তারা থাকতো, মাষ্টার সাহেবের সামনে ঘাড় হেঁট করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে, নয় তো খেলায় মেতে উঠতো লাটু, আর ডাংগুলি নিয়ে। দেখতাম, কর্মচঞ্চল বাড়িতে সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। আমিই একা, একান্ত একা। বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত বুড়ি ঝিটা, গোয়ালঘরের এক কোণে বসে গন্ধকে পাট কাঠির মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দেশলাই তৈরী করছে এক মনে। ছুটে যেতাম তার কাছে। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে বলতাম, একটা গল্প বলো না ঝি-মা!

‘ফোকলা মুখে, একরাশ হাসি হেসে ঝি-মা বহুবার-শোনা সেই একই বাঙমা বেঙমীর গল্প বলতো, কিংবা শোনাতো জীয়ন-কাঠি মরণ-কাঠির কথা। কিন্তু তাতে কি আর তখন মন ভোলে?– শৈশব ছাড়িয়ে তখন পা দিয়েছি বাল্যে। মন চায় নতুনত্ব। নতুন কিছু জানতে শিখতে মন তখন উৎসুক ছিল। অনুযোগ শুনে বুড়ো-ঝি মুখ ভার করে বলতো, তাহলে আর কোন কিস্সা শোনাই বলো? তোমার ভাইয়েদের কাছে শোনো গে, ওরা সব নেকাপড়া করে, অনেক নতুন নতুন গল্প জানে।

‘অনুসন্ধিৎসু মন এবার একটা পথ খুঁজে পেলো। কোথা থেকে আকস্মিক একটা আলোর রশ্মি এসে পড়ে কোন এক অজানা জগৎকে চোখের সামনে উদ্ভাসিত করে তুললো। মনে হলো, তাইতো, ঠিকই তো। এবার থেকে বই-ই তো আমার সঙ্গী হতে পারে। কতো দেশের কতো মানুষের নতুন নতুন গল্প শোনাতে পারে। ওরা- বইরা আমার।’

নূরুন্নেছা খাতুনের শৈশবস্মৃতি এত লম্বা লম্বা উদ্ধৃতির মাধ্যমে উপস্থাপিত করার কারণ, এ কালের পাঠকের তাঁর সম্পর্কে তো নয়ই, তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কেও ধারণা নেই। তিনি আজ একজন বিস্মৃত মানুষ। অথচ তার যে অবদান তাতে তিনি হারিয়ে যাওয়ার মতো লেখিকা নন। শৌখিন লেখিকা তিনি ছিলেন না, ছিলেন কমিটেড লেখক। সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি কথাশিল্পী হওয়ার ব্রত গ্রহণ করেন। জন্ম মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে। বাবা খোন্দকার হাবিবুস সোবহান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে, সে কালের জন্য সেটা বেশি বয়স। স্বামী কাজী গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন আইনজীবী। শ্বশুরবাড়িতে সাহিত্যচর্চার উৎসাহ পান। বাড়িতেই বাংলা ও ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেন।

১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় নূরুন্নেছার প্রথম উপন্যাস স্বপ্নদ্রষ্টা। একটি সামাজিক উপন্যাস হিসেবে এটিকে উপেক্ষা করা যাবে না। ভাষা পরিমার্জিত রচনাশৈলী সাবলীল। ১৯২৫-এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস আত্মদান, বলা হয়েছিল ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। অন্য দুটি উপন্যাস বিধিলিপি ও নিয়তি। ফিকশন ছাড়াও প্রাবন্ধিক রচনাও রয়েছে তার, যেমন ‘মোসলেম বিক্রম ও বাংলার মোসলেম রাজত্ব (১৯১৬)। তাঁর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস জানকী বাঙ্গ।

নূরুন্নেছা প্রথম বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিক, যিনি ছিলেন সাহিত্যে নিবেদিতা এবং একই সঙ্গে সমাজসেবা ও নারী জাগরণের একজন কর্মী। পিছিয়ে থাকা মুসলমানসমাজের কল্যাণে তিনি কাজ করলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মুসলিম জাতীয়তাবাদে নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদে। ১৯৩১ সালে মুন্সিগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ১৬তম অধিবেশন হয়। সেখানে নূরুন্নেছা ‘বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং সেটি শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন :

‘…যদিও আমাদের বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের আদি পুরুষগণ আরব, বাগদাদ বা পারস্য দেশ হইতে পূর্বে এদেশে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এই বঙ্গের ফল, জল, আকাশ-বাতাস, ঔষধি-বনস্পতি প্রভৃতির সহিত যুগযুগান্তর ধরিয়া আমরা পরিচিত। এই বঙ্গের বাণীই আমাদের জন্মদিন হইতে আরম্ভ করিয়া শেষের দিন পর্যন্ত নিয়ত কর্ণকুহরে ধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু আমাদের সম্প্রদায়ে এমন অনেকে আছেন, যাঁহারা পরম সত্যকে অস্বীকার করেন। পঞ্চনদ তীরবাসী সকলেই পাঞ্জাবী, বিহারের সকলেই বিহারী, কিন্তু বাঙ্গালার সন্তান যাহারা তাহারা কেবলমাত্র ধর্মান্তরের জন্যই বাঙালী নহেন, ইহার ন্যায় আশ্চর্যজনক অযৌক্তিক কথা আর আছে কি না জানি না। আমাদের ভ্রাতৃবৃন্দের জননী জায়া দুহিতাগণের মনে বঙ্গবাণীর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তি যদি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে থাকে, তবে তাহা অচিরে কি মঙ্গল ও কল্যাণকে যে আমাদের করায়ত্ত করিয়া দিবে, তাহা একমুখে বলিয়া শেষ করা যায় না।

মোসলেম মহিলা সম্মেলনের সভানেত্রীর অভিভাষণে নূরুন্নেছা বলেছিলেন :

‘আমরা হচ্ছি পর্দানশীন মোসলেম রমণী। সাহিত্যে আমাদের পুরুষদেরই একটু দাঁড়াবার স্থান মেলে না, আমরা তো কোন দূরে পড়ে আছি।…

‘দূর চিরদিনই দূর থাকে না। সাধনায় তা নিকট হয়ে আসেই আসে।… এখন নিজের নিজের চেষ্টায়, বিদ্যায় ও জ্ঞানের উজ্জ্বল জ্যোতির ভেতর দিয়ে, অশেষ বাধাবিঘ্ন মাড়িয়ে, নিঃশব্দে খানিকটা এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের প্রধান কর্তব্য।

‘স্ত্রী-শিক্ষা– এটা নিশ্চয়ই আজকাল আমাদের অপরিহার্য জিনিসের মধ্যে হয়ে পড়েছে। আর এইটিই আমাদের রুগ্‌ণ সমাজে নাই বললেই চলে। তার ফলে আমাদের জাতীয় জীবন সকল রকমে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

অসামান্য মহিলা ছিলেন নূরুন্নেছা খাতুন। তাঁর অবদানের জন্য যে স্বীকৃতি তিনি দাবি করেন, তা তিনি পাননি। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে বিপরীত। পরিবার থেকে উৎসাহ পেয়েছেন, মুসলমান সাহিত্যসমাজ থেকে ততটা পাননি। তবে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদনী’ ও ‘সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।

দুই

প্রতিকূল সময়ে নিজের পথ নিজে করে যারা এগিয়ে যান, তাঁদের মর্যাদা আলাদা, ইতিহাসে তাঁদের একটি আসন প্রাপ্য। নারী-শিক্ষা, বাঙালিত্ব, নারী প্রগতি, সমাজসংস্কার প্রভৃতি প্রশ্নে নূরুন্নেছা খাতুনের মতামত খুবই স্পষ্ট। সাহিত্যের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সওগাত-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘আমাদের কাজ’-এ তিনি বলেন :

‘সমাজের উন্নতি করতে হলে তার প্রথম সোপন হচ্ছে সাহিত্যের সাধনা।…

‘সর্বক্ষণ এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে “বাঙ্গালী” শব্দের উপর আমাদের প্রতিবাদী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশি অর্থাৎ কিনা, প্রকৃত বাঙালী বলে পরিচয় দিতে হলে হিন্দুর চেয়ে আমরাই বরং দু’পা এগিয়ে যাব। আমাদের সর্বক্ষণ মনে থাকা দরকার যে-ভারতের অর্ধেক সংখ্যক মোসলমান আমার এই বাঙ্গলা দেশেরই সন্তান।

‘আমাদের জন্মগত অধিকারে অনাস্থাই আমাদের সমাজকে এক রকম কোণঠাসা করে রেখেছে, একে গজাতে দিচ্ছে না। এখন আর বাঙ্গালা শিখবার ভয়ে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে সঙ্কুচিত হলে চলবে না। বুক ঠুকে এগিয়ে দাঁড়িয়ে এখন জোর গলায় বলতে হবে- আমি বাঙালী আর এই বাঙ্গালা সাহিত্যই আমার সাহিত্য।

‘জাতীয় জীবনকে গড়ে তুলবার একমাত্র উপায় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা। আমাদেরকে এই পথ অবলম্বন করতেই হবে। … আমাদের দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করতে হবে। স্বকীয় চেষ্টায় এখন একটু ত্রুটি হলেই পতঙ্গের মতো পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে।’

[‘আমাদের কাজ’, মহিলা সওগাত, ভাদ্র ১৩৩৬]

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে একজন স্বশিক্ষিত মুসলমান নারী, যিনি এই বক্তব্য দিতে পারেন তিনি সামান্য নারী নন, তিনি নিঃসন্দেহে অসামান্য। যখন নূরুন্নেছা এই কথা বলছেন, তখন রোকেয়া জীবিত। তার এই বক্তব্যে তিনটি বিষয় পাওয়া যায়। এক, সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব, দুই. বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ শুধু নয় সারা ভারতের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের বাসভূমি বাংলাদেশ, সুতরাং বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। মুসলমানের চেয়ে তার বাঙালি পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মুসলমান পৃথিবীর দেশে দেশে বহু জাতির মধ্যে রয়েছে, কিন্তু বাঙালি মুসলমান শুধু বাংলাদেশেই এবং তারাই এই ভূখণ্ডে সংখ্যায় বেশি। সুতরাং, বাঙালিত্বের দাবিদার বাঙালি মুসলমানেরই বেশি। এবং সেই দাবি যদি বাঙালি ছেড়ে দেয় মুসলমানিত্বকে ধরে রাখতে গিয়ে তা হলে তা হবে তার জন্য আত্মঘাতী। এই বিষয়টি তখন সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান পুরুষ ভেবে দেখেননি।

তৃতীয় যে বিষয়টির ওপর নূরুন্নেছা গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো জ্ঞানচর্চা এবং বাঙালি মুসলমানকে সেই পথ অবলম্বন করতেই হবে। বাঙালি মুসলমান নারীদের এবং পুরুষদেরও ‘দেহ-মনের জড়তা ও আড়ষ্ঠতা দূর করে আত্ম-উন্নতির চেষ্টা করতে বলেছেন। আত্ম-উন্নতির চেষ্টা না করলে পোকামাকড়ের মতো ‘পদদলিত ও নিষ্পেষিত হয়ে মরতে হবে, সে কথা সোজাসুজি বলেছেন।

সাহিত্যচর্চা ও সমাজকল্যাণে নূরুন্নেছার একজন যোগ্য উত্তরসূরি দৌলতন নেছা খাতুন, যাকে আজ আমাদের সাহিত্যসমাজ একেবারেই ভুলে গেছে। তার জন্ম ১৯২২ সালে বগুড়ার সোনাতলায় তাঁর বাবার কর্মস্থলে। তাঁর বাবা ইয়াছিন আলী রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তিনিও লেখালেখি করতেন। তার স্বর্গোদ্যান, হীরার ফুল, জীবনতারা নামে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।

সেকালের প্রথামতো শৈশবে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র আট বছর বয়সে ডাক্তার হাফিজুর রহমান নামক এক চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় ১৯৩৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক, ১৯৪০ সালে আইএ এবং ‘৪২ সালে বিএ পাস করেন। লেখাপড়ায় ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। সংসার সামলে ১৯৫৯-এ তিনি সমাজকল্যাণে এমএ করেন।

দৌলতন নেছা শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, রাজনীতিতেও ছিল তাঁর আগ্রহ। রাজনীতিতে তাঁর শুরু তিরিশের দশকে কংগ্রেসী রাজনীতি দিয়ে। ওই সময় একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনে অংশ নিয়ে। একজন মুসলমান মেয়ের জন্য সেটা খুব ছোটো ব্যাপার ছিল না। ১৯৫৪-র নির্বাচনে যে কয়েকজন মহিলা যুক্তফ্রন্টের টিকিটে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন দৌলতন নেছা। তার এলাকা ছিল রংপুর দিনাজপুর। মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ মাস কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালে তাঁকে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকেন। এর মধ্যে তার জীবনে নেমে আসে এক বিপর্যয়। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯৬৪-তে। একমাত্র ছেলে ছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তিনিও মারা যান। ষাটের দশকে তিনি থাকতেন ঢাকার র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যেত। তিনি ছিলেন শ্যামলা, বেঁটে-খাটো এবং মাথায় চুল ছিল পাতলা। বাংলা একাডেমিতে তিনি কখনো আসতেন। ষাটের দশকে ঝরণা নামে তার একটি বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা থেকে। ওই সময় নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা ও সংরক্ষণের বিধান রেখে তিনি যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়নের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেন।

আজীবন দৌলতন নেছা বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বিরোধিতা করেছেন। ওই বিল উত্থাপনের সময় সংসদে তিনি বলেন :

‘বিবাহের সময় যৌতুকের দাবি আজ অতিশয় ব্যাপক ও ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়া বিরাট জাতীয় সমস্যার রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। ইদানীং এই প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হইতেছে এবং জনগণ ব্যাপকভাবে ইহার অবলোপ দাবি করিতেছেন। যৌতুক সামাজিক পাপ। ইহা স্বামী-স্ত্রীর প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের মূলে আঘাত করিতেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট হুমকি দেখা দিয়াছে।’

নারী প্রগতির জন্য দৌলতন নেছা অবিরাম কাজ করেছেন। তবে তাঁর কর্মক্ষেত্র ঢাকার মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ নয়, উত্তরবঙ্গের অবহেলিত অঞ্চল। তিনি তিরিশের দশকে গাইবান্ধা মহিলা সমিতি গঠন করেন। ১৯৭০ এর দশকে তিনি সেখানে এক মহিলা সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকারের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগদান করেন।

দৌলতন নেছার সাহিত্যকর্মের পরিমাণ অল্প নয়। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাস পথের পরশ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি পুনর্মুদ্রিত হওয়া প্রয়োজন। কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালামের মন্তব্য, দৌলতন নেছার পথের পরশ এক জীবনালেখ্য; এই প্রচেষ্টা পথের দাবীর চেয়েও উৎকৃষ্টতর বলে আমার মনে হয়েছে।’ কথাটি নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সঙ্গে পথের পরশের কোনো তুলনা হয় না শিল্পকর্ম হিসেবে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের একটি চিত্র তাতে পাওয়া যায়। অনেক ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি। রোমন্থন’ শীর্ষক ছোটগল্পের ভাষা :

‘প্রভাতের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল নাজমার। দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার করুণ শব্দে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট কলরবও কানে এসে পড়ল। লোটনকে কি পাওয়া গেল!

‘দরজা খুলে আঙ্গিনায় বেরিয়ে আসতেই বাইরে থেকে ভোলা চেঁচিয়ে বলল, লোটনের শাড়ী নাকিন খালের পানিতে ভাইসা উঠছে বুজী। লোক নামছে খালে খোঁজনের লাইগা। আপনে বাঁশের মইটা বাইয়া ছাপড়ার ওপরে উঠলে দেখবার পাইবেন। আমি ওহানে যাইতাছি। রুদ্ধ কণ্ঠে কেঁদে উঠল জয়তুন।

‘পাথরের মতো স্থির দৃষ্টি নিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নাজমা। জয়তুনের কান্নার শব্দে ফিরে তাকাল।

‘জয়তুন নাজমার হাত ধরে আকর্ষণ করে বলল, আহ বুজী উপরে উইঠা দেহী। মই বেয়ে ছাপড়ার উপরে উঠে অদূরে খালের উপর দৃষ্টি পড়তেই শেলের মতো নাজমার কানে বেজে উঠল ললাটনের সেদিনের সেই আর্তচীৎকার,

‘বুজী গো বুজী…

‘সবে সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছিল নাজমা সেদিন, পিঠে কার কোমল করস্পর্শে ফিরে দেখে লোটন একটু বিস্মিত হয়ে নাজমা বলল,– এমন ভর সন্ধ্যেবেলা তুই যে লোটন,

‘আইজ দিনভোর মায়ে আমারে ঘরে বন্ধ কইরা রাখছিল বুজী।

‘কেন রে?

‘মুখ নীচু করে লোটন বলল, তোমার কাছে আইতে দিব না তাই। সহালে ইসকুলে তাই আইতে পারি নাই বুজী।’

দৌলতন নেছা কতটা নারী প্রগতিবাদী ছিলেন, তা তাঁর আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের একটি লেখা থেকে বোঝা যায়। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তিনি লিখেছিলেন :

‘চিরকালই দেখা গেছে ধর্মের অনুশাসনের নামে মানুষকে যত সহজে অবনমিত করা যায় আর কোন শক্তি তা পারে না। তাই দেখা গেছে ধর্মের নামে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের বুকে এমন অনেক জিনিস জমা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অঙ্গ নয়। হয়ত কোন প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি করেছে মানুষকে আয়ত্তে রাখার জন্য অথবা কোন সমষ্টিগত শক্তি করেছে নিজেদের ক্ষমতাকে সমাজের বুকে কায়েমী রাখার জন্য।

‘পাশ্চাত্য দেশের নারী আন্দোলনের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের গতিও একই ধারায় পরিণতির পথে এগিয়ে, চলেছে। সময়ের পার্থক্য আছে কিন্তু গতির পার্থক্য নাই। আমাদের দেশেও ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ নারী জাতির অগ্রসরণের পথে বার বার বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তবুও সমস্ত বাধা-বিপত্তি ঠেলে নারীর অগ্রসরণ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যদিও এখনও করবার রয়েছে তাঁদের আরও অনেক।

‘এই সেদিনও ভারতে ধর্মের অনুশাসন থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করে সামাজিক অধিকার প্রদান করল রাষ্ট্র–মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দিয়ে।

‘মুসলিম সমাজে এখনও বহু প্রকার আইন আছে যা ধর্মের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে রাষ্ট্রের আওতায় আসা দরকার। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পুরুষের বহুবিবাহ রদ। নারীর পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ইত্যাদি।

‘আজ মুসলিম নারী সমাজকে এইসব অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগী হয়ে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।’

[‘পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলনের গতি’]

দৌলতন নেছার উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ নিবন্ধের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বধূর লাগিয়া, নাসিমা ক্লিনিক, করমপুরের ছোট বউ, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৭৭ সালে ‘নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়।

দৌলতন নেছার সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেক নারী সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁদের কারও থেকে তাঁর অবদান কম নয়। নানা কারণে তিনি আজ বিস্মৃত। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত জীবনীমালা সিরিজে দৌলতন নেছা খাতুনের একটি জীবনী প্রকাশিত হয়েছে বেশ আগে। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া পিনু, যিনি তাঁরই এলাকা গাইবান্ধার মানুষ। পথনির্মাতাদের ভুলে যাওয়া ভালো না। ১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট দৌলতন নেছা মারা যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *