পোড়াদহের মেলা থেকে তমিজ বাড়ি ফেরে অনেক রাত করে। অতো রাতে মেলা-ফেরতা মানুষের কলরবে মাঝিপাড়া গমগম করে ওঠে, ঘুমিয়ে-পড়া বৌঝিরা জেগে উঠে পুরুষদের হাত থেকে ঝোলা তুলে নেয়, ছেলেমেয়েরা জিলেপির আর তেলেভাজার গন্ধে ঘুমের মধ্যেই গড়িয়ে পড়ে নতুন কোনো স্বপ্নে। আর তমিজের ঘরে তার সঙ্গে ঢোকে শুধু কালাম মাঝি। তমিজের বাপের ঘরের দরজায় উকি দিয়ে বলে, ও চাচা, ও তমিজের বাপ, কাল জুম্মাঘরত একবার আসো তো বাপু। মণ্ডল তোমার গাওত। হাত দিছে, হামরাই সালিশ করমু। শুনিছো তো, হামার তহসেন হাবিলদার হবি, এই মাসেই প্রমোশন হওয়ার কথা, তাই এবার মেলাত আসবার পারে নাই। তহসেন একটা চিঠি লেখলে আমতলি থ্যাকা দারোগা লিজে অ্যাসা মণ্ডলকে ব্যান্দা লিয়া যাবি। কাল তুমি একবার আসো।
কালাম মাঝি চলে গেলে ঘরটা ঝপ করে নীরব হয়ে যায়। কুলসুম তমিজের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। তমিজের বাপের জ্বরো শরীরটা নিয়ে তামামটা দিন যে কীভাবে কাটলো তা এক আল্লা ছাড়া আর কেউ জানে না। জানার দরকারও নাই। আর তমিজ মেলায় ফুর্তি করে ফিরলো এতো রাতে। আর তার আদরের বাহার কতো! –শালপাতার ঠোঙা করে জিলেপি এনেছে, কদমা এনেছে, বেগুনি পেঁয়াজি, কতরকমের তেলে-ভাজা। খলুইতে বড় মাছের ভাগা, মাছে পচনের গন্ধ। আনুক! কুলসুমের কী?
তবে ছোঁড়ার গায়ের জোর বটে। বাপের অতো বড়ো গতরটা সে একাই তুলে ফেললো মাচার ওপর। কুলসুম আড়চোখে তার হাতের ক্ষমতা দেখে। তাও তো কাল থেকে বাড়ির বাইরে, সারাটা দিন মুখে তার কিছু পড়েছে কি-না কে জানে? এই খালি পেটে মানুষটা সারা দিন কী খাটনিটাই না খেটেছে।
ডোবা থেকে তমিজ কলসি ভরে পানি আনে। মেঝেতে বড়ো একটা মালসা রেখে বাপের মাথায় পানি ঢালে, গজর গজর করে, গাও বলে পুড়্যা যায়, এক বদনা পানিও ঢালা হয় নাই। রাগ করে কুলসুম জবার দেবে কী, তমিজের বাপের বিছানায় পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে তাকে এগিয়ে আসতে হয় তমিজের হাত থেকে বদনা নিতে। বেটাছেলে কি আর এসব কাম কুলাতে পারে গো? অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালার পর। কুলসুম স্বামীর মাথা মুছে ভেতরের উঠানের দিকে পা বাড়ালে তমিজ তার হাতে তুলে দেয় তেলে-ভাজার ঠোঙা। এই মাঝরাতে এসব খেতে বয়ে গেছে কুলসুমের। ঠোঙাগুলো মাচার এক কোণে ফেলে রেখে সে তুলে নেয় মাছের খলুই। উঠানে বসে সে মাছ ঘোয়, মাছ কোটে আর বাপের পাজরার কাছে বসে তমিজ একটার পর একটা জিলেপি খায়।
তমিজের ঘাড়ে চিনচিন করে ব্যথা, ব্যথাটা খুব একটা কষ্ট দেয় না, বরং একটু মিষ্টি মিষ্টিই লাগে। এই ঘাড়ে আজ কাঠের জিনিস বওয়া হলো মেলা। আম কাঠের, কাঁঠাল কাঠের খাট, তক্তপোষ, আলনা, বেঞ্চি, টুল, চেয়ার, পিড়ি—একেকটা ভারি কী। কামলা তো আরো মেলা ছিলো, তমিজের মতো এতো বইতে পারলো না আর কেউ। মেলা পয়সা কামালো সে। এই টাকাটা রেখে দেবে একদম আলাদা করে। আজ মেলায় কামলা খাটার বুদ্ধিটা পাওয়া গেলো;সামনের দুই মাসে ওদিকে বাগবাড়ি নিশানের মেলা, দক্ষিণে এলাঙ্গির মেলা, তারপর ধরো রয়াদহের ফকিরের মেলা। আর করতোয়ার পশ্চিমে চৈত্র পর্যন্ত তো সপ্তাহে সপ্তাহে কোথাওঁ না কোথাও মেলা একটা লেগেই থাকে। কয়েকটা মেলায় গতর খাটাতে পারলে তার রোজগার খায় কোন শালা? ঐ রোজগারের একটা পয়সাও সে সংসারে ঢালবে না। জোড়া গোরু কিনবে দশটিকার হাট থেকে। একেকটা গোরু মোষের সমান, দশরথের হাঁপর থেকে ফলা গড়িয়ে নিয়ে লাঙলের সঙ্গে গোরু জুতে দিলে এক চাষে মাটি উপড়ে আসবে দেড় হাত নিচে থেকে। এক বিঘা জমিতে আমন তো আমন, আউশও সে যা তুলবে, এই তামাম এলাকার কোনো চাষার বেটা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবে নি। নিজেদের ভিটার জমিটা সে খাইখালাসি নেবে শরাফতের কাছ থেকে, সেই জমির মাটি কী! মাখনের মতো মাটি, দুটো চাষ দিলেই ধান বাড়ে দুব্বার মতো। কিছু টাকা জমালেই সে জমিটা পায়। টাকা সে জমাতে পারবে না কেন? তার তো আর চাষাদের মতো আলগা ফুটানি নাই, ফুর্তি করে পয়সা ওড়াবার বান্দা সে নয়। এই যে শালা কেরামত আলি, পুবের চরুয়া চাষা, এখন গান করে করে। খুব নাকি পয়সা কামায়। কিসের কামাই? তার কামাইয়ের বরকত কোথায়? আজই তো কতো টাকা ঢেলে এলো নটির ঘরে। এভাবে ওড়ালে পয়সা কামাই করে লাভ কী?
বটতলার ঘাট থেকে মাছহাটির ভেতর দিয়ে তমিজ ঘাড়ে করে কাঠের আলনা নিয়ে যাচ্ছে কাঠপট্টির দিকে, তো হুরমতুল্লার সঙ্গে দেখা। ক্যা রে, তমিজ, হামার জাময়ে দেখছিলু?
তোমার জামাই? কেটা? ও কেরামত? উঁই তো তামাম দিন মেলার মদ্যেই।
কেরামতেক মাছ কিনবার দেখিছু?
না তো। মাছহাটির দিকে কেরামতকে তমিজ কৈ একবারো তো দেখে নি। অথচ, হুরমতুল্লা জানায়, মেলা দেখতে হুরমতুল্লা তাকে পুরো চারটা টাকা দিয়েছে। তার আশা, জামাই ভালো দেখে যমুনার একটা রুই কি কাৎলাহার বিলের এক কুড়ি পাবদা কিনবে। তা হলে হুরমতুল্লাকে খালি খালি মাছ কিনতে পয়সা নষ্ট করতে হয় না। তা সেদিকে কি আর তার গুণধর জামাইয়ের কোনো খেয়াল আছে? যুধিষ্ঠিরের কাছে তমিজ কয়েকবার শুনলো, কেরামত খালি ঘোরাফেরা করছে সার্কাসের আশেপাশে আর সার্কাসের তাঁবুর পেছনে মেলার মাঠের একেবারে উত্তরে চাটাইয়ের বেড়ার ওধারে। আলনা কাঁধে দাঁড়াতে একটু কষ্ট হলেও তমিজ ইচ্ছা করেই বলে, তোমার জামাই শুনলাম ঐদিকে আছে। দেখো, ঐ বেড়ার দিকে উটকাও। তা সেদিকে আর হুরমতুল্লা যায় কী করে? হুরমতুল্লার অন্ধকার মুখ দেখে তমিজ খুশি হয়ে ফের বলে, ঐ তো তাম্বুর ওটি না হয়–।
হুরমতুল্লা আর দাঁড়ায় না। সে ঘুরছিলো দশরথের সঙ্গে। দশরথ কর্মকারও নিজের জামাইয়ের ওপর একটুও প্রসন্ন নয়। সারা বছর কোনো যোগাযোগ রাখে না, যুধিষ্ঠিরের মা মরার আগে মেয়েকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো, চণ্ডাল জামাই শাশুড়ির মরার খবর না পাওয়া পর্যন্ত বৌটাকে আসতেই দিলো না। আবার দেখো, সন্ন্যাসীর মেলা লাগার তিন দিন আগে এসে হাজির একেবারে গুষ্টিশুদ্ধ। বোন বোনাইকে পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। জামাইকে ধুতি দাও, তার বোনাইকে ধুতি দাও, মেয়েদের শাড়ি দাও। হ্যান দাও ত্যান দাও। দুই সন্ধ্যা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াও, পিঠা বানাও, পায়েস করো। আবার মেলার দিন জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে নগদ সাতটা টাকা। যুধিষ্ঠির দেখে এসেছে, জামাইবাবু তার বসে গেছে জুয়ার আসরে। মাছ কি দৈ কিছুই কেনে নি, কেনার কোনো আশাও নাই।
দশরথ ও হুরমতুল্লা নিজের নিজের জামাইয়ের কীর্তি সবটাই পরস্পরকে না বললেও নিজেদের কপালের দোষ দেয়। দুজনে একসঙ্গে জিলেপির দোকানে ঢোকে এবং একই আক্ষেপে একেকজন অন্তত আধ সের করে জিলেপি খায়।
সার্কাসের তাঁবুর ওপারে বাঁশের নতুন বেড়া চোখে পড়ে আর তমিজের মেজাজটাও খিচড়ে আসে, সে কি অন্তত একবার ঐ জায়গাটা ঘুরে আসতে পারে না? এতো খাটনি যাচ্ছে, একটু ফুর্তি করবে না?
তা সন্ধেবেলা কাঠ বইবার সুযোগ কম, এদিক ওদিক তাকিয়ে তমিজ সেখানে একবার গিয়েছিলো বৈ কি। নতুন বাঁশের দরজা ভেজানো, ঝোঁকের মাথায় তমিজ একটু ঠেলতেই খুলে গেলো। ভেতরে জনাচারেক মানুষ। গলা শোনা যায় কেরামত আলির। সুর করে সে গাইছে,
লাল ভুগাজুগ কুসুমলটি নাকে তাহার তিনটি খুঁটি গাড়া।
সেই পুরুষের সবই বিৰ্থা যে দিলো না তার দুয়ারে পাড়া।।
কেরামত আলি আসর জমিয়ে রেখেছে দেখে তমিজের বুকে ছোটো একটি কাঁটা। বেঁধে : শালা এই মানুষটা যেখানেই যায়, কেবল শোলোক বেঁধে বেঁধেই সবাইকে মাত করে রাখে। তবে তমিজের বুকের কাটাটা ছিলো একটি কাটার কুঁড়ি, ফোঁটার আগেই বিনাশ ঘটে অঙ্কুরেই। হাজার হলেও মানুষটা কেরামত আলি, আবদুল কাদেরের সভায় এর গান শুনে সেদিন তমিজ কেমন চাঙা হয়ে উঠেছিলো। তাকে দেখে কেরামত চিৎকার করে ওঠে, আরে তুমি? আসো আসো। ও কুসুম, কুসুমরানী, কুটুম্ব আসিছে ঘরত। বসবার দাও গো, পান দাও, তামুক সাজো।
মেঝেতে সতরঞ্চির ওপর চাদর পেতে বসা সবারই পরনে ফর্সা ধুতি, গায়ে জড়ানো শাল। একজনের গায়ে কালো কোট, তবে নিচে ধুতি। কেরামতও ধুতি পরে এসেছে, তাকে রীতিমতো ভদ্দরলোকের মতো দেখায়। লাঠিডাঙা কাচারির এক কর্মচারীর পাশে বসে থাকা রোগাপটকা মেয়েটির মস্ত উঁচু বুক দেখে তমিজ থতমত খায়, আবার তাকে তো কেউ বসতেও বলে না। আর বললেই বা সে বসে কী করে? দাঁড়িয়ে থাকতেও তার পা কাঁপে। এখন ভরসা কেরামত আলি। কেরামত আলির চোখ দুটি তার নয়নতারা, রসিক নাগর পাগলপারা কথাগুলি তার সারা গায়ে বিলি কেটে দেয়, তার মাথায় সে পায় কাঁচা শুপারি খাবার আমেজ। কেরামত আলি যখন আছে, সেই যখন এখানকার গায়ক, তখন বোধহয় ফরাসে না হলেও অন্তত মাটিতে বসা যায়, তমিজ এরকম ভাবছে এমন সময় কেরামত গেয়ে ওঠে, সে আমারে ডেকে নিলো, তিতা মিঠা পান খাওয়ালো, পান খাওয়ালো, তিতা মিঠা পান খাওয়ালো। কাছারির কর্মচারী হেসে উঠলে সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে এবং একজন হাসতে হাসতেই বলে, পানও বলে তিতা হয়? কবি হামাগোরে কতো কথাই কবার পারে গো! সবার হাসি ও একজনের তারিফের কথায় সায় দিয়ে তমিজ হাসতে চেষ্টা করে, কিন্তু সাহস পায় না। তবে আরেকটু এগিয়ে দাঁড়ায়। সবার হাসি ও তারিফে কেরামত একটু মাথা নুয়ে হেসে দ্বিগুণ বেগে গান চড়ায়,
নাগর হলো মাঝির বেটা তারে এখন বোঝায় কেটা
কুসুমরানীর আধমণি বুক ধরা তো নয় মাছটি মারা।
বিশসেরি বুক ধরা তো নয় বেড়জালে বাঘাড়টি ধরা।।
লোকজনের প্রবল, হাসিতে তমিজের শরীর থেকে বিলি কাটা গান সম্পূর্ণ ঝরে পড়ে এবং ঐ গানই সমবেত হাসির দমক হয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে বার করে দেয় ঘর থেকে। বাঁশের দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে তমিজ শোনে সবার প্রবল হাসি ছাপিয়ে উঠছে কেরামতের গানের পরের কলিটি, লটির পাওনা ফাঁকি দিলো মাঝির বেটার কেমন ধারা?
তখন থেকে তমিজের মাথাটা গরম এবং শরীরটা ঠাণ্ডা। এক নটিমাগীর সামনে, বেশ্যার সামনে কেরামত আলি তাকে এমন হেনস্থা করলো? তার ইচ্ছা করছিলো, মেলা থেকে সোজা চলে যায় নিজগিরিরডাঙায় এবং ঐ শালা কেরামতের বৌকে ডেকে নিয়ে শুয়ে পড়ে মোষের দিঘির পুবের ঢালে। কিন্তু শরীর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। শরীরের তাড়ায় নয়, মাথার গরমেই অতিষ্ঠ হয়ে তমিজ একবার মেলা থেকে বলতে গেলে রওয়ানা হয়েই গিয়েছিলো, কিন্তু তখন কাঠপট্টির বড়ো বড়ো খদ্দেরের নৌকায় খাট আর আলনা বেঞ্চি তোলা হচ্ছে, ফুর্তি টুর্তি শেষ, এখন তারা বাড়ি রওয়ানা হবে। তমিজকে তাই মেলাতেই থাকতে হলো। তা শেষ পর্যন্ত ছিলো বলেই তিন আনা কম তিন টাকা রোজগার তো হলো।
এতো রোজগারেও জান ভরে সুখ তার হয় না : এক বেশ্যামাগীর সামনে কেরামত তাকে এমন অপমান করলো। কুসুমনটির ধামার মতো বুক তাকে এতোটুকু উত্তাপ দেয় না; তার হাতপা জাড়ে কাঁপে। কেন?—মেলার শেষে নৌকায় একটা মস্ত খাট তুলে দিতে দিতে সে ঐ খাটের খরিদ্দারের চাপা গালি শোনে, শালা বেন্যার বাচ্চা, আজ তুই কার ঘরোত ঢুকিছিলু জানিস? কেরামতকে লিয়া গেছি গান শোনার জন্যে; তাই তুইও যাবু? কুসুম নটির ঘরত যায়া জান লিয়া বারায়া আসবার পারলু, তোর বাপের বরাত। কুসুমনটির ঘরে তমিজ ঠিক ঠাহর করতে পারে নি, এখন বোঝে, ঐ লোকটা হলো জোড়গাছার মফিজ সরকার। নৌকায় ওঠার সময় সরকারের সঙ্গে ছেলে ছিলো বলে লোকটা তমিজকে আর ঘটালো না। নইলে নিজের হাতেই আচ্ছাসে শিক্ষা দিয়ে দিতো।
তমিজের বাপের গায়ের শীত হঠাৎ করে দারুণ বাড়ে এবং তার প্রবল কাঁপুনি জ্বর ও ঘুম ফুড়ে তাকে খোঁচা দেয় এবং তাইতেই কি-না কে জানে ছটফট করতে করতে সে পাশ ফিরে শোয় এবং মুখ দিয়ে আ আ আওয়াজ করতে থাকে। তমিজ তখন হাত দেয়। বাপের কপালে, তার খসখসে দাড়িওয়ালা গালে এবং জানতে চায়, বাজান। তোমার ক্যাংকা ঠেকিচ্ছে গো? ও বাজান!
এরকম করে বাপকে সে কখনো ডেকেছে কি-না তার নিজের অন্তত জানা নাই। তমিজের বাপকে জিগ্যেস করলেও বেটার এরকম হামলে ডাকার কোনো নজির সে মনে করতে পারবে কি-না সন্দেহ। বেটার এমন অপরিচিত ডাকে সে সাড়া দেয় না। অথবা জ্বর চড়তে থাকায় সে ড়ুবে গিয়েছিলো অতল ঘুমের মধ্যে। বাপের কপাল আর দাড়িওয়ালা মুখ থেকে তমিজ নিজের হাত নিয়ে যায় কাঁথার ভেতরে এবং বাপের তপ্ত শরীরে ঐ হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বেশ ওম পায়। বাপের গতরের গা-পোড়ানো তাপ তার একটু আগে পানি-ঘাটা হাত আর মফিজ সরকারের মুখে কলজে-ফুটো-হওয়া বুক থেকে বইতে থাকে সারা শরীর জুড়ে। হয়তো এই তাপেই মুছে যায় কেরামতশুদ্ধ কুসুমনটির ঘর। তমিজ শুয়ে পড়ে বাপের পাশে, তার কথার অনেকটাই তুলে নেয় নিজের শরীরে এবং বাপকে জড়িয়ে ধরে তার জ্বরের আঁচে গা পোহায়।
বাপের তাপের ওমে তমিজ ঘুমিয়েই পড়েছিলো হয়তো। উঠান থেকে ডাকলো কুলসুম, ভাত হছে।
কয়েকবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে কুলসুম গজরাতে গজরাতে ঘরে আসে এবং বাপবেটাকে এমন জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে। থাকে। কাঁথার কাছে মুখ নিয়ে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে কী ঠাহর করার চেষ্টা করে। কিসের গন্ধ সে পায় সে-ই জানে, তমিজের বাপের গায়ের তাপে তার নাক জ্বলছিলো কি-না তাই বা বলবে কে? তবে তার গন্ধ নেওয়ার তীব্র টানে ঘুম থেকে তন্দ্রায় উঠে আসে তমিজ। তন্দ্রার ঘোরেই তমিজ শোনে, কুলসুম আপন মনে গজর গজর করছে, এই মানুষটাক বলে ওংকা করা মারে? এই সাদাসিদা আবোর মানুষটাকও বলে খড়ম দিয়া মারে? বুড়া শকুন, মণ্ডলের হাতপাও খস্যা খস্যা পড়বি, বুড়া শকুন কুঠ হয়া মরবি, তামাম গাওত তার কুঠ হবি। শরাফত মণ্ডলের হাতপা জুড়ে কুষ্ঠ ছড়িয়ে ফেলার জন্যে অনির্দিষ্ট ও অপরিচিত কর্তৃপক্ষের কাছে সে বেশ কয়েকবার আবেদন জানায়। শেষে কুষ্ঠের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ মণ্ডলের শাস্তির জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত না হওয়ায় কোনো অপঘাতে সে তার আশু মরণ দাবি করে, তেরাত্তির যাবি না, তোমরা শোনো, এক রাতও লাগবি না, বুড়া আজই মরবি। তার কিসের জোতজমি, তার কিসের বিল, বুড়ার মাথাত ঠাঠা পড়বি। ঠাঠা পড়বি!
পাতলা তন্দ্রার ঘোর কাটতে থাকে তমিজের। কুলসুমের শাপমণ্যি তার কানে বাজে শোলোকের মতো। কুলসুমের অভিশাপে কেরামতের গানের তেজ, কেরামতের গানের ধার। চেরাগ আলির নাতনি, কিন্তু তার কথা তো চেরাগ আলির শোলোকের মতো নয়। . তা আর হবে কী করে? ফকির চেরাগ আলির গান তো তার নিজের বাঁধা শোলোক নয়। সেগুলো কে কবে বেঁধেছিলো, কোন দেও না দানব, কোন ফকির না সন্ন্যাসী, কোন জিন না ফেরেশতা, সেগুলো নাজেল হলো কোখেকে—সে খবর অন্যে পরে কা বাত, চেরাগ আলি নিজেও তো জানতো না। আর কেরামত গান বাঁধে নিজে। তার তেজ বলো আর রস বলো, হিংসা বলো আর দরদ বলো, হেলা করা বলো আর ইজ্জত করা বলো, সুখ বলো আর কষ্ট বলো,–শোলোকের সবই তো তার নিজের কথা। মণ্ডলের জুলুমের বিত্তান্ত কি কেরামতের কানে যায় না?