আগামীকাল বকুলের গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ জাতীয় অনুষ্ঠানের আগের দিনটি যেমন জমজমাট হওয়া উচিত তেমন লাগছে না। বকুলের মনে হল সবাই কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়েছে। মুনা। আপা যথারীতি অফিসে চলে গিয়েছে। আজ অফিসে না গেলে কি হত? বাবুও রান্নাঘরে ভাত নিয়ে বসেছে। সেও বোধ হয়। স্কুলে যাবে। কি আশ্চর্য এত বড় উৎসবের ঠিক আগের দিনটিতে সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যেন গায়ে হলুদ খুব সাধারণ ব্যাপার। এ বাড়িতে রোজই এ রকম একটা উৎসব হচ্ছে। বকুল বেশ মন খারাপ করে রান্নাঘরে গেল। ইতস্তত করে বলল স্কুলে যাচ্ছিস, বাবু?
হুঁ।
তোরা সবাই যদি যে যার ধান্ধায় বেরিয়ে যাস তাহলে কাজগুলি কে করবে?
ঘরের কি কাজ?
বকুলের কান্না পেয়ে গেল। কাল তার গায়ে হলুদ আর আজ বাবু বলছে ঘরের কি কাজ? কত কিছু করে লোকজন। ঘর সাজায়। কলাগাছ পুঁতে। কি কি রান্না হবে তার লিস্ট করে। তার বেলায় কিছুই হচ্ছে না। প্রথম দিকে বাবা খানিক উৎসাহ দেখিয়েছেন। বকুলের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু একটি কথাও বললেন না। এর মানে কি এই যে বকুলের বিয়েটা কেউ পছন্দ করছে না?
বাবু হাত ধুতে ধুতে বলল, কি কাজ বললে না? বকুল মুখ কালো করে বলল, কোন কাজ নেই। কাজ আবার কি?
কিছু আনতে হলে বল।
আনতে হবে না কিছু।
বকুল তার ঘরে চলে গেল। সে আজ সারাদিন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়বে। তিনটা গল্পের বই হাতে আছে। একটা বইয়ে নাম এক বৃন্তে দু’টি ফুল। খুব নাকি ভাল বই। টিনা ভাবীর মতে, . অসাধারণ বই। টিনা ভাবীর কথার তেমন গুরুত্ব অবশ্যি নেই। সে অতি অখাদ্য বইকেও মাঝে মাঝে বলে অসাধারণ।
দশ পাতা পড়বার পর বকুলের মনে হল সে কি পড়ছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মন বসছে না।
বাড়িতে কোন লোকজন নেই। যে কাজের মেয়েটি ছিল সে পরশু দিন মুনা আপার দু’টি শাড়ি চুরি করে পালিয়েছে। কেমন নির্জন চারদিক। বকুলের গা ছমছম করতে লাগল। তার শ্বশুর বাড়ি নিশ্চয়ই এমন নির্জন হবে না। চারপাশে লোকজন থাকবে। সেটা হবে একটা হৈচৈয়ের বাড়ি। আনন্দের বাড়ি। অদেখা সুখ ও আনন্দের কথা ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ ভিজে উঠতে লাগল। দরজার কড়া নড়ছে। বকুলের উঠে গিয়ে দরজা খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোন ভিখিরি নিশ্চয়ই। আজকাল ভিখিরিরা খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজায় কড়া নাড়ে, কলিং বেল টিপে ভিক্ষা চায়।
কড়া নেড়েই যাচ্ছে। এ ভিখিরি নয়। বকুল চোখ মুছে দরজা খুলল। টিনা ভাবী বিরাট একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঘুমুচ্ছিল নাকি? এক ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি। চোখ লাল কেন?
বকুল জবাব দিল না। টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, বাড়িঘরের এই অবস্থা কেন? এটাকে তো বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন তোদের কোনো আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে। যা ময়দার লেই তৈরি কর।
কেন?
কেন কি? ঘর সাজাব। জানি তোরা কেউ কিছু করবি না। কাগজ নিয়ে এসেছি। কাচি আছে ঘরে?
জি আছে।
বের কর। বাবু কোথায়?
স্কুলে।
আজকের দিনটায় স্কুলে না গেলে হত না। কি সব অদ্ভুত ভাইবোন তোর।
নিজের বিয়েব জন্যে রঙিন কাগজের মালা বানাবো খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু উপায় নেই। টিনা ভাবী ছাড়বে না।
মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন রে বকুল?
কিছু ভাল লাগছে না ভাবী।
বিয়ের ঠিক আগে এ রকম হয়। হঠাৎ করে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায়। ভয়টা কেটে যায় বিয়ের রাতেই।
এই বলে টিনা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
বকুল।
কি?
তোকে কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেব, বুঝলি?
কি কায়দা-কানুন?
বলব বলব। এত ব্যস্ত কিসের?
বকুল উঠে দাঁড়াল। টিনা বলল, যাচ্ছিস কোথায়?
চা নিয়ে আসি। তুমি তো আবার মিনিটে মিনিটে চা খাও।
চায়ে চুমুক দিয়ে টিনা প্রথম যে কথাটি বল সেটা হচ্ছে–বিয়ের রাতে তোর বর যখন প্রথম তোর গাযে হাত দেবে তখন ইলেক্ট্রিক শক খাবার মত লাফিয়ে উঠবি না। বুঝলি?
বকুল অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে তার অস্বস্তি লাগে আবার সেই সঙ্গে ভালও লাগে। সে এ রকম কেন? সে কি খারাপ মেয়ে? বকুলের বুক হু-হু করতে লাগল।
মুনা ভেবে রেখেছিল। সে আজ লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত কাজ করবে। তারপর ঘরে ফিরে আসবে। সেটা সম্ভব হল না। সিদ্দিক সাহেব তাকে ডেকে একগাদা কাজ দিয়ে দিলেন এবং শান্ত গলায় বললেন, যে ভাবেই হোক আজ পাঁচটায় শেষ করে দেবেন। পারবেন না?
জি পারব।
গুড। ভেরি গুড। আপনি ছাড়া অন্য কেউ হলে বলত–একদিনে সম্ভব না।
মুনা কিছু বলল না। সিদ্দিক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মেয়েদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে এরা সহজে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। তবে শেষ পর্যন্ত কন্টিনিউ করতে পারে না।
আমি স্যার পাঁচটার মধ্যেই শেষ করে দেব।
গুড। পাঁচটার সময় আমি অফিস থেকে বেকবি। তখন ফাইলগুলি নিয়ে যাব।
যেদিন খুব মন দিয়ে কাজ করবার থাকে সেদিনই যন্ত ঝামেলা দেখা দেয়; যেমন আজ একাউন্টের নতুন মেয়েটি এসে গলা নিচু করে তার এক গাদ সমস্যার কথা বলতে লাগল। সেই সমস্যাও ভয়াবহ সমস্যা। তার স্বামীর ছোট ভাই তাকে একটি প্ৰেমপত্র লিখে বসে আছে। এই ব্যাপারটি সে তার স্বামীকে জানাবে, না জানাবে না। এই হচ্ছে সমস্যা। মেয়েটির সঙ্গে মুনার তেমন কোন আলাপ নেই। আজ হঠাৎ করে এ রকম একটি জটিল সমস্যার কথা তাকে বলতে এল মুনা? মুনা একবার ভাবলী বলবে. পরে তোমার কথা শুনব ভাই। আজ একটু ব্যস্ত আছি। কিন্তু এটা বলা সম্ভর নয়।
মেয়েটি যাবার পরপর এলেন পাল বাবু। তিনি কোন এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর খোঁজ পেয়েছেন। যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ সবই বলতে পারে। পাল বাবুর ইচ্ছা মুনাকে নিয়ে একবার তার কাছে যাওয়া। বহু কষ্টে মুনা পাল বাবুকে বিদেয় করল তখন এসে উপস্থিত হলেন শওকত সাহেব। মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপার কি মামা?
তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
জরুরি কথা বাসায় গিয়ে শুনব। এখন কাজ আছে তুমি যাও।
না এখনই বলতে হবে।
বল তাহলে। এক মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হবে।
এখানে বলা যাবে না। বাইরে আয়।
বাইরে কোথায় যাব?
চল তোদের ক্যান্টিনে যাই। জায়গাটা নিরিবিলি।
ক্যান্টিনে যেতে পারব না। যা বলার এখানেই বল। আমি টেবিল ছেড়ে উঠব না।
শওকত সাহেব বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলেন। মুনা তাকিয়ে রইল। বড় ঝামেলায় পড়া গেল।
মামা বল।
বলছি।
বলছি বলেও তিনি মুখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল।
মুনা।
বল শুনছি।
বকুলের বিয়েটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। ওদের খবর পাঠিয়ে দে বিয়ে হবে না।
কেন?
কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। খারাপ স্বপ্ন! ভোর রাতে স্বপ্নটা দেখলাম।
তুমি স্বপ্ন দেখছ এই জন্যে বিয়ে হবে না?
স্বপ্নটা শুনলে তুই বুঝবি?
কিছু শুনতে হবে না। তুমি বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।
আমার কথাটা পুরোপুরি শোন–স্বপ্নে দেখলাম তোর মামি এসে আমাকে বলছে, জহির ছেলেটা ভাল না। ও আমার মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। তারপর দেখলাম। বকুল শুয়ে আছে আর জহির একটা বটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছে এই সময় ঘুমটা ভেঙে গেল।
মুনা বলল, চা খাবে মামা? শওকত সাহেব কিছু বললেন না।
চা এনে দিচ্ছি। খাও। তারপর বাড়িতে চলে যাও।
আর কিছু বলবি না?
না। খবরের কাগজে। আজকাল প্রায়ই খবর উঠছে যৌতুকের জন্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন এইসব খবর পড়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছি।
শওকত সাহেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, বাড়িতে গিয়ে কোনো খোঁজ নিয়ে দেখ, যে রাতে তুমি স্বপ্ন দেখেছি আগের দিনের পেপারে এ রকম কোন খবর আছে।
কথা সত্যি। এ জাতীয় একটি খবর সত্যি সত্যি আছে। শওকত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
চলে যাচ্ছ মামা?
হুঁ।
চা খাবে না?
না।
বিকেল পাঁচটায় সিদ্দিক সাহেব এসে দাঁড়ালেন টেবিলের সামনে। নিচু গলায় বললেন, কাজটা শেষ করতে পারেননি। তাই না? মুনা বিব্রত স্বরে বলল জি না স্যার।