বড়দির বিয়ের দিন আমি প্রথম ধুতি পরি। মা আমাকে গোলাপি রঙের সিল্কের পাঞ্জাবি ও জরিপাড় ধুতি পরিয়ে দিয়েছিল, এবং ফুলফুল আঁকা সাদা পাম্পশু। দু-তিন বার আছাড় খেয়ে ধুতিটা আমি মোটামুটি কায়দা করে নিয়েছিলাম কিন্তু নতুন জুতোর জন্যে আমার পায়ে ফোঁসকা হয়ে যায়, ফলে জুতোর মধ্যে তুলো লাগাতে হয়।
খুব আনন্দ হয়েছিল বড়দির বিয়েতে। সাত দিন ধরে আমরা তালতলার বাড়িতেই ছিলাম। বিয়ের দিন সকাল থেকেই গেটের সামনে সানাই বসেছিল। সানাইয়ের বাজনার থেকেও আমার বেশি মজা লেগেছিল যে লোকটি পোঁ করে থাকে, তাকে দেখতে। একজন বেঁটে মতন লোক সারা দিন-রাত ধরে শুধু সানাইতে পোঁ-ও-ও করে যায়।
সারা দিন ধরে তত্ত্ব গেল, তত্ত্ব এল। কী বিরাট বিরাট দু’খানা মাছ এল বরের বাড়ি থেকে। বড়দিকে গায় হলুদ মাখিয়ে চান করানো হল। মা বড়দিকে বলে দিল, দুপুরবেলা ঘুমুবি। আজ একদম ঘোরাফেরা করবি না। বিয়ের কনেকে দুপুরে ঘুমুতে হয়–এই নিয়ম!
আমার খুব ইচ্ছে ছিল নেমন্তন্নর সময় জল কিংবা নুন পরিবেশন করার। কিন্তু আমাকে কিছুতেই তা দেওয়া হল না। আমাকে বলা হল, বরযাত্রীদের কাছে বেলফুলের মালা নিয়ে যেতে, কিন্তু সেটা তো মেয়েদের কাজ তাই আমি নিইনি।
বর এসেছিল একটা হাঁসের পিঠে চড়ে। মানে, একটা মটোরগাড়ি–সেটাতে ফুল দিয়ে হাঁসের মতন সাজানো। সেই মটোরগাড়ির পাদানিতে দু’পাশে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল–তাদের এমন পোশাক, ঠিক যেন ইতিহাস বইয়ের সৈন্য!
জামাইবাবু খুব রোগা আর লম্বা। টকটকে ফরসা রং, চুলগুলো কোঁকড়া। তার দু’হাতে তিনটে আংটি। তিনি গদিমোড়া চেয়ারে বসে খুব ঘামতে লাগলেন, একজন লোক ময়ূরের পালকের পাখা দিয়ে তাকে হাওয়া করতে লাগল। জামাইবাবু দারুণ বিদ্বান, ডবল এম এ পাস! তিনি কারওর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকান না সব সময় চোখ নিচু করে থাকেন। জামাইবাবুরা থাকেন খঙ্গাপুর। বিয়ের পর বড়দিকে খঙ্গপুরে নিয়ে চলে যাবেন।
সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়িটা লোকে একেবারে ভরে গেল। বড়বাবু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করছেন। জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বড়বাবুর যে ঝগড়া হয়েছিল–আজ কিন্তু সেটা দেখে কেউ বুঝতে পারবে না। জ্যাঠামশাই একদম সাজপোশাক করেননি-ফতুয়া পরে ঘোরাঘুরি করছেন-মাঝে মাঝে এসে বড়বাবুর সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। বাবা আছেন মিষ্টির ঘর পাহারায়। সাধুকাকা অবশ্য বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই বসে রইলেন। সাধুকাকাকে কেউ চেনে না।
বিষ্ণু, দীপ্তি, অংশু, রেণু–ওরাও এসেছে নেমন্তন্ন খেতে। সুপ্রকাশদা আসতে পারেননি। বিষ্ণুর সঙ্গে কয়েক দিন আমার কথা বন্ধ ছিল, কিন্তু আজ আমি নিজে থেকেই ভাব করে নিলাম। আজকের দিনে কি বিষ্ণুর সঙ্গে কথা না বলে থাকা যায়? ওরা কিন্তু কেউ ধুতি পরেনি। রেণু ফাজলামি করে আমার ধুতি খুলে দেবার চেষ্টা করছিল–কিন্তু আমার কোমরে বেল্ট বাঁধা, অত সহজে খুলবে না! রেণু মাথায় লাল রিবন, সাদা সিল্কের ফ্রক পরে এসেছে। কিছু দিন আগে ওর কান বেঁধানো হয়েছে বলে, দু’কানে এখনও একটু একটু ঘা। ওর কানে ব্যথা দিয়ে দিলে এত লোকজনের মধ্যেই বোধহয় কেঁদে ফেলবে।
আমার কাজ হল সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। একবার ছাদে কিংবা বারান্দায় খাবার জায়গায়, কিংবা একতলায় বর যেখানে বসেছে সেই আসরে কিংবা যে-ঘরে বড়দিকে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু সব জায়গাতেই আমরা তাড়া খাই। যেখানেই যাই, কেউ-না-কেউ বলে, এই ছোটরা, এখানে কী করছিস, নীচে যা! আবার নীচে গেলে বলে, ওপরে যা। দীপ্তি অবশ্য শাড়ি পরে এসেছে, ওকে বেশ বড়ই দেখাচ্ছে। ও অনায়াসেই বড়দের দলে ভিড়ে গেল।
আমরা কেউই আগে খাব না ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আমাদের জোর করে ফার্স্ট ব্যাচে খাইয়ে দেওয়া হল। কেউ বারণ করার আগেই আমরা একটা করে পান খেয়ে নিলাম, কিন্তু আমার জামাতেই শুধু পানের পিক লেগে গেল। আগে খাইয়ে দিক আর। নাই দিক, আমরা কেউ ঘুমোব না, বিয়ে দেখব। লগ্ন অনেক দেরিতে। রেণুটা এমন ক্যাবলা, ওরই ঘুমে চোখ ছোট হয়ে এল আগে। আমি ওকে চিমটি কেটে জাগিয়ে রাখতে চাইলাম। রেণু নিজেই নিজের হাতে দু-এক বার চিমটি কাটল। তারপর একটু বাদে দেখি রেণু নেই। আর একটু বাদে দেখলাম, সাধুকাকার ঘরে রেণু অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
উঠোনের ছবি-আঁকা পিড়িতে জামাইবাবুকে আগে এনে বসানো হল। তিনজন বাঘা বাঘা পুরুত মন্ত্র পড়তে লাগলেন জোরে জোরে। সেই প্রথম আমরা বুঝতে পারলাম, জামাইবাবু একটু তোতলা। প্রতিটি কথা বলছেন থেমে থেমে, মাঝে মাঝে মধুকে বলছেন—মধু।
আমি একটু আড়ালে এসে বললাম, এ মা, হি-হি-হি, জামাইবাবু তোতলা।
বিষ্ণু গম্ভীর ভাবে আমাকে ধমক দিয়ে বলল, ছিঃ ওকথা বলতে নেই। ডবল এম এ পাশ না!
আমার তখন ভয় হতে লাগল, বড়দি জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলবে না তো? তা হলে কী হবে?
বিষ্ণুকে বললাম, চল, বড়দিকে দেখে আসি।
অংশুর বোধহয় ঘুম পেয়েছে। ওর আর ভালো লাগছে না–ও বিষ্ণুকে বলল, এবার বাড়ি যাবি না?
বিষ্ণু বলল, কী করে যাব? মা’দের তো এখনও খাওয়াই হয়নি। তুই ঘুমোবি!
ঘুমিয়ে পড়লে ওর আত্মসম্মানে লাগবে বলে ও ঘুমোতেও চায় না।
বড়দির ঘরে খুব মেয়েদের ভিড়। ঠেলেঠুলে আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম। ইস, কী সুন্দর সাজিয়েছে বড়দিকে! টকটকে লাল রঙের শাড়ি, সারা গায়ে ঝলমল করছে গয়না, মুখময় চন্দনের ফোঁটা, কানে কানপাশা, কপালে ঝুলছে টিকলি। কাছে গিয়ে দেখি বড়দির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।
বড়দিকে সাজাবার ভার নিয়েছে মা। পাউডারের পাফ দিয়ে বড়দির গালে বুলোতে বুলোতে মা ফিসফিস করে বলছে, এই, কী করছিস কী? বোকা মেয়ে! সব সাজ নষ্ট হয়ে যাবে!
বড়দির পেছনেই দাঁড়িয়ে দীপ্তি। বড়দিকে দেখে ওরও চোখ ছলছল করছে দেখলাম।
হঠাৎ দরজার কাছে আওয়াজ শোনা গেল, ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো!
তাকিয়ে দেখি, জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু, অনাদি জ্যাঠামশাই। অনাদি জ্যাঠামশাই খুব ভালো ছবি তোলেন, উনি বড়দির ছবি তুলতে এসেছেন।
দরজার কাছ থেকে মেয়েদের ভিড় প্রায় ঠেলেঠুলেই সরানো হল। অনাদিজ্যাঠা স্ট্যান্ডের ওপর বসানো মস্ত বড় ক্যামেরাটা ঠিক করলেন। তারপর মস্ত বড় একখানা কাপড়–যেটার একদিকে লাল আর একদিকে কালো সেই কাপড়খানা দিয়ে অনাদিজ্যাঠা ক্যামেরা ও নিজের মুন্ডু সম্পূর্ণ ঢেকে ফেললেন। বেশি আলোর ব্যবস্থার জন্য দু’খানা হ্যাঁজাক এনে রাখা হল ঘরের মধ্যে। অনাদিজ্যাঠা ছবি তুলবেন, আমরা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাৎ অনাদিজ্যাঠা কালো কাপড় থেকে মুন্ডু বার করে হুংকার দিয়ে উঠলেন, এ কী, মেয়ের চোখে জল কেন?
মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ওর চোখে পাউডার লেগে গেছে তো—
আমি কি শুভদিনে কান্নার ছবি তুলব নাকি!
মা নিজের আঁচল দিয়ে বড়দির চোখ মুছিয়ে দিলেন। অনাদিজ্যাঠা আবার কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ফেললেন, সেই অবস্থাতেই হুকুম করলেন, মুখ ভোলো! কনের মুখ। আরও উঠবে!
মা বড়দির থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে দিলেন।
হাসো!
বড়দির ঠোঁট কাঁপছে। আবার মুখ নিচু করতে যাচ্ছিল, অনাদিজ্যাঠা বকুনি দিলেন, হাসো! একদম নড়বে না–
বড়দি ঠোঁট খুলে হাসার চেষ্টা করল। ভিজে চোখ তখনও টলটল করছে, ঠোঁটে হাসি হেসে–সেই অবস্থাতেই বড়দির ছবি অবিনশ্বর হয়ে রইল।
ভিড়ের মধ্যে খুব গরম লাগছিল বলে আমরা আবার বাইরে চলে এলাম। বিষ্ণু আমাকে জিজ্ঞেস করল, হা রে বাদল, সূর্যদা কই রে? সূর্যদাকে তো এক বারও দেখিনি।
আমি চুপ করে রইলাম। আজ সারা দিনে এ-বাড়িতে কেউ সূর্যদার কথা এক বারও উচ্চারণ করেনি। তাই থেকেই আমি বুঝেছি, সূর্যদার কথা বলা আজ নিষেধ। সূর্যদা তো হিংসুটে, বড়দির বিয়েতে সবাই আনন্দ করুক এটা চায়নি–তাই সূর্যদাকে কেউ আসতে বলেনি।
কিন্তু আমার প্রাণের বন্ধু বিষ্ণুকে একথাটা না বললে চলে কী করে! অথচ অংশু রয়েছে যে! আমি অংশুকে বললাম, তুই একটু যা তো, বিষ্ণুর সঙ্গে আমার প্রাইভেট কথা আছে।
অংশু বলল, আমাকে বলবি না?
না, শুধু বিষ্ণুর সঙ্গে—
অংশু রেগে গিয়ে বলল, তা হলে আমি মাকে বলে দেব, তোমরা প্রাইভেট কথা বলো।
ঠিক আছে, তা হলে বলব না!
একটু বাদে আমি আর বিষ্ণু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চট করে অংশুকে কাটিয়ে দিয়ে নীচে এসে সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে রইলাম। উঁকি মেরে দেখলাম, অংশু ওপরে উঠে গেল। তখন আমি বললাম, জানিস, সূর্যদা না বড়দিকে বিয়ে করবে বলেছিল।
বিষ্ণু এত জিনিস বোঝে, কিন্তু এই কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অবিশ্বাসের সুরে বলল, যাঃ, তা কখনও হয়?
আমি জোর দিয়ে বললাম, হ্যাঁ রে, আমাকে নিজের মুখে বলেছে। গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে–সেই যে যেদিন ধর্মঘট হল–
এক বাড়িতে আবার বিয়ে হয় নাকি?
এখন তো জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি–দুটো বাড়ি–!
তা হলেও! বর আবার কনেকে কখনও আগে থেকে চেনে নাকি?
সূর্যদা আমাকে বলেছিল কেন?
সূর্যদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো কথাটা। সূর্যদা এখন কোথায়?
কী জানি।
তুই জানিস না?
সূর্যদা তিন-চার দিন আগে বাড়ি থেকে কোথায় যেন চলে গেছে।
বিষ্ণু একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর আপনমনে বলল, সুর্যদার খুব সাহস!
আমি খানিকটা অভিমানের সঙ্গে বললাম, ঘেচু সাহস! এই তো সূর্যদা বলেছিল, আর কেউ বড়দিকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে তো হল সূর্যদা কী করল!
বিষ্ণু হঠাৎ অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁরে বাদল, বিয়ে মানে কী রে?
এর উত্তর আমিও ঠিক জানি না। তবু বললাম, বিয়ে হয়, এই রকম নিয়ম আছে।
কেন হয়? বিয়ে হলে কী হয়?
বিয়ে হলে ছেলেমেয়ে হয়। বড়দির এবার ছেলেমেয়ে হবে।
বিয়ে না হলে কেন হয় না?
আমিও জানি না ভাই। দীপ্তির শিগগিরই বিয়ে হবে–তখন ওকে জিজ্ঞেস করবি?
দীপ্তিটা ভীষণ হিংসুটে। ও বলবে না।
এই সময় একসঙ্গে অনেক উলু ও শাঁখের আওয়াজ শোনা গেল। বিয়ে বোধহয় শেষ হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেলাম। তখন বড়দিকে পিড়ির ওপর বসিয়ে জামাইবাবুর চারদিকে ঘোরানো হচ্ছে।
আমরা ভেবেছিলাম বিয়ে দেখাটা দারুণ কিছু ব্যাপার। কিন্তু একটু পরেই একঘেয়ে লাগল। খালি মন্ত্র পড়া আর মন্ত্র পড়া। বিষ্ণুদেরও বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল।
রেণু কোথায় সে কথা সবাই ভুলে গেছে। আমার মনে পড়ল। সাধুকাকার ঘরে গিয়ে দেখি রেণু দেওয়ালের ধার ঘেঁষে ঘুমোচ্ছে। আমি গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলে। বড় বড় চোখ মেলে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে হয়ে গেছে?
আমি বললাম, প্রায় শেষ হয়ে গেল। তুই তো কিছুই দেখলি না।
রেণু তখন একছুটে চলে গেল বিয়ের আসরে। আর সে সেখান থেকে নড়বে না। ওর ঘুম একদম ছুটে গেছে। অংশু জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেল রেণুকে।
বিষ্ণুদের ঘোড়ারগাড়ি চলে যাবার পর আমি দেখলাম, বাড়ির সামনের রাস্তায় এঁটো কাটার পাহাড় জমেছে কয়েক জন কাঙালি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার ওপর একদল কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে তাদের পাশে। আলো ঝলমল বিয়েবাড়ির পাশে সব সময়েই এক দৃশ্য থাকে–তবু সে-দিন মধ্যরাত্রে ওই দৃশ্য যেন আমি প্রথম দেখলাম মনে হল।
পরদিন আমার ঘুম ভেঙেছিল খুব ভোরে। সারা বাড়ি তখন ঘুমন্ত। খুব হিসি পাওয়ার জন্যই ঘুম ভেঙে যায়–আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। কিংবা হয়তো ঘুমের মধ্যেই আমি শুনেছিলাম লোহার গেটে ঝনঝন শব্দ। কিছু একটা কোলাহল।
তিনতলার বারান্দা থেকে দেখলাম, বাগান পেরিয়ে লোহার গেটের ও-পাশে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যদা। গেট তালাবন্ধ। গেটের এ-পাশে দরওয়ান আর জ্যাঠামশাই। সূর্যদার চুল উসকোখুসকো। কী কথা হয়েছিল আমি কিছুই শুনতে পাইনি। দৃশ্যটা শুধু দেখেছি। সেই অবস্থায় নীচে নেমে যাবারও সাহস পাইনি–তা হলে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে দারুণ বকুনি খেতাম। সূর্যদা নিশ্চয়ই চাচামেচি করেনি, তা হলে তিনতলা থেকেও শোনা যেত–বোধহয় সূর্যদা অনুনয়বিনয় করেই কিছু বলছিল–জ্যাঠামশাই বরং রাগারাগি করছিলেন–তারপর দরোয়ান দৌড়ে গিয়ে বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে এল। বড়বাবু রাত্রে নিজের বাড়ি ফেরেননি। সূর্যদা এসে যাতে না কোনও গণ্ডগোল করে, সেই জন্যই বড়বাবু থেকে গিয়েছিলেন সম্ভবত। বড়বাবুও কী সব বলতে লাগলেন, আমি রেলিংয়ে থুতনি ঠেকিয়ে সেদিকে চেয়ে রইলাম।
গেটের তালা খোলা হল না। সূর্যদা একসময় মুখ ফিরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। সেই ভোরবেলা সূর্যদাকে দেখে আমার ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল। সূর্যদাকে আর কেউ ভালোবাসে না। আমি ভালোবাসি। আমি যদি নিজের প্রাণ দিয়েও সূর্যদার জন্য তখন কিছু করতে পারতাম–তাতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু কী করব? সূর্যদা বোধহয় একবার বড়দির সঙ্গে শুধু দেখা করতে চেয়েছিল। বাসরঘরে বড়দি, আরও অনেকে ঘুমিয়ে রয়েছে। চুপি চুপি বড়দিকে ডেকে আনব? কিন্তু বুঝলাম, তাতেও কোনও লাভ নেই বড়দি সূর্যদাকে চলে যেতে বলেছিল। সূর্যদাকে কেউ নেমন্তন্ন খেতেও দিল না। একবার ইচ্ছে হল, সূর্যদার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকি। তা-ও ডাকা হল না। সূর্যদা সেই যে দারুণ অপমানিত হয়ে চলে গেল এবাড়ি থেকে তারপর আর বেশ কয়েক বছর আমি সূর্যদাকে দেখিনি।