1 of 2

২৭. ফজরের নামাজ

ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পাবেন নি, এ জাতীয় দুর্ঘটনা ইরতাজউদ্দিনেব দীর্ঘ জীবনে কখনো ঘটে নি। সব মানুষের শরীরের ভেতর একটা ঘড়ি আছে। সেই ঘড়ি নিঃশব্দে টিকটিক করে সময় রাখে। যখন যা মনে করিয়ে দেবার মনে করিয়ে দেয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের ঘড়িতে কোনো গোলমাল হয়েছে। ফজর নামাজের ওয়াক্তে তার ঘুম ভাঙল না। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়েছে। পায়ের কাছে রোদ ঝলমল করছে। লজা ও অনুশোচনার তার সীমা রইল না। কী ভয়ঙ্কর কথা! ফজরের নামাজ ছাড়া তার দিন শুরু হতে যাচ্ছে?

গতরাতে ঘুমোতে যেতে অনেক দেরি হয়েছিল। এই কারণেই কি ভোরে ঘুম ভাঙে নি? এটা কোনো যুক্তি না। মানুষ একটা ভুল করলে ভুলের পক্ষে একের পর এক যুক্তি দাঁড়া করায়। এটা ঠিক না। ভুলকে ভুল হিসেবে স্বীকার করে নেয়াই ভালো। ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে অজু করলেন। নামাজ পড়লেন। নামাজের সময পার হয়ে যাবার পরেও তাকে কাজ পড়তে হলো না। কারণ আমাদের নবি–এ-করিম একবার অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পারেন নি। তার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ফজরের নামাজ কাজা ছাড়াই দুপুর পর্যন্ত পড়া যাবে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ইরতাজউদিনের মনে হলো, কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন আমাদের নবি! তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কর্ম কত না শ্ৰদ্ধা কত না ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

ইরতাজউদ্দিন নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যে সকালে নাশতা খেলেন না। স্কুলের দিকে বাওনা হলেন ঠিক সাড়ে নটায়। স্কুলে পৌঁছতে পনেরো মিনিট লাগে। তারপরেও হাতে থাকে। পনেরো মিনিট। ক্লাস শুরু হয় দশটায়। এখন অবশ্যি কোনো ক্লাস হচ্ছে না। ছাত্ররা আসছে না। স্কুল বন্ধ থাকবে না খোলা থাকবে–এধরনের কোনো সরকারি ঘোষণাও নেই। কিছু শিক্ষক আসেন। কমনরুমে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে যে যার বাড়ি চলে যান।

গল্পগুজবের একমাত্র বিষয়–দেশের কী হচ্ছে? শিক্ষকদের প্রায় সবাইকেই দেখা যায় আনন্দিত ভঙ্গিতে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি যে ভয়াবহ জিনিস–এ ব্যাপারে তারা অতি দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তানি মিলিটারির শৌর্যবীর্যের কথা বলতে এদের

ভালো লাগে।

শুনেছেন না-কি, সব তো একেবারে শোয়ায়ে ফেলেছে। যেদিকে যাচ্ছে একেবারে শ্মশান বানিয়ে যাচ্ছে।

জ্বালাওপোড়াও বলে এত যে লাফালাফি ঝাঁপঝাঁপি, এক ধাক্কায় শেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি কী জিনিস যে জানে সে জানে।

এদের মধ্যে কিছু আছে যাদের এরা অন্ধকারে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখেসাক্ষাৎ আজরাইল। দরকারের সময় ছাড়ে–তখন আর কোনো উপায় থাকে না। এদের এখনো ছাড়ে নাই। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে ছাড়বে। তার আগে ছাড়ার দরকার নাই।

দয়ামায়া বলে এক বস্তু এদের মধ্যে নাই। এরা হলো ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ। তক্তা একবার ধরলে পেরেক মেরে ছেড়ে দিবে।

পেরেক মারতে মারতে আসছে। পেরেক মেরে বাঙালি সিধা করে দেবে। বাঙালি ভেবেছিল সিংহের সাথে সাপলুড়ু খেলবে। সিংহ সাপলুড়ু খেলে না।

মিলিটারিবিষয়ক আলাপ-আলোচনার শেষে ঝালমুড়ি দিয়ে চা খাওয়া হয়। আগে পত্রিকা নিয়ে টানাটানি করা হতো, এখন পত্রিকা আসছে না বলে সেই পর্ব হয় না। অংক স্যার ছগিরউদ্দিন এক দুই দান দাবা খেলেন স্কুলের ইংরেজি স্যার কালিপদ বাবুর সঙ্গে। কালিপদ বাবু তুখোড় খেলোয়াড়–কাজেই প্ৰতিবারই তিনি হারেন এবং হেরে কিছু চিল্লাচিল্লি করেন। এই হলো এখনকার স্কুলের রুটিন। রুটিনের তেমন কোনো হেরফের হয় না। উত্তেজনাহীন জীবনে মিলিটারি। আসছে। এই একমাত্র উত্তেজনা। এই নিয়ে কথা বলতেও তাদের ভালো লাগে। এতেও কিছুটা উত্তেজনা পাওয়া যায়। খারাপ ধরনের উত্তেজনা। তাতেই বা ক্ষতি কী?

মিলিটারি নীলগঞ্জে কবে নাগাদ আসবে?

দেরি নাই। আসলো বলে। ময়মনসিংহ চলে এসেছে। যে-কোনোদিন নীলগঞ্জ চলে আসবে। খবর দিয়ে তো আসবে না। হঠাৎ শুনবেন আজাদহা উপস্থিত। মেশিনগানের ট্যাট ট্যাট গুলি।

ভয়ের কথা, কী বলেন?

ভয়ের কথা তো বটেই। এরা সাক্ষাৎ আজরাইল। মুখের কথার আগেই গুল্লি। হিন্দু হলে ছাড়ান নাই।

হিন্দু মুসলমান বোঝে কীভাবে?

কাপড় খুলে খৎনা দেখে। তারপরে চার কলমা জিজ্ঞেস করে। কলমায় উনিশ বিশ হয়েছে কি গুল্লি।

চার কলমা তো আমি নিজেও জানি না।

মুখস্থ করেন, তাড়াতাড়ি মুখস্থ করেন। মিলিটারি এসে পড়লে আর মুখস্থ করার সময় পাবেন না। ময়মনসিংহের এডিসির যে দশা হয়েছে সেই দশা হবে।

উনার কী হয়েছিল?

চার কলমা জিজ্ঞেস করেছে। কলমা তৈয়ব বলেছে ঠিকঠাক। কলমা শাহাদতে গিয়ে বেড়াছেড়া করল। তখন জিজ্ঞেস করল বেতেরের নামাজের নিয়ত। পারল না–সঙ্গে সঙ্গে গাংগানির পাড়ে নিয়ে দুম দুম দুই গুল্লি।

বেতেরের নামাজের নিয়তও জিজ্ঞেস করে?

সব জিজ্ঞেস করে। পাকিস্তানি মিলিটারি ধর্মের ব্যাপারে খুব শক্ত।

বিপদের কথা।

বিপদ মানে বিপদ, মহাবিপদ।

রোজ কেয়ামত বলতে পারেন। বিপদের আশঙ্কায় কাউকে তেমন চিন্তিত মনে হয় না। নীলগঞ্জ গ্রামের রৌদ্রকরোজুল দিন। ঝকঝকি করছে এপ্রিলের নীলাকাশ। খেতে খামারে কাজ কর্ম হচ্ছে–চিন্তিত হবার কী আছে। শহরে ঝামেলা হচ্ছে। শহরে ঝামেলা হয়েই থাকে। শহরের ঝামেলা গ্রামকে স্পর্শ করে না। রাজা আসে রাজা যায়–এ তো বরাবরের নিয়ম। রাজা বদলের ছোফা শরীরে না লাগলেই হলো। লাগবে। না বলাই বাহুল্য। বড় বড় আন্দোলন শহরে শুরু হয়ে শহরেই শেষ হয়। গ্রাম পর্যন্ত আসে না।

ইরতাজউদ্দিন স্কুলে এসে দেখলেন, স্কুলের শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। জোর গুজব মিলিটারিরা ময়মনসিংহ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। একটা বড় দল গেছে হালুয়াঘাট। যে-কোনো সময় নীলগঞ্জে চলে আসতে পারে। স্কুলে আছেন হেডমাস্টার সাহেব। ছাত্র থাকুক না থাকুক। তিনি দশটা-পাঁচটা স্কুলে হাজির থাকেন। ছগির সাহেব এবং কালিপদ বাবুও আছেন।

ছগির সাহেব দাবা খেলছিলেন, আজ তিনি ভালো খেলেছেন। কালিপদ বাবু সুবিধা করতে পারছে না। তার মন্ত্রী আটকা পড়ে গেছে। মন্ত্রী খোয়ানো ছাড়া কালিপদ বাবুর সামনে কোনো বিকল্প নেই। অংক স্যারের মুখভর্তি হাসি। আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে অংক স্যার আনন্দিত গলায় বললেন, নীলগঞ্জে মিলিটারি চলে আসতেছে শুনেছেন না-কি?

ইরতাজউদ্দিন বললেন, তাই না-কি?

হেড স্যারের কাছে যান। উনার কাছে লেটেস্ট সংবাদ আছে।

মিলিটারি আসছে এরকম খবর পাঠিয়েছে?

আরে না। এরা কি খোঁজ-খবর দিয়ে আসে? হুট করে চলে আসবে। এসেই রাজা আটক করে ফেলবে। সরাসরি গজের আক্রমণ। হা-হা-হা।

হাসতেছেন কেন? মিলিটারি আসা কি কোনো আনন্দের বিষয়?

আমাদের জন্যে সমান। আমরা আমেও নাই ছালাতেও নাই। দেশ শান্ত হলেই খুশি। ছাত্র পড়াব, বেতন পাব। আর কী?

ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরের দিকে রওনা হলেন। ছগির সাহেব দাবার বোর্ডের উপর ঝাঁকে পড়লেন। ইচ্ছা করলেই তিনি মন্ত্রীটা খেতে পারেন। খেতে ইচ্ছা করছে না। আটকা থাকুক, ধীরেসুস্থে খাবেন। খাদ্য তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তিনি গজের চাল দিলেন। তেমন চিন্তা-ভাবনা করে দিলেন না। বিপক্ষের মন্ত্রী আটকা পড়ে আছে, এখন এত চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই।

হেডমাস্টার মনসুর সাহেব মাথা নিচু করে কী যেন লিখছিলেন। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে মাথা তুললেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার কী হয়েছে?

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না। তাঁর ভালো লাগে না। গত তিন রাত ধরে তার ঘুম হচ্ছে না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। স্বামী আশেপাশে থাকলে মহিলা অনেকটা সুস্থ থাকেন। এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এখন তিনি স্বামীকে চিনতে পারছেন না। এক রাতে তিনি স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন– এই তুমি কে? তুমি ঘরে ঢুকলা কেন? খবরদার! খবরদার! মনসুর সাহেব বললেন, আসিয়া আমাকে চিনতে পারছি না? আমি আমি।

খবরদার আমি আমি করব না। খবরদার। হেডমাস্টার সাহেব রাতে আলাদা ঘরে ঘুমান। আসয়াকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। ছাড়া পেলে তিনি একা একা নদীর পাড়ে চলে যান।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, মিলিটারি নাকি আসছে?

মনসুর সাহেব হাতের কলম নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আসবে তো বটেই।

শুধু শুধু গণ্ডগ্ৰামে আসবে কেন?

দেশটাকে নিজের মুঠোয় নিতে হলে আসতেই হবে। কবে আসবে সেটা কথা। শহরগুলোর দখল এরা নিয়ে নিয়েছে–এখন ছড়িয়ে পড়বে। কোনো রেসিসটেন্স পাচ্ছে না, কাজেই ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা দ্রুত ঘটবে।

রেসিসটেন্স হবে?

অবশ্যই হবে। কে জানে, এখনই হয়তো শুরু হয়েছে। সামনের দিন বড়ই ভয়ঙ্কর ইরতাজ সাহেব। কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।

ভাবি সাহেবের শরীর কেমন? ভালো না। তাকে এখানে আনা ঠিক হয় নাই। মনে হয়। বাপ-ভাইয়ের কাছেই সে ভালো ছিল। তাকে এখানে এনে ভুল করেছি।

মানুষের কর্মকাণ্ড কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ সেই বিবেচনা কঠিন বিবেচনা। মানুষ প্রায়ই এই বিবেচনা করতে পারে না। ভুল এবং শুদ্ধ একমাত্র আল্লাহপাকই বলতে পারেন।

মনসুর সাহেব বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার মতো আল্লাহভক্ত মানুষদের একটা সুবিধা আছে–সব দায়দায়িত্ব আল্লাহর উপর ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাস করতে পারেন। বড় কোনো বিপদ যদি আসে, তখনও আপনার মতো মানুষরা সবই আল্লাহর হুকুম বলে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে থাকে।

এইটা কি ভালো না?

না, এটা ভালো না। মানুষকে বিবেক দেয়া হয়েছে। চিন্তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যুক্তিবিদ্যার মতো কঠিন বিদ্যায় জন্মসূত্ৰেই মানুষ পারদশী। সেই মানুষ যদি সবই আল্লাহর হুকুম বলে চুপ করে থাকে, তাহলে কীভাবে হয়?

আল্লাহপাক আমাদের সবুর করতে বলেছেন।

ভালো কথা, সবুর করেন। আপনার ছোট ভাইয়ের কোনো খবর পেয়েছেন? শাহেদ না তার নাম?

জি তার নাম শাহেদ। না, কোনো খবর এখনো পাই নাই।

এটা নিয়েও নিশ্চয়ই আপনার মনে কোনো দুশ্চিন্তা নাই? সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হচ্ছে, তাই না?

ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার মনটা মনে হয় আজ ভালো নাই।

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। মন ভালো আছে–এই কথা প্ৰিয়জনদের জানাতে ইচ্ছা করে। মন ভালো নাই–এই খবর ঢোল পিটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না।

মাওলানা সাহেব!

জি।

কনফুসিয়াসের নাম শুনেছেন?

জি-না।

বিখ্যাত চীনা দার্শনিক। তিনি পাঁচটি সম্পর্কের কথা বলেছেন। পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই পাঁচটা সম্পর্ক কী, জানতে চান?

ইরতাজউদ্দিন উসখুসি করছেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আসরের নামাজের সময় অল্প। পাঁচ সম্পর্কের কথা যদি হেডমাস্টার সাহেব ব্যাখ্যা করে বলা শুরু করেন, নামাজের সময় পার হয়ে যেতে পারে। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী খবর পাঠিয়েছেন। খুব নাকি জরুরি প্রয়োজন। সেখানেও যেতে হবে। তার সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনটা কী তিনি বুঝতে পারছেন না!

মাওলানা সাহেব শুনেন, পাঁচটা সম্পর্ক হচ্ছে শাসকের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। পিতা-পুত্র সম্পর্ক। বড়ভাই-ছোটভাই সম্পর্ক এবং বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক। বুঝতে পেরেছেন?

জি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু হঠাৎ করে সম্পর্কের ব্যাপারটা আমাকে কেন বললেন, সেটা বুঝলাম না।

আপনাকে বললাম। কারণ পাঁচটা সম্পর্কের কোনোটাই আমার সঙ্গে সম্পর্কিত না। পাকিস্তানি শাসকের সঙ্গে প্ৰজা হিসাবে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নাই। আমার কোনো ছেলে নাই যে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হবে। আমার কোনো ভাই নাই, বন্ধুও নাই।

ইরতাজউদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, বন্ধু কি নাই?

হেডমাস্টার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বন্ধু আছে। আপনি আছেন। আপনার কথাটা মনে ছিল না। খুব কাছাকাছি যারা থাকে, তাদের কথা মনে থাকে না।,

নামাজের সময় হয়ে গেছে, উঠি? বলতে বলতে ইরতাজউদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।

জয়নামাজে দাঁড়ানোর পর জাগতিক সব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে দূর করতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই এই কাজটা তিনি পারেন। আজ পারলেন না। কনফুসিয়াস নামের চীনা দার্শনিকের কথা মাথায় ঘুরতে লাগল। সূরা ফাতেহা পড়ার সময়ই তাঁর মনে হলো কনফুসিয়াস ভুল করেছেন। আসল দুটা সম্পর্ক বাদ দিয়ে গেছেন। মাতা-পুত্র সম্পর্ক, মাতা-কন্যা সম্পর্ক। তিনি কি ইচ্ছা করে এই ভুলটা করেছেন? না-কি ভুলটা অজান্তে হয়েছে? মার সঙ্গে কি তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না?

ইরতাজউদিনের নামাজে গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি আবারো শুরু থেকে নামাজ শুরু করলেন। এইবার তার মাথায় ওসি সাহেবের স্ত্রীর কথা চলে এলো। মহিলার নাম তিনি জানেন। নামটা এখন মনে পড়ছে না।

নামাজে দাড়ানোর অর্থ আল্লাহপাকের সামনে দাড়ানো। আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মহিলার নাম মনে করার চেষ্টা আল্লাহপাকের সঙ্গে বেয়াদবি করার চেয়ে বেশি। ইরতাজউদ্দিন প্ৰাণপণ চেষ্টা করছেন নাম মনে না। করার। লাভ হচ্ছে না। মাথার মধ্যে ঘুরছে–কী যেন নাম? কী যেন নাম? ফলের নামে নাম। ফলটাি কী? আঙ্গুর, বেদােনা? নামের মধ্যে কি আছে। কি নাম দিয়ে যে ফল, তার মনে পড়ছে। সেই নাম কেউ রাখবে না–কলা। তাহলে নামটা কী?

এদিকে ছগির সাহেবও খুব হৈচৈ শুরু করেছেন। কালিপদ বাবুর মন্ত্রী খাওয়ার পরেও তিনি হেরে গেছেন। আসলে মন্ত্রী খেতে গিয়েই ভুলটা হয়েছে। মন্ত্রী ছিল টোপ। তিনি বোকার মতো টোপ গিলেছেন। টোপ গিলে ফেসে গেছেন। ছগির সাহেব চেচাচ্ছেন, আপনি যা করেছেন তার নাম ভাওতাবাজি। ভাওতাবাজি খেলা না।

কালিপদ বাবু বললেন, ভাওতাবাজি কী করলাম?

ভাওতাবাজি কী করেছেন, বুঝেন না? হিন্দু জাতটাই ভাওতাবাজির জাত। মিলিটারি যে ধরে ধরে নুনু কেটে মুসলমান বানায়ে দিচ্ছে, ভালো করছে। আপনার যন্ত্রও কাটা দরকার।

এটা কী রকম কথা?

অতি সত্যি কথা। ভাওতাবাজির খেলা আমার সঙ্গে খেলবেন না। বুঝেছেন?

আমার সঙ্গে যদি খেলতে চান স্ট্রেইট খেলবেন।

আমি তো খেলতে চাই না, আপনিই জোর করে খেলতে বসান।

আমি জোর করে খেলতে বসাই?

অবশ্যই।

আপনি যে শুধু ভাওতাবাজ তা-না, আপনি মিথ্যাবাদী নাম্বার ওয়ান।

আমি মিথ্যাবাদী?

শাটআপ।

চিৎকার করছেন কেন?

আবার কথা বলে? শাটআপ মালাউন।

ইরতাজউদ্দিন নামাজ শেষ করে কমনরুমে এসে দেখেন, দুজনের ঝগড়া মিটমাট হয়ে গেছে। তারা আবারো দাবা খেলতে বসেছেন। কনফুসিয়াসের কথা হয়তোবা সত্যি। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভাই এবং বোন পাওয়া যেমন ভাগ্যের ব্যাপার, বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।

 

ওসি সাহেবের স্ত্রী ইরতাজউদ্দিনকে চমকে দিয়ে কদমবুসির জন্যে নিচু হলো। ইরতাজউদ্দিন খুবই বিব্রত হলেন। ঠিক তখনই মেয়েটির নাম তাঁর মনে পড়ল। কমলা।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, মাগো, মাথা নিচু করে সালাম করা ঠিক না। মানুষ একমাত্র আল্লাহপাক ছাড়া আর কারো কাছেই মাথা নিচু করবে না। এটাই আব্দুল্লাহপাকের বিধান।

কমলা নরম গলায় বলল, এইসব বিধান আপনাদের মতো জ্ঞানীদের জন্যে। আমার মতো সাধারণদের জন্যে না। আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নের বিষয়ে কথা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছি।

স্বপ্নের তাফসির করার মতো যোগ্যতা আমার নাই। তারপরেও বলো শুনি কী স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা কখন দেখেছ?

ভোররাত্রে। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পরে পরেই মোরগের বাগ শুনেছি। স্বপ্নে দেখলাম, বড় একটা মাঠ। মাঠ ভর্তি কাশফুল ফুটেছে। আমি মনের আনন্দে ছোটাছুটি করতেছি। এক সময় ছোটাছুটি বন্ধ করে বিশ্রামের জন্যে বসলাম। তখন দেখি, আমার শাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে চোরকাটায়। আমি অবাক হয়ে ভাবতেছি, কাশীবনে চোরকাটা আসল কীভাবে? তারপর চোরকাটা বাছতে বসলাম। একটা চোরকাটা তুলি, সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে এক ফোটা রক্ত পড়ে। দেখতে দেখতে শাড়ি ভর্তি হয়ে গেল রক্তে। এই হলো স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখার পর থেকে খুব অস্থির লাগতেছে।

ইরতাজউদ্দিন বললেন, স্বপ্ন দেখে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। সন্তানসম্ভব। মায়েরা ভয়ের মধ্যে থাকে। সেই ভয় থেকে তারা দুঃস্বপ্ন দেখে।

এইটা ছাড়া আর কিছু নাই?

অনেক সময় আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষকে সাবধান করেন। তবে তিনি সংবাদ পাঠান রূপকের মাধ্যমে। সেই রূপকের অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। আমার এত জ্ঞান নাই। আমি মুর্থ কিসিমের মানুষ।

চাচাজি, আজ রাতে আমার এখানে খাবেন।

মাগো, আজ বাদ থাকুক।

জি-না, আজ আপনি খাবেন। আজ আমার একটা বিশেষ দিন।

বিশেষ দিনটা কী? আজ কি তোমার বিবাহের দিন?

কমলা জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে হাসল। ইয়তাজউদ্দিন বললেন, আমি অবশ্যই তোমার এখানে খানা খেতে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *