কুছ খুব নহীঁ
ইতনা সতানা ভী কিসূকা
হ্যয় মীর ফকীর, উসকো নহ্ আজার দিয়া কর।
(এমন করে কাউকে যন্ত্রণা দেওয়াটা কি খুব ভালো কাজ?
মীর এমনিতেও সর্বহারা, তাঁকে আর কষ্ট দিও না।)
নসিবের কী লিখন দেখুন, কলকাতায় গিয়েছিলুম টাকার ঝোলা নিয়ে ফিরব বলে, আর ফিরে এলুম ফকিরের তাঞ্জিমারা ঝুলি নিয়ে। একটা সুফি কিস্সা মনে পড়ে গেল, মান্টোভাই। এইসব কিস্সই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, নইলে কবেই ফৌত হয়ে যেতুম। এক সুফি গুরু একদিন তাঁর শিষ্যদের বললেন, মানুষকে যতই সাহায্য করার চেষ্টা করো না কেন, দেখবে মানুষের ভিতরে এমন কিছু থাকবে, যাতে কিছুতেই সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। শিষ্যরা অনেকাই তাঁর কথা মেনে নেয় নি। এর কিছুদিন পরে তিনি এক শিষ্যকে বললেন, নদীর ওপর যে সেতুটা আছে, তার মাঝখানে এক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা রেখে এসো তো। অন্য শিষ্যকে বললেন, শহর ঘুরে দেখো কোন মানুষটা ঋণে একেবারে জর্জরিত। তাকে সেতুর একদিকে নিয়ে এসে বলল সেতুটা পার হতে। তারপর দেখো কী হয়। গুরুর কথামতো শিষ্যরা কাজ করল। যে লোকটিকে সেতু পার হওয়ার জন্য আনা হয়েছিল, সে সেতুর ওপারে আসতেই গুরু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সেতুর মাঝখানে কী দেখতে পেলে?
-কই, কিছু না।
-কিছু দেখতে পাও নি?
-না।
-তা কী করে হয়? একজন শিষ্য বলল।
-সেতু পেরোনোর সময় হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা চোখ বন্ধ করে যদি যাই, তবে কেমন হয়? দেখাই যাক না, যেতে পারি কি না। তা দেখছি, চোখ বন্ধ করে ঠিক চলে এসেছি।
গুরু তার শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
কলকাতা থেকে ফেরার সময় ওই কিস্সাটাই বার বার মনে পড়ছে। নিজেকে বুঝিয়েছি, গালিব তোমার পথের মাঝে অনেক স্বর্ণমুদ্রা ছড়ানো ছিল, কিন্তু খেয়ালের বশে তুমি চোখ বুজে এলে, তাই কিছুই পেলে না। অনেক পরে ভেবে দেখেছি, আমার জীবনে এছাড়া আর কীই বা হতে পারত? কত ভুলই না করেছি। দুনিয়াদারির হালহকিকৎ মাথায় ঠিকমত ঢুকত না। আমি ভাবতুম একরকম, আর হয়ে যেত উল্টো। কেন বলুন তো, মান্টোভাই? এমনিতে তো আমি এমন কিছু ভোলাভালা মানুষ ছিলুম না, পেনশনের টাকা আদায় করতে কলকাতা অবধি ছুটেছিলুম তো, যাকে খুশি করার দরকার খুশি করতুম, যার পেছনে চিমটি মারলে মজা, তার পেছনে চিমটিও দিতুম, তবু ওই লোকটার মতো আমার অবস্থা দাঁড়াল, খেয়ালের বশে চোখ বুজেই সেতু পার হলুম।
আরে, সেই জন্যেই তো দিল্লি দরবারে জায়গা পেতে এত দেরী হল। তাকেও অবশ্য জায়গা বলে না, কোনও মতে টিকে থাকতে পারলুম। দরবারের রাজনীতি বুঝতুম না, তারপর গোরাদের জমানা শুরু হতে চলেছে, সব মিলেমিশে, বুঝলেন মান্টোভাই, একেবারে ঘোটালা অবস্থা। রাজনীতি বোঝা আমার মতো বুরবাকের কম্মো না। চেষ্টা করলে কি আর বুঝতে পারতুম না? চেষ্টাই তো করিনি। জওকসাব এসব খুব ভালো বুঝতেন। তাই জাঁহাপনা বাহাদুর শাহও তাঁকে চোখে হারাতেন। কিন্তু জওকসাবের কটা শের আপনার মনে আছে? মান্টোভাই, একটা মানুষ দুটো কাজ পারে না। রাজনীতি আর কবিতা-এ হল দুই মহলের। ব্যাপারস্যাপার। এক মহলে জিততে চাইলে, অন্য মহলে তোমাকে হারতেই হবে। রাজনীতির মহলে আমি জিততে পারিনি। জওকসাব আমাকে দেখলে মিটিমিটি হাসতেন। আমি মনে-মনে বলতুম, ঠিক হ্যায় মিঞা, হাসো, বহুৎ খুব, আওর হাসো, কিন্তু দরবারের খিদমতগারি করতে করতে কবিতা তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তুমি বুঝতেও পারছ না। জওকসাব একদিন মজা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মির্জা, আপনার শের সহজে বোঝা যায় না কেন? এত কঠিন করে লেখেন কেন?
আমি হেসে বলেছিলুম, আপনার দিল কঠিন হয়ে যায়নি তো?
-মানে?
আমি উত্তর দিইনি। মোমিনসাবের একটা শের বলেছিলুম :
রোয়া করেঙ্গে আপ ভি পহ্রোঁ
ইসি তরহ্
অটকা কহিঁ যো আপ কা দিল ভি মেরী তরহ্।
(কাঁদবেন আপনিও প্রহরে প্রহরে আমার মতো
হৃদয় যদি বাঁধা পড়ে কোথাও, আমারই মতো।)
মান্টোভাই, দিল্লি দরবারের সঙ্গে যত জড়িয়েছি, ততই বুঝতে পেরেছি, রাজনীতির সঙ্গে কবিতার কখনও দোস্তি হতে পারে না। আমাদের বাদশা বাহাদুর শাহ এত-এত শের লিখতেন, সব কিচর, জঞ্জাল, আর আমি তাঁর চাকর বলে সেইসব শের সংশোধন করে দিতে হত। কিছুদিন পর্যন্ত গোরাদের ওপর আমার ভরসা ছিল, হয়তো ওরা নতুন কিছু করবে, কিন্তু ১৮৫৭-র পর বুঝতে পারলুম, সবই ক্ষমতার খেলা। আর কবিকে এই ক্ষমতার খেলা থেকে দূরে থাকতে হয়, মান্টোভাই, নইলে, আমি বলছি, লিখে রাখুন, কবিতা তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে। সে দরবারে গিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলতে পারে, অনেক বিষয় মতামত দিতে পারে, সব -সব ফালতু; আমরা তো আসলে তার কাছে কবিতাই চেয়েছিলুম। তার বদলে তিনি আমাদের কী দিলেন? বাদশা বাহাদুর শাহের জন্য লেখা প্রশস্তি। এছাড়া আর কীই বা দিতে পারেন জওকসাবদের মতো কবি, যারা কোনও না কোন ক্ষমতার কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন? তাঁদের বাজারদর তো বাঁধা হয়ে গেছে। সত্যি বলছি মান্টোভাই, পারলে ওই জওকের পেছনে আমি লাথি মারতুম; গজলের সঙ্গে এত দূর বেইমানি? একবার রাজনীতির ভেতরে গিয়ে ঢুকলে, বেইমানি আপনার রক্তে কখন ছড়িয়ে যাবে, বুঝতেও পারবেন না। রাজনীতি তো আসলে মুখোশ -বদলের খেলা। বাহাদুর শাহের সময় তো দরবারের কোনও রোশনাই ছিল না, সবই বিকিয়ে গেছে, তবু কত যে ষড়যন্ত্র আর পিছন থেকে এর পিঠে ওর ছুরি মারা দেখেছি।
বাদশা আকবর শাহ, মানে দুনম্বর আকবর শাহ, তখন তন্তে। হ্যাঁ, ১৮৩৪ সালই হবে। প্রথম বার আমি দরবারে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলুম। জাফর, মানে বাহাদুর শাহ তার পরে। বাদশা হবেন। কিন্তু আমি জানতুম, আকবর শাহ তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য এক ছেলে সেলিমকেই দেখতে চান। এ বিষয়ে বাদশা ইংরেজদের সঙ্গে কথাবার্তাও চালাচ্ছিলেন। ভাবলুম, আমাকে সেলিমের দিকেই থাকতে হবে, কেননা জাফর ততদিনে জওককে উস্তাদ হিসেবে বরণ করেছেন। আকবর শাহের জন্য লেখা একটা কসীদায় সেলিমের খুব গুণগান করলুম, রাজা-বাদশাদের কাছে পৌঁছবার সেটাই তরিকা। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। ইংরেজরা সেলিমকে মেনে নিল না; তিন বছর পরে আকবার শাহের মৃত্যু হল, আর বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে বাদশা হয়ে গেলেন জাফর। আমার অবস্থাটা তাহলে বুঝতেই পারছেন। বাহাদুর শাহের কাছে একেবারে নামঞ্জুর হয়ে গেলুম। তাঁকে উদ্দেশ্য করেও অনেক কসীদা লিখেছিলুম, কিন্তু তার মন পেলুম না, দরবারেও যাওয়া হল না। কালে সাহেব আর আক্সানউল্লা খান সাহেবের সুপারিশে অনেক পরে আমাকে দরবারে জায়গা দিলেন ঠিকই, কিন্তু আমি যেন তার গলার কাঁটা হয়েই ছিলুম।
খেয়াল বড় মারত্মক জিনিস; খেয়ালের পাল্লায় যে পড়েছে তার জীবন সতরঞ্চের খোপ ছেড়ে বেরিয়ে যাবেই। আর ওই যে, অন্ধের মতো ভাবতুম, আমার শরীরে মোঘল রক্ত, আমির খসরুর পর আমার মতো ফারসি গজল কে লিখতে পারে, বুঝতেই চাইনি, রুপেয়া না থাকলে রক্তের কোন মূল্য নেই, তোমার গজল লোকে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাবে। দিল্লি কলেজে তো পড়ানোর চাকরি হয়ে যেত আমার। ফারসি পড়ানোর জন্য কলেজের একজন শিক্ষক দরকার ছিল। ভারত সরকারের সচিব থমসন সাহেব এসেছিলেন সাক্ষাঙ্কার নিতে। কবি মোমিন খান, মৌলবি ইমাম বশ আর আমার নাম সুপারিশ করা হয়েছিল ফারসি শিক্ষক-পদের জন্য। থমসন সাহেব আমাকেই প্রথম ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি তো পাল্কিতে চড়ে সাহেবের। বাড়িতে গেলুম; বাড়িতে পৌঁছে সাহেবকে খবর পাঠিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলুম। সাহেব এসে আমাকে না নিয়ে গেলে ভিতরে যাব কেন? তোমার দরজায় যদি একজন মির্জা আসেন, তাঁকে নিজে এসে আপ্যায়ন করে নিয়ে যাওয়াই তো তারিকা। অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পর সাহেব এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মির্জাকে আপ্যায়নের তারিকার কথা সাহেবকে বললুম। সাহেব হেসে বললেন, আপনি যখন গভর্নরের দরবারে আসবেন তখন নিশ্চয়ই আপনাকে আপ্যায়ন করা হবে। কিন্তু এখন তো আপনি চাকরির জন্য এসেছেন মির্জা।
আমি বললুম, একটু বেশী সম্মান পাওয়ার জন্যই তো সরকারি চাকরি করব বলে ভেবেছি। এ তো দেখছি, যেটুকু সম্মান আমার আছে, তাও আর থাকবে না।
-এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই মির্জা।
-তা হলে আপনিও আমাকে মার্জনা করুন। চাকরিটা আমি নিচ্ছি না।
কথাটা বলে সাহেবের দিকে আর ফিরেও তাকাইনি। পাল্কিতে উঠে বসলুম। চাকরিটা পেলে আমার একটু সুরাহা হত, উমরাও বেগমের মুখে হাসি দেখতে পেতুম, কিন্তু খোদা যে আমার জীবনের জন্য অন্য খেলা ছকে রেখেছেন।
কলকাতা থেকে ফেরার পর শাহজাহানাবাদ আমার কাছে জেলখানা হয়ে উঠল। মাথায় চল্লিশ হাজার টাকার ওপরে দেনার বোঝা। কীভাবে শোধ করব জানি না। মান্টোভাই, একা একা ঘরে বসে একটা একটা করে মাথার চুল ছিড়ি। রাস্তায় বেরোলেই পাওনাদাররা চেপে ধরে, কী হল মিঞা, কলকাতায় যাওয়ার আগে কত বড় বড় কথা বলে গেলেন।
আমাকে মিনমিন করে বলতে হয়, আর একটু সময় দিন। কিছু একটা হয়ে যাবেই। আমার কেসটা তো উঁচু আদালতে গেছে।
কিন্তু আমি জানতুম, কিছুতেই কিছু হবে না। উঁচু আদালতে পাঠানো রিপোর্ট তো নিগ্রোর কোঁকড়ানো চুলের মতো, আশিকের রক্তঝরা হৃদয়ের মতো, বধ্যভূমিতে উচ্চারিত হত্যার ঘোষণার মতো।
একদিকে পাওনাদার, অন্যদিকে শামসউদ্দিনের পা চাটা লোকজনেরা। চোখ নাচিয়ে, হেসে আমাকে জিগ্যেস করত, কী মিঞা, কলকাতায় কী হল বলুন? ওরা সবাই জানত। কিন্তু মানুষ তো অন্য মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েই আনন্দ পায়। আমি ওদের কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠলুম। বাইরে আর বেরুতে ইচ্ছে করত না। একা দিবানখানায় বসে একের পর এক চিঠি লিখতুম নাসিখসাবকে, মীর আজম আলি, হাকিরকে। খৎ লিখতে লিখতে যেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতুম। আর তো কেউ কথা বলার ছিল না; মহলে নয়, শাহজাহানাবাদেও নয়; দূরের মানুষের সঙ্গেই সারা জীবন আমার যত কথাবার্তা। তারা কেউ এই মাটি-পৃথিবীতে থাকে, কেউ আকাশে আকাশে উড়ে বেড়ায়। মান্টোভাই, আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম। এই দুনিয়ায় আমার কোন দেশ নেই, আমি এখানে নির্বাসনে এসেছি।
এক দুপুরে হঠাৎই উমরাও বেগম দিবানখানায় এল। আমি তখন মনে মনে একটা নতুন। গজল ভাঁজছি, আর কাপড়ে একটা করে গিঁট দিচ্ছি। কাপড়ে গিঁট দেওয়ার ব্যাপারটা জানেন তো? ওটা আমার অভ্যেস ছিল। একটা গজল কখন, কোথা থেকে ভেসে আসবে, কেই বা। জানে। কাগজ-কলম নিয়ে বসার অভ্যেস আমার ছিল না। এক -একটা শের মনে মনে ভাঁজছি, আর কাপড়ে একটা করে গিঁট দিচ্ছি। একটা গিঁটে বাঁধা রইল একটা শের। তারপর কাউকে একসময় বলতুম লিখে নিতে। কাপড়ের এক -একটা গিঁট খুলতেই এক -একটা শের বেরিয়ে আসত। আমার বেশী কিছু প্রয়োজন ছিল না, মান্টোভাই। কখনও নিজের হাভেলি করার কথা মনেও আসেনি, সঞ্চয় নেই বলে দুঃখ হয়নি, শুধু চেয়েছিলুম, কয়েকটা মানুষ যেন একটু ভাল ভাবে খেয়ে পড়ে থাকতে পারি, রোজ সন্ধেবেলা যেন পছন্দের পানীয়টুকু পাই। একটা কিতাব পর্যন্ত কখনও কিনিনি। ধার করে পড়েছি। আমার বাড়িতে কোন কিতাব ছিল না, মান্টোভাই। কী হবে কিতাব দিয়ে? খোদা তবে দিলকেতাব দিয়েছেন কেন?
কথায় কথায় আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি। হ্যাঁ, তো এক দুপুরে উমরাও বেগম এল আমার কাছে। তখন একটা শের মনের ভেতরে পাক খাচ্ছে :
মওত কা একদিন মুআইন হ্যায়
নিদঁ কিয়োঁ রাত ভর নহীঁ আতী
সত্যিই তখন আমার মনের অবস্থা ওইরকম। সবসময় মনে হয়, একমাত্র মৃত্যুই আমাকে এত অপমান, নিগ্রহ থেকে মুক্তি দিতে পারে। মৃত্যু তো আমি ডাকলেই আসবে না। যখন আসবার সে আসবে। কিন্তু সারা রাত আমার চোখে ঘুম আসে না কেন? মনে হত, নিজের কবরের। সামনেই বসে আছি। গৃহবন্দি হওয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনও রাস্তা ছিল না। বাইরে বেরুলেই পাওনাদাররা ঘিরে ধরে। মাঝে মাঝে বাড়িতেও হানা দেয়। তারপর দুজন পাওনাদার গিয়ে আদালতে নালিশ করল। রায় বেরুল, হয় আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে, না হলে জেলে যেতে হবে। পাঁচ হাজার টাকা আমি কোথায় পাব? তাই বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলুম। শাহজাহানাবাদে রইস আদমিদের জন্য একটা নিয়ম ছিল। কারও নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে, সে রাস্তায় না বেরুলে বাড়িতে এসে গ্রেফতার করা হত না। তাই নিজের ঘরেই কারাবাস মেনে নিতে হল আমাকে। দোস্তরাও কেউ আসে না। মান্টোভাই, একেই বোধহয় বলে কাফেরের জীবন। তবে একশো বছর দোজখে থেকে কাফের যে যন্ত্রণা ভোগ করে আমি তার দ্বিগুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছি। উরফির কবিতা মনে পড়ত বারেবারেই। ভাগ্য আমার পেয়ালায় যে বিষ ঢেলে দিয়েছে, তার তিক্ত বাস আমার হৃদয়কে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে, আশা নিরাশার দোলায় দুলত আমার হৃদয়।
বেগম বলল, আপনি ঘর থেকে একদমই বেরোন না শুনলাম, মির্জাসাব?
আমি হেসে বললুম, আমার খবর তুমি রাখো না কি, বেগম?
-আপনি কি খোঁচা না দিয়ে কথা বলতে পারেন না?
-খোঁচা দেব কেন? তুমি থাকো মসজিদে, সেখানে কাফেরের খবর পৌঁছয় কী করে?
-আমি বোধহয় আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুশমন, তাই না?
-তা কেন? তা কেন? মজাও বোঝ না? বসো বেগম। আমি তাকে সব কথা খুলে বললুম।
-কিন্তু এভাবে আপনি থাকবেন কী করে মির্জাসাব?।
-পারছি তো বেগম।
-না, না। মানুষ এইরকম থাকলে পাগল হয়ে যায়। দোস্তরা কেউ আসে না কেন?
-কে আমার দোস্ত? হ্যাঁ, একজনই আছে -মওত -সে কবে আসবে তা তো জানি না।
-ইয়া আল্লা। মওতের কথা কেন বলেন আপনি?
-এছাড়া আর কী চাইবার আছে আমার জীবনে? উদ্দেশ্যহীন একটা জীবন কেটে যাচ্ছে আমার। কোথাও কোন নকশা দেখতে পাই না। নকশা তো একটা থাকার কথা ছিল। মওলা রুমির মুর্শিদ শামসউদ্দিন তাবরিজির কথা কদিন ধরেই মনে পড়ছে, বেগম। শামসউদ্দিনসাব তখন যুবক। দিনের পর দিন রাতে ঘুমাতে পারেন না, খিদে পায় না তাঁর। বাড়ির লোকেরা বারবার জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে মুহম্মদ -হ্যাঁ তার আসল নাম ছিল মুহম্মদ মালেকদাদ -কেন ঘুমোতে পারো না, কেন কিছু খাও না? শামসউদ্দিন বলেছিলেন, আল্লা আমাকে ধুলো থেকে তৈরি করেছেন। তিনি কেন আমার সঙ্গে কথা বলছেন না? তা হলে আমি কেন খাব, কেন ঘুমোব? আমি তাঁর কাছে জানতে চাই, কেন আমাকে সৃষ্টি করলেন, কবে আমি এসেছি, কোথায় যাব? তিনি যদি আমকে উত্তর দেন, তবেই আমি আবার খেতে পারব, ঘুমোতে পারব। আমার জীবনের নকশাটা যদি দেখতে পেতুম, বেগম।
-তা হলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন কেন, মির্জাসাব?
-ঠাট্টা করি না বেগম। তবে তোমার আমার পথ আলাদা। তোমার আল্লা থাকেন মসজিদে, তার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করো তুমি। মৌলবি-মোল্লারা তোমাকে পথ দেখান। আর আমার খোদা থাকেন দরগায়, সেখানে মওলা রুমি গান করেন, শেমা নাচেন। তোমার পথটা আমার জন্য নয় বেগম; আমি আনন্দ উৎসবের ভেতরে খোদাকে পেতে চাই।
-আমিও তাই চাই মির্জাসাব। কিন্তু আপনি তো আমার সঙ্গে কথাই বলেন না। বলতে-বলতে উমরাও কেঁদে ফেলেছিল। মান্টোভাই, সেই প্রথম আমার মনে হল, কত দীর্ঘ দিন ধরে উমরাও বেগমও জেলখানায় বন্দি হয়ে আছে। আমি যদি তার দিকে একবার হাত বাড়িয়ে দিতে পারতুম! পারিনি। একবার নির্দেশের ভুল হয়ে গেলে আবার বিশুদ্ধ হতে কতদিন লাগে, মান্টোভাই?
উমরাও বেগম মহলসরায় চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি কাপড়ে গিঁট দিলুম :
দিখাউঙ্গা তমাশা দী অগর ফুরসত
জমানে নে
মেরা হর দাগ-এ দিল এক
তুখমা হ্যায় সর্ব -এ
চিরাগাঁ কা।
শোনো, শোনো বেগম, আমি তোমাকে বলছি, যদি সময় পাই তবে আমিও দেখিয়ে দেব, আমার হৃদয়ের ক্ষতগুলো এক একটা অঙ্কুরিত বীজ।
বন্দিত্বের দিনগুলোতে আমার একজন বন্ধু তো সঙ্গেই ছিল আমার গজল। মান্টোভাই, আমি সেই গভীর-গোপন সুরকে জিগ্যেস করলুম, বলো তো, আমার নসিবে কেন সারা জীবনের বন্দিত্ব? সে কী বলল জানেন? আরে তুমি কি কাক যে জাল পেতে তোমাকে ধরা হবে ছেড়ে দেওয়ার জন্য? তুমি বুলবুল বলেই তো খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে, কত অনাগত যুগকে গান শোনাবে তুমি। মানুষ এভাবেই নিজের সামনে কত মরীচিকা যে তৈরি করে রাখে! গালিবের ব্যর্থতার কথা কোনও শব্দে প্রকাশ করা যায় না, মান্টোভাই। অন্ধকারে ডুবে আছে আমার ঘর। আমি নিভে যাওয়া মোমবাতি ছাড়া কিছু নই। লজ্জায় নিজের কালো মুখের দিকে নিজেই তাকাতে পারি না।
এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সময়ের কোন হিসেবই করতে পারতুম না। মনে হত, জন্ম থেকেই যেন এই ঘরে বন্দি হয়ে আছি। শুধু কাল্লুর সঙ্গে মাঝেমধ্যে যা কথাবার্তা। সন্ধেবেলা। কাল্লু শরাব দিতে এসে কাল্লু কিছুক্ষণ আমার সামনে বসে থাকত। আর ওর তো একটাই নেশা, কিস্সা শোনা। কিছু বলত না, শুধু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমি কখন কথা বলব, সে অপেক্ষায়। তারপরেই একটা কিস্সর জন্য আবদার করবে কাল্লু। এমন আজিব আদমি আমি দেখিনি ভাইজানেরা। কিস্সার পর একটা কথা বলবে না। রোজ রোজ কি আর কিস্সা বলতে ভালো লাগে? তবে একেকদিন বলতুম। নইলে কান্নুই বা বাঁচবে কী করে? একটা মজার কিস্সা, ইশকের কিস্সা শুনিয়েছিলাম একদিন কাল্লুকে। শুনুন, আপনাদেরও ভাল লাগবে, ভাইজানেরা; গালিবের কফন-ঢাকা জীবনের কথা কতই বা আর শুনবেন?
এ এক সুন্দরীর গল্প। তার নাম জাহানারা। কেমন তার রূপ? মীরসাব যেমন একটা শের -এ লিখে গেছেন :
উসকে ফরোগ-এ হুসে চুকে হ্যাঁয়
সবনে
শমা-এ হিরম হো য়া দীয়া সোমনাথ কা।।
(তার রূপের ঔজ্জ্বল্যের কাছে সবাই ঋণী
কাবার বাতিই হোক অথবা সোমনাথের প্রদীপ।।)
তিনজন যুবক জাহানারাকে নিকে করার জন্য নবাবের দরবারে এল। কেউ কারও চেয়ে কম নয়; নবাব ঠিকই করতে পারেন না, কার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন। শেষে তিনি মেয়ের হাতেই পছন্দের ভার ছেড়ে দিলেন। মাসের পর মাস চলে যায়। জাহানারা তবু মন ঠিক করতে পারে না। খোদার কী খেয়াল। নিকে আর হল না সুন্দরীর; হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেল আমাদের গল্পের জাহানারা। তিন যুবক তাকে একসঙ্গে মিলে কবরে শুইয়ে দিয়ে এল। প্রথম যুবক রয়ে গেল সেই সমাধিক্ষেত্রেই। সে শুধু ভাবত, নসিবের এ-কোন খেলা তার আশিককে দুনিয়া থেকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে গেল। দ্বিতীয় যুবক ফকির হয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। যাকে সে ভালবেসেছে, তার মৃত্যুর কারণ সে জানতে চায়। আর তৃতীয় যুবকটি রয়ে গেল নবাবের কাছে, তাঁকে সান্তনা দেওয়ার জন্য।
যে ফকির হয়েছিল, সে অনেক জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এল এক নতুন দেশে। শুনতে পেল, সেখানে নাকি একজন মানুষ থাকেন, যিনি আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটাতে পারেন। ফকির যুবক তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। রাতে যখন তারা দুজনে খেতে বসেছে, তখন সেই জ্ঞানী মানুষটার নাতী কেঁদে উঠল। মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে বাচ্চা ছেলেটিকে আগুনে ফেলে দিলেন।
ফকির যুবক চিৎকার করে উঠল, এ কী করলেন আপনি? দুনিয়ায় অনেক পাপ-দুঃখ দেখেছি আমি, কিন্তু এমন অপরাধ কেউ করতে পারে?
মানুষটি হেসে বললেন, এত ভাববেন না। যথার্থ জ্ঞান না থাকলে সাধারণ বিষয়কেও। অন্যরকম মনে হয়। বলেই তিনি একটা মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। আগুনের ভেতর থেকে ছেলেটি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এল।
ফকির -যুবক মন্ত্রটি স্মরণ রেখেছিল। সে বেশ কিছুদিন পর ফিরে এল নিজের দেশে। প্রেমিকার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতেই জাহানারা তার সামনে এসে দাঁড়াল। নবাব তো মেয়েকে পেয়ে দেশ জুড়ে উৎসব শুরু করে দিলেন। তিন যুবক জাহানারাকে নিকে করার জন্য আবার এল। জাহানারা কাকে বেছে নিয়েছিল জানেন? তার আশিককে। কে তার আশিক, বলতে পারেন মান্টোভাই?
হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন? এটুকু না বলতে পারলে, আপনাকে তো লেখক হিসেবে মেনে নেব না।
কী বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, আমি জানতাম আপনি বলতে পারবেন। ফকির-যুবক জাহানারাকে জীবন দিয়েছে, এর নাম মানবিকতা। তৃতীয় যুবক একেবারে সন্তানের মত নবাবকে সান্তনা দিয়েছে। প্রথম যুবকই, হ্যাঁ, একমাত্র সেই আশিক, যে এতদিন ধরে সুন্দরীর সমাধির পাশে বসে থেকেছে। মৃত্যুও তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম, দিল্লির রেসিডেন্ট ফ্রেজারসাহেব খুন হয়ে গেছেন। ইয়া আল্লা!