২৭. বার্লিন আর্মি হেড কোয়ার্টার

বার্লিন আর্মি হেড কোয়ার্টারের বিশেষ এক বাঙ্কারে হিটলার নৈশভোজ শুরু করেছেন। নৈশভোজে কিছুটা আড়ম্বর আছে। কারণ আজ অনেকদিন পর হিটলারের বান্ধবী ইভা ব্ৰাউন উপস্থিত আছেন।

পুরনো রেড ওয়াইনের বোতল খোলা হয়েছে। হিটলার এক চুমুক রেড ওয়াইন খেয়ে মাথা নাড়লেন। তাঁর পছন্দ হয়েছে। দু’রকমের সুপ দেয়া হয়েছে। বেবী কর্ন-এর একটি প্রিপারেশন আছে। আলুভাজা আছে। মাখন মাখানো মাশরুম আছে। শূকরের মাংসের সসেজ এবং লাল করে পোড়ানো খরগোসের মাংস আছে। মাংসের বাটিগুলির ঢাকনা খোলা হয় নি। হিটলার নিরামিষ খাবার পছন্দ করেন, তবে কিছুদিন আগে জেনারেলদের এক সম্মেলনে এক টুকরা খরগোসের মাংস মুখে দিয়েছিলেন বলে বিশেষ আয়োজনের দিনে তার টেবিলে মাংস রাখা হয়। মাছের কোনো আইটেম নেই। ইভা ব্ৰাউন মাছের গন্ধ পছন্দ করেন না।

একটু দূরে গ্রামোফোনে মোৎসার্ট বাজছে। ডাইনিং টেবিলে মোমবাতির আলো। পরিবেশ চমৎকার। হিটলারকে প্ৰসন্ন দেখাচ্ছে। যুদ্ধের ভালো কোনো খবর পেলে তিনি প্ৰসন্ন বোধ করেন। ভালো খবর পাওয়ার তেমন কারণ নেই। ভয়াবহ দুঃসংবাদ একের পর এক আসছে। তারপরেও যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত অঘটন। ঘটে। ইভা ব্ৰাউনের ধারণা তেমন কোনো ঘটনা ঘটেছে।

ইভা ব্ৰাউন ওয়াইন গ্লাস তুলে টোস্ট করলেন— জার্মানির মৃত্যুঞ্জয়ী বীরসৈনিকদের। হিটলারও গ্লাস তুললেন। গ্লাসে গ্লাসে শব্দ হলো। সেই শব্দও সঙ্গীতের মতোই। হিটলার ইশারা করলেন, গ্রামোফোন যেন বন্ধ করা হয়। তিনি ডিনার নীরবেই করেন, তবে মাঝে মাঝে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে। আজ সে রকম একটা দিন।

হিটলার আলুভাজা মুখে দিতে দিতে বললেন, জার্মান ফিল্ড মার্শালদের বিশেষত্ব কী তুমি জানো?

ইভা ব্ৰাউন বললেন, তারা ধীমান বীর। মহান যোদ্ধা। সাহসী।

ঠিকই আছে, তবে তাদের প্রধান বিশেষত্ব হলো তারা কখনোই জীবিত অবস্থায় শত্রুর কাছে ধরা পড়ে না। আত্মসমর্পণ করে না। মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু ধরা দেবে না।

ইভা ব্ৰাউন বললেন, ফিল্ড মার্শালদের এই বিষয়টি জানতাম না।

হিটলার অহংকারের সঙ্গে বললেন, এখন পর্যন্ত কোনো জার্মান ফিল্ড মার্শালকে কেউ জীবিত অবস্থায় বন্দি করতে পারে নি।

ইভা ব্ৰাউন রেড ওয়াইনের গ্লাস আবারো উঁচু করে বললেন, মহান ফিল্ড মার্শালদের উদ্দেশে।

হিটলার বললেন, তুমি জার্মান ফিল্ড মার্শাল বলো নি।

ইভা ব্ৰাউন বললেন, ভুল হয়েছে। সরি। মহান জার্মান ফিল্ড মার্শালদের উদ্দেশে।

হিটলার গম্ভীর গলায় বললেন, এ ধরনের ভুল আমার পছন্দ না।

 

সময় ১৯৪৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাস। তারিখ দুই। হিটলার তখনো জানেন না তার ফিল্ড মার্শালদের একজন, ফিল্ড মার্শাল পাউলাস, স্টেলিনগ্রাদে সোভিয়েতদের কাছে হাত তুলে আত্মসমৰ্পণ করেছেন। তাঁর সঙ্গে আত্মসমৰ্পণ করেছে ৯১ হাজার জার্মান সৈন্য। তারা বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। শীতে এবং ক্ষুধায় কাতর।

ফিল্ড মার্শাল পাউলাসকে সোভিয়েট মার্শাল জর্জি ঝুকভের তাঁবুতে নেয়া হলো। তাঁবুতে পেতলের কড়াইয়ে আগুন জ্বলছিল। ঝুকভ হাতের দস্তানা খুলে আগুনের সামনে হাত মেলে রেখেছেন। ফিল্ড মার্শাল পাউল্যাসের সঙ্গে তিনি হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, আগুনের আরো কাছে এসে দাঁড়ান, শরীর গরম হোক।

পাউলাস কাছে এগিয়ে এলেন। তাঁর দৃষ্টি ভাবলেশহীন।

ঝুকভ বললেন, গরম এক মগ সামরিক কফি কি দেব? কফি শীত কাটাতে সাহায্য করে। আপনি ক্ষুধার্তা?

পাউলাস হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নৈশভোজ সারব। আপনি ভাগ্যবান। আপনার জন্যে আমরা দু’বোতল জার্মান রেড ওয়াইন জোগাড় করতে পেরেছি। আমাদের যেমন ভদকা, আপনাদের তেমন রেড ওয়াইন। আমার খুব শখ বার্লিনে বসে আপনাদের রেড ওয়াইন খেয়ে দেখব। যেখানকার জিনিস সেখানে বসেই খাওয়া উচিত।

 

‘মার্শাল ঝুকভের তাড়া খাইয়া জার্মানবাহিনী বার্লিনের উদ্দেশে ছুটিতেছে…’

এককড়ির দোকানে খবর পড়া হচ্ছে। আজ দুটা পত্রিকা পড়া হবে। কলিকাতা সমাচার এবং ঢাকা প্ৰকাশ। যুদ্ধের খবর এক পত্রিকায় পড়ে মজা পাওয়া যায় না। শ্রোতারা আরো জানতে চায়। যুদ্ধের ফলাফল কী? এখনো পরিষ্কার না। ঢাকা প্রকাশ লিখেছে- তুরুপের তাস এখনো হিটলারের হাতে। তুরুপের তাসটা কী তাও বোঝা যাচ্ছে না।

খবর পাঠক মাথা দুলিয়ে বলল, হিটলারের বিচি তো মাথায় উঠছে। এই বিচি আর নামব না। খবর পাঠকের নাম দেবু। সে গৌরাঙ্গের ভঙ্গিতে খবর পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেরকম হচ্ছে না। পাখি উড়ে গেলে তার পালক পড়ে থাকে। গৌরাঙ্গ মারা গেছে। কিন্তু তার খবর পাঠ রেখে গেছে।

এককড়ি বললেন, অসভ্য অশ্লীল কথা বলব না।

এক শ্রোতা বলল, ঘটনা সত্য, বলতে অসুবিধা কী?

এককড়ি বললেন, তুমি জানো ঘটনা সত্য? যুদ্ধ তুমি করতেছা? পুরাটাই হিটলারের কৌশল।

কী কৌশল?

এমন ভাব করতেছে যে পরাজিত। রওনা দিয়েছে বার্লিনের দিকে। পিছনে পিছনে আসতেছে রুশরা। ফাঁদে পা দিয়েছে। জার্মান বিমান যখন ঝাপ দিয়া পড়ব তখন বুঝব।

ঘটনা এইরকম আপনেরে বলেছে কে? হিটলার সাব তো আপনের সাথে পরামর্শ করে নাই।

হিটলারকে যে চিনে সে জানে ঘটনা এইরকম। হিটলার সাপ্ত খাওয়া জিনিস না। অন্য জিনিস।

এইটা অবশ্য ঠিক।

হিটলার তো একলা না, তার সাথে আছে মুসৌলিনি। আরেক ধাইন্যা মরিচ। আছে জাপানিরা। জাপানিরা কী এখনো বুঝি নাই? কলিকাতা খালি কইরা সব পালাইছে কোন সুখে? জাপানিরা যখন বোমা ফেলতে শুরু করব আমরার বান্ধবপুর বাদ থাকব এরকম চিন্তা করবা না।

দর্শকরা আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসল। দেবু বলল, একটা বিষয় কেউ বুঝতেছে না। মহাবিপদ আমরার সামনে।

এক শ্রোতা বলল, বুঝায় বলো বিপদটা কী?

জাপানিরা বাৰ্মা দিয়া ঢুকবে চিটাগাং। সেখান থেকে ময়মনসিংহ-ঢাকা। ময়মনসিংহ-ঢাকা জয় হয়ে গেলে তারা রওনা দিবে কলিকাতা। বান্ধবপুরের উপর দিয়া যেতে হবে। এরা যেদিকে যায় ছারখার করে দিয়ে যায়। যুবক সব মেরে ফেলে। অল্পবয়স্ক মেয়ে সব নিজের দেশে চালান করে দেয়।

কেন?

দেবু বিরক্ত হয়ে বলল, একেকটা প্রশ্ন এমন করেন! মেয়ে ধইরা নিয়া যাবে। কেন বুঝেন না? মা ডাকার জন্য নিবে না।

এককড়ি বললেন, বাজে আলাপ বন্ধ। কাগজ পড়। দেশের মেয়ে নিয়া যাওয়া সহজ না। নেতাজি স্বয়ং আছেন। নেতাজিও সাগু খাওয়া লোক না।

খবর পাঠ চলতে থাকে।

ভয়াবহ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, এই চিন্তার মধ্যে কি কোনো আনন্দ আছে? হয়তো আছে। খবর শুনতে আসা মানুষদের আনন্দিত মনে হয়। মানুষ বড়ই বিচিত্র জীব।

 

ধনু শেখও খবর শুনছেন। তাকে পড়ে শোনাচ্ছে আতর। ধনু শেখ খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। পায়ের ওপর কম্বল চাপা দেয়া। হাতে তামাকের নল। চোখে চশমা। এমনিতে তিনি চশমা পরেন না। যখন খবর শুনতে বসেন তখন আয়োজন করে চশমা চোখে দেন। ধনু শেখের বাড়িতে যে কাগজ আসে তার নাম যুদ্ধ সংবাদ। সেখানে যুদ্ধের খবর ছাড়া আর কোনো খবর থাকে না। এই ভালো। যুদ্ধের খবর ছাড়া আর সব খবরই এখন গুরুত্বহীন।

খবর পড়া শেষ হয়েছে। আতর চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। ধনু শেখ বললেন, একটু বসো। কথা আছে।

আতর বসল।

অনেক দিন ধরে একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাস করব বলে ভেবেছি। জিজ্ঞাস कद्भो श्श नरें।

জিজ্ঞাস করেন।

শরিফারে বাড়ি থেকে পালাবার ব্যবস্থা কি তুমি একই করেছ? না-কি আরো কেউ তোমার সঙ্গে ছিল?

আমি একাই করেছি।

যে কাজটা করেছ, তাতে শরিফার লাভ হয়েছে, না ক্ষতি হয়েছে? ভালোমতো চিন্তা কইরা উত্তর দাও।

ক্ষতি হয়েছে।

অল্প ক্ষতি, না বড় ক্ষতি?

বড় ক্ষতি?

এতে কী প্রমাণিত হয়েছে বলে?

আতর চুপ করে আছে। সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা কী উত্তর শুনতে চাচ্ছেন। তিনি যে উত্তর শুনতে চাচ্ছেন সেই উত্তর ছাড়া অন্য কোনো উত্তরেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন না।

ধনু শেখ হুক্কার নিলে লম্বা টান দিয়ে বললেন, এতে প্রমাণিত হয়েছে– ‘নারী বুদ্ধি প্ৰলয়ঙ্করী’। ভবিষ্যতে আর কখনো নিজের বুদ্ধিতে কিছু করব না।

আচ্ছা।

এখন বলে আমারে তুমি কি অপছন্দ করা?

করি।

অল্প অপছন্দ কর, না বেশি?

বেশি।

ঘিন্না করা?

হুঁ।

যারে ঘিন্না কর তারে সব সময় চোখের সামনে দেখা তো ভালো কথা না। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার বিবাহ দিব। এক ছেলের পিতার সঙ্গে আগে কথা হয়েছিল। তাকে পত্র দিয়েছিলাম ছেলে এবং ছেলের পিতা যেন তোমাকে দেখে যায়। পত্রের উত্তর এসেছে। দুই-একদিনের মধ্যে তারা আসবে। সন্ধ্যাকালে কন্যা’ দেখানো হবে। যদি পছন্দ হয় তাহলে বিবাহের দিন এবং কাবিন ধার্য হবে। এই বিষয়ে কিছু বলতে চাও।

না।

তোমার পাড়াবেড়ানি অভ্যাস আছে আমি জানি। আগামীকাল থাইকা যেন ঘরের বাইরে পা না যায়।

আচ্ছা।

যার সঙ্গে বিবাহের কথাবার্তা হয়েছে তার বিষয়ে কিছু জানতে চাও?

না।

ধনু শেখ বললেন, জানতে না চাইলেও আমার জানানো কৰ্তব্য। ছেলের পারিবারিক অবস্থা ভালো না, তবে ছেলে উচ্চশিক্ষিত। এম.এ পরীক্ষা দিয়েছিল। পাশ হয় নাই। আবার দিবে। বুঝেছ?

হুঁ।

গোটা বান্ধবপুরে এম. এ পরীক্ষা দেওয়া কেউ নাই, এটা খেয়াল রাখবা। ছেলের গাত্ৰবৰ্ণ কালো। তবে পুরুষমানুষের কালো গাত্ৰবৰ্ণ শুভ। ছেলের নাম শাহনেয়াজ। এখন সামনে থেকে বিদায় হও।

 

আমগাছের চারপাশে শিবশংকর ঘুরছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে অসুস্থ। গত রাতে তার জ্বর এসেছে। এখন জ্বর নেই, তবে মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। মাথা ফাঁকা লাগছে। জ্বর আসার আগে এরকম লাগে।

শিবশংকর ঠিক করেছে। শরীর যখন ঠিক থাকবে, মন ভালো থাকবে, তখন সে clockwise, ঘুরবে। আবার শরীর যখন খারাপ থাকবে, মনও ভালো থাকবে না, তখন ঘুরবে Anti clockwise.. এখন সে এন্টি ক্লিকওয়াইজ ঘুরছে।

আতর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথায় ওড়না। ওড়নার রঙ গাঢ় হলুদ। তার পরনের শাড়ির রঙ নীল। সে শাড়ি দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেয় নি। ওড়না দিয়ে দিয়েছে। আতর আজ এক আসে নি। হামিদাকে নিয়ে এসেছে। হামিদা যথারীতি বোরকা পরা। সে আতরের মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে। হামিদার কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। আতর, হামিদাকে দাড়া করিয়ে এগিয়ে গেল। শিবশংকর বলল, আমি তোমার জন্য সুন্দর একটা নাম খুঁজে বের করেছি।

আতর নামটা কি সুন্দর না?

হ্যাঁ  সুন্দর। কিন্তু তারচে’ও সুন্দর। নামটা বলব?

না। এখন পর্যন্ত আতর নামটাই আমার পছন্দ। যেদিন পছন্দ হবে না। আপনার কাছ থেকে নতুন নাম নেব।

তোমার সঙ্গে বোরকা পরা উনি কে?

আমার পাহারাদার। আপনি কি আমার একটা কাজ করে দেবেন?

অবশ্যই। কী কাজ?

একটা চিঠি লিখে দিবেন?

আমি একজনকে একটা চিঠি পাঠাব। জরুরি চিঠি। আজই পাঠাতে হবে।

তুমি তো লিখতে পার।

আমি চাই না যাকে চিঠি লিখব। সে আমার হাতের লেখা দেখে আমাকে চিনে ফেলুক।

কাগজ-কলম তো আনি নাই।

কাগজ-কলম আমার সঙ্গে আছে। দিব?

দাও। আমার হাতের লেখা কিন্তু ভালো না। তবে বানান ভুল হবে না।

আতর হামিদার কাছ থেকে কাগজ এবং কলম এনে দিল। শিবশংকর চিঠি লিখতে বসেছে। আতর পাশে দাঁড়িয়ে।

শিবশংকর বলল, সম্বোধন কী লিখব?

আতর বলল, সম্বোধন লাগবে না। লিখেন–

আমার খুব ইচ্ছা আপনার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়। এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভব মনে করেন। তবে বাড়ির সামনে একটা খুঁটি পুতবেন। খুঁটি দেখে বুঝব।

আপনার চিরদিনের দাসী

আতর শিবশংকর বলল, দাসী লিখব কেন?

আতর বলল, আমার দাসী লিখতে ইচ্ছা করতেছে। দাসীর চেয়েও নিচে যদি কিছু থাকত। তাই লিখতে বলতাম।

শিবশংকর বলল, যাকে তুমি এই চিঠি লিখছ সে যে কী খুশি হবে। কয়েকটা খুঁটি পুতবে।

আতর বলল, আমাকে বিয়ে করলে খুশি হবে কেন?

কারণ তুমি ভালো মেয়ে। দেখতেও সুন্দর। সবাই সুন্দর পছন্দ করে।

আপনি করেন?

না।

আপনি কী পছন্দ করেন?

বুদ্ধি।

আতর বলল, আচ্ছা যাই। শিবশংকর বলল, চিঠিটা নিয়ে যাও। আতর বলল, চিঠিটা আপনার জন্যে। আতর ছোট ছোট পা ফেলে যাচ্ছে। সে একবারও পেছনে তাকাল না।

 

শিবশংকর চিঠি হাতে নিয়ে বসে আছে। তার মুখ ছাইবৰ্ণ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যে জ্বর আসব আসব করছিল। সে জ্বর এসে গেছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। রোদের দিকে তাকাতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যে-ই তাকে দেখছে সে-ই বুঝে ফেলছে ঘটনা কী। শিবশংকর চিঠিটাকে গুটি পাকিয়ে বলের মতো করেছে। সেই বল হাতের মুঠিতে লুকানো। চিঠিটা সে খুবই গোপন কোনো জায়গায় লুকিয়ে রাখবে। এমন কোনো গোপন জায়গা যেন কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। সে চিঠি নিয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা হবে। গহীন জঙ্গলে ঢুকে পড়বে। বড় কোনো গাছ খুঁজে বের করবে। বড় বড় গাছের কাণ্ডে কাঠবিড়ালি গর্ত তৈরি করে, চিঠিটা রাখতে হবে এমন কোনো গর্তে। কাঠবিড়ালির তৈরি করা গর্তে কখনো বৃষ্টির পানি ঢ়োকে না।

গোপীনাথ বল্লভ শিবশংকরের খোঁজে এসেছেন। তার ছাত্রের শরীর ভালো না। এই অসুস্থ শরীরেও সে যেন কোথায় কোথায় ঘোরে। তিনি খবর পেয়েছেন। শিবশংকর মাঝে মাঝে জঙ্গলে ঢোকে। জঙ্গলে বুনো শূকরের উপদ্রব হয়েছে। দাতাল শূকর নামশুদ্ৰ পাড়ার একজনকে দাঁত বসিয়ে জখম করেছে। গোপীনাথ বল্লভ বললেন, তুমি এখানে?

হুঁ।

কী করা?

কিছু করি না। একটু আগে হাঁটছিলাম, এখন বসে আছি।

তোমার জ্বর কি বেড়েছে? চোখমুখ লাল। চল বাড়িতে চল।

না।

এখানে বসে থাকবে?

এখানে বসেও থাকব না। আমি জঙ্গলে ঢুকব। জঙ্গলে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ শেষ করে বাড়িতে যাব।

জঙ্গলে কী কাজ? সেটা আপনাকে বলব না।

গোপীনাথ শিবশংকরের হাত ধরলেন। শিবশংকরের মনে হলো, তার হাতের চিঠি কেড়ে নিতে যাচ্ছে। সে এক ঝটিকায় হাত সরাল। কঠিন গলায় বলল, আমার কাছে আসবেন না।

তোমার কাছে আসব না কেন?

আপনাকে নিষেধ করেছি। এই জন্যে। এখন থেকে আমি আপনার কোনো কথা শুনব না। আপনি একজন মূর্থি। স্বাস্থ্যবিদ্যার কিছুই জানেন না। আয়ুৰ্বেদ চিকিৎসারও কিছু জানেন না।

তোমার হয়েছে কী?

শিবশংকর উঠে দাঁড়াল। গোপীনাথ চিন্তিত মুখে বললেন, যাও কই?

জঙ্গলে যাই। আপনি আমার পেছনে পেছনে আসবেন না। যদি আসেন আমি ভয়ঙ্কর কাণ্ড করব।

আমার তো মনে হয় তোমাকে ভূত-পেত্নিতে ধরেছে।

শিবশংকর হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল। তার হাতের মুঠায় চিঠি। পেছনে পেছনে দৌড়ালেন গোপীনাথ। তবে তিনি শিবশংকরের নাগাল পেলেন না। সে গহীন জঙ্গলে ঢুকে গেল।

দুপুরের পর অনেক ঝামেলা করে তাকে উদ্ধার করা হলো। সে অনেক উঁচুতে একটা কড়ই উঁচুতে একটা কড়ই গাছের ডাল জড়িয়ে ধরে জ্বরের ঘোরে কাঁপছিল। বান্ধবপুরে ছড়িয়ে পড়ল। মনিশংকরের ছেলে শিবশংকরকে ভূতে ধরেছে। ভুত তাকে কড়ই গাছের মাথায় নিয়ে তুলেছিল। ভূত নামানের জন্যে ভূতের ওঝা আনতে লোক ছুটল।

 

ধনু শেখের বাড়িতে কনে দেখার লোকজন উপস্থিত। দু’একদিনের মধ্যে তাদের আসার কথা, তারা আজই চলে এসেছে। আজ দিনটা না-কি বিশেষ শুভ। বর শাহনেয়াজ এসেছে। তার বাবা, বড় চাচা এবং এক মামা এসেছেন। তাদেরকে সমাদর করে বসানো হয়েছে। মুরুব্বিারা অপেক্ষা করছেন ‘কন্যাসুন্দর আলো’র জন্য। এই আলোয় কুরূপা মেয়েকেও অপরূপ মনে হয়।

শাহনেয়াজ হালকা পাতলা গড়নের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের যুবক। লাজুক স্বভাবের। সহজে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। বেশির ভাগ সময়ই তার দৃষ্টি জানালার দিকে। জানালা দিয়ে বড় গাঙের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। আতর যখন হামিদার হাত ধরে ঘরে ঢুকাল তখনো শাহনেয়াজ জানোলা দিয়ে তাকিয়ে।

আতরকে বেশ কিছু পরীক্ষা দিতে হলো। যেমন, গামলায় দু’পা ড়ুবিয়ে মেঝের ওপর হেঁটে যাওয়া পরীক্ষা। মেঝেতে পায়ের পাতার ছাপ কী রকম পড়ছে তা দেখাই এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। মেঝেতে ছাপ যত কম পড়বে তত ভালো। এরপর শুরু হলো সুতা পরীক্ষা। পায়ের কোনো আঙুল জোড়া কিনা তা সুতা ঢুকিয়ে দেখা।

ছাপ পরীক্ষার পর ধর্মজ্ঞান বিষয়ক পরীক্ষা। যেমন, বেতরের নামাজের নিয়ত কী? অজুর নিয়ত কী?

ধর্ম পরীক্ষার পর সাধারণ বুদ্ধি পরীক্ষা। যেমন, একসের বেগুন ড়ুবাতে কত সের পানি লাগবে?

সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষার সময় শাহনেয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, যথেষ্ট হয়েছে, আর কত! বেগুন পানিতে ড়ুবানোর দরকার কী?

প্ৰশ্নকর্তা শাহনেয়াজের চাচা। তিনি বললেন, দরকার আছে। তুমি যা বুঝি না। তা নিয়া কথা বলবে না। মুরুব্বিদের সঙ্গে কথা বলতে হয় আদবের সঙ্গে। তোমার মধ্যে আদবের অভাব দেখলাম। যাই হোক, মা আতর এখন বলো কোন জিনিস বিহনে খাদ্য প্রস্তুত হবে না?

আতর বলল, আগুন।

হয় নাই। শশা লবণের ছিটা দিয়া খাওয়া যায়। আগুন লাগে না।

আতর বলল, লবণ?

না, লবণ না। চিন্তা-ভাবনা করে বলো। যা মনে আসে তাই বলবা না।

শাহনেয়াজ বলল, চাচা, আপনিও চিন্তা-ভাবনা করে প্রশ্ন করেন। এইসব কী প্রশ্ন?

শাহনেয়াজের বড় চাচা উঠে দাড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, তোমার এই বেয়াদবি তো আমি নিব না। সবার সামনে অপমান করেছ। নিজেকে তুমি কী ভাবো? তাকে বসানোর চেষ্টা করা হলো। সব চেষ্টাই বিফলে গেল। তিনি এই মুহুর্তেই নৌকা নিয়ে গ্রামে ফিরবেন। বিরাট হট্টগোল শুরু হলো। এই হট্টগােলের মধ্যে শাহনেয়াজ আতরকে স্পষ্ট গলায় বলল, মেয়ে দেখার নামে আমরা যে অপমান তোমাকে করেছি। তার জন্যে কিছু মনে করো না।

ধনু শেখ শাহনেয়াজের বড় চাচাকে ফেরাবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর লোকজন গিয়ে পায়ে ধরে তাকে ফেরত আনল। গ্রামের মানুষজনের কাছে পায়ে ধরা অনেক বড় জিনিস।

বড় চাচার মাধ্যমেই জানা গেল যে, কন্যাকে সবারই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। সুলক্ষণা কন্যা। এখন সবচে’ ভালো হয় মাওলানা ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলে। পছন্দ হবার পর বিয়ে ফেলে রাখতে হয় না। কন্যার ওপর জিনের নজর পড়ে। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে জিন নজর দিতে পারে না। বিবাহিত মেয়েদের বিষয়ে জিনের কোনো আগ্রহ নাই।

 

শিবশংকরের ভূত নামানোর ওঝা চলে এসেছে। উঠানে আগুন করা হয়েছে। আগুনের সামনে জলচৌকিতে বসানো হয়েছে শিবশংকরকে। তার চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে বাচ্চাদের মতো লালা পড়ছে। আগুনে হলুদ পুড়তে দেয়া হয়েছে। ওঝা মন্ত্রপাঠ করছেন

কালীঘাটে কালী মা

হায় আলি হায় ফাতেমা

পুবে গুনাই ঘাট

রাখিলাম জঙ্গল পট

বিষ্ণু হৈলা পোকাম্বর

আদস্ফ শূলপানি। ইত্যাদি…..

মন্ত্রপাড়া শেষ করে শুকনা মরিচপোড়া শিব শংকরের নাকের কাছে ধরা হলো। ওঝা কঠিন গলায় বললেন, তুই কে? তোর নাম কী? তুই থাকাস কই? না বললে বান মাইরা কী করব তার নাই ঠিক। বল কই থাকিস?

শিবশংকর গোঙাতে গোঙাতে বলল, গাছে থাকি।

তুই নারী না পুরুষ, এইটা বল। নারী?

হুঁ।

ওঝা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, যা ভেবেছিলাম। তাই। পেততুনিতে ধরেছে। জঙ্গলায় তিন চাইরটা পেততুনি থাকে- সব কয়টা দুষ্টের সেরা। এই তোর নাম বল। নাম না বললে মরিচ পুড়া নাকের ভিতর ঢুকায়ে দিব।

শিবশংকর বিড়বিড় করে নাম বলল।

পরিষ্কার করে বল। সবাই যেন শুনে, এইভাবে বল। তোর নাম কী?

হরিদাসী।

দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। কারণ অল্প কিছুদিন আগেই হরিদাসী মারা গেছে। তাকে শশানে পুড়িয়ে তার ছাই পাঠানো হয়েছে গঙ্গায় ফেলার জন্যে। তার যে গতি হয় নাই, সে প্রেতিযোনী প্রাপ্ত হয়েছে, এটা বান্ধবপুরের লোকজন জানত না।

 

আতর তার স্বামীর সঙ্গে বিশাল রেলিং দেয়া খাটের এক কোণে জড়সড় হয়ে আছে। মেঝেতে আতরের দাসী হামিদা বসে আছে। প্রথম বাসরের এই নিয়ম। স্বামী যেন স্ত্রীর খুব কাছে যেতে না পারে তার জন্যে পাহারার ব্যবস্থা। সারারাত সে এখানেই থাকবে।

শাহনেয়াজ নিচু গলায় বলল, আমি যে কবিতা লেখি এটা বোধহয় তুমি জানো না। আমার তিনটা কবিতা সওগাত-এ ছাপা হয়েছে। সওগাত পত্রিকার নাম শুনেছ?

আতর না-সূচক মাথা নাড়ল।

বাংলা পড়তে পার?

আতর হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

শরৎ বাবুর উপন্যাস পড়েছ?

আতর না-সূচক মাথা নাড়ল।

‘আনোয়ারা’ পড়েছ?

আতর আবারো না-সূচক মাথা নাড়ল। শাহনেয়াজ বলল, এখন থেকে গল্পউপন্যাস পড়বে। আমি জোগাড় করে দিব। সাহিত্যবোধ তৈরি না হলে আমার কবিতা বুঝতে পারবে না। এখন তোমাকে বিদ্যাসুন্দর পড়ে শোনাব। মন দিয়ে শোন, বুঝতে পার কি-না দেখ। বিদ্যার রূপ বর্ণনা পড়ব। বিদ্যা ছিল তোমার মতোই রূপবতী। তার রূপের বর্ণনা এবং তোমার রূপের বর্ণনা একই। বুঝেছ?

আতর আবার না-সূচক মাথা নাড়ল, তবে তার ধারণা সে মানুষটাকে বুঝতে পারছে। পাগলা ধরনের মানুষ। পাগলা না হলে বইখাতা নিয়ে কেউ স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে আসে না।

শুন রাজা সাবধানে পূর্বে ছিল এই স্থানে
বীরসিংহ নামে নরপতি।
বিদ্যা নামে তার কন্যা আছিল পরম ধন্যা
রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী।
প্ৰতিজ্ঞা করিল সেই বিচারে জিতিবে যেই
পতি হবে সেই যে তাহর।
রাজাপুত্ৰগণ তায় আসিয়া হরিয়া যায়
রাজা ভাবে কী হবে ইহার।।

শাহনেয়াজ মুগ্ধ হয়ে পড়ছে। আতর তাকিয়ে আছে। আতরের হঠাৎ মনে হলো তার জীবনটা মনে হয় সুখেই কাটবে। আজ ভোরেই সে শিবশংকরকে একটা চিঠি দিয়েছে, এই ভেবে এখন খারাপ লাগছে।

বই থেকে চোখ তুলে শাহনেয়াজ বলল, আতর।

জি।

কী পড়ছি বুঝতে পারছ তো?

পারছি।

লোচন অর্থ কী বলো? ওই যে লাইনটা—

বিধি চক্ষু দিল যারে সে যদি না দেখে তারে
তাহার লোচনে কিবা ফল?

আতর বলল, লোচন অর্থ আমি জানি না।

লোচন হলো চক্ষু। লাইন দু’টার অর্থ হলো, বিধি যাকে চোখ দিয়েছেন। সে যদি সেই চোখে না দেখে তাহলে চোখ দিয়ে লাভ কী? বুঝেছ?

জি।

বুঝতে না পারলে বলবে, আমি বুঝিয়ে দেব। হাসে কে? কে যেন হাসল।

হামিদা হাসে। আপনার কথা শুনে মজা পেয়ে হাসে।

শাহনেয়াজ বই থেকে চোখ তুলে মেঝেতে বসে থাকা হামিদার দিকে তাকাল। হামিদা মাথা নিচু করে প্রায় পুঁটলির মতো হয়ে গেল। শাহনেয়াজ বলল, প্রতিশব্দ বলে একটা বিষয় আছে। একই জিনিসের দু’টা তিনটা করে নাম। প্রতিশব্দ শিখতে হবে। কবিতা লেখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বুঝেছ?

আতর বলল, কথাটা কারে বললেন?

শাহনেয়াজ বলল, তোমাকে বলেছি।

হামিদার দিকে তাকায়া বলেছেন তো, এই জন্যে ভাবলাম তাকে বলেছেন।

তোমাকেই বলেছি। এখন তুমি বলো দেখি দুপুর’-এর প্রতিশব্দ কী?

জানি না।

হুট করে জানি না বলব না। চিন্তা-ভাবনা করবা। চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে। আচ্ছা দেখি আমি কয়টা বলতে পারি।

শাহনেয়াজ চোখে থেকে চশমা খুলল। চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে প্রতিশব্দ বলতে থাকল।

দুপুর
মধ্যাহ্ন
দ্বিপ্রহর
মাঝবেলা
দিবামধ্য
মধ্যদিন
যোহর

আতরের হাসি আসছে। সে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। শাহনেয়াজ বলল, এখন আসো রাতের প্রতিশব্দ কী জানো বলতে থাক। আতর অনেক ভেবেচিন্তে বলল, নিশা।

শাহনেয়াজ বলল, হয়েছে। আরো বলো।

আর পারব না। আপনি বলেন।

শাহনেয়াজ গড়গড় করে প্রতিশব্দ বলে যাচ্ছে

রাত
রাতি
নিশীথ
রজনী
যামিনী
বিভাবরী
তামসী
ক্ষণদা
নক্ত
অসুরা
যামবতী

আতর খিলখিল করে হেসে ফেলল। শাহনেয়াজ বন্ধ চোখ খুলে বিরক্ত হয়ে বলল, হাসো কেন?

আতর বলল, আপনার যা মনে আসতেছে আপনে বলতেছেন।

কী বললা তুমি? আমি ডিকশনারি মুখস্থ করা লোক। ডিকশনারি মুখস্থ করতে গিয়ে প্রথমবার এম এ সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষায় ফেল করেছি।

ও আচ্ছা।

তোমাদের বাড়িতে কি ডিকশনারি আছে?

ডিকশনারি থাকলে তোমার কাছে পরীক্ষা দিতাম।

আতর বলল, পরীক্ষা দিতে হবে না। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাবেন না?

শাহনেয়াজ বলল, রাতে আমি ঘুমাই না। যারা কবি-সাহিত্যিক তাদের জন্যে রাতের ঘুম হারাম। কবি-সাহিত্যিকরা রাতে চিন্তা-ভাবনা করেন। দিনে ভাব আসে না। ভাব আসে রাতে।

আপনি ঘুমান কখন?

দিনে। বলতে গেলে সারাদিনই ঘুমাই। আতর, একটা কলম এনে দাও তো। দেখি কিছু লেখা যায় কি-না। তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে রাখি। কবিতার নামটা মাথায় চলে আসছে— ‘মানস প্রিয়া’। মানস প্রিয়া অর্থ কী বুঝেছ? যে প্রিয়া মনে বাস করে।

আমি তো মনে বাস করি না। আমি বান্ধবপুরে বাস করি।

শাহনেয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, বান্ধবপুর কবির মনের বাইরের কোনো জায়গা না। এখন তুমি বলে মনের কী কী প্রতিশব্দ জানো।

আমি কেনোটাই জানি না। আপনি বলেন।

শাহনেয়াজ আগ্রহ নিয়ে প্রতিশব্দ বলছে। প্ৰতিশব্দ বলার সময় সে চোখ বন্ধ করে থাকে। কাজেই হামিদা ঘোমটা তুলে আতরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

মন
চিত্ত
অন্তর
মানস
হৃদি
মর্ম
হিয়া
আঁত
দিল
পরান
অন্তকরণ
চিত্তাপট
মনোমন্দির

শাহনেয়াজ চোখ মেলে বলল, আরো তিন চারটা আছে, এখন মনে পড়ছে না। এসব হচ্ছে চর্চার ব্যাপার। অভ্যাসের ব্যাপার। অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। যাও কাগজকলম নিয়ে আসা। না-কি তোমাদের বাড়িতে কাগজ-কলমের ব্যবহার নাই?

হামিদা কাগজ-কলম আনতে গেল। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে সে ফিরছে না। শাহনেয়াজ বলল, ব্যাপার কী?

আতর বলল, হামিদা ফিরবে না।

কেন?

তার বুদ্ধি বেশি। এইজন্যে ফিরবে না।

এখানে বুদ্ধি বেশির কি আছে?

আতর বলল, সে ফিরবে না যাতে আপনি আমারে নিয়া ভাব ভালোবাসা করতে পারেন। খাট থেকে নামেন। দরজা বন্ধ করেন। বাতি নিভানি।

কবি শাহনেয়াজ খাট থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আতর তাকে টেনে তুলল। আতরই দরজা বন্ধ করল, বাতি নেভাল।

শাহনেয়াজ বলল, তোমার নাম আতর না হয়ে হিয়া’ হলে ভালো হতো।

কেন?

অনেক মিল পাওয়া যেত। আতরের সঙ্গে মিলে আতর কাতর পাথর। আর কিছু না। হিয়ার সঙ্গে অনেক কিছু মিলে যেমন—

হিয়া
প্রিয়া
নিয়া
দিয়া

আতর বলল, চুপ করেন তো।

শাহনেয়াজ বলল, বাতিটা একটু জ্বলাও। আমি অন্ধকারে থাকতে পারি না। ভয় লাগে।

কিসের ভয়?

ভূতের। আমাদের বাড়িতে তিন-চারটা ভূত আছে। এর মধ্যে একটা খুবই দুষ্ট। তোমাদের এই বাড়িতে কি ভূত আছে?

আতর হেসে ফেলল। শাহনেয়াজ বলল, রাতে হাসবা না। ভূত প্রেত রাতে হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়। চুম্বক যেমন লোহা টানে— মেয়েদের হাসি তেমন ভূত টানে। কই বাতি জ্বালাতে বললাম না?

আতর বাতি জ্বালালো। *

————-

* ‘মধ্যাহ্ন’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লিখেছিলাম, মনিশংকরের পুত্র শিবশংকর পরিণত বয়সে মারা যান। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার এবং পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংলার। একটি ব্যাপার বলা হয় নি—তিনি চিরকুমার ছিলেন। তাঁর Ph.D গবেষণাপত্র An introduction to Tantric Buddhism উৎসর্গ করেছিলেন একজন মুসলমান কিশোরীকে। তার নাম আতর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *