বাদাতে ধানকাটা আরম্ভ হইয়াছে, সালতি সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়াছে –চারিদিক জলময় –মধ্যে মধ্যে চৌকি দিবার টং, কিন্তু প্রজার নিস্তার নাই –এদিকে মহাজন ওদিকে জমিদারের পাইক। যদি বিকি ভালো হয় তবে তাহদিগের দুই বেলা দুই মুঠা আহার চলিতে পারে নতুবা মাছটা, শাকটা ও জনখাটা ভরসা। ডেঙাতে কেবল হৈমন্তী বুনন হয় –আউস প্রায় বাদাতেই জন্মে। বঙ্গদেশে ধান্য অনায়াসে উৎপন্ন হয় বটে কিন্তু হাজা, শুকা, পোকা, কাঁকড়া ও কার্তিকে ঝড়ে ফসলের বিলক্ষণ ব্যাঘাত হয়; আর ধানের পাইটও আছে, তদারক না করিলে কলা ধরিতে পারে। বাহুল্য প্রাতঃকালে আপন জোতের জমি তদারক করিয়া আপন বাটীর দাওয়াতে বসিয়া তামাক খাইতেছেন; সম্মুখে একটা কাগজের দপ্তর, নিকটে দুই-চারিজন হারামজাদা প্রজা ও আদালতের লোক বসিয়ে আছে –হাকিমের আইনের ও মামলার কথাবার্তা হইতেছে ও কেহ কেহ নূতন দস্তাবেজ তৈয়ার ও সাক্ষী তালিম করিবার ইশারা করিতেছে –কেহ কেহ টাকা টেঁক থেকে খুলিয়া দিতেছে ও আপন আপন মতলব হাঁসিল জন্য নানা প্রকার স্তুতি করিতেছে। বাহুল্য কিছু যেন অন্যমনস্ক –এদিকে ওদিকে দেখিতেছেন –এক একবার আপন কৃষাণকে ফাল্তো ফরমাইশ করিতেছেন, “ওরে ঐ কদুর ডগাটা মাচার উপর তুলে দে, ঐ খেড়ের আঁটিটা বিছিয়ে ধুপে দে,” ও এক এক বার ছমছমে ভাবে চারিদিকে দেখিতেছেন। নিকটস্থ এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল –মৌলুবী সাহেব! ঠকচাচার কিছু মন্দ খবর শুনিতে পাই –কোনো পেঁচ নাই তো ? বাহুল্য কথা ভাঙিতে চান না, দাড়ি নেড়ে –হাত তুলে অতি বিজ্ঞরূপে বলিতেছেন –মরদের উপর হরেক আপদ গেরে, তার ডর করলে চলবে কেন ? অন্য একজন বলিতেছে –এ তো কথাই আছে কিন্তু সে ব্যক্তি বারেঁহা, আপন বুদ্ধির জোরে বিপদ থেকে উদ্ধার হইবে। সে যাহা হউক আপনার উপর কোনো দায় না পড়িলে আমরা বাঁচি –এই ডেঙা ভবানীপুরে আপনি বৈ আমাদের সহায় সম্পত্তি আর নাই –আমাদের বল বলুন, বুদ্ধি বলুন সকলই আপনি। আপনি না থাকলে আমাদের এখান হইতে বাস উঠাইতে হইত। ভাগ্যে আপনি আমাকে কয়েকখানা কবজ বানিয়ে দিয়েছিলেন তাই জমিদার বেটাকে জব্দ করিয়াছি, আমার উপর সেই অবধি কিছু দৌরাত্ম্য করে না –সে ভালো জানে যে আপনি আমার পাল্লায় আছেন। বাহুল্য আহ্লাদে গুড়গুড়িটা ভড় ভড় করিয়া চোক মুখ দিয়া ধুঁয়া নির্গত করত একটু মৃদু মৃদু হাস্য করিলেন। অন্য একজন বলিল –মফস্বলে জমি-জমা শিরে লইতে গেলে জমিদার ও নীলকরদের জব্দ করিবার জন্য দুই উপায় আছে –প্রথমত মৌলুবী সাহেবের মতন লোকের আশ্রয় লওয়া –দ্বিতীয়ত খ্রীষ্টিয়ান হওয়া। আমি দেখিয়াছি অনেক প্রজা পাদরীর দোহাই দিয়া গোকুলের ষাড়েঁর ন্যায় বেড়ায় ! পাদরী সাহেব কড়িতে বলো –সহিতে বলো –সুপারিসে বলো “ভাই লোকদের” সর্বদা রক্ষা করেন। সকল প্রজা যে মনের সহিত খ্রীষ্টিয়ান হয় তা নয় কিন্তু যে পাদরীর মণ্ডলীতে যায় সে নানা উপকার পায়। মাল মকদ্দমায় পাদরীর চিঠি বড়ো কর্মে লাগে। বাহুল্য বলিলেন, সে সচ্ বটে –লেকেন আদমির আপনার দীন খোয়ানা বহুত বুরা। অমনি সকলে বলিল –তা বটে তো, তা বটে তো ; আমরা এই কারণে পাদরীর নিকটে যাই না। এইরূপ খোশ গল্প হইতেছে ইতিমধ্যে দারোগা, জন কয়েক জমাদার ও পুলিসের সার্জন হুড়মুড় করিয়া বাহুল্যের হাত ধরিয়া বলিল –তোম ঠকচাচা কো সাত জাল কিয়া –তোমার উপর গেরেপ্তারি হেয়। এই কথা শুনিবামাত্র নিকটস্থ লোক সকলে ভয় পাইয়া সট্ সট্ করিয়া প্রস্থান করিল। বাহুল্য দারোগা ও সার্জনকে ধন লোভ দেখাইল কিন্তু তাহারা পাছে চাকরি যায় এই ভয়ে ওকথা আমলে আনিল না, তাহার হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। ডেঙ্গা ভবানীপুরে এই কথা শুনিয়া লোকারণ্য হইল ও ভদ্র ভদ্র লোকে বলিতে লাগিল দুষ্কর্মের শাস্তি বিলম্বে বা শীঘ্রে অবশ্যি হইবে। যদি লোকে পাপ করিয়া সুখে কাটাইয়া যায় তবে সৃষ্টিই মিথ্যা হইবে, এমন কখনই হইতে পারে না। বাহুল্য ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়াছেন –অনেকের সহিত দেখা হইতেছে কিন্তু কাহাকে দেখেও দেখেন না। দুই-এক ব্যক্তি যাহারা কখন না কখন তাহার দ্বারা অপকৃত হইয়াছিল, তাহারা এই অবকাশে কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া নিকটে আসিয়া বলিল –মৌলবী সাহেব ! একি ব্রজের ভাব না-কি ? আপনার কি কোনো ভারি বিষয় কর্ম হইয়াছে ? না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বাহুল্য বংশদ্রোণীর ঘাট পার হইয়া শাগঞ্জে আসিয়া পড়িলেন। সেখানে দুই-একজন টেপুবংশীয় শাজাদা তাঁহাকে দেখিয়া বলিল –কেউঁ তু গেরেপ্তার হোয়া –আচ্ছা হুয়া –এয়সা বদ্জাত আদমিকো সাজা মিলনা বহুত বেহতর। এই সকল কথা বাহুল্যের প্রতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা লাগিতে লাগিল। ঘোরতর অপমানে অপমানিত হইয়া ভবানীপুরে পৌঁছিলেন –কিঞ্চিৎদূরে থেকে বোধ হইল রাস্তার বামদিকে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়া গোল করিতেছে, নিকটে আসিয়া সার্জন বাহুল্যকে লইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখানে এত লোক কেন ? পরে লোক ঠেলিয়া গোলের ভিতর যাইয়া দেখিল, একজন ভদ্রলোক এক আঘাতিত ব্যক্তিকে ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া আছেন –আঘাতিত ব্যক্তির মস্তক দিয়া অবিশ্রান্ত রুধির নির্গত হইতেছে, ঐ রক্তে উক্ত ভদ্রলোকের বস্ত্র ভাসিয়া যাইতেছে; সার্জন জিজ্ঞসা করিল, আপনি কে ও এ লোকটি কি প্রকারে জখম হইল? ভদ্রলোক বলিলেন –আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস –আমি এখানে কোনো কর্ম অনুরোধে আসিয়াছিলাম দৈবাৎ এই লোক গাড়ি চাপা পড়িয়া আঘাতিত হইয়াছে, এই জন্য আমি আগুলিয়া বসিয়া আছি –শীঘ্র হাসপাতালে লইয়া যাইব তাহার উদ্যোগ পাইতেছি –একখানা পালকি আনিতে পাঠাইয়াছিলাম কিন্তু বেহারা ইহাকে কোনো মতে লইয়া যাইতে চাহে না, কারণ এই ব্যক্তি জেতে হাড়ি। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে বটে কিন্তু এ ব্যক্তি গাড়িতে উঠিতে অক্ষম, পাল্কি কিংবা ডুলি পাইলে যত ভাড়া লাগে তাহা আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সততার এমনি গুণ যে ইহাতে অধমেরও মন ভেজে। বরদাবাবুর এই ব্যবহার দেখিয়া বাহুল্যের আশ্চর্য জন্মিয়া আপন মনে ধিক্কার হইতে লাগিল ! সার্জন বলিল –বাবু, বাঙালীরা হাড়িকে স্পর্শ করে না, বাঙালী হইয়া তোমার এত দূর করা বড়ো সহজ কথা নহে। বোধ হয় তুমি বড়ো অসাধারণ ব্যক্তি, এই বলিয়া আসামীকে পেয়াদার হাওয়ালে রাখিয়া সার্জন আপনি আড়ার নিকট যাইয়া ভয়মৈত্রতা প্রদর্শনপূর্বক পালকি আনিয়া বরদাবাবুর সহিত উক্ত হাড়িকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল।
পূর্বে বড়ো আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা বৎসরে তিন তিন মাস অন্তর হইত এক্ষণে কিছু ঘন ঘন হইয়া থাকে। ফৌজদারী মকদ্দমা নিষ্পত্তি করণার্থে তথায় দুই প্রকার জুরি মকরর হয়, প্রথমত গ্রাঞ্জুরি, যাহারা পুলিশ-চালানি ও অন্যান্য লোক যে ইণ্ডাইটমেণ্ড করে তাহা বিচারযোগ্য কি-না বিবেচনা করিয়া আদালতকে জানান –দ্বিতীয়ত পেটিজুরি, যাহারা গ্রাঞ্জুরি বিবেচনা অনুসারে বিচারযোগ্য মকদ্দমা জজের সহিত বিচার করিয়া আসামিদিগকে দোষী বা নির্দোষ করেন। এক এক সেশনে অর্থাৎ ফৌজদারী আদালতে ১৪ জন গ্রাঞ্জুরি মকরর হয়, যে সকল লোকের দুই লক্ষ টাকার বিষয় বা যাহারা সৌদাগরি করে তাহারাই গ্রাঞ্জুরি হইতে পারে। সেশনে পেটিজুরি প্রায় প্রতিদিন মকরর হয়, তাহাদিগের নাম ডাকিবার কালীন আসামী বা ফৈরাদি স্বেচ্ছানুসারে আপত্তি করিতে পারে অর্থাৎ যাহার প্রতি সন্দেহ হয় তাহাকে না লইয়া অন্য আর একজনকে নিযুক্ত করাইতে পারে কিন্তু বারোজন পেটিজুরি শপথ করিয়া বসিলে আর বদল হয় না। সেকশনের প্রথম দিবসে তিনজন জজ বসেন, যখন যাঁহার পালা তিনি গ্রাঞ্জুরি মকরর হইলে তাঁহাদিগাকে চার্জ অর্থাৎ সেশনীয় মকদ্দমার হালাৎ সকল বুঝাইয়া দেন। চার্জ দিলে পর অন্য দুইজন জজ যাঁহাদের পালা নয় তাঁহারা উঠিয়া যান ও গ্রাঞ্জুরিরা এক কামরার ভিতর যাইয়া প্রত্যেক ইণ্ডাইটমেণ্ডের উপর আপন বিবেচনানুসারে যথার্থ বা অযথার্থ লিখিয়া পাঠাইয়া দেন, তাহার পর বিচার আরম্ভ হয়।
রজনী প্রায় অবসান হয় –মন্দ মন্দ সমীরণ বহিতেছে, এই সুশীতল সময়ে ঠকচাচা মুখ হাঁ করিয়া বেতর নাক ডাকাইয়া নিদ্রা যাইতেছেন। অন্যান্য কয়েদীরা উঠিয়া তামাক খাইতেছে ও কেহ কেহ ঐ শব্দ শুনিয়া “মোস পোড়া খা, মোস পোড়া খা” বলিতেছে কিন্তু ঠকচাচা কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রা যাইতেছেন –”নাসা গর্জন শুনি পরান শিহরে”। কিয়ৎকাল পরে জেলরক্ষক সাহেব আসিয়া কয়েদীদের বলিলেন –তোমরা শীঘ্র প্রস্তুত হও, অদ্য সকলকে আদালতে যাইতে হইবে।
এদিকে সেশন খুলিবামাত্রে দশ ঘণ্টার অগ্রেই বড়ো আদালতের বারান্দা লোকে পরিপূর্ণ হইল –উকিল, কৌন্সুলি, ফৈরাদি, আসামী, সাক্ষী, উকিলের মুৎসুদ্দি, জুরি, সার্জন, জমদার, পেয়াদা –নানা প্রকার লোক থৈ থৈ করিতে লাগিল। বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবকে লইয়া ফিরিতেছেন ও ধনী লোক দেখিলে তাঁহাকে জানুন না জানুন আপনার বামনাই ফলাইবার জন্য হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিতেছেন, কিন্তু যিনি তাঁহাকে ভালো জানেন তিনি তাঁহার শিষ্টাচারিতে ভুলেন না –তিনি এক লহমা কথা কহিয়াই একটা-না-একটা মিথ্যা বরাত অনুরোধে তাঁহার হাত হইতে উদ্ধার হইতেছেন। দেখতে দেখতে জেলখানার গাড়ি আসিল –আগু পিছু দুই দিকে সিপাই। গাড়ি খাড়া হইবামাত্রে সকলে বারান্দা থেকে দেখিতে লাগিল –গাড়ির ভিতর থেকে সকল কয়েদীকে লইয়া আদালতের নীচেকার ঘরের কাঠগড়ার ভিতর রাখিল। বাঞ্ছারাম হন হন করিয়া নীচে আসিয়া ঠকচাচা ও বাহুল্যের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন –তোমরা ভীমার্জুন –ভয় পেও না –এ কি ছেলের হাতের পিটে ?
দুই প্রহর হইবামাত্রে বারান্দার মধ্যস্থল খালি হইল –লোক সকল দুইদিকে দাঁড়াইল –আদালতের পেয়াদা “চুপ্ চুপ্” করিতে লাগিল –জজেরা আসিতেছেন বলিয়া যাবতীয় লোক নিরীক্ষণ করিতেছে এমন সময়ে সার্জন পেয়াদা ও চোপদারেরা বল্লম, বর্শা, আশাসোঁটা, তলোয়ার ও বাদশাহ্র রৌপ্যময় মটুকাকৃতি সজ্জা হস্তে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর সরিফ ও ডিপুটি সরিফ ছড়ি হাতে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর তিনজন জজ লাল কোর্তা পরা গম্ভীরবদনে মৃদু মৃদু গতিতে বেঞ্চের উপর উঠিয়া কৌন্সুলিদের সেলাম করত উপবেশন করিলেন। কৌন্সুলিরা অমনি দাঁড়াইয়া সম্মানপূর্বক অভিবাদন করিল –চৌকির নাড়ানাড়ি ও লোকের বিজ্বিজিনি এবং ফুসফুসানি বৃদ্ধি হইতে লাগিল –পেয়াদারা মধ্যে মধ্যে “চুপ্ চুপ্ চুপ্” করিতেছে –সার্জনেরা “হিশ হিশ” করিতেছে –ক্রায়র “ওইস –ওইস” বলিয়া সেশন খুলিল। অনন্তর গ্রাঞ্জুরিদিগের নাম ডাকা হইয়া তাহারা মকরর হইল ও আপনাদিগের ফোরম্যান অর্থাৎ প্রধান গ্রাঞ্জুরি নিযুক্ত করিল। এবার রস্ল্ সাহেবের পালা, তিনি গ্রাঞ্জুরির প্রতি অবলোকন করিয়া বলিলেন –মকদ্দমার তালিকা দৃষ্টে বোধ হইতেছে যে, কলিকাতায় জাল করা বৃদ্ধি হইয়াছে কারণ ঐ কালেবের পাঁচ-ছয়টা মকদ্দমা দেখিতে পাই –তাহার মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি যে নালিশ তৎসম্পর্কীয় জবানবন্দিতে প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহারা শিয়ালদাতে জাল কোম্পানির কাগজ তৈয়ার করিয়া কয়েক বৎসরাবধি এই শহরে বিক্রয় করিতেছে –এ মকদ্দমা বিচারযোগ্য কি-না তাহা আমাকে আগ্রে জানাইবেন –অন্যান্য মকদ্দমার দস্তাবেজ দেখিয়া যাহা কর্তব্য তাহা করিবেন তদ্বিষয়ে আমার কিছু বলা-বাহুল্য। এই চার্জ পাইয়া গ্রাঞ্জুরি কামরার ভিতর গমন করিল –বাঞ্ছারাম বিষন্ন ভাবে বটলর সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন। দশ-পনের মিনিটের মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি ইণ্ডাইটমেণ্ড যথার্থ বলিয়া আদালতে প্রেরিত হইল। অমনি জেলের প্রহরী ঠকচাচা ও বাহুল্যকে আনিয়া জজের সম্মুখে কাঠরার ভিতর খাড়া করিয়া দিল ও পেটিজুরি নিযুক্ত হওন কালীন কোর্টের ইণ্টারপ্রিটার চিৎকার করিয়া বলিলেন –মোকাজান ওরফে ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমলোক্কা উপর জাল কোম্পানির কাগজ বানানেকা নালেশ হুয়া –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল –জাল বি কাকে বলে আর কোম্পানির কাগজ বি কাকে বলে মোরা কিছুই জানি না, মোরা সেরেফ মাছ ধরবার জাল জানি। মোরা চাষবাস করি মোদের এ কাম নয় –এ কাম সাহেব সুভদের। ইণ্টারপ্রিটার ত্যক্ত হইয়া বলিল তোমলোক বহুত লম্বা লম্বা বাত কহতা হেয় –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল – মোদের বাপ-দাদারাও কখন করে নাই। ইণ্টারপ্রিটার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেজ চাপড়িয়া বলিল –হামারি বাতকো জবাব দেও –এ কাম কিয়া কি নেহি ? নেহি নেহি এ হামলোক কাভি কিয়া নেহি –এই উত্তর আসামীরা অবশেষে দিল। উক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার তাৎপর্য এই যে আসামী যদি আপন দোষ স্বীকার করে তবে তাহার বিচার আর হয় না –একেবারে সাজা হয়। অনন্তর ইণ্টারপ্রিটার বলিলেন –শুন –এই বারো ভালা আদমি বয়েট করকে তোমলোক কো বিচার করেগা –কিসিকা উপর আগর ওজর রহে তব আবি কহ –ওন্কো উঠায় করকে দুসরা আদমিকো ওন্কো জাগেমে বটলা যায়েগি। আসামীরা এ কথার ভালো-মন্দ কিছু না বুঝিয়া চুপ করিয়া থাকিল। এদিকে বিচার আরম্ভ হইয়া ফৈরাদির ও সাক্ষীর জবানবন্দীর দ্বারা সরকারের তরফ কৌন্সুলি স্পষ্টরূপে জাল প্রমাণ করিল, পরে আসামিদের কৌন্সুলি আপন তরফ সাক্ষী না তুলিয়া জেরার মারপেছি কথা ও আইনের বিতণ্ডা করত পেটিজুরিকে ভুলাইয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার বত্তৃতা শেষ হইলে পর রস্ল্ সাহেব মকদ্দমা প্রমাণের খোলসা ও জালের লক্ষণ জুরিকে বুঝাইয়া বলিলেন –পেটিজুরি এই চার্জ পাইয়া পরামর্শ করিতে কামরার ভিতর গমন করিল –জুরিরা সকলে ঐক্য না হইলে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে পারে না। এই অবকাশে বাঞ্ছারাম আসামীদের নিকট আসিয়া ভরসা দিতে লাগিলেন, দুই-চারিটা ভালো-মন্দ কথা হইতেছে ইতিমধ্যে জুরিদের আগমনের গোল পড়ে গেল। তাহারা আসিয়া আপন আপন স্থানে বসিলে ফোরম্যান দাঁড়াইয়া খাড়া হইলেন –আদালত একেবারে নিস্তব্ধ –সকলেই ঘাড় বাড়াইয়া কান পেতে রহিল –কোর্টের ফৌজদারী মমলার প্রধান কর্মচারী ক্লার্ক অব্দি ক্রৌন জিজ্ঞাসা করিল, –জুরি মহাশয়েরা ! ঠকচাচা ও বাহুল্য গিল্টি কি নাট গিল্টি ? ফোরম্যান বলিলেন –গিল্টি –এই কথা শুনিবামাত্র আসামীদের একেবারে ধড় থেকে প্রাণ উড়ে গেল –বাঞ্ছারাম আস্তে-ব্যস্তে আসিয়া বলিলেন –আরে ও ফুল গিল্টি ! এ কি ছেলের হাতের পিটে ? এখুনি নিউ ট্রায়েল অর্থাৎ পুনর্বিচারের জন্য প্রার্থনা করিব। ঠকচাচা দাড়ি নাড়িয়া বলিলেন –মোশাই ! মোদের নসিবে যা আছে তাই হবে মোরা আর টাকাকড়ি সরবরাহ করিতে পারিব না। বাঞ্ছারাম কিঞ্চিৎ চটে উঠিয়া বলিলেন –সুদু হাঁড়িতে পাত বাঁধিয়া কত করিব –এসব কর্মে কেবল কেঁদে কি মাটি ভিজানো যায় ?
এদিকে রস্ল্ সাহেব উল্টে-পাল্টে দেখিয়া আসামীদিগের প্রতি দৃষ্টি করত এই হুকুম দিলেন – “ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমাদের দোষ বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইল – যে সকল লোক এমন দোষ করে তাহাদের গুরুতর দণ্ড হওয়া উচিৎ, এ কারণে তোমরা পুলিপালমে গিয়া যাবজ্জীবন থাক।” এই হুকুম হইবামাত্র আদালতের প্রহরীরা আসামীদের হাত ধরিয়া নীচে লইয়া গেল। বাঞ্ছারাম পিচ কাটিয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন –কেহ কেহ তাঁহাকে বলিল –এ কি –আপনার মকদ্দমাটা যে ফেঁসে গেল ? তিনি উত্তর করিলেন –এ তো জানাই ছিল –আর এমন সব গলতি মামলায় আমি হাত দি না –আমি এমতো সকল মকদ্দমা কখনই ক্যার করি না।