পবনের আত্মহত্যা প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধির মতো লখাইয়ের মনে চেপে বসল। ঘোরা ফেরায়, আহারে নিদ্রায় প্রতি মুহূর্তেই চোখের সামনে পবন চোখের জল ভরা মুখে যেন মাথা নেড়ে বলছে, ঠিক ঠিক ঠিক, তবে তাই হোক। আগুরিপাড়ার দিকে সে ভুলেও যায় না। এমন কী যেদিন বনের মৃতদেহ দেখতে সারা সেনপাড়া জগদ্দল ভেঙে পড়েছিল সেদিনও সে যায়নি।
কাঞ্চনকেও লখাইয়ের মতোই দারুণ মানসিক যন্ত্রণায় পেয়ে বসেছে পবনের আত্মহত্যাকে ঘিরে। তার প্রতিমুহূর্তের আতঙ্ক, যে কোনও মুহূর্তে তার জীবনে এক সাংঘাতিক দুর্ঘটনা বয়ে নিয়ে আসবে অপদেবতা। কখনও একটু হাওয়া লাগলে চমকে ওঠে সে। পুকুরে ডোবায় গঙ্গায় নামতে গিয়ে যেন জলে কী দেখেছে এমনি অপলক তীক্ষ্ণ চোখে দেখে। পুত্র হীরালালকে আগলে আগলে রাখে সব সময়। লখাইয়ের থাপ্পড় খেয়ে সে রাত্রে পবনের চলে যাওয়ার কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে একলা থাকতে আর পারে না সে। আর লখাইকে আড়ালে আবডালে পেলেই খালি বলে, তোমার জন্যেই, তোমার জন্যেই, তুমি পাতকী।
তখন লখাই পুব কোণ বরাবর মাঠ ভেঙে সোজা আখড়ায় সারদার কাছে চলে যায়। সারদাও লখাইয়ের পথ চেয়েই বসে থাকে তার সব দুঃখ জ্বালা অশান্তির লাঘব করতে। তাকে আদরে আপ্যায়নে সোহাগে সেবায় ভরে তোলে। কিন্তু লখাইয়ের কোথাও তৃপ্তি নেই, শান্তি নেই। তার আজ গভীর সংশয়, সেও কাউকে তৃপ্ত করতে বা শান্তি দিতে পারেনি। জীবনটা এক নিরর্থক বস্তু মাত্র। যেন তার সমস্ত বেগও স্তব্ধ হয়ে আছে। সমস্ত জীবনটা এখন এসে ঠেকেছে তার মাত্র তিনজনের মধ্যে। হীরালাল কাঞ্চন আর সারদা। তাও সবসময়েই যেন মনে হয়, এ তিনজনও তার কাছে থেকেও দূরে রয়েছে। পুরো নাগাল কিছুতেই পাওয়া যায় না।
তা ছাড়া, কাঞ্চনের জীবনও এক বিচিত্র অবস্থায় এসে ঠেকেছে। তার চরিত্রগত যে বিশেষত্ব তাতে লখাইয়ের মনে সারদার স্থান মুখে মেনে নিলেও বুকের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী অভিমানে পুড়ে যাচ্ছে তার। লখাইয়ের সমস্ত বুকের একপাশ তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। হীরালালকে নিয়ে সে পোড়ানি শান্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু এ পোড়ানির নিরন্তর দহন থামতে চায় না। বিদ্রোহের কথা মনে হয়েছে তার, কিন্তু কার বিরুদ্ধে? তার সারা বুক জুড়ে যে রয়েছে লখাই!
এ অবস্থাতেই পেটে সন্তান নিয়ে সে মারা গেল গঙ্গার ঘাটে নাইতে গিয়ে। আগুরিপাড়ার ঘাটে নেয়ে উঠে হঠাৎ বন চাঁড়ালের ফাঁসঝোলানো সেই তেঁতুলগাছের দিকে নজর পড়তেই কেমন ঠকঠক করে কেঁপে উঠল তার হাত পা। কথা বলতে গিয়ে স্বর ফুটল না গলায়। দুহাতে পেট চেপে ধরে পড়িমড়ি করে বাড়ির দিকে ছুটল সে।
কিন্তু দাওয়ায় আর উঠতে পারল না। উঠতে গিয়ে হঠাৎ ধপাস করে মাটিতে মুখ দিয়ে পড়ল। রক্তের বন্যায় কাপড় উঠল ভিজে।
কালী ড়ুকরে চিল্কার করে উঠে তাকে সাপটে তুলে ধরল। কিন্তু কাঞ্চন কেঁপে কেঁপে উঠল, চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে তাকাল আর বার বার বলতে লাগল, পবন..পবন…
লখাই বাইরে ছিল। মধু তাকে খুঁজে নিয়ে এল যখন, তখন কাঞ্চন বোধ করি তার স্পর্শটুকুর
জন্যই মরতে পারছিল না।–লখাই যেন একটা বাজপড়া মাথা-মুড়নো বৃহৎ বনস্পতির মতো হীরালালকে বুকে নিয়ে কাঞ্চনের চিতা পোড়ানো দেখল।
শ্মশান থেকে যখন সবাই ফিরে চলেছে তখনও লখাইকে চলতে না দেখে কালী ডাকল, ঘরে চলো।
লখাই তাকিয়েছিল মাঝ গঙ্গার দিকে বড় বড় চোখে। বলল, দ্যাখো তো বউঠান, মাঝগঙ্গায় ওটা কে?
কালী অবাক হয়ে একমুহূর্ত গঙ্গার দিকে তাকিয়ে কিছু না দেখে শিউরে উঠে লখাইয়ের হাত টান দিয়ে বলল, কী আবার ছাই! চলল তাড়াতাড়ি।
লখাই তেমনি গঙ্গায় বলল, পবন আর তার বউ যেন কাঞ্চীবউ নে কোথা যাচ্ছে, ওরা হাসছে আমার দিকে দেখে।
কালী এবার জোর করে টেনে নিয়ে গেল লখাইকে।
কিন্তু লখাই পথে যেতে ফিরে আগুরিপাড়ার ঘাটে তেঁতুলতলায় এসে দাঁড়াল। যে ডালটায় পবন ফাঁস লটুকেছিল, সেদিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলে উঠল, যা দিয়েছি তার বাড়া কিছুই নেই, কিন্তু আমার ঘেন্নায় তুই পানঘাতী হবি, তা তো জানতুম না ভাই!…